এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • হারানো-প্রাপ্তি –নিরুদ্দেশ ৩

    Parimal Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৫৯০ বার পঠিত
  • মুম্বাইয়ের জনতা কলোনির জকিন আরপুথাম বিগত ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন ভারতের বিভিন্ন শহরে বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন নিয়ে। ম্যাগসেসাই পুরস্কারও পেয়েছেন। নিজেও বস্তিবাসী তিনি। রাষ্ট্রের কর্তাদের কাছে জকিনের বিখ্যাত উক্তি - আমরা তোমার দাতব্য চাই না, আমাকে তোমার পরিকল্পনায় শামিল কর।
    কলকাতার জনসংখ্যার যে বিশাল অংশ নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী বস্তিতে থাকেন, যে বিশাল অসংগঠিত শ্রমের স্রোত প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে শহরে এসে ঢোকে, তার একটা বড় অংশই এই শহরের অতিকায় সচল যন্ত্রটির অবিছেদ্য নাটবল্টু। তাদের শস্তা শ্রম আমাদের স্বচ্ছল স্বচ্ছন্দ জীবনকে নানা ভাবে ভর্তুকি দিয়ে চলে বিবিধ বিচিত্র পথে। (কলকাতার পূবপ্রান্তে যে হাজার চল্লিশেক মানুষ প্রতিদিন আমাদের মলমূত্র ফিরিয়ে দেন টাটকা সব্জি মাছ আর অক্সিজেন বানিয়ে, প্রযুক্তির সাহায্যে যা শোধন করতে গেলে খরচ হত কয়েক কোটি টাকা, তাঁরাও এই শ্রমের অংশ) আমাদের ভাল থাকা জড়িয়ে আছে সেই মানুষগুলোর টিকে থাকার সঙ্গে, সেই মানুষগুলোর খারাপ থাকা (– মুঠো পাকানো হাত, শক্ত চোয়াল, খর চোখ – ) আমাদের সুস্থির জীবনে অশনি সংকেত।
    আজকের ভারতবর্ষে কোনও শহর এই বাস্তবতায় পিঠ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না। কলকাতা তো নয়ই। তার কারণ এক বিশাল নিম্ন আয়ের অসংগঠিত শ্রমিক জনগোষ্ঠী থাকে আমাদের এই অঞ্চলে। আমরা চাইলেও কোনও জাদুবলে তাদের ভ্যানিশ করে দিয়ে সস্তা সুলভ শ্রম আমদানি করা যাবে না পাঞ্জাব বা কেরালার মতো। গুজরাটের মতো তাদের লুকিয়েও ফেলা যাবে না ঝাঁ চকচকে শহরের কার্পেটের নীচে। চাই বা না চাই, তারা থাকবে – ভিড় গাদাগাদি মেট্রোয় গায়ে গা লাগিয়ে, কিম্বা রাজপথে গাড়ির স্রোতের ফাঁকেফোঁকরে বিপজ্জনক পারাপারে।
    এই সহাবস্থানটা দীর্ঘকাল ধরেই আছে, ছিল। তার মধ্যে একটা গতিশীলতা ছিল, ইনক্লুসিভনেস ছিল – যে কারণে কলকাতা দেশে বিদেশে বিখ্যাত ছিল ভারতের শ্রেষ্ঠ মানবিক শহর হিসেবে। সেই কারনেই কোনও এক কালে হয়তো কর্পোরেশনের হোর্ডিং –এ ছিল বস্তির নগ্ন শিশুর ছবি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কলকাতার যিশুর এক ছত্র, আর ঐ লাইনটা – কলকাতা, তুমি কার? তাতে সেই যিশুদের কতটা কী লাভ হয়েছে সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়, কিন্তু তখনও অবশ্য কাচ-ঢাকা মল আর এত ফ্লাইওভার হয়নি। এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ার জন্য আন্দোলনে ফেটে পড়েছিল কলকাতা শহর। তার আগে খাদ্য আন্দোলনে এই শহরে গুলি লাঠি চলেছিল, মারা গিয়েছিল ছাত্র কৃষক। তার কিছু পরে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল এক ঝাঁক উজ্জ্বল মেধাবী তরুণ।
    আজ এই কথাগুলো বেশ একটু রোম্যান্টিক শোনাতে পারে, কিন্তু আসলে এসবের পেছনে রয়েছে একটা নির্মম ঐতিহাসিক বাস্তব – দেশভাগ! মানব সভ্যতার একটি বৃহত্তম শিকড়-ছেড়া উৎপাটনের ভুক্তভুগী এই বঙ্গের মানুষ। পাঞ্জাবের মতো রাষ্ট্র তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, মানুষ নিজের উদ্যম আর অধ্যাবসায়ে গড়ে-পিটে নিয়েছে একটা জীবন, গোটা দেশে যার জুড়ি নেই।
    আজ আমরা যারা কাচের ভেতর থেকে কিম্বা ফ্লাইওভার দিয়ে উড়ে যেতে যেতে নিরুচ্চার নির্লিপ্তিতে বাইরেটা দেখি, তাদের অনেকেই কিন্তু সেই সময়ের টিকে-যাওয়া বেঁচে-ফেরা প্রজন্মের সন্তান সন্ততি। সেই ব্যক্তিগত ইতিহাস আমাদের সংকীর্ণ ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে শিখিয়েছিল, একটা বিশ্বনাগরিকতার বোধ দিয়েছিল। সেই কারণেই এক সময় কলকাতার বাতাসে ধ্বনি উঠেছিল – আমার নাম তোমার নাম ভিয়েতনাম! সেই কারণেই আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে আফ্রিকার এক কালো নেতাকে দেখতে ইডেনে ভেঙে পড়েছিল শহর।
    আজ ইডেনে আরেকজন নেলসন ম্যান্ডেলা এলে সেই ভিড় শাহরুখের আই পি এল জয়ের ভিড়কে টেক্কা দিতে পারবে কি? কে জানে। তবু কয়েক বছর আগে নন্দীগ্রামে গুলি চালনার পর এই কলকাতার রাস্তায় হেঁটেছিলেন দলমত নির্বিশেষে মানুষ, ঘুরিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসের গতিমুখ। তাঁরা প্রায় কেউই নন্দীগ্রামে হতাহতদের মতো কৃষিজীবী ছিলেন না। পাশে এসে দাঁড়ানোর, হাত বাড়িয়ে দেবার ঐতিহ্যটা হারিয়ে যায়নি নিশ্চয়ই। এই যে বিগত কয়েকদিন ধরে সুপ্রিম কোর্টের অমানবিক রায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এত বাঙালি, ফেসবুকে সক্রিয় হয়েছেন (তার বেশ কিছুটা যদিও, যাকে বলে, প্রিচিং দা কনভার্টেড), তাঁদের বেশিরভাগের নিশ্চয়ই আত্মীয় বন্ধু পরিচিতের মধ্যে একজনও ঘোষিত সমকামী নেই। কিন্তু সেটা কোনও বাধা হয়নি। এটাই তো সহমর্মিতার সংস্কৃতি, যা সমাজকে বাসযোগ্য রাখে।
    সেই সংস্কৃতি দাবী করে সামান্য একটু মনোযোগ – শহরের গুরুত্বপূর্ণ, বিশাল ভর্তুকি-প্রাপ্ত গণপরিবহণ থেকে রাতারাতি খসে গেল যে ৮০ হাজার মানুষ, তাদের দিকে। তাদের কারোর কারোর সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের দৈনন্দিনের ঘড়ি বাঁধা রয়েছে যে।
    (শেষ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৫৯০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    শপথ  - Prolay Adhikary
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • practical | 131.247.233.16 (*) | ২২ ডিসেম্বর ২০১৩ ০৯:০৭46134
  • ইউটোপিয়া তে আবেগপ্রবণ হয়ে বাস করে লাভ নেই । বাস ভাড়ার থেকে টিউব / মেট্রো ভাড়া বেশি হবেই,পৃথিবীর সর্বত্র তাই। আপাতদৃষ্টি তে " বেশি ভাড়া" এক দশকের বেশি ভাড়া না বাড়ানোর ফল -দিল্লি মেট্রো তে ভাড়া অনেক বেশি এখনো।
    বরং রাস্তায় বাস কমে যাওয়া অনেক বেশি সমস্যার - এই বাস গুলোতে অনেক অসংগঠিত শ্রমিক ও কাজ করত । লোকাল ট্রেনের কামরা বাড়ানো টাও জরুরি ।সরকারী বাস বেশি চলা দরকার ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন