এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  ঘুমক্কড়

  • ভাদিয়াকুন্ড - ১

    সমরেশ মুখার্জী লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | ঘুমক্কড় | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৬৭১ বার পঠিত | রেটিং ৩.৫ (২ জন)
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩
    বাতিল হোলো পূর্ব পরিকল্পনা

    সেদিন ১২ই জানুয়ারি ২০২০ রবিবার। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর পঞ্চম দিন। হোম‌ওয়ার্ক অনুযায়ী প্ল‍্যান-এ ছিল সুরয়ায়া গড়ি থেকে শিবপুরীর দিকে ১২কিমি দুরে ঘসারাইতে মোহনী মহারাজ আশ্রমে রাতটা কাটাবো। ওখানে রণজিৎ হনুমান মন্দিরে অখন্ড রামনাম সংকীর্তন হয়। তার মাত্রা কেমন অজানা। করেরা মন্দিরে রাত চারটে অবধি উদ্দাম সুন্দর‌কাণ্ড পাঠের অভিজ্ঞতা তাজা। বয়স হয়েছে, সারাদিন হাঁটাহাঁটি‌র পর রাতের ঘুমটা ঠিকঠাক না হলে পরদিন ক্লান্ত লাগে। তবে মোহনী মহারাজ আশ্রমটা বড়। কোনো এক কোনে কোথাও বডি ফেলার জায়গা পেলে কানে তুলো গুঁজে ম‍্যানেজ হতে পারে।

    গত মে-জুনে একাকী উত্তরাখন্ড ভ্রমণে একটা টেন্ট ছিল সাথে। এবার সেটা থাকলে এসব জায়গায় কাজে আসতো। আশ্রমে জায়গা না পেলে প্ল‍্যান-বি ছিল সোয়া কিমি দুরে বাঁকড়ে হনুমান মন্দির। কিন্তু শর্মনের শলা‌ শুনে ঘসারাই থেকে পাঁচ কিমি এগিয়ে ভাদিয়াকুন্ড যাওয়া‌ই ঠিক করি। অর্থাৎ প্ল‍্যান-সি ফাইনাল।
    প্রগতজীর ধাবায় মিনিট দশেক অপেক্ষা করতেই এলো শিবপুরী‌র লোকাল বাস। দুটো স‍্যাক নিয়ে চলন্ত বাসে আমার টলোমলো অবস্থা দেখে একটি কিশোর পিছনে‌র সীট থেকে উঠে বলে, আঙ্কল, আপ বৈঠিয়ে। এমন বিরল সহবতে মন দ্রবীভূত হয়।

    এক মধ‍্যবয়স্ক সহযাত্রীকে বলি, আমি আগে এদিকে আসিনি, ভাদিয়াকুন্ড যাবো, কোথায় নামতে হবে, মেহেরবানী করে যদি একটু আগে বলে দেন, ভালো হয়। দুজন নিজেদের মধ‍্যে আলোচনা করে, বাস কোথা দিয়ে যাবে কন্ডাক্টর‌কে জিজ্ঞাসা ক‍রে আমায় বলে, আপ কো কারবালা চক উতারনা হ‍্যায়। উঁহাসে ভাদিয়াকুন্ড পয়দল সিরফ্ পাঁচ সাত মিনট কা রাস্তা, বেফিকর রহিয়ে বাবুজী, হাম বাতা দেঙ্গে। একাকী ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় দেখেছি গ্ৰামেগঞ্জে স্থানীয়রা শহুরে হাবভাব দেখলে গুটিয়ে যায়। সহজভাবে কথা বললে আন্তরিক‌ভাবে সাহায্য করতে চায়।

    যাক নিশ্চিন্ত হ‌ওয়া গেল। কিন্তু কারবালা চৌরাস্তা‌টা কী ব‍্যাপার? ইরাকের কারবালা প্রান্তরে হজরত মহম্মদের দৌহিত্র হোসেন ইবন আলী দেড়শো সাথী নিয়ে ইয়াজিদের চারহাজার সৈন‍্যের সাথে প্রতিবাদের লড়াইয়ে শহীদ হন। দিনটা ছিল ১০ই অক্টোবর ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দ। সেই উপলক্ষে পালিত হয় শোকের উৎসব মহরম। কিন্তু এখানে কারবালা চকের কী তাৎপর্য? জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওখানে একটি তালাও‌তে মহরমের তাজিয়া‌ বিসর্জন দেওয়া হয়, তাই নাম কারবালা চক।

    কারবালা চকে নেমে আধা কিমি উত্তরে হেঁটে পৌঁছ‌ই মধ‍্যপ্রদেশ পর্যটনের ট‍্যুরিস্ট ভিলেজ রিসর্টের গেটে। আনুমানিক ২০০x১০০মিটার জায়গা‌ নিয়ে বিলাসবহুল পর্যটকাবাস। বিয়ের পার্টি‌ও হয় ওখানে। সুন্দর সাজানো পার্ক। রিসর্টের দক্ষিণে কিছুটা নীচে বিস্তৃত সখ‍্যাসাগর লেক। রিসর্টের নিজস্ব ছোট্ট বোটিং জেটি‌ও রয়েছে। রিসর্টের সীমানা থেকেই শুরু মাধব ন‍্যাশানাল পার্ক। যে রাস্তায় এলাম তা রিসর্টের গেট থেকে বাঁদিকে চলে গেছে বাণগঙ্গা ধামের দিকে। সিন্ধিয়া ছত্রী পরিসর ছুঁয়ে তা গিয়ে মিলেছে শিবপুরী রিং রোডে। রিসর্টে একটি রাত্রি‌বাসের নূন‍্যতম দক্ষিণা মাত্র তিন হাজার - অর্থাৎ আমার ঝোলাপিঠে ভ্রমণের আট দশ দিনের খরচ।

    ওসবে আমি নেই। তাই ট‍্যূরিস্ট ভিলেজকে নমো করে সবুজ লনে উদাসীন দৃষ্টি বুলিয়ে ডান দিকে দক্ষিণ-পূর্ব দিশায় শখানেক মিটার দুরে ভাদিয়াকুন্ডের পথ ধরি। সপ্তাহে সাতদিন‌ই সকাল আটটা থেকে রাত দশটা অবধি খোলা। তবে সন্ধ‍্যা‌র প‍র আলোআঁধারে, মশার কামড়ে ভাদিয়াকুন্ড ঝর্না ও সংলগ্ন সখ‍্যাসাগর লেক মোটেও উপভোগ্য নয়। বোটিংয়ের তো তখন প্রশ্ন‌ই নেই। লেকের পাশে সংলগ্ন উদ‍্যানে হয়েছে লেকভিউ কাফে। শিবপুরী শহরের কেন্দ্র থেকে ভাদিয়াকুন্ড প্রায় সাত কিমি। তবু সন্ধ্যার পরেও নির্জনতা সন্ধানী‌রা সেখানে যায়। তাই রাত দশটা অবধি গেট খোলা থাকে।

    দশ টাকার টিকিট কেটে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে ফুট চল্লিশেক নীচে নামি। ঐ টিকিটে চব্বিশ ঘন্টায় যতবার খুশি আসা যাওয়া করা যায়। ২৫মি চ‌ওড়া পাথর বাঁধানো চত্বর। বসার বেঞ্চ। মাঝে বাঁধানো লম্বাটে অগভীর জলাশয়ের ওপর রেলিং দেওয়া পারাপারের খেলনা সেতু। জলাশয়‌টি সোয়াশো মিটার পূবে গিয়ে মিশেছে সখ‍্যাসাগর লেকে। বেশ কিছু বড় বড় পত্রময় প্রাচীন বৃক্ষের ফলে জায়গাটা বেশ ছায়াময়। অনেক লালমুখো বাঁদরের দাপাদাপি। এসব তো ওদের‌ই জায়গা। আমরাই অবাঞ্ছিত। তবু ওরা থাকে ওদের মতো। বিরক্ত না করলে বা সামনে দিয়ে হাতে খাবারের ঝোলা ঝুলিয়ে না গেলে ওরা‌ দর্শকদের কিছু বলে না। চারপাশে চোখ বুলিয়ে তৃপ্তি হয়।

    পশ্চিমে ফুট চল্লিশের খাড়া পাথরের দেওয়াল। একটু জায়গা ছেড়ে বারোটা খিলান‌ওয়ালা ইংরেজি S অক্ষরের আকারের চাতাল। ভিতরে শঙ্কর ভগবানের স্থান। চাতালের পাথরের ঢালু ছাদ বেয়ে চুঁইয়ে নামছে জলধারা। তাতে নাকি আছে উপকারী খনিজ পদার্থ। ভিতরে মহাদেবের স্থানের দুপাশে চারটি পাথরের গোমুখ দিয়ে বেরোনো জল নাকি তার উপকারী‌তার জন‍্য একদা রপ্তানি হোতো। চাতালের ধার বরাবর ইংরেজি S অক্ষরের মতো‌ই কয়েক ধাপ সিঁড়ি - আসলে স্টেপ রিটেনিং ওয়াল - চাতালটা ধরে রাখার জন‍্য। জল পড়ে সিঁড়িতে শ‍্যাওলা ধরেছে। সিঁড়ির শেষে একটা ২৫x১৫মিটার কুন্ড - সেটা‌ই ভাদিয়াকুন্ড। জনশ্রুতি বিবাহের পূর্বে বা পরে মনোমালিন্যে‌র কারণে সম্পর্ক পানসে হয়ে এলে যুগলে এই কুন্ডে স্নান করলে নাকি তা পুনরুজ্জীবিত হয়। তবে যতো যুগল ওই কুন্ডে স্নান করতে আসে তাদের সবার‌ই যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে গেছে তা না‌ও হতে পারে। কেউ হয়তো আসে না জেনেই, স্রেফ কুন্ডে স্নানের আনন্দ নিতে। কেউ বা আসে জেনে, সুসম্পর্ক থাকলেও, তা বজায় রাখতে।

    কুন্ডে‌র জল খেলনা সেতুর তলা দিয়ে আর‌ও কয়েকটি খেলনা জলাশয় হয়ে অবশেষে গিয়ে পড়ছে পূব দিকে সখ‍্যাসাগর লেকে। ওখানে দিনের বেলা বোটিং হয়। চত্বরের উত্তরে খাড়া পাথরের ফুট পঞ্চাশেক দেওয়া‌ল। তার উপরেই রিসর্ট। নীচে চত্বরে‌র ফুট পাঁচেক উপরে সেই পাথরের দেওয়ালে একটি পাইপ লাগানো। সেখান দিয়ে বারোমাস দিবারাত্রি বেরিয়ে আসছে পরিস্কার জল। স্থানীয়দের মতে সেই জল‌ও শরীরের পক্ষে খুব ভালো। লোকে নির্দ্বিধায় আঁজলা ভরে পান‌ও করছে। আমি ওখানে দুদিন থাকাকালীন ঐ জল‌ই পান করেছি। তবে শহুরে মনে সংশয়ে‌র কারণে বোতলে ভরে ক্লোরিন ট‍্যাবলেট দিয়ে।

    জানুয়ারি‌তে ভাদিয়াকুন্ড ঝর্ণা‌য় জলের ধারা শীর্ণ ও স্বচ্ছ। বর্ষা‌য় ওখান দিয়েই লাফিয়ে নামে মাটি ধোয়া লালচে জলের বিশাল ধারা। তখন এ ঝর্ণার রূপ দর্শনীয়। লোকজন তখন‌ই বেশি আসে এখানে। নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রকৃতির সমীহ উদ্রেককারী শক্তি‌র প্রকাশ মানুষ‌কে চিরকাল আকর্ষণ করে এসেছে। বিদ্ধংসী ঘূর্ণিঝড়, মহাপ্লাবন, ভয়াবহ সুনামী, আগ্নেয়গিরির‌র অগ্নুৎপাত - প্রকৃতির এহেন সব রুদ্রলীলার ভিডিও তাই মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখে।

    রাত্রি‌বাসের সন্ধানে

    চত্বরের দক্ষিণে রয়েছে একটি ছোট মন্দির। গেরুয়া শিখর। পাশে দুটি ঘর সমেত লম্বাটে টানা বারান্দা। ওটাই কী রঘুবীর পুরী মহারাজের আশ্রম? একজন বয়স্ক সিকিউরিটি গার্ড পাইপের জলে চান করার আগে উর্দি খুলে গায়ে তেল মাখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাকে‌ই জিজ্ঞাসা করে জানলাম আমার অনুমান সঠিক। তবে মহারাজ কদিনের জন‍্য গেছেন হরিয়ানা। মন্দিরের সেবক হিসেবে এখন আছেন তাঁর সঙ্গী রাধেশ্বর পুরী মহারাজ। তবে তিনি‌ও তখন সেখানে নেই। কাছেই কোথাও ভান্ডারা হচ্ছে, গেছেন সেখানে। আসবেন তিনটে নাগাদ। আশ্রমে তখন কেউ নেই।

    মন্দিরের বাঁদিকে একটি দরজায় হুড়কো টানা। তালা নেই। জুতো খুলে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকি। ছোট চৌকোনা একটা খিড়কিহীন জায়গা। বড় লোহার ট্রাঙ্ক, ড্রাম, কিছু বস্তা রাখা। মনে হয় ভাঁড়ার ঘর। বাঁদিকে কয়েক ধাপ নেমে প্রশস্ত একটা ঘর। বেসমেন্টে‌র মতো। লাল মেঝে। মাঝে আসন পাতা। দেওয়ালে কিছু ভগবানের ও মহারাজের বাঁধানো ফটো। তাতে মালা পরানো। এক পাশে একটি একানে চারপাই। মনে হয় এটাই মহারাজের শয়ন কাম সাধনকক্ষ। বাইরে টানা ঢাকা বারান্দা। ভাবি ঘরে থাকতে না পেলে ঐ বারান্দাতেই রাতটা কাটিয়ে দেবো। রাতে বাঁদরের বাঁদরামি‌র ভয় নেই। সাথে মশারী আছে। মেঝেতে পাতার একটা পাতলা ফোমম‍্যাট আছে। একটা খাপি কম্বল কিনেছি করেরায়। সুরয়ায়া‌র আশ্রমের মতো এখানে‌ও নিশ্চ‌ই দু একটা কম্বল পেয়ে যাবো। তাহলে আর চিন্তা কিসের? পিঠের বড় স‍্যাকটা ভাঁড়ার ঘরের এক কোনে রেখে বেরিয়ে আসি।

    তৈলমর্দনরত গার্ডকে বলি, দেখুন, আমি রাতে আশ্রমে থাকবো ভেবে সুরয়ায়া রামজানকী মন্দির থেকে এসেছি। মহারাজের সাথে তো দেখা হোলো না। এখন বারোটা বাজে। আমি বাঁকড়ে হনুমান মন্দির থেকে ঘুরে আসছি। আপনি তো এখানে পাঁচটা অবধি থাকবেন বললেন, মহারাজ এলে দয়া করে একটু বলে দেবেন ওনাকে যে কলকাতা থেকে একজন এসে ঐ স‍্যাকটা রেখে গেছে। নয়তো চিন্তায় পড়ে যাবেন, কে আবার ওখানে ব‍্যাগ রেখে গেলো ভেবে। স‍্যাকের ওপর আমার নাম ও মোবাইল নম্বর লেখা আছে। চাইলে আমায় যোগাযোগ‌ও করতে পারেন উনি। কোনো অসুবিধা নেই তো? উনি বলেন, কোনো অসুবিধা নেই। আপনার সামান সলামত থাকবে। আপনি ঘুরে আসুন। মহারাজ এলে আমি আপনার কথা বলে দেবো। তবে রাতে এখানে থাকতে পারবেন কিনা সেটা কিন্তু উনি‌ই বলবেন। সে ব‍্যাপারে আমি কোনো আশ্বাস দিতে পারবো না। বলি, সে তো বটেই। আপনি কেবল ওনাকে আমার কথা বলে দিলেই হবে। বাকি কথা আমি এসে ওনার সাথে বলবো।

    বিরসবদন বাবা

    ভাদিয়াকুন্ডের আশ্রমটা দেখে‌ মহারাজের সাথে দেখা না হয়েও মনে হোলো এখানে একটা কিছু ব‍্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। অনিশ্চয়তাবোধ চলে গেল। একাকী ভ্রমণে বেশ কয়েকবার আমি ষষ্ঠেন্দ্রিয়র এমন বার্তা পেয়েছি, যেমন - ওখানে না যাওয়াই ভালো, এখানেই হয়তো হয়ে যাবে, আর একটু দেখা দরকার - ইত‍্যাদি। এযাবৎ তা সঠিক প্রতিপন্ন হয়েছে। তাই হালকা হয়ে চললুম ফেলে আসা সুরয়ায়া‌র পথে।

    রিসর্টের কাছে আসতে দেখি জলের ক‍্যানের পাঁজা নিয়ে যাচ্ছে একটা তিন চাকার পুঁচকে ভ‍্যান। মিনারেল ওয়াটার সাপ্লায়ার। হাত দেখাতে দাঁড়িয়ে যায়। বলি, মোহনী বাবা আশ্রম যাবো, আপনি তো ওদিকে‌ই যাচ্ছেন, একটু ছেড়ে দেবেন? চালক কেবিনের দরজা খুলে বলেন, আসুন। আপনাকে হাইওয়েতে ছেড়ে দিয়ে আমি ডানদিকে চলে যাবো। ওখান থেকে বাস‌ পেয়ে যাবেন। ভাদিয়াকুন্ড থেকে মোহনী‌বাবা আশ্রম পাঁচ কিমি। ২৭নম্বর জাতীয় সড়কে আমায় ছেড়ে দিয়ে ভ‍্যান চলে যায় ডানদিকে। বাঁদিকে একটু দুরে দেখি একটা বাস থেকে লোক নামছে। যাবে করেরা‌র দিকে। দৌড়ে যাই। কন্ডাক্টর আমায় খেয়াল করেনি। বাসটা চলে যায়। পিছনে‌ই আসছিল একটি বাইক। হাত দেখাতে সে দাঁড়িয়ে যায়। বলি, মোহনী‌বাবা আশ্রমের কাছে ছেড়ে দেবেন? ছেলেটি বলে বসুন, আমি‌ ওদিকে‌ই যাচ্ছি, ভাগোড়া। স্থানীয় ছেলেটি সরলমতির। ওটুকু পথেই সে ওর অনেক কথা বলে।

    আশ্রম প্রাঙ্গণে তিন জটাধারী রোদ পোয়াচ্ছিলেন। ভাদিয়াকুন্ডে হয়তো থাকার ব‍্যবস্থা হয়ে যাবে তবু আমার স্বভাব প্ল‍্যান-বি ছকে রাখা। এক্ষেত্রে তো এটাই ছিল প্ল‍্যান-এ। এক বাবার কথাবার্তা খুব মার্জিত, আন্তরিক। অন‍্যজন রয়েছেন ভাবের ঘোরে। তৃতীয়‌ বাবার চিরতা চিবোনো মুখভাব সুবিধার লাগলো না। হাবভাব দেখে মনে হোলো তিনি‌ই ওনাদের মধ‍্যে মূখ‍্য। তিনি জানালেন ওনাদের কোনো একটা উৎসব চলছে তাই আশ্রমের গোটাকতক অতিরিক্ত ঘরে এখন কয়েকজন বহিরাগত সাধু রয়েছেন। তাই ঘর পাওয়া যাবে না।

    আমি আগেই আশ্রমটা এক চক্কর ঘুরে দেখে নিয়েছি। ওখানে আছে একটা পাকা ছাদের বড় যজ্ঞমন্ডপ। তার চারপাশে গ্ৰীলের দেওয়াল এখন ঠান্ডার জন‍্য মোটা প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা। পরিস্কার সিমেন্টের মেঝেতে কয়েকটি বিছানা পাতা। মানে ওখানে কেউ এখন থাকছেন। তবে এখনও জনা ছয়েক লোক আরামসে শুতে পারে। উল্টো দিকে একটু দুরে আর একটি মন্ডপে জনা তিনেক ভক্ত খোল, কত্তা‌ল, হারমোনিয়াম ছাড়া নিম্নস্বরে নিবেদিত ভঙ্গিতে রামনাম জপছেন। ওটা‌ই অখন্ড সংকীর্তন। ঝলমলে দিনে‌র বেলায় যদি এমন ঝিম ধরা ব‍্যাপার হয় তাহলে রাতের প্রবল ঠান্ডায় তার মাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা কম। তাই বলি, আমার ঘর না হলেও চলবে। ঐ মন্ডপে‌র মেঝেতে কি আজ রাতটা শুতে পারি? বিছানাপত্র‌ও কিছু চাই না। ওসব আছে আমার কাছে।

    আমার চেহারা, পোষাক, হাবভাবে প্রথাগত ভক্তসূলভ ছাপ নেই। হয়তো সে জন্য‌ই মুখ‍্যবাবা জানতে চান, এভাবে কষ্ট করে আশ্রমে থাকতে চান কেন? সুরয়ায়া‌তে লাল্লুকে দেখানো বেড়ালটা আবার ঝোলা থেকে বার করি। এমন যাত্রায় সেটাকে অনেকবার বার করতে হয়েছে। তবে বেড়াল দেখে‌‌‌ও বাবা লাল্লুর মতো প্রভাবিত হলেন না। বাবার মুখভাব ক্রনিক আমাশা রুগী‌র মতো অপ্রসন্ন। তবু স্বরে কয়েক আউন্স সেন্টিমেন্ট মাখিয়ে বলি, যদি রাতটা এখানে কাটাতে আসি, মোহনী মহারাজের কৃপা থেকে বঞ্চিত হবো না তো? মূখ‍্যবাবা হয়তো এমন ছিনে জোঁকের পাল্লায় আগে পড়েন নি। নিস্তার নেই দেখে নিমরাজি ভঙ্গিতে অস্পষ্ট ভাবে মাথা নাড়েন। সেটাই আমি ভিসা অন এ্যারাইভালের প্রতিশ্রুতি ধরে নি। প্ল‍্যান-এ বস্তির টাইমকলের লাইনে বালতি রাখার মতো আশ্রমের যজ্ঞশালার বুড়ি ছুঁয়ে থাকে। আমি জোড়হস্তে নমস্কার করে বিদায় নিই। হোবো শৈলী‌তে ঘুরতে হলে গাত্রচর্মটা নাসিকাশৃঙ্গী প্রাণী গোত্রের ভাবলে কোনো সমস্যা হয় না।

    শ্বেত পাথরের হেরিটেজ মাইল ফলক

    আশ্রম থেকে পূব দিকে ভাঙাচোরা রাস্তায় হাঁটতে থাকি। যাবো বাঁকড়ে হনুমান মন্দিরে। রাস্তা পূনর্নিমানের কাজ চলছে। বাঁদিকে মাধব জাতীয় উদ‍্যানে‌র তারকাঁটার বেড়া। আধা কিমি যেতে বাঁদিকে চোখে পড়ে একটা চ‌ওড়া কাঁচা রাস্তা চলে গেছে জাতীয় উদ‍্যানে‌র দিকে। সেই রাস্তার মোড়ে দেখি একটা প্রাচীন মাইলস্টোন। ইঁটের গাঁথুনি করে শ্বেতপাথরের ফলক লাগানো। তাতে খোদাই করে লেখা BANKREY HANUMAN ROAD. Furlong 8-3.

    মাইল, ফার্লং ছিল ব্রিটিশ জমানায় দূরত্বের ইম্পিরিয়াল ইউনিট। এক ফার্লং মানে এক মাইলের আটভাগের একভাগ যা মেট্রিক ইউনিটে ২০১.১৬৮ মিটার। বাঁকড়ে হনুমান মন্দির এখান থেকে মোটে ছশো মিটার। তারপর এই রাস্তা কোটা, হাতোদ হয়ে অর্জুনগাঁও থেকে বাঁদিকে ঘুরে ১৭কিমি দুরে শিবপুরী গোয়ালিয়র জাতীয় সড়কে গিয়ে মিলেছে। কিন্তু ৮-৩ ফার্লং মানে তো ১৬৭০ মিটার। অর্থাৎ এই মাইলফলকটি মন্দিরের দূরত্ব‌সূচক নয়, যে সময়ে এই মেঠো পথটি ঝাঁসি শিবপুরী সড়ক থেকে সোয়া দু কিমি গিয়ে‌ই শেষ হয়ে গেছি‌ল - সেই পথের দৈর্ঘ্য‌সূচক। তার মানে এই মাইলফলকটি শতাব্দী প্রাচীন হেরিটেজ আইটেম! তখন ঐ রাস্তা যতটা গিয়ে শেষ হয়ে গেছি‌ল হয়তো সেখান থেকেই তখন‌ও অক্ষত ছিল শিবপুরী‌র বিখ‍্যাত জঙ্গল। অবশ‍্য তখন এই এলাকা ছিল নরোয়র জেলার অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান জেলা সদর শিবপুরী তখন ছিল শিপড়ি নামক ছোট জনপদ। এই বাঁকড়ে, কোটা, পরাসরি, বলারপুর বা আরো পূবে সুরয়ায়া বরং সে তুলনায় তখন ছিল বর্ধিষ্ণু জনপদ।

    বিপর্যস্ত হালুম

    অতীতের শিপড়ি‌র বিস্তৃত অরণ‍্য ছিল মোগল, মারাঠা, সিন্ধিয়াদের রাজকীয় মৃগয়াভূমি। এখান থেকে‌ই ১৫৬৪ সালে আকবরের বাহিনী মান্ডু থেকে আগ্ৰা যাওয়ার পথে ধরে নিয়ে যায় বেশ কিছু হাতি। তারপরেও অনেক‌বার আকবরের হাতিশালের জন‍্য শিপড়ি‌র জঙ্গল থেকে হাতি ধরা হয়েছে। লর্ড কার্জনের পর ১৯০৫ সালে ষাট বছর বয়সে ভাইসরয় হলেন লর্ড মিন্টো। দাম্ভিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মিন্টো গোয়ালিয়র পরিদর্শনে এসে এই শিবপুরী‌র জঙ্গলে‌ই মেরেছিলেন উনিশটি বাঘ। পরবর্তী ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ‌‌ও কম যান না। ১৯১৬ সালে এ‌ই জঙ্গলে একদিনে‌‌ই তিনি ভবলীলা সাঙ্গ করেন আটটি হালুমের।

    এভাবে যথেচ্ছ শিকারের ফলে শিবপুরী‌র জঙ্গলে ক্রমশ কমতে থাকে বাঘ। জঙ্গল কেটে বসতি, চাষজমি তৈরির ফলে সংকুচিত হতে থাকে অরণ‍্য। অবশেষে ১৯৫৯ সালে ৩৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মহারাজা মাধো রাও সিন্ধিয়া‌র স্মৃতি‌তে মাধব জাতীয় উদ‍্যান ঘোষণা করে শুরু হয় অরণ‍্য ও বন‍্যপ্রাণ সংরক্ষণের উদ‍্যোগ। জাতীয় উদ‍্যানে‌র আওতায় আসায় বাঁকড়ে ও অর্জুনগাঁও জনপদ পরিত্যক্ত হয়। তবে ততদিনে ক্ষতি যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে। তাই ১৯৭০ সালের পর এখানে আর বাঘের দেখা পাওয়া যায় নি।

    তাহলে রাজদর্শনের উপায়?

    জোমাটো এ্যাপে নিমেষে ফাস্টফুড আনানোর মতো চাইলে‌ই বাঘ দেখতে হলে এখন যেতে হবে জুলজিকাল পার্কে। তারজালির ঘেরাটোপে‌ সীমিত পরিসরে মনূষ‍্য নির্মিত আরণ‍্যক পরিবেশ। বিভিন্ন কোটা‌য় সংরক্ষিত সরকারি চাকরির মতো এখনো সেখানে সংরক্ষিত আছে কিছু বাঘ। সংখ্যা‌য় তারা সামান‍্য। তাদের শিকার করার ঝক্কি নেই। সরকারি মাংস খেয়ে বেড়েছে ভুঁড়ি। আদুরে বেড়ালের মতো তারা গাছের ছায়ায় পড়ে পড়ে ঘুমোয়। রোববার বিকেলে ভাতঘুম দিয়ে ওঠা কেরানী যেমন অলস হাই তুলে গিন্নি‌কে ডাকে - ক‌ই গো চা দাও, এরাও তেমনি বিকেলে ক্ষিধে পেলে চনমন করে তাকায়, মৃদু হাঁক পাড়ে। রক্ত জল করা হালুমের বদলে তা এখন জোরালো মিঁয়াও সদৃশ।

    কিছু ডাকাবুকো ডোরাকাটা‌ও আছে। তাদের অন‍্য কোনো জঙ্গলে‌র নিকটবর্তী গ্ৰামাঞ্চলে দুষ্টুমি‌ করার জন‍্য এখানে কয়েদ করা হয়েছে। অবাধ অরণ‍্যচারণায় বাধা পড়ার দুঃখে, ফেলে আসা জঙ্গলের কথা ভেবে কখনো অস্থির‌চিত্তে তারা একনাগাড়ে এপাশ ওপাশ পায়চারি করে যায়। যে বাঘ জন্মেছে এই ঘেরাটোপে‌ তার নেই উন্মুক্ত জঙ্গলে‌র অভিজ্ঞতা, তাই নেই কোনো অস্থিরতা‌ও। সে এই সীমিত পরিসরে‌ই অভ‍্যস্থ হয়ে গেছে। পেল্লায় গতর আর বাহারি ডোরাকাটা আলখাল্লা ছাড়া তার চরিত্রে বাঘত্ব‌ আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই।

    মাধব জাতীয় উদ‍্যানে গাড়িতে জাঙ্গল সাফারি‌তে এখন চিতল, নীলগাই বা শেয়াল দেখতে পেলেই উল্লসিত হয় পর্যটক‌রা - যাক তবু কিছু "ওয়াইল্ড লাইফ" দেখা হোলো। ফেসবুকে পোষ্ট করা যাবে। ট‍্যূর গাইডের মুখে বিগতদিনের বাঘের গল্প শুনে‌‌ই হতে হয় সন্তুষ্ট। ভাগ‍্যে থাকলে এখন‌ও টিকে থাকা কিছু লেপার্ডের চকিত দর্শনে দুধের স্বাদ কিছুটা মিটতে পারে ঘোলে। পাউচের দুধের স্বাদ পেতে সারিস্কা বা শিবপুরীতে রূপান্তরিত হ‌ওয়ার আগে‌ যাওয়া যেতে পারে রণথম্বোর বা বান্ধবগড়। বাঘ চাইলে ছুটে এসে হাইজাম্প মেরে হাতির পিঠে‌ও উঠে পড়তে পারে। তবে ওখানে‌ রাস্তার ধারে বাঘ দেখতে পেয়ে খোলা জিপসি‌র ফ্রেমে ভর দিয়ে দুম্বো ক‍্যামেরা নিয়ে হামলে পড়া দেশি বিদেশি পর্যটকদের নিত‍্য আদেখলাপনা দেখে দেখে বাঘের‌ও চোখ পচে গেছে। তাই তারা সাফারি পথের পাশ দিয়ে‌‌ পর্যটকদের টেরিয়ে দেখতে দেখতে পথকুকুরের মতোই নির্বিকার ভাবে চলে যায়। তাই বলেছি প‍্যাকেটের দুধ। তবে মালাই না মারা সদ‍্য দোয়া দুধের স্বাদ পেতে গাড়ি রাস্তা ছেড়ে এলিফ্যান্ট সাফারিতে কানহা, করবেট, কাজিরাঙা বা মানস অভয়ারণ‍্যে গেলে এখন‌ও প্রকৃত জংলী পরিবেশে আপন বিচরণ ক্ষেত্রে রাজকীয় মহিমায় দর্শন পাওয়া যায় বনের রাজার।

    তবে পর্যটকদের নিত‍্য আনাগোনা বাঘের মতো একান্তচারী প্রাণী‌র পক্ষে অত‍্যাচার বিশেষ। তাই বাফার জোনে চললেও কোর জোনে টাইগার সাফারি‌ নিষিদ্ধ হ‌ওয়া উচিত। গভীর জঙ্গলে তাদের থাকতে দেওয়া হোক নিজের মতো। কোর এরিয়া‌য় যাওয়ার অধিকার থাকুক কেবল বনকর্মী, ব‍্যাঘ্র বিষয়ে গবেষকদের। দক্ষ চিত্র গ্ৰাহকের‌ও সেখানে যাওয়ার অনুমতি থাকুক‍। তারা গভীর অধ‍্যবসায়ে তুলে আনবেন বাঘের গতিবিধি‌র কিছু উচ্চমানের ভিডিও। টাইগার রিজার্ভ প্রাঙ্গণের প্রেক্ষাগৃহে বড় স্ক্রিনে দেখা‌নো হোক সেই ভিডিও। সেখানে আধ ঘন্টায় পর্যটক‌রা যা দেখবে তা হয়তো কয়েক মাসের পরিশ্রমের ফসল। সেই ভিডিও অন্তর্জালে প্রকাশিত না হোক, তা কেবল ওখানে গিয়ে টিকিট কেটে‌ই দেখা যাবে। তাহলে পর্যটকদের চোখের ক্ষিধে মিটবে। পার্কের‌‌ দুপয়সা রোজগার হবে। বনের রাজা রাণী ও তাদের ছানাপোনা‌রাও থাকবে শান্তি‌তে।

    ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশংসনীয় উদ‍্যোগ

    উত্তর-পশ্চিম ভারতে মধ‍্যপ্রদেশ, গুজরাত ও রাজস্থানের ২ লক্ষ ৬৭ হাজার বর্গকিমি এলাকা জুড়ে আছে কাথিয়াবাড় গির শুস্ক পর্ণমোচি বনাঞ্চল। এখানেই আছে ভারতের প্রাচীন‌তম পর্বতমালা - আরাবল্লী। মাউন্ট আবু যার শিরোমণি। এই বিস্তৃত অঞ্চলে আছে ১৮টি স্বীকৃত অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ‍্যান। এশিয়া‌টিক সিংহর শেষ বাসস্থান গির‌ অরণ‍্য‌ও এই বনাঞ্চলে। মাধব জাতীয় উদ‍্যানের অবস্থান‌ও এই ভৌগোলিক পরিমন্ডলে।

    দোষে গুণে‌ই মানুষ। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী‌ নিজ স্বার্থে দেশে জরুরী অবস্থা জারি করে দেশবাসীর কাছে হয়েছে‌ন কলঙ্কিত। তবে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজের জন‍্য তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা‌‌ও প্রাপ‍্য। যেমন আমেরিকার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সামরিক সাহায্য করে বাংলাদেশের সৃষ্টি বা অপারেশন ব্লুস্টার দিয়ে খালিস্থান আন্দোলন খতমের সূত্রপাত। তবে সেগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অরাজনৈতিক প্রেক্ষিতে মূলত তাঁর‌ই উদ‍্যোগে ১৯৭২ সালে লাগু হয় বন‍্যপ্রাণী সংরক্ষণ আই‌ন। সেটা‌ ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। ১৯০০ সালে সারা পৃথিবীতে বন‍্য বাঘের সংখ‍্যা ছিল আনুমানিক এক লক্ষ যার অধিকাংশ‌ই ছিল অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে। রাজন‍্য, অমাত‍্য ও উচ্চশ্রেণীর মানুষের অবাধ মৃগয়া চলেছে ১৯৬৮ সাল অবধি। সাথে ছিল চোরা শিকারের দৌরাত্ম্য। ফলে বন‍্য বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে।

    অনেক দেরী হয়ে গেলেও এ‌ই প্রেক্ষাপটে ইন্দিরা‌জী পরের বছর নিলেন আর একটি অত‍্যন্ত জরুরী ও প্রসংশনীয় উদ‍্যোগ - প্রোজেক্ট টাইগার - যার ফল ভবিষ্যতে হবে সূদুরপ্রসারী। ১৯৫৬ সাল থেকে বাঘ বাঁচাতে মরীয়া আবেদন করে আসছিলেন রাজস্থান বনদপ্তরের এক অফিসার‌ কৈলাস সঙ্খলা। তিনি পরে হয়েছিলেন রাজস্থানের চিফ ওয়াইল্ড‌লাইফ ওয়ার্ডে‌ন। অর্থাৎ বণ‍্যপ্রাণের ব‍্যাপার‌টা তিনি ভালো‌ই বোঝেন। ইন্দিরা‌জী তাঁকেই প্রোজেক্ট টাইগারের প্রথম অধিকর্তা মনোনীত করে সবাই‌কে বুঝি‌য়ে দিলেন এটা নিছক একটা সরকারি ঢক্কানিনাদ নয়, তিনি এ ব‍্যাপারে যথেষ্ট সীরিয়াস। কৈলাসজী তখন ছিলেন দিল্লী জুলজিক‍্যাল পার্কের অধিকর্তা।

    পয়লা এপ্রিল ১৯৭৩ সালে করবেট জাতীয় উদ‍্যানে‌র ধিকালা রেঞ্জে যখন এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় তখন সারা ভারতে ৯টি টাইগার রিজার্ভে বাঘের সংখ‍্যা কমে দাঁড়িয়ে‌ছে মাত্র ২৬৮তে। বনকর্মী, সহযোগী গ্ৰামবাসী, সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, সাংবাদিক, আমলা, মন্ত্রী, সরকারি দপ্তর সবার মিলিত প্রয়াসে ৪৫ বছর পরে ২০১৮ সালে ১৮টি রাজ‍্যে ৫০টি টাইগার রিজার্ভে সর্বশেষ ব‍্যাঘ্রসূমারীতে বাঘের সংখ‍্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় তিন হাজার।

    ১৯৯৪ সালে কৈলাসজী‌ চলে গেছেন অনন্তলোকে। তাঁর দক্ষ সতীর্থ - রাজস্থানের রণথম্বোর টাইগার রিজার্ভে বাঘের পূনর্বাসনের একনিষ্ঠ কারিগর - ব‍্যাঘ্রবিশেষজ্ঞ ফতে সিং রাঠোর‌ও বৈকুন্ঠধামে চলে গেছেন ২০১১ সালে। বন‍্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ মহলে তাঁরা Tiger Man of India হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেমন সেলিম আলী পরিচিত ছিলেন Birdman of India হিসেবে।

    আশা করা যায় তাঁদের মতো দক্ষ ও নিষ্ঠাবান প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ‌দের নির্দেশিত পথে প্রোজেক্ট টাইগার ভবিষ্যতে‌ও সঠিক দিশায় চলবে। বজায় থাকবে এই উদ‍্যোগের সাথে সংযুক্ত সবার নিষ্ঠা। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে বন‍্য বাঘের সংখ‍্যা এখন বছরে ৬% হারে বাড়ছে। খুব‌ই সন্তোষজনক এক তথ‍্য। এভাবে চললে ধরাধাম থেকে এই সুন্দর, ঐশ্বর্য‌মন্ডিত প্রাণী‌টি হয়তো বিলুপ্ত হ‌য়ে যাবে না।

    সেদিন একটি প্রাচীন শ্বেতপাথরে‌র মাইলফলক অতীতের কিছু শ্বেত চর্মের ও তাদের অনুগত বাদামী বর্ণের রাজন‍্যদের অপরিণামদর্শী দৌরাত্ম‍্য মনে করিয়ে দিয়েছিল। টাইগার কান্ট্রিতেই বনের রাজার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা‌য় মন ভারী হয়ে গেছি‌ল। বাড়ি ফিরে প্রোজেক্ট টাইগার সম্পর্কে এসব কথা জেনে তবু একটু ভালো লাগলো।

    সিংহের মতো বাঘ গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণী নয়। বাঘ একান্ত‌চারী। সে শিকার‌ও করে একা। তার সচ্ছন্দ বিচরণ ও শিকারের জন‍্য প্রয়োজন অন্তত শখানেক বর্গকিমির বিস্তৃত অরণ‍্য। প্রোজেক্ট টাইগার সমীক্ষায় ভারতে ৩২টি মূখ‍্য টাইগার করিডর নথিভুক্ত হয় যে পথে শিকারের খোঁজে বা অন‍্য কারণে‌ও বাঘ ইচ্ছে মতো এক অরণ‍্য থেকে নিকটবর্তী অরণ‍্যে যাতায়াত করে। রাজস্থানের রণথম্বোর থেকে মধ‍্যপ্রদেশের পালপুর কুনো হয়ে মাধব জাতীয় উদ‍্যান অবধি প্রায় ১৪০ কিমি ব‍্যাপী অরণ‍্যপথটি‌ও তেমন একটি টাইগার করিডর। এই করিডর চিরে চলে গেছে ব‍্যস্ত মুম্বাই-আগ্ৰা জাতীয় সড়ক। তবু গভীর নির্জন রাতের আঁধারে অরণ‍্যচারীরা মানুষের রাজপথ পার হয়ে চলে যায়।

    ১৯৭০ সালে মাধব উদ‍্যান থেকে বাঘ বেপাত্তা হয়ে গেলেও হয়তো সংরক্ষণ উদ‍্যোগে‌র ফলে ২০০৭ সালে ওখানে আবার দেখা গেছে এক পরিযায়ী ব‍্যাঘ্র জুটি‌কে। ওখানে আছে অনেক হরিণ, সখ‍্যাসাগর লেকে পর্যাপ্ত জল। জায়গা‌টা ভালো লেগে গিয়ে তারা ওখানে ডেরা‌ বেঁধেছে কিনা জানা নেই। জংলী বাঘের আয়ু দশ পনেরো বছর। হয়তো সেই জুটি এতোদিনে ইহলোক ত‍্যাগ করেছে। তাদের ডোরাকাটা ছানাপোনা হয়ে থাকলে খবর হয়ে যেতো। তা যখন হয়নি তখন ধরে নেওয়া যায় মাধব জাতীয় উদ‍্যানে এখন আর বড় মিঞা‌ নেই। তবে ওখানে এখনও আছে কিছু ছোটে মিঞা - অর্থাৎ লেপার্ড‌।

    বাঁকড়ে হনুমান মন্দির

    সেই শ্বেতপাথরে‌র মাইলফলক থেকে ছশো মিটার দুরে মন্দিরের গেট। প্রায় দশ বিঘা এলাকা নিয়ে মন্দির। মন্দির চত্বরে আলাপ হোলো মন্দির কমিটির প্রধান ডঃ গিরিশ মহারাজের সাথে। তিনি এখানে নিয়মিত ভাগবত পাঠ ও ব‍্যাখ‍্যা করেন। মূলত তাঁর উদ‍্যোগে‌ই এখানে সবকিছু সুষ্ঠুভাবে চলছে। জানতে চাই বাঁকড়ে শব্দের অর্থ কী। উনি বলেন বাঁকড়ে হোলো মহারাষ্ট্রের একটি ব্রাহ্মণ‍্য গোত্র। জানান এই মন্দিরে হনুমান‌জীর মূর্তি‌র প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় ৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে। এখান থেকে পাওয়া প্রাচীন কিছু মূর্তি গোয়ালিয়র কেল্লা‌র নীচে গুজারিমহল সংগ্ৰহালয়ে সংরক্ষিত আছে। সিন্ধিয়া রাজবংশ অতীতে কয়েকবার এই মন্দিরের জীর্ণোদ্ধার বা মেরামত করেন। বছর পঞ্চাশেক আগে গীতা প্রেস গোরক্ষপুর সমিতি সারা ভারতের প্রাচীন মান‍্যতাপ্রাপ্ত হনুমান মন্দিরের যে সমীক্ষা করে তাতে এই মন্দিরের বিশেষ উল্লেখ আছে। বর্তমান মন্দিরের যে রূপ তা ১৯৯১ সালে সর্বশেষ মেরামতের পর।

    বাঁকড়ে হনুমান মন্দিরে বহুদিন ধরে ধার্মিক অনুষ্ঠান, ভাগবত পাঠ, ভান্ডারা, বিদাই সমারোহ এসব হয়ে আসছে। অতীতে মহারাজ মাধো রাও মঙ্গলবার শিবপুরী‌তে এলে মন্দিরে সোয়া মন রুটি‌র ভোগ চড়তো। রাজ পরিবারের সদস‍্যরা আসতেন মন্দিরে। এখন‌ও প্রতি মঙ্গলবার এখানে অনেক ভক্ত‌সমাগম হয়। গিরিশ‌জী বলেন আমায় একটু শিবপুরী যেতে হচ্ছে কিন্তু আপনি এতদুর থেকে এসেছেন অবশ‍্য‌ই দুপুরে খেয়ে যাবেন। ইচ্ছে হলে রাতে এখানে থাকতেও পারেন। নমস্কার করে চলে যান সজ্জন পন্ডিত‌জী। একটু আগে মোনী‌বাবা আশ্রমের বিপরীত অভিজ্ঞতা হোলো এখানে।

    এ যেন ঠিক ধনঞ্জয় !!!

    পন্ডিত‌জীর এক সহকারী আমায় মন্দিরের উত্তর পূর্ব কোনে রান্নাঘরে নিয়ে যায়। এগিয়ে আসে মুকেশ কুশ‌ওয়াহা। তরুণটি মন্দিরের রান্নার দায়িত্বে আছে। সহকারী ওকে বলে, বাবুজী কলকাতা থেকে এসেছেন। পন্ডিতজী এনাকে দুপুরে এখানে খেয়ে যেতে বলেছেন। ইনি আমাদের মেহমান, যত্ন করে খাওয়াবি। পন্ডিত‌জীর সহকারী ছেলেটি নমস্কার করে চলে যায়।

    তখন বেলা দেড়টা। মুকেশ কাঠের উনুনে বসানো বড় লোহার কড়ায় গরম জল দেখি‌য়ে বলে, বাবুজী আপনি চান করে নিন। ডাল আছে। আটা মেখে গরম গরম রুটি করে দেব। সঙ্গে গামছা নেই। মাথায় জড়ানো বৌয়ের একটা বাতিল উড়নি আছে। সেটা দিয়ে চান করে গা মাথা মুছে নেওয়া যাবে। কিন্তু পিছনের খোলা চাতালে পাতলুন খুলে অন্তর্বাস পড়ে চান করতে হবে ভেবে চানের ইচ্ছে উপে গেল। কারণ অদূরে কিছু লোকজনের সাথে কয়েকটি মহিলা‌ও রয়েছেন। মুকেশ নাছোড়, দুপুরে চান না করলে আরাম হয় না। একটা চাদর দিয়ে বলে এটা জড়িয়ে নিন। অগত‍্যা ওর চাদর জড়িয়ে এক বালতি গরম জল নিয়ে পিছনের চাতালে যাই।

    কয়েকটা তৃষ্ণার্ত গরু বালতি দেখে সাগ্ৰহে এগিয়ে আসে। গরম জলে‌ই মুখ দিতে যায়। হাত নাড়িয়ে তাড়াই তাদের। বালতি‌টা একপাশে সরিয়ে রেখে কল খুলে নালির পাশে পা দিয়ে দাঁড়া‌ই। চাতালে খানিক‌টা জল দাঁড়িয়ে যায়। গরুগুলো বুঝতে পারে আমার উদ্দেশ্য। বালতি ছেড়ে চাতালে মুখ নামিয়ে চোঁক চোঁক ক‍রে খানিক জল খায়। খুব তেষ্টা পেয়েছিল ওদের। তৃষ্ণা মিটিয়ে চলে যায় ওরা। আমি‌ও চান করে বারান্দায় পাতা চাটাইয়ে এসে বসি।

    কাঠের আগুনে সেঁকা, দেশী ঘি মাখা‌নো মোটা মোটা গরম রুটি ও অড়হড় ডাল। শুধু খিদের মুখে বলেই নয়, সত‍্যি‌ই লাগে অমৃত। অমন রুটি দুটি খেলেই ছ ঘন্টার জন‍্য নিশ্চিন্তি। মুকেশ আরো দুটো গছাতে চায়। আঁতকে উঠে বারণ করি। খাওয়া‌র পর মুকেশ বলে, বাবুজী, তাড়া নেই তো? বলি, কেন? ও বলে তাহলে ঐ প্রবচন হলে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন। আমার ফোন নাম্বার রাখুন। আশেপাশে‌ই থাকবো। বিশ্রাম করে উঠে ফোন করবেন, চা করে দেব। এ তো জামা‌ই আদর! অভিভূত হয়ে যাই।

    মুকেশ আমার নিয়ে যায় দোতলার হলে। একপাশে মেঝেতে ম‍্যাট পেতে দেয়। জানলার পর্দা সরিয়ে দেয়। ফুরফুরে হাওয়ায় সাথে শীতের মিঠে রোদ এসে হামা দেয় মেঝেতে। পূবে দিগন্তবিস্তারি চাষের ক্ষেত। উত্তরে যতদূর চোখ যায় মাধব জাতীয় উদ‍্যানের অরণ‍্য। শরীরে ক্লান্তি মজুদ ছিল। ঠিকই বলেছিল মুকেশ, চান করে বেশ আরাম হয়েছে। তার ওপরে ভরপেট খাওয়া। ন‍্যাপস‍্যাকে মাথা দিয়ে ম‍্যাটে বডি ফেলতে‌ই ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসে।

    সাড়ে তিনটে নাগাদ নীচে নামতে‌ মন্দির চত্বরে মুকেশের সাথে দেখা হয়। বলে, বিশ্রাম করে ভালো লাগছে না? মাথা নেড়ে সায় দিই। সত্যি, বেশ ফ্রেশ লাগছে। ও বলে, চলুন তাহলে চা করে দি‌ই। ঠিক যেন 'গল্প হলেও সত‍্যি' সিনেমায় বাবুর্চি ধনঞ্জয়ের চরিত্রে রবি ঘোষ। তেমনি হাস‍্যময় সরল মুখ। ছিপছিপে শরীর। চটপটে কাজকর্ম। কাগজের কাপে স্বাদু চা হাতে ওর সামান্য জীবনকথা শুনি।

    পড়াশোনা বিশেষ করেনি মুকেশ। রান্না ছাড়া আর কিছু বিশেষ জানে না। গ্ৰাম থেকে কয়েক বছর আগে পেটের দায়ে ভাগ‍্য অন্বেষনে বেরিয়েছিল। এই মন্দিরে এসে সজ্জন পন্ডিত‌জীর কৃপায় রান্নার কাজ পেয়ে রয়ে গেছে। থাকতে খেতে পায়। অল্প মাইনে‌ও পায়। ভান্ডারা লাগলে কিছু বকশিশ মেলে। তাতেই চলে যায় ওর। ভেবে লাভ নেই বলে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে না ও। চলে আসার আগে কিছু বখশিশ দিই। পন্ডিতজীর অতিথি বলে নিতে চাইছি‌ল না। অভাবী প্রান্তিক মানুষ‌গুলি হৃদয়ের এমন ঐশ্বর্য কীভাবে পায় বুঝি না! টাকাটা ওর পকেটে গুঁজে দিয়ে র‌ওনা হ‌ই। ধনঞ্জয় বলে, ফির আইয়েগা বাবুজী। ক্ষণিকের জন‍্য ভুলে‌ই গেছি‌লাম - ও তো মুকেশ!

    লালকেল্লার ঐতিহাসিক বিচার

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মালয়ের (মালয়েশিয়া) যুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা জাপানি সৈন‍্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ‍্য হয়। তাদের এনে রাখা হয় সিঙ্গাপুরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত থেকে জাপানে চলে গিয়ে রাসবিহারী বসু ততদিনে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্ৰামে জাপানি সহযোগিতা‌র ভিত তৈরি করে ফেলে‌ছেন। তাঁর উদ‍্যোগে সিঙ্গাপুরে ভারতীয় বংশোদ্ভুত যুদ্ধ‌বন্দী‌ সৈন‍্যদের নিয়ে ১৯৪২ সালের আগষ্টে তৈরি হয় ইন্ডিয়ান ন‍্যাশানাল আর্মি বা INA. সাম্রাজ্য‌বাদী ব্রিটিশ শাসন থেকে পরাধীন ভারতকে মুক্ত করতে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে INA কে সামরিক সাহায্য করতে‌ রাজি হয় জাপান। INA এর সামরিক নেতৃত্বের দায়িত্ব পান মোহন সিং। তবে জাপানের সাথে মতবিরোধে ডিসেম্বরে‌ই ভেঙে যায় অঙ্কুরিত INA.

    অতঃপর জার্মানি থেকে জাপান হয়ে ১৯৪৩ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুরে এসে দ্বিতীয় দফায় আজাদ বাহিনীর হাল ধরেন সুভাষচন্দ্র। সেই দল‌ই ইম্ফল ও কোহিমায় ব্রিটিশ‌দের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ে‌ জমি ছিনিয়ে নিয়ে‌ছিল ১৯৪৪ সালের এপ্রিলে। বার্মা‌ যুদ্ধ‌ক্ষেত্রে আজাদ হিন্দ বাহিনীর একটি দল সামান্য উপকরণে বিশাল ব্রিটিশ‌ বাহিনীর বিরুদ্ধে‌‌ মরীয়া লড়াই করে‌ও শেষরক্ষা করতে পারে না। ১৯৪৫ সালের ১৭ই মে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে তারা যুদ্ধ‌বন্দী হিসেবে ধরা পড়ে। ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে জার্মানির পতনের সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ৫ নভেম্বর ১৯৪৫ এ দিল্লী‌র লাল কেল্লা‌য় শুরু হয় সেই বিদ্রোহী সেনা অফিসার‌দের কোর্ট মার্শাল - INA Trial - চলে ১৯৪৬ এর মে অবধি। কর্ণেল গুরবক্স সিং ধিঁলো, কর্ণেল প্রেম কুমার সাহগল ও মেজর জেনারেল শাহ ন‌ওয়াজ খানের বিরুদ্ধে আনা হয় সবথেকে গুরুতর অভিযোগ - ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।

    এই বিচারের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের দেশব্যাপী অসহযোগ, আইন অমান‍্য বিক্ষোভের সাথে করাচি থেকে কলকাতা‌য় শুরু হয়ে যায় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ। জব্বলপুরে সেনাবাহিনী‌র এক ইউনিটের বিদ্রোহ বলপূর্বক দমন করা হয়। ভারতীয় সৈন‍্যরা ক্ষোভে ফুটতে থাকে। মাদ্রাজ, পুনে রেজিমেন্টে ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশ অফিসারদের নির্দেশ অমান্য করতে শুরু করে। লালকেল্লা বিচারের তিন বছর আগে ৯ই আগস্ট ১৯৪২এ গান্ধীজী গোয়ালিয়রে "করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে" ডাক দিয়ে "ভারত ছাড়ো" আন্দোলনের সূচনা করতে তার পরদিনই ব্রিটিশ সরকার নেহরু, বল্লভভাই, আসফ আলী, আজাদ সহ কংগ্রেসের বারোজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে আহমেদনগর কেল্লা‌য় কয়েদ করে। তবু নেতৃত্বহীন স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ অহিংস, সংহিস, চোরাগোপ্তা নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। লর্ড লিনলিথগোর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গুরুত্ব ও বিস্তৃতির দিক থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সাথে তুলনীয়। লালকেল্লা বিচারের সময় পরিস্থিতি আর‌ও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। জনগণের হুংকার ওঠে:

    লাল কিলে সে আয়ি আওয়াজ,
    ধীলন, সাহগল, শাহ নওয়াজ।
    ইন তিনো কি হো উমর দরাজ।
    (long live you three)
    লাল কিলা তোড় দো,
    আজাদ হিন্দ ফৌজী কো ছোড় দো।


    বিচার প্রক্রিয়ায় জাতীয় কংগ্ৰেসের তরফে গঠিত হয় এক ডিফেন্স কাউন্সিল। তাতে ছিলেন তখনকার কিছু বিশিষ্ট উকিল ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব - ভুলাভাই দেশাই, স‍্যার তেজবাহাদুর সপ্রু, কৈলাস নাথ কাটজু। সেই দলে যোগ দেন আহমেদ‌নগর কেল্লা থেকে সদ‍্য (এপ্রিলে) মুক্তি পাওয়া আসফ আলী ও নেহরু। হিন্দু, শিখ, মুসলিম - তিন ধর্মের তিন বিদ্রোহী সেনা অফিসারের মুক্তি‌র জন‍্য চলে জটিল আইনি লড়াই। এই ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ ও জাতীয় কংগ্রেস এক সুরে গলা মেলায়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লীমেন্ট এ্যাটলী পরে স্বীকার করেন সুভাষ বোসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় আজাদ হিন্দ বাহিনী ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতীয় সৈন‍্যবাহিনীতে ভারতীয় সৈন‍্যের ব্রিটিশ আনুগত্যের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে এযাবৎ কুটিল বিভেদ নীতি‌ ও সৈন‍্যবলে নানান ব্রিটিশ কলোনি শাসনে অভ‍্যস্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য‌বাদের শীর্ষ‌নেতৃত্ব ইংল‍্যান্ডে নড়েচড়ে বসে মানতে বাধ‍্য হয় - ভারতে ব্রিটিশ রাজের মৃত‍্যুঘন্টা বাজতে শুরু করেছে।

    লালকেল্লা বিচারের রায় প্রকাশিত হোলো ১৯৪৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। বিচারে তিনজনকেই দোষী সাব্যস্ত করে রাষ্ট্রদ্রোহী‌তার অপরাধে ফাঁসি‌র সাজা দেওয়া হোলো। তবে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের প্রবল বিক্ষোভ ও সৈন‍্যবাহিনীর প্রকাশ‍্য অসন্তোষ উপলব্ধি করে তদানীন্তন ব্রিটিশ সেনাপ্রধান সে সাজা কার্যকর করতে চাইলে‌ন না। তাঁর মনে হয়েছিল তাহলে হয়তো দেশে বিক্ষোভের এমন আগুন জ্বলে উঠতে পারে যা সামাল দেওয়া প্রবল পরাক্রমী ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে‌ও সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাই মান বাঁচাতে তিন অভিযুক্ত‌কে‌ই চাকরী থেকে বরখাস্ত করে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁরা মর্যাদা পান 'জিন্দা শহীদ' হিসেবে, কারণ ফাঁসি তো হয়েই যাচ্ছি‌ল প্রায়। এর এক বছর সাড়ে আট মাস বাদেই ভারত থেকে পাকাপাকি পাততাড়ি গুটোতে বাধ‍্য হয় ব্রিটিশ‌রাজ। স্বাধীন হয় ভারত। সফল হয় সুভাষ‌চন্দ্রের পূর্ণ স্বরাজের স্বপ্ন এবং আরো অনেকের সাথে অধিকাংশ দেশবাসীর।

    কিন্তু কেন এই শিবের গাজন?
    সেটা আসবে ২য় পর্বে …. নাহলে এক‌ই পর্বে ৯২০০ শব্দের লেখা পড়তে ধৈর্য্য‌চ‍্যূতি ঘটতে পারে।

    চিত্রাবলী:-

    ভাদিয়াকুন্ড থেকে সখ‍্যাসাগর লেক - বাঁদিকে ট‍্যূরিস্ট রিসর্টে‌র বোটিং পয়েন্ট


    ভাদিয়াকুন্ড (লাল তীর) - শীতে ঝর্ণার ধারা শীর্ণকায় (সবুজ তীর)


    তবে বর্ষা‌য় জলধারা ভালো‌ থাকে (ছবি-আন্তর্জাল)


    ভাদিয়াকুন্ডের পাশে হনুমান মন্দির (লাল তীর) - যেখানে ছিলাম (সবুজ তীর) এবং এ দুয়ের মাঝে সব মিলিয়ে রঘুবীর পুরী মহারাজের আশ্রম


    প্রথমে ঢুঁ মারলুম মোহনী মহারাজ আশ্রমে


    হেরিটেজ পথনির্দেশ (লাল ও সবুজ তীরের প্রসঙ্গ আসবে পরবর্তী পর্বে)


    বাঁকড়ে হনুমান মন্দির
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩
  • ভ্রমণ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৬৭১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • R.K | 165.225.226.243 | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৪526730
  • যেমন লেখার হাত তেমনি সরস অভিজ্ঞতা একে কথায় অনবদ্য
  • Arindam Basu | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৫৭526738
  • স্বপ্ন দেখার মতন ঘুরে বেড়ানো! 
    এ এক ভারতবর্ষের গল্প |
     
  • হীরেন সিংহরায় | 2a00:23c8:c117:2901:1c4b:8be7:c11e:a143 | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০২:২৮526759
  • কি চমতকার ঘুরে এলাম ! ধন্য লেখনী  
  • সমরেশ মুখার্জী | ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:০৫526802
  • যারা প্রথম পর্বটি ভালো লেগেছে বলে জানিয়েছেন, তাদের সবাই‌কে জানা‌ই ধন‍্যবাদ
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন