এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে এখনো শ্রমদাস!

    বিপ্লব রহমান লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৯ আগস্ট ২০১৮ | ১১৫৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • "সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা অন্যের জমিতে প্রতিদিন বাধ্যতামূলকভাবে মজুরি (শ্রম) দিয়ে আসছি। কেউ মজুরি দিতে না পারলে তার বদলে গ্রামের অন্য কোনো নারী-পুরুষকে মজুরি দিতে হয়। নইলে জরিমানা বা শাস্তির ভয় আছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভয় যেকোনো সময় জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার।"

    চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ঢালে প্রায় ১০ হাজার ত্রিপুরা জনজাতির শ্রম দাসত্বের চিত্রটি এভাবেই ফুটিয়ে তুললেন ছোট কুমিরা নামক আদিবাসী পল্লীর নিকুঞ্জ ত্রিপুরা (৭০)।

    কিছুদিন আগে পেশাগত কারণে সেখানের ছোট কুমিরা, বড় কুমিরা, সুলতানী মন্দির, মহাদেবপুরসহ বিভিন্ন ত্রিপুরা আদিবাসী পল্লী ঘুরে দেখা যায় ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবন। ভূমিহীন, হত-দরিদ্র ত্রিপুরারা সেখানে অন্যের জমিতে বসবাস করেন। জীবিকার জন্য বংশপরম্পরায় তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে ব্যক্তিমালিকানার জমি ও ফলবাগানে শ্রম দিতে হয়। বিনিময়ে তাঁরা পান মাথাপিছু দৈনিক ১৪০ টাকা। কোনো কারণে এই শ্রম দিতে ব্যর্থ হলে তাঁদের দিতে হয় বদলি শ্রম অথবা জরিমানা।

    এতো কিছুর পরও ফসলের জমি ও ফলবাগানের সম্পদ ভোগ করার কোনো অধিকার তাদের নেই। সেখানে নেই শিক্ষা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, সুপেয় জল বা বিদ্যুৎ সুবিধা। উপরন্তু ঝুপড়ি কুঁড়ে ঘরগুলোতে বসবাসের জন্য একেকটি গ্রাম থেকে তাদের জমির মালিককে বছরে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।

    বন বিভাগের সংরক্ষিত পাহাড়-বনাঞ্চল ও ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলায় অনুমতি না থাকায় তারা হারিয়ে ফেলেছেন জুম চাষ ও শিকারের ঐতিহ্য। এতোকিছুর পরেও বাড়তি দুর্ভোগ হিসেবে রয়েছে প্রতি মুহূর্তে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক।

    স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা আলাপকালে জানালেন, ত্রিপুরাদের এই দুরবস্থা সম্পর্কে তারাও ওয়াকিবহাল। কিন্তু সীতাকুণ্ডের জায়গা-জমি 'অকৃষিভুক্ত' বলে চিহ্নিত হওয়ায় সেখানের খাসজমিতে তাদের পুনর্বাসনে আইনগত সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, তবে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল সিদ্ধান্ত নিলে বিশেষ বিবেচনায় নীতিমালা শিথিল করে ত্রিপুরাদের খাসজমিতে পুনর্বাসন করা সম্ভব। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় বলে মনে করেন তারা।

    ছোট কুমিরা ত্রিপুরা পল্লীর কর্ণরাম ত্রিপুরা (৪০) এই লেখককে জানান, ব্রিটিশ তারা পাহাড় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন সেখানে ৯০টি পরিবারের বসবাস। আশপাশের টিলাসহ গ্রামটি অনেক বছর ধরে জহুর আহমেদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির ইজারাধীন। খুব ভোরে গ্রামের নারী-পুরুষরা 'মালিকের' রাবার বাগানে শ্রম দিতে যান। সেখানে বাগান পরিষ্কার করার পাশাপাশি জঙ্গল থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করার কাজও করেন তারা। এই করে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন কাটছে।

    কয়েক বছর আগে 'ইপসা' নামের একটি বেসরকারি সংস্থা সেখানে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। বেশকিছু আদিবাসী ছেলেমেয়ে সেখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে, এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি পুরো গ্রামে।

    ইপসা ছাড়া অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এখনো কোনো রকম নাগরিক সুবিধাই গ্রামটিতে পৌঁছে দেয়নি। পানীয়জলের জন্য এখনো গ্রামবাসী পাতকুয়া ও ছড়ার ওপর নির্ভরশীল। স্যানিটেশন ব্যবস্থাও নেই। সন্ধ্যা ঘনালে কেরোসিনের কুপি বাতির টিমটিমে আলোই ভরসা।

    অন্যদিকে, মহাদেবপুর ত্রিপুরা পল্লীতে কোনো স্কুলও নেই। সেখানে বসবাসকারী ৪৫টি আদিবাসী পরিবার ভিন্ন ধরনের শোষণের শিকার। ওই পল্লীর পঞ্চকুমার ত্রিপুরা (৬৫) এই লেখককে জানান, প্রায় ৩৫ বছর আগে জঙ্গল পরিষ্কার করে তারা গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানকার ইজারাদার ইস্কান্দর চৌধুরীর সঙ্গে মৌখিক চুক্তিতে গ্রামবাসী আশপাশের টিলায় বিশাল কাঁঠাল বাগান ও পেয়ারা বাগান তৈরি করেন।

    তখন কথা ছিলো, আদিবাসীরা প্রতিবছর এসব ফলের আধাআধি ভাগ পাবেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই চুক্তির কথা অস্বীকার করেন ইজারাদার। তখন থেকেই ফলদ সম্পদের ওপর অধিকার হারিয়ে গ্রামবাসী নিজেদের তৈরি ফলবাগানে বাধ্যতামূলক শ্রম দিয়ে আসছেন। ইজারাদারের মৃত্যুর পর তার ছেলেরা বাগান ও গ্রামের ইজারাদার হয়েছেন। কিন্তু আদিবাসীদের ভাগ্য ফেরেনি।

    ওই গ্রামের বাসিন্দা মনিবালা ত্রিপুরা (৫০) বললেন:

    মালিক আমাদের জমি থেকে উঠে যেতে বললে যে কোনো সময় উচ্ছেদ হতে হবে। তখন আমরা যাব কোথায়? ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে খাব কী? এখানে তবু কোনো রকমে বেঁচে তো আছি!..

    ত্রিপুরা গ্রামগুলো ঘুরে দেখার পুরো সময় সাংবাদিক-মানবাধিকার কর্মীর ছোট্ট দলটিকে ঘিরে রাখে এক ঝাঁক হতদরিদ্র আদিবাসী শিশু। অধিকাংশই বাংলা ভাষা বোঝে না, শহুরে 'বাঙাল'দের কাজকর্ম দেখাতেই তাদের যতো আগ্রহ।কাজের ফাঁকে মোবাইল ফোনের ক্যামেরাতে তোলা হয় বেশকিছু আলোকচিত্র। সব দুঃখগাঁথা ছাপিয়ে ছবি তুলতে শিশুরাই দেখায় ব্যপক উৎসাহ।

    চন্দ্র বিজয় বা নয়া গ্যালাক্সি আবিস্কার বা ক্লোনের পর ল্যাবরেটরীতে প্রাণ সৃষ্টির মহা মহা কীর্তি গাঁথার যুগেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে অল্প কয়েক কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক চন্দ্রনাথের পাহাড়ের কোলের ত্রিপুরাদের এই দূরাবস্থার কথা জেনে পথপ্রদর্শক সহযাত্রী ত্রিপুরা ছাত্রছাত্রীদের মুখে বাক্য সরে না।

    খাগড়াছড়ির বাসিন্দা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী পিপিকা ত্রিপুরা ফেরার পথে বললেন:

    এখানের আদিবাসীরা এখনো যেনো সেই সামন্তযুগেই আটকে আছে! দু-মুঠো আহার যোগাড় করতেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম জীবনপাত করছে। কেউ তাদের পাশে নেই!
    "পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ" (একুশে বইমেলা, ২০১৫, সংহতি প্রকাশন, কাঁটাবন ঢাকা) বই থেকে।...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৯ আগস্ট ২০১৮ | ১১৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রৌহিন | 342323.191.0134.245 (*) | ১০ আগস্ট ২০১৮ ০৩:৫৭63641
  • এই ইজারাদারদের কী বক্তব্য? এভাবে ভূমিদাস নিয়োগ কি বে-আইনী নয়?
  • বিপ্লব রহমান | 9001212.30.2334.177 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৮ ০৫:৩৪63642
  • অবশ্যই বেআইনী। ইজারাদারদের কেউ মিডিয়ার সাথে কথা বলতে রাজি নন। তাই তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

    আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি জানালেন, সীতাকুণ্ডে খাস জমি নেই দেখে ভূমিহীনদের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যাচ্ছে না।

    আমরা তাকে "একটি বাড়ি একটি খামার" ইত্যাদি সরকারি প্রকল্পে অসহায় মানুষগুলোকে পুনর্বাসনের কথা বলেছি। কিন্তু কবে যে নথি উর্ধ্বদিকে ধাবিত হবে? ততদিন এই জনপদ টিকে থাকবে তো? দেশান্তরী হতে বাধ্য হবে না?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন