এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহাভারত

    শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৫ এপ্রিল ২০১১ | ২৯৯৬ বার পঠিত


  • ভূমি রচনার জন্য কিছু আলাপন

    রেল কলোনীর কোয়ার্টারে আমাদের প্রতিবেশে থাকতেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে থেকেই আমার ঠাকুমা, বম্মা(বড়মা বা জেঠিমা), দাদা-দিদি খুঁজে পেয়েছিলাম। ঠাকুমা এবং জেঠিমা রামায়ণ-মহাভারত পাঠ করে শোনাতেন সন্ধ্যার অবকাশে। চারপাশে তখন উত্তাল দিনকাল। সিআরপিএফ কিম্বা কং-সিপিএম অথবা নকশালী হামলায় লাশ পড়ে থাকতো জলের বিরাট ট্যাঙ্কের পাশে প্রায়শই। মহাভারত পাঠের উপযুক্ত সময়ই ছিল তখন। যখন দৃশ্য লাশের পরিমাণ কমলো এবং অদৃশ্য লাশের সংখ্যা বাড়ার পথে ভারতবর্ষ, এই ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্য সমেত হাঁটা দিল তখন আমার কাজ দাঁড়ালো এঁদেরকে রামায়ণ এবং মহাভারত পাঠ করে শোনানো। কাহিনী, কাব্য অনেকটাই মুখস্ত হয়ে এসেছিল দিনে দিনে। আমার যত বেড়েছে দখল ততই বয়সের বালি পায়ের থেকে পিছলে পিছলে গিয়েছে ঠাকুমার। এক সময় তিনিও পিছলে গেলেন জীবনের চলমান রেল থেকে। আমি তখন কালী সিঙ্ঘির মহাভারতে।

    কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত পড়তে গিয়ে আবার মাঝে মাঝেই খুব জটিল আলোচনা শুনছি জেঠুর এবং বাবার মধ্যে। ব্রহ্মের বয়স এবং সময়ের পরিমাপ। সূর্‌যের পঞ্চদশ নিমেষে এক কাষ্ঠা। নিমেষ মানে হল চোখের পাতা ফেলার সময়কাল। এইভাবে কলা, দিন, অহ, পক্ষ, মাস, ঋতু, আয়ন, বছর। এখান থেকেই কেলেঙ্কারি। মানুষের একবছর মানে দেবতার একদিনরাত। ৩৬০টি দেব-দিনরাতে ১ দৈব বছর। দেবেদের ১২০০০বছরে এক যুগ। হাজার যুগে ১ ব্রহ্মদিন বা রাত। সংখ্যা আমাকে বিষ্মিত করছে। ৩৩ব্রহ্ম দিন এবং ৩০ ব্রহ্ম রাতে এক মাস। ১২ ব্রহ্ম মাসে ১ বছর এবং ব্রহ্মের আয়ু ১০০ ব্রহ্ম বছর। চোখ ছানাবড়া হবার যোগার আমার। ব্রহ্ম, দৈব, মানুষ তিনের কাল আলাদা। এই হিসেবে ব্রহ্মের ১ ব্রহ্ম বছর মানে মানুষের ৪৩২০০০০ কোটি বছর। সদ্য পাটিগণিত কষা মাথা ঘেঁটে দিতে যথেষ্ট। এর সঙ্গে আবার কলি, দ্বাপর, ত্রেতা, সত্যযুগের হিসেব ধরলে এক এক মনুর শাসনে সবকটা মহাযুগে এই চারটে করে থাকে যুগ। এই করে ৭১টা মহাযুগ। তারপরে মন্বন্তর। এমন করে ১৪ জন মনুর শাসন চলে এক এক কল্পে। মাথা আর নিতে চায়না। অঙ্ক কষে জেঠু দেখান। পরে দেখলাম, ও হরি এ সব হরিবংশের অঙ্ক।

    তা সে বড় বড় অঙ্কের জটিল আলোচনা থেমে গেল একদিন। বদলির চাকরীতে বদল হল বাসস্থানের একদিন। যৌথপরিবারের রেল কলোনীতে গড়ে ওঠা এক রকমের বিকল্প গেল ভেঙে। কৈশোরের প্রশ্নের উত্তর দেবার মানুষ কমতে থাকলো এবারে। বই-ই বন্ধু আমার। শরত, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ হয়ে এরিক ফন দানিকেন। দেবতারা এসে কি কি করেছেন তার কথাকান্ড! মাথা আরো ঘাঁটছে। অন্যদিকে ইতিহাস। মহাভারত শ্‌রুতি ছিল, পরে লেখা। তাহলে গণেশ না? ব্যাসকূট তাহলে কি? বুদ্ধদেব বসুর আগেই পড়ে ফেলেছি নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি, সমরেশ বসু ইত্যাদি। মহাভারতের যুদ্ধের কাল নির্ণয় করছেন সমরেশ। চারপাশের দেশের গতি স্তব্ধ যেন। নেই নেই হাহাকার বেজেই চলেছে। স্ট্রাইক, বাবা-জ্যাঠাদের হাহুতাশ। চাকরীর উন্নতি চাই। না হলে ছোট্ট ঘরেই একদলা হয়ে জীবন। ফুটবল মাঠের বন্ধুরা ফুটবল থেকে মস্তানিতে নিয়ে যায়।

    -"কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা?'

    ডায়ালগ দিয়ে চলে যায় মুদির দোকানের মালিকের ছেলে। দাদা স্থানীয়। বললে বলে মাগিবাজী করতে যাচ্ছি কলকাতা। চিৎকার করে স্টেশন চত্তরে। মিঠুন নায়ক। ভোলামামারা বলে কলির কেষ্ট। কেষ্ট মাথায় ঢুকছে। ইন্টুমিন্টু সব কেষ্ট। দুপুরে কোয়ার্টারে বৌদি থেকে ছাতে সন্ধায় দিদি-দাদার লীলা করেন। প্রাজ্ঞরা বলেন কিছুই হবেনা দেশের। সব দেখি আর শুনি। বুঝি, বুঝিনার মায়ায় ঘিরে থাকি।

    চলে যাই কলকাতা। বাসা বদল। ইমার্জেন্সি শেষ হয়ে গ্যাছে অনেকদিন। জনতা উলটে গিয়ে ইন্দিরা কং। রাজ্যে সিপিআইএম। জ্যোতিবাবু কৃষ্‌ণের মত দেশের রাজনীতি আসলে চালাচ্ছেন। মতামত আসে আশপাশ থেকে। লীলা না রাজনীতি মহাভারত? কৃষ্ণ কি করেন? চেনা মহাভারতের ছকে উত্তর অমিল। মাষ্টারমশাই পড়ান বাড়িতে। না পড়ান না। পড়া বোঝার রাস্তা বাতলে দেন। আগের মাস্টারমশাই রেগে-মেগে তাঁর শ্যামাসুন্দরীর ছাত্রী অনেক ভাল বলে চলে গিয়েছেন, অঙ্ক জীববিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞানের মত মুখস্ত করাতে পারছেন না বলে। অঙ্ক বোঝা যায়? মানে তার ফর্মূলা আছে? সেটা বুঝলেই বাকীটা সহজ? নেশা লাগে।

    মাস্টারমশাই ম্যাক্সিম গোর্কীকে নতুন করে পড়তে বলেন। বাড়িতেই ছিল গোর্কীর "মা'। পৃথিবীর পাঠশালায় ইত্যাদি পড়ে ফেলি। এর মধ্যে আবৃত্তি থেকে নাটকের পালা শুরু। কর্ণকুন্তী সংবাদ-এর মানে যা বুঝেছি শুধু তাই না, অন্য কিছুও। মেঘনাদ বধ কাব্য আসলে একটা পরাজিত ভূখন্ডের আত্মচেতনা, আত্মসন্মান বাড়ানোর দলিল। অনেক পরে জেনেছি মধু দত্ত সেই লোক, যে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কাগজে সিপাহী বিদ্রোহের জন্য ইংরেজ-এর কড়া সমালোচনা করেছিলেন, যখন কলকাতার বুদ্ধিজীবিরা চুপ। নতুন করে মুসলমান শাসন সইবেনা। বঙ্কিমের আনন্দমঠ মানে বদলে নিতে থাকে ক্রমশ। হাতে আসে অনুশীলন সমিতির প্রথম ম্যানিফেস্টো। মুসলিম বিদ্বেষ আছে। তাই রবীন্দ্রনাথ "লোকহিত' লেখেন তাহলে? তাই নিখিলেশ চায়না স্বদেশীর ওই চেহারা? স্বদেশীটা কি বস্তু? দেশ কি? দেওয়ালে লেখা একদিকে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব, অন্যদিকে জনগনতান্ত্রিক বিপ্লব। নির্বাচনী যুদ্ধ এবং নির্বাচন বয়কট। কিন্তু আন্তর্জাতিকতাই মুখ্য। তাহলে?

    কার্ল মার্ক্সের সঙ্গী যোদ্ধা ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস বলছেন রাষ্ট্র জন্মালো কি করে, মর্গানের কাজের সূত্রে। মর্গান আবার আমেরিকান। আমেরিকা আবার সাম্রাজ্যবাদী। আরেক আমেরিকান হাওয়ার্ড ফার্স্ট স্পার্টাকাসের গল্প লিখছেন। জ্যাক লন্ডন বলছেন মুষ্টিযোদ্ধা মেক্সিকান কিশোরের মুক্তিযুদ্ধের কথা। পুঁজিপতি আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ। সোভিয়েত বলছে আমেরিকা শত্রু। চীনও তাই। সোভিয়েত বলছে শান্তির কথা, মাও বলেছেন বিশ্ববিপ্লব শান্তিপূর্ণ হতেই পারেনা।

    তারাতলায় তেরো পার্টির জোটের রাস্তা বন্ধ কর্মসূচী। বিদ্যুৎ, শিক্ষা এসব নিয়েই। কলেজ যাবার কথা। হলনা। রাস্তায় গুলি চললো। মাধাও হালদার শহীদ। বন্দীমুক্তির দিন পেরিয়ে আজিজুল হক আজকালে। সন্দীপনও। কলেজ স্ট্রীট তখনো উত্তাল। নন্দন সংস্কৃতি জন্মায়নি। মমতার মিছিল চলেছে, গুলিও। বানতলা, ধানতলা পেরিয়ে গানে সুমন চট্টো। কালচার-ফালচার না বোঝা মুখ্যমন্ত্রী বলেন ওসব কতই হয়। অনিতা দেওয়ান ক্ষমা কোরো। অন্ধ্রে জনযুদ্ধ, বিহারে এমসিসি, পার্টি ইউনিটি। ভোটে ইন্ডিয়ান পিপলস লীগ। এম-এল লিবারেশন গোষ্ঠীর প্রার্থী আমার ছাত্রীর বাবা বলেন চারুবাবু ভুল। খতম দিয়ে হবেনা। ক্রমে ক্রমে ইন্দিরা-রাজীব মৃত্যু। কংগ্রেস বেড়ে আবার শেষ একরকম। নব্য জনতা শক্তি আবার। বন্ধু সরকার থেকে পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি কই? চাকরী নেই। কৃষিতে থম। জমিতে অপারেশন বর্গা হয়েছে, ফসল কই? ইরফান হাবিব মুঘল আমলে কৃষির কথা লিখতে গিয়ে মুদ্রা নিয়ে লেখেছেন। মুঘল শাসনেও নাকি আসলে বাদশাহের প্রতাপ দিল্লীর আসেপাশেই শেষ। তাই অন্য রাজা, ধনাঢ্যরাও মুদ্রা বানিয়েছেন অনেক। তোডরমলের রাজস্ব নীতির আগেই এক কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র আছে। জমির মাপ থেকে পরকীয়ার শাস্তি সব আছে তাতে। এতো উত্তর ভারতের গল্প, দক্ষিণে? প্রবল দ্রাবিড় চেতনা, হিন্দু ব্রাহ্মণত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সে কৌটিল্যকে নিয়েছিল কোনো কালে? মৌর্য সাম্রাজ্য কতদূর ছিল? আধুনিক মহাভারত তখনই সম্পাদিত হয়েছে জানলাম। তাই বৌদ্ধদের ছাপ এত। তাই কৌটিল্য নেড়া-নেড়ি নিয়ে ব্যাতিব্যাস্ত। তাদের বিশ্বাস করেন না। সেচ কি রাজার কর্ম না? প্রজাউন্নতিতে বিফল রাজাকে রাজদ্রোহ গ্রাস করেনা? ধর্ম কি সামাজিক অনৈক্যের স্রষ্টা না? সোভিয়েতের পতাকা নেমে গেল। গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকা! সাম্রাজ্যবাদের জয়। মার্ক্স মহামূর্খ পাতায় পাতায় লেখা হচ্ছে। লেনিন ডাঁহা আকাট। স্ট্যালিন হিটলারের চেয়েও বড় ডিকটেটর। দালাদিয়েরে ছাতাটি দুলছে জোরে জোরে, হিটলারের সঙ্গে চুক্তি করার ছাতাটি। আমার মাথা গোলাচ্ছে আবার। হাঙ্গেরীতে সোভিয়েত ট্যাঙ্ক কি বিপ্লব করেছে? তিয়েনয়ানমেন-এ কারা জিতেছে? কমিউনিষ্ট পার্টর সদর দপ্তরে কামান দাগতে বলা মাও যৌনতা ছাড়া আর কিই বা বুঝলেন? মাও-এর ডাক্তার অনেক টাকার বই ছাপায়। দেও জিয়াং-এর বেড়াল ইঁদুর ধরলেই হবে। মাও-এর বিরাট বিরাট ছবি ঝোলে চীনের সবখানে, যেন ভারতের গান্ধীবাবা।

    কং-জনতা লুকোচুরির মধ্যেই বাবরি ভেঙে যায়। মন্দির ওঁহি বনায়েঙ্গে! রমিলা থাপার বলেছিলেন বর্ণব্যবস্থা যতই কড়া মনে হোক মনুস্মৃতিতে আসলে এমন হতেই পারেনা। থাকলে আর শঙ্কর জন্মের জন্য এত এত বিধান দিতে হবে কেন? স্পার্টার শাসন যতই কড়া হোক ঘুষ আটকানো যায়নি। পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য বাহিনী পাঠাতে তাই সেখানেও সংসদে কেনা-বেচা হয় সাংসদ, টাকায়, যৌনতায়। থাপর বলছেন এদেশে এসে যবন সেলুকাসীয় গ্রীকরা বৈষ্ণব হয়েছিল। বাকীরা তখন তাদের দলে নেয়নি। হরিবংশ মহাভারতের "খিল' কিনা সে নিয়ে সংশয় বেড়েছে মনে। কপিল গঙ্গা এনেছিলেন ভগীরথকে দিয়ে সগরের পুত্র ছাই করে, এটা পুরাণ। হরিবংশ এসব বলছেই না। সাংখ্যের কপিল নারায়ণ স্বয়ং। বেদবাদীদের সঙ্গে সন্ধি তাহলে? ঋকের লোকেরা সামের লোকদের কুকুর সাজিয়ে তামাশা করেছে সুক্তে। এদের কোনো বিরোধ নেই? অন্ন ব্রহ্ম বলা লোকগুলো কই গেল? যাজ্ঞবল্ক্য গার্গী সমেত সকলকে থামিয়ে দিলেন অতিপ্রশ্ন করতে নেই বলে। রাম ঐতিহাসিক কিনা সে নিয়ে কথা বলা যাবেনা! গোধরা হবেই হবে। রাজধর্মের কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী এক, গর্ব সে বোলো হাম হিন্দু হ্যায় বলা। গণতন্ত্রে আবার রাজধর্ম কি? নরেন্দ্র মোদী সিন্ধু সভ্যতার লোকেদের মত মুখ নিয়ে নির্বিকার, কিছুই হয়নি তো! সিন্ধু সভ্যতা উবে যায়নি। ল্যাটার হরপ্পান বলে একটা স্টেজ আছে। সিন্ধুর লোকেদের ধাঁচ তাই নরেন্দ্র মোদীর মুখে। কিন্তু সকলের স্নানাগার গড়া, সকলের ধান্যভান্ডার গড়া সেই সিন্ধুর লোক এ না। খুনী এ! রবীন্দ্রনাথ দেশকে স্রেফ জ্ঞমা মাঞ্চ করাকে ভাল চোখে নেননি। চার অধ্যায়ে ইন্দ্রনাথের কথা। ন্যাশনালিজম ইউরোপ থেকে ধার করা। এই ভূখন্ড ব্রিটিশের বন্দুকের ডগায় তৈরী দেশ। এক ভাষা না, এক ধর্ম না। কাশ্মীর থেকে নাগাল্যান্ড ধর্ম এবং ভাষাজাতীয়তার দাবী। রাজবংশীরাও তাই বলছেন। একে কি করে বলবো বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য? জাতপাতের রাজনীতিতে মায়াবতী মায়ার মায়া। কংগ্রেস থেকে সিপিএম সবাই হিসেব করে প্রার্থী দেয়। কথা বলে। মমতা ও গৌতম বড় মা'র কাছে গিয়ে এতকাল অবহেলিত মতুয়াদের কল্যাণে জান নিছাবর।

    আউল-বাউল-কর্তাভজা-দরবেশ-ফকিররা লোকায়ত জ্ঞানভান্ডার। লালন কি দাদু, কবীর কি সুফী চিস্তি বিরোধের বাইরে মহামানবের কন্ঠস্বর। সেই মহামানব কে? কারা? অরণ্যের দখলের যুদ্ধ এখন মাওবাদী বনাম রাষ্ট্র। দুপক্ষের দাঁত-নোখের লড়াই। অহিংসা বস্তুত এক মহান তামাশা। আমি অহিংস বলে আমি দুর্বল, কারোর হিসেবে পড়িনা। বন্দুকে বিরোধ মিটলে আবার বন্দুক আসবে বলে বলে ক্লান্ত। এখন এসব কথার সময় নয়। সব পক্ষই বলেন,

    -ক্লৈব্যং মাস্ম গম: পার্থ, নৈতৎত্যউপপদ্যতে।

    হে পার্থ ক্লীবতা ত্যাগ কর। আত্মীয় বন্ধু বিনাশের কালে তুমি কেউ না। তুমি নিমিত্ত মাত্র।

    এই কি ধর্মগ্রন্থ? এই কি ধর্ম? এ যদি ধর্ম হয় তাহলে অধর্ম কি? অগঠিত একটা দেশকে নিয়ে লেখা খুব কঠিন কাজ। গার্সিয়া মার্কেজের ভূমিটির ইতিহাস এখনো নবীন। আমাদের ঘাড়ে কয়েক হাজার বছরের দায়। একশো না দশ সহস্র বছরের নির্জনতায় আমরা স্থাপিত। কন্ঠস্বর খুঁজে পেতে গেলে নির্মাণ চাই। সেই নির্মাণ আমাকে দিতে পারে একমাত্র মহাভারত, মহা ভারবাচ্য চ বলে না, দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতির যুদ্ধক্ষেত্র বলে। সেই ক্ষেত্র থেকে কি পাই তা জানতেই এই প্রয়াস। ভূমিকা তাই ভূমিকার মতন হল না, আমার মতন অপন্ডিতের ব্যাক্তিগত পাঠের সামান্য খসড়া। মার্জনা করবেন পাঠক আমার এ অক্ষমতা। এই মহাকথাকে জানতে বসেছি। তার লিখিত-অলিখিত সকল চেহারায়। তাই আমার গমনাগমন ডায়নামিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে। কল্পনার পাখায় একটি লৌকিক পাঠ নির্মাণ আমার উদ্দেশ্য মাত্র। মহাভারতের এবং মহা ভারতের বিপুল পরিসরের ব্যাস বংশের নির্মিত এবং সংগৃহিত আখ্যানের প্রতিটি প্রান্তকে যথাসাধ্য মন্থন করেই চেষ্টা করেছি এই রূপ প্রস্তুত করতে। কোনো নির্দিষ্ট পাঠের এটি ব্যাখ্যা না, টিকা-টিপ্পনী না, স্বতন্ত্র মহাভারত রচনাই এ ক্ষুদ্রের বিপুল স্পর্ধা। আসন পেতে বসলে পাঠারম্ভ। সর্বশেষ তিরস্কার-পুরস্কার নতমস্তকে স্বীকার্য।

    প্রথম পর্ব

    রাত্রি ঘনিয়ে এল। একটু একটু করে আশ্রমের সামনের রাস্তাটা অন্ধকারে ডুবে গেল। সারাদিন লোক এসেছে, গেছে। বনের মধ্য দিয়ে এই পথ চলে গেছে অনেক দূরে। দুটো রাজ্যর মধ্যবর্তী এই বনাঞ্চল। তাদের রাজধানী দুটোকে জুড়ে রেখেছে এই পথ। দুটো রাজ্যই কৌরবদের তাঁবেদার। তাদের হুকুমে ওঠে বসে। বনের সীমান্ত অবধি সাধারণের ব্যবহারের জন্য। কিন্তু বনের ভিতরের এই রাস্তা সকলের জন্যে নয়। সাধারণ ভাবে রাজবংশীয়দের মৃগয়ার জন্য ব্যবহার হয়। আর কাঠকাটার দল, ব্যবসায়ীর দল আসে এই পথ ধরে বনের ভিতর। কাঠ এখন খুব দামী বস্তু। দিকে দিকে যেন নগর নির্মাণের ধুম পরে গেছে। কাঠের নগর সব। তার চারদিকের প্রাকারও আজকাল পারলে কাঠ দিয়েই বানাবে সবাই। ভারতবর্ষ চোখের সামনে পালটে যাচ্ছে। আগেকার কালে সকলে চেষ্টা করত পাথর দিয়ে নগর বানাবার। এখন চাইছে কাঠ। ব্যাপারটা কি? সকলের মগজে ঢুকবেনা কারণটা। পাথরের নগর বানাবার জন্য পাথর লাগে। এবারে যে অঞ্চল পাহাড়ি বা পাথুরে অন্তত সেখানে অসুবিধা কম, কিন্তু যেখানে পাহাড়ের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে? সেখানে পাথর আনার যা খরচ তা কে দেবে? রাজা বলতে যারা, ধনবান বলতে যারা, তারা কেউই এত ধনীও নয়। আর একজন দুজন নগর নির্মাণ করে থাকতে যাবে কেন? অনেকের থাকার নগরও অনেকের সামর্থ্যের মধ্যেই থাকা দরকার। সেই জন্যেই চাই কাঠের নগর। এতে বড়লোকের বিলাসিতার অনুকরণ করাও যাবে আবার সেই সঙ্গে খরচটাও কমবে। তাছাড়া বেশীদিন একই ধরণের গৃহ বা গৃহসজ্জা আজকাল অচল। এতে করে সময়ে সময়ে সে সজ্জা বদল করে নেওয়া যায়।

    এর আরেকটা মানে আছে। গ্রামের জীবন থেকে অনেক মানুষ এবারে শহরে এসে জমছে। এটাও খেয়াল করার মত বিষয়। তাই একটা নগর প্রতিষ্ঠা শেষ হতে না হতেই আরেকটা নগরের ভিত খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে এই গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে তো নগরের সারি লেগেছে যেন। দুটো নদীর যে কোনোটারই বুকের উপর দিয়ে ভেসে যেতে যেতে দেখা যায় একটি নগর সীমা শেষ হতে না হতেই যেন আরেকটা প্রায় শুরু হয়ে গেল। সেই নগরগুলো গড়ে তোলার জন্যে লাগে কাঠ। সেই কাঠের জন্যে বন উজাড় হচ্ছে। রাজার কোষাগারে অর্থের সংস্থান বাড়ছে। আরেকটা যুদ্ধের জন্যে তৈরী হচ্ছে বাহিনী। ছোট ছোট যুদ্ধ ক্রমাগত চলছে। কেউ নিশ্চিন্ত নয়। কেউ শান্তিতে নেই। মাথার উপরে বড় ছাতার মত কোনো সার্বভৌম সম্রাট নেই। কৌরবরা গৃহবিবাদে পর্‌যুদস্ত। পাঞ্চাল ছাড়া এদেরই সামর্থ্য ছিল একমাত্র অঞ্চলটাকে শান্তিতে রাখার, কিন্তু তার বদলে ক্রমাগত এরা নিজেদের মধ্যে লড়ে চলছে। কূটনৈতিক লড়াই। কিন্তু হস্তিনাপুর তা নিয়েই মত্ত। প্রত্যেকবার এই বংশের রাজ্যাধিকারের প্রশ্নটাই এদের সময় নিয়ে নিচ্ছে। বড় কিছু করবে কখন? যোদ্ধা আছেন অনেক, কিন্তু সৈনাপত্য কে করবে? সেনাপতি যুদ্ধ পরিচালনা করে, রাজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে তার চিন্তা নেই। সে কাজ করেন রাজা। তিনিই আসলে সৈনাপত্যের দায়িত্বে। সেই রাজাই হস্তিনাপুরে সমস্ত সমস্যার উৎসস্থল। দেবব্রত ভীষ্ম, সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে ভাববেন কেন? তিনি কি রাজা?

    অবশ্য তাঁর দিক থেকে দেখতে গেলে ঠিকই আছে। তাহলে? আরো অপেক্ষা!একটি দীর্ঘ্যশ্বাস পড়লো তাঁর অচেতনেই। শ্বাসটি পড়ে তাঁকে কিঞ্চিত ভাবনা ভঙ্গ করালো। এবারে উঠতে হয়। কাল সকালে যাত্রা। যাত্রা? না। মহাযাত্রা!তিনি কাল ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে যাত্রা করবেন হস্তিনাপুর। তিনি উঠে দাঁড়াতেই পাশের থেকে একটি ছায়া এগিয়ে এল।

    -সখা, আজকে সন্ধ্যাহ্নিক বাদ চলে গেল যে!

    -হুম্‌?! ভাবছি এবার থেকে বাদই দেব এই ক্রিয়া। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই সূর্‌যপূজন বন্ধ হওয়া দরকার। এ বড় প্রাচীন এবং পশ্চাদপদ ধারণা।

    তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। পেছনে পেছনে ছায়া চললো। তাঁর প্রায় আবাল্য সহচর চতুর বর্মা। যার কাছে তিনিই ব্রহ্ম। সন্ধ্যাহ্নিক নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলার পরে তাঁকে প্রতিপ্রশ্ন করে এমন সাহস চতুরের নেই। তাই আপাতত কথা না বলেই তিনি আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারবেন। সূর্‌যপূজা আপাতত তাঁর প্রয়োজন নেই। সূর্‌যপূজকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব মধুরও নয় অনেক কারণেই। ঋকবেদের শুরুর দিকের সুক্তগুলিতে ঋষিরা যে দর্শীবাক্য সঞ্চয় করেছেন তাতে বেশীটাই ছিল সূর্‌যপূজা। কিন্তু সেকাল আর নেই। একালে এখন ব্রহ্মবিদদের দাপট চলছে। এরই মধ্যে তিনি না ব্রহ্মা, না সূর্‌য কারোর প্রাধান্যই আলাদা করে স্বীকার করেননি। কাজেই এঁরা কেউই তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট নন। তাতে কিছু যায় আসেনা তাঁর। তিনি আর কিছুকালের মধ্যেই এসব সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির অবসান ঘটাবেন। আর তার জন্যই কাল সকালে তাঁর যাত্রা। থেমে গেলেন হঠাৎ। সঙ্গে চতুরও। সামনের পথের বাঁকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন একটি রথ তাঁর পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেনা রথ, হস্তিনাপুরের চিহ্নবাহী। রথের দিক থেকে একটি খর্বকায় মানুষ তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। এখনো সম্পুর্ণ অন্ধকার গ্রাস করেনি এই অরণ্য। চিনতে পারলেন তিনি। এ অধিরথ।

    -প্রণাম মহর্ষি!

    -যাত্রা তো কাল অধিরথ। আজ কেন? আর তুমিই বা কেন? তুমি তো সারথ্যকার্‌য্‌যের জন্য হস্তিনাপুরে নেই।

    -মাতা সত্যবতী আদেশ করেছেন। আমি অন্য কোনো রথচালককে একাজের ভার দিতে পারবোনা। কাল প্রভাতের আগেই মাতা আপনাকে দেখতে ইচ্ছা করেন। একান্ত অনুরোধ তাঁর, কোনো কাজেই যেন মহর্ষি বেদব্যাস এ আবেদন প্রত্যাখ্যান না করেন!

    -মাতা আবেদন করেন না অধিরথ। তিনি আদেশ করেন।

    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৫ এপ্রিল ২০১১ | ২৯৯৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন