ঋত্বিকের গরীবরথ
অনেকের মুখে শুনেছি, রেলগাড়ির কথা শুনলেই সবচেয়ে আগে তাদের মনে পড়ে অপু দুর্গার রেলগাড়ি দেখার কথা। মৃণাল সেনের 'ভুবন সোম' এর এক্কেবারে গোড়ায় নাম দেখানোর সময়ে রেলগাড়ীর গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্লাসিক্যাল গতায়াত নান্দনিকতা ও ধ্রুপদী ধারাকে মিশিয়ে এক সার্থক শিল্পসমুদ্রে অবগাহন- প্রচেষ্টা।
কিন্তু আমার কাছে রেলগাড়ী মানেই ঋত্বিক কুমার ঘটকের 'কোমল গান্ধার'। দুজন সূর্যপুঁজমুখী।
অনসূয়া আর ভৃগু।
তারা।
তাদের প্রজন্ম।
যারা রেললাইনের শেষ নিঃশ্বাসের ওপর চেপে বসা বিভাজিকার ওপরে হাত রেখে এপার থেকে চোখ ভাসিয়ে ওপারে অর্থাৎ 'বিদেশে' নিজের বাড়ি খোঁজে। যে রেললাইন একদিন ছিল যোগচিহ্ন, তা বিয়োগান্তক হয়ে বিষণ্ণ এলিয়ে থাকে সরলরৈখিক, আকাশের সমান্তরাল- যে আকাশের মেঘ - বিহঙ্গ এক পার থেকে অন্যপারে উড়ে যেতে পারে দ্বিধাহীন। ভৃগু'র বাবা মরার সময়ে বলেছিলেন, জীবনটা আরম্ভ করেছিলাম নির্মল ছন্দে,এভাবে শেষ হওয়া কি উচিৎ ছিল?
ভৃগুর বাবার প্রশ্ন 'এপার পদ্মা ওপার পদ্মা মধ্যে জাগনাচরকে' চুমু খেয়ে এক পাক প্রদক্ষিণ করে বাতাসে মিলিয়ে গেল। মানুষ কি ওই জাগনাচরের মতো? চৌত্রিশ দিকে থই থই উবুর ডুবুর জল, তার মধ্যেও নাকানিচোবানি খেতে খেতে নিজের অস্তিত্বটুকু আকুলিবিকুলি জানান দেওয়ার চেষ্টা?
সবথেকে অন্তর মথিত দৃশ্য ছিল, যখন রেলগাড়ী খুনে ডোরাকাটার মতো প্রবল ও তীব্র প্রাখর্য্যে ছুটে ছুটে যেতে থাকে সেই পাথরের বিভাজিকার উদ্দেশ্যে, অতঃপর অন্ধকার। ধাক্কার শব্দ। কিছু ফেটে যেন চৌচির হয়ে গেল...
মজার কথা, রেলগাড়ীটিকে দেখা গেল না একবারও, যেমন দেশভাগের যন্ত্রণা দেখা যায় না, সতত সুখের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ভিখারির মতো না খেতে পেয়ে মরার অভিঘাতটা দেখা যায় না, তবু সেটা ধাক্কা মারে, বুকের ওপর দিয়ে যায়, তবু তা চৌচির করে। কি চৌচির করে- তা খুঁজতে খুঁজতে ব্যথার মায়াপদ্মায় একটা জেলেডিঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে পড়া, যার কোন শেষ নেই শুরু নেই শুধু চরাচরব্যাপ্ত একটা চিনচিনে ব্যথাবুক ছাড়া আর কিছু ঠাওর হয় না...সেই ডিঙ্গিতে যারা বসে থাকে, তারা ভৃগুর মতো রুক্ষ; অনসূয়ার মতো ক্লান্ত।
এক জীবনে স্বদেশকে বিদেশ হয়ে যেতে দেখে তিরিশে তাদের একশো তিরিশ বয়স হয়ে গেল।
আর কতবড় জিনিয়াস হলে দর্শককে হাতের পুতুলের মতো নাড়াচাড়া করা যায়!! তাদের ভূমিকাকে বদলে ফেলা যায়!
পরিচালক দ্রষ্টা। তিনি যা দেখবেন, দর্শককে তাই দেখাবেন। পরিচালকের দেখাটা দর্শক দেখবে। এক্ষেত্রে একটি সার্থক দৃশ্যে দর্শক চরিত্রটির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতেই পারেন। তিনি ভাবতেই পারেন, এ তো আমারই কথা, আমারই ভাব। কিন্তু এক লহমায় কীভাবে একজন দর্শক একটি দৃশ্যের অন্তরে বিঁধে রক্ত মাংস মজ্জা মেদ ধুকপুক হৃদপিণ্ড সমেত টগবগে একটি চরিত্র হয়ে যান, তা এই দৃশ্যটি না দেখলে বোঝা যায় না।
সর্বগ্রাসী ট্রেনটা যখন বিভাজিকাকে উদ্দেশ্য করে দুদ্দাড় করে ছুটে আসছে, তখন মনে হয়, ঐ বিভাজিকার জায়গায় আমিই দাঁড়িয়ে। ঐ ট্রেন আমাকেই আসছে গুঁড়িয়ে দিতে, আমাকেই সে ধাক্কা দিল, আমার বুকের ওপর দিয়ে চলে গেল, তীব্র বিধ্বংসী অভিঘাতে আমিই সংজ্ঞা হারালুম, আমার সেই চোখেমুখে দেখামাখা অন্ধকারটাই স্ক্রিনে ফোটান হল- কালো রঙের একটা ব্ল্যাঙ্ক ভিডিও ক্লিপ..
আমরা যারা দেশভাগের কথা কানে শুনেছি, বইয়ের পাতায় পড়ে পড়ে কাগজের নৌকো গড়ে ভাসিয়ে দিয়েছি অপারের বুকে, ঐ ট্রেনটা তাদেরও বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের মনন আর টুঁটি ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। ঠুঁটো জগন্নাথের মতো ইতিহাসের সাক্ষীগোপাল করে তোলে। আমরাও ইতিহাসের নকসীকাঁথার এফোঁড় ওফোঁড় বুনন হয়ে যাই।
ঋত্বিক ঘটকের প্রয়াণ দিবস ছিল কাল। আমাদের নিদ্রিত সত্তাকে যিনি চৈতন্যের চাবুক মেরে জাগনাচরের মতো নিত্য জাগরুক ও দগ্ধদীপ্ত রাখেন, তাঁর হাতে যেন এমনভাবেই শাশ্বতখুন হতে পারি আর অনসূয়ার শাড়িরঙের গাঢ়কে আরও একটু নিগূঢ় দিতে পারি।
তামিমৌ ত্রমি