পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
"উফ ! উফ!" , করছে ব্যথাতে সুপর্ণা। স্টেশনের গেটে আঙুল কেটে গেছে। অনির্বান তার ভেজা হাত দুটো মুখে নিয়ে চুষছে।
"এবার ঠিক আছে ?"
ব্যথাতে কুকিয়ে উঠছে সুপর্ণা। রক্ত ঝরলে ব্যথা তো হবেই। এরকমই এক ব্যথা পেয়েছিল কিছুমাস আগে। কারনটা অবশ্য অন্য। সেই ব্যথায় মত্ত হয়ে যে ভুল করেছিল তার মাশুল গুনতে এখন দুজনে এই নির্জন স্টেশনে বোজকা নিয়ে বসে আছে। বেনামী এই স্টেশনের অহংকার ছিল দুটো ঝকঝকে রেললাইন। মাসে একবার করে আলতা রঙের তরল দিয়ে স্নান করে সেই লৌহ পাটাতন। আর তারপরেই স্টেশন ছাড়িয়ে বাঁকা দিগন্তের দিকে এগিয়ে যায়। আজও কথা ছিল সেই উষ্ণ তরলে ভেজার। স্টেশনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে অভুক্ত কাকের মতো। সুযোগ পেলেই যেন ছ মেরে নিয়ে যাবে।
"হ্যা ঠিক আছে। ", ওড়না দিয়ে হালকা করে মাথার ঘাম মুছে নিলো সুপর্ণা। হেমন্তের সকালে গরম না থাকলেও তার গায়ে ঘাম হচ্ছে। অনির্বানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ,"এবার কোথায় যাবো ? "
উত্তর নেই অনির্বানের কাছে। যে বন্ধুর ভরসায় সে সুপর্ণাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সে মাঝপথেই উধাও হয়েছে। তাই কোথায় যাবে , কি করবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলোনা। খালি জানতো স্টেশনে একটু পরে ট্রেন আসবে যেটা কলকাতা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায় । সেই ট্রেনেই কোনরকমে চেপে পড়লে পুরোনো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে। এই শহর, এই রাস্তাঘাটের কাছে আর তাকে জবাবদিহি করতে হবেনা।
কিন্তু সুপর্ণার চিন্তা অন্য। বেতের ঝুড়ির মতো হালকা ফুলে ওঠা পেটটার দিকে তাকিয়ে তার চোখ নরম হয়ে উঠলো। কি ভেবেছিল আর কি হয়ে গেল জীবনটা ? একবার নিজেকেই গাল মন্দ করলো। বেশ করে করলো। মনের স্বাদ মিটিয়ে , কিন্তু তাতে দুঃখ কিছু কম হলো না।
বাড়িতে জানানোর স্পর্ধা ছিল না। উনিশ বছর বয়সে পোয়াতি হয়েছে। একবার নিজের মেয়ে জন্মকে গাল দিলো মনে মনে। তার কত বন্ধুরাই তো প্রেম করে। সোনা , বাবু করে সারাক্ষন মোবাইলে সেটে থাকে। এমন তো না যে তারা কখনো সহবাস করেনি ? পড়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কত কিছুই না করেছে। কৈ , তাদের অবস্থা তো সুকন্যার মতো নয়।
তাহলে তারই বা হলো কেন ? যথেষ্ট ব্যবস্থাও নিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও এই অবস্থা ? পয়সা থাকলে হয়তো সেই নিরোধ কোম্পানির উপর কেস করতো। কিন্তু এখন সেই সবের জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে।
একটা ট্রেন ঢুকছে ছুক ছুক করে। অনির্বান উঠে গিয়ে দেখলো।
"চল , ট্রেন আসছে "
সুপর্ণা উঠে দাঁড়ালো সেই বজকাটা নিয়ে। কেন যেন মনে হলো অনির্বান তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে পালাবে। ছেড়ে দেবে তার সঙ্গে। পুরানো সিনেমাতে এরকম অনেকবার হয়েছে। প্রেগনেন্ট করে ছেলেরা পালিয়ে গেছে। অনির্বানও হয়তো সেরকমই কিছু একটা করবে।
ট্রেন থামতেই অনির্বান আগে উঠলো। সুপর্ণা একটু স্বস্তি পেল। যাক , পালায়নি এখনো।
ফাঁকা ট্রেনে জানলার ধরে দুটো সিট্ বেছে নিয়ে বসলো দুজনে। সুপর্ণা জানলার ধারে আর অনির্বান তার পাশেই। "ভোঁ " , শব্দ করে ইলেকট্রিক ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। শহরের গন্ডি পেরিয়ে শহরতলীর মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুই প্রেমিক প্রেমিকাকে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সুপর্ণা। বড় বড় অট্টালিকাগুলো কেমন যেন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলছে ,"আমরা জানি সব কিছু "
হঠাৎ কিছু একটা মনে পরে গেল সুপর্ণার। ব্যাগের ভেতরে এলো , পাথাড়ি খুঁজতে লাগলো।
অনির্বান তার এই ব্যস্ততা দেখে জিজ্ঞেস করলো ," কি হলো ? কিছু খুজছিস ?"
সুপর্ণা তার দিকে একবার খালি তাকালো। মুখে কিছু না বললেও বুকটা কেঁদে উঠছে। তার কবিতার খাতাটা ফেলে এসেছে।
"কি হলো , বল কিছু !", অনির্বান একটু জোর দিয়ে বলল।
"আমার কবিতার নোটবইটা "
"ফেলে এসেছিস ?"
সুপর্ণা কিছু বললোনা। খালি মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। ষোলোআনা জীবনের চোদ্দআনাই যেন ফেলে চলে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কাল হারিয়েছে সে। গঙ্গাঘাটে বসে লিখছিল। এক নতুন কবিতার কয়েকটা লাইন
"এ কোন রঙে রাঙালে তুমি , ভাবলে না একবারো
রুপালি চাঁদের আলোয়ে কেড়ে নিলে লজ্জা আমার ,
পেট গুরু গুরু , মন সুরু সুরু লজ্জা মাখলো ঠোঁটে ,
মুখ ফুটে একবার বললেনা ,ইন্দ্রানী ,ভয় নেই তোমার , আমি আছি
তোমার সঙ্গে।
শেওলা ভেজা নদীর চড়ে গড়বো দুজনে ঘর ,
ও ইন্দ্রানী আমি হবো তোমার বর "
(২)
ট্রেনে ভীড় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। সুপর্ণার মনে হলো যেন এই জনসমুদ্রে সবাই তার পরিচিত। তার এই অবস্থা দেখে তাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। সামনের সিটে বসে থাকা একটা বয়স্ক মহিলা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। মহিলার দৃষ্টিটা কেমন যেন অদ্ভুত। এমনভাবে আবার কেউ তাকায় নাকি ? যেন সুপর্ণার চোখের মধ্যে দিয়ে তার অন্তরাত্মাকে দেখতে পারছিলেন তিনি।
সুপর্ণা একটু ঠিক করে বসলো। বা হাত দিয়ে অনির্বানের হাত টা চেপে ধরলো একটু ভরসার জন্য।
নিজেকে সে যতটা স্বাধীন মনে করতো এখন ততটা মনে হচ্ছেনা। একটু একটু ভয় তার বুকটা থরথর করে কাঁপছে। কোথায় যাবে ? কি করবে ? কি খাবে ? এই সবকিছু নিয়েই কেমন যেন গোলমেলে লাগছিল তার মনটা। গলাটা একেবারে শুকিয়ে উঠেছে।
ব্যাগ নেড়েচেড়ে জলের বোতলটা বার করলো সুপর্ণা। একেবারে তলানিতে ছলাৎ ছলাৎ করছে। এতো জল কখন শেষ হলো ? একবার ভাবলো দু একটা পাথর ফেলে দেখবে। সত্যি কি জল উঠে আসে কিনাড়াতে ?
অনির্বান বোতলটা দেখে বলল," সামনের স্টেশনে ভোরে নেবো। এখন এই টুকু দিয়ে চালিয়ে নে "
কেমন একটা সন্দেহ ফোঁস করে উঠলো সুপর্ণার। আবার পালানোর মতলব করছেনা তো অনির্বান ? স্টেশনে জল ভরতে ভরতে গাড়ি চলে গেছে এটা একটা পুরানো প্লট। মনে মনে হাসি পেলো। সত্যি কি অনির্বান সারা জীবন থাকবে তার সাথে ? হবে তার গর্ভজাত এর বাপ্ ?
অনির্বানের দিকে তাকিয়ে বলল ," অনির্বান , আমরা কি পারবো ?"
অনির্বানের মুখে কোন হাসি ফুটলো না। বরঞ্চ একটু ভয়ই লাগলো।
"ভরসা রাখ , ঠিক পারবো। এ ছাড়া তো কোন উপায় নেই রে। " , বলেই থেমে গেল সে।
ট্রেনটা ঝিক ঝিক করে এসে একটা স্টেশনে এসে দাঁড়ালো । অনির্বান সুপর্ণার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল ,"দ্বারা , জল নিয়ে আসছি "
হালকা ভিড় ঠেলে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। সুপর্ণা জানলা দিকে তাকিয়ে থাকলো। মনে মনে বলল ," তাড়াতাড়ি আসিস "
জানলার গরাদ ধরে বসে রইলো চিন্তান্বিত চোখে সুপর্ণা। ট্রেনে ভিড় আর একটু বাড়লো। কিন্তু অনির্বানের কোন পাত্তা নেই।
কোথায় গেল সে?এদিকে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। অনির্বান কি আর আসবেনা ?
সুপর্ণা জানলাটা খুব শক্ত করে চেপে ধরলো যেমনভাবে অনির্বানের হাতটা চেপে ধরেছিল চারদিন আগে। ওই স্টেশনের লাইনেই পরে ছিল ওর মৃতদেহ। রক্তে মাখা রেললাইন গুলো সকালেই সুপর্ণাকে ডাকছিল। বলছিল যে সিঁদুর তোর সিঁথিতে পড়েনি সেই সিঁদুর আমার গায়ে লেপ্টে দে।
হয়তো একই রকম ভাবে অনির্বাণকেও সেইদিন ডেকেছিল।
"এই মেয়ে "
সুপর্ণা ছলছল চোখে তাকিয়ে দেখলো সেই সামনের সিটে বসা মহিলাটার দিকে।
"জল খাবে একটু ?"
সুপর্ণা ঘাড় নাড়লো একটুখানি। অনির্বান সত্যি তার সাথে থাকেনি। স্টেশনে জল আন্তে গিয়েই যদি পালিয়ে যেত তাহলেই হয়তো ভালো হতো। দুটো গাল মন্দ করতে পারতো। আগত সন্তানকে বলতে পারতো যে তার বাপ্ এই বিশাল ভূ -খন্ডে কোথাও একটা আছে। পালিয়ে গেছে তাকে ছেড়ে। কিন্তু অনির্বান এরকম ভাবে চলে যাবে সেটা মেনে নিতে পারেনি সুপর্ণা।
ট্রেনটা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে একটা স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। সামনের মহিলা নরম গলায় সুপর্ণাকে জিজ্ঞেস করলেন ," এই মেয়ে , তোর কোথাও যাওয়ার আছে ? এই স্টেশনই তো শেষ। "
সুপর্ণা থরথর করে বলল ,"কোন স্টেশন দিদি ?"
"নামখানা। ", তারপর ছিপছিপে পোয়াতি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন তার মায়া হল। তিনি বললেন ," আমার সাথে যাবি ?"
সুপর্ণা কিছু বললনা। যাওয়ার জায়গা তার সত্যি কিছু নেই। যতদিন অনির্বান ছিল , একটা আস্তানা ছিল , একটা ভরসা ছিল। এখন সব হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে তার কবিতার খাতাটাও।
"চল ট্রেন থেকে নামতে হবে। কি নাম রে তোর ?"
নাম তার হারিয়ে গেছে। কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিলোনা। অনির্বানের প্রেমিকা ? সুপর্ণা ? নাকি অন্য কিছু । একটু ঢোক গিলে বলল খালি ," ইন্দ্রানী"
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |