এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  জাদু দুনিয়া

  • নামদাফা এবং – ৭

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | জাদু দুনিয়া | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৩৮৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • | | | | ৫  | | | |
    ঠিক ছিল আমরা  কাঁটায় কাঁটায় সকাল আটটায় উল্লুক মুল্লুকের উদ্দেশ্যে রওনা হব। সাড়ে সাতটায় প্রাতরাশ দেবার কথা বলে রাখা হয়েছে। এদিকে হয়েছে কি আমার ঘুমই ভেঙেছে সাতটা ষোলোয়।  কাল রাস্তায় অত অসুস্থ হয়ে পড়ায় রুম্মি জানিয়েছেন তিনি আজ বেরোবেন না। কাজেই  মিস্টার পার্ফেক্টও আর তাঁকে ডাকতে আসেন নি, ফলে আমিও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি। এর সাথে সেই পাশের ঘরের প্রবল নাসিকাগর্জনে দুই রাত না ঘুমানোও ছিল।  তা ঘড়ি দেখে তো তিড়িং করে একলাফে বাথরুমে। দাঁত মেজে বেরিয়ে শুনি একটা বড়সড় গাড়ি হর্ন টর্ন দিয়ে বেরোচ্ছে বা ঢুকছে। রুম্মি ইতিমধ্যে কম্বলের মধ্যে থেকে আধখানা মুন্ডু বের করে ‘কি ব্যপার গাড়ি হর্ন দিচ্ছে আর তুমি এখনো রেডিই হও নি!’ কি যন্ত্রণা একে দেরী হয়েছে এখনো স্নান করে তৈরী হতে হবে, তায় আবার সেই নিয়ে খোঁচাখুচির কি মানে! তো যাই হোক আম্ফানের বেগে তৈরী হয়ে প্রাতরাশের টেবলে হাজির হলাম সাতটা পঁয়ত্রিশে। সবাইকে নিয়ে  গাইডমশাই রওনা হলেন আটটা দশ। যাক অন্তত আমার জন্য যে দেরী হয় নি তাতেই খুশি। 

    গাইডের পিছুপিছু আমরা গিয়ে হাজির চা বাগান আর হালকা পাতলা জঙ্গলের মাঝে একটা ছোট্ট গ্রামে। আগে থেকেই সম্ভবত বলা ছিল দুজন বেশ কিছু কলা নিয়ে বেরিয়ে আসেন, দেখে মনে হল কাঁঠালি কলা। এসে ডাকাডাকি করতে থাকেন আর ইয়েসসস হুকু হুক হুক করে উল্লুক পরিবার হাজির হয়।  সবচেয়ে লম্বা  গাছটার নীচে গিয়ে একটা করে কলা হাতে নিয়ে সবাই সাধাসাধি করে, কিন্তু অমনি একডাকেই নেমে আসবে! উল্লুক বলে কি হ্যাংলা নাকি অ্যাঁ? বেশ কিছুক্ষণ সাধাসাধি করার পরে অনেকটা নীচে এসে লম্বাআ হাত বাড়িয়ে খপাৎ করে কলাটা নিয়েই চার হাতপায়ে দ্রুত উঠে যায় উল্লুককত্তা, গিন্নী উল্লুকিনী অনেকটা উপর থেকে পাতার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে  দ্যাখে। উল্লুকছানারা কেউ নামে না এ ডাল ও ডালে খেলে বেড়ায়। নীচে থেকে ডাকাডাকির সাথে তাল মিলিয়ে উল্লুক পরিবারও কখনো ‘অ হ হ হ’ করে কখনো ‘হুক্কু হুক হুক হুক্কুউউউ’ করে কথাবার্তা চালিয়ে যায়। এক মহিলা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে আমাদের আদেখলামি দেখছিলেন, আমি গুটিগুটি গিয়ে ভাব জমাই। 

    গ্রামের নাম উনি বলেন বাইর‌্যাকুই, গুগল অবশ্য দেখালো Barekuri Bargaon। সারা বছরই এখানে পর্যটকরা আসে উল্লুকদের দেখতে। এখন এই উল্লুক পরিবারটা আসছে কয়েক মাস হল, এই উল্লুককত্তা নাকি নওযোয়ান হয়ে বিয়ে করে সংসার পেতে এইদিকে এসেছে। মোটামুটি ৫০০ মিটার ব্যাসের বৃত্তাকার এলাকার গাছে  ওদের ঘোরাফেরা।  এছাড়া ধনেশ পাখি, গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিল, সেও আসে যখন তখন। আমরা অবশ্য দেখি নি, তবে  তখন অনেকটা বেলাও হয়ে গেছে। নাম জিগ্যেস করতে  নাম বলেন, ফিক করে হেসে বলেন ফেসবুকে যেন না দিই। ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন রাগ করবে। জিগ্যেস করি এই এত কলা যোগাড় করে রাখতে খরচ হয় না?  গ্রামের সকলেরই কিছু কিছু গাছ আছে তার থেকেই হয়ে যায় অনেকটা আর  পর্যটকরাও টাকা দিয়ে যায়। তবে সবাই দিতে চায় না, কিছু কিছু গ্রুপ  কলা খাইয়ে  হুড়মুড়িয়ে গাড়ি চড়ে চলে যায়। ইতিমধ্যে গিন্নি উল্লুকিনীর লজ্জা ভেঙেছে একটু, দেখলাম কলা নিয়ে গেল নেমে এসে। যাক  অবশেষে  নন হিউম্যান প্রাইমেট অর্থাৎ কিনা আমাদের এই হোমো স্যাপিয়েন্সদের পূর্বপুরুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হল। 
     

    উল্লুক উল্লুকিনী - 'ডাকলেই অমনি নেমে আসবো?আমরা কি হ্যাঙলা?'
     
    অতঃপর ডিহিং পাটকাই। রাস্তায় করিমভাই একবার রাস্তা হারিয়ে ফেললেন, তা সে তেমন কিছু না। অল্প ঘুরে দেড় ঘন্টার জায়গায় পৌনে দুই ঘন্টায়ই পৌঁছে গেলাম। জঙ্গলে ঢুকে মোটামুটি ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়ালো গাড়িদুটো। একদিকে বেশ  একদিকে বেশ অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে তবে জঙ্গল দেখা যাচ্ছে অনেকটা দূরে, আরেকদিকে একটা সরু রাস্তা ঢুকে গেছে। প্রথমে আমরা সেদিকেই চললাম। আমি যথারীতি সবার পেছনে ইচ্ছে করেই খানিক ধীরে চলছি  এদিক ওদিক দেখতে দেখতে। অল্প কিছু ঝিঁঝির ডাক আর অনেক উপরে কিছু পাখির ডাক ছাড়া চারিদিক অতি শান্ত। সামনে ডানদিকে একটা প্রায় দেখা যায় না এমন শুঁড়িপথ থেকে রূপম বেরোতে বেরোতে বলেন হুলক গিবনের একটা দল এইখানটায় ছিল। বাকীদের এগোতে দিয়ে আমি  যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ঢুকি ভেতরে, কিছুটা গিয়ে একটা গাছের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়াই।  আন্দাজ তিরিশ সেকেন্ডের মাথায় পাশের গাছটার উপরে নড়াচড়া টের পাওয়া যায়। খুব সাবধানে গুঁড়ি মেরে আরেকটু সরে  জুম করতেই কপালে  সাদা পট্টিওলা পুরুষ উল্লুক, কৌতুহলী হয়ে নীচে কী দেখছে। ব্যাস ব্যাসস। হাফপোষ্য টাইপ নয় একেবারে ওদের স্বাভাবিক বাসস্থানে ছবি পেয়ে গেছি আর কি চাই। 


    ডিহিং পাটকাই ন্যাশনাল পার্কের মাটির তলা দিয়ে গেছে ইন্ডিয়ান অয়েলের তেল, ন্যাচারাল গ্যাস আর কন্ডেন্সেট বহনকারী পাইপলাইন। বেশীদিন নয় এই ২০২১ এর আগস্ট মাসেই ডিহিং পাটকাই অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে যাওয় ডিগবয় দুলিয়াজান রোডের পাশে পাইপলাইন ফেটে গ্যাস কন্ডেন্সেট বেরিয়ে  আগুন জ্বলতে থাকার দৃশ্য দেখেছে গোটা ভারত। তখন খবরও হয়েছিল যে  অভয়ারণ্যের জীববৈচিত্র্য  ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পরে যথারীতি সেসব খবর কাগজের পাতা থেকে হারিয়ে যায়, জানা হয় নি সে আগুন কবে নিভেছিল,  জঙ্গলের গাছপালা প্রাণীকূলই বা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখানে এক জায়গায় দেখি পাইপলাইনের জোড়ের কাছে সম্ভবত কাটা হয়েছিল, সেইটে নাইলনের দড়ি, প্ল্যাস্টিক  চাদর আর পাটের ফেঁসো দিয়ে শক্ত করে পেঁচিয়ে বাঁধা, দড়ির গা ঘেঁষে সরু সুতোর মত নীলাভ গ্যাস বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে বায়ুমন্ডলে। শুনি মাফিয়ারা  নিয়মিতই কাটে, এ এক সমান্তরাল বাণিজ্য ব্যবস্থা। যে চওড়া ন্যাড়া এলাকার পাশে আমাদের গাড়ি রাখা ছিল সেই এলাকাটায় এদিক ওদিক করে চলে গেছে পাইপ লাইন, একটা তৈলকূপও  দেখলাম, উপরের ঢাকনায় তালা লাগানো মোটা শিকল গোছের তার দিয়ে বাঁধা। মাঠের বাঁদিকে জঙ্গল ঘেঁষে একটা দোচালা দোতলা বাড়ি। 

    দোচালা বাড়ির বাইরের দরজায় তালা লাগানো, বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে উপরের ঘরে মশারি টাঙানো ধারগুলো কোনোমতে জড়িয়ে মশারির চালে তোলা। ঘরে বসে সামনে তাকালে সোজাসুজি তৈলকূপ আর পাইপলাইন দেখা যাবে। বোঝা গেল রক্ষীর ঘর। হয়ত কাছেই কোথাও গেছেন অথবা হয়ত শুধু রাতেই থাকেন। এইসব বলাবলি করতে করতেই সাইকেল চালিয়ে দুজন হাজির হয়ে তালা খোলেন। আমরা দু একজন এগোই, ওঁরা রাতেও থাকেন দিনেও বেশিরভাগ সময়ই। কাছে কোথাও বাজার করতে গিয়েছিলেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই বলেন কদিন এখানে একটা টাস্কার ঘুরছে সম্ভবত দলছুট আমরা যেন একটু সাবধানে থাকি। এসব তো জঙ্গলে গেলে রক্ষীরা বলেই থাকেন জঙ্গলটার গুরুত্ব বোঝাতে, তাই খুব একটা পাত্তা দিই না।  বরং জিজ্ঞাসা করি চুরি টুরি হয় কিনা, ঘাড় নেড়ে বলেন হ্যাঁ হয় তো, নিয়মিতই হয়। নিজেরা দেখেছেন চুরি হতে?  মনে মনে অবশ্য ভাবি যদিও কেউ দেখেই ফেললে সেটা কি আর চুরি বলা যায়? ছিনতাই বা ডাকাতি বললে বরং ঠিক হয়। দুজনে একসাথে বলেন হ্যাঁ হ্যাঁ দেখি তো। অর্থাৎ ঘটমান বর্তমান। ‘দেখলে কী করেন?’ ‘কী আবার করব?  দেখে রাখি পরেরদিন হেড অফিসে খবর পাঠাই।‘ 

    তা বটে ওই জনহীন জঙ্গলে রোগা প্যাংলা দুটো ছেলে চোখেমুখে অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট,  দুটো বন্দুক, তাও চলে কিনা খোদায় মালুম নিয়ে কীইবা করবে! ইতিমধ্যে গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য রূপমের পেছন পেছন ওই দূরের জঙ্গলে ঢুকেছেন গিয়ে। মধুমিতাকে ডেকে নিয়ে আমিও হাঁটা লাগাই। জঙ্গলের এই অংশটা আরো ঘন আর অল্প চড়াই। জায়গায় জায়গায় রাস্তা প্রায় বন্ধ। গাছের ডাল সরিয়ে লতাপাতা ঠেলে এগোতে হয়। মিনিট দশেক হাঁটার পরই দেখি সবাই একে একে ফিরছেন, আমাদেরও ইশারা করেন  ফিরে যেতে। উঁকি মেরে দেখি সামনে অল্প একটু চওড়ামত জায়গায় দাঁড়িয়ে রূপম ইশারা করছেন ফিরে যেতে আর দেবাশীস ইশারা করছে যেন কথা না বলি, আওয়াজ না করি। চোকে চোখ পড়তেই দেবাশীস ইশারায় ডাকে। গুটি গুটি এগিয়ে দেখি  প্রায়  টাটকা হাবর (হাতির গোবর) আর অল্প দূরেই হাতির মস্ত  গোদা পায়ের ছাপ, সেও  বোধহয় খুব বেশীক্ষণের নয়। ইতিমধ্যে রূপম হাতের ইশারায় দ্রুত বেরিয়ে যেতে বলেন। অগত্যা খানিক অনিচ্ছেতেই চুপচাপ বেরিয়ে আসি।  ফাঁকা জায়গায় এসে ঠিক হয় আমরা ফরেস্ট অফিসে গিয়ে কোর এলাকায় ঢোকার পার্মিট বানিয়ে ভেতরে ঢুকব। অতএব আবার গাড়ি। রাস্তায় একজায়গায় দেখা গেল  একটা পাইপের কাটা মুখ দিয়ে  ভুসভুস করে গ্যাস বেরোচ্ছে, কি আওয়াজ তার। করিম ভাই বলেন কন্ডেন্সেট আসলে। 


    পাটকাই ফরেস্ট অফিস। 
     


    ফরেস্ট অফিসটা দিব্বি ছিমছাম দোতলা বাড়ি। পার্মিট করানোর পরে আমাদের ভেতরে ডেকে চা  খাওয়ান দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক। চা খেয়ে আমরা রওনা দিই সঙ্গে একজন গাইড। গাইড আমাদের গাড়িতেই আসেন হাতে একটা ছোট প্যাকেটে একটা বাক্স। তাতে ‘বোমা’ আছে যদি টাস্কার তাড়া করে বা অন্য কিছু। এইবার মনে হয় নাহ সত্যিই বোধহয় দাঁতাল মহাশয় আছেন আশেপাশেই। গাড়ি চলে মাটির পায়েচলা অতি সরু রাস্তা দিয়ে,  দুপাশে মস্ত মস্ত গাছ আর সরু মোটা নানারকম লতা একেবারে ঘিরে ধরে নুয়ে পড়েছে পথের উপরে। মিনিট পঁচিশ গিয়ে গাড়ি থামে সামান্য ফাঁকা একটা জায়গায়। নেমে বোঝা গেল জায়গাটা ফাঁকা হবার কারণ। একপাশে ভারী চমৎকার একটা বাড়ি, গাইড বলেন ওটা বীট অফিসার বা অন্য কোনও অফিসার এলে তাঁদের জন্য বানানো হয়েছে। তবে এখনো অবধি কেউই এসে থাকেন টাকেন নি, নতুন বাড়ি, উদ্বোধনও হয় নি। সমরেশদা সজলদা আমি মধুমিতা বলাবলি করি আহা এই বাড়িটায় যদি রাতে থাকা যেত! ইতিমধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি  শুরু হয়েছে। বাড়ির উল্টোদিকের  সরু পায়েচলা পথ দিয়ে সোজা গেলে টানা ৪০ কিমি গিয়ে তবে ঘোরার জায়গা পাওয়া যাবে। মাঝে দাঁতালবাবাজী তাড়া করলে ঘোরার কোন উপায় নেই বিধায়  ওই রাস্তায় যাবার পরিকল্পনা রূপম খারিজ করে দেন। এদিকে বৃষ্টি বাড়ছে দেখে গাড়িতে উঠে ফিরতি রওনা। 


    আহা এইখানে যদি একটা রাত থাকা যেত!
     
    গহীন অরণ্যে 

    ইশ এত চমৎকার এমন ঘন জঙ্গলে এরকম রেলস্টেশানের মত বুড়িছোঁয়া করে চলে যেতে হবে। আমি গজগজ করতে থাকি, দেবাশীসও যোগ দেয়। আমরা দুজনে সমানে গজগজ করি এরকম দশ মিনিট দাঁড়ানোর জন্য আবার পার্মিট আর গাইড! পুঁইশাকের আবার ক্যাশমেমো  দুদ্দুর। আমার লাগাতার গজগজে বিব্রত বোধ করেই কিনা কে জানে গাইড বলেন সামনে একজায়গায় সাইড করে রাখতে। আমরা নামতে করিমভাইকে বলেন স্টার্ট বন্ধ করে রাখতে, আমরা হেঁটে এগোব। একেবারে চোখের আড়ালে গেলে উনি যেন যতটা সম্ভব নিঃশব্দে গাড়ি খানিক এগিয়ে এনে আবার দাঁড়িয়ে পড়েন। কথামত আমরা নিঃশব্দে এগোই। ডিহিং পাটকাই এইবারে তার সমস্ত রূপ গন্ধ শব্দ নিয়ে ধরা দেয়। চিলাপাতার মত কিম্বা তার চেয়েও ঘন এই অংশ, সবুজের বোধহয় নটা না এগারোটা শেড দেখলাম। কোথাও বন্যলতার ডগা আগুনে কমলা হয়ে রয়েছে হঠাৎ দেখলে মনে হয় ফুল। কাছে গেলে ভুল ভাঙে। কি একটা পাখি খানিক্ষণ শিস দিয়ে থেমে গেল, আর কোন শব্দ নেই কোত্থাও। গাইড জানান সম্ভবত সুলতান টিট। জিম করবেটের লেখা  মনে পড়ে গা শিরশির করে ওঠে  – জঙ্গলে ঢুকে আপনি কাউকে দেখতে না পেলেও জানবেন বহুজোড়া চোখ আপনাকে ঠিকই লক্ষ করছে। 

    গাইড হঠাৎ একটু পিছিয়ে এসে দেবাশীসের জ্যাকেট টেনে ধরে থামতে ইশারা করেন।  আমরাও থেমে যাই। আমাদের ওখানেই স্থির হয়ে দাঁড়াতে ইশারা করে পাশের জঙ্গলে চোখ রেখে গাইড পায়ে পায়ে পিছিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছান।  আড়চোখে দেখি নিঃশব্দে দরজা খুলে কী যেন  করছেন মুখ কিন্তু সেই জঙ্গলের দিকে। আমি নড়তেই দেবাশীস আমার ব্যাগে হ্যাঁচকা টান মারে। কী যেন দেখায় ইশারায়, আমি কিছুই দেখতে পাই না। ইতোমধ্যে গাইড ফেরত এসেছেন পা টিপে টিপে একটু এগিয়েও যান। হাতে দেখি সেই ‘বোমা’র বাক্স। আসলে ওগুলো আছাড়ি পটকা। হাতি তাড়াতে কাজে লাগে গোটা উত্তরপূর্ব ভারত জুড়ে। আমরা তিনজনেও পেছন পেছন এগোই, আবার থামি।  বেশ খানিকক্ষণ গাছের ফাঁক দিয়ে ভেতরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মনে হয় একটু উপরে অন্ধকারটা আরেকটু ঘন লাগে যেন। তবে কি ... তবে কি? উপরে মস্ত চ্যাটালো কিছু একটা নড়ল যেন! নাকি একঠায় তাকিয়ে থেকে চোখ ভুলভাল দেখছে? আবারো মনে হল  ওপর নীচ করে নড়ে উঠল যেন! গাইড আমাদের গাড়ির দিকে যেতে ইশারা করেন। নিজে আসেন সবার শেষে একভাবে জঙ্গলের দিকে চোখ  রেখে পিছিয়ে পিছিয়ে, গাড়িতে উঠেই বলেন যত দ্রুত সম্ভব চালাতে। করিমভাই তৈরীই ছিলেন। 

    ইতোমধ্যে কেটে গেছে ৪৫ মিনিট। ফরেস্ট অফিসে ফিরে শুনি রূপমদের গাড়ি বেরিয়ে গেছে,  করিমভাই বলেন একটাই রাস্তা পেয়ে যাব রাস্তায়। এদিকে ফরেস্ট অফিসে গাইডকে নামিয়ে বেরোবার মুখে একজন এসে গাইডের জন্য সাতশো টাকা দাবী করেন। মিস্টার পার্ফেক্ট বলেন, পার্মিট করানোর সময়েই তো গাইডের টাকাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেবাশীস চুপচাপ পকেট থেকে বের করে দিয়ে দেয়। পরে বলে বেচারি হয়ত একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে কাজ করে কি চাষের খেতে, কটাকাই বা পায়। এগুলো ওরা পার্টটাইম করে যাতে আরেকটু আয় হয়।  তাইই বটে, আর উপর্যুপরি লক ডাউনে কর্মহীনতা, বেকারি যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! দেবাশীস বাকী রাস্তা আমাদের বোঝাতে বোঝাতে আসে হাতি নাকি এমনি এমনি তাড়া করে না, আগে অনেক সিগনাল দেয় সরে যাবার। কীরকম? না প্রথমে নাকি পেছন ঘুরে গিয়ে নিজের  ল্যাজ মুচড়াতে থাকে ঘনঘন, তাই বুঝে সরে গেলে আর কিছু করে না। বোঝো!  হাতিরা দেখি ফজলুল হকের সেই ‘হোগাখানই দেখাইয়ো’ বাক্য একেবারে  দিল পে নিয়ে নিয়েছে!! তো এতেও না বুঝলে তখন দ্রুত কান ঝাপটায়,  তখনো সরে গেলে ভাল, নাহলে চার্জ করে।  আর হাতির সাথে দৌড়ে তো চিতাবাঘও পারে না আর আমরা তো নিতান্তই দুপেয়ে জীব। 

    এরপরে আর কি! একটা  বদখত রেস্টুরেন্টে গিয়ে অকথ্য বাজে খাবার খাওয়া,  বনশ্রীতে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার প্রায়। আজও ব্রহ্মপুত্রে সূর্যাস্ত মিস। কিন্তু থাকগে,  মিয়াও, দেবান আর রোয়িঙের সূর্যাস্ত এখনো চোখে লেগে আছে। আর আজ সারাদিনের  অভিজ্ঞতা তো  স্মৃতির লকারে এক জ্বলজ্বলে মণি। বাকী সবকিছু কালকে দেখব কালকে ভাবব। আজ মন মাথা জুড়ে থাক   ডিহিং পাটকাই। 
     
    ** এই ভিডিওটাও থাক। এটা আমাদের কারো তোলা নয়,ইউটিউবে পেলাম। ওই বারেকুরি গ্রাম ও সেখানকার প্রায় পোষ্য উল্লুক পরিবার। 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | ৫  | | | |
  • ভ্রমণ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৩৮৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ** - sumana sengupta
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2600:6c40:7b00:1231:2107:955d:4c73:bd0a | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:২৫504365
  • বাপ রে, ঐভাবে সারাক্ষণ গ্যাস লীক হচ্ছে, এটা খুব বিপজ্জনক না? ঐ গ্যাস তো ইন্ফ্লেমেবল, নাকি? এই যে আছাড়ি পটকা ফাটানো হয়, আর হাওয়াতেই গ্যাস সবসময় মিশে থাকছে, এর থেকে আবার জঙ্গলে আগুন লেগে যেতে পারেনা?
  • | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:৩৭504386
  •  হ্যাঁ বিপজ্জনক এবং উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র‍্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। ডিহিং পাটকাইএর মধ্যে দিয়ে পাইপলাইন নেবার সময়ই পরিবেশবাদীরা খুব আপত্তি করে। কিন্তু পরিবেশ নিয়ে কথা বললেই ত হয় অ্যান্টি ন্যাশনাল নয় ব্যগড়াবাদী।  এত কোটি কোটি টাকার ব্যপার মাথা থেকে পা পর্যন্ত এত লোকের ইন্টারেস্ট জড়িয়ে যে কিছুই করে না কেউ। 
     
    আছাড়ি পটকায় আগুন লাগার সম্ভাবনা কম।  এটা ফাটানো হয় কোন খোলা জায়গায় বা বাড়িঘরের আশেপাশে হাতি ঠ্যাকাতে। শব্দ হয় জোর তুলনায় আগুন কম। আর পাটকাই এলাকা চিরহরিৎ বনভূমি, একটু স্যাঁতস্যাতে ভিজে ভাব থাকে সাধারণত। 
     
  • স্বাতী রায় | 117.194.36.174 | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:২৫504412
  • বাঃ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন