এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • রুহানি - পর্ব ৩ - রাহনুমা হীরামন

    সুপর্ণা দেব
    ধারাবাহিক | ২৫ জুলাই ২০২০ | ২৬৭৬ বার পঠিত
  • রুহানি সফরের নেশা করতে গিয়ে হীরামনকে বাদ দিলে চলবে না। হীরামন ছাড়া এই সফর অসম্পূর্ণ। সেই কবে কোথা থেকে কোন সময়ে কীভাবে যাত্রা শুরু করেছি মনে পড়ে না সবসময়। এই হীরামনই আমাকে এই দীর্ঘ পথের কথা ভুলতে দেয় না। মায়ালন্ঠনের আলো বারবার জ্বালিয়ে দেয় সে। সেই পথের গন্ধ, স্পর্শ, রূপ, রঙ, কাঁটা ও ফুল , জল ও বাষ্প, বিষ ও মধু কিছুই সে ভুলতে দেয় না। সেই লন্ঠনের আলোয় হীরামন আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় আজো। এই বহমান অতিথিশালার কয়েকটি ঘরের কয়েকটি দিন ও রাত ফিরিয়ে আনল আমার টিয়া, হীরামন।



    ~ ১ ~


    এই কিসসা খোদ ইবন বতুতার মুখ থেকেই শোনা। বাইরে জাঁকিয়ে শীত। পরিষ্কার আকাশে তারাগুলো এতো কাছে, মনে হচ্ছে হাত দিয়ে টুপ করে পেড়ে নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজে ফেলি। এতো সহজে যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন এ সুযোগ ছাড়া কি উচিত? রাতের জন্য আস্তানা গেড়েছি ক্যারাভান সরাইতে। কীকরে জানব এখানে ইবন বতুতাও এসে বসেছেন? ইবন, দস্যুদের হাতে নাকাল হয়েছেন অনেক বার। সেই ভয়ে আমাদের মতই দিনের শেষে ক্যারাভান সরাই তার মতন কেউকেটারও ভরসা। ভেতরে ঝিম মেরে বসেছে অন্ধকার, কালো আদুরে বেড়ালের মত। একটা আঙটায় ধিক ধিক জ্বলছে তুষ। ইবন বসেছেন দুটো তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে। মাটির এবড়ো খেবড়ো দেওয়ালে ধিকি ধিকি আগুন নকশা কাটছে, সেই নকশাই আবার রঙিন পশমে বুনে বুনে আমাদের জড়িয়ে ধরেছে শাল আর বালাপোষ হয়ে। কটকটে গরম কফি, তিতকুটে, সঙ্গে কুমড়ো বিচি ভাজা কাঠ বাদাম। আমাকে আবার কুমড়ো বিচি আর কাঠ বাদাম ডান হাত দিয়ে নিয়ে বাঁ কাঁধের ওপরে নিয়ে যেতে হচ্ছে। উফ, হীরামন বসে আছে আমার বাঁ কাঁধে, অমন সাধের পশমিনা আংরাখা একেবারে দশ নখে আঁকড়ে। ব্যাটা গল্প শুনতে পেলে আর কিছুই চায় না। আবার ফোড়ন কাটবে কানের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে। দিহিলিতে ছেড়ে এসেছে তার দুই স্যাঙাৎ রুমি আর চিনার কে। কাজেই আমাকে জ্বালিয়ে মারছে আর কী।

    ইবন শোনাচ্ছিলেন মালাবারের দারুচিনি বনে ঘনিয়ে ওঠা বিকেলের গল্প। সেখান থেকে ইবন ভেসে যান সিলোনে। সিলোনে গিয়ে তিনি তাজ্জব বনে যান। সেই দেশের চারিদিকে চুনি, লাল টকটকে চুনি। মেয়েদের গায়ে গলায় হাতে চুনির গয়না। একটা শাদা হাতির মাথায় চুনি, একটা নয়, সাতটা বড় বড় চুনি, মুরগির ডিমের মত বড়। সুলতানের হাতে একটা চুনি দিয়ে বানানো বাটি। তার মধ্যে ঘৃতকুমারীর তেল। উরিব্বাবা! সে দেশের সুলতান বললেন, এ আর নতুন কী? আমাদের এরম কত আছে!

    আমরা সবাই ইবন বতুতার চারদিকে ঘন হয়ে গুছিয়ে বসলাম। ইবন ইশারায় আরও কফি আনতে বললেন। ক্যারাভান সরাই এর ফরমাশ খাটা ছেলেরা জালি দেওয়া মবখারা টাঙিয়ে দিয়ে গেলো। জালির ভেতর দিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে জ্বলন্ত লবানের ধোঁয়া। আঙটার তুষের ওম। এ কোণে ও কোণে একটা দুটো কালো পাঁশুটে বেড়াল। বেড়াল দেখলেই হীরামন আরো নখ দিয়ে আমার পশমিনা আংরাখা চেপে বসছে। অবশ্য হীরামন যা ঝগড়ুটে! বেড়াল কেন বাঘও কাছে ঘেঁষবে না।

    গলা খাঁকড়িয়ে ইবন, মুখে দুটো লবঙ্গ ফেলে বললেন, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম, বুঝলেন! সবে চিন দেশ ছেড়েছি। সমুদ্রের কোন অজানা অঞ্চল দিয়ে চলেছি মাঝিমাল্লার দল বুঝতেই পারছে না। শোঁ শোঁ হাওয়া। আকাশ কালো অন্ধকার। দশ দিন সূর্যের মুখ দেখিনি। বেঁচে থাকবো কি না বুঝতেই পারছি না! জাহাজের সবাই আবার চিন দেশে ফিরে যেতে চাইলো কিন্তু তখন তা আর সম্ভব নয়। বিয়াল্লিশ দিন সমুদ্রে আমাদের এইভাবেই কাটল। অনিশ্চিত। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না কী হতে চলেছে। তেতাল্লিশ দিনে দূর থেকে একটা পাহাড় দেখা গেল। পাহাড়! মানে ডাঙা! বাতাসের বেগ আমাদের সেই দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। জলের মধ্যে পাহাড়! অভিজ্ঞ নাবিকের দল বলাবলি করতে লাগলো, এরকম কোনো ধারণাই তাদের নেই। কোথাও মস্ত বড় কিছু ভুল হচ্ছে!

    বললে বিশ্বাস করবেন না, সবাই ইষ্টনাম জপতে শুরু করলো। বিপদে একমাত্র ঈশ্বরই ভরসা! আমি সেসব কথা আমার রিহলাতে লিখে রেখেছি।
    যাইহোক, কিছুক্ষণ পর বাতাস একটু শান্ত হল। তারপর হালকা রোদ্দুর ফুটে উঠল। পাহাড়টা আরো স্পষ্ট হল আমাদের কাছে। আমরা সবাই কী দেখলাম জানেন?
    পাহাড়টা একটু একটু করে ওপরে উঠছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আমরা তো বাক্যিহারা। মুখে কারো কথা সরছে না। আবার ও দিকে মাঝিমাল্লার দল একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কী কান্না কী কান্না!

    গল্পের মাঝখানেই আমরা সবাই প্রায় দমবন্ধ করে বলে উঠলাম, কেন? কেন?
    ইবন বললেন, আমি মাল্লাদের শুধোলাম, ওহে তোমরা অমন করছ কেন?
    ওরা কী বলল জানেন? আজ্ঞে হুজুর, ওটা রক পাখি, রক পাখি। পাহাড় নয়। একবার যদি আমাদের দেখতে পায় আমরা তাহলে আজ বেঁচে ফিরবো না।
    তখন সেই পাখি মাত্র দশ মাইল দূরে। কী বিশাল, কী বিশাল! একটা প্রকান্ড পাহাড়ের মত দেখতে। ঈশ্বরের কী করুণা জানিনা, বাতাস আমাদের অন্যদিকে দ্রুত ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
    সে পাখির আসল চেহারা কী, তা জানার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোটাই হয় নি সেদিন! খুব জোর বেঁচে গেলাম আমরা!

    আমরা সবাই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলাম, আরব্য রজনীর সিন্দবাদ সওদাগরের গল্পে রক পাখির কথা শুনেছি বটে! সিন্দবাদ ও ওরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল। আমরা ভাবতাম সেটা নেহাতই গল্প। রকের আবার দুটো মাথাও দেখা যায়। দুই পায়ে মস্ত হাতি নিয়ে আকাশে উড়ছে।

    হীরামন টা বেশি পাকা! আমার কানের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে বলল, জটায়ু আর গরুড়, এরাও তাহলে সত্যি সত্যি আছে, অ্যাঁ? আমাদের পাখিদের বংশ খুব সম্ভ্রান্ত, জানো!
    আমি তাড়াতাড়ি বললুম, চুপ চুপ একদম। এতো বড় একজন ভূপর্যটক এখানে বসে আছেন। এনার সামনে একদম মুখ খুলবি না!

    আমাদের অবিশ্যি মুখ খুলতে হল কারণ ভেড়ার মাংসের গরমাগরম সোবরা এসে গেছে। সোবরায় মিশে আছে তুলতুলে ভেড়ার মাংস, কাবলি ছোলা সেদ্ধ, রসুন টমেটো, বুরগুর, পুদিনা। লবানের ধোঁয়ার সঙ্গে সোবরার হালকা হালকা ধোঁয়ায় গন্ধের আরামে একেবারে চোখ বুজে আসছে। শীতটা যা পড়েছে!

    তারপর কবে জনিনা, সেই ধোঁয়া গলে গলে গলে গলে হঠাত দেখি ফনফনে সমুদ্রের ফ্যানা হয়ে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে। গরম গরম রসমের সঙ্গে মুচমুচে সুরমাই মাছ ভাজা খাচ্ছি। এমন সময় হীরামন একটা কাগজ এনে কোলের ওপর ফেলে বলল পড়ো দিকিনি! সেই মনে পড়ে, সেদিন তো আমায় খুব চুপ করিয়ে দিয়েছিলে। এই দ্যাকো, ওই রক পাখি আমাদের এই দেশেও ছিল। ষষ্টি চরণের মতো হাতি নিয়েও লোফালুফি করত।
    পড়লাম, গণ্ডবেরুন্ড পাখি। ভারতের দক্ষিণের এক রাজ্যের সরকারি সিম্বলও ছিল এককালে। কখনো দুই বা একমাথা। বেশির ভাগই দুই মাথা। বিশাল পায়ের নখে লুতুপুতু করছে পুতুলের মত হাতি। আরে এযে এক্কেবারে রক পাখি!

    হীরামন বড্ড পাকা! বলে কী, এতে অদ্ভুত কী আছে? এতোদিন ধরে তোমার সঙ্গে দেশে দেশে কালে কালে তো কম ঘুরছি না। কোথায় হকিকত শেষ হয়ে আজগুবি শুরু হচ্ছে সে টা বোঝাও আমায়! সব সত্যি! একেবারে জিলিপির প্যাঁচের মত সত্যি! হকিকত আর আজগুবিতে আসলে কোনও ফারাক নেই। এ মজার শেষ নেই! নাও নাও ওঠো, এরা খুব ভালো কলার চিপস বানাও। আমাকে কিনে দাও দেখি!
    আমি ওর মাথায় একটা টোকা মেরে বললাম, হীরামন, ইউ রক!!!



    ~ ২ ~


    ইবন বতুতা উড়নি দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বিল্টু দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল, ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা, দেশটাকে এরম বিচ্ছিরি কী করে ফেললেন আপনারা? আমার তো পষ্ট মনে আছে, এই তো সেদিন আমার জাহাজ ভিড়ল আপনাদের বাংলায়। আহা, চোখ একেবারে জুড়িয়ে গেল। চারিদিক সবুজ, শস্য উপচে পড়ছে। আমি তো এতো দিন ধরে নানা দেশে ঘুরছি। এমন শস্যবোঝাই দেশ এইখানেই দেখলাম। আর কী শস্তা, কী শস্তা! গ্রামের পর গ্রাম শুধু ধানখেত আর ফলের বাগান। এখন তো দেখছি ভালো করে কেউ খেতে পরতেই পায় না। এহেহেহে, চারদিক যে একেবারে অশান্তি ছেয়ে আছে। এটা কী আপনার উচিত কাজ হয়েছে?

    বিল্টু দাদুকে এবার একটু অসহায় দেখাল। শুকনো মুখে ঢোঁক গিলে বলল, আজ্ঞে আপনি এসেছিলেন তা বেশ কয়েকশ বছর হয়ে গেল। দেশের ওপর কত ঝড় ঝাপ্টা বয়ে গেছে। আমি একা আর কত করব বলুন তো? সবাই যদি সঙ্গে না থাকে!

    এই বলে বিল্টু দাদু ইবন বতুতাকে জল বাতাসা দিয়ে দাওয়ায় বসতে দিল। বিল্টু দাদুর কাছে আমি গল্প শুনি। দাদু, গল্পের ভেতর দিয়ে আমাকে যে কোথায় কোথায় নিয়ে যায়! বিলটু দাদুর নাম বিল্টু বসু। ওরা জিরাট না জনাই কোথাকার যেন জমিদার ছিল। শুনেছি দাদু নাকি খুব সাফ মাথার লোক ছিল। খুব বুদ্ধি। কিন্তু দাদু চাইল সে নাকি ড্রয়িং এর মাস্টার হবে। বিলটু দাদুর মা মানে যিনি ওই হেঁশেলে বসে শিলনোড়ায় মানকচু, নারকোল, কাঁচা লঙ্কা আর সর্ষে বাটছেন, তিনি তো শুনেই রেগে আগুন! বললেন তাই হ গে যা। মোটা একটা চশমা পরবি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ থাকবে আর খুকু খুকু করে কাশবি! ঠিক হোলোও তাই। তবে বিল্টু দাদু আমাকে খুব ভালোবাসে। বলে তুই একটা মস্ত দোলন চাঁপা।
    মস্ত দোলন চাঁপা কী, দাদু?

    ওরে মা, তোর বয়সটাই যা বেড়েছে। বুদ্ধিশুদ্ধি তো তেমন বাড়েনি। শিশুর মত সরল, তাইতো তুই দোলন চম্পা।

    শুনে আমি বেড়ালটার মত খুশি হয়ে যাই। তবে দাদু আমাকে খাটায় খুব। জল দে, একটু হাওয়া করে দে, তুলিগুলো ধুয়ে দে, রঙ গুলে দে, মাকে লুকিয়ে নাড়ু নিয়ে আয়, পান সেজে দে, এইসব। ওদের আবার খুব তোয়াজের পান খাওয়া। আমার মত হীরামনও দাদুর খুব ন্যাওটা।

    তা দাদুর কথা শুনে ইবন বলল, এহেহেহে, আপনাদের দেশের লোকেরা তো বেজায় দুষ্টু। এইবারে বুঝতে পেরেছি খোরাশানের লোকেরা কেন আপনাদের বাংলাকে “দুজাখাস্ত পুর নিমাহ “ মানে” ভালো জিনিসে ভরা একটি নরক”বলত! নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল। হুম! এতোদিনে পরিষ্কার হল।
    বিল্টু দাদু বলল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হল। পঞ্চাশে মন্বন্তর হল। তারপর, তারপর...
    দাদুকে মাঝপথে থামিয়ে ইবন বলল কত নৌকো দেখেছিলাম। কী চমৎকার লেগেছিল আমার, নদী নৌকো মাঠ ভরা সোনালি ধান। মাশাআল্লাহ। এমন চোখ জুড়নো। প্রত্যেক নৌকোয় একটা করে ঢাক থাকত। দুটো নৌকো কাছাকাছি এলেই দুজনেই ঢাক বাজাতো।
    দাদু বলল, জানেন একসময় নৌকোর পর নৌকো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে বিদেশি শত্রু কোনোভাবে নৌকো ব্যাবহার করতে না পারে। যার ফলে খাবার দাবার পৌঁছে দেওয়া অসম্ভব কাজ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
    চৈত্রের দুপুরে নারকেল গাছের মাথায় সুজ্জি গন গন করছে। ইবন বলল, এখানে এসেই চারিদিকে শুধু খাই খাই আর খাই খাই। দুটো রুটির জন্য মানুষগুলোর কী দুর্দশা! ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! দেশের লোককে দুবেলা দুমুঠো খেতে দিতে পারছেন না আপনি ?
    বিলটু দাদু বলল আমি একা একা কী করব বলুন তো? আসলে মা অন্নপূর্ণা রেগে গেছেন, বুঝলেন!
    ইবন বলল, এ কিসসা তো আমাকে কেউ শোনায় নি। তাহলে বলেই ফেলুন।

    খর রোদে কাক ডাকে খা খা খা খা। দাদুর মা হেঁশেল থেকে বলে ওঠেন ভাত বেড়েছি। গুণেগুণে ঠিক তিন বার ডাকবো তারপর হেঁশেল বন্ধ করে আমি ঘুমুতে যাব।
    আমরা সব দাওয়ায় সুড়সুড় করে খেতে বসে গেলাম। ইবনও তার জোব্বাজাব্বা সামলিয়ে সোনামুখ করে দাদুর মায়ের হাতে কচু নারকেল বাটা, কুমড়ো ফুল ভাজা, মুগ ডাল আর মোচার ঘণ্ট খেতে শুরু করল।

    বিল্টু দাদু বলল, এ কিন্তু কিসসা নয়। এ হল হকিকত। আমাদের শিবঠাকুর আর পার্বতীর মধ্যে একদিন খুব ঝগড়া হচ্ছে। শিব ঠাকুর বলছে এই জগত টা আর কী? একটা মায়া। শুধুই মায়া! শুনে মা পার্বতী বললেন বটে! সারাদিন ধরে এই যে এতো খাবারের জোগাড় দিচ্ছি এগুলো সব তোমার গাঁজার ধোঁয়ার মত মায়া? সূর্যের তাপে জলরাশি থেকে, সবুজ পাতা থেকে ভাপ জমে আকাশে মেঘ হয়, মেঘ থেকে বৃষ্টি, তার পর শস্য। ফুলে ফুলে পরাগ মিলনে ফলন আর ফলে ভরে ওঠে পৃথিবী। নিশিরাত থেকে উঠে আমাকে এইসব তদারকি হয়। দুধেল গাই দুধ দেয়, ফলে ফলে রসের ক্ষীর জমা হয়, শিকড়ে শিকড়ে জলকণা। মৌমাছি বিন্ধু বিন্দু মধু জমা করে। সব কাজ সারা হলে দক্ষিণ পূর্ব অগ্নিকোণে আমি রান্না করতে বসি। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ খেতে পায়। তুমি মায়া মায়া বললে আমি মানবো কেন? আমার খাটুনির কোন দাম নেই? এ মায়া নয় স্বামী, এ হোল দায়িত্ব, সেবা, ত্যাগ ও পরিশ্রম। পালন ও পোষণ। এই বলে অভিমানী পার্বতী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

    ব্যাস আর যায় কোথায়? সারা পৃথিবীতে ঘোর অনিয়ম, অনাচার, অনাহার। সব জায়গায় অশান্তি আর হাহাকার! কারণ সব শান্তির মূল তো ওই অন্ন। দু মুঠো ভাত। শিব আর কোথাও এক টুকরো দানাপানি জোটাতে পারেন না। শেষে তার ভুল ভাঙল। এই হোল গল্প।

    উঠোনে এক ঝাঁক তিত্তির পাখিও দানা খাচ্ছে। সেই দিকে তাকিয়ে দাদু বলল, ইবনবাবু, আপনি কত দেশ ঘুরেছেন। রিহলা লিখেছেন। আমাদের দেশে প্রাচীন বই গুলোতে তৈত্তিরীয় উপনিষদে অন্নকে পুজো করেছেন ঋষি রা। শুধু অন্ন নয় আকাশ, জল, মাটি কৃষি, ফলন, পুরো পরিবেশের সেবা ও শুশ্রূষা, এই আমাদের সাবেক ধর্ম। যা ধারণ করে রাখে তাই ধর্ম। অন্নের থেকে আর বড় ধর্ম কী? ইনিই মা অন্নপূর্ণা। শিবের মত সমস্ত প্রাণীদের পালন করছেন। তাঁর একহাতে অন্নপাত্র আরেক হাতে দর্বী ( হাতা)। তিনি দুটো খেতে দেন তাই আমরা খেতে পাই। তাই বলছিলাম এখন অন্নপূর্ণা, নিম অন্নপূর্ণা হয়ে গেছে!
    আমি তো বোকা দোলন চম্পা। চুপটি করে বসে বসে দুই বুড়োর শুনছিলাম। দেখলাম ইবনের চোখে জল। বলল, যান, মা ভেতরে গেছেন। পান সেজে দিয়ে আসুন। পায়ে একটু হাত বুলিয়ে দেবেন। ও হ্যাঁ আমার জন্যও পান আনবেন। একটু বেশি গুলকন্দ দিয়ে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৫ জুলাই ২০২০ | ২৬৭৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    আগ - Soudamini Shampa
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • i | 110.174.255.237 | ২৫ জুলাই ২০২০ ১৬:২২95491
  • আবারও মুগ্ধ, লেখার মায়ায়, মহিমায়।
    নমস্কার জানবেন।
  • ফরিদা | ২৫ জুলাই ২০২০ ১৬:৩৭95493
  • এই সিরিজটা খুব পছন্দের জায়গা হয়ে উঠছে। 

  • বিপ্লব রহমান | ২৫ জুলাই ২০২০ ১৮:০২95498
  • ঘনাদার সিরিজের মতো ঘনিয়ে উঠেছে কিসসা। ব্রেভো     

  • b | 14.139.196.11 | ২৫ জুলাই ২০২০ ১৮:৩২95501
  • খুব ভালো হচ্ছে।
  • সুকি | 49.207.203.64 | ২৫ জুলাই ২০২০ ১৮:৪৪95503
  • এই সিরিজটা খুব ভালো হচ্ছে। 

  • | ২৫ জুলাই ২০২০ ২০:১৩95509
  • চমৎকার সরস সিরিজ হচ্ছে এটা।
  • Tim | 2607:fcc8:ec45:b800:b546:3dcb:52d2:5474 | ২৬ জুলাই ২০২০ ০৮:৩৬95537
  • খুব ভালো হচ্ছে এই সিরিজ। পড়ছি
  • শঙ্খ | 103.242.189.109 | ২৬ জুলাই ২০২০ ১৮:২৭95567
  • খুব মায়াকাড়া।
  • শিবাংশু | ৩১ জুলাই ২০২০ ১০:৪২95738
  • দুর্ধর্ষ। প্রতিটা লেখাই পড়ছি।
  • Tim | 174.102.66.127 | ০৮ আগস্ট ২০২০ ০৭:৩২96030
  • আবার পড়লাম। এবার সিকোয়েন্স মেনে।খুব ভালো হচ্ছে এই ধারাবাহিক।
  • শাফি মুহাম্মাদ মাসুদ | 27.147.206.230 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১২:০১96923
  • লেখা খুব ভাল লাগছে... বই আকারে পেতে চাই।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন