এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একজন কমলালেবু - শাহাদুজ্জামান

    Muhammad Sadequzzaman Sharif লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৩ মার্চ ২০১৮ | ২১৬৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • শাহাদুজ্জামানের লেখা একজন কমলালেবু পড়ে শেষ করলাম। জীবনানন্দ দাশের জীবনী বলা যেতে পারে এই উপন্যাসকে। শাহাদুজ্জামান সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নাই। ক্র্যাচের কর্নেল দিয়ে মুগ্ধ করেছেন অনেক আগেই। ক্র্যাচের কর্নেলের পরে অন্য কিছু আর পড়া হয়নি, দুই একটা গল্প বাদে। একজন কমলালেবু দিয়ে তিনি আবার মুগ্ধ করে দিলেন আমাদের। গত বছরের বই, আমার সৌভাগ্য হয়েছে এ বছর পড়ার।

    জীবনানন্দ দাশ কে বলা হয় বিশুদ্ধতম কবি। আধুনিক কবিতা যার হাত ধরে পূর্ণতা পেয়েছে। যাকে রবীন্দ্রনাথের পরে বা রবীন্দ্রনাথের সম পর্যায়ের কবি বলে মনে করেন অনেকই। সেই কবি কে সারাটা জীবন কি নিদারুণ কষ্ট করে যেতে হয়েছিল ভাবতে অবাক লাগে। বিয়ের পরে পরেই চাকরি হারান। এরপর বছর পার হয়ে যায় আর কোন চাকরির খবর নাই। নিদারুণ অর্থ কষ্টে দিন পার করছেন তিনি। স্ত্রী লাবণ্য বিয়ের পর আর সুখের দেখা পাননি। অধ্যাপক বর করে বিয়ের পরেই বেকার দেখে তার মানসিক অবস্থাও বেতাল। তিনি কবি বা কবিতা সম্পর্কে বিন্দু মাত্র আগ্রহ পান না। জীবনানন্দ দাশের এই আর্থিক কষ্ট সারা জীবনেও আর শেষ হয়নি।

    আর্থিক কষ্ট না যাওয়ার অন্যতম কারন হচ্ছে কবি পুরোপুরি কবিই ছিলেন। তিনি অন্য কিছুতেই আর স্বস্তি পেতেন না। দেখা গেল বহু কষ্টের পরে হয়ত একটা কলেজের শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন কিন্তু তা আর উনার ভাল লাগছে না।চাকরি ব্যাপারটাই তার কাছে বিচ্ছিরি একটা কাজ। তিনি লিখেছেন -
    “পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকুরী
    এ কেমন পরিবেশই রয়ে গেছি সবে
    বাকপতি জন্ম নিয়েছিল যেই কালে…”
    তিনি চান নির্জন একটা কক্ষে বসে শুধুই লিখে যেতে। কবিতা যে লিখে অর্থ কামাবেন সে উপায়ও নেই। উনার বিখ্যাত বিখ্যাত কবিতা প্রকাশ পাচ্ছে কাগজে আর সঙ্গে সঙ্গে সমালোচকরা ঝাঁপিয়ে পরছেন তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করতে।

    অবশ্য সমালোচনাকে তিনি পাত্তা দিতেন না এক রত্তিও। নিজের প্রথম কবিতার বই পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। আশা করেছিলেন কবিগুরু ভাল কিছু বলবেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেকটা পাত্তাই দিলেন না জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে। উল্টা অনেকটা রূঢ় ভাষায় উত্তর দিলেন চিঠির। যা রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের সাথে একবারেই বেমানান। তিনি সাধারণত কেউ এই ধরনের বই পাঠালে তার প্রশংসাই করেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশকে লিখলেন -
    “তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারি নে। কাব্যের মুদ্রাদোষ ওস্তাদিকে পরিহাস করে।”
    অন্য কেউ হলে হয়ত দমে যেতেন। কিন্তু অন্য সব জায়গায় পরাজিত, মুখচোরা জীবনানন্দ দাশ নিজের কবিতার বেলায় ছিলেন দারুণ কঠিন।তিনি উনার কাব্যশক্তি সম্পর্কে পুরোমাত্রায় সজাগ ছিলেন। তিনি জানতেন তিনি যা লিখেছেন তা উৎকৃষ্ট। রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করলেও উৎকৃষ্ট না করলেও উৎকৃষ্ট। তিনি অনেকটা কড়া ভাষায় চিঠির উত্তর দিলেন -
    “সকল বৈচিত্র্যের মত সুর-বৈচিত্র্যও আছে সৃষ্টির ভিতর। কোন এক বিশেষ ছন্দ বা সুর অন্য সমস্ত সুর বা ছন্দের চেয়ে বেশি করে স্থায়ী স্থান কি করে দাবি করতে পারে? আকাশের নীল রং, পৃথিবীর সবুজ, আলোর শ্বেত রং, কিংবা অন্ধকারের কালো রং - সমস্ত রঙগুলোরই একটা আলাদা বিশিষ্ট ও আকর্ষণ আছে। একটাকে অন্যটার চেয়ে বেশি সুন্দর ও সুচির বলা চলে বলে মনে হয় না।”

    প্রথম প্রথম নিজের স্টাইলে লেখার আগে ওই সময়ের নানা কবির প্রভাব উনার কবিতায় দেখা গেছে। যেমন একটা কবিতা -
    “একাকী রয়েছি বসি,
    নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
    পাইনি কে তাহা টের।
    দূর দিগন্তে চলে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের।
    কোন সুদূরের তুরানী প্রিয়ার তরে
    বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
    দীর্ঘ দিবস বয়ে গেছে যারা হাঁসি অশ্রুর বোঝা
    চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের ‘রোজা’,
    আমার গগনে ইদরাত কভু দেয়নি যে হায় দেখা,
    পরানে কখনো জাগেনি ‘রোজা’র ঠেকা।"

    এই কবিতা পড়ে যে কারো মনে হতে পারে এটা নজরুলের লেখা। কিন্তু বেশি দূর না। তারপরেই উনি উনার জায়গা খুঁজে পেয়ে গিয়েছিলেন। লিখে ফেলেন সব অমর কবিতা। লিখলেন -
    “ফিরে এসো এই মাঠ, ঢেউয়ে;
    ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
    দূর থেকে দূরে - আরো দূরে
    যুবকের সাথে যেয়ো নাকো আর।

    কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে!”

    লিখলেন -
    “বঁধু শুয়ে ছিল পাসে - শিশুটিও ছিল;
    প্রেম ছিল, আশা ছিল - জ্যোৎস্নায়, তবু সে দেখিল
    কোন ভূত? ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার? অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।”

    বাংলা কবিতা যেন একটা ঝটকা খেয়ে গেলো। এর আগে কেউ কবিতায় এই ধরনের শব্দই ব্যবহার করেনি। তিনি দেখালেন এও হয়।

    ট্রাংক ভর্তি করে লিখে রেখে গেছেন গল্প উপন্যাস। কিন্তু প্রকাশ করেননি। জীবিত অবস্থায় একটা গল্প বা উপন্যাসও ছাপা হয়নি। লিখে গেছেন সাংকেতিক ভাষায় এক ডাইরি। তাতেই সব নিজের দুঃখ কষ্টের কথা লিখে গেছেন, নিজের প্রথম প্রেমের কথা বলে গেছেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে যখন বিভিন্ন জায়গা থেকে দুই একটা পুরষ্কার পাচ্ছেন তখনো তিনি তার অবস্থা ভুলে জান নাই। কিংবা তখন আর তাকে টানে না কোন কিছুই। পুরষ্কার আর তাকে আলোড়িত করে না। তিনি লিখেছিলেন -
    “মানুষটা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি
    কেউ দেয় - বিনি দামে - তবে কার লাভ-

    সারা জীবন মনের মাঝে একটা আত্মহত্যা ইচ্ছা নিয়ে ঘুরেছেন। ট্রামের নিচে পরে মারা যাওয়াও অনেকে আত্মহত্যা বলেই মনে করেন। বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্যর মত হাতে গোনা গুটিকয়েক মানুষ বরাবর তার পাসে থেকেছেন। বাকিরা তফাতেই থেকে গেছেন। তাই হয়ত সারা জীবন কষ্ট করে যাওয়া জীবনানন্দ দাশ মনে ক্ষোভ নিয়েই চলে গেছেন।
    শাহাদুজ্জামান কে ধন্যবাদ জীবনানন্দ দাশ কে সজীব করে আমাদের সামনে হাজির করার জন্য।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৩ মার্চ ২০১৮ | ২১৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Muhammad Sadequzzaman Sharif | 129.30.45.187 (*) | ২৩ মার্চ ২০১৮ ০৮:১৭63958
  • কমলালেবু নামকরন করেছে জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতা আছে কমলালেবু নামে, সেখান থেকে।
    "একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
    আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
    আবার যেন ফিরে আসি
    কোন এক শীতের রাতে
    একটা হিম কমলালেবুর করুন মাংস নিয়ে
    কোন এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে।"
    নীল হাওয়ার সমুদ্রে পড়ার ইচ্ছা থাকল। তবে একজন কমলালেবু লিখতে শাহাদুজ্জামানও যথেষ্ট ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। বইয়ের শেষে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহারিত ৫৬ টা বইয়ের নাম দেওয়া আছে।
  • Debarati Chatterjee | 127.227.89.67 (*) | ২৩ মার্চ ২০১৮ ১১:২৫63956
  • কমলালেবু। উজ্জ্বল। অনেকগুলো কোয়ার জোট।
  • /-\ | 69.160.210.3 (*) | ২৩ মার্চ ২০১৮ ১১:৪০63957
  • নীল হাওয়ার সমুদ্রে - প্রদীপ দাশশর্মা ; প্রথম সংস্করণ ঊর্বী প্রকাশন, দ্বিতীয় প্রতিভাস, তৃতীয় পরম্পরা।
    একই, জীবনানন্দের জীবন নিয়ে উপন্যাস। অবশ্যই পড়া উচিত। বহু পড়াশুনো ও গবেষনাসঞ্জাত লেখা। প্রদীপ দাশশর্মা অন্য ধারার গদ্যে উল্লেখযোগ্য নাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন