এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • গোলান পাহাড় ঃ

    dd লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ৬৬২ বার পঠিত
  • গোলান পাহাড় ঃ
    আরব ইস্রায়েলের কুরুক্ষেত্র

    গোলান পাহাড় খুব বড় একটা কিছু মালভূমি নয়। ম্যাপ দেখলে দেখবেন মাত্র সাড়ে চারশো বর্গ মাইলের মতন। খুব চওড়া যেখানে সেখানে সাতাশ মাইল আর দৈর্ঘ্যে সবচে বেশী ৪৫ মাইল। সবথেকে উঁচু যায়গা ১৭০০ ফীট। তবে এই উপত্যকার সেই অর্থে কোনো নিদৃষ্ট সীমান্ত নেই - তাই আয়তনের রকমফের আছে।চারিদিকে উষর সমতলের মাঝে একটা আখাম্বা - যাকে বলে টেবল টপ মাউন্টেইন।আসলে পাহাড় কিছু নয়, টিলা বলাই ভালো। ইংরাজীতে তাই সব সময়েই এই অঞ্চলকে গোলান হাইট বলে। গোলান হিল নয়।
    তবে এটি যেন এক প্রাকৃতিক দুর্গ। মূলতঃ পাথুড়ে,পাহাড়ী জমি।পশ্চিমে বিরাট হ্রদ সী ওফ গ্যালিলি। সেখান থেকে খাড়া উঠে গেছে পাথুরে পাঁচিল। এ ছাড়াও পুবে ও পশ্চিমেও দুই নদীর বন্ধন। ঐ উপত্যকা যার দখলে তার নজরে, এবং তার হাতের মুঠোয় মধ্য প্রাচ্যের অনেক গুরুত্বপুর্ন নগর যেমন সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস বা ইজরয়েলের হাইফা। ইজরায়েলের পানীয় জলের ৪৫ % আসে গোলান উপত্যকার কিনরেট লেক থেকে।ইজরায়েল, সিরিয়া,জর্ডান আর লেবানন - এই চার দেশের সীমান্ত রেখায় এই উপত্যকা।
    যুদ্ধতপ্ত মধ্যপ্রাচ্যে এরকম অঞ্চল বারবারই তাই রণভুমি হয়েছে।

    তিন হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক হাত বদল হয়ে অনেক রক্তে ভিজে গোলান হাইট এখন ইজ্রায়েলের হাতে - সেই ৬৭'র "ছয়দিনের যুদ্ধের" পর থেকেই। আর ৭৩'এ ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের পর আরো জাঁকিয়ে বসবে ইজরায়েল এই উপত্যকায়। এই চার দশকে ইজরায়েল অনেক ম্যাজিক দেখিয়েছে। গোলান হাইট এখন কৃষি জমিতে সবুজ। অনেক কিব্বুত্জ ওখানে। কাগজে কলমে গোলান হাইট এখনো সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। ইজরায়েলী ওকুপেশনের কোনো আন্তর্জাতিক ডিপ্লোম্যাটিক স্বীকৃতি কিছু নেই - তো ইজরায়েলের বয়েই গেছে। অনেক ইহুদীকে গত তিন দশকে তারা গোলান হাইটে "বসিয়েছেন"। তারাও জমি জিরেত নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছেন। আর আছে হাজার দশেক দ্রুজ সিরিয়ান। ধর্ম বিশ্বাসে যারা চমকপ্রদ ভাবে বৌদ্ধিক।
    সেই বাইবেলের সময় থেকেই গোলান পাহাড়ের রক্তপাতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াকু ইহুদীদের শেষ ঘাঁটি ছিলো এই খানেই।

    পঞ্চদশ ও ষোড়োশ শতাব্দীতে আসেন দ্রুজ ধর্মের লোকেরা। কম বেশী সব সময়েই ইহুদীরা থাকতেন গোলানে - মাঝে তুর্কীরা একবার তাদের সমূলে উৎখাত করে - আবার ইতিহাসের পাতা উল্টে যায়। ইহুদীরা ফিরে আসেন।
    উনবিংশ শতাব্দীতে খুব পরিকল্পিত ভাবে ইহুদীরা গোলান পাহাড়ে বসবাস শুরু করতে থাকে। সিরিয়ান মুস্লিম, দ্রুজ আর ইহুদীরা একসাথেই থাকতেন। আধুনিক যুগে গোলান হাইট ছিলো সিরিয়ার এক প্রদেশ।

    সুজলা সুফলা গোলান উপত্যকা অনেক বার হাত বদল হয়েছে । অনেক বার রক্তাক্ত হয়েছে।

    সব থেকে বেশী হলো দুটি আরব ইজরায়েল যুদ্ধে। ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সাল। স্মৃতির দৌড়ে খুব বেশী দুর যেতে হয় না।

    ১৯৬৭ - ছয় দিনের যুদ্ধ।
    ************************************

    ছয় দিনের যুদ্ধ নামেই খ্যাতি। কিন্তু ঠিক ছয় দিন নয় - কোনো ফ্রন্টে একটু কম , কোথাও একটু বেশী। আর " যুদ্ধ" ? সেটাও বোধ হয় অতি কথন। কেন না ইজরায়েলের প্রতিপক্ষ ইজীপ্ট সিরিয়া আর জর্ডান - এই তিন দেশ ভালো করে লড়াই শুরুও করতে পারলো না। ইজরায়েলে যেন এক সুনামীর মতন গুঁড়িয়ে দিলো এই তিন দেশকে।

    আমি শুধু গোলান হাইটের লড়াইএর কথাই লিখছি।

    এই লড়াই শুরু হলো ৫ জুন। প্ররোচিত কিন্তু অঘোষিত ভাবে ইজরায়েল, বিমান হানা দিয়ে সিরিয়ার প্রায় ৭০ ভাগ বিমান ধ্বংশ করে দিলো ৫ জুনের সকালেই।

    সিরীয় বিমান বাহিনীর মিগ ১৫, মিগ ১৭ ও সে সময়কার সব থেকে আধুনিক প্রযুক্তির মিগ ২১ আর আকাশে উড়তেই পারলো না। পার্ল হারবারের জাপানী বিমান হানার মতনই সারপ্রাইজ ও প্রি এম্পটিভ হানায় প্রথম দিনেই কিস্তি মাত করে দিলো ইজরায়েল।

    গোলান পাহাড়ে ভালই ঘাঁটি গেড়ে বসে ছিলেন সিরীয়ান সেনানী। প্রায় দুশো ট্যাংক,অনেক কামান। তাদের সব থেকে বড় শক্তি অবশ্য গোলান হাইটের ভৌগলিক চরিত্র। খাড়া পাহাড় আর আড়া আড়ি বয়ে যাওয়া নদী ও পাহাড়ী ঝর্না। এ বড় দুর্জয় দুর্গ। ঐ দুর্গ থেকে থেকে তারা ক্রমাগতঃ কামান দাগিয়ে ব্যতিবস্ত করে রাখতো সমতলের ইজরয়েলী নাগরিকদের। প্রতি আক্রমনের দুশ্চিন্তা তাদের খুব একটা ছিলো না।
    গোলান হাইটের দুর্ভেদ্যতা নিয়ে শংকিত ছিলো স্বয়ং মোশে ডায়ান। তখন উনি ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। ইজরায়েলের প্রধান মন্ত্রী লেভে এসকফ ও চীফ ওফ স্টাফ ডেভিড এলাজার প্রথম থেকেই গোলান হাইট আক্রমনের পক্ষে ছিলেন কিন্তু ডায়ান আদৌ রাজী ছিলেন না। তার ধারনা ছিলো গোলান পাহাড় দখল নিতে গেলে প্রায় তিরিশ হাজার ইহুদী সেনা ঘায়েল হবেন। তাছাড়াও তখন ইজরায়েল লড়াই করছে সিনাই ফ্রন্টে মিশরের সাথে আর উত্তরে জর্ডানের বিরুদ্ধে। মোশে ডায়ান তৃতীয় ফ্রন্ট খুলতে ভয় পেলেন।

    তাই পাঁচ থেকে আটই জুন পর্য্যন্ত ইজরায়েল গোলান হাইটে শুধুই বিমান থেকে বোমা বর্ষন করে গেলো। "লিমিটেড ওয়ার"।

    অন্য দুই ফ্রন্টে জর্ডান আর ইজীপ্টের তখন কোমর ভেঙে গেছে। বাকী ছিলো শুধু মপিং আপ। কিন্তু মোশে ডায়ান তখনো গোলান হাইটে যুদ্ধে আগ্রহী নন। ডেভিড এলজার বার বারই উৎসাহ দেখাচ্ছেন কিন্তু ডায়ান সাহেব অনড়। আর আরবপক্ষে কথা ছিলো জর্ডন ইজীপ্ট আর সিরীয়া একই সাথে ত্রিমুখী আক্রমন করবে ইস্রায়েলকে কিন্তু প্রথম চারদিনের যুদ্ধে যখন ইজীপ্ট ও জর্ডন বেধড়ক মার খাচ্ছে তখন সিরীয়া শুধু গোলান হাইটে কিছু স্থানীয় আক্রমন ছাড়া আর কিছু করে নি।
    হঠাৎ করেই ৯ জুনের ভোরে সমস্ত প্রোটোকল ভেঙে মোশে ডায়ান গোলান ফ্রন্টের সেনাধ্যক্ষকে আক্রমনের নির্দেশ দিলেন (আইনতঃ সেই নির্দেশ আসা উচিৎ ছিলো চীফ ওফ স্টাফ ডেভিড এলাজারের কাছ থেকে)।কিন্তু হেড আপিসের বড়োবাবুর মতন হঠাৎই যেনো ঘুম ভেঙে তড়বড়িয়ে উঠলেন মোশে ডায়ান। ইজরায়েলের আক্রমনের মুখে তাসের প্রাসাদের মতন ছত্রাকার হয়ে গেলো সিরীয়ান প্রতিরক্ষা। প্রায় বিনা বাধায় দশই জুন ইজরায়েল পুরো গোলান হাইট দখল করে নিলো। মরনপন লড়াই তো দুরের কথা - উপত্যকার অনেক শহর সিরীয়ান সেনানীরা পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেলো। ইস্রায়েলের গোলানী ব্রিগেড এই যুদ্ধে খুব নাম করে। এই গোলানী ব্রিগেড সারাবিশ্বের সেনা মহলেই এক কিংবদন্তী। এই ব্রিগেডের সেনানীরা তাদের উর্ধতন অফিসারদের নাম ধরে ডাকেন - সেনাবাহিনীর হায়ার্কি এই ব্রিগেডের কালচারে নেই। মোশে ডায়ান ভেবেছিলেন না জানি কতই রক্তক্ষয়ী হবে গোলান পাহাড়ের লড়াই ,কিন্তু মাত্র শ খানেক ইহুদী সেনা ঘায়েল হন এই যুদ্ধে।

    ছয় দিনের যুদ্ধ শেষ। একতরফা লড়াই শেষ । এ তো ইতিহাস। তবু তাতেও অনৃতকথন ঘটে যায়। ইতিহাসের পাতা উল্টাতেই থাকে।

    সত্তর দশকের মাঝামাঝি সাংবাদিক রামি টাল এর সাথে কথোপকথনে মোশে ডায়ান জানান সিরিয়া কখনই ইজারায়েল আক্রমনের চেষ্টা করে নি। হ্যাঁ, গোলান পাহাড় থেকে গোলা ছুঁড়ে সমতলের হুলা উপত্যকার ইহুদী চাষাদের " হ্যারাস" করা হতো নিয়মিত ভাবে। ইজরায়েল ও সিরিয়া দু পক্ষই সীমান্তে গোলার লড়াই চালাতো কিন্তু তা ছিলো নেহাৎ ই সীমান্ত সংঘর্ষ। যুদ্ধের প্রথম কদিনে সিরিয়ার আপাত নিস্পৃহতা তাই ইজীপ্ট তথা আরব দুনিয়াকে বিস্মিত ও আহত করেছিলো।
    তাহলে কেনো ঐ লড়াই? মোশে ডায়ান বলেন গোলান হাইটের উর্বর জমির উপর লোভ- কৃষক লবীর চাপেই ঐ লড়াই। যার ফলে সিরিয়া হয়ে গেলো ইজরায়েলের চিরদিনের শত্রু।
    এই ইন্টারভিউ প্রকাশিত হয় কুড়ি বছর পর - মোশে ডায়ানের মৃত্যুর পর। যেমন তিনি অনুরোধ করেছিলেন সাংবাদিক রামি টালকে।

    ইজরায়েল দখল করে নিলো গোলান পাহাড়। দেড় লক্ষ সিরিয়ান অসামরিক কৃষিজীবিকে দূর করে দেওয়া হলো। প্রায় হাজার তিরিশেক ইহুদী পরিবার গোলানে বসবাস শুরু করলেন আর থাকলেন প্রায় পনেরো হাজার ড্রুজ - কৃষক ও মেষপালক।
    "ডি ফ্যাক্টো অকুপ্যান্ট"। জবরদখল। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই এই অকুপেশনের। খাতায় কলমে গোলান এখনো সিরীয়ার অচ্ছেদ্দ্য অংশ। ইজরায়েল অবশ্য এই সব ফিরমানের থোড়াই তোয়াক্কা করে। এই ছয়দিনের এক তরফা যুদ্ধের শুরুতে কিন্তু আরব পক্ষই ছিলো ওভার কনফিডেন্ট। সিরিয়ান সেনানায়ক একজন ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন যে টেনেটুনে চারদিন যুদ্ধ চলবে - তারপরই ইজরায়েল খতম। ইজিপ্টের প্রেসিডেন্ট নাসেরও কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান নি যে ইস্রায়েল আগ বাড়িয়ে আক্রমন করার সাহস দেখাবে। শুধু আমেরিকাই ইস্রায়েলকে বলে এসেছিলো যে আরব পক্ষ সাতদিনের বেশী লড়াই চালাতে পারবে না।

    ১৯৭৩ - ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ
    *********************************
    আরব দেশেরা বড় লজ্জায় পরলো। ছয়দিনের লড়াইতে তাদের সার্বিক হার - এই অপমানের হাত থেকে মুক্তি চাই। সেই মতন তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি চললো জোর কদমে।

    গতবারের যুদ্ধে ইস্রায়েলের একতরফা দাপট ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে এবার তাই আরব পক্ষ বিমান বিরোধী প্রতিরক্ষায় মন দিলেন। রাশিয়া থেকে কিনলেন তারা SAM মানে সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল । সিরিয়ান বাহিনীতে আছে সোভিয়েট ট্যাংক টি ৫৪,টি৫৫ এবং সর্বাধুনিক টি ৬২। এই টি ৬২ তে আছে স্মুথ বোরের ১১৫ মিমি বিরাট কামান। আর আছে নাইট ভিশন যার ফলে নিশুতি রাতের অন্ধকারেও এই ট্যাংক যুদ্ধ করতে পারে। ইস্রায়েল বাহিনীর হাতে পুরোনো আমলের শেরম্যান আর সেনচুরীয়ান ট্যাংক। আধুনিক ট্যাংক বলতে শুধু আমেরিকান প্যাটন ট্যাংক। ১৯৬৭'র ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে খেমকারান রনাঙ্গনেই প্রমান হয়ে গেছিলো প্যাটন ট্যাংকের দুর্বলতা। তবে ইজরায়েলের এই সেঞ্চুরীয়ান ট্যাংকে আপগ্রেড করে নতুন ব্রিটীশ এল- ৭ ,১০৫ মিলিমিটারের কামান বসানো হয়েছিলো যা সিরিয়ান টি৫৫ ট্যাংকের কামানের থেকে বেশী দুরপাল্লার ছিলো। প্রায় সমতল উষর মরু অঞ্চলে কামানের রেঞ্জের প্রয়োজন খুবই বেশী।

    সেই মতন ইজরায়েলী বাহিনীতে কামান দাগানোর প্রশিক্ষন ছিলো খুব গুরুত্বপুর্ণ। তারা জানতেন পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই মরু অঞ্চলে ঠিক নিশানায় কামান চালানো খুব জরুরী। কারন , পাহাড়,জংগল,গাছ - এই সব কোনো আড়ালই নেই যাতে করে ট্যাংক লুকিয়ে থাকতে পারে।ট্যাংক চলতে শুরু করলেই ধুলো ওড়ে - তাই দূর থেকে চোখে পড়বার আগেই টের পাওয়া যায় প্রতিপক্ষের আগমন বার্ত্তা।

    তবে এই যুদ্ধে ইস্রায়েলের সবথেকে বড় শত্রু ছিলো তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর আরব যুদ্ধক্ষমতা নিয়ে তাচ্ছ্যিল্লের ভাব। "ডামাস্কাস পৌছতে লাগবে এক ঘন্টা আর কায়রো পৌছতে দুই" এইধরনের দাদাগিরি মার্কা প্রবাদ তখন খুব প্রচলিত ছিলো ইস্রায়েলে।

    এবারে আর আরব পক্ষে জর্ডান নেই। গতবারের যুদ্ধেই তাদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছিলো। খবর ছিলো জর্ডানের রাজা গোপনে খবর দিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারকে এই আসন্ন যুদ্ধের কথা। কিন্তু ইসরায়েল বিশ্বাসই করতে চায় নি ইজীপ্ট বা সিরিয়া আবার সাহস করে রনাঙ্গনে নামবে।
    ৬ই অক্টোবরে যখন ইজীপ্ট আর সিরীয়া একই সাথে আক্রমন করলো ইস্রায়েল তখন একেবারেই অপ্রস্তুত। আগের বারের মতন ম্যাজিক দেখানো সম্ভব নয়। সিরীয়া ও ইজীপ্ট - দুই দেশেই রয়েছে ঝাঁকে খাঁকে স্যাম টু বিমান ঘাতী মিসাইল। সেই রক্ষাকবচ ভেদ করে ইস্রায়েলের বিমান আর আঘাত হানতে পারলো না।

    প্রায় ১৪০০ ট্যাংক আর হাজার খানেক কামান নিয়ে সিরীয়ান বাহিনী গোলান হাইট আক্রমন করলো ৬ অক্টোবর। সেদিন ছিলো "ইয়ম কিপ্পুর" দিন। ইহুদীদের পবিত্রতম উৎসবের দিন। বহু সেনাই ছুটীতে।সরকারি প্রশাসনও ঢিলে ঢালা।ইজরায়েলে সবাই খুসীর মেজাজে।

    বেলা তখন দুটো।প্রথমেই প্রায় দেড়শো সিরীয়ান বিমান, গোলানে নাগাড়ে বোমা ফেলে গেলো আর কিছুক্ষন পরেই প্রায় এক হাজার কামান একসাথে গোলা ফেলতে লাগলো পুরো গোলান পাহাড়ে।চল্লিশ হাজার সিরীয়ান সেনা তিন ভাগে আক্রমন করলো তাদের ট্যাংক নিয়ে।

    ঠিক সেই সময়েই,ইজরায়েলের অন্য প্রান্তে ইজীপ্ট আক্রমন করেছে সিনাইতে।

    প্যানিক। গোলান হাইটে তখন মাত্র ১৮৮ টি ইজরায়েলী ট্যাংক আছে। সিরীয়ান সেনাবাহিনীর নিউমেরিক্যাল সুপেরিওরিটী প্রায় নয় গুন বেশী। উত্তর গোলানে মাউন্ট হের্মন গোলানের সবথেকে উঁচু অংশ। ওখানে রয়েছে ইস্রায়েলের যাবতীয় পর্য্যবেক্ষনের ঘাঁটী। হেলিকপ্টারে করে সিরীয়ান কম্যান্ডো বাহিনী নেমে খুব সহজেই দখল করে নিলো সেই দুর্গ।তখন মাত্র দুই ঘন্টা হয়েছে সেই যুদ্ধের বয়স।এই ওয়াচ টাওয়ারে ছিলো ইজরায়েলের সেই সময়ের সবথেকে আধুনিক ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম। সিরীয় বাহিনীর সাথে হেলিকপ্টারে উড়ে এসেছিলো রাশান আর ইস্ট জার্মান টেকনিশিয়ানেরা। তারা তড়িঘড়ি সেই ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের দখল নিয়ে পাচার করে দিলো সেই সব।

    সিরীয়ান ট্যাংকে ছিলো নাইট ভিশন। সেই টেকনলজি তখনো বাকী দুনিয়ায় অজানা। তাই নিশুতি রাতেও তারা যুদ্ধ চালাতে পারতো,যেটা ইজরায়েলের সেনাদের কাছে ছিলো না। তাই সন্ধ্যা হয়ে আসতেই সিরীয়ান ট্যাংক বাহিনী হু হু করে এগিয়ে এসেছিলো।

    মধ্যরাতেই সিরীয়ানেরা গোলান হাইটের অনেকটা এলাকা দখল নিয়ে নিলো। সেই সময়েই যদি তারা সমতলে ঝাঁপিয়ে পড়তো তাহলে ইজরায়েল আর রক্ষা পেতো না।কিন্তু তাদের হাইকম্যান্ড নির্দেশ পাঠালো যে এক্ষুনি আর যুদ্ধ নয় - সকালবেলা রিগ্রুপ করে আবার লড়াই শুরু হবে। আজ এখানেই বিশ্রাম।

    পরের দিনে (সাত অক্টোবর) সিরীয়ান বাহিনী দখল করে নিলো গোলান পাহাড়ের সব কটি গুরুত্বপুর্ন অঞ্চল। এক সিরীয়ান কম্যান্ডার রেডিওতে মেসেজ পাঠালেন " সী ওফ গ্যালিলী পুরোটাই আমার চোখের সামনে" । যেন আগের যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি। শুধু বিজিত ও বিজয়ী স্থান পরিবর্তন করেছেন।

    একটা ইন্টেরেস্টিং তথ্য- যখন ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের প্রথম দিকে আরবেরা চমকপ্রদ জয় করছেন তখন অনেক নামকরা সাহেবী কাগজে সেই খবরগুলো ছাপা হতো পিছনের পাতায়। সিরীয়ানেরা গোলান দখল করে নিলে স্বনামধন্য টাইমস সংবাদপরের প্রথম পাতায় স্থান পায় নি এই খবর। ভিয়েতনামের দিয়েন বিয়েন ফুর পতনের খবরও পশ্চিমের সংবাদপত্রেরা খুব দায়সারা ভাবে ছেপে ছিলেন।
    ইস্রায়েল সেনার মধ্যে পরাজয়ী মনভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো। কিছু কিছু যায়গাতে ইস্রায়েলী সৈন্যদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিলো। কোর্ট মার্শালের ভয় দেখিয়ে।তবে সেগুলি ব্যতিক্রম। দক্ষিন গোলানে ইস্রায়েলী ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার বিপন্ন হয়ে পড়লে এক অফিসার, জিভিকা গ্রীনগোল্ড (Zvika Greengold) যে রকম লড়াই করেছিলেন সেটি ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের একটি কিংবদন্তী হয়ে ওঠে। জিভিকা প্রায় কুড়ি ঘন্টা ধরে সিরীয়ান ট্যাংক বাহিনীর সাথে লড়াই করলেন। বার বার তার ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়ে পরছিলো, আবার নতুন ট্যাংকে উঠে কখনো প্রায় একাকী, কখনো প্লাটুনের সাথে জিভিকা একাই একশো হয়ে যুদ্ধ করছিলেন।এ যেন কুরুক্ষেত্রের মহারথীদের লড়াই। বহুবার রথ চুর্ণ হচ্ছে, ঘোড়ারা মারা যাচ্ছে, নিহত হচ্ছে সারথীও - মহারথী আবার নতুন রথে উঠে লড়াই শুরু করছেন। বার বার আহত হয়েছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েন নি। রক্তাত,দগ্ধ,ক্লান্ত জিভিকা অবশেষে রনাঙ্গন ত্যাগ করলেন যখন দেখলেন তার কমরেডেরা তিনটি অটুট প্যাটন ট্যাংক ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে, "আমি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেল্লাম" তিনি পরে বলেছিলেন। যুদ্ধের শেষে জিভিকা একজন ন্যাশনাল হীরো হলেন। লোকের মুখে মুখে অনেক রূপকথা ছড়ালো - যেমন জিভিকা একাই ষাঠটি সিরিয়ান ট্যাংক ধ্বংশ করেছেন।

    আটই অক্টোবর থেকে ইসরায়েল নতুন সেনা পাঠাতে শুরু করলো গোলান হাইটে প্রতি আক্রমনে। এ সময়ে সিরীয়া ও একটি ট্যাকটিক্যাল ভুল করে। গোলান হাইট দখল করে তারা আর এগোলেন না। সে সময়ে সমতলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লে ইস্রায়েলের পক্ষে সেই আক্রমন ঠেকানো নিশ্চয়ই মুশকিল হতো। কিন্তু তাদের মধ্যে ঐ "কিলার ইনস্টিনক্ট" বড় কম ছিলো।সন্ধ্যা নাগাদ গোলান পাহাড়ের দখল নিয়ে তারা পশ্চিমে নীচে নামলেই পেতেন জর্ডান নদী। সেখানকার সেতুগুলি অক্ষতই ছিলো। হু হু করে তারা সমতলে নেমে,জর্ডান নদী পার হয়ে, সম্পুর্ণ অপ্রস্তুত ইজরায়েলের নার্ভ সেন্টারে পৌঁছে যেতে পারতেন। কিন্তু তারা ঝাঁপ বন্ধ করে গোলান পাহাড়েই ঘাঁটী গেঁড়ে বসলেন।

    এবারে ইস্রায়েল তাদের বিমান বাহিনীকে তেমন ভাবে ব্যবহার করতে পারেন নি। গোলান হাইটে একই দিনে তাদের ছটি বিমান ধ্বংশ হয়। ইজরায়েল বড্ডো বেশী তাদের বিমান বাহিনীর উপর নির্ভর করতো। এক ধাক্কায় ছটি বিমান এই সেক্টরে ধ্বংশ হলে তাঁরা চিন্তায় পড়লেন।তবে সিরীয়ান যে স্যাগ্গার টু অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইল ছিলো, যেটি সিনাই ফ্রন্টে ইজরায়েলী ট্যাংক বাহিনীকে বেসামাল করে দিচ্ছিলো, সেটি গোলান পাহারের উঁচু নীচু টেরইনে খুব সুবিধে করতে পারে নি।

    এই ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের অন্য সেক্টরে,অর্থাৎ সিনাইতে সুয়েজ ক্যানাল ক্রস করে ইজিপশিয়ান বাহিনী কিন্তু সিনাইতে এসে গেছেন। কিন্তু ইজরায়েলের কর্ত্তারা জানতেন তার থেকে আরো বেশী বিপদ এই পুর্ব দিকে,গোলান হাইটে। সিরীয়ানরা একবার সমতলে নেমে আসলে তাদের একের পর এক শহর আক্রমনের মুখে পড়বে। তাই তারা রিজার্ভ ফোর্স আর যা কিছু ট্যাংক ছিলো সবই পাঠাতে শুরু করলেন গোলান হাইটে। হাতের কাছে যে কটি ট্যাংক ছিলো সব গুলি ই পাঠিয়ে দিলেন তারা গোলানে। অনেক ট্যাংকে তখনো ভারী মেশিন গান লাগানো হয় নি, অনেক ট্যাংকের কামানগুলির ক্যালিব্রেশন হয় নি - ফলে নিশানা ভুল হবে, কিন্তু কী আর করা। সিরীয়ান বাহিনীকে কিছুতেই সমতলে নামতে দেওয়া চলবে না।
    কিন্তু ঐ জোড়াতালি দেওয়া সেনারাই প্রতি আক্রমন করে মাত্র দু দিনের মধ্যে গোলান হাইট পুনর্দখল করে নিলেন।
    কেনো হেরে গেলো সিরীয়ানরা ? পরিকল্পনার অভাব। যথেষ্ট গোলা ও জ্বালানীই ছিলো না। আর ছিলো ৬৭'র ছয়দিনের যুদ্ধের দুঃস্মৃতি। মাত্র একশো ঘন্টার গোলান যুদ্ধে গোলান পাহাড় হাত বদল হলো দু বার। দু দিন, মাত্র দু দিন সিরীয়া গোলান পাহাড় নিজের দখলে রাখতে পেরেছিলো।হার্ডওয়ারেও সামান্য সমস্যা ছিলো, যেমন সিরিয়ান ট্যাংকগুলির কামান খুব একটা নীচের দিকে নামানো যেতো না। মেরে কেটে ৫% ডিপ্রেস করা যেতো। তাই উঁচু অঞ্চলে থাকলে তাদের নীচের দিকে নিশানা করা মুষ্কিল। কিন্তু ইজরয়েলি ট্যাংকের কামানদের উপরে দিকে এলিভেট করতে কোনো অসুবিধাই ছিলো না।

    ৯ অক্টোবরে গোলান পাহাড়ের নীচে আরব যুদ্ধের বৃহত্তম ট্যাংক যুদ্ধ হলো। সংখ্যায় পাঁচ গুন ছয় গুন বেশী হওয়া স্বত্তেও বিশ্রী ভাবে হেরে গেলো সিরীয়ানেরা রনাঙ্গন " ভ্যালী ওফ টীয়ার্স"'এ। গোলান পাহাড়ের উত্তরে মাউন্ট হেরমন - যেটি সিরীয়ান কম্যান্ডোরা দখলে নিয়ে ছিলেন ছয় অক্টোবর, সেখানে কিছুটা রুখে দাড়ালেন তারা। অবশেষে বাইশে অক্টোবর, সেই মাউন্ট হেরমন ও ইস্রায়েলী বাহিনীর কবজায় চলে এলো।

    সেই ভ্যালী অফ টীয়ার্সের যুদ্ধে লেফটেনান্ট কর্নেল এভিগডর কাহালনি খুব নাম করেন। সমুদ্রের ঢেউএর মতন সিরীয়ান ট্যাংক আসছে আর একটা ছোটো টিলার উপর কাহালানি তার স্বল্প সংখ্যক ট্যাংক নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। যদিও প্রচুর সিরীয়ান ট্যাংক ধ্বংশ হচ্চিলো তাও ইস্রায়েলী ট্যাংকেরা একটি দুটি করে ক্রমশঃ পিছু হঠতে শুরু করলো। কাহালানী রেডিও মারফৎ তার ট্যাংকদের বল্লেন "আমরা ওদের থেকে ভালো যোদ্ধা, চলো ওদের আক্রমন করি" এবং তার ট্যাংক চালিয়ে টিলার সবথেকে উঁচু যায়গায় উঠে কামান দাগাতে শুরু করলেন। অমন অরক্ষিত যায়গায় ট্যাংক নিয়ে যাওয়া মানে প্রায় নিশ্চিত সুইসাইড - কিন্তু এর ফল হলো দুটো। এক তো ইসরয়েলী ট্যাংকেরা নতুন উৎসাহে আবার ফ্রন্টলাইনে চলে এলেন আর সিরীয়ানেরা ভাবলো বোধহয় নতুন ট্যাংক বাহিনী এসে গেছে। তারা পিছু হটলেন - প্রায় তিনশো বিধ্বস্ত ট্যাংক পরে রইলো । কাহালানীর ট্যাংক সেই যুদ্ধে সতেরোটি সিরীয়ান ট্যাংক চুর্ন করেছিলো, তার মধ্যে একটা মাত্র দশ ফীট দুর থেকে। কাহালনী তার ট্যাংকের "জালনা" দিয়ে একসময় দেখলেন সামনেটা পুরোটাই অন্ধকার। তার ৬৭ সালের যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় বুঝলেন খুব সামনেই কোনো ট্যাংক এসে গেছে। তিনি তার গোলন্দাজ বল্লেন এখনই ফায়ার করো। গানার প্রশ্ন করলো রেঞ্জ কত দেবো? অধৈর্য্য কাহালনি গানারের পিঠে এক লাথি মেরে চিৎকার করে বল্লেন ট্রিগার দাবাও। এক্ষুনি ট্রিগার দাবাও। সেই গোলাতেই তার সপ্তদশতম শিকার ঘায়েল হয়েছিলো।

    গোলান পাহাড় দখল করেই কিন্তু ইজরায়েলী বাহিনী বসে থাকে নি।তারা হু হুকরে সমতলে নেমে ছত্রভংগ সিরিয়ান বাহিনীকে ধাওয়া করে পৌঁছে গেলেন দামাস্কাস শহরের ৪০ কিলোমিটার দুরে পৌছে গিয়ে দামাস্কাসের শহরতলীতে গোলাবর্ষন করেতে শুরু করে দিলেন।বাইশে অক্টোবরে ইজরাইলী বাহিনী দামাস্কাসের মাত্র দশ মাইল দূরেই পৌঁছে যান। শহর দখলের লড়াই করার মতন ক্ষমতা ইজরায়েলের ছিলো না। পরের দিনই "যুদ্ধ বিরতি" ঘোষণা হয় - যদিও খুচ খাচ সংঘর্ষ আরো কিছুদিন চলবে।পরে অবশ্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিয়ে,ইজরায়েল পিছু হঠে আসে ,কিন্তু গোলান পাহাড় আর সিরীয়াকে ফেরৎ দেয় নি।

    ইতিহাসের তথ্যানুসন্ধান কখনো থেমে থাকে না। এই যুদ্ধের পরে আরব দুনিয়া তাদের হৃত আত্মসন্মান অনেকটাই আবার ফিরে পেলেন। ইস্রায়েলীরা যে অবধ্য অজেয় নয় এটাও প্রমান হলো। নিশ্চিত কেউই কিছু বলতে পারে না কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে ইস্রায়েলের হারাবার অনেক কিছুই আছে। ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদী সৈন্য মারা যান। ইস্রায়েল খুব ছোট্টো দেশ - এই আড়াই হাজার তরুনকে হারানো তার পক্ষে একটা বিপদ্জনক সংখ্যা। কেন না এই গতিতে যুদ্ধ করলে সেনা আর অর্থ - দুটি ই ফুরিয়ে যাবে ইস্রায়েলের।

    দুই তরফে কার কতো ট্যাংক আর প্লেন ধ্বংশ হয়েছে তার নির্ভরযোগ্য তথ্য দেখলে অবাক হতে হয়। মনে হয় এতো বলিউডের সিনেমা। কিন্তু ইজরায়েলের তুলনায় ক্ষয় ক্ষতি আরবপক্ষে সত্যিই অবিশ্বাস্য রকমের বেশী। কিন্তু সিনাই ফ্রন্টে আর একতরফা হারে নি ইজিপশিয়ানেরা - সেটা একটা স্টেলমেট হয়ে ঝুলে ছিলো। সেটাই আরব পক্ষের লাভ।

    এই লড়াইকে ইজীপ্টে বলা হয় "রামদানের যুদ্ধ" আর কায়রো শহরে নানান বিজয় স্তম্ভ বানিয়ে ,যুদ্ধ জয়ের স্মারক মিউজিয়াম বানিয়ে এখনো ইজীপ্টে ওটা এক জাতীয় বিজয় দিবস।
    ইজরায়েলের পার্মানেন্ট সেনা বাহিনীও ছোটো - যেটা রয়েছে সেটা হচ্ছে রিজার্ভ ফোর্স। বাধ্যতামূলক তিন বছরের সামরিক ট্রেইনিং নিতো সব সবল তরুনেরাই (এখন মেয়েরাও এতে অংশ নেন)- কিন্তু তাদেরকে একসাথে ডাক দিলে দেশ চলবে কী করে ? দোকানপাট, আপিস কাছারি সবই তো লোকশুন্য হয়ে পড়বে।

    তুলনায় আরব জোটের পক্ষে সব কটি আরব দেশতো আছেই - এমন কি যারা আরব নন কিন্তু মুসলিম দেশ,যেমন মরক্কো বা পাকিস্তান - এরাও সেনা দিয়ে সাহায্য করে। এই যুদ্ধেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। মূলতঃ ইরাক ছাড়াও আরো অনেক দেশের সেনারাই আরব পক্ষে যোগ দেয়। প্রতিটি আরব দেশই অস্ত্র শস্ত্র ও সেনা দিয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে এই যুদ্ধে যোগদান করেছিলো। প্রায় এক লক্ষ অন্যান্য আরব দেশের সেনারা ছিলো ইজরায়েলের প্রতিপক্ষে। আরব ছাড়াও আরো কিছু কিছু মুসলিম দেশ যেমন,সুদান,পাকিস্তান আর মরোক্কোও সেনা পাঠায়। নর্থ কোরিয়া পাঠায় কুরি জন বৈমানিককে, কিউবাও পাঠায় প্রায় হাজার তিনেক সেনা।

    আরবরা কেনো বার বার হেরে যায় ইস্রায়েলের কাছে। ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩। এটা কি জাতি গত বৈশিষ্ট্য ?
    খুবই বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু আলোচোনা কম হয় নি। মিলিটারী হিস্টরিয়ান জন কীগান দেখিয়েছেন ইওরোপীয় "মুখোমুখী সংঘর্ষ"'র বদলে আরবদের যুদ্ধ চিরকালই বিদ্রোহ,অন্তর্ঘাত, উপদলীয় রাজনীতি ও কূটযুদ্ধ নির্ভর। ৭৩'র সুয়েজ পার হবার চমকপ্রদ রনকৌশলও ছলনা (deception) ও কূটযুদ্ধের দারুন ব্যবহার। কিন্তু ইসরায়েলের সাথে মুখোমুখী সংঘর্ষ শুরু হতেই - সিরীয়া বা ইজীপ্ট, কেউই লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় নি।

    টি ই লরেন্স বলতেন আরব রননীতি হচ্ছে "লড়াই না করে যুদ্ধ জেতা" । আরেক ফৌজী ঐতিহাসিক কেনেথ পোলাক বলেছিলেন certain patterns of behavior fostered by the dominant Arab culture were the most important factors contributing to the limited military effectiveness of Arab armies and air forces from 1945 to 1991.These attributes included over-centralization, discouraging initiative, lack of flexibility, manipulation of information, and the discouragement of leadership at the junior officer level.

    এই মতগুলি তর্ক সাপেক্ষ। কিন্তু আরব ইসরায়েলের লড়াই বড়ই একপেশে। বহুগুন বেশী সেনানী ও অতি আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়েও কোন যাদুতে বার বার হেরে যায় ইস্রায়েলের কাছে সেটা না হলে রহস্যই থেকে আর ইস্রায়েল? ছয় বছর আগে যেমন হেলায় তিন আরব দেশকে নাস্তানাবুদ করেছিলো মাত্র তিন চার দিনে, এবারে কেনো শুধু সন্মানজনক ড্র ? এক ঐতিহাসিক তো এই ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধকে ইস্রায়েলের পক্ষে "কোয়ালিফায়েড ডিফিট" আখ্যাই দিয়েছিলেন ।যদিও, গোলান হাইট ফ্রন্টে ইজরায়েলের বিজয় নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই তবে সিনাই ফ্রন্টে বেশীদিন যুদ্ধ চললে কী হতো বলা মুশকিল।
    আমেরিকান যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ রবর্ট এস বলিয়া চারটি কারন নির্দেশ করেছেন - যেমন ঃ

    প্রথমতঃ আরবদের প্রতি তাচ্ছিল্যের মনোভাব। যেটা আদৌ পেশাদারী চরিত্র নয়। যার ফলে তেমন ভাবে তৈরী হয়নি ইস্রায়েল।এই অবজ্ঞার মনোভাবকে "রেসিস্ট" বলতেও দ্বিধা করেননি এক ঐতিহাসিক।

    দ্বিতীয়তঃ টেকনলজির উপর অহেতুক বেশী নির্ভরতা। অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে - তারাই সব করবে। ইনফ্যান্ট্রীর আর কী প্রয়োজন? উদাহরন দিয়েছেন ১২ই অক্টোবরের টেল শামসের লড়াইএর। প্রথম দিন আঠাশটি ট্যাংক নিয়ে ইস্রায়েল ঐ ছোটো পাহাড় দখল করতে গেলে সিরীয়ান বাহিনীর হাতে রীতিমতন নাস্তানাবুদ হয়ে পিছিয়ে আসে। আঠাশটির মধ্যে ছাব্বিশটি ট্যাংকই ধ্বংশ হয় সিরীয়ান সাগ্গার এ টি ৩ মিসাইলের আঘাতে। পরের দিন ইস্রায়েল আবার আক্রমন করে - এবারে প্যারাট্রুপার সেনা নিয়ে। কয়েক ঘন্টার লড়াইতে ছিনিয়ে নেয় ঐ পাহাড় - আর তাদের ক্ষতি? মাত্র চারজন সেনা জখম হয়।

    তৃতীয়তঃ তাদের গুপ্তচর বিভাগের উপর অনাবশ্যক আস্থা। আরব দেশগুলির স্যাম বিমান বিদ্ধংশী মিসাইলের কথা ইস্রায়েলের সবাই জানতো, কিন্তু তাদের বিশ্বাস ছিলো আরব দেশ গুলির আক্রমনের খবর তারা আগেই পাবে এবং তখন আবার ৬৭ সালের মতন প্রি এম্পটিভ এয়ার স্ট্রাইক করে যুদ্ধ জিতে যাবে।

    আর শেষ পয়েন্ট ঃ রণনীতির সুপন্ডিত ক্লসউইত্জ (Clausewitz) যাকে বলতেন Volksgeist , অনুবাদে বলা যায় দেশপ্রেম সেটায় ঠিক টান না পরলেও কোথাও একটা খামতি ছিলো। সেটা উদ্দীপনার। ৬৭ সালে ইস্রায়েল সেনারা মনে প্রানে বিশ্বাস করতো এ লড়াই বাঁচার লড়াই , এ লড়াই জিততে হবে। জানতো যে এ লড়াই না জিতলে তারা কেউ বেঁচে ফিরবে না। গোটা ইস্রায়েল দেশ, ইহুদী জাতি - সবটাই বিপন্ন হবে। ১৯৭৩ সালে এই ভয় আর ছিলো না। আমেরিকা ব্রিটেইন পাশেই আছে, কিছু একটা হয়ে যাবে।

    ৭৩এর যুদ্ধ শেষ হলো। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি হলো। জর্ডান নদী দিয়ে অনেক জল গড়ালো। গোলান পাহাড় এখন এক ট্যুরিস্ট স্পট।

    শুধু দেড়লক্ষ সিরীয়ান চাষা আর মেষপালক - যারা ঘরছাড়া হলো ,তাদের যুদ্ধ বোধহয় এখনো শেষ হয় নি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ৬৬২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    চম - dd
    আরও পড়ুন
    ও শানওয়ালা - dd
    আরও পড়ুন
    দ্রোণ পর্ব - dd
    আরও পড়ুন
    কর্ণসংহার - dd
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Rit | 213.110.243.23 (*) | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৬:৪২57505
  • ডিডি স্যর,
    বড্ড ভালো লেখা।
  • avi | 113.252.164.43 (*) | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৭:৩২57506
  • এ জিনিস বাংলায় পাই না। নীরদচন্দ্রের কিছু লেখায় আভাস ছিল। আরো আরো আসুক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন