এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  শিক্ষা

  • সলিলদা : অন্য শিক্ষাকর্মী

    শুভেন্দু দাশগুপ্ত
    আলোচনা | শিক্ষা | ০৯ জুন ২০২১ | ২৪৮৩ বার পঠিত
  • সলিলদা, সলিল বিশ্বাস এর প্রথম পরিচয় শিক্ষক। সলিলদার পেশা কলেজ শিক্ষকতা। সলিলদার নেশা শিক্ষা, শিক্ষা নিয়ে ভাবনা, অন্য শিক্ষা ভাবনা, অন্য শিক্ষা প্রয়োগ।

    তখন সত্তর। রাজনীতিতে 'নকশালবাড়ি আন্দোলন'। যারা নকশালবাড়ি আন্দোলনের রাজনীতিতে, কাজে না হলেও ভাবনায়, তারাই অন্য অন্য বিষয়ের আন্দোলনে। সেই সময়ের আন্দোলন যতটা মনে পড়ছে বলে যাচ্ছি। বন্দীমুক্তি আন্দোলন, গণবিজ্ঞান আন্দোলন, কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন, গণসঙ্গীত, সুস্বাস্থ্য আন্দোলন, পথ নাটক, ছোটো পত্রিকা আন্দোলন, পথ শিক্ষা আন্দোলন, অন্য অর্থনীতি ভাবনা, পরিবেশ আন্দোলন, সাক্ষরতা আন্দোলন, নারী আন্দোলন, তৃতীয় লিঙ্গের আন্দোলন, অন্যমনের মানুষ আন্দোলন, অধিকার আন্দোলন, যৌনকর্মীদের অধিকার আন্দোলন। 'গ্রামে চলো'র ডাক তখন অন্য অনেক পথে চলোর ডাকের জন্ম দিয়েছে।

    সলিলদা সেই ডাকে সাড়া দিয়ে অন্যপথে চলার পথিক। সলিলদার অন্যপথ 'অন্য শিক্ষা'। পথের সাথী আমার জানা দীপাঞ্জনদা, দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী, দেবাশিস, দেবাশিস সরকার, আরও কয়েকজন। খানিকটা সময় আমি।

    সলিলদা খুঁজে পেলেন অন্য শিক্ষার ধারণা পাওলো ফ্রের-এর লেখায়। প্রয়োগে আমরা। আমার প্রয়োগে থাকার গল্প বলে সলিলদা, সলিলদা দের গল্প বলি। দেবাশিস আমি বেছে নিলাম নিউ আলিপুরের পিছনে সাহাপুরে গরীব পরিচারিকাদের বসতি। পরিচারিকাদের পরিবারের বসতি। সলিলদা আমাদের বোঝালেন কী করতে হবে। আমরা সেই মতো অন্য লেখাপড়ার আন্দোলনের কর্মী হয়ে গেলাম। সপ্তাহের কয়েকটা দিন সন্ধাবেলা আমরা পরিচারিকাদের নিয়ে বসতাম। প্রথামাফিক অ আ ক খ বর্ণমালা শেখাইনি।

    পাওলো ফ্রের দর্শনে, সলিলদার, সলিলদাদের পরিচালনায় অন্যভাবে শুরু। একটা উদাহরণ দিই।

    একদিনের বিষয় ছিল 'হাত'। আমরা তিনটে বড়ো বোর্ডে 'হ' 'া' 'ত' লিখে নিলাম। এদের কী বলে বললাম । এদের যোগ করে 'হাত' হয় বললাম। ওরা বললেন। তারপর তিনটে অক্ষর কী করে লিখতে হবে শেখালাম। পেন্সিল, কলম, ধরে ওদের শেখানো যাবে না। আঙুলে, হাতে, কবজিতে একটা জড়তা সেই বয়সে এসে গেছে। কেউ কেউ পারতেন। আমরা কখনো দেশলাই কাঠি দিয়ে, কখনো সুতলি দড়ি দিয়ে অক্ষর বানাতাম। ওরা পারতেন।

    তারপর শুরু হতো পরের অধ্যায়। বলা হতো 'হাত' এই কথাটার মতন আর কী কী কথা ওরা জানেন, বলতেন হাতা, হাতল, হাতুড়ি হাতাহাতি, হাতসাফাই। জানা যেতো ওদের শব্দ/কথা সংগ্রহ। আমরা লিখে রাখতাম।

    এবার শুরু 'হাত' নিয়ে কথা বলা। শব্দের পরে কথা, জানাজানির পরের ধাপ। ওঁরা বলে যেতেন, আমরা লিখে রাখতাম। এমন নয় যে একজনের কথা শেষ হলে আর কয়েকজন। একজনের কথার মাঝে, কথার পিঠে আরেকজন। উৎসাহে, ইচ্ছেয়, স্বতঃস্ফূর্ততায়। দুটো একটা এতদিন বাদে মনে পড়ছে। যেমন একজন : হাত আছে, তাই আমরা কাজ পাই, খাটি, রোজগার করি, পেট চলে। আরেকজন : রোজগার করে কি হবে, টাকা পয়সা তো আর আমাদের হাতে থাকে না। স্বামীরা নিয়ে নেয়। অন্য আরেকজন : আমি তো সবটা বলি না, খানিকটা নিজের কাছে লুকিয়ে রাখি। বাকিদের সায় : হ্যাঁ, এটা তো করাই যায়।

    নারীপুরুষ সম্পর্ক, স্ত্রী স্বামী সম্বন্ধ, এই সম্বন্ধে অর্থনীতির ভূমিকা, স্ত্রীদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ধরন। নিজেদের 'সিলেবাস' নিজেরাই বানিয়ে চলেন। ওঁদের এই চলমান কথায়, সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক বানানোয় আমরা কেউ কথা বলতাম না, লিখে রাখতাম। এমনভাবে যতটা মনে আছে, 'টাকা', 'কয়লা', 'জল' এইসব।

    বেশ চলছিল আমাদের 'অন্য ইস্কুল'। মাঝে মাঝে আমরা বলতাম অভিজ্ঞতা বিনিময়। সলিলদা, দীপাঞ্জনদা, দেবাশিস আরও কেউ। বুড়ো হয়ে গেছি নাম মনে রাখতে পারি না । একদিন পরিচারিকাদের স্বামীরা এসে বলল আমরা যেন আর না যাই। পরিচারিকারা স্কুলে আসছেন বলে বাড়ির কাজের সমস্যা হচ্ছে। আমরা আর যাইনি।

    অনেক পরে একদিন গিয়েছিলাম। ওঁরা যা যা বলেছিলেন, আমরা যতটা লিখে রেখেছিলাম, তা দিয়ে হাতে লেখা একটা বই বানিয়ে 'আমাদের বই' ওঁদের হাতে দিয়ে এসেছিলাম। ওঁরা অবাক। আমরা বলেছিলাম আপনাদেরই কথা দিয়ে আপনাদের বই। কী খুশি ওঁরা। আমাদের মন খারাপ। হয়তো ওঁদেরও।

    আমি এরপর আর সলিলদাদের প্রকল্পে থাকিনি। তবে সলিলদাদের ছেড়েও যাইনি মনন জগতে। সলিলদারা যা শিখিয়েছিলেন সেই অন্য শিক্ষাভাবনা নিয়ে অন্য অন্য জায়গায় গিয়েছি অন্য পাঠশালা বানাতে।

    সলিলদারই মতো অন্য রাজনীতির পথে হাঁটা অন্য শিক্ষক অশোকদা, অশোকবাবুর সঙ্গে, মুর্শিদাবাদ জেলায় বহরমপুরের কাছে হরিহর পাড়া গ্রামে। বানানো হল 'গাছতলা ইস্কুল'। যারা লেখাপড়া করবে তাদের বানানো বই দিয়েই লেখাপড়া। সলিলদার ধরিয়ে দেওয়া পথ।

    আর একবার অন্যরাজনীতির পথে হাঁটা আমার বন্ধু কুণাল, কুণাল দেবের অন্য কাজের জায়গায়। কুনাল অন্য কাজ করতো বীরভূমে মল্লাারপুরে গ্রাম গড়িয়ায় পথের খাদানে কাজ করে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে। কুনাল তাদের ছোটোদের নিয়ে পাঠশালা বানিয়েছিল। 'মচেরা'। সেখানে পড়ানোর বিষয় তারা যা চারপাশে দেখে তাই নিয়ে।

    সলিলদা জীবনভর অন্যশিক্ষা নিয়ে ভেবে গেছেন। লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। এমন মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি যিনি যে বিষয়টা নিয়ে অন্যপথে হাঁটা শুরু করেছিলেন সেই পথটা ছেড়ে যাননি। সেই পথে হাঁটাকে জোরদার করতে সেই পথ নিয়ে বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

    সলিলদার সঙ্গে শেষ দেখা একটা আলোচনা সভায়। সলিলদাই ডেকেছিলেন বলতে। অন্য শিক্ষাভাবনা নিয়ে সলিলদার বই ধরে আলোচনায়। সেই যে সত্তর দশকে অন্য পথে হাঁটা শুরু, অনেকের অনেক বিষয়ে হাঁটা শুরু, তা এখন কমে গিয়েছে। এখন কমে গেলেও আমার বিশ্বাস যা এখন থেমে যাওয়া তা আবার শুরু হবে, কমে যাওয়া আবার জোরদার হবে।

    'সত্তর দশক' নিছক একটা দশক কাল নয়। একটা দর্শন, একটা ভাবনা, একটা রাজনীতি, একটা আন্দোলন পথ।

    নতুন করে আসা 'সত্তর দশক' এ অন্য লেখাপড়া বানানোয় সলিলদাকে দরকার পড়বেই।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৯ জুন ২০২১ | ২৪৮৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Somenath Guha | ০৯ জুন ২০২১ ১৮:৩৯494777
  • নমস্য মানুষ। ওনাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। শুভেন্দুদা কেও ধন্যবাদ এত প্রাঞ্জল ভাবে ওনার সম্পর্কে পাঠকদের জানানোর জন্য।

  • শর্মিষ্ঠা রায় | 2402:3a80:ab9:1bb9::5623:fe01 | ০৯ জুন ২০২১ ২১:০৫494784
  • বড্ড ভালো লাগলো 

  • Anindita Roy Saha | ১১ জুন ২০২১ ১০:৫২494838
  • এই পরম শ্রদ্ধেয় মানুষটির সম্পর্কে আরো জানতে পারলাম। লেখককে ধন্যবাদ। 


    গুরুর সম্পাদকদের বলি, ওঁর সম্পর্কে লেখাগুলি বড়ো বিচ্ছিন্নভাবে আসছে। একত্র হয়ে একটা সিরিজ হতে পারতো। একই কথা ডা স্মরজিৎ জানা সম্পর্কিত লেখাগুলির ক্ষেত্রেও। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন