এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • বাদল সরকার এবং

    শুদ্ধসত্ব ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ৩০ মে ২০১১ | ৮৭৪ বার পঠিত
  • রবিবার সকাল বেলাতে এখনো আমার এই কলকাতা শহরের বাড়িতে মাথায় চন্দনের তিলক কাটা,গলায় কন্ঠী পরা বৈষ্ণব ভিক্ষুক আসেন সামনের গৌড়িয় মঠ থেকে। তাঁদের গলায় দোলে হারমোনিয়াম,খোল,হাতে থাকে মৃদঙ্গ। গানের সুরে চারপাশকে জানিয়ে তাঁরা এসে পড়েন ভিক্ষা নিতে। এটা রিচুয়াল। যুগের পর যুগ চলছে। গানের সুর মন টানে,মন ভরায়। যাঁরা গাইছেন তাঁরা নিতান্ত ভিক্ষার জন্য গাইছেন না ভক্তির জন্য,সে কূটকাচালি পরে করবো। আগে দেখে নিই এইভাবেই বছরের পর বছর চলে কি করে? কেন ট্রেনে,বাসে,ফুটপাথে বিবিধ হকারের গলায় আসে বিবিধ সুর? একেকজন একেকরকম স্কেলে,নোটে গলা লাগিয়ে ডাক-হাঁক দেন,ক্রেতা সচকিত হবেন বলে। এক আইসক্রিমওয়ালা নিউআলিপুরের একটি পাড়ায় তিনতলা ফ্ল্যাটের নীচ দিয়ে চলে যান এক অদ্ভূত হাঁক দিয়ে। তিনি বলেন কি তা কিছুই বোঝা যায় না। গলা দিয়ে একটা অদ্ভূত সুর বার করেন এবং সেই সুরের সঙ্গে যথোচিত হাতের ভঙ্গীমা করে ডাকেন। যাদের ডাকেন তাদের নামটাই শুধু শোনা যায় স্পষ্ট করে। দাদা-দিদি,খোকা-খুকুকে ডাকেন। বাকীটা কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। এই যে বিবিধ রকম এই সবই পারফরমেন্স। জনজীবনের অঙ্গ।

    আপনাকে যখন খেতে দেওয়া হবে তখন কোন প্লেট-এ কোন খাবার দেওয়া হবে তা নির্দিষ্ট থাকে সব বাড়ির হেঁসেলেই। বিচ্যুত হবার উপায় কম। হলে আপনিও অবাক হন। পায়েস বাটিতে না দিয়ে থালায় দেওয়া হয় না,আবার ভাত থাকার বদলে বাটিতে খেতে দিলে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আবার দেখুন মুড়ি যখন আপনি কলকাতায় খাবেন তখন সে আসবে সাধারণভাবে বাটিতে। এটাই যদি মেদিনীপুরে খেতে বসেন তাহলে দুপুরবেলায় পোস্তর সঙ্গে থালাতেও আসতে পারে। সন্ধে হলে বড় কাঁসার বাটিতে চপের সঙ্গে মাখা অবস্থায়। পারফরমেন্স-এর উপকরণ এমন দেশকাল সাপেক্ষে নির্দিষ্টই থাকে। আমরা,আম জনতাও আমাদের অচেতনেই পারফর্ম করে যাই।

    বাঁ হাতে দোকানদার টাকা দিলে অনেকেই অসন্তুষ্ট হন। অনেক দোকানদার হাতে করে টাকা নিলেও কিছুতেই ক্রেতাকে হাতে দেবেন না। দোকানের কোনো বয়ামের উপরে রেখে দেবেন বা খালি স্পেসে রেখে দেবেন। আপনি যতই হাত পেতে থাকুন হাতে কিছুতেই দেবেন না। কেউ কেউ আছেন কখনোই আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন না কেনা-বেচার সময়ে। ব্যাস্ত থাকুন বা না থাকুন অন্য দিকে তাকিয়েই উত্তর দেবেন। জিনিসের দাম বেশী বা ওজন কম এই সংক্রান্ত আলোচনায় বা দরাদরির সময়েও তিনি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর অস্বস্তি হয়। আবার যিনি কোনো একটি অপরাধের তদন্ত করেন তিনি খুব সক্রিয় হলে আপনার চোখের দিকে তাকিয়েই কথা বলবেন। সেই কথাকে শুনতে বলা হবে চোখের দিকে তাকিয়েই। তিনি আপনার বিচলন দেখবেন। আপনার চোখ কাঁপছে কিনা,ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে কিনা,ঘাম জমছে কিনা, ঘাড়ে বা কানের পাশ থেকে গড়িয়ে আসছে কিনা সেটাও দেখবেন। একসময়ে বিচারে স্বাক্ষীর এই জাতীয় চরিত্রাবলী লক্ষ করাটা আমাদের হিন্দু বা মুসলিম আইনের বিচারকের আবশ্যকীয় কর্ম ছিল। মেকলে অধ্যুষিত অধুনাতন ইউরোপীয় প্রনালীতে সে সব চুলোয় গেলেও এখন আবার নার্কোটিক টেস্ট,লাই ডিটেক্টর ইত্যাদি দিয়ে কাজের চেষ্টা হচ্ছে। যদিও এগুলোর ফলাফল এখনো আইনি স্বীকৃতি পায়না তবুও কাজে লাগানো হয় বহু সময়েই। খেয়াল করলে দেখবেন এগুলো রিচুয়াল মাত্র। এগুলো সঠিক ফল দেবেই এমন নাও হতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে বিবিধ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বংশজ ঐতিহাসিক জ্ঞানভান্ডারে এগুলোর কিছু ফলাফল রক্ষিত আছে। এম্পেরিক্যালিই এগুলো আহৃত হয়েছে। তাই এর ব্যবহারের একটি নির্দিষ্ট যুক্তি কাঠামোও আছে। অব্যর্থ নাই হতে পারে,কিন্তু একটা পদ্ধতি বটেই এ সব।

    এসবকে লক্ষ করে গেছিলেন সুধীন্দ্র ওরফে বাদল সরকার। এই যে জনজীবন পারফরমেন্স নিয়ে গঠিত,এই যে রিচুয়াল কাজ করে জীবনে। নাট্যকর্মের সবটাই আসে জীবন থেকে সরাসরি। তাকে আলাদা করে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে যুক্ত করে দেখাটাও একটা কাজ বটেই। মঞ্চের নাটকে আমি যখন একটি চরিত্রের একটি মুহুর্তকে বেছে নিয়ে আলো ফেলে শব্দ সহযোগে তার কাজকে দেখাতে থাকি তখন সেই আলোটা বা শব্দটা আসে কোথা থেকে? কেউ কেউ মঞ্চে বাস্তবতা বজায় রেখে দিনের বা রাতের আলো করেন,তার সোর্স নির্দিষ্ট করেন ইত্যাদি এবং ধ্বনির ক্ষেত্রে চরিত্রের এবং অ্যাকশনের সঙ্গে স্থান-কালের দূরত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে এ সব যা হবে তা হবে মঞ্চে। তার একটি নির্দিষ্ট গন্ডী আছে। আছে একটি নিজস্ব বাস্তবতা। তাকে অস্বীকার করা যায় কি করে? তাই আবার অনেকেই আলোর জন্য মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগান। রঙের ব্যবহারও করেন। ধ্বনিকেও বিবেচনা করেন সেই একই উপায়ে। তবু যত যাই করা হোক সে হোলো লেখার পরে আলাদা করে আন্ডারলাইন দিয়ে বা ব্র্যাকেট করে বা ইনভার্টেড কমার মধ্যে রেখে বিশেষ করে তোলার চেষ্টা। এবং এটা খুব স্পষ্টভাবেই দেখেছিলেন বাদল সরকার। আর দেখেছিলেন তার খরচ।

    কেন দেখেছিলেন? তার কি প্রেক্ষাপট ছিল? সাধারণভাবে বলা যায় এই দেখার প্রেক্ষাপটটা তাঁর বিদেশে কিছুকাল চাকরীর সূত্রে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে তৈরী হয়েছে। শিবপুর থেকে এঞ্জিনীয়ার হয়ে একদা কর্মসূত্রে গিয়েছেন বিদেশে। সেখানে জেনেছেন রিচার্ড শেখনার,জের্জি গ্রোটস্কি ইত্যাদির কাজকর্ম। ইউরোপিয়ান থিয়েটারটা ক্রমশ এগোচ্ছিল। স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেখশট থেকে এগোচ্ছিল। অভিনেতা নিয়ে চিন্তা থেকে এলিয়েনেশন তৈরী করে নাট্যক্রীড়া সম্পর্কে চিন্তা করতে দেওয়া,যাতে দর্শক বিষয়বস্তু হারিয়ে না ফেলে সে সব পেরিয়ে নাট্যক্রীড়ার নানান বিষয় নিয়ে ভাবার সময় এসেছিল। অবশ্যই একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল তার। সেই প্রেক্ষাপটটা ছিল মূলত বামপন্থী। পোলান্ডে গ্রোটোস্কি ভাবছেন পুওর থিয়েটারের কথা। বানাচ্ছেন আউসউইৎজ-এর অনুকরণে একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প,যেটা আসলটার থেকে মাত্র ষাট মাইল দূরে,ওপোল-এ। ওখানে মঞ্চস্থ করবেন স্তানিশ্ল উইস্পিয়ানস্কির 'অ্যাক্রোপোলিস'। নাট্যকবিতা একটি,যেখানে পোলান্ডের ধর্ম,রাজনীতি,ইতিহাস সব মিলেমিশে যাবে। কাজ করছেন রিচার্ড শেখনার। নির্দেশনার পাশাপাশি কাজ করছেন পারফর্মেনস স্টাডি নিয়ে। এঁদের সকলেই ধীরে ধীরে বদলে নেবেন কাজের ভাবনা,ক্ষেত্র কিছুটা। কাছাকাছি সময়েই অগুস্ত বোয়াল ব্রাজিলে কাজ করছিলেন তাঁর স্তানিস্লাভস্কিয়ান ধাঁচ ছড়িয়ে দেবার জন্য। সেখান থেকে কিছুকাল পরে জুন্টা দ্বারা অত্যাচারিত এবং নির্বাসিত হয়ে আর্জেন্তিনা থেকে পেরু,ইকুয়াদোর,ফ্রান্স ঘুরতে ঘুরতে তৈরী করবেন তাঁর থিয়েটার ফর দ্য অপ্রেসড-এর কাজ।

    এই যে বদলগুলো ঘটছিলো,এ সব শুধু উপরিতলের বদল ছিল না। পোলান্ড জার্মানির দখলমুক্ত হলেই তার মুক্তি ঘটেনা। রাশিয়ান,কম্যুনিষ্ট বলে পরিচিত,আসলে নয়া-জারদের আওতায় গিয়ে পরে। দমবন্ধ করার পরিস্থিতি চারপাশে তৈরী হয়। এমন না যে এই পরিস্থিতি অ-কম্যুনিষ্ট দেশগুলোতে হয় না। সেখানেও অপছন্দের শিল্পিকে কম্যুনিষ্ট দাগিয়ে দিয়ে গলা টিপে ধরা যায়। সব জায়গাতেই শিল্পিকেই আবিষ্কার করতে হয় তাঁর কাজের ভাষা এবং স্পেস তৈরী করতে হয়। বিশেষ করে এই ধরণের কালেক্টিভ শিল্পের ক্ষেত্রটা আরো বিপজ্জনক। একা একা করা যায় না,জায়গা না পেলে করা যায় না। শিল্পি প্রকৃত প্রস্তাবে যে কাজটি করেন সেটি হল তাঁর নিজের পদ্ধতিতে 'সত্য' কে খোঁজার কাজ। সে সত্য শেষ সত্য হতে হবে এমন না,কিন্তু তার কোনো একটা চেহারাকে ধরার কাজটা খুব জরুরী তার পক্ষে। তাই প্রকৃত শিল্পি সব সময়েই বিপজ্জনক শাসকের কাছে। বোয়াল যখন তাঁর পদ্ধতিকে পারফেক্ট করার জন্য মিলিটারি জুন্টার আমলে অভিনেতাকে বলেন চরিত্রের সত্যকে আবিষ্কার করতে তখন সেটা জুন্টার কাছে বিপজ্জনক। চরিত্র উঠে আসে সমাজ থেকে,তার উৎপাদিত সত্যকে জানতে গেলেই ব্যবস্থাকে জানতেই হবে। ফলে বোয়ালের কাজ বিতর্কিত এবং বিপজ্জনক। অ্যাক্রোপোলিস যতই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চেহারা নিক না কেন,সেই ক্যাম্পের প্রেক্ষাপটের নাটকে যতই বাইবেলের চরিত্ররা ব্যবহৃত হোক না কেন,ব্যবস্থা যা বোঝার তা বুঝে যায়। তখন গ্রোটোস্কিকেও ভাবতে হয় রাস্তাটা ঠিক কি হবে! শেখনার এবং গ্রোটোস্কি এই জায়গা থেকে ক্রমশ সরে আসেন থিয়েটারের অন্য ফর্মেশনের দিকে। রিচুয়ালের ব্যবহার তাঁদের আকৃষ্ট করে,কম্যুনিকেশনের পদ্ধতি হিসেবে। বোয়াল ঢুকে যান বিষয়ের গভীরে। বাজারে দোকানির থেকে একটি ছেলে চাল-ডাল নিয়ে চলে যাচ্ছে। দোকানি তার কাছে দাম চাইলে সে জানাচ্ছে সে এতই গরীব এবং দাম যে ভাবে বেড়েছে তাতে সে দাম দিতে পারবেনা। দোকানি এবং ক্রমশ সমবেত জনতার সামনে একসময়ে অনেক ঝগড়া-ঝাটির মধ্যে সে সুবিনয়ে বলে সে গরীব বলে কি সে খাবেনা,সে বাঁচবে না? মৌলিক প্রশ্নটিকে এভাবেই তুলে আনেন বোয়াল তাঁর কাজে। একটা সময়ে থানা-পুলিশ হবার আগে জানানো হয় এটা আসলে একটা থিয়েটার। সরাসরি এবং পুরোদস্তুর রাজনৈতিক থিয়েটার এটা। আবার ঠিক উল্টোদিকে কম্যুনিজমের প্রয়োগ যে প্রশ্নগুলো তুলছিল সেই প্রশ্নগুলোকে নিয়েই শুধুমাত্র ডগমাটিক ভাবনার গন্ডী ছেড়ে বেরোতে চাইছিলেন ইউরোপের বহু নাট্য-শিল্পি। তাঁরা সকলেই নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে শেষত সর্বহারার বিজয় হবে। হলেও সেই বিজয়ের যে চেহারা গুলাগ দেখাচ্ছে তার সঙ্গে সহমত ছিলেন না। আবার নিজেদের দেশগুলোতে ধনতন্ত্রের কামড় যে কি সেটাও বুঝছিলেন বেশ। মনুষত্ব্যহীনতা তাদের ক্রমশ বিক্ষুব্ধ করেছে,ইনডেফিনিট করেছে এবং ইতিহাসের প্রথাসিদ্ধ ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ করতে বলেছে। এখানেই এসে পড়ছে অস্তিবাদ এবং আরো অন্যান্য বিচলন। হদিশহীন একটা শতক ক্রমশ সব কিছুকেই অস্থির করে দিয়েছে। এই সমস্ত কিছু নিয়েই আমাদের থিয়েটারে এসেছিলেন বাদল সরকার।

    নাট্যকার হিসাবে এসেছিলেন। কিন্তু শুধু নাট্যকারেই সীমাবদ্ধ থাকলে আমাদের ক্ষতির পরিসীমা ছিলনা। নাট্যকারকে বহন করেন প্রয়োগকর্তারা। তাঁরা আটকে ছিলেন মঞ্চে। শম্ভু মিত্ররা মঞ্চকে পছন্দ করতেন। এমনকি উৎপল দত্ত-ও। পানু পালের অ্যাজিটপ্রপ শুধুমাত্র নির্বাচনী মহাসংগ্রামের অস্ত্র। যে বামপন্থীদের সংস্কৃতির কথা বারেবারে উঠে আসে আমাদের বিদগ্ধ আলোচনায় তাঁদের একটা বড় অংশ(বিশেষত নেতৃস্থানীয় অংশ) নাট্যজাতীয় শিল্পকে শুধুমাত্র জনসভার আগে লোক ভরানোর কাজ মনে করেছেন ফ্যাসীবিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ থেকে আই পিটি এ-র ফরমেশনে এসেও। চলে এসেছেন শম্ভুবাবুরা। নয়া থিয়েটার বা নব থিয়েটার মঞ্চে বাণিজ্যিক ধারা থেকে পৃথক হতে ব্যবহৃত একটি সঙ্কেত। কিন্তু সেই থিয়েটারের খরচ কম হলেও কত কম? তা কে জোগাবে? অজিতেশ,উৎপল দত্তরা চলে গিয়েছেন সিনেমা,যাত্রা ইত্যাদিতে। সেখান থেকে অর্থ এনে সামলাবেন প্রযোজনার খরচ। শম্ভুবাবু সরকারী বা বেসরকারী সহযোগিতা থেকেও চালাতে কষ্ট পেয়েছেন। বাকীরা সেখানে তথৈবচ। তাছাড়া আছে উপযুক্ত নাট্যমঞ্চের সমস্যা। যে সব মঞ্চ আজও গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার চেয়ে অনেক ভাল ছিল বোধহয় বন্ধ কারখানাগুলোকে থিয়েটারের স্পেস-এ পরিণত করা। ওই মঞ্চে নাট্য প্রযোজনা শুধুমাত্র নিজেদের স্বান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কিছু না। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস ছাড়া বাকীগুলো কেমন তা যাঁরা নাট্যপ্রযোজনার সঙ্গে জড়িত তাঁরা জানেন! প্রথম দিকে তো সেটিও ছিল না। ছিল মিনার্ভা খুব কষ্ট করলে,নতুবা একসময়ে মুক্তাঙ্গন। মুক্ত অঙ্গনই যদি হবে তাহলে আর স্টেজ নিয়ে ভাবনা কেন তা আমি আজও বুঝিনি। এখনো যখন কোনো কাজের জন্য ওখানে যেতে হয় শুধু অবাক হয়ে ভাবি, দক্ষিণ কলকাতার এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায়,একটি ট্রাস্টের অবিবেচক পদক্ষেপ আর পাশাপাশি থাকা ট্রাম কোম্পানি আর একটি ব্যাক্তিমালিকের বদান্যতায় কি করে ধ্বংস করে দেওয়া যায় একটি নাট্যসম্ভাবনাকে। সরকারেরা শুধু ঘুমোন। অথচ ওখানেই বাদলবাবুর 'এবং ইন্দ্রজিৎ'-এর প্রথম নাট্যমঞ্চায়ণ। অস্তিবাদী নাটক বা কারো কারো কথায় কিমিতীবাদী নাট্য(এই এক্সিটেন্সিয়ালিস্ট এবং অ্যাবসার্ড নিয়ে এখানে কথা বলা মুশকিল স্থান সংকুলানের জন্য) জন্মালো ভারতবর্ষে। সার্ত্র,বেকেট,ইওনেস্কোর মতন এখানেও সম্ভব এমন একটা নাটক লিখে ফেলা,এটা জানা গেল। হ্যঁ¡,পরে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ও লিখেছেন,সেই মোহিত যিনি 'সক্রেটিস' লিখেছিলেন নক্ষত্রের জন্য। শ্যামল ঘোষ পাঁচ ঘন্টার সেই নাটককে পরে তিনঘন্টায় আনিয়ে মঞ্চায়ণ করেছিলেন। কিন্তু আমার সমস্ত শ্রদ্ধা সমেতই বলি বাদলবাবুর অস্তিবাদী/কিমিতীবাদী নাটক,প্রযোজনা অতি কঠিন কাজ। বিশ্বের সেরা কাজেদের মধ্যে পড়ে। আজকেও 'এবং ইন্দ্রজিৎ'কে মঞ্চায়ণ করাটা একটা চ্যালেঞ্জ। তাকে কন্টেম্পোরারি না করে করা যাবেনা,আবার সে এতই কন্টেম্পোরারি যে কি ভাবে ধরা হবে,নাটকটা খুলবে কোথা থেকে আসলে সেটাই রাতের ঘুম কাড়ার জন্য যথেষ্ট। এর আগে কমেডি লিখেছেন,মঞ্চ সফল সে সব। কিন্তু সেটা আমার আজকের বিষয় না।

    বিষয় এই সরতে থাকার চেষ্টাটা। বহুরূপীর প্রযোজনায় অনেকগুলো নাটক হল। বাকী ইতিহাস,প্রলাপ,ত্রিংশ শতাব্দী,পাগলা ঘোড়া,শেষ নেই ইত্যাদি তাঁকে মঞ্চসফল শুধু না,বেশ অন্যমানের নাট্যকার হিসেবে স্থান দিল মঞ্চে। তবু পোষালোনা? শতাব্দী,তাঁর দল,প্রথম মঞ্চে করে 'এবং ইন্দ্রজিৎ'। বাতাসে,খেয়াল করে দেখুন,বিক্ষোভ আর হতাশার গন্ধ সেই প্রথম শো-র সময়েই। মানে ১৯৬৩ তে। স্বাধীনতা কিছুই দেয়নি। স্বপ্নপূরণ হয়নি,নেহেরু কাউকে টাঙাননি ল্যাম্পপোস্টে কালোবাজারির জন্য। ভারত অনাবিষ্কৃতই থেকে গিয়েছে আদ্যন্ত। তাই সে ভূখা,ধুঁকছে। ভেঙে যাবে অবিভক্ত কম্যুনিষ্ট পার্টি পরের বছরেই। এবং ইন্দ্রজিৎ হতাশ,একা,ভীষণ একা। তার মতন অসংখ্য যুবক-যুবতী জানেনা তাদের কি ভবিষ্যৎ! তাদের জন্য আছে সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস। তা দিয়ে কি হবে? ধুয়ে কে জল খাবে? বৈদেশিক ঋণ এর খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে বিধানবাবুর আমলেই। পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্যিক সুবিধা ছিল যে শুল্কব্যবস্থা তাও অবলুপ্ত। কারখানাগুলো কাত হয়ে পড়েছে। কলকাতা এবং তার বিরাট পৃষ্ঠভূমির জন্যে এখানে কারখানা বানানোর দরকার নেই। শুধু মাল সাপ্লাই দিলেই হবে। পুঁজি উড়ে যাচ্ছে বিবিধ রাজ্যে,যেখান থেকে এসেছেন সেই সব পুঁজির মালিকরা। এককালে এঁদের অনেকেই আলো করেছিলেন বড়বাজার কংগ্রেস কমিটি,যে কমিটি ছিল আসলে আলাদা কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে। যে কমিটির জন্য গান্ধীবাদী প্রফুল্ল সেন-কে রাতারাতি ছাড়তে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীত্ব গান্ধীর নির্দেশেই। গান্ধী বলেছিলেন একজনকে রাখতে যিনি বিড়লার প্রতিনিধি হবেন,শোনেননি ভদ্রলোক। তায় আবার খাদ্য সংকটে মজুতদারী রোখার জন্য বড়বাজারে কিছু কিছু অবাঙালী ব্যবসায়ীর গুদামে হানা দিয়েছে তাঁর পুলিশ। রাতারাতি বিধান রায় কে বিড়লার সঙ্গে এক প্লেন এই উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দিল্লী। বিধান ফিরেছেন সকালে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে। প্রফুল্লর বিরুদ্ধে সভা হয়েছে বড়বাজারে মারোয়ারি ব্যবসায়ীদের,বিড়লার নেতৃত্বে,তারা চিঠি বিড়লাই দিয়ে এসেছেন প্রফুল্লর বাড়িতে। এগুলো সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস নয়। কেশোরাম পোদ্দারের মিলে (বিড়লা সম্পর্কিত ইনিও) স্বাধীনতার পরেরদিনও গুলি চলেছে,শ্রমিক মরেছে এই পশ্চিমবঙ্গে। আজ টাটার জন্য যা যা হয়েছে,সালিমের জন্য যা যা হয়েছে তা যেন এসবের পুনরাবৃত্তি মাত্র। ওই পশ্চিমবঙ্গের এক যুবক ইন্দ্রজিৎ। ইন্দ্রজিৎ,যাকে লক্ষণ বধ করে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে,নিরস্ত্র। রামের রাবণবধ, সীতা উদ্ধারের প্রেস্টিজ সুরক্ষিত হয়। সেই ইন্দ্রজিৎ এবং? শূণ্যতা...! তারপরে? তারপরে? খুঁজতে সরলেন আরো বাদল সরকার।

    সে কথা বলার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। প্রাচীন গ্রীসে মূলত ব্যাক্কাই বা ডাওনিসাস-এর পূজোতে অনুষ্ঠিত হত নাট্যক্রীড়া। এই দেবতাটির উৎপত্তি নিয়ে অনেক রকমের জল্পনা-কল্পনা আছে। মূলত মদ,এক্সট্যাসি,আঙুর ফসলের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ইনি। এঁর জন্য সারারাত নাট্যউৎসবের শেষে পাহাড়ের গোপন ঢালে নারীরা নগ্ন নাচে মত্ত হত। সে নাচ ছিল পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ। নারীরা উন্মত্তের মতন একে অনুসরণ করতেন এঁর পূজোর শোভাযাত্রায়। তারই সঙ্গে মাইসিনিয়ান,মিনোয়ান গ্রীকদের দ্বারাও তিনি পুজিত ছিলেন বলে মনে করা হয়। আবার এও বারেবারেই ধরা হয় যে ইনি পূর্বের দিকের থেকে বা এশিয়া থেকে আসা (বা বিদেশাগত দেবতা),বা ফ্রিজিয়ায় এঁর স্থান ছিল। এমনকি ইথিওপিয়াতে এঁর বাস ছিল। যাই হোক না কেন,ইনি চাষাভুষো অধ্যুষিত থ্রেস-এ যে কারণে পূজিত হয়তেন এই কারণ ছাড়াও এঁর পূজো হত গ্রীক শহরগুলোতে। সেখানে যাবতীয় বিপজ্জনক,অসংযমী,যুক্তিহীন(যা ভাগ্য বলেই একমাত্র ব্যাখ্যা করবে কম বোধসম্পন্ন মানুষের দল) ও উদ্দাম কাজের মানুষদের দেবতা ইনি। রক্ষাকর্তা-ও। সাধারণ সভ্যতার বাইরে এঁর অবস্থান। ঠিক এই কারণে কিন্তু যুক্তিবাদী গ্রীসের (শহুরে অভিজাত এবং নাগরিকদের) কাছে ইনি বেশ ঘৃণ্য ছিলেন। তাহলেও সাধারণের মধ্যে এঁর অবস্থান এত জোরালো ছিল যে এঁকে বাতিল করাও সম্ভব ছিল না। ফার্টিলিটি কাল্ট,রহস্য,যৌনতা সব মিলেমিশে এই দেবতার উৎসব পশ্চিমি নাট্যের উৎস। এবারে ভাগ্যের উপরে এত নির্ভরশীলতা সোফোক্লিসের নাটকে কেন থাকে তার কিছুটা আন্দাজ এর থেকে পাওয়া যেতে পারে। আবার ওন্য অনেক কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ যার জন্য প্লেটো নাটককে অমন নির্বাসন দেবার পক্ষপাতি ছিলেন। বিশৃঙ্খলা তাঁর ইউটোপিয়াতে বরদাস্ত করা যাবেনা। এখানে থেকে এই যে নাট্যচর্চা যা বহু সময়েই সামাজিক-অর্থনৈতিক বিরোধের (গ্রীসের চাষ নির্ভর গ্রামাঞ্চল এবং বাণিজ্য কেন্দ্রিক আথেনিয় শহুরে সংস্কৃতির বিরোধের মতন) প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতো। এমনকি তথাকথিত মধ্যযুগের অন্ধকার ইউরোপে,যখন প্রভু খ্রীষ্টের বন্দনাই নাট্য স্বার্থকতা বলে বিবেচ্য তখনো সুকৌশলে ঢুকে গিয়েছে এই বিরোধ। খ্রীষ্টানদের বিবিধ সেক্টের লড়াই শহর-গ্রাম অর্থনৈতিক বিভাজনে প্রভাবিত ছিল বই কি! তার প্রভাবও পড়েছে নাট্যচর্চায়। গ্রীসের জারজ রোমান সংস্করণ বা রোমের জারজ ব্রিটিশ নাট্যসংস্করণের মধ্যে ক্রমশ যা হারিয়ে গিয়েছে তা হল এই স্পেক্টাকলের সম্ভাবনা। স্পেক্টাকল,যা স্পেকটেটর-এর জন্য তৈরীও তা শেক্সপিয়রিয়ান নাটকেও রয়েছে,কিন্তু ফারাক হয়েছে বিপুলত্বে। মিড সামারস নাইটস ড্রিমস কোনোভাবেই ডিওনিসিয়ান স্পেক্টাকলের অনুরণণও না। একটা সম্পূর্ণ পাহাড়ের কোলে,কেটে কেটে বসানো হাজারে হাজারে দর্শকাসনের সামনে একটি বিপুল শোভাযাত্রা সর্পিল গতিতে যখন এসে পৌছয় তখন তার উন্মাদনা চরমে। উদ্দাম নাচ আর গান-এ ছেয়ে আছে সে। কিছুটা বলা যায় চৈতন্য চলেছেন নবদ্বীপের পথে পথে,আর তাঁর পিছনে কেঁদে কেঁদে হরিনামগান করতে করতে চলেছে সারা নবদ্বীপ,তাহলে বোধহয় অনুমান করা যায় তার বিরাটত্ব। এই বিরাটত্বের ফারাক শুধুমাত্র বিষয়ের জন্য না,শুধুমাত্র শহুরে রুচির জন্য না,আসলে ফারাক হল ক্যানভাসের। প্রসেনিয়ামে এই বিপুলকে ধরা সম্ভবই না। এই বিপুলতা, জনতাকে কি অসম্ভব প্রভাবিত করতে পারে তা যাঁরা হায়দ্রাবাদের পথে চলতে থাকা জনশিল্পি গদরের জননাট্যমন্ডলীর শোভাযাত্রা দেখেছেন তাঁরা অনুমান করতে পারবেন। শুধু শোভাযাত্রার লোক না,গদরের গানের সঙ্গে,জননাট্যের নাচের সঙ্গে পাহারায় থাকা হাবিলদারও নেচে চলেছে। সে এক অসম্ভব দৃশ্য!

    ইউরোপিয়ান থিয়েটারের বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে একে ক্রমশ স্পেক্টাকলের দিকে নিয়ে চলেছিলেন গ্রোটোস্কি,শেখনার-রা। ধর্মীয়-সামাজিক-যৌনতার নতুন বয়ান নির্ভর বুনন এক। অন্যদিকে বোয়াল,তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গীমায়,স্পেক্টেটরকে স্পেক্ট-অ্যাক্টরে পরিণত করার কাজ করে চলেছেন। ভারতের নাট্যধারার সূত্রে শুধু কি এর প্রভাব? না। ডাওনিসাসের সঙ্গে নামগত সূত্রেই যোগাযোগ আছে শিবের। Dio আসলে জিউসের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাচীনতর কাল থেকেই। Nysos শব্দটায় শিবের মাহাত্ম্যবাচক শব্দ "Nisah'-গত মিল রয়েছে। যার অর্থ সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। আবার Nyas শব্দটি 'সুখী পর্বত' হিসেবে কৈলাশকে চিহ্নিত করছে। নেশা আর কাম এই দুই বস্তুর সঙ্গে দুজনের সম্পর্ক বাদ দিলেও থাকে ষাঁড় আর সাপ নিয়ে মিল। সে যাই হোক,এমন মিল প্রাচীন ফার্টিলিটি কাল্টের দৌলতে কিছু আশ্চর্য্যের না আমাদের কাছে। যেটা তাৎপর্য্যপূর্ণ সেটা হল শিবও নাট্যশাস্ত্র প্রবক্তা। নন্দী তার প্রতিলিপি করেছেন মাত্র। ইন্দ্র-ব্রহ্মা-বিষ? ণু অধ্যুষিত সংস্কৃতায়িত ভূবনে শিব নিতান্তই লোকজ দেবতা। অথচ ধীরে ধীরে তাঁকে দেবপ্রধান বলে স্বীকৃতি দিতে হল। গ্রীসেও ব্যাক্কাই-কে গ্রীক দেবরাজ জিউসের অধীনস্থ করা যায়নি বলে একসময়ে জিউসের সন্তান বানাতে হয়েছে। এঁকে মেনে নিতে হয়েছে প্যাগান রোমানদেরও। আর এই দেশে শিবকে মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেটা হয়েছে তা হল নাট্যসংস্কৃতির সংশোধন। রাজার দরবারে চলে গিয়েছিল নাটক। এককালে যখন সামবাদীদের ব্যাঙ্গ করার জন্য ঋক্‌চর্চাকারীরা নাট্যক্রীড়া করছে এবং সেখানে কুকুরের বেশে কয়েকজন সেজেগুজে নাচছে এবং গাইছে তখনই এটা বোঝা যাচ্ছে যে এই মাধ্যমের শক্তি কতটা। এমনকি ঋকবেদ-এও আমরা প্রাচীন নাট্যরচনা পাই যম-যমী সংবাদে বা ইন্দ্র এবং তার পুত্রের সংবাদে। অর্থাৎ মাধ্যমগতভাবে এর শক্তি অপরিচিত না এবং সেই কারণেই রাজদরবারেও এর ঠাঁই হয়েছে। অথচ এর একটি পাশাপাশি চলা ধারা ছিল নিশ্চই। তার সম্পর্কে আমাদের কাছে এখনো খুব স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবু মৃচ্ছকটিক জাতীয় নাটক এবং কালিদাসের রচনায় সংস্কৃতের সঙ্গে পালির ব্যবহার (যা তখন ওই অংশের জনগণের মূল ভাষা) সেদিকেই আমাদের ইঙ্গিত করতে থাকে।

    ফার্টিলিটি কাল্ট (লিঙ্গ ফর্মে শিবপূজা) থেকে চলতে চলতে নাটক পৌঁছেছে শাসকের কাছে। এই ধারা বেয়েই যাত্রা এবং অন্যান্য লোকজ পারফর্মেন্সের উপাদান কাজ করে চলেছে আমাদের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে। ইউরোপিয়ান থিয়েটারের পাশাপাশিই এগুলোও বাদল সরকারের উপাদান। গম্ভীরার মধ্যে আছে শিবকে উপলক্ষ করে নিজেদের সমস্যা,দু:খ-কষ্ট,আনন্দ নিবেদন করার পদ্ধতি। বাদল সরকার বাম গ্রোটস্কি ছাড়াও,বাম আন্দোলনের দৌলতে লোক সংস্কৃতি সম্পর্কে তৈরী হওয়া ভাবনা জানতেন না এমন না। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মাউন্টব্যাটন কাব্য কি করতে পারে তাও তাঁর অজানা ছিল না। তাছাড়া আরেকজনের ভাবনাও এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরাধীন ভারতের অন্যতম সেরা নাট্যপ্রযোজক ভদ্রলোকের নাম রবীন্দ্রনাথ। ইউরোপিয়ানদের এদেশে মঞ্চসজ্জা দেখে যিনি অনুধাবন করতে পারেন বাস্তবতার নাম করে বোকামো করা হচ্ছে এবং যিনি জানেন আসলেই একটি স্টুলকে একই মঞ্চে রাজসিংহাসন থেকে দারোয়ানের বসার জায়গা সব বানানো যায় দর্শকের কল্পনাশক্তির উপরে ভর করে(বাঙ্গালীর কাছে যাত্রা,কথকতায় কল্পনা বিস্তারের পাখা ছিল),তিনিও কিছু কথা বুঝেছিলেন,বলেছিলেন। যেমন গানের ব্যবহারের শক্তি,যেমন মঞ্চসজ্জায় স্বাতন্ত্র্য তৈরী করা,যেমন একটিমাত্র জালের আড়াল দিয়ে রক্তকরবীর গোটা নাটকে যক্ষপুরীকে তুলে আনা ইত্যাদি। তা কল্পনা যদি এতটাই পারে,তাহলে সেই কল্পনা একটি মঞ্চেই আবদ্ধ থাকে কেন? নাটক যদি শিক্ষার মাধ্যম হয়,নাটক যদি সচেতনতার প্রচারক হয়,নাটক যদি সমস্যা আলোচনার একটি নিবিড় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ স্থান হয় তাহলে সেই নাটক শুধু মঞ্চেই আটকে থাকবে কেন? তাহলে তো মঞ্চ পাওয়া না পাওয়া,তার জন্য বিশেষ কর্তৃপক্ষকে খুশী করা ইত্যাদি হিসেবে, আর দর্শককূল হিসেবে শুধু পরিশীলিত মধ্যবিত্ততেই খেলা শেষ! সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বাদল সরকার। কিন্তু মঞ্চ বিরোধিতা করেননি। সেটা নিতান্তই অপপ্রচার। আসলে নিজের কাজ নিয়ে শহর-গ্রাম তোলপাড় করে বেড়াচ্ছিলেন। আমাদের নাট্যকর্মীকূলের একটি বড় অংশ অফিস শেষ করে এসে থিয়েটারের মহড়ায় অভ্যস্ত। অভ্যস্ত হাফ বা ফুল ছুটি নিয়ে এসে মঞ্চে অভিনয় করায়। তাঁরা যেমন-তেমন ব্যবস্থায় অভিনয় বা প্রযোজনা করেন না। গোছানো সাজানো গ্রামীণ মঞ্চ নেই। আলো,শব্দের বিশেষ প্রক্ষেপণ নেই খোলা মঞ্চে। মানুষ এক জায়গায় বসে প্রবন্ধ পাঠের মুখ করে দেখছেন না নাটক। আসছেন-যাচ্ছেন,ধরে না রাখতে পারলে হেসে বিদ্রুপ করে চলে যাবেন,পাশেই বিক্রেতারা বিক্রি করে চলেছে,ক্রেতা কিনছে,সেই পরিবেশ তাঁদের সমস্যা করেছে। তাঁদের সমস্যা করেছে বাদল সরকারের শরীরি ভাষা। নাট্যচর্চার জন্য শরীরচর্চা করতে হয় নাকি? তাহলে তো ফুটবল খেললেই হয়। আমাকে এক প্রবীণ অভিনেতা বলেছিলেন এ কথা। আমি গিরীশ ঘোষের একটি কথা আমার মত করে মনে করিয়েছিলাম। "দেহ-পট সনে নট সকলি হারায়"। বলেছিলাম বেলঘড়িয়ার নাট্যমঞ্চের আগে গিরীশবাবুরা কিঞ্চিত দেহচর্চা করতেন বলেই শুনেছি। ডাম্বেল-বারবেল ইত্যাদি। তাড় খুব একটা পছন্দ হয়নি কথাটা। একটা বড় কারণ বোধহয়,মধ্যবিত্তের চিরকেলে উৎপাদন পদ্ধতির শ্রমদানের অংশ থেকে বিযুক্তি। ফলত নাট্যচর্চা,ড্রয়িংরুম ড্রামায় পরিণত হয়েছে। সেখানে বাদল সরকারের নাট্যপদ্ধতিতে শরীর কাজ করবে সেট থেকে প্রপ্‌স অনেক কিছুর মতন। কাজ করবে একটি নাট্যভাষা নির্মাণ করতে,যা অনেক বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে কথা ছাড়াই পৌঁছে যাবে। মঞ্চে এমন পদ্ধতি আছে মণিপুরের কানহাইয়ালাল,রতন থিয়াম,মধ্যপ্রদেশের প্রয়াত হাবিব তনবীরের কাজে। আমাদের কাজে অতীব কম এ পদ্ধতি। এটাও একটা কারণ বিরূপতার। অথচ থিয়েটারের প্রভূত সম্ভাবনাকে এভাবে নষ্ট করা হয়েছে। এই সব মধ্যবিত্ততা থিয়েটারকে ক্রমশ খর্ব করেছে। আর খর্ব করেছে প্রথার বাইরে না যেতে পারার দুর্বলতা। ফলে বাদল সরকারের শতাব্দী গোষ্ঠী এবং তার সচেতন থার্ড থিয়েটার এঁদের কাছে নাটক না হিসেবেই পরিচিত থেকেছে।

    আর সমস্যা থেকেছে বাদল সরকার নিয়ে! বিরাট। লোকটা প্রচলিত ঢঙের বামপন্থী না,অনুদানের উপর নির্ভর করে অনুবাদ নাটকের কাজ করে চলেনা। নেতা-ফেতাদের কথা শোনেনা। সত্তরের ওই আগুণে সময়ে মিছিল,ভোমা,সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস,স্পার্টাকাস এসব নাটক করেছে। লোকটা নিতান্ত নকশাল বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। তাতেও সমস্যা। উৎপল দত্ত-র মতন ভয়ঙ্কর নাট্যমেধা,"তীর" করে নকশাল হয়েছিলেন বটে,কিন্তু কালে কালে "জনতার আফিম"-ও করেছেন বাম 'সুখবাচ্য' ফ্রন্টে এসে। "দু:স্বপ্নের নগরী" থেকে সরে গিয়েছেন মুম্বাই ফেরত। অথচ,বাদল সরকার আদতে গেলেনও না,ফিরলেনও না। গোটা ভারতের নাট্যচর্চাকারীরা মাথা ঝুঁকিয়ে সেলাম করেছে,তবু ইব্রাহিম আলকাজি বা জবর প্যাটেল হতে তাঁর সময় হল না। পুরস্কার দিলেও শান্ত হলেন না। তৃতীয় নাট্যের গবেষণাগার থেকে মাল নিয়ে অনেকেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার ছাড়াই চালিয়ে দিয়েছেন মঞ্চে,মঞ্চের বাইরে নির্বাচনী কুরুক্ষেত্রে,কিন্তু ওই নাট্যকে ব্যার্থ বলতেই সময় ব্যয় করেছেন বেশী। তাতেও দমানো যায়নি লোকটাকে। মূল ধারার সংবাদপত্র,সংবাদ মাধ্যম কিছুই তাঁকে জায়গা খুব একটা দেয়নি। আসলে রেনিগেড বই তো না! মেইনস্ট্রিম এ ওই সাফল্য ছেড়ে চলে যাওয়াকে বাজারী হাওয়া মানে কি করে? এমন নাট্যব্যাক্তিত্ব ভারতীয় থিয়েটারে কই? গিরিশ কারনাড থেকে মোহন আগাসে সকলেই শিক্ষকপ্রতিম সন্মান করেন যাঁকে,সেই বাদল সরকারকে কোনো সরকারই এক টুকরো জমি একটু স্থায়ী গবেষণার কাজের জন্য দেবার সৌজন্য দেখাতে পারলো না। এই রাজ্যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় নাটক নিয়ে কোর্স করেছে,তারাও কেউ কখনো এনাকে ডেকে এনে সত্যি শিক্ষা দেবার সাহস করতে পারলো না। মধ্যমানের তৈলদানকারী দলানুগত শিক্ষককূল আর পরিকাঠামো বিহীন নাট্যশিক্ষার প্রতারণা দিয়ে চালিয়ে দিল। কিন্তু কিছু যায় আসেনা সত্যিই। আমরা,যারা ক অক্ষর গো মাংস তারাও যখন আজ নাট্যপ্রযোজনার কাজে যাই তখন এই মোটা মাথায় ভাবার চেষ্টা করি নাট্যভাষা নিয়ে। ভাবার চেষ্টা করি নাট্য প্রযোজনার আসল কারণ কি! বাদল সরকার পরবর্তী বাংলা নাট্যস্রোতে টেক্সট,তার ব্যবহার,তার ভাঙচুড়,তার গভীরে যাওয়া ছাড়া তাৎক্ষণিক সফল প্রযোজনা হলেও হতে পারে,কিন্তু কালান্তরে গমনকারী প্রযোজনা হয়না। আমাদের এমন একজনকে কাজে ছাপিয়ে যেতে হবার চ্যালঞ্জ থাকে তিনি অমল,বিমল,কমল না,তিনি "এবং ইন্দ্রজিৎ"! আমরা সে কাজে ব্যার্থ হই আর শিক্ষিত হই দিন প্রতিদিন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ৩০ মে ২০১১ | ৮৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 2345.110.784512.238 (*) | ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৭:৩২89027
  • গদ্যেপদ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে- নামে শিলিগুড়ির এক পত্রিকার ৮ই জুলাই, ২০১১ সংখ্যায় আজ এই লেখাটা ফের পড়লাম!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন