এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • পুঁটিকাহিনী ৬ - পারুলদি পর্ব

    San Gita লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২২ মে ২০১৭ | ১৪৯৪ বার পঠিত
  • পুঁটির বিয়ের আগে শাশুড়িমা বললেন যে, ওবাড়ি গিয়ে পুঁটিকে কাজকম্মো বিশেষ করতে হবে না। ওমা! তাও আবার হয় নাকি! গিয়ে কিন্তু দেখা গেল, সত্যিই তাই। পুঁটি সপ্তাভর আপিস করে আর সপ্তাহান্তে মাসতুতো-মামাতো দেওর-ননদ জুটিয়ে দিনভর আড্ডা- অন্তাক্ষরী-তাস খেলা এ সব করে। শখের রান্না বা ঘর গোছানো এসব করতে ইচ্ছে হলে করে, আর কিছু না। যা করে, তার আবার বিস্তর প্রশংসা পায়! শান্ত পরিবারটি হইচইবাজ পুঁটিকে পেয়ে বেশ খুশি হয়ে উঠল।

    শাশুড়িমা যেমন ভালোমানুষ, তেমন কর্মঠ। তাঁর সাথে ঘরের কাজ করার জন্য দুই বোন আছে। ছোট বোন শীলাদি, তখন বছর ৩৬-৩৭, সকালে আর বিকেলে এসে ঘরদোর ঝাঁটপাট দেওয়া, বাসন মাজা এ সব করে আর বড় বোন পারুলদি, অনেকটাই বড়, তখনই পঞ্চাশের ওপর, সারাদিন থাকে, রাঁধে, বাড়ে, অন্য কাজও করে, সন্ধ্যেবেলা বাড়ি যায়- পারুলদির ভাষায় সে "ভোদির হেল (হেল্প) টানে"। ও! বলা হয়নি তো সে পুঁটিকে ডাকে "ভৌ"(বৌ), পুঁটির শাশুড়িমাকে "ভোদি"(ভোদি) আর শ্বশুরমশাইকে নির্ভুল "দাদা", তবে বেশি পুলকিত হলে মাঝেমাঝে "দোস্তিভাই"ও ডাকে বইকি- ঘোষদস্তিদার থেকে কিভাবে এই ডাকে উপনীত হয়েছিল, সে একমাত্র পারুলদিই জানত! এছাড়া বাড়ির দুই ছেলেমেয়েকে নাম ধরেই ডাকত পারুলদি- ওদের অনেক ছোট থেকে চেনে, পুঁটির কত্তামশাই তো বিয়ে করতে যাবার সময় সব বড়োদের সাথে পারুলদিকেও প্রণাম করে গিয়েছিল।

    পারুলদির অফুরান প্রাণশক্তি। যেমনে তার শরীরে উদ্যম, তেমনই তার গলায় জোর। ফলপাকুড় চুরি করতে আসা বাচ্চাপার্টিদের পিলে চমকে দেওয়ার জন্য পারুলদির একটা "কে রে?" হাঁকই যথেষ্ট। আবার চোখের নিমেষে খাবার রেডি করে দেওয়া বা ভারী লেপতোষক টেনে ছাদে নিয়ে রোদে দেওয়া তার বাঁ হাতের খেল।

    দুপুরে খাওয়ার পর মাটিতে মাদুরটি বিছিয়ে আধশোয়া হয়ে টিভিতে বাংলা সিনেমা চালায় পারুলদি। যত অখাদ্য সিনেমা, ততই তার আমোদ বেশি। নায়িকার দুঃখে সে এক্কেবারে নাকের জলে চোখের জলে হয়ে হেঁচকি তুলতে থাকে, আবার নায়ক যখন ভিলেনকে পেটায়, তখন উত্তেজনায় উঠে বসে "মার, মার!" বলে নিজের বাঁ হাতের তেলোয় ডান হাত দিয়ে ঘুঁষি মারে, বাকিরা তার ঐ মারমুখী চেহারা দেখে কোথায় পালাবে ভেবে পায় না তখন!

    তার গল্পের ঝুলিতেও অনেক গল্প- কে যেন বিয়ের আগে খুব রোগা ছিল, বিয়ের পরে খুব "টল ফিগার" হয়েছে, ভ্যাবাগঙ্গারাম পুঁটি বুঝতে পারছে না দেখে দুপাশে হাত ছড়িয়ে কতটা "টল" অর্থাৎ আয়তনবৃদ্ধি হয়েছে বুঝিয়ে দেয় পারুলদি।

    তারপর ধরুন যেবার পাড়ার সবাই মিলে তারকেশ্বর যাওয়া হয়েছিল- আগে থেকে ঘর "ভোক" করাই ছিল, ফলে কোন অসুবিধাই হয়নি।

    একবার পাড়ায় মারুতি ভ্যানে করে বেডশীট, বেডকভার এ সব বিক্রি করতে এল। পারুলদি দেখা গেল খুবই আপ্লুত, তাদের পাড়াতেও নাকি এরা গতকাল বিক্কিরি করতে গিয়েছিল, অনেকে কিনেছে, বেশ ভালো- "এট্টা চাদরে নয়ডা গিট"। আপনারা কে কী বুঝলেন জানিনা, বোকাবুদ্ধু পুঁটি বুঝল যে এরা শুধু বাঁধনি চাদর বেচে। কিন্তু দুজন দুদিকে ধরে যে চাদরটা দেখাচ্ছে, দোতলার বারান্দা দিয়ে দেখে তো সেটাকে কোনমতেই বাঁধনি মনে হচ্ছে না। তবে? পারুলদির কথায় কান পাতে আবার "পেন দেসে, চিরুনি দেসে, আয়না ... " ও হরি!! একটা চাদরের সাথে ওরা ন'টা করে গিফ্ট দিচ্ছে তবে!!

    পুঁটির পুত্তুর আসার পর তার সাথেও খুব খেলা করত পারুলদি। খাওয়ায় প্রচন্ড অনাগ্রহী শিশুকে দিনের বেলা টিকটিকি দেখিয়ে " আয়, আয়, আয়, আয়, টি টি টি টি, ভাত খাইয়া যা" আর সন্ধ্যেবেলা চাঁদকে ডেকে
    "আয় চাঁদ লড়িয়া
    ভাত দিমু বাড়িয়া
    রাংগা সুতার কাপড় দিম
    খাটের তলায় হুতি দিম
    দুধ খাবার বাটি দিম
    সোনার কপালে চাঁদ টি দিয়া যা"
    করে মনোরঞ্জন করায় কোন ক্লান্তি ছিল না পারুলদির।

    ছেলেদের ছোটবেলাতেই স্বামীকে হারিয়েছে পারুলদি, কিন্তু হেরে যায়নি এক দিনের জন্যেও। লোকের বাড়িতে কাজ করে একফালি জমি কিনেছে, হোক না কলোনীতে, চায়ের দোকান দিয়েছে, বাড়িও তুলেছে কষ্টেসৃষ্টে। বড়ছেলে, বড়বৌমা আর নিজে মিলে চায়ের দোকানটা চালাত আর ছোট ছেলে ড্রাইভিং শিখে ট্যাক্সি চালাত।

    ভোর চারটেয় উঠে দোকানের জল ভরা, উনোন ধরানো দিয়ে দিন শুরু হত পারুলদির, তারপর সারাদিন ধরে দফায় দফায় রুটি, ডিমসেদ্ধ, টোষ্ট, ঘুগনি, বেগুনী, আলুর চপ, তড়কা, ডিম কষা আর একশো দফা চা করতে করতে রাত এগারোটায় দিন শেষ হত। বড় মায়া ছিল ঐ চিলতে দোকানটার ওপর। কিন্তু একবার কী নিয়ে যেন জোর ঝামেলা বাঁধল মা-ছেলেতে। ছেলে-বৌমা মায়ের দোকানে ঢোকাই ঘুচিয়ে দিল। আবার লোকের বাড়িতে কাজে লাগতে হল পারুলদিকে।

    পুঁটিদের রান্নাঘরের জানলা থেকে ওদের চায়ের দোকানটা দিব্যি দেখা যায়। রান্না করতে করতে কখনও কখনও অন্যমনস্ক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে পারুলদি। কখনও বা চায়ের দোকানের ভাষা উঠে আসে মুখে, হঠাৎ এসে যাওয়া এক-আধজন অতিথির জন্য নিজেদের ৫ কাপ চা থেকে "পাইল" করে আরো ১ কাপ চা বাড়িয়ে দেয় সে।

    চায়ের সাথে আরো যে সব খাবারদাবার বানিয়ে বিক্কিরি করত পারুলদি, সেই পদগুলো বড় ভাল রাঁধত। একবার বললেই খুশী হয়ে বানিয়ে ফেলত সেসব। সেই মুচমুচে বেগুনী, ঝালঝাল ডিমকষা আজও যেন মুখে লেগে আছে পুঁটির।

    কয়েক বছর পরে একসময় মায়েপোয়ে আবার ভাব হয়ে যায় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে, পারুলদি পুঁটিদের বাড়ির গন্ডি ছাড়িয়ে আবার পুরনো দোকানে পা রাখে। কিন্তু আসাযাওয়ার পথে দেখা হলে "ভৌ"-এর আর বাড়ির বাকিদের খবর নিতে ভোলে না এখনও।

    ©sangitaghoshdastidar
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২২ মে ২০১৭ | ১৪৯৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kihobejene | 83.189.88.246 (*) | ২২ মে ২০১৭ ০৬:২৫59804
  • khub bhalo laglo ... aro aro likhun ...
  • Kallol | 213.99.211.135 (*) | ২৬ মে ২০১৭ ১০:৩২59805
  • ছোটোবেলা ফিরিয়ে দিলেন - এরা সবাই আমার ভীষণ চেনা, শীলা-দি, পারুল-দি আর সেই শান্ত পল্লীশ্রী, এক লহমায় কয়েক দশক পিছিয়ে গেলাম
  • San gita | 57.15.5.151 (*) | ২৬ মে ২০১৭ ১০:৪৫59806
  • আপনি কি সিংহ বাড়ির আত্মীয়?
  • Kallol | 213.99.211.135 (*) | ২৬ মে ২০১৭ ১০:৫৬59807
  • পরমাত্মীয় বলতে পারেন - আমার মামাবাড়ী
  • San Gita | 57.15.5.151 (*) | ২৬ মে ২০১৭ ১১:১৬59808
  • হু, ঠিকই চিনেছি আপনাকে। ডাকনামটাই যদিও শুনেছি বেশি।
  • Kallol | 213.99.211.135 (*) | ২৬ মে ২০১৭ ১১:৩৪59809
  • পৃথিবী সত্যিই খুব ছোট্ট জায়্গা ঃ-)
  • pi | 167.50.15.253 (*) | ২৭ মে ২০১৭ ০৩:০১59810
  • ভাল লাগল পারুলদির গল্প।

    'খাটের তলায় হুতি দিম' মানে কী ? শুতে দেওয়া ?
  • San Gita | 57.15.4.70 (*) | ২৭ মে ২০১৭ ০৩:২৫59811
  • হ্যাঁ। আচ্ছা, বলো দেখি চাঁদের কি জায়গা কম পড়িয়াছে যে খাটের তলায় শোয়ার লোভে নেমে আসবে?
  • pi | 167.50.15.253 (*) | ২৭ মে ২০১৭ ০৩:২৮59812
  • সেটাই। খাটের উপরে শুতে দেবার, পাশবালিশ দেবার অফার দিলে তাও মনে হয় চাঁদ ভেবে দেখতে পারত।
  • San Gita | 57.15.12.184 (*) | ২৮ মে ২০১৭ ০৫:৫৩59813
  • পুঁটিও সেকথাই বলত পারুলদিকে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন