এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • ভারতের করোনা পরিস্থিতি ২: পরীক্ষা প্রার্থনীয় (?)

    Anirban M লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৪ জুলাই ২০২০ | ৩৪৯২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • আবার ভগ্নাংশ, আবার ত্রৈরাশিক



    প্রথম কিস্তির (ভারতের করোনা পরিস্থিতি ১: ভগ্নাংশ না ত্রৈরাশিক) লেখা শেষ করেছিলাম এই বলে যে ভারতে করোনা পরীক্ষা যথেষ্ট হচ্ছে কিনা সেইটা নিয়ে আলোচনা করব দ্বিতীয় কিস্তিতে। বিবিসি র প্রতিবেদনে এবং আরও অনেক আলোচনায় এরকম সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে যে, ভারতে যে যথেষ্ট করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছে না, তার কারণ যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে না। আজকের কিস্তিতে আমরা দেখব এর পক্ষে বিপক্ষে কী প্রমাণ আছে। বিবিসি র প্রতিবেদনে এর স্বপক্ষে প্রথম যে প্রমাণ টি দেওয়া হয়েছে সেটি হল প্রতি দশ লাখ জন সংখ্যায় ভারতে মোট করোনা পরীক্ষার সংখ্যা। আমরাও এই চিত্রটি দেখব। কিন্তু তার আগে আগের কিস্তির আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে একটা কথা মনে করিয়ে দিই। আগের কিস্তিতে আমরা দেখেছিলাম যে কোন দেশের করোনা পরিস্থিতি মোট সংখ্যার বিচারে একরকম দেখায়, মোট জনসংখ্যার অনুপাতে আরেকরকম দেখায়। ভারতের মত দেশে, যেখানে জনসংখ্যা খুবই বেশী, যেকোনো আনুপাতিক পরিসংখ্যানের মান খুব বেশী হয় না। আমি এটাও আলোচনা করেছিলাম যে পরিস্থিতি ভেদে দুরকম পরিসংখ্যান নিয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। বিবিসির প্রতিবেদনটি শুরু হচ্ছে ভারতে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দিয়ে। কিন্তু ভারতে যে পরীক্ষা কম হচ্ছে সেটা দেখাবার জন্য তাঁরা প্রতি দশ লাখ জন সংখ্যার অনুপাতে মোট পরীক্ষার সংখ্যাটি প্রকাশ করেছেন। এর ফলে ভারত করোনা পরীক্ষার আনুপাতিক সংখ্যায় অনেক নিচে নেমে গেছে! কিন্তু তাঁরা যদি পরীক্ষার সংখ্যাতেও মোট সংখ্যা দেখাতেন? তাহলে কি দাঁড়াত?আসুন দেখে দেওয়া যাক। প্রথমে দেখি, পরীক্ষার অনুপাত, প্রতি হাজার জনসংখ্যার জন্য। আগের দিন আমি মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ, কিছু পশ্চিম ইউরোপের দেশ, আমেরিকা এবং ব্রাজিল এর তুলনামূলক আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু আজকের আলোচনায় আমরা পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশকেও নেব, যাদের মধ্যে তাইওয়ান অনেক বেশী করোনা পরীক্ষা করেছে। এছাড়া থাকবে নিউজিল্যান্ড, যে দেশটির করোনা প্রতিরোধের সাফল্যের মুলে আছে অনেক পরীক্ষা – এমনটাই মনে করা হয়। চিনকে আমরা এবারও আলোচনায় রাখতে পারছি না। তার একটা কারণ, চিনে মোট আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম -- ৮৪০০০ এর মত, OWID অনুসারে। যদিও অন্য দু একটা সাইটে আরও কম সংখ্যা দেখাছে। এর একটা বড় কারণ চিন একটি প্রদেশের মধ্যে সংক্রমণ আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু চিনকে আজকের আলোচনা থেকে বাদ দেওয়ার বড় কারণ হল, চিনে কত করোনা পরীক্ষা হয়েছে সেই সংক্রান্ত কোনও তথ্য নেই। 



    চিত্র ১ বিভিন্ন দেশে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় করোনা পরীক্ষার সংখ্যা



    উপরের ছবি থেকে একথা পরিষ্কার যে আনুপাতিক হিসেবে (প্রতি ১০০০ জনসংখ্যায়) ভারতে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু আনুপাতিক হিসেবে ভারতে কিন্তু করোনা রোগীর সংখ্যায়ও খুব বেশি না। ভারত যে করোনা রোগাক্রান্তের বিচারে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে সেটা কিন্তু মোট সংখ্যার বিচারে। তাই মোট পরীক্ষার সংখ্যার বিচারে ভারতের পরিস্থিতিটাও বুঝে নেওয়া উচিত। 



    চিত্র ২ বিভিন্ন দেশে মোট করোনা পরীক্ষার সংখ্যা



    এখানে মোট সংখ্যাটির একক হিসেবে লাখ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ আমেরিকার পাশে যে ৩৬১.৪ দেখতে পাচ্ছেন সেটির মানে হল ৬ জুলাই অবধি আমেরিকাতে মোট ৩৬১.৪ লাখ অর্থাৎ ৩.৬১ কোটি পরীক্ষা হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটিই ৯৭.৯ লাখ। (ভারতের এই পরিসংখ্যানটি একটু পুরনো। ১২ জুলাই অবধি এই সংখ্যাটি এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অবশ্য বাকি দেশের পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। )। যাই হোক, এই রেখাচিত্রটি দেখানোর কারণ হল এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে, ভারতে মোট আক্রান্ত এবং মোট পরীক্ষা দুটি চলকের মান বেশ উপরের দিকে।



    তৈলাধার পাত্র না পাত্রাধার তৈল?


    কিন্তু যে কথাটা মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে আসে বিভিন্ন প্রতিবেদনে তা হল, ভারতে করোনার প্রাদুর্ভাব কম, কারণ পরীক্ষা অনেক কম হচ্ছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে এই বক্তব্যটি আনুপাতিক হিসেবের ওপর দাঁড়িয়ে করা, কারণ সেই বিচারেই ভারতের স্থান করোনা টেবিলের নিচের দিকে। আসুন দেখা যাক, এই বক্তব্যটি কতটা যথার্থ। আমাদের কাছে ভারতে প্রতি দশ লাখ জনসংখ্যার জন্য করোনা আক্রান্তের সংখ্যা (৪৮৭) এবং প্রতি হাজারে করোনা পরীক্ষা (৭, প্রতি দশ লাখে ধরলে এয়েই সংখ্যাটি হবে ৭০০০ মত) এই দুটি পরিসংখ্যানই আছে এবং আমরা এটাও জানি যে আন্তর্জাতিক বিচারে এদুটিই বেশ কম। কিন্তু আসল ব্যাপার হল এই পরিসংখ্যানগুলিকে দেখার ভঙ্গি যা কখনই দর্শকের রাজনীতি বা রাজনৈতিক দর্শন নিরপেক্ষ হতে পারে না। আধ গ্লাস জলকে আপনি অর্ধেক ভর্তিও বলতে পারেন, অর্ধেক খালিও বলতে পারেন। আমরা এই  পরিসংখ্যানটিকেও দুভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। কেউ বলতে পারেন, যে ভারতে পরীক্ষা কম হচ্ছে বলে আক্রান্তের সংখ্যা কম, আবার কেউ বলতে পারেন আক্রান্তের সংখ্যা কম বলে সরকার পরীক্ষা কম করছেন। আপাতদৃষ্টিতে দুটিই সঠিক হতে পারে। আপনি কোন মতে বিশ্বাস রাখবেন সেটা নির্ভর করে আপনি সরকার কিভাবে কাজ করে বলে মনে করেন তার ওপরে। সরকার আমাদের দেশে করোনা পরীক্ষা করছিল কন্টাক্ট ট্রেসিং এর মাধ্যমে। অর্থাৎ,ধরুন কারও করোনা হলে সরকার চেষ্টা করছিল তার সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের পরীক্ষা করে রোগ কতটা ছড়িয়েছে সেটা বোঝার। এখন যদি কোথাও সরকার এই কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করে এবং সেখানে যদি প্রাথমিক অবস্থায় রোগ অনেক কম থাকে, তাহলে সরকার সব কাজ ঠিক ভাবে করা সত্বেও পরীক্ষা কম হবে। আবার সরকার যদি ট্রেসিং এর কাজটি ঠিক ভাবে করতে না পেরে থাকে তাহলেও কিন্তু রোগ এবং পরীক্ষা দুইই কম হবে। যদিও এইভাবে যে রোগীরা বাদ পড়ল তাদের রোগ বাড়লে তারা হাসপাতালে আসবেই এবং তখন সেই রোগ এবং পরীক্ষা দুইই বাড়ার কথা। কিন্তু সে তো ভবিষ্যতে। কেউ এটা মনে করতেই পারে যে, এখন সরকারের অসতর্কতার জন্য রোগ কম দেখালেও, ভবিষ্যতে রোগী সংখ্যার বিস্ফোরণ হবে। তত্ত্ব হিসেবে এ দুটিই কিন্তু যুক্তি সঙ্গত। এছাড়া কেউ এটাও মনে করতে পারেন যে, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং খুব একটা কার্যকরী পদ্ধতি নয়। আসলে সরকারের যত্রতত্র পরীক্ষা করা উচিত, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া Drive Through পরীক্ষা কেন্দ্র করেছে, যেখানে লোকে গাড়ি চালিয়ে যাবে আর তার পরীক্ষা হয়ে যাবে।



    বিষয়টি আরেকটু ভালো করে ব্যাখ্যা করার জন্য আমি একটি উদাহরণ ব্যবহার করছি। করোনা পরীক্ষা করে রোগ ধরা অনেকটা জাল দিয়ে মাছ ধরার মত। ধরুন আপনি একটি বড় দিঘিতে, জাল নিয়ে  মাছ ধরতে গেছেন। যত বড় জাল, তত বেশি মাছ উঠবে, কিন্তু মাছের ঘনত্ব পাড়ের কাছেই বেশী। তাহলে কি আপনি এমন বড় জাল নিয়ে মাছ ধরতে যাবেন যাতে পুরো দিঘি ঢাকা পড়বে? সেটা আপনি যেতে পারেন যদি আপনার জাল বানানোর খরচ না লাগে বা বড় জালের জন্য বাড়তি পরিশ্রম না হয়। কিন্তু সেটা যদি না হয়,তাহলে আপনি জলে কিরকম মাছ আছে সেটা বুঝে জালের মাপ ঠিক করবেন। ধরুন আপনি একটা ছোট জাল নিলেন। তাতে ৮ কেজি মাছ আর ৪ কেজি আগাছা উঠল। আপনি এবার আরেকটু বড় একটা জাল নিলেন যা পুকুরের ভেতর অনেকটা অবধি চলে যায়। তাতে ১০ কেজি মাছ আর ১০ কেজি আগাছা উঠল। এরপর আপনি আরও বড় জাল নিলেন যাতে ১৫ কেজি মাছ উঠল ঠিকই,কিন্তু আগাছাও উঠল 3০ কেজি। খেয়াল করুন, আপনি যত বড় জাল নিচ্ছেন, মাছ তত বেশী উঠছে ঠিকই (৮ কেজি, ১০ কেজি, ১৫ কেজি) কিন্তু   সেই সঙ্গে এক কেজি মাছ তোলার জন্য আপনাকে তত বেশী বেশী আগাছা তুলতে হচ্ছে (আধ কেজি, এক কেজি আর দুই কেজি)।  এখন করোনা পরীক্ষার ব্যাপারটাও এই জাল ফেলে মাছ ধরার সমতুল্য। পরীক্ষা যত বাড়াবেন, বেশী রোগী যেমন পাওয়া যাবে তেমনি অনেক বেশী পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসবে। কিন্তু জালের মাপ দেখে বোঝা যাবে আপনি মাছ ধরতে কতটা সচেষ্ট। তো কীভাবে আমরা জাল মাপব? করোনার ক্ষেত্রে জালের মাপ হল প্রতি করোনা রোগী পিছু মোট পরীক্ষার সংখ্যা, যা মোট করোনা রোগীর সংখ্যাকে মোট পরীক্ষার সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে।  নিচের ছবিতে এই চলকটির মান বিভিন্ন দেশের জন্য দেওয়া হল।



    চিত্র ৩ প্রতিটি করোনা রোগীর জন্য মোট পরীক্ষার সংখ্যা।



    এখন এই সংখ্যাটা যত বেশী হবে, তত বলা যেতে পারে দেশটি যথেষ্ট পরীক্ষা করছে। ভারতের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ১৫ অর্থাৎ ভারতে প্রতিটি করোনা রোগী পাওয়ার জন্য ১৪ জন সুস্থ লোকের পরীক্ষা করা হয়। প্রশ্ন হল, ভারতের জাল বড় না ছোট? বিবিসি’র প্রতিবেদনে ভারতের সাথে তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, সাউথ আফ্রিকা (10.7), ইন্দনেসিয়া(৮.৭), আর্জেন্টিনা (৫.৫) ও চিলির(৪) পরিসংখ্যান ছিল। আমি আমার রেখাচিত্রে ভারতের নিচে থাকা দেশগুলিকে রাখি নি (আমেরিকা ছাড়া), কিন্তু কয়েকটি উন্নত দেশের পরিসংখ্যান যোগ করেছি যেগুলি বিবিসি’র ছবিতে ছিল না। আমার হিসেব করা চলকের মান বিবিসির থেকে এটু আলাদা হয়েছে কারণ ওদের পরিসংখ্যানটি আরেকটু পুরনো। যেমন, আমার হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য এই চলকটির মান ১০১,বিবিসি’র হিসেবে ৯৮। কিন্তু এর জন্য এদের আপেক্ষিক অবস্থানের পরিবর্তন হয় নি। এখন প্রশ্ন হল ভারত বাকিদের তুলনায় ভাল করছে না খারাপ? বিবিসির প্রতিবেদনে নিউজিল্যান্ড ও তাইওয়ান এর পাশে ভারতের পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলা হয়েছে যে ভারতে পরীক্ষা কত কম হচ্ছে। কিন্তু দেখুন, তাইওয়ান বা নিউজিল্যান্ড-এর পাশে অন্য উন্নত দেশগুলির পরিস্থিতিও খুব ভাল নয়। একমাত্র কাছাকাছি গেছে দক্ষিণ কোরিয়া। জাপান, জার্মানি, ইটালি, ইউ.কে এরা সবাই প্রতিটা করোনা রোগী পিছু ২২ থেকে ২৬ টা পরীক্ষা করছে, আর রাশিয়া সামান্য বেশী- ৩১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো ভারতের চেয়েও কম পরীক্ষা করছে। কিন্তু এরা তো সবাই উন্নত দেশ, চিকিৎসা ব্যবস্থা, সরকার পরিচালনার সবই তো আমাদের থেকে অনেক ওপরে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, আমি তবু একবার ভারতের সাথে এই সব দেশের গড় আয়ের ফারাকটা মনে করিয়ে দিচ্ছি।



    চিত্র ৪ বিভিন্ন দেশের গড় জাতীয় আয় (USD Purchasing Power Parity, 2019)



    উপরের ছবি থেকে এটা স্পষ্ট যে ভারতের সাথে এইসব উন্নত দেশগুলির আয়ের ফারাক যতটা করোনা জালের মাপের ফারাক কিন্তু ততটা নয়। তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া বা নিউজিল্যান্ড যা পেরেছে তা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া বা নিউজিল্যান্ড-এর থেকে ধনীতর দেশেরাও কিন্তু সেটা পারেনি। তার সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে তাইওয়ান বা নিউজিল্যান্ড দ্বীপরাষ্ট্র, তাদের জনসংখ্যাও কম (তাইওয়ান ২ কোটির কাছাকাছি, নিউজিল্যান্ড প্রায় ৫০ লাখ)। আমাদের প্রতিবেশী আরেক কম জনসংখ্যার (প্রায় ২ কোটি) দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাও কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে করোনা প্রতিরোধ করেছে – ৯ জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী তাদের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২০৯৪! কিন্তু সেখানে যে অনেক পরীক্ষা হয়েছে এরকম জানা যায় নি। এমনকি OWID Database এ তাদের পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন তথ্য নেই। এমনকি হতে পারে যে দ্বীপরাষ্ট্রদের করোনা নিয়ন্ত্রণে কোন বাড়তি সুবিধা আছে যেহেতু সে দেশে ঢোকা বেরোনো অনেক বেশী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? আমি জানি না। কিন্তু এসবই সম্ভাবনা। আরেকটা বিষয়েও এই সময় মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনি যদি চিত্র ১ ও ২ দেখেন, তাহলে দেখবেন যে মোট পরীক্ষা এবং প্রতি হাজার জনসংখ্যায় পরীক্ষার ক্ষেত্রে তাইওয়ানের স্থান একেবারে নিচের দিকে -- তাইওয়ান প্রতি হাজারে মাত্র তিন জনের পরীক্ষা করেছে। এই দুটো পরিসংখ্যান মেলালে একটা জিনিসই দাঁড়ায়। তাইওয়ানে রোগ ছড়িয়েছিল কম, তাই প্রতি রোগী পিছু পরীক্ষার সংখ্যা অনেক বেশী হলেও, জনসংখ্যার অনুপাতে পরীক্ষার সংখ্যা অনেক কম। এখন কেউ বলতে পারেন তাইওয়ানে রোগ কম ছড়িয়েছিলই প্রতি রোগী পিছু পরীক্ষার সংখ্যা অনেক বেশী হওয়ায়। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে ও রোগী পিছু পরীক্ষার সংখ্যা বেশী। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও সেখানে প্রতি হাজারেও পরীক্ষা কিন্তু কম নয় -- ৮৮। তাই রোগী পিছু পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে রোগ এতই কম রাখা গেল যে বেশী পরীক্ষার দরকার পড়ল না – এটা খুব ভাল ব্যাখ্যা বলে মনে হয় না। আরেকটা সম্ভাবনা হল, তাইওয়ানে চিনের মতই অল্প জায়গায় রোগটাকে আটকে রাখা গেছে। সুতরাং পরীক্ষার ব্যাপারে যা বলা হচ্ছে তা সার্বজনীন নাও হতে পারে। অনেক পরীক্ষা, বড় জাল কেনার মতই, ভাল ব্যাপার। কিন্তু খুব বেশী দেশ অনেক বেশী আর্থিক ক্ষমতা থাকা সত্ব্বেও যদি সেটা করে উঠতে না পারে তার মানে বুঝতে হবে বিষয়টা অতটা সহজও না।



    অতঃকিম


    ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো তাহলে? আমি দেখাবার চেষ্টা করলাম বিবিসি বা অন্য অনেক প্রতিবেদন যেভাবে ভারতে করোনা পরিস্থিতি দেখানোর চেষ্টা করছে সেটা সত্যি নাও হতে পারে। একই তথ্য-পরিসংখ্যান অন্য ছবি দিতে পারে যদি আলো অন্যভাবে ফেলা যায়। কিন্তু এটা দেখানোর মাধ্যমে আমি কি এটা বলার চেষ্টা করছি যে “মেরা ভারত মহান”? নাকি বলছি করোনা একটা নিছক মিডিয়ার বানানো বাঘ? এই দুটো প্রশ্নেরই উত্তর না এবং না। আমি শুধু একটা তর্ক তুলছি, একটা তথ্যসিদ্ধ আলোচনার প্রস্তাবনা রাখছি। তার কারণ বিভিন্ন দেশে এবং ভারতের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যেও) করোনা আক্রান্তের সংখ্যা (একটি তীব্র রাজনৈতিক টানাপোড়েন এর বিষয়। প্রায় সব দেশই নিজেদের পরিস্থিতি যতটা সম্ভব ভাল দেখাতে চাইছে। টোকিও অলিম্পিক বাতিল হওয়ার আগে পর্যন্ত জাপান যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে দেখাচ্ছিল, সেটা অলিম্পিক বাতিল হওয়ার পরেই যেভাবে আক্রান্তের সংখ্যা জাপানে বাড়তে শুরু করে, তা থেকে অনেকেই অনুমান করেছেন। বৃটেনে সাময়িক ভাবে করোনা আক্রান্তের ভৌগোলিক তথ্য প্রকাশ না করা  বা মৃত্যুর বিস্তারিত খতিয়ান না দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছে তাদেরই সংবাদ মাধ্যম । এছাড়া চিনের করোনা পরিসংখ্যান নিয়ে পৃথিবীর সংশয় বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে বিদেশী ছাত্রদের ভিসা বাতিলের হুমকি দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুমে ক্লাস শুরু করার জন্য চাপ দিছে সে তো আমরা জানিই। সব রাষ্ট্রের, সমস্ত নীতির সূচিমুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা। এই অতিরিক্ত করোনা কেন্দ্রিকতার জন্য যদি পরিযায়ী শ্রমিক হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ক্যানসার রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মরে যায় তাতেও রাষ্ট্রের এবং তার বেশীর ভাগ নাগরিকের কিছু যায় আসে না। করোনার আতঙ্ক অন্য সব ট্র্যাজেডিকে ঢেকে দিচ্ছে, অন্য সব মৃত্যুকে আড়াল করে দিচ্ছে – এই অসহায়তা, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিপদের চেয়ে কিছু কম ভয়াবহ নয়। আমি তাই অন্য স্বরের সম্ভাবনাক্যা জাগিয়ে তুলে চাই। আমার লেখা নিয়ে তর্ক তুলুন, আলোচনা করুন, কিন্তু বিনা প্রশ্নে কোন ন্যারেটিভকে মানবেন না—সে রাষ্ট্রেরই হোক বা মিডিয়ার। 


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৪ জুলাই ২০২০ | ৩৪৯২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বটগাছ - Anirban M
    আরও পড়ুন
    লাইক-ইট - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বর্ম - Anirban M
    আরও পড়ুন
    প্লাবন - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অরিন | ১৫ জুলাই ২০২০ ১১:৪৪95232
  • "নিউজিল্যান্ড ৪ কোটি '

    না, নিউজিল্যাণ্ডের জনসংখ্যা সাড়ে উনপঞ্চাশ লক্ষ, এই দেখুন,

    https://www.stats.govt.nz/topics/population

    চার কোটি হতে ঢের দেরী!‌

  • Anirban M | ১৫ জুলাই ২০২০ ১৩:৪৯95241
  • ধন্যবাদ! সংশোধন করে দিচ্ছি।

  • অরিন | ১৫ জুলাই ২০২০ ১৫:১৯95242
  • খুব ভাল করে লিখেছেন । প্রশংসনীয়!

    এখানে দু-একটা কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। করোনা সংক্রমণ কার হয়েছে কার হয়নি, তা নির্ণয় করার আপাতত একমাত্র উপায় পরীক্ষা করা। এতে করে অসুখ বাড়ছে না কমছে সেটাও সরাসরি পরীক্ষা করা ব্যতীত সম্ভব নয়। যার জন্য ১০০০ জন পিছু কতজনের পরীক্ষা করা হল, এই সংখ্যাটির দুটি তাৎপর্য আছে । এক, বিভিন্ন  দেশে কিভাবে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে, কিভবে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, সেসবের সরাসরি মূ্ল্যায়ন করার জন্য মাথাপিছু পরীক্ষার সংখ্যাটি জানার প্রয়োজন আছে। দুই, কোন দেশে জনপ্রতি আসলে কি হারে অসুখ ছড়াচ্ছে, বা অসুখ যদি কমতে থাকে, কি হারে কমছে, তাকে মাপার জন্যও বহু সংখ্যায় পরীক্ষা করার প্রয়োজন । এখন মাথাপিছু যাই হোক, ভারতে বিপুল জনসংখ্যা, সেখানে স্বভাবতই পরীক্ষার সংখ্যাও অধিক। এ তো সহজ কাজ নয়। 

    পরীক্ষা কম হচ্ছে না পরিমাণমত হচ্ছে সেটা জানবার উপায় কি ? সরাসরি কোন উপায় নেই, তবে কতগুলো বিষয় ভাবা যেতে পারে। 

    এক, কাদের পরীক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে? পরীক্ষা কি সাধারণ মানুষের যখন তখন করা হচ্ছে? না কি, কেবল মাত্র যাঁরা কোন রকম অসুখের লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসকের বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্বারস্থ হচ্ছেন, তাঁদেরই করা হচ্ছে? এখন তাঁদের মধ্যেও যদি "সকলের" না পরীক্ষা করা হয়, বা করা সম্ভব না হয়, তাহলে "আসলে" যতজনের অসুখ হয়েছে, বা "আসলে যে হারে" অসুখ ছড়াচ্ছে, তার থেকে "কম" ধরা পড়বে । এতে করে সমস্যা এই, যে মানুষগুলো পরীক্ষার আওতার বাইরে রয়ে গেলেন, তাঁদের যদি চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব না হয়, অসুখটা অতি ছোঁয়াচে বলে তাঁদের মাধ্যমে অসুখ ছড়াতে থাকে, কালক্রমে সংক্রমণের পরিস্থিতি কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে  যেতে পারে। তাছাড়া যে সব মানুষ Asymptomatic, কিন্তু সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম, এঁরা পরীক্ষার আওতার বাইরে থেকে যাবেন কিন্তু রোগ ছড়াবেন। এঁদের ধরার একমাত্র উপায় কনট্যাকট ট্রেসিং, এবার সেখানেও ঘাটতি থাকলে কিছু করার নেই । 

    আবার, যদি এমন করা সম্ভব হয় যে, যখন তখন সাধারণ মানুষের পরীক্ষা করা হচ্ছে, যাদের সিমটম বেরোচ্ছে তাঁদের কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি, প্রচুর পরীক্ষা হয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কনট্যাকট ট্রেসিং, তাতে একটা সময় পরীক্ষার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় পৌঁছন সম্ভব যে মোটামুটি কি হারে অসুখ বাড়ছে তার একটা প্রায় নিখুঁত আন্দাজ করা যেতে পারে। তার সঙ্গে যদি চিকিৎসার বন্দোবস্ত টুকুও করে ফেলা সম্ভব হয় তাহলে অসুখটিকে কব্জা করতে পারা সম্ভব হয়। যে ব্যাপারটি নিউজিল্যাণ্ডের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বা সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে বা দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছিল। 

    কাজেই, শুধু সংখ্যার ভিত্তিতে দেখলে পুরো চিত্রটি পরিষ্কার নাও হতে পারে। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন