এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহাভারত - দ্বিতীয় পর্ব

    শুদ্ধসত্ব ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০৩ মে ২০১১ | ১৩৪৭ বার পঠিত

  • ।।২।।

    ক্লান্তি এসেছে চোখে। কিন্তু ঘুমোবার কোনো উপায় নেই তাঁর। অধিরথ গেছে কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে আনতে। তিনি জানেন সে আসবেই। মাতৃ আজ্ঞা অবহেলা করার লোক নয় সে। তাছাড়া তারও দায় আছে বইকি। তিনি একা একা সে দায় বহন করবেন কেন? মনটা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। যেন সে দায় সে অস্বীকার করেছে বলে তাঁর মনে হতে থাকে। ফেনিয়ে ওঠা ভাবনাগুলো তাঁর মধ্যে একটা ঝড় দাঁড় করায়। কেউ নেই তাঁর জন্য। তিনি একা। অনেককাল একা! না না, অনেককাল নয়, আসলে চিরকাল একা। জেলেবস্তির মেয়ে তিনি। অপূর্ব শরীর তাঁর এখনো। ত্বকের টান এখনো নষ্ট হয়নি। যেন খুব যত্নে কেউ পালিশ করেছে শ্বেত পাথরে। ছন্দে ছন্দে বানিয়েছে তাঁর শরীর। বর্তুল উরুদ্বয়, এখনো ক্ষীণকটি। গুরু নিতম্বে এখনো আঁট হয়ে বসে হারটি। তিনি চললে শুধু চাবির গোছা দুলতে থাকে অবিরল। তার সঙ্গে সঙ্গত করে গলার চন্দ্রহার। দুটি স্তনের মধ্যে কোনো রকমে পরে থাকে। এখনো তাঁর দুই স্তনের মধ্যে খুব একটা ফাঁক তৈরী হয়নি। কম বয়সে যখন পুরুষ স্পর্শে স্তনের উপরে থাকা হালকা রোম দাঁড়িয়ে যেত তখনতো আরো কম ছিল ফাঁক। পদ্মের ডাঁটি তার মধ্য দিয়ে গলতে পারতো না। শুধু পরাশর নাকি, কত কত পুরুষ মরেছে ওই ফাঁদে।

    তবে পরাশরের আগে কাউকে সঁপে দেননি নিজেকে। পুরুষ এসেছে, উত্তেজিত হয়েছে, ফাঁদে পরা বাঘের মত বা শিয়ালের মত ছটফট করেছে, কিন্তু তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। অনেক কম বয়স থেকে নৌকা পারানির কাজে লেগেছেন। বলা যেতে পারে তাঁর পিতা চেয়েছিলেন তিনি এ কাজে লেগে থাকুন। মেয়ের রূপ পিতার চোখেও পড়েছিল। জেলেবস্তিতে এ মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা মানে বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা হবে। তিনি নিজে ছিলেন জেলে সমাজের মাথা। কাজেই তাঁর অজানা ছিলনা জেলে পুরুষদের দৌড়। তিনি চেয়েছিলেন মেয়ে একাজে থাকলে কালে কালে অন্য সমাজের পুরুষের চোখে পড়বে এবং তাতে তার একটা সদ্‌গতি হতে পারে। তবে তিনিও এতটা আশা করেননি।

    পরাশর যেদিন প্রথম তাঁর নৌকায় চড়লেন সেদিনটা এখনো মনে পরে সত্যবতীর। পরাশর কে বা কত বড় মুনি তা তাঁর জানা ছিলনা এবং সেটাই স্বাভাবিক! জটাজুটধারী একটা লোক তাঁর নৌকায় চড়ার আগে অনেকক্ষণ তাঁর দিকে চেয়ে ছিলেন। আরো অনেক লোক ছিল ঘাটে। কিন্তু শীতের ভোর ছিল সেটা। সকলে তখনও পশরা নিয়ে শুধু জড়ো হচ্ছে, যাবার মত উদ্যোগ কারোর নেই। একটু সূর্য উঠলে তবে যাবার ইচ্ছে সকলের। আসলে এই সময়ে এই দোয়াব অঞ্চলের নদীপথ থাকে কুয়াশার আড়ালে। সেই কুয়াশা আবার জলের মত গায়ে লাগে। বড্ড ঠাণ্ডা! তারই সঙ্গে থাকে জোলো হাওয়া। একটু রোদ উঠলে কিছুটা আরাম লাগে। তাই তারা তখন সব একটু আড়াল খুঁজে রাজার জলসত্রের পাশে আগুন জ্বালিয়েছিল। ওম পোহাবে তাতের। কিন্তু এই লোকটা সেসব কিছুই করছিলনা। নদীর পারে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকেই।

    নৌকার দড়ি-দড়া সব ভাল করে দেখে নিতে নিতেই সত্যবতীর চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু দেখে আর কি হবে? প্রতিদিনই এমন হাজারো তাকে দেখে চলেছে। গা সয়ে গেছে। তার ইচ্ছে হলে একটু দেয়ালা করে ছেড়ে দেয়। না হলে অবজ্ঞা!

    মাছের জন্যে জাল ফেলে আসে সে সকালে। ওই পারে গঙ্গার মধ্যে একটি চর কিছুকাল হল জেগে উঠেছে। সেই চরের কোনো নাম নেই। চরের মধ্যে তার বাবা একটি কুটীরও বানিয়ে রেখেছে। যদি এককালে দেখা যায় এই চর থেকে যাবে, তাহলে দখল পাকা হয়ে গেল। এই করে করে নুনিয়ার চর, সাতক্ষীরা, মেটিয়া কত কত চর দখল করে নিয়েছে তারা তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে আসে রাজার লোক। খাজনার বন্দোবস্ত করতে অথবা কোনো কারণে যদি নদীর উলটো পারের জেলেদের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধে তাহলে তার মীমাংসা করতে। তবে সত্যবতী তার জীবদ্দশায় যুদ্ধ দেখেনি। শুনেছে আগেকার কালে হত। এখন তার বাবার দাপটে বাঘে-হরিণে এখানে এক ঘাটে জল খায়। কাজেই এই কুটীরে অনেক সময়েই সত্যবতী নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়। বিকেলে ফেরার পথে ফেলে রাখা জাল টেনে দেখে নেয় কত মাছ পড়ল। সেই মাছ নৌকায় তুলে ঘরে ফেরে। তার একার মাছ ধরার জন্য বাবা একটা ছোট জাল বুনে দিয়েছেন। ছয়হাতি জাল। একা টানতে বা তুলতে কষ্ট হবেনা। তারি সঙ্গে এই জালে খুব বড় এমন মাছও কিছু পড়বেনা, যাতে সত্যবতীর বিপদ হতে পারে। বড় মাছ হলে টানের চোটে পাগল করে দেবে তোলার সময়। আজকেও সত্যবতী বেরিয়েছে জাল নিয়ে। শীতের নদীতে মাছ পাওয়া খুব সহজ না সে জানে, কিন্তু পাক বা নাই পাক ওই অপেক্ষাটা তার ভাল লাগে। যেন তার জীবনের মতন। সেও জানে জেলেবস্তির কোনো ছেলের জন্যে সে জন্মায়নি। এমন কেউ একদিন আসবে যে তাকে এই মাছের গন্ধভরা বিশ্ব থেকে নিয়ে যাবে অনেক দূরে। সে কেমন আর কত দূর তা জানা নেই তার।

    ভাবতে ভাবতেই আনমনা হয়ে গেছিল সে। এমন সময়ে ওই মুনি তার নৌকার কাছে এসে দাঁড়ায়। কিছু বলে তাকে। একটা শব্দ পায় সে, কিন্তু খেয়াল ছিলনা বলে বুঝতে পারেনা কোথা থেকে আসছে শব্দটা। তারপরে সম্বিত ফিরতে দেখে ওই মুনি তার নৌকার গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে। হাতে একটা বাদ্যযন্ত্র। এতক্ষণ যন্ত্রটা তার চোখে পরেনি। যন্ত্রটা কাঠের। তারযন্ত্র। এমন যন্ত্র সে মাঝে মাঝে দেখেছে। গ্রামের মেলায় বা শহরে যে দু-একবার গেছে সেখানে দেখেছে। এই যন্ত্রটা বাজিয়ে গান করে লোক। তাদের পোশাক-আশাক মুনির মতই অনেকটা। তবে এনার পোশাক যতটা পরিস্কার ততটা থাকেনা। তাছাড়া এনার উর্ধাঙ্গ এই শীতের অনাবরিত। তারা গরমেও অনেক পোশাক আসাক পরে থাকে। মাথায় থাকে পাগড়ি। এনার সে সব কিছুই নেই। শ্রশ্মুগুম্ফমণ্ডিত এক যুবক। চোখগুলি উজ্জ্বল এবং তীব্র। চামড়ার রঙ বলছে ইনিও বর্ণসঙ্কর। পিতা বা মাতার কেউ একজন এদেশীয় বাদামী চামড়ার অধিবাসী। কিন্তু সে সব কিছু ছাপিয়ে প্রখর হয়ে উঠছে মুনির ব্যাক্তিত্ব। এই শীতের সকালে অনাবৃত উর্ধাঙ্গ নিয়ে সুঠাম মুনি তার কাছে কী চান?

    -প্রণাম মুনে! কী আদেশ?

    খুব ধীর চোখে তাকে দেখে নিলেন মুনি। দেহের প্রতিটি অংশ স্পর্শ করে গেল তাঁর দৃষ্টি। সত্যবতী দেখলেন দৃষ্টিতে স্পষ্টতই কামনার আভাস আছে, কিন্তু লালসা নেই। যেন কোনো মূর্তি দর্শন করছেন মুনি। একসময় সেই দৃষ্টি থামলো তার নাভিতে। নিটোল গোল নাভি তার। গভীরও বটে।

    উত্তর দিলেন না মুনি। ধীরে কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে তার নৌকার গলুই-এর দিকে এগিয়ে এলেন। নৌকায় চড়লেন। তারপরে বললেন,

    -আমি একা যাত্রী হব!

    সত্যবতী কিছু বলার আগেই শান্ত স্বরে তিনি বললেন,

    -তোমাকে আমি কামনা করি যুবতি! আমি বাশিষ্ঠ্য পরাশর।

    নামটা সত্যবতীর জানা যে খুব এমন নয়। মুনি-ঋষিদের নিয়ে তার আলাদা কৌতুহল নেই। এমনকি রাজা-রাজরা নিয়েও পিতারা যে আলোচনা মাঝে মাঝে করেন তা সে আলস্যভরেই শোনে। মনে থাকেনা খুব একটা। পরাশর নামটা তার চেনা না হলেও বুঝতে অসুবিধা হল না ইনি নিশ্চই বেশ কেউকেটা কেউ একজন। নাহলে এত নিশ্চিত স্বরে কেউ নিজের পরিচয়জ্ঞাপন করেনা। কিন্তু কামনা শব্দটা তার কাছে খুব ভারী লাগছে। কিছু কিছু গল্প সে শুনেছে এর আগে। গ্রামের দিদিদের কাছে, মাসী বা বৌদিদের কাছে। এরা সব সাঙ্ঘাতিক শক্তিশালী হন। দেশের রাজারাও এদের সমীহ করে চলে। জঙ্গলে আশ্রম করে থাকেন, আর মাঝে মাঝে লোকালয়ে আসেন। কখনো খাবার, কখনো নারী, কখনো রাজার দরবারে যাবার জন্য। তখন অনেক সময়েই পথের কোনো নারীকে এদের পছন্দ হয়, তার সঙ্গ করেন। কেউ বাঁধা দেবার নেই এতে। এ হল প্রথা। মুনি সংসর্গ করলে পরে সেই নারীর সন্মান কমেনা। তাছাড়া নারী সংসর্গের পরে এঁরা কিছু না কিছু এমন দান করে যান যাতে তার প্রভুত উপকার। এমনিতেই তাদের সমাজে যৌন সংসর্গ নিয়ে খুব একটা ছুত-মার্গ নেই। তবে সন্তান না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। হলে সমস্যা হল তখন কন্যাকে বিয়ে দিয়ে যে পণ পাওয়া যায় তার পরিমাণ কমে যায়। সেই কারণেই সন্তান সম্ভাবনা সকলে এড়িয়ে চলে। তাই তাদের গ্রামের ধাই বা বয়স্থা মহিলারা শিখিয়ে দেয় কিভাবে এবং কোন সময়ে সন্তান সম্ভাবনা থাকে। সত্যবতীর এখন সন্তান সম্ভাবনার সময়। সেটা ছাড়াও আরেকটা অসুবিধা আছে। মুনি কি কিছুই টের পাচ্ছেন না? তার শরীরে সারাক্ষণ লেগে আছে মাছের গন্ধ। রসিকেরা দূর থেকেই রসিকতা করে চলে যায়, কারণ এই গন্ধ নিয়ে সহবাস করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। একমাত্র জেলের ঘরের ছেলে পারবে। কিন্তু জেলের ঘরের ছেলে তার নৌকায় আসবেনা। সকলেই জানে সে, সত্যবতী জেলের ঘরে যাবেনা। বাকী চাষা-ভুষো, কুমোর-কামার বা ছোট ব্যবসায়ীরা দূর থেকে নজরের সুখ করে, চাট্টি যৌনতা মেশানো রসিকতা করে, কিন্তু ছুঁতে চায়না। সেটাও কি মুনির নজরে পড়ছে না?

    মুনির নজরে সবই ছিল। ছিল তার প্রতিষেধকও। মহর্ষি চ্যবনের এই আবিষ্কারটি তাঁর বংশেও রয়েছে। তিনি নিজে ভেষজ-র রহস্য সন্ধানে ব্যাপৃত। সুতরাং, সত্যবতীর মৎস্যগন্ধ কেটে গেছিল। কিন্তু তাতে বিপদও ঘনিয়েছিল। প্রথমত, গর্ভধারণ করেছিল সে। দ্বিতীয়ত তার কাছে পুরুষের আসাটা অনেক সহজ হয়ে গেছিল। জেলেরাজ জানতেন এই কন্যা এমনই কিছু ঘটাবে একদিন। এ তাঁর কুড়িয়ে পাওয়া কন্যা। কিন্তু জন্মলক্ষণ বলছে এ মেয়ে যে সে ঘরের নয়। কাজেই জেলের সমাজে একে ঘর দেওয়া যায়না। কিন্তু অন্য সমাজের সঙ্গে তাঁর বিশেষ চলাচলও নেই। এই নৌকার পারানীগিরির ভাবনা সেই কারণেই। কেউ যদি কোনোদিন দেখে ফেলে একে, কোনোদিন দেখে বোঝে এ এখানকার জন্য নয়, তাহলেই এর গতি হবে। কিন্তু তা বলে মুনি পরাশর? হ্যঁ¡, খোঁজ তিনি নিয়েছেন। ইনি মুনিশ্রেষ্ঠ, বেদ বিভাজনও করেছেন। তাছাড়া মহর্ষি বশিষ্ঠ্যের বংশ বলে কথা। রাজা রাজরাও এঁকে দেখলে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য, নইলে রাজার আসন নিয়েও টানাটানি পরে যেতে পারে। তবু সংসার ইনি করবেন কেমন করে? আজ এখানে তো কাল সেখানে, কোনো ঠিক নেই গতিবিধির। সমগ্র দেবখন্ড থেকে এই দোয়াব সর্বত্র এঁর গমনাগমন। অনেক শিষ্য, অনেকানেক স্থানে শাখা-আশ্রম রয়েছে। মন মানে না। এই হাতে কি মেয়ে দেওয়া যায়? যদি মেয়ে নিজেও কুশল হত ধর্ম-কর্মে তাহলেও কথা ছিল। মনুর চতুর্বর্ণ বিভাজন সমাজে যতই দুর্বল হোক, সংস্কৃত জ্ঞান বিহীন কন্যা ঋষি পরাশরের ঘর করবে এতটাও সম্ভব না। আচরণ থেকে দর্শন কিছুই জানেনা এ মেয়ে। তাহলে?

    সমাধান পরাশরই করে গেলেন। পুত্র জন্মানোর আগে জেলেরাজকে জানিয়ে দিলেন দায় তাঁর। এই কন্যা তাঁর মনোহরণ করেছে। কামকুশল শুধু নয়, এর মধ্যে রয়েছে জানার আকাঙ্খা। যতবার মুনি এসেছেন ততবার নতুন নতুন প্রশ্নের ভাঁড়ার খুলে বসেছে মেয়ে। পরাশর ন্যুনতম সংস্কার দিয়েছেন একে। ভাষা শিক্ষাও অল্পবিস্তর। নাগরিক সমাজের রীতিনীতিও শিখিয়েছেন। তাঁর উত্তরাপথের দিকে যাবার কথা ছিল। কিন্তু যাননি প্রায় দুই বছরকাল। থেকে গেছিলেন কাছেই। বারেবারে এসেছেন। সন্তানের জন্মের সময় যে দ্বীপে প্রথম নিয়ে গেছিলো কন্যা সঙ্গমের জন্য, সেই দ্বীপেই তাকে নিয়ে এসেছেন। তিনদিন তিনরাত থেকেছেন। সঙ্গে গ্রামের ধাই। অবশেষে সন্তান জন্মেছে। সেই সন্তান সমেত সত্যবতী থেকেছেন ওই দ্বীপেই। দ্বৈপায়ন সন্তানের জননী হয়েছেন সত্যবতী। ঋষি অপেক্ষা করেছেন সন্তানের বয়স অন্তত দেড় বছর হবার। মাতৃদুগ্ধের অভ্যাস ছেড়েছে শিশু ধীরে। একদিন তাঁদের দুজনকে নিয়েই বেরিয়ে পরেছিলেন পরাশর। কিন্তু কিছুকাল পরেই বুঝলেন এ ভ্রাম্যমাণ জীবন সত্যবতীর নয়। তাঁকে নিয়ে আবার ফিরেছেন জেলেরাজার কাছে পরাশর। সন্তানকে নিজের দায়িত্বে রাখবেন। যুবক পরাশরও এই প্রথম পিতা হয়েছেন। আর কানীন সত্যবতীর সন্তান চলে গেলে সত্যবতী থাকতে পারবে জেলে রাজার ঘরে। তাছাড়া ওষধির প্রয়োগে সত্যবতীর যোনিপথ আবার প্রায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পুরুষ সংসর্গের জন্য তার অপরাধ আর ততটা থাকবেনা বলেই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু দিনগুলো আর এক থাকেনি। সত্যি বলতে কি ওই পুরুষ অতি রূপবান না হলেও সত্যবতীর মনে ও মননে তীব্র ছাপ রেখেছেন। এক গভীর উপস্থিতি পুরুষের। কামকুশলতায় এবং পান্ডিত্যে নিপুণ। জগতে কোনো প্রশ্নই এঁকে বিচলিত করেনা। কি অনায়াসে গ্রহণ করলেন সন্তানের খবর! সমাজ, সংস্কার, দেবধর্ম-কিছুই যেন তাঁর বাধা নয়। সত্যবতী ভয়ে ছিলেন যদি এই জন্ম না হয়, যদি অনেকের মত তাঁকেও সন্তানঘাতী হতে হয়? হয়নি।

    দ্বৈপায়নকে নিয়ে চলে যাবার পরেও এসেছিলেন পরাশর। কয়েকবার এসেছিলেন। কিন্তু দুজনেই বড় শান্ত হয়ে গেছিলেন। এমনকি শরীর বিনিময়ের উন্মাদনাও তাঁদের চঞ্চল করেনি। যেন জেনেই গেছিলেন এই সম্পর্কের আর কোনো পরিণতি নেই। এভাবেই যতকাল যায় ততকাল মাত্র সঞ্চয়। তারপরে শূন্য সব। অথচ বিবাহ নিয়ে কোনো কথাই হয়নি তাঁদের। কী বাধা ছিল? অবস্থান ছাড়া আর কী? সংস্কার ছাড়া আর কি? সত্যবতী গভীরে কখনো কখনো চেয়েছিলেন এঁর সঙ্গে থাকতে। প্রকাশ করতে পারেননি। পরাশরের ভ্রাম্যমাণ জীবন ত্যাগের প্রশ্ন নেই। এই জীবনই তাঁর জ্ঞানের উৎস। পরাশর এ প্রসঙ্গে কোনো আলোচনাতেই জাননি কখনো। তাহলে কি সত্যি জগতের কোনো কিছুতেই অবিচলিত থাকেন এমন ভাবাটা সত্যবতীর ভুল ছিল? আসলেই সংস্কার, বৈদিক ঋষিদের অননুমতীর আশঙ্কাই কি তাঁকে ভয় পাওয়াতো? জানেন না সতবতী। শুধু জানেন সন্তান তাঁর স্মরণ মাত্র তাঁর সামনে উপস্থিত হবে, এই পিতা এবং পুত্রের প্রতিজ্ঞা। সে প্রতিজ্ঞা কখনো ভাঙেনি পুত্র।

    তিনি নিজেকে ভেঙেছিলেন। বৃদ্ধ রাজা শান্তনুকে বিবাহ করেছিলেন। শর্ত দিয়েছেন সে সব কথা ঠিক, কিন্তু তাতেও কি আর এই বিবাহের স্বার্থকতা আসে? কোথায় পরাশর, আর কোথায় কামনালোলুপ শান্তনু! আবার অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে কানীন সত্যবতীর সন্তান সংবাদ সকলেই জানত। দোজবরে ছাড়া বিয়ে হবার মত উপায় কই? মুনির ঘরে মেয়ে না দিলে থাকে নবীন রাজন্যরা। তারা রাজকুমারীদের দার পরিগ্রহণ করবে, সত্যবতীর সঙ্গে তাদের কি? রতিকুশলতাই শুধু রাজবংশের জন্য উপযুক্ত নয়। পিতা কোনোদিনই কোনো বৈশ্যর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেবেন না একথা সত্যবতী জানতেন। জেলে রাজ হবার সুবাদে এদের সঙ্গে পিতাকে ব্যবসায়িক কাজে লিপ্ত থাকতে হয়। এদের অর্থগৃধ্‌নুতাকে তিনি ঘৃণা করেন! শেষে শান্তনুতেই রাজী হতে হল। অত্যন্ত কঠিন শর্ত দিয়েছিলেন তিনি। গাঙ্গেয় দেবব্রতকে রাজপাট দেওয়া চলবেনা। কিন্তু মেয়ের বাপের সেই শর্তও মেনেছেন শান্তনু পুত্র দেবব্রতের অসীম স্বার্থত্যাগে। এমনকি ভবিষ্যতে যাতে বংশধর নিয়ে সমস্যা না হয় তাই দেবব্রতকে বিবাহ ভাবনাও ত্যাগ করতে হয়েছে। তবু তাতে পরোয়া করেননি গাঙ্গেয়। এত সব কঠিন শর্ত অতিক্রান্ত হয়ে যাবে জানলে হয়ত জেলেরাজ আরেকটু কঠিন কিছু ভাবতেন। কে জানে? এখন আর এ সব ভেবে কী লাভ? বরং সামনের সঙ্কটের কথাই ভাবা ভাল। রাত্রি অবসান হবার আগেই তাঁর প্রথম সন্তানকে চাই। সেই পারে এই সঙ্কটে তাঁকে রক্ষা করতে।

    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৩ মে ২০১১ | ১৩৪৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন