ভারতের আদালতে হিজাব নিষিদ্ধ করার নতুন নির্দেশ।
এর বিশ্লেষণ কী?
কর্ণাটক হাই কোর্ট বলেছে হিজাব যেহেতু ধর্মীয় আইনের মধ্যে পড়েনা, সুতরাং বিচারপতিদের রায় হলো, ("We are of the considered opinion that wearing of hijab by Muslim women does not form a part of essential religious practice in Islamic faith," -- সূত্র এনডিটিভি ডট কম) -- কর্ণাটক রাজ্য সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে হিজাব নিষিদ্ধ করেছে, কোর্ট তার সঙ্গে একমত। স্কুলে কলেজে মুসলিম মেয়েরা হিজাব পরতে পারবে না।
একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে আমি এই রায়কে সমর্থন করতে পারতাম। কারণ, হিজাব, বোরখা, ঘোমটা, অন্তঃপুর, সুতিকাগৃহ, কাশী কিংবা বৃন্দাবনে হিন্দু বিধবাদের জন্তুর মতো ফেলে রাখা এবং হাজার সামাজিক নিষেধ মেনে চলতে বাধ্য করা -- আমি সবকিছুকেই প্রাগৈতিহাসিক সিস্টেম বলে মনে করি, এবং আমি চাই হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান সমস্ত ধর্মে নারীদের সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা যেন একশো ভাগ থাকে। কে কী পরবে, কে কী খাবে, কে কার সঙ্গে শোবে -- এসব ব্যক্তিগত অধিকারের ওপর যেন রাষ্ট্র বা সমাজ বা ধর্ম চোখ রাঙাতে না পারে।
আমরা এই যুগে বসে বল্লাল সেন অথবা তালিবান কোনোটাই চাইনা। মধ্যযুগীয় খৃষ্টান নারীবিদ্বেষও চাইনা।
কিন্তু সে হলো ব্যক্তি আমি'র মত। আমার একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক আমি আছে। সে আমি বলছে, হিজাব নিষিদ্ধ করা এই মুহূর্তে ভারতের শাসকশ্রেণীর একটা রাজনৈতিক চাল, এবং মুসলিম মেয়েদের জোট বাঁধা একটা তীব্র আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেওয়ার খেলা। এবং দক্ষিণ ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের যে রোডব্লক রয়েছে, তা অতিক্রম করার একটা কৌশল। একটা ধাপ। এই কারণে আমি আজকে এই মুহূর্তে মুসলমান মেয়েদের হিজাব আন্দোলনকে সমর্থন জানাবো।
কোর্টের রায়কে সম্মান জানাবো, কিন্তু তাকে চ্যালেঞ্জ জানাবো সাংবিধানিক ও নৈতিক জায়গা থেকে।
রাজীব গান্ধীর আমলে শাহ বানোর ঘটনা আমরা কেউ কেউ হয়তো মনে রেখেছি। সেখানে মুসলিম নারীদের তালাক দেওয়ার অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে এই বৃদ্ধা তীব্র এক জনআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, শাহ বানো বলেছিলেন, ডিভোর্স দিলে পুরুষদের বাধ্যতামূলকভাবে খোরপোষ দিতে হবে। ইসলামী মৌলবাদী পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে একটা বিরাট রেসিস্টেন্স তৈরী করেছিলেন তিনি।
ভারতের সংসদে সেই ঘটনা নিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছিলো। আমার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ দাদা লোকসভা সদস্য সৈফুদ্দিন চৌধুরীর অসামান্য বক্তৃতা আমরা শুনেছি এই বিষয়ে। (পরে অবশ্য সিপিএম সফিদাকে পার্টি থেকে বের করে দিয়েছিলো, কিন্তু সে অন্য গল্প।)
কিন্তু রাজীব গান্ধীর অনেকগুলো চরম অদূরদর্শিতার মতো এই সামাজিক আন্দোলনে হস্তক্ষেপ এবং তাকে বানচাল করে দেওয়ার তৎকালীন কংগ্রেসী ভোটব্যাঙ্কের খেলায় শাহ বানো আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ভারতকে এবং তার নারীদের মৌলবাদীদের হাত থেকে এবং পুরুষতান্ত্রিকতার হাত থেকে মুক্ত করার সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট হয়েছিল।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, হিজাব নিষিদ্ধ করলেই মুসলিম মেয়েদের আধুনিক করে তোলা যাবে, এবং তা হবে শাহ বানো লিগেসীকে যোগ্য সম্মান দেওয়া। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। আজকের পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম। এখন হিন্দু ও মুসলিম দুই দিকেই মৌলবাদীরা চাইছে যাতে মেয়েদের আবার আঁতুড়ঘরে এবং রান্নাঘরে চিরতরে পুঁতে ফেলা যায়। মুসলিম মেয়েরা যারা হিজাব অধিকার আন্দোলন করছে, তারা যেমন একদিকে হিন্দুত্ববাদীদের জয় শ্রীরাম স্লোগানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তেমনি আবার নিজেদের মৌলবাদী রক্তচক্ষু সমাজকর্তাদের কাছে একটা স্ট্রং বার্তা দিতে চাইছে যে আমাদের ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করে নেবো, এখানে মোল্লাদের হস্তক্ষেপ আমরা চাইনা।
এই কারণেই দেখবেন, হিজাব অধিকার আন্দোলনের পিছনে তেমন কোনো মোল্লাতন্ত্রের সোচ্চার সমর্থন নেই। বা থাকলেও এই লড়াকু মেয়েদের তাতে কিছুই যায় আসেনা।
তারা চায় শিক্ষার অধিকার, শিক্ষার আলো। এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। যা হিন্দু মুসলিম খৃষ্টান ইহুদী বৌদ্ধ -- কোনো মৌলবাদী চায়না।
আজকে সুপ্রীম কোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আমি যতদূর বুঝেছি, সেখানেও খুব একটা তফাৎ কিছু হবেনা।
ভোট ব্যাঙ্কের এই খেলা আগে খেলেছে রাজীব গান্ধী ব্র্যান্ডের কংগ্রেস। এখন সে খেলায় ভারত চ্যাম্পিয়ন হলো হিন্দু ফ্যাসিস্টরা। তারা বুঝে গেছে, মেরুকরণ ও সামাজিক বিভাজন ছাড়া নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল তাদের পক্ষে সম্ভব হবেনা। হিন্দু মুসলিম মেরুকরণ এখন সম্পূর্ণ। এবারে মুসলিমদের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টি, এবং লিবারাল ভোট ব্যাঙ্কেও বিভেদ সৃর্ষ্টি।
অনেক লিবারাল ও প্রগতিশীল ভারতীয় এই ফাঁদে পা দেবেন।
আমিও দিতাম -- যদি না আরএসএস ও হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্টদের হাতের তালুর মতো চিনতাম।
###
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।