ঘনাদা থুড়ি বেণুদা তখন বলছেন রিঙ্কুর সাথে তাঁর প্রেমের গল্প। ‘বুzলেন আমি তো মুসলমান আর ও হিন্দু, তা রেজেস্ট্রি করেসি, হিন্দুমতে আর মুসলমান মতেও বিয়ে করেসি। তিনবার বিয়ে করেসি। তা হিন্দু বিয়ায় জিগ্যাস করে গোত্র কী? আমি বলে দিসি হিমু গোত্র। পুরুতেও বিয়া পড়ায় দিসে।‘ ... ...
সামনে দিগন্তজোড়া ক্যানভাসে চলছে রঙে রেখায় ছবি আঁকা। কমলা থেকে লাল হয়ে মেরুণ হয়ে সূর্য টুপ্পুস করে নেমে যায়, ডুব দেয় দিবাঙে। বিশাল উপত্যকা ছড়িয়ে থাকে রূপোলি থেকে নীল হয়ে পার্পল হয়ে যাওয়া দিবাঙের ধারাগুলো বুকে নিয়ে, কমলালেবু গাছেরাও সেজে ওঠে লাল কমলার নানা শেডে, সূর্য ডুবে যাওয়ার পরে আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট কি একঘন্টা পশ্চিম আকাশ ধরে রাখে রঙের ছোপ। ওখান থেকে নেমে ভেতরের প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়াই, খাবারঘরের জানলা দরজা দিয়ে লালে লাল আকাশ আর মাথার উপরে পেট্রোল ব্লু আকাশ ধীরে ধীরে মুছে নেয় মনের উপর লেপ্টে থাকা কালো অন্ধকার। ‘কলুষ কল্মষ বিরোধ বিদ্বেষ হউক নির্মল,হউক নিঃশেষ-‘ সুচিত্রা মিত্রর জোরালো বলিষ্ঠ গলার সাথে মিশে যেতে থাকে আমার গলা। ... ...
নামদাফায় যদিও বিগ ক্যাট প্রজাতির চার রকম প্রাণীর (টাইগার, লেপার্ড, স্নো লেপার্ড, ক্লাউডেড লেপার্ড) সন্ধান পাওয়া যায় তবে এতটা নীচে লোক চলাচলের পথের এত কাছে তারা আসে না, বলা ভাল তাদের আসার দরকার হয় না (ভাগ্যিস!), জঙ্গল এখনো যথেষ্ট ঘন এবং জঙ্গলের অনেকটাই মানুষের, অন্তত শহুরে মানুষের জন্য প্রায় অগম্য স্থান। কিন্তু চোরাই কাঠ পাচারকারিদের উৎপাতে বেমক্কা বন নিধনের ফলে নামদাফার জীববৈচিত্র্য অনেকটাই ঝুঁকির মুখে। আর কতদিন তথাকথিত উন্নয়নের জাঁতাকল ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নামদাফা বাঁচবে জানি না, এখনো অন্তত অনেকটাই আছে। এমনকি নদীর ওইপারের কোর এরিয়াতে না ঢুকলেও প্রজাপতিই যে কতরকম দেখা যায়, পাখি সেও তো কতরকমই দেখা যায় আর দেখা যায় নানারকম রঙ বেরঙের পোকা। ও হ্যাঁ নামদাফায় কিন্তু প্রচুর অজস্র জোঁক। এখানে পাঁচ রকম বিভিন্ন প্রজাতির জোঁক দেখা যায়। শুকনো আবহাওয়ায় এমনিতে জোঁক কম হলেও ডিসেম্বরেও কিছু জোঁক দিব্বি মানুষের গোড়ালি কিম্বা জুতোমোজা ও জিন্সের ফাঁক গলে পায়ের গোছে ঝুলে পড়েছে। ... ...
দেবান বাংলোটা এমন জায়গায় যেখান থেকে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু সূর্যাস্তের দেড়ঘন্টা পরেও নদী পেরিয়ে জঙ্গলের ওই কোণায় যে দক্ষিণ পশ্চিম আকাশ তার দিগন্তরেখা ঘেঁষা আঁচল টকটকে লাল হয়ে থাকে। গোটা আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে, আমলকি গাছের মাথায় হীরের দুলের মত ঝকঝকে সন্ধ্যাতারা, আস্তে আস্তে একটি দুটি করে রাতের ক্লাসে হাজিরা দিচ্ছে অন্য তারারাও, তবুও দিগন্তের আঁচল তখনো লাল থেকে গাঢ় লাল হয়ে মেরুণ হয়ে আসছে আর সেই রঙটুকু ফোটাতেই যেন অল্প একটু তুঁতেনীল লেগে আছে উপরে। ... ...
নামদাফা টাইগার রিজার্ভ - অভয়ারণ্যের নাম এটাই। ব্যপ্তি মিশমি পাহাড়ের দাফা-বাম রেঞ্জ আর পাটকাই রেঞ্জের মাঝের পুব পশ্চিমে বিস্তৃত প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার এলাকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৬৫৬ ফুট (২০০ মিটার) থেকে ধাপে ধাপে বেড়ে প্রায় ১৫০০০ হাজার ফিট (৪৫৭১ মিটার) অবধি উঠেছে। বলা হয় যে এই অঞ্চলের উদ্ভিদসম্পদের পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করতে কমবেশী ৫০ বছর সময় লাগবে, এত বহুল ব্যপ্ত এর উদ্ভিদবৈচিত্র। মিশমি-তিতা বা কপতি-তিতা নামের ভেষজ উদ্ভিদ নামদাফার গহীনেই একমাত্র পাওয়া যায়। স্থানীয় জনজাতির মানুষেরা এই ভেষজ উদ্ভিদ তাঁদের প্রায় সবরকম অসুখ বিসুখেই ব্যবহার করেন। এই উদ্ভিদের রপ্তানী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এখানে বলে রাখি ডিব্রুগড়ে নেমে ঈপ্সিতার সাথে কথা বলার সময় ঈপ্সিতা বলেছিল নামদাফায় গিয়ে লোকজনকে জিগ্যেস করতে যে জ্বর টর হয় কিনা। তা,আমি জিগ্যেসও করেছিলাম, শুনলাম না না জ্বর হয় না তো। হলে ঐ লতা পাতা বেটে খেলেই কমে যায়। কী পাতা? শুনলাম জংলী পাতা এই জঙ্গলেই পাওয়া যায়। পাতা মানে তাহলে হয়ত মিশমি-তিতার কথাই বলছিলেন ওঁরা। ‘নামদাফা’ শব্দটা দুটো সিংফো শব্দের মিশ্রণে তৈরী। নাম হল জল আর দাফা মানে উৎস। দুইয়ে মিলে দাফা-বাম হিমবাহে উৎপন্ন নদীকে বোঝানো হয়। নদীর নামটাও ভারী মিষ্টি – নোয়া ডিহিং’ ... ...
সে প্ল্যানটা, কি বলব মশাই, এক্কেবারে লালে লাল। লাল পান্ডা, লাল কাঠবেড়ালি, লাল শিয়াল, লাল খ্যাঁকশিয়াল, লাল লাল প্রজাপতি, তিনরকম গন্ধগোকুল, চার রকম উদবেড়াল, উল্লুক, হনুমান, শম্বর, কয়েক রকম হরিণ আর অনেকরকম পাখি দেখা যাবে শুধু নয়, আদিম অ-মানুষ বা না-মানুষ (non human primate)ও দেখা যাবে বলে লেখা। এতকিছু তো আর আমাদের দেখা দেবে বলে তৈরী হয়ে বসে নেই, কিন্তু এর চার ভাগের একভাগ দেখতে পেলেও ভারী খুশি হয়ে যাব নির্ঘাৎ। অতএব চলো গোছগাছ করি। ওদিকে জানুয়ারী মাসে অফিস যদি নিতান্তই খুলে যায় তার আগে অন্তত দুই এক সপ্তাহ ওয়ার্ক ফ্রম মাউন্টেন করে নেওয়া দরকার, নাকি? ... ...
চামেলিপিসিদের খাটের নীচে কী আছে সেটা দেখতে খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু জিজি মানা করেছে। অন্যদের বাড়ি গিয়ে তাদের জিনিষপত্রের দিকে তাকানো নাকি ভারী অসভ্যতা। ওদের চৌকির তলায় এত এত জিনিষ যে কখনো পাশ দিয়ে অসাবধানে যেতে গেলেও পায়ে গুঁতো লাগে শক্ত বস্তামত কীসবের সাথে। চামেলিপিসির বাড়ি থেকে ফেরার সময় প্রথমদিন অত লোককে রাস্তায় লাইন করে বসে খেতে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। অনেকেই কেমন নোংরা কালো জামা পরা, একদম সামনে যে তার শার্টের কাঁধে এত্তটা ছেঁড়া! ওদের মায়েরা বকে না জামা নোংরা করলে? জিজি তাড়াতাড়ি হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে, ওদের নাকি বলে কাঙালি। শ্রীহরি ওদের ভোজন করায়। রোজ রোজ লুচি ছোলারডাল খেতে পায় কী মজা! মা বোঝায় না মোটেই মজা নয়, সারাদিনে ওরা অনেকেই হয়ত আর কিচ্ছুই খেতে পাবে না। ওরা রাস্তায়ই থাকে, অনেকের মায়েরাও হয়ত ওই লাইনেই বসেছে। আমার খটকা যায় না, রাস্তায় থাকাটা কি খুব খারাপ ব্যপার? কেমন ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে পারে। ... ...
এর মধ্যেও দুই তিনদিন সাড়ে দশটায় বাস ধরতে হয়েছে আর দিদিটাও সমানে ব্যাটারি ব্যাটারি করে গেছে। এখন আবার ওর সঙ্গের আরো দুটো দিদিও হাসে আর চোখের সামনে কিলবিলিয়ে আঙুল নাচায়। ইচ্ছে করে ঘ্যাঁক করে কামড়ে ধরি একটা আঙুল। কিন্তু ঠিক সাহস হয় না। খালি মনে মনে ভাবি দাঁড়াও না মা বলেছে চশমা পরলে আর চোখের নড়াচড়া টের পাওয়া যাবে না, আসুক আমার চশমাটা তৈরী হয়ে। কিন্তু অনেক ছোট একটা মেয়েকে অবাধে লাঞ্ছনা করার এমন সুযোগ ওরা ছেড়ে দেবে কেন? কাজেই প্রথম যেদিন চশমা পরে বাসে উঠলাম ওরা একেবারে হইহই করে উঠল ‘আরে আরে দেখ ব্যাটারির চারচোখ’। এবারে নতুন খেলা, চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে জানলার বাইরে হাত বের করে ঝুলিয়ে রাখা ‘এই ফেলে দিলাম ফেলে দিলাম’। ভয়ে কাঠ আমি, চশমা ভেঙে গেলে বা হারিয়ে গেলে মা হয়ত মেরেই ফেলবে আমাকে, বারেবারে বলে দিয়েছে সাবধানে রাখতে। হোঁচট খাচ্ছিলাম বলে বকেছে পড়ে যেন চশমা না ভাঙে। ... ...
ইন্দ্র রায় রোড ধরে হেঁটে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোডে ওঠার মুখটায় ডানদিকের কোণায় ‘দাঁ পেপার হাউস’, রাস্তা থেকে বেশ অনেকটা উঁচু বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। দোকানের ভেতরে নতুন খাতার গন্ধ, নতুন উডপেন্সিল আর রবারের গন্ধ, হলদে গোলাপী চার্টপেপারের গন্ধ, নতুন বইখাতায় মলাট দেবার ব্রাউন পেপারের গন্ধ ম’ ম’ করে। আর আছে রং পেন্সিল, রং কলম আর রঙ বাক্স। মোম দেওয়া রঙ পেন্সিলের ছোট বাক্স ড্রয়িং ক্লাসের দিন ইস্কুলে নিয়ে যেতে হয়। আমারটা বারো রঙের ছোট্ট বাক্স, সুলগ্না খুব সুন্দর আঁকতে পারে, ওর বাক্সে আঠেরটা রঙ। ত্রিসীমার একটা ইয়াব্বড় বাক্স আছে তাতে ছত্রিশটা রঙ, একদিন ইস্কুলে দেখাতে এনেছিল। ... ...