এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো  গুরুচন্ডা৯ ছয়

  • সেই মেয়েটা ভেলভেলেটা

    দময়ন্তী
    গপ্পো | ১৭ জানুয়ারি ২০০৬ | ১০১৮ বার পঠিত
  • "খুকী তোমাদের কিচ্ছু বোঝে না মা" --

    ছ সাত বছরের নিনি কে ওর জিজি শিখিয়েছিল বাসে ট্রামে উঠতে গেলে দুই কনুই দুপাশে বাগিয়ে ধরে বেশ গুঁতাতে গুঁতাতে উঠতে হয়। ফলে ফাঁকা ট্রাম বাসেও নিনি তাই করত। ওর তৎকালীন উচ্চতার কারণে এই গুঁতোগুলো কখনওই দাঁড়ান ভদ্রলোক মহিলাদের হাঁটুর খুব একটা ওপরে পৌঁছাত না, শুধু একদিন ছাড়া। সেদিন এক 'কাকু' ওকে ট্রেনে উঠতে সাহায্য করার চেষ্টা করতেই নিনির কনুইয়ের এক গুঁতো ভদ্রলোকের উপচীয়মন ভুঁড়ির নীচের দিকে। ভদ্রলোক একেবারে "আঁক" করে উঠেছেন। বেচারা! ভাবতে পারেন নি ঐটুকু মেয়ে অমন সদ্য শিং গজান ছাগলছানার মত গুঁতিয়ে দেবে। আশেপাশের লোকজন, কেউ মজা পেলেন, কেউ বিরক্ত, আর ওর মা চুড়ান্ত অপ্রস্তুত। জিজি, মানে ওর ছোটপিসী ছিলেন মধ্য চল্লিশের এক মহিলা। তা নিনি এই পদ্ধতির সুফল বুঝতে শুরু করে আট ন বছর বয়স থেকেই। আট বছরে বাবা মারা যাওয়ার পরই মা তো নিনি আর নানা কে নিয়ে চলে গেল কোন্নগরে, আর জিজি থেকে গেল কলকাতায়। মাঝে মাঝেই কলকাতায় আসা লোকাল ট্রেনে চেপে। সবসময় তো লেডিস কম্পার্টমেন্ট অবধি পৌঁছন যায় না। নিনি অবশ্যি লেডিস, জেনারেল নির্বিশেষে ঐভাবেই ডাইনে, বাঁয়ে কনুই চালিয়ে উঠত। আর মাঝেমধ্যেই দেখত প্রবল আগ্রহে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা হাতেরা সিঁটিয়ে সরে যেত। একদিন এরকমই এক সাহায্যকারী, ধবধবে সাদা শার্ট পরা এক ভদ্রলোক ওকে বললেন 'তুমি ভারী ডেঁপো মেয়ে বুঝলে? এই বয়সেই পেকে একেবারে ঝিক্কুস হয়ে গেছ!' নিনি তো প্রবল অবাক। সে কি কথা! ও তো কিচ্ছু বলে নি। বড়দের কথার মধ্যে কথা বললে মা বলেন 'পাকামী কোরো না', কিন্তু এখানে সেসব কিছুই নয়। ওর কিরকম যেন একটা খারাপ লাগতে থাকে। একটু একটু রাগ আর খানিকটা খানিকটা খারাপলাগা। তখনও অপমানবোধের সঠিক ধারণা তৈরী হয় নি কিনা, নিনি তাই সিটে বসে আপনমনে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে। মা দেখতে পেয়ে বলেন 'যে যা খুশী বলুক তুই ঐভাবেই ওঠানামা করিস, তবে ফাঁকা থাকলে অত গুঁতাস না'। তারপরে স্বগোতোক্তি করেন 'তুই বড় তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছিস। ছোড়দি বড় ভালা জিনিষটা শিখাইসিল।' নিনি বোঝে তার মানে বড়দের বোধহয় অমনি গুঁতিয়েই ট্রেনে টেনে উঠতে হয়। ঐ ভদ্রলোক তারমানে ওকে ছোট দেখে আর বড়দের মত ব্যবহার করতে দেখেই ঐ কথাটা বললেন। মা'কে জিগ্যেস করতেই এক ঝামটা, 'অত বক্‌বক্‌ করিস কেন? বোস জানালার ধারে চুপ করে।' আবার স্বগোতোক্তি 'এই তো শুরু'।

    নিনি দৌড়াচ্ছে, নিনি দৌড়াচ্ছে, খুব দৌড়াচ্ছে স্কুলের মাঠে। সামনেই স্পোর্‌ট্‌স। ওর খুব ইচ্ছে রিলে রেসে নাম দেয়, খুব একটা ভাল দৌড়াতে পারে না বলে বাকীরা ওকে রাখতে চাইছে না। তা দিদিমনি বলেছেন ও যদি সবিতা আর রিমার সাথে সমানে সমানে দৌড়াতে পারে তবেই ওকে নাম দিতে দেবেন। ওদের স্কুলের মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়ে চলা পথ আছে। স্কুলের কোন গেট বা বাউন্ডারী ওয়াল না থাকায় লোকে ওখান দিয়ে শর্টকাট মারে। দুটি ছেলে যাচ্ছিল সাইকেল নিয়ে। তাদের গতি বেশ ধীর হয়ে যায়, আহা মেয়েরা দৌড়াচ্ছে, হঠাৎ ধাক্কা লেগে যায় যদি!! নিনি একেবারে সবিতার সাথে সাথে পৌঁছেছে। বেজায় ফুর্তি প্রাণে, এবারে আর দিদিমনি বাদ দেবে না দল থেকে। দৌড়ে দৌড়েই ফিরছে, হাঁপাচ্ছে, কানে এল 'এই যে ব্যাটারী তোমার আসল ব্যটারী জ্বলবে কবে?' পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে নিনি দেখে একটা কালো সিড়িঙ্গে মত ছেলে, দাঁতগুলো একেবারে গাঢ় হলুদ, বের করে হাসছে। কিছু বোঝার আগেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল 'তুমি কে? দাঁত মাজ না কেন?' কপ করে মুখ বন্ধ করে হলুদদন্তী ও তার সঙ্গী সাইকেল নিয়ে ধাঁ। এদিকে আরেক ক্যাচাল--- এবারে দিদিমনিকে কৈফিয়ৎ দাও কেন 'ছেলেদের সাথে কথা' বলছিলে? তাদের তুমি চেনো কিনা? মহা ঝামেলা! সারাদিন কানের মধ্যে মশার ভন্‌ভনের মতই বিন্‌বিন্‌ করতে থাকে "ব্যাটারী .... ব্যাটারী......." নিনির চোখে একজোড়া নার্ভ নেই, তাই ওর চোখের মনিটা কখনও স্থির হয় না, ফলে চোখের ফোকাল লেন্থও কখনও স্থির হয় না, কয়েক মিলিমিটারের তফাৎ হয়। অসুখটার নাম নাকি 'মিস্‌ট্যাগমাস', কিছুতে সারার নয়। ফলে নিনি ফার্স্ট বেঞ্চে না বসলে দেখতে বোর্ড দেখতে পায় না, যদিও ওর চশমা আছে। ও যখন কেজি-টুতে পড়ত তখন থেকেই ক্লাস নাইন টেনের দিদিরা কেউ কেউ ওর চোখের জন্য ওকে "ব্যাটারী" বলে ক্ষেপাত। তখন থেকেই এই শব্দটা শুনলে ওর মনে হয় ওরও যদি শামুকের মত একটা খোলা থাকত আর ও তার মধ্যে হাত পা গুটিয়ে ঢুকে যেতে পারত! আজ কিন্তু নিনি বোঝে, ও আরেকটা শামুককে দেখেছে। প্রথমে একটু একটু , পরে বেশ ফুর্তি হতে থাকে। নিনি দাদুর খুচরো পয়সার বাক্স থেকে একটা ১০ পয়সা নিয়ে বিকেলবেলা খেলতে গিয়ে হজমীগুলি খায় চেটে চেটে। কপ্‌ করে মুখ বন্ধ করে পালানোর দৃশ্যটা ভাবে--- জিভ বের করে হাত চাটে --- চকাস চকাস--- বেশ হয়েছে বেশ হয়েছে।

    ক্লাস নাইনের নিনি জানে বুক ঢেকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়। দিদা বলে, মা বলে, ছবির মা বলে----সবসময় ঢিলা জামা পরতে হয়----স্কুলের নীপবীথি দিদিমনি ইলাকে বলেন 'এমন অসভ্যের মত শাড়ী পর কেন? এখানে কি প্রেম করতে এসেছ যে আঁচল অমন সরু করে প্লিট করেছ?' ইলা অপমানে মুখ নীচু করে থাকে। ইলার এটা তৃতীয় বছর ক্লাস নাইনে। নিনির সাথে ওরা বিশেষ কথা বলে না। 'ভাল মেয়ে' বলে ব্যঙ্গ করে। নিনির প্রাণের বন্ধু মিমির সাথে কিন্তু ইলার বেশ ভাব আছে। নিনি পরে শোনে মিমিকে নাকি ইলা বলেছে 'তোকে তো ভারী মিষ্টি দেখতে, ফীগারও ভীষণ ভাল। নিনি তো ফর্সা, দেখতেও ভাল, তোদের দিকেই তো সব ছেলেরা তাকাবে। রাস্তায় আসি যাই, আমাকে তো দেখতেও ভাল না, গায়ের রঙও কাল, বুকটা অন্তত একটু বোঝা না গেলে ছেলেরা তাকাবে কেন বল?" নিনি আর মিমি এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেও সিদ্ধান্তে আসতে পারে না "ছেলেদের তাকানো" ব্যপারটা ভাল না খারাপ। ওরা জানে, শুনেছে ছেলেরা তাকানো আর ছেলেদের দিকে তাকানো দুটোই খুব খারাপ। কিন্তু তাহলে ইলা অমন বিষণ্ন আর চিন্তিত কেন? ওর দিকে যদি কেউ না তাকায় তাহলে তো সমস্যার অর্ধেকই রইল না। আলোচনা করতে করতেই মিমি বলে 'জানিস মাস্টারপাড়ার একটা ছেলে আমাদের পেছন পেছন এসে একদিন আমাদের বাড়ীটা চিনে গেছে। তারপর থেকে রোজ বিকেলে সামনে দিয়ে বার ৪-৫ তাকাতে তাকাতে যায়"। নিনি তো হাঁ। বলিস কি কাকীমা টের পায় নি? মিমি বলে "না:" তারপরে চুপি চুপি বলে "ছেলেটাকে ভারী মায়াবী দেখতে আর খুব শান্ত" বলতে বলতে মিমি একটু লালচে হয়ে যায়।

    "ওলো তোর সাধের বাঁশি, বনপলাশী, দেখনহাসি, ডেমোক্রেসি যাবে ভেসে" ------

    নিনি গোপালবাবুর কোচিঙে অঙ্ক করতে গেছে। সেখানেই ক্লাস টেনের দেবী আর পম্পা আসে। দুজনে ভীষণ বন্ধু। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকে না, ক্লাসেও বসে পাশাপাশি। কথা হচ্ছে বড় হয়ে কে কি করবে? কৃষ্ণার সাফ কথা, বিয়ে করব ব্যাস। সঙ্গে সঙ্গে পম্পার কৌতুহল 'কাকে করবি রে?' কৃষ্ণা একটু বিরক্ত 'তা কি জানি? যার সাথে হবে'। পম্পার স্পষ্ট উত্তর 'কেন আমি তো দেবীকে করব।' নিনির মনে হয় হঠাৎ সামনে একটা মস্ত আয়না ভেঙ্গে পড়ল। নিনি অবাক হয়ে দেবী আর পম্পার দিকে হাঁ হয়ে তাকায়। এ আবার কি কথা! নিজের অগোচরেই দেবীকে একবার খুঁটিয়ে নজর করে --- সত্যি মেয়েতো? ভাঙ্গা আয়নার কাঁচের টুকরোগুলো কুড়োবার আগেই মাস্টারমশাই এসে পড়েছেন, অঙ্ক শুরু কর। ভাবনারা মাথায় কেবলি হিজিবিজি আঁকে, তাহলে ও-ও ইচ্ছে করলে মিমিকে বিয়ে করতে পারে? মিমি ও তো ওর খুব বন্ধু। মিমি স্কুলে না গেলে ওরও যেতে ইচ্ছে করে না তো। ভাবতে ভাবতে কিরকম শীত শীত করতে থাকে, কি যেন, কিরকম যেন --- না: এরকম হয় না। তাহলে আরো কাউকে কাউকে দেখা যেত না? আচ্ছা গত সপ্তাহে সেই যে দেখল মামাবাড়ীর টিভিতে 'পথে অল দেরী'--- আর সেটা তো বেশ ভালও লেগেছিল, কিন্তু সেইরকম তো ঠি---ক ভাল লাগছে না ভাবতে এটা----না:। বিয়ে ভাবতে গেলে ঐ সিনেমাটার মত, অথবা ওরকম আরো যে সব সিনেমা আছে সেরকমই বেশ লাগে। কিন্তু উত্তমকুমারকে একটু কেমন যেন--- দূর অত চোখে কাজল দেওয়া লোক মোট্টে ভাল লাগে না। তার থেকে বেশ 'সোনার কেল্লা'র ফেলুদার মতন কেউ হলে---দূর পম্পার কথাটা বোঝা গেল না।

    ব্রাসেলসের পোর্তে দ্য নামুর মেট্রো স্টেশনের সামনে ঠিক রাস্তা পেরোতে যাবার মুহূর্তে 'ওয়াক' সিগনাল অফ হয়ে গেল। যা: এখন দাঁড়াও কিছুক্ষণ। এইরে !আবার নিনির সামনে ভেঙ্গে পড়ে একটা আয়না। সামনে দাঁড়ানো দুটো মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে প্রাণপনে চুমু খাচ্ছে। নিনি জীবনে দেখে নি এ দৃশ্য। ভাল করে দেখতে থাকে, নিনি মন দিয়ে লক্ষ্য করে দুজনকে। পাশ থেকে মানস ওর কনুই ধরে হ্যাঁচকা টান মারে, 'চল চল এখানে এসব খুব কমন। অমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস না'। তারপর তো নিনি দেখতেই থাকে, দেখতেই থাকে। যত দেখে তত মনে হয় বছরখানেক আগে দেবীর সাথে দেখা হওয়ার কথাটা। কিরকম একটা ভেঙ্গে পড়া বিষন্ন ভাব ছিল ওর মধ্যে। ওকে পম্পার কথা জিগ্যেস করায় খুব কষ্ট করে হেসে বলেছিল 'শ্বশুরবাড়ীতে। খুব ভাল আছে'। দেশে ফিরে পূজাসংখ্যা 'আনন্দবাজার' পড়তে গিয়ে আবার চমক। তিলোত্তমার 'চাঁদের গায়ে চাঁদ' পড়ে মনে হয় তবে তো দেবীরা নেহাৎ কম নয়।

    "চক্ষুকর্ণ দুটি পাখায় ঢাকা" ------

    নীরাদিদিমনির ছেলে নাকি ভীষণ পড়ায় ভাল। কোলকাতার হিন্দু স্কুলে পড়ে। সে নাকী আবার খুব পন্ডিতও। নিনিকে তো মা কিছুতেই হিন্দী সিনেমা দেখতে দেয় না, নাকি ভীষণ খারাপ। কাল টিভিতে একটা খুব মজার সিনেমা হচ্ছিল "কামচোর"। নিনি দেখেছে সেজমামার কথায় মা আপত্তি করে নি তো, তাই। পরেরদিন মা স্কুল থেকে এসে একটু দ্বিধাগ্রস্ত। সেজমামার সাথে কথা বলবে কি বলবে না করছে। মাত্র ১৫ দিনের জন্য আসা দাদা , তাকে কি বলাটা ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতে বলেই ফেলে
    ' দেখ সেজদা ----- কালকের সিনেমাটা , টিভিতে যেটা ছিল, নাকি বড্ড বাজে। '
    'সেকি রে জুঁই ? কেডা কইল?'
    'এই নীরাদি কইতাসিলেন--- '
    'ক্যারে? কি হইসে?'
    'এই ওঁর ছেলে কইসে যে সিনেমার নাম হয় "কামচোর" হেই সিনেমা দেখনডাই এক------"
    ৩-৪ সেকেন্ড সমস্ত ঘর চুপ। আর তারপরই সেজমামার ঘর ফাটিয়ে হাসি, তার সাথে বাবাকে হাসতে দেখে মনিও হাসতে শুরু করল। মা তো প্রথমে অবাক, তারপরই দুই ভুঁরুর মাঝে ৩ টে ভাঁজ। এই রে মা রেগে যাচ্ছে। সেজমামা তার মধ্যেই বলে উফ তোরা যে কবে একটু একটু হিন্দী বুঝবি! আরে কাম শুনিস নাই? কাজকাম সেই কাম, হিন্দীতে কাজরে কাম কয়।
    কিন্তু নিনি এখনও অথৈ জলে। কাম মানে যে কাজ ও-ও জানে, কিন্তু ........ হঠাৎই ওর জ্ঞানচক্ষু উদয় হয়--- আরে তাই তো এটা তার মানে সংস্কৃত কাম, মানে ঐ পন্ডিত ছেলে যা ভেবেছে। সত্যি তো পন্ডিত বলে কথা! হিন্দীর মধ্যে বাংলা, তার মধ্যে সংস্কৃত খুঁজে বার করবে আর নাক শিঁটকাবে আর মুখ বেঁকাবে , তবে না পণ্ডিত। বড় হয়ে এই ছেলে বাংলার প্রফেসার হয়। নিনির খুব কৌতুহল, এই ছেলে বাংলা সাহিত্যের সেই "কচুয়া ধরত যব হাসিয়া" জাতীয় লাইন পড়তে এবং পড়াতে গিয়ে কি ভাবে, আর কি বলে?

    নিনির মনে আসে নীপবীথি দিদিমনির কথা। ওঁর কিন্তু কোন সিনেমা বা কোথায়ও ব্যবহৃত কোন শব্দ নিয়ে এমন ভয়ংকর আপত্তি ছিল না। অথচ উনিই মেয়েদের সামান্য কারণেও বিদ্রুপ করতে পারলে ভারী খুশী হতেন। বাপ্‌স্‌ উনি যদি জানতেন নিনি আমস্টার্ডামে কিরকম সব মিউজিয়াম দিব্বি ঘুরে ঘুরে দেখেছে -- আর -- এই সমস্ত। আচ্ছা কাউকে প্রেম বা সাজপোষাক বিষয়ে বিদ্রুপ করার সময় ওনঁর মুখটা কিরকম উজ্জ্বল হয়ে যেত কেন? বেশ রেলিশ করে করে বলতেন কিন্তু। আর যে মেয়েটিকে বলতেন সে যত লজ্জা পেত, অপমানিত বোধ করত ততই আরো খুশী খুশী হয়ে উঠতেন। নীরাদিদিমনি কিন্তু এমনিতে বেশ ভাল লোক। মাধ্যমিক পাশ করে সব্বাই প্রনাম করছে দেখে অঙ্কে কম্পার্টমেন্টাল পাওয়া নমিতাও কি ভেবে যেন প্রনাম করে ফেলল। আর অমনি নীরাদিদিমনির স্বত:স্ফুর্ত উচ্ছাস - খুব খুশী হয়েছি ভীষণ খুশী হয়েছি। অথচ ওঁর সামনে রিমা একবার রবীন্দ্রনাথের আম খেতে গিয়ে দাড়িতে আমের রস লেগে যবার মজার গল্প বলে ফেলেছিল --- উরিবাবারে সে কি কুরুক্ষেত্তর কান্ড! আর কি উদ্দাম বকুনি!! বেচারী রিমা ভেবেই পায় নি, রবীন্দ্রনাথ আম খেতেন না, নাকি অত বড় দাড়িতে রস লাগত না?

    "ত্বকের যত্ন নিন" ------

    নিনির ছোটদিকে দিব্বি খাপচু দেখতে। আগে নাকি গায়ের রং একটু মাজামাজা ধরণের ছিল। মানে ওর মামাদের মত অত টুকটুকে ফরসা ছিল না। তা বড়মামী ছোটদিকে প্রত্যেকদিন কাঁচা হলুদ আর মুসুরির ডাল বাটা মাখাত। শীত গ্রীস্ম, জ্বর পেটখারাপ সবেতেই। কলেজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চলেছে এই রুটিন। সপ্তাহে একদিন সরষের খোলবাটা মাখাত। নিনির এটা খুব মজা লাগত লালী-বুলির খাবার জিনিষ ছোটদিকে মাখতে দেখে। তা এক রবিবারে দেখা গেল সমস্ত খোল লালী-বুলির জাবনায় দেওয়া হয়ে গেছে এদিকে দোকান থেকে বিকেলে দিয়ে যাবে। তাহলে সপ্তাহান্তিক খোলচর্চার কি হবে? নিনি তো দোকানে যেতে দুই পায়ে দৌড়। পাড়ার শিবুদার দোকানে গিয়ে বলে "আড়াইশো খোল দাও তো।" শিবুদা জানে ওদের বাড়ী দুটো গরু। আড়াইশোয় কি হবে? বাচ্চা মেয়ে, ভুল তো হতেই পারে। তাই জিগ্যেস করে "আড়াইকিলো তো?" নিনি বলে "না না আড়াইশো।" পোটেনশিয়াল খদ্দের হারাতে না চেয়ে শিবুদা বলে "তুই বরং ১ বার বাড়ী থেকে জেনে আয়।" এবারে নিনির কিন্তু খুব প্রেস্টিজে লেগেছে। ও সবিস্তারে জানায় কেন আড়াইশো গ্রামই দরকার। ব্যাস ঘরে ঘরে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। দুদিন বাদে স্কুল থেকে ফিরে নিনির কি হেনস্থা। কি না সবাই নাকি ছোটদির খোলচর্চার কথা জেনে গেছে। তা গেছে তো গেছে কি হয়েছে? কে জানে কি হয়েছে! কিন্তু নিনি জানতে থাকে "সারাদিন বই মুখে নিয়ে বসে থাকলেই কি আর বুদ্ধি গজায়!। পড়ে তো যত রাজ্যের গপ্পের বই তা এই হবে না তো কি!" জানতে থাকে শ্বশুরবাড়ীতে গেলে ওর খুব মুশকিল হবে, কারন ওর তো আর কোন কান্ডজ্ঞান নেই। আবার শোনে এইসবই হল ওর বদমাইশী, নিজেও ফাটা ফাটা গোড়ালী নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর তাই ছোটদিকে এইভাবে অপদস্থ করেছে। চেঁচামেচি করেও কাউকে বিশ্বাস করাতে পারে না যে ও কোনকিছু ভেবে দোকানদারকে বলে নি। মাকেও না। আরো শোনে নানার বৌকেও নাকি ওর জন্য খুব কষ্ট পেতে হবে।

    নিনি আর চেঁচায় না। চুপ করে যায়, গম্ভীর হতে শেখে। খুব একটা দৌড় ঝাঁপ করে খেলতে পারত না, তবে খেলতে যেত রোজ বিকেলে মাঠে। সবার সাথে হইচই করতে খেলতে বেশ লাগত। তা দিদা হঠাৎ বলে দিল আর কারো বাড়ী গিয়ে খেলতে হবে না। ওরা তখন শুভ্রাদের উঠোনে খেলত। নিনিদের বাড়ী কেউ আসতে চায় না, নিনির মানা হয়ে গেল অন্যদের বাড়ী যাওয়া। ব্যাস খেলাধুলো শেষ। সত্যি তো ছোটদি বেশী লোকের সাথে মিশতে পারে না, কথাও বলতে পারে না, আর নিনি সারাক্ষণ হ্যা হ্যা করে যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে, আর সব কাকীমা জ্যাঠিমারা কেবলই বলে যান এসে এসে "আহা মুন্নি আর নিনি দেখো একেবারে দুইরকম, মুন্নি খুব শান্ত, তবে নিনি আমাদের ভারী মিশুক। নিনিকে কিছু বল, সবসময় হাসিমুখ।" আরো কত কি। তা দিদা হয়ে তাঁর একটা কর্তব্য নেই মুন্নির বদনামের প্রতিকার করার! তাই তিনি করেন। নিনির তো বাবাও নেই, কিছু একটা বদনাম হলে? তাই দেবুদের বাড়ী ঝগড়া হলে "নিনি পড়তে বোসো...."। নিনি গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে "আমার দিন কাটে না, আমার রাত----" দিদার ক্রুদ্ধ মন্তব্য "বা: এখন থেকেই এইসব গান?" গানের আবার এইসব, কিসব কি? ওমা তা বললে কি হয়? এইটুকু মেয়ে এত পাকা পাকা গান কি বাপু! মুন্নিকে নাকি পাড়ার ছেলেরা কিসব বলে। পেছনে পেছনে স্কুলে যায়। তাই মুন্নির সাথে ছবির মা যায় মুন্নিকে স্কুলে পৌঁছে দিতে , নিয়ে আসতে। ছোটদি বড় হয়ে কলেজে চলে যায়। নিনি ফোর থেকে ফাইভ, ফাইভ থেকে সিক্স,সেভেন, এইট,নাইন উঠতে থাকে। স্কুলে শাড়ী, বাড়ীতে ফ্রক। বাইরে কখনও শাড়ী, কখনও ফ্রক। সালোয়ার কামিজ? কক্ষণো না। ওসব অসভ্য পোষাক। কিন্তু আশ্চর্য্য হল শাড়ী পরলেই কানে আসে কিছু না কিছু গানের কলি। সবসময় যে খারাপ লাগে তাও নয়।

    "ইয়োবন যো শুরু হো যাতা হ্যায়
    থোড়ি মস্তি হোতি হ্যায়
    থোড়া গর্বি লাগতা হ্যায়।" -------------

    নাইন, টেন, ইলেভেন, টুয়েলভ------ আকনা স্কুল---সমরদার কোচিঙ---- ট্রেনে বাসে রোজ যাওয়া---- শ্রীদূর্গা মিল থেকে মাস্টারপাড়ার গন্ডীটা হঠাৎ বাড়তে থাকে। কত নতুন বন্ধু। দীপান্বিতা পড়াল "বিশ্বাসঘাতক"। এখন আর মা বলে না ঐ বইটা পড়বে না--ওটা বড়দের বই। মা স্কুলে নীরাদিদিমনির কাছ থেকে নিয়ে এল "ন হন্যতে" আর "মংপুতে রবীন্দ্রনাথ"। ন হন্যতে পড়ে তো দীপান্বিতা, নিনি, জয়তি, মিমি, নন্দিনী এক্কেবারে বিহ্বল। ছন্দা পড়াল "বলাকার মন"। ভাল, তবে ন হন্যতের মত নয়। মা বলে "এবারে তুই পুরো শরৎ রচনাবলী ই পড়তে পারিস"। নিনি লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘাড় নাড়ে। হুঁ: ওর যেন কিছু পড়তে বাকী আছে। সেই যে সব্বাই শুভ্রাদের বাড়ী খেলতে যেত আর ওকে দিদা যেতে দিত না তখন বিকেল গুলো তো ও লুকিয়ে লুকিয়ে ঐসবই পড়ত। এদিকে আজকাল টিভিতেও দেখে অনেক সিনেমা। পাড়ার কাছের চলচ্চিত্রমে এলো "শোলে" দীপান্বিতা নাকি আগে বার দুয়েক দেখেছে ওর দাদার সাথে। আরো একবার দেখার খুব ইচ্ছা। নিনি তো দেখেই নি। চলল দুজনে। ট্রেনে লেডিজ কম্পার্টমেন্টেই যায় ওরা। সিনেমাও লেডিজ সিটেই দেখবে বলে এসেছে। কিন্তু সব সিট ভর্তি। অতএব ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। নিনির চিরকালই ধারের সিটের প্রতি অসম্ভব দুর্ব্বলতা। ও বসল প্যাসেজের ধারে। দীপার পাশে পরপর ৩ টে ছেলে। ওদের থেকে বোধহয় একটু বড়ই হবে। শোলে দেখে নিনি তো একেবারে ফিদা। এদিকে দীপা কিন্তু হল থেকে বেরিয়ে অবধি বেশ চুপচাপ। কেন রে দীপা কি হয়েছে? দীপা বলে কিচ্ছু না। দীপার মাথায় ভীষণ চুল। কোমর ছাড়ানো ইয়া মোটা বিনুনিটাও আজ তেমন করে দুলছে না দীপার হাঁটার সাথে সাথে। চলে গেল দীপা বাড়ী, ওদের বাড়ী তো ওপারে নবগ্রাম কাটাপুকুরের কাছে। নিনিও বাড়ী ফেরে একটু বিমনা হয়েই।

    নিনিরা শ্রীরামপুর বটতলা থেকে স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে আসত ফেরার সময়ে। ক'দিন পরেই দেখা গেল নিনিদের স্কুল থেকে ফেরার সময়ে দীপা একটু পিছিয়ে যায়। আর একটি ছেলে সাইকেল নিয়ে আসে ওদের পাশে পাশে। দীপাকে নাকি বলেছিল ওকে ঠিক বাসন্তির মত লাগছে। দীপাকে ছোটবেলা থেকে সবাই বলত "কালো"। তাই ও প্রথমে ভেবেছিল ব্যঙ্গ। কিন্তু ওকে নাকি একটা চিঠি দিয়েছে ভীষণ সুন্দর। তাই দীপাও বুঝেছে ওটা ব্যঙ্গ নয়। কোনোদিন দীপা দিব্বি খুশী খুশী থাকে, কোনোদিন আবার ওদের ঝগড়া হয়, বেজায় মনখারাপ করে বসে থাকে। ইলেভেনের অ্যানুয়ালে দীপা রীতিমত খারাপ করল আর তারপরেই কেলো। দীপার প্রেমিক নাকি খুব খুশী হয়েছে। ওমা সে কী রে? খুশী মানে? দীপা কেমন বিভ্রান্ত হয়ে জানায় ও-ও বুঝতে পারছে না। ছন্দা আর সীমা খুব রেগে যায় --- পরেরদিন ই ধরে ওরা জেরা শুরু করল। জানা গেল ইনি নাকি হায়ার সেকেন্ডারী প্রচুর চেষ্টা করেও পাশ করতে পারেন নি। যাক কলা!! তো তাতে দীপার খারাপ রেজাল্ট হওয়ায় খুশী কেন? এইবারে হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে ছেলেটি। "তোমরা নিজেদের কি ভাব শুনি? সব সায়েন্স দেখাচ্ছ? অ্যাঁ? করবে তো সেই খুন্তি নাড়ার চাকরী তার আবার অত রেজাল্ট ফেজাল্ট কি? " সীমা, ছন্দা, নন্দিনী তো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। নিনি আর জয়তী দেখে দীপা আস্তে আস্তে পিছিয়ে গিয়ে হাঁটা দিয়েছে। নিনি তাড়াতাড়ি দীপার সঙ্গ ধরে। দীপার মুখটা কি যে অদ্ভুত হয়ে আছে। ঠিক কাঁদো কাঁদো নয় অথচ আবার কিছু যেন একটা। দীপা কিন্তু স্টেশনের দিকে যাচ্ছে না, বরঞ্চ কলেজ মোড়ের দিকে হাঁটা দিল যে! নিনি সাথে আসছে এটা এবারে দীপার খেয়াল হয়। নিনিকে বলে তুই ফিরে যা, আমি একটু একলা একলা ঘুরব। নিনি ঘাবড়ে যায়, বোঝাতে চায় চল বাড়ী চল। একলা ছাড়তে চায় না। দীপা বুঝতে পারে, বলে তুই কি ভাবছিস আমি আত্মহত্যা করব, নারে তা নয়, তবে একটু একা একা ঘুরি। তারপরে সন্ধ্যে হবার আগেই ফিরে যাব। অগত্যা নিনি ফেরত আসে। পরে শুনেছিল দীপা নাকি ঘন্টা দুই ঘুরে তারপর বাড়ী যায়। এই ঘটনার ১০-১২ বছর বাদে নিনি শুনেছিল সেই দুটি পংক্তি

    "প্রথম প্রেম ঘুচে যাবার যন্ত্রনাকে নিয়ে
    কান্না চেপে ঘুরেছিলাম তোমারই পথ দিয়ে"
    দীপার সাথে তখন আর যোগাযোগ নেই।

    নিনি, জয়তী, দীপান্বিতা, রুমা আর ঝুমা প্রতি রবিবারে ফিজিক্স পড়তে যায় সমরদার বাড়ী। উনি প্রতিদিন কতকিছু খাওয়ান। ওঁর দুই ছোট ভাই, নিনিরা নাম দিয়েছে ব-না আর ছো-না। অর্থাৎ কিনা বড় নার্ভাস আর ছোট নার্ভাস। নিনিরা গিয়ে বেল বাজালে এদের দুজনের একজনই আসে তালা খুলতে। আর ওদের কাউকে দেখলেই ভীষণ নার্ভাস হয়ে যায়, হাত কাঁপতে থাকে, কোথায় তালা আর কোথায় চাবি। ওরাও তখনই নিজেদের মধ্যে কথা বন্ধ করে একদম চুপ হয়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাতে আরো বেড়ে যায় নার্ভাসনেস। কিন্তু ধানচুদি বা নিরুপমাদি দরজা খুলতে এলে আর এই মজাটা হয় না। সমরদার বাড়ী কালীপুজা হয়। পরেরদিন ওদের সব্বার নেমন্তন্ন থাকে। তখন তো আর ছেলেদের ব্যাচ, মেয়েদের ব্যাচ আলাদা করে কিছু মানা হয় না। নিনিরা খেতে বসে বিশ্বদিপ, কমল, অর্ঘ্যদের সাথেই। সমরদার বাড়ীর পাশে রেললাইন টপকে ওপারে যাবার একটা সরু ফালি পায়েচলা রাস্তা আছে। ওটা টপকে ৩-৪ মিনিট হাঁটলেই নিনিদের বাড়ী। সমরদা রোজ পড়ান শেষ হবার পর নিনি আর জয়তীকে লাইন পার করিয়ে দিয়ে যান। ঐসময় প্রায় কোনোদিনই কোন গাড়ী থাকে না, কিন্তু উনি ঠিক দুদিক সাবধানে দেখে তবে পার করাবেন। আসার সময় নিনির মায়ের কড়া নির্দেশ আছে একা একা যেন লাইন না পেরোয়। স্টেশান ঘুরে, শাড়ীমহলের সামনে দিয়ে যাবে। নিনিও লক্ষ্মী মেয়ের মত শোনে। অতটা ঘুরতে সময় লাগবে বলে মা প্রতিদিন সতর্ক করেন ১৫-২০ মিনিট আগে বেরোবার জন্য। নিনি তাই বেরোয় আর তারপর মিমিদের বাড়ীতে মিনিট দশেক গপ্প করে তবে যায়। নাহলে তো বড্ড আগে পুঁছে যাবে আর তখন আবার সমরদার জেরা। সমরদা রামকৃষ্ণ মিশনের একটি স্কুলে পড়ান। প্রতি শনিবার বাড়ী আসেন। আজও কি খুশী হন নিনিদের কাউকে দেখলে। এমন শিক্ষক আর একজনকেও দেখে নি নিনি। এরপরে যখন কলেজ গেল তখনও না।

    "হরিণা বৈরী আপনা মাসে" -------

    নিনিরা স্টেশান থেকে ৩ নম্বর বাসে করে যায় বটতলা অবধি। বাসে সকালে কি ভীড়, কি ভীড়। ওরা তো ওঠেই সবসময় সামনের দরজা দিয়ে। ড্রাইভারের পেছনের লম্বা সিটটার সামনে দাঁড়ায় ওরা সামনের রড টা ধরে। অবধারিত কিছু লোক এগিয়ে এসে ঘেঁসে ঝুঁকে দাঁড়াবে। উত্তরপাড়ার সোমা একদিন একজনে্‌ক সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলায় যা যা শুনল তাতে সারাদিন কোন পড়া শুনতে পেল না। পরের সপ্তাহটা রিকশা করে গেল। কিন্তু তা রোজ তো মুশকিল। ঝুমার মাথায় আসে আইডিয়াটা। সেদিন পুজার ছুটি পড়বে। নিনি পরেছে ক্যালিকোর একটা রঙ্‌চঙে ছাপা শাড়ি। বাসে উঠে দাঁড়াতেই হল। পেছনে এসে দার্হায় এক পঞ্চাশের আশেপাশে বয়সের ব্যক্তি। ভদ্রলোকের হাঁটু বোধহয় নড়বড়ে হয়ে গেছে। কেবলই সামনে ঝুঁকে যাচ্ছেন। নিনির একহাত তো রডে। অন্যহাতে আধাভেজা ফোল্ডিঙ ছাতা। কাঁধের ওপরে ছাতাটা ধরে রাখে। সিটের ওপরের আয়নায় দেখে ভদ্রলোক অন্যদিকে তাকিয়েঅ আস্তে আস্তে আবর ঝুঁকছেন। নিনির তো আর সামনে যাবার উপায় নেই। বাসটা একটা ঝাঁকুনি দেয় আর অমনি চাপ পড়ে নিনির অটোম্যাটিক ছাতার বোতামে। ওপরের ফিতে টা বোতামে বাঁধা, ছাতা তাই লাঠির চেহারায় সরাসরি গিয়ে গদাম ধাক্কা মারে ঐ ধিনিকেষ্টর থুৎনিতে। নিনি খুব লজ্জিত হয়ে পেছন ফিরে বলে "দাদু ড়ষক্ষক্ষঁ একদম বুঝতে পারি নি।" এহেন আপন ডাক "দাদু"তে ভদ্রলোককে আরো ক্রুদ্ধ দেখায়। কিন্তু নিনি এত কাঁচুমাচু হয়েছে যে উনি আর কিছু বলেন না। তবে বাকী রাস্তায় আর ওঁর জানুদৌর্ব্বল্যের কোন প্রমান পাওয়া যায় না। হাঁটুর ওপরে কড়া নজরই রাখেন হয়ত বা।

    শকুন্তলা কালীপুজার বেদম ভীড়ে নিনি কিছুতেই বেরোতে চায় না। অথচ মিমি, রিঙ্কু, শুভ্রা, সাতু, শর্বরী রা তো যাবেই যাবে। আর মেলার আকর্ষণ তো কিছু আছেই। বিশেষ করে নিনি না গেলে মিমিও যেতে চায় না যে। তা চল বিকেল বিকেল যাওয়া যাক। আর তাছাড়া করবেই বা কি? রাতে বেরোতে দেবে নাকি? ঘুরতে ঘুরতেই ঠাকুর এসে গেল যে। নিনি আর শুভ্রা ছাড়া সব্বই ঠাকুর পেন্নামের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। নিনি তো সেই "পয়োমুখম" পড়ে থেকে আর কোন ঠাকুরকে পেন্নামও করে না, মানেও না। মা অবশ্য জোর করে, বকেঝকে দূর্গাআর সরস্বতী পূজায় অঞ্জলী দেওয়ায়। তা নিনি কোন মন্ত্র বলে না কিছুতেই। তো ওরা দুজনে গিয়ে কাঁচের চুড়ি দেখতে থাকে। ঠাকুর দেখে ফিরেই রিঙ্কু কাঁদতে থাকে। ছেলে আর মেয়েদের লাইন পাশাপাশি,বাঁশ বেঁধে আলাদা আলাদা লাইন করা ওরা যখন মন্দিরের জানলার ঠিক সামনে তখনই একজোড়া আঙুল ছেলেদের লাইন থেকে বেরিয়ে সাঁড়াশীর মত এসে নিজের কাজ সেরে আবার ঢুকে গেছে। কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয় কে করেছে। কারণ ঠিক মেয়েদের লাইনের পাশেই যে সব পুরুষ তারা কেউ হলে বোঝা যেত। হাতটা বেরিয়েছে তার পরের সারি থেকে ভীড়ের সুযোগে। অনেকেই রিঙ্কুকে বলে "ন্যাকাচৈতন, আতাক্যালানে, ঢলানী" ইত্যাদি। "ও কেন নিজেকে বাঁচিয়ে চলে নি? আর তেমন কিছু তো হয় নি, একটু চিমটিই তো কেটেছে বাপু। চুপ করে গেলেই হয়। এত পাড়া জাগিয়ে কাঁদার কি আছে! আদিখ্যেতা"। রিঙ্কু অনেকদিন পর্যন্ত মনে মনে কল্পনা করে চলে --- ও যদি খুব শক্ত করে আঙুল দুটো চেপে ধরে টানতে থাকত, তাহলে তো ভীড় ভেঙ্গে ঐ প্রাণীটাকে বেরিয়ে আসতেই হত। অথবা --- ওর হাতে যদি ব্লেড থাকত আর তাই দিয়ে ঐ আঙুলদুটোয় কোপের পর কোপ--আ-:।

    পরের পর্ব
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ১৭ জানুয়ারি ২০০৬ | ১০১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • প্রত্যয় ভুক্ত | ৩০ জুন ২০২১ ১২:২৫495468
  • এই সমরদার পুরো নাম কি সমর ঘোষ?আমি মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয়ের ছাত্র,শ্রীরামপুরেই থাকি।আমাদের ভৌতবিজ্ঞান ,রসায়ন পড়ান সমরবাবু।ওনার স্ত্রী মমতা ম্যাম আমাদের পদাৰ্থবিদ্যা পড়ান।স্যার আগে বরানগর রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষক ছিলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের‌ই প্রাক্তন ছাত্র,শ্রীরামপুরেই বাড়ি।

  • | ৩০ জুন ২০২১ ১২:৩৪495469
  • না এখানে নামটা বদলে দেওয়া আছে। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন