এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • রিয়েক্টর

    জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণ্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৫ মে ২০১৯ | ১৮৪২ বার পঠিত
  • মাঝরাতে চিপস খেয়ে জানালা দিয়ে খালি প্যাকেট ফেলতে গিয়ে দেখি গাছতলায় এক ছায়ামূর্তি বসে বসে মাথার চুল ছিঁড়ছে।

    স্বাভাবিকভাবেই আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম।‌ এত রাতে আমি ছাড়া এই অঞ্চলে আর কারোরই জেগে থাকার কথা না।‌‌ নাইট গার্ডের অলিখিত চাকরিটা শুধুই আমার।

    নিজেকে সামলাতে না পেরে আমি চাপা গলায় চিৎকার করে উঠলাম,

    কে ওখানে? কে? কে?

    -আহ! একবার বললেই তো হয় নাকি? তিনবার কে কে বলে চিল্লানোর দরকারটা কি? কানে কালা নাকি আমি?

    গলাটা শুনে কিছুটা ধাতস্থ হলাম। গলাটা আমার চেনা। এটা কোন প্রেতাত্মার গলা না। পাশের বাসার রাশেদ ভাইয়ার গলা। কিন্তু তার তো এতো রাতে গাছতলায় বসে থাকার কথা না। মাত্র দুইদিন আগেই তার নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে।

    রাশেদ ভাইয়া আবার কথা বলে উঠলেন,শুকনা খাবার কিছু থাকলে ফেলো তো!

    আমি একপ্যাকেট চিপস আর বিস্কুট ফেলে দিলাম। সাথে একবোতল পানি। আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছি নতুন ব‌উয়ের সাথে তার কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু সেটা কি?

    আমি তাকে আর কোনো প্রশ্ন না করে জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। ভেতরে ভেতরে যদিও জানতে ইচ্ছা করছে কিন্তু মুখে কৌতুহল দেখিয়ে প্রশ্ন করার মতো মেয়ে আমি না। কেন জানি মনে হচ্ছে তিনি নিজে থেকেই বলবেন। আমার সাথে অনেকেই ফ্রি হয়ে অনেক কথা শেয়ার করে। কেননা আমি হলাম গাছের মতো। শুনি,ভুলে যাই। কাউকে কখনো বলতে যাই না।
    রাশেদ ভাইয়াও হয়তো শেয়ার করবেন।

    হলোও তাই। পরদিন পাড়ার একটা বাচ্চাকে দিয়ে রাশেদ ভাইয়া আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। গাছতলায় গিয়ে বসলাম। রাশেদ ভাইয়া শুকনা মুখে বসে আছেন।‌

    ভেতরে ভেতরে কৌতুহল ফেটে পড়লেও মুখে একটা স্বাভাবিক ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে সহজ গলায় বললাম, বলুন কি হয়েছে?

    রাশেদ ভাইয়া আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মেয়েটা লাইক দেয়।

    আমি আঁতকে উঠলাম। চারপাশ থেকে এই একটা বাক্য যেন তিনবার প্রতিধ্বনিত হয়ে আছড়ে পড়লো আমার কানে,

    মেয়েটা লাইক দেয়
    মেয়েটা লাইক দেয়
    মেয়েটা লাইক দেয়

    ঘটনাটা পরিস্কার বুঝতে হলে রাশেদ ভাইয়ার ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে। সংক্ষেপে বলি,

    রাশেদ ভাইয়া একজন ঘোর রিয়েক্টর। ফেসবুকের লাইক অপশনটির প্রতি তার তীব্র ঘৃণা।
    তার ফেসবুক আইডির নাম 'রিয়েক্টর বয় রাশেদ'।
    এমনকি তিনি তার ফ্রেন্ডলিস্টে কোনো লাইকার রাখেন না। বায়োতে লিখে রাখেন, 'অনলি রিয়েক্টরেরা এড দাও,লাইকার দূরে থাকো।'

    কেউ যদি তার পোস্টে মজা করেও কখনো লাইক দেয় তো সেদিন মনের দুঃখে তিনি না খেয়ে থাকেন।
    একবার আমি মনের ভুলে তার ডিপিতে লাইক দিয়ে ফেলেছিলাম। ভোর পাঁচটার সময় তিনি আমার জানালায় ঢিল মেরে ঘুম ভাঙ্গিয়ে রিয়াক্ট চেন্জ করতে বলেছিলেন।
    তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন মার্ক জুকারবার্গের কাছে অনুরোধ পাঠাতে যে ফেসবুক থেকে যেন লাইক অপশনটা তুলে দেয়া হয়।
    এমনকি এলাকাবাসীর সাহায্যে লাইকবিরোধী আন্দোলন তোলার‌ও অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এলাকাবাসী তার এই খেয়ালি আন্দোলন সমর্থন করেনি।

    এলাকার চেয়ারম্যান রাগী গলায় বলেছিলেন, মানুষ না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে আর তুমি আছো ফেসবুকের রিয়াক্ট নিয়ে!

    এই অবস্থায় তার বাবার মনে হলো ছেলের বিয়ে দেয়া দরকার। বিয়ে হলো অনেক পাগলামীর মহাঔষধ। বিয়ে দিলে যদি এই লাইক-রিয়াক্টের ভুত মাথা থেকে যায়!

    সুতরাং এলাকার মুরব্বিদের মতামত নিয়ে সবাই মিলে পরামর্শ করে কিছুদিন আগেই এক সুন্দরী প্রাইমারী টিচার মেয়ে দেখে রাশেদ ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছেন।

    আর আজ শোনা যাচ্ছে সেই মেয়ে লাইকার। কি ভয়ঙ্কর!

    আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তো কি হয়েছে লাইক দেয়! তাকে বুঝিয়ে বললেই তো হয়। আপনার সাথে থাকতে থাকতে রিয়াক্ট দেয়া শিখে যাবে।

    রাশেদ ভাইয়া আফসোসের সুর তুলে দুঃখী গলায় বললেন, আর শিখবে! বিয়ের আগে আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু..
    আমি কি তাকে বলিনি মনে করছো? সে ফেসবুক লাইট ইউজার। রিয়াক্ট দিতে বলেছিলাম বলে বিরক্ত হয়ে বলেছে, আমার তোমার মতো এতো আজাইরা সময় নেই। সারাদিন বসে বসে ফেসবুকে রিয়াক্ট দেয়া ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ থাকে।

    আমি দুঃখী গলায় বললাম,এটা তো‌ শুনতেই হবে আপনাকে ভাইয়া। আপনি কিছু করেন না, এদিকে চাকুরীজীবী মেয়ে বিয়ে করেছেন। একটু খোঁটা তো সহ্য করতেই হবে।

    রাশেদ ভাইয়া বললেন,‌খোঁটা সহ্য করতে আমি রাজি আছি।‌ যা ইচ্ছা বলুক, ব্যাপার না। কিন্তু পোস্টে লাইক দেবে কেন? নাহ! অসম্ভব! আমার পক্ষে এই মেয়ের সাথে বাস করা সম্ভব না। ওকে দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। তিনদিন হলো বিয়ে হয়েছে তারমধ্যে গত দুইরাত‌ই গাছতলায় বসে কাটিয়েছি।

    -এখন কি করবেন?

    :ওরে ফেরত দিয়ে আসবো। ডিভোর্স দিয়ে দেবো।

    আমি চমকে উঠে ভীতু গলায় বললাম, পোস্টে লাইক দেয় বলে একটা মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে দেবেন?

    রাশেদ ভাইয়া আমার কথার জবাব না দিয়ে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। আমিও তার পেছন পেছন গেলাম। কি হয় দেখা যাক।

    রাশেদ ভাইয়ার শ্বশুরমশাই এসেছেন। গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছেন। তার মেয়ে তার সামনেই বসে আছে। তার চোখমুখ ফোলা।

    রাশেদ ভাইয়াকে আসতে দেখে তার শ্বশুর উঠে দাঁড়ালেন।‌ থমথমে গলায় বললেন, সমস্যা কি?

    রাশেদ ভাইয়া সহজ স্বরে বললেন, সমস্যা একটাই। আপনার মেয়ে।‌ ওকে নিয়ে যান। আর কোনো সমস্যা নাই।

    -কেন? মেয়ে নিয়ে যাবো কেন? বিয়ের দুইদিন পর‌ বলবা আপনার মেয়ে নিয়ে যান,মশকরা করো?

    :মশকরা আমি করি না। আপনার এই ক্ষ্যাত মেয়ের সাথে আমি সংসার করতে পারবো না।

    রাশেদ ভাইয়ার শ্বশুর রাগী গলায় বললেন, কি! কি বললে তুমি? আমার মেয়ে ক্ষ্যাত? নিজে তো করোনা এক পয়সা ইনকাম। নেহায়েৎ তোমার বাবা আমার ভালো বন্ধু তাই তোমাকে মেয়ে দিয়েছিলাম। তোমার সাতজন্মের সৌভাগ্য যে আমার মেয়ের মতো ব‌উ পেয়েছো।

    রাশেদ ভাইয়া মুখ বেঁকিয়ে বললেন, সৌভাগ্য না ছাই! আগে যদি জানতাম আপনার মেয়ে এত ক্ষ্যাত তাইলে...

    এতক্ষনে ভাবী মুখ খুললেন। উঁচু গলায় বললেন, বাবা থামো! কার সাথে কথা বাড়াচ্ছো তুমি! এদের কোনো লেভেল আছে?

    রাশেদ ভাইয়া গমগমে স্বরে বহুল প্রচলিত বাংলা সিনেমার সেই কমন ডায়লগটি দিলেন,

    কাজী সাহেব! আমি গরীব হতে পারি, কিন্তু পোস্টে লাইক দেই না!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৫ মে ২০১৯ | ১৮৪২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • জাহাঙ্গির আলম | 340112.228.122312.200 (*) | ২৯ মে ২০১৯ ০৪:১২48209
  • সত্যিই অসাধারন!
    অঞ্জন দত্তের একটা টিভি নাটকে "প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য'' তে নায়ক তার স্ত্রীকে সহ্য করতে পারতো না কারন সে ছিল আটপৌরে, কবিতা পড়তে ভালবাসেনা, মৃণাল সেন কিম্বা সত্যজিতের সিনেমা দেখেনা, সারাদিন শুধু একেরপর এক টিভি সিরিয়াল দেখে। এই সিলি ব্যাপারটা আমার ব্রেন ছুয়ে যায়, সত্যিই মানুষ কি শুধু খাবে দাবে আর বাচ্চা পালবে, তাহলে মানুষ না হয়ে পশু হওয়াই ভাল ছিল তাদের।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন