ভেবেছিলাম "একা বেড়ানোর আনন্দ" সিরিজে প্রথম পর্বে প্রাককথনের পর দ্বিতীয় পর্বে রাখবো এটা। কিন্তু আজকেই দেখি দীপাঞ্জন পোষ্ট করেছে বিদিশা। ওর লেখায় ছবিগুলি সুন্দর, বর্ণণা বিশদে। খাসা হয়েছে। আমার লেখা একটু কাছাখোলা ধরণের। আশকথা পাশকথার বাহুল্য। তবু লিখে যখন ফেলেছি, পোষ্টেই দি।
সময়ের আড়াই বছর আগে ২০১৬তে কর্মজীবনে ইতি টেনে কম খরচে ভবঘুরে মেজাজে একাকী ভ্রমণের নেশায় ধরেছে। এই ধরতাইটা কিছু লেখার শুরুতে থাকবে। মার্জনা প্রার্থনীয়। তবে সেই নেশার সূত্রপাত হয়েছিল কর্মজীবনে, ২০০৯ সালে, ছোট্ট একটা ফুলকি থেকে। কেজো জুতো তাকে তুলে ক্রমশ বাড়লো সেই নেশা। প্রথম মাইক টেস্টিং ছিল ১২ দিনের। ১৫-১-১৭ কর্ণাটকের মনিপাল থেকে রওনা দিয়ে ঝাঁসী, ওরছা, বিদিশা, খাজুরাহো, চিত্রকুট দেখে ডেরায় ফিরেছি। খরচ হয়েছিল ১০৩৩/দিন। সময়ের সাথে সব কিছুরই খরচ বাড়ে। তবু তিন বছর বাদে ২০২০ সালের শীতে ৬৩ দিনের একাকী ভ্রমণ সাঙ্গ হোলো ৩১৪/দিন। ছ বছর বাদে ২০২৩ সালের শীতে ৬০ দিনে হোলো ৫১৩/দিন।
এতো কম খরচে বেড়ানো শুনে কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীর কথায় উহ্য সংশয় অনুভব করি - আধপেটা খেয়ে ওয়েটিং রুমে রাত কাটাইনি তো? আসল ব্যাপার অন্য। শীতকালে এসি ক্লাসে যাওয়া বাহুল্য। প্রায় ৬ হাজার কিমি ভ্রমণে দুরপাল্লার যাত্রায় গেছি স্লীপার ক্লাসে। স্বল্প দুরত্বে গেছি জেনারেল ডাব্বায়। গেছি লোকাল বাস, শেয়ার অটোতে। করেছি কিছু হিচহাইক এবং অনেক পদচারণা। গন্তব্যে পৌঁছে, দু থেকে ছ দিন থেকে, আশপাশে হেঁটে ঘোরার মজাই আলাদা। তাই ২০২০তে ৬৩ দিনের যাত্রায় দুরপাল্লার যাত্রা সময় বাদ দিলে ৫৬ দিনে হেঁটেছি ২৭৬কিমি। গড়ে ৫কিমি/দিন। সর্বাধিক ১২কিমি, কোলহাপুরে, রানকালা লেক প্রদিক্ষণ ধরে।
এই সবের ফলে যাতায়াতেও খরচ হয়েছে যৎসামান্য। সাধারন হোটেল, ধর্মশালা, গুরুদ্বারা, আশ্রমে থাকায় রাত্রিবাসের খরচও হয়েছে কম। সাধারণ ভোজনালয়ে আহার করেছি সস্তায়। অনেকদিন দুপুরে করেছি আপেল, কলা, গাজর, কড়াইশুটি, ছোলাভাজা, মুড়ি, লাড্ডু দিয়ে ড্রাই লাঞ্চ। সাথে ছিল ইলেকট্রিক কেটলি। ফলে প্রাতরাশে এবং ডিনারে রুমে বসেই ডিম সেদ্ধ, ভেজ ম্যাগী, দুধ কর্নফ্লেক্স বানিয়ে খেয়েছি। সস্তায় পৌষ্টিক আহার। হোটেলের তেল, মশলা সমৃদ্ধ খাবার খুবই কম খেয়েছি বলে শরীরও ছিল সুস্থ। তবে এভাবে বেড়ানো অনেকেরই পোষাবে না। আসল বাধা মানসিক। সেটা না থাকলে বাকিটা জলবৎ।
বিদিশার ১০কিমি দুরে UNESCO World Heritage Monument সাঁচী দেখতে বিদিশায় একরাত থাকলেই চলে। কিন্তু আমি ছিলাম তেরাত্রি। ঝাঁসি থেকে ভোরের ট্রেনে বিদিশায় পৌঁছলাম নটায়। স্টেশনের কাছে একটি সাধারণ হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরোলাম। আশপাশে দেখতে দেখতে দু কিমি হেঁটেই চলে গেলাম বিদিশা বাস স্ট্যান্ড। গিয়েই দেখি বেরিয়ে যাচ্ছে রায়সেনের লোকাল বাস। দৌড়ে গিয়ে উঠি। ভীড় বাসে সীট পেলাম না। প্রয়োজনও নেই। মাত্র আট কিমি পথ। দশ টাকা ভাড়া। পিছনের দিকে লোহার পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। পিছনের টানা সীটের ডানদিকে তিনটে সীটে নানা সাইজের ছটি চিল্লার নিয়ে দুটি স্থানীয় মহিলা যাচ্ছেন। আটজনের দলের মাঝে পিছনের পুঁচকেটি মাইক টাইসনের মতো রাশভারী। কয়েকবার ওর সাথে চোখ ইশারায় মজা করি। ভবি ভোলবার নয়। কঠিন ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিশ্বগুরুর মতো মেপে গেল আমায়। মিনিট পনেরোয় পৌঁছে গেলাম সাঁচী। রিজার্ভ গাড়িতে ঘোরার আরাম, সুবিধা অনেক তবে জনবাহনে ঘুরলে এমন খুচরো মজাও বেশ লাগে।
পুঁচকে টাইসন সমানে মেপে গেল মোরে
তৃতীয় মৌর্য্যসম্রাট অশোক তাঁর পিতা বিন্দুসারের জীবৎকালে কিছুদিন বিদিশার রাজ্যপাল ছিলেন। বিদিশার এক বৌদ্ধ শ্রেষ্ঠীর কন্যা বেদিশা মহাদেবী শাক্যকুমারী বা দেবীর জন্ম সাঁচীতে। যুবক অশোকের সাথে দেবীর প্রেম ও পরিণয় সাঁচীতেই। তাঁদের পুত্র মহেন্দ্র ও কণ্যা সংঘমিত্রা পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অংশ নেন। পুত্র কন্যার জন্মের কিছুদিন পর অশোক চলে যান পাটূলীপুত্র।
মৌর্য্য সম্রাটের পত্নী হিসাবে এক ব্যবসায়ীর কন্যা দেবী রাজকীয় মর্যাদায় গৃহীত হননি। তাই দেবী বিদিশাতেই থেকে যান। পরে অশোকের আরও তিনটি বিবাহ হয়। দেবী কিন্তু বিয়ের পর অশোককে বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট করতে পারেননি। তিনি তখন হিন্দুকূশ থেকে বঙ্গদেশ অবধি সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত। কলিঙ্গযুদ্ধে লক্ষাধিক মৃত্যুদর্শনে বিহ্বল হয়ে তিনি রূপান্তরিত হন ধর্মাশোকে। বৌদ্ধধর্ম গ্ৰহণ করে প্রচার করতে শুরু করেন শান্তিবার্তা। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সাঁচীতে নির্মান করেন বৌদ্ধ স্তূপ যাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী ১৩০০ বছরে আশেপাশে আরো কয়েকটি স্থানে তৈরী হয় একশোরও বেশী স্তুপ। কিন্তু প্রথমে সাঁচী কেন? প্রথম প্রেমের স্মৃতিতে?
দ্বাদশ শতাব্দীতে পরিত্যক্ত হয়ে দীর্ঘ ছশো বছর সাঁচী লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। ১৮১৮ সালে ব্রিটিশ সামরিক অফিসার General Taylor জঙ্গলাকীর্ণ, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া সাঁচীর সন্ধান পান। কাকতালীয় ভাবে পরের বছর অন্য এক ব্রিটিশ সেনা অফিসার ঔরঙ্গাবাদের অদূরে জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে গিয়ে খুঁজে পান আর এক বৌদ্ধিক রত্ন, অজন্তা গুহাশ্রেণী। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে শুরু হয়ে প্রায় আটশো বছর ধরে পাহাড় কেটে তৈরী করা এক অত্যাশ্চর্য্য সৃষ্টি। এটিও বর্তমানে UNESCO World Heritage Monument. বর্তমান সাঁচীর ভব্য রূপ পুরাতত্ব বিভাগের সাত বছরের (১৯১২ - ১৯) সংরক্ষণ প্রয়াসের ফল। সেই কর্মযজ্ঞের মুখ্য পূরোহিত ছিলেন তদানন্তীন ASI Director General, Sir John Marshall. উনি হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, সারনাথ, তক্ষশীলার পুরাতাত্বিক সর্বেক্ষণর সাথেও যুক্ত ছিলেন।
বাসস্টপ থেকে পাহাড়চূড়ো প্রায় ১কিমি। অটো পাওয়া যায়। আমি হেঁটেই গেলাম। অনুচ্চ পাহাড়ের উপরিভাগ প্রায় সমতল। নয়ানাভিরাম সবুজের মাঝে অনেক স্তুপ, কারুকার্যমণ্ডিত তোরণ, ছাদ বিহীন স্তম্ভের সারি, বিহার, মন্দির, জলাধার, প্রশস্ত চত্বর, সিঁড়ি এসব নিয়ে সাঁচীর সংরচনা অতি মনোরম। গেটের পাশে শ্রীলংকা সরকার কর্তৃক নির্মীত অনাড়ম্বর মহাবোধি ভবন।
নীচে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ক্ষেতের বুক চিরে সিঁথির মতো চলে গেছে কালো রাস্তা। দুরে পাহাড়ের সারি। অদুরে ব্যেস ও বেতয়া নদীর সঙ্গম। জনপদ থেকে দুরে নির্জন পাহাড়ের উপর এরকম শান্তিময় প্রাকৃতিক স্থান ধ্যান ও ধর্মচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ। সাঁচীতে স্তুপ নির্মানের সেটাও একটা কারণ হতে পারে। ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে কফিশপের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে এক কাপ কফি নিয়ে বসলাম। অধিকাংশ দর্শক চলে গেছেন। নিঝুম হয়ে গেছে জায়গাটা। একটু পরে দুর পাহাড়ের পিছনে হারিয়ে গেল দিনান্তের সূর্য। উঠেছিলাম পাথুরে সিঁড়ি ধরে। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে নেমে গেলাম গাড়ী চলা ঘোরানো পিচের পথ ধরে।
দিনান্তে সাঁচী
পরদিন গঞ্জ বসোদার বাসে পাঁচ কিমি দুরে বেতয়ার তীরে নেমে বাঁদিকের রাস্তা ধরে তিন কিমি হেঁটে দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম উদয়গিরির পাদদেশে। বাসের টিকিট দশটাকা। অটোতে অপেক্ষা সহ যাতায়াতে চারশো চেয়েছিল। তার চেয়ে এই ভাল। ইচ্ছে মতো ঘোরা যাবে। এখানে রয়েছে ভারতের প্রাচীনতম হিন্দু গুহা মন্দির। ছোট বড় মিলিয়ে মোট কুড়িটি গুহা। দুটি জৈনধর্মী, বাকি হিন্দুধর্মী। খ্রীষ্টাব্দ তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সূবর্ণযুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারগুপ্তের পৃষ্ঠপোষকতায় এগুলি তৈরী হয়। ১,৩,৪,৫,৬,১৩ নং গুহাতে বিষ্ণু, শিব, গনেশ এসবের মূর্তি এখোনো অক্ষত আছে। সেকালে শিল্পীরা পাথরে খোদিত শিল্পকর্মকে রোদ, বৃষ্টি, হাওয়ার ক্ষয় (weathering action) থেকে বাঁচাতে গাছের রস দিয়ে তৈরী এক প্রকার লাল রঙ মাখাতেন। ১৭০০ বছর পরে আজও সেই লাল রঙ্গের প্রলেপ দেখা যায়! কিছু ঐতিহাসিকের মতে দিল্লীর কুতব চত্বরের লৌহস্তম্ভটি নাকি আদিতে এখানেই ছিল।
ভারতে পাহাড়কুলের মধ্যে বয়সের হিসেবে বড়দা আরাবল্লী। অবশ্য শুধু ভারতে নয় তিনি হয়তো পৃথিবীর তাবৎ পর্বতমালার মধ্যে বয়ঃজ্যেষ্ঠ। অতঃপর ভারতের মেজ, সেজর দলে আসে পূর্বঘাট, পশ্চিমঘাট, বিন্ধ্যাচল, সাতপুরা, নীলগিরি এবং তরুণতম হিমালয়। পাললিক শিলায় (Sedimentary Rock) উৎপন্ন বিন্ধ্যাচল পর্বতমালাতেই অবস্থিত উদয়গিরি। ASI এর লাগানো ম্যাপ দেখে আন্দাজ পাওয়া গেল উত্তর প্রান্তে ব্যেস নদীর কিনারে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের “জাঙ্গল রিসর্ট” ও পূর্ব পশ্চিমে দুটি পাহাড়ে বিস্তৃত পায়ে চলা পথ (cave trail) ধরে গুহাশ্রেণী দেখে পূবালী পাহাড়ের পাদদেশ ধরে ব্যেস নদীর বাঁধ ছুঁয়ে ইন্টারপ্রিটেশন পয়েন্টে ফিরে আসতে প্রায় ৩ কিমি হাঁটতে হবে। উন্মুক্ত পাহাড়ী পথে শীতের মিঠে রোদে হাঁটার মজাই আলাদা।
ASI সূচনা পটে উদয়গিরি কেভট্রেল পথনির্দেশ
ভদ্র, সপ্রতিভ তরুণ গার্ড মাখন সিং রাজপুতের সাথে খানিক গল্প হলো। বলে বেশী লোক আসে না এখানে। সারাদিন নির্জনে বসে থাকি, আপনার সাথে দুটো কথা বলে ভালো লাগলো। উৎসাহ নিয়ে তালা খুলে একটি গুহা দেখালো। কিছু ভাঙ্গাচোরা মূর্ত্তি রয়েছে। একটা নন্দী দেখলাম। পিঠে কেউ ফুলের মালায় গিঁট বাঁধছে। এরকম নন্দী কোথাও দেখিনি। মাখন বললো, চলুন আপনাকে আর একটা জিনিস দেখাই।
এমন নন্দী আগে কখনো দেখিনি
উদয়গিরি থেকে একসময় পাথরের ব্লক কেটে চালান যেতো। পাহাড়ের ওপর এক খাদান চত্বরে একটি ছোট্ট সূর্য ঘড়ি খোদাই করা আছে। একটা কাঠি রেখে ছায়া দেখে পাঁচ মিনিটের সুক্ষতায় সময় বলে দিল মাখন। আমি হতবাক! অনুমান খাদানের সুপারভাইজার সময় দেখার জন্য বানিয়েছিল। ক্ষয়ে গিয়ে এমন আবছা হয়ে গেছে যে মাখন না দেখালে চোখেও পড়তো না। আর একটু ওপরে ১৯৩৩ সালে তৈরী ছোট্ট বিশ্রামগৃহ। স্থান নির্বাচন অনবদ্য। উত্তরে ব্যেস নদীর বুকে চেক ড্যামের গা বেয়ে নামছে সাদা ফেনিল জলের ধারা। চারপাশে সবুজ ক্ষেত। মাখন জানালো রেষ্টহাউসটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। কড়াইশুটি ও বেসনের লাড্ডু বার করলাম। দুজনে সিঁড়িতে বসে খানিক জলযোগ করে ওকে কুড়িটা টাকা বখশিশ দিই। নিতে চাইছিল না মাখন। বলে আপনি পরদেশী, আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন তাই আমার যেটুকু জানা আপনাকে বললাম। আপনার থেকেও কিছু জানলাম। এর জন্য আবার বখশিশ কীসের? বলি, খুশি হয়ে দিচ্ছি, রাখো। আমি পশ্চিম দিকে রওনা দিই। ও ওখানেই বসে রইল। ছেলে ছোকরার দল এসে নানা হরকৎ করে। ওপর থেকে চারপাশে নজর রাখবে মাখন। ওর জোড়িদার আছে নীচে।
![](https://lh3.googleusercontent.com/DbEj83fE6eY2UOkTD51E-CuiwiCy1OoeBoZQIlHb9wm5f63Zdm0XIQQdns7NJqw--LQaNL4UwGYyq18F4v6tcQrxQdpjaEVPccKHBjMGQCmD7g6Tj4mrn5t2Fhv4sMwxm0wzNpv00l4S7s5BRj7J9g)
পথ চলতে পাথরের নীচে একটা বনবিড়াল (Civet) মুখ ঘুরিয়ে অবাক চোখে আমায় দেখে। দুর থেকে ছবিটা ভালো উঠলো না। নদীর প্রান্তে ঘন জঙ্গলের মধ্যে "জাঙ্গল রিসর্টের" পরিবেশ অতি সুন্দর। পাঁচশো টাকায় বোটিং টিকিট না কেটে জেটিতে নামা মানা। পার্কের বেঞ্চে ঘন্টাখানেক গড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে চললাম পশ্চিমের পাহাড়ের দিকে। পাললিক শিলার স্তরগুলি রং ও বৈচিত্রে বেশ দৃষ্টিনন্দন। দুরে বিদিশার কাছে সমতলের মাঝে একটা খাড়া পাথরের টিলা। ওটাই লোহাঙ্গী হিল। কাল যাব।
পাঁচটা নাগাদ ইন্টারপ্রিটেশন পয়েন্টে পৌঁছোনার আগেই ওপর থেকে আমায় দেখে মাখন তরতরিয়ে নেমে এল। বলল, একটু বসুন, চা বানাই, খেয়ে যান। সেই সকালে বেড়িয়েছি, আট ঘন্টা হয়ে গেছে। প্রাণটা সত্যি চা চা করছিল। ছেলেটির উষ্ণ আন্তরিকতার মন ভরে গেল। চা খেয়ে হাঁটা দিলাম। মাখন বলছিল, একটু দাঁড়ান, গাঁয়ের কেউ এলে আপনাকে বলবো হাইওয়ে অবধি ছেড়ে দিতে। বলি, দরকার নেই, চলে যাবো টুকটুক করে।
প্রায় আধা পথ যাওয়ার পর দেখি একটি অটো আসছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি, কিন্তু হাত দেখাই নি। সে নিজেই এসে কাছে দাঁড়ায়। পিছনে এক গ্ৰাম্য মহিলা বসে। এছাড়া অটোটা খালি। চালক বলে, কোথায় যাবেন? বলি, মেন রোড, ওখান থেকে বাসে বিদিশা। ও বলে, ওখানে বাস নাও দাঁড়াতে পারে। আমি বেতয়ার ব্রীজ পেরিয়ে রামলীলা ময়দান অবধি যাচ্ছি, চলুন, ওখানে সব বাস দাঁড়ায়। মুম্বাই, কর্ণাটকে কয়েকবার ভাড়া না জিজ্ঞাসা করে অটোয় উঠে চূনা লাগায় আমি শুধোই, কত লাগবে। সে বলে, আমি ভাড়ায় যাচ্ছি না, গাড়ির একটু কাজ আছে, ওখানে চেনা গ্যারেজে গাড়ি দিয়ে মেলায় বৌকে নিয়ে একটু ঘুরবো। যা ইচ্ছে হয় দেবেন। এবার বুঝি মহিলাটি ওনার পত্নী। রামলীলা ময়দানের কাছে নেমে কুড়িটা টাকা দিয়ে বলি, চলবে? লোকটি অমায়িক হেসে বলে, ঠিক আছে। আমাকে তো আসতেই হোতো, আপনাকে পেয়ে যাতায়াতের তেল খরচটা উঠে গেল। ভাবি, মাখনের অযাচিত চা, অটোওলার অপ্রত্যাশিত লিফট, দিনটা ভালই গেল।
পরদিন নটায় গলিঘুঁজি ধরে লোহাঙ্গী হিলের গেটে গিয়ে দেখি তালা মারা। টিকিটের বালাই নেই কিন্তু সোমবার বন্ধ। ঘন সুঁচালো লোহার ফলা লাগানো তিন প্রস্থ গেট। কয়েকটি ছেলে বললো গেট টপকে ওই পাথরের খাঁজ ধরে উঠে যান, কোন চৌকিদার নেই আজ। গেট টপকাতে গিয়ে পা ফসকালে লৌহশলাকায় বিশেষ জায়গায় মারাত্মক জখমের আশাংকা। অতীতে শৈলারোহণের স্বল্প অভিজ্ঞতায় জানি, পাথরে ওঠার চেয়েও নামাটা কঠিন। অবশ্য জীবনযাপনেও তাই। আরামে অভ্যস্থ হয়ে গেলে কৃচ্ছসাধন সহজ নয়। আমায় চিন্তিত দেখে ওরা ভরসা দেয়, আঙ্কল, বেফিকর চলা যাইয়ে, হামলোগ তো যাতে হ্যায়। ওরা যেতেই পারে, অল্প বয়েস, হালকা শরীর। জ্ঞানবৃদ্ধরাও হঠকারিতায় নেই। মুশকিল হয় আমার মতো বয়স বিস্মৃত সোয়া ছাপ্পান্নর বিভ্রান্ত প্রৌঢ়ের। ভ্রান্ত প্রত্যয়ের হাতছানি বিপদজনক। তবু অদেখা লোহাঙ্গীর আকর্ষনে খুব সাবধানে তিন ধাপ গেট টপকে উঠে গেলাম। ওরা নিচ থেকে করতালি দিয়ে আমায় অভিনন্দন জানায়।
অতীতে সুফী সন্ত শেখ জালাল চিস্তীকে স্থানীয়রা লোহাঙ্গী পীর বলতো। তাঁর নামেই শহরের মাঝে প্রায় শ খানেক ফুট উঁচু এই আখাম্বা খাড়া টিলাটির নামকরণ। উপরে কোনো অজানা সন্তের সমাধি, পাশেই অন্নপূর্ণা মন্দির, মসজিদ, বৌদ্ধ স্তম্ভ, প্রার্থনা হল ইত্যাদি রয়েছে। সমাধির সামনে হালে লাগানো একটি শিবলিঙ্গও রয়েছে। যারা মন্দিরে পূজো দিতে আসে তারা মসজিদে ও সমাধিতেও প্রার্থনা করে যায়। সমাধিতে ফারসী ভাষায় ১৪৬০ ও ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দের কিছু লিপি উৎকীর্ণ আছে। আষাঢ় পূর্ণিমায় পাহাড়ের মাথায় বৌদ্ধ মেলা হয়। অর্থাৎ সর্বধর্মের সমাবেশ। অশোক স্তম্ভের মতো খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে পাথরে কোঁদা পদ্মের আকারে পিলারের উপরিভাগও পড়ে আছে। উপর থেকে চতুর্দিক সুন্দর দৃশ্যমান। আজ বন্ধ বলে জনমানবহীন। একটু ঝুঁকি নিয়ে এসে বেশ ভালোই লাগলো।
লোহাঙ্গী টিলার শিরে লাঞ্চের পর গেলাম বিজামন্ডল। ঘিঞ্জি বসতির মাঝে ASI এর তত্বাবধানে বেশ কিছুটা রেলিং ঘেরা জায়গা। গেট খোলা, টিকিট নেই। চৌকিদারকেও দেখা গেল না। আমি ছাড়া আর কোনো দর্শকও নেই। শিলালেখ থেকে জানা গেছে পরমার বংশীয় রাজা নরবর্মন একাদশ শতকে দেবী চর্চিকা বা বিজয়ার উদ্দেশে এই মন্দির নির্মান শুরু করেন। নাম ছিল বিজয়া মন্দির। অজ্ঞাত কারণে নির্মাণ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
অসম্পূর্ণ বিজামণ্ডল এর নির্মানশৈলী ও বিশালতা কোণারকের সূর্যমন্দিরের সাথে তুলনীয়। পরবর্তীতে খননে অনেক কিছুর সাথে মহিষাসুরমর্দিনী, অষ্টভূজ গণেশ মূর্ত্তি পাওয়া গেছে। অসমাপ্ত বিজয়া মন্দিরে কয়েকশো বছর ধরে চলে সূলতানী রোষ। ইলতুৎমিস (১২৩৪), আলাউদ্দিন খিলজী (১২৯৩) ও গুজরাতের বাহাদুর শাহের (১৫২৬) আমলে। অবশেষে ঔরঙ্গজেব ১৬৮২ সালে বিদিশার নাম পাল্টে করে দেন আলমগীরপুর ও বিজয়ামন্দিরের অনেকটা ধ্বংস করে তারই পাথর দিয়ে তৈরি করান আলমগীর মসজিদ। স্থানীয়রা অবশ্য বলতো বিজামন্ডল মসজিদ।
২৮৩ বছর ধরে এখানে চলে আসা ইদের নামাজ ১৯৬৫ সালে মধ্যপ্রদেশের তদান্তীন দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী পন্ডিত দ্বারকাপ্রসাদ মিশ্রের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়। সরকারী অনুদানে সাঁচী রোডে তৈরী হয় নতুন ঈদগাহ। ২০০২এ ASI মন্দির চত্বরে একটি গুদাম বানিয়ে এখানে পাওয়া মূর্ত্তির ভগ্নাংশ তালাবন্ধ করে রেখে দেয়। কিছু উন্মুক্ত জমিতেও সাজিয়ে রাখা আছে। তার কারুকার্য বেশ উন্নত মানের। এখানে আছে অষ্টম শতকের একটি বাউলী (step well). তার দেওয়ালে খোদিত আছে কৃষ্ণলীলার কিছু দৃশ্য। অনুমান ওই মন্দিরের আগেও এখানে কিছু ছিল।
সুলতানী ধ্বংসলীলার নমুনা
কিছু ভাস্কর্য সাজিয়ে রাখা আছে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। ASI এর উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
বিজামণ্ডল চত্বরে বাউলি। পিছনের গুদামে রাখা আছে এখানে খননে পাওয়া আরো কিছু ভাস্কর্য
বিজামন্ডল থেকে দেড় কিমি হেঁটে গেলাম চরণতীর্থ। পথে পড়ল কালকে দেখা রামলীলা ময়দান। একমাসব্যাপী জমকালো মেলা চলছে। বেত্রবতী বা বেতয়া নদীর বুকে প্রাকৃতিক দ্বীপের ওপরে তৈরী হয়েছিল তিনটি শিব মন্দির। ১৭৭২এ পেশোয়া নানা সাহেবের সেনাপতি আপ্পারাও খান্ডে নির্মান করেন রামেশ্বর শিব মন্দির। তাঁর ভগিনী জিজাবাই ১৮০৭ সালে নির্মান করেন গোপেশ্বর শিব মন্দির। তৃতীয় মহেশ্বর শিব মন্দিরটি কে, কবে নির্মান করেন জানা নেই। সেটি পরে জলের তোড়ে ভেসে যায়। আজ তার কোনো অস্তিত্ব নেই।
ভারতী মঠ থেকে চরণতীর্থ - বেতয়া নদীর মাঝে দ্বীপে দুটি মন্দির। তৃতীয়টি বণ্যায় বিলুপ্ত
কথিত আছে বনবাস কালে শ্রীরামচন্দ্র এখানে এসেছিলেন। পাথরে তার পদচিহ্নও আছে। তাঁর চরণস্পর্শ ধন্য এই স্থানটি তাই চরণতীর্থ নামে পরিচিত। মন্দিরের একটু আগে দানাবাবা ঘাট। স্থানীয় মানুষ কৃষনকান্তজীর সাথে কথা বলে জানা গেল এখানে নাকি ভারতের সর্ববৃহৎ যক্ষ ও যক্ষী মূর্ত্তি পাওয়া গেছিল, যার প্রতিকৃতি বর্তমানে দিল্লীর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গেটের দুপাশে রাখা আছে। চলে আসার আগে বললেন, ২০১৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া কৈলাশ সত্যার্থী (শর্মা) এই বিদিশারই মানুষ। বিদিশার সম্রাট অশোক টেকনিক্যাল কলেজে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং পড়েছিলেন। এই বিশাল দেশের কত কি যে অজানা আমার!
ইতিহাস চর্চায় বিশেষ বুৎপত্তি নেই। তাই বেশী গভীরে যাওয়ার সাধ্য নেই। তবে কোনো প্রাচীন জায়গায় গেলে তার মোটামুটি কিছু প্রেক্ষাপট জানলে ভালো লাগে। সেই আগ্ৰহ থেকেই ভাসা ভাসা কিছু জানলাম, এই লেখায় ধরে রাখলাম। সেবার একাকী ভ্রমণকালে সাঁচী, উদয়গিরি, বিদিশার প্রাচীনতার গন্ধমাখা সান্নিধ্যে তিনটে দিন বেশ কাটলো।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।