এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • করোনা পাঁচালি – অস্ট্রেলিয়া

    শাশ্বতী বসু লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৫ এপ্রিল ২০২০ | ২০৭৬ বার পঠিত
  • –আপনি কি চায়না থেকে ফিরছেন?

    গত ২১ শে ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে ফেরার পথে সিডনী এয়ারপোর্টে এক পুলিশ অফিসারের খুব নির্লিপ্তভাবে বলা এই প্রশ্নের উত্তরে ঠিক একই ভাবে একটা নেতিবাচক উত্তর দিয়ে নিজের কাজে মন দিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, কনভেয়ার বেল্টের চারিদিকে লাগেজের জন্য অপেক্ষারত যাত্রীদের একই ভাবে প্রশ্নটি করে করে যাচ্ছেন – উত্তরের জন্য কোন আগ্রহ লক্ষ করলাম না। ব্যাস এই পর্যন্তই।

    সিডনীতে এই ভয়াবহ অতিমারী কভিড-১৯ এর চেহারা এরকমই ঢিলেঢালা ছিল ফেব্রুয়ারির শেষ দিক অব্দি। যদিও ততদিনে মেলবোর্নে কভিড-১৯ এ প্রথম মৃত্যুটি ঘটে গেছে মেলবোর্ন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী। কিন্তু আতঙ্ক তখনো শুধু বিনবিনে অস্বস্তির পর্যায়ে – ভয় তেমনভাবে জনমানসে থাবা গেড়ে বসে নি। তবে মৃত্যুটি যেহেতু হয়েছে এক চাইনিজ অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোকের, যিনি সম্প্রতি উহান থেকে ফিরেছেন, তাই মোটামুটি চিন সম্পর্কে এখানকার কিছু কিছু মানুষের মনে – সেটা লক্ষ্য করেছি সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষেই – এক গোপন বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠছিল। অবশ্য সেটা খুব একটা গুরুত্ব পাবার মত কিছু নয়। চিন এখানে সব সময় ভিলেন।

    কিন্তু মার্চের শুরুতেই সিডনীতে অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিলো। যখন পাশের পাড়ার একটি স্কুলে একটি সাউথ কোরিয়ান ছাত্রের টেস্টে করোনা ধরা পড়লো। ছেলেটিও নাকি চিন-ফেরৎ সাম্প্রতিক কালে। তাহলে করোনা তো একেবারে ঘরের মধ্যেই। একটা ভয় ভয় অস্বস্তিতে শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছিল। সরকারী প্রশাসনও নড়ে চড়ে বসতে শুরু করল। শুনলাম স্কুলটি তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিছু ভাবার অবকাশ না দিয়ে পরের দিনই আবার একটি বৃদ্ধাবাসে। তারপরে একটি প্রি-স্কুলে। তারপরে আবার বাচ্চাদের ক্রেশে। করোনায় আক্রান্তর সংখ্যা নিঃশব্দে ধীর গতিতে বেড়েই চলেছে।

    চৌঠা মার্চ একই দিনে করোনা ১১ জন কে ধরে ফেলল। এটা কী করে সম্ভব? ভয় এবার মনে পাকাপাকি আসন গেঁড়ে বসতে শুরু করেছে। কর্তৃপক্ষের সর্বপ্রথম ঘোষণা হল, যারা বাইরে থেকে আসছে তাদের গৃহবন্দি করো। তার সাথে সবার বিনা দরকারে বাইরে বেরনো বন্ধ। সে কী! তবে তো জিনিষপত্র কিছু কিনে রাখা দরকার। অনেককিছু তো ঘরে নেই। দোকানে যেতে হবে। সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম রোজকার মত। সুপারমার্কেটের পাশ দিয়ে যাচ্ছি; এই সকাল সাতটাতেই বন্ধ গেটের বাইরে বেশ বড় রকমের জটলা। সকলের চোখে মুখে উত্তেজনা – যেন গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গেই জ্যা-মুক্ত তীরের মত ছুটে যেতে পারে। শঙ্কিত হয়ে সুপার মার্কেটে কাজ করা বন্ধুটিকে ফোন করি – ভেতরের খবর আর কী! আমি ও বাঙালি তো। একটু ভেতরের ব্যাপারে সব সময়েই উসখুস করা... যা শুনি তা’ আরও বিপজ্জনক। লোকে পাহাড় সমান উঁচু করছে ট্রলি ভর্তি জিনিস কিনে। আমিও কি কিনতে শুরু করব? কিন্তু আমার যদি শরীর খারাপ হয় – একে বয়স হয়েছে তার ওপর সব সময় টেনশন করার বাতিক। বন্ধুবান্ধব – ওই যারা একটু পরামর্শ দিতে পারে – সবাই নয় – তাদের ফোন করি। কিছু সুরাহা হয় না। সবাই বলে, কিনে রাখো না দু চার দিনের জন্য; আরে সে তো করোনা না থাকলেও করি। তা হলে – কিনো না; ব্যাজার হয়ে বন্ধুরা ফোন রাখে। ছেলে মেয়েরা বলে – তুমি তোমার মেডিক্যাল সেন্টারে বরং একটা ফোন করে দেখো একটা ফ্লু শট নিতে পার কি না। না পারলেও একটা বুকিং করে রাখো। যাতে সময় মত তোমাকে ডেকে নিতে পারে।

    প্রায় এক দশকের বেশী মত হ'ল অস্ট্রেলিয়াতে সবার ফ্লু ভ্যাক্সিন নেওয়া (সরকারী আর্থিক সহায়তায়) প্রায় বাধ্যতামুলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় মহামারীর মতই এখানে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু হতে শুরু করেছিলো তখন। যাই হোক, ফোন করলাম মেডিক্যাল সেন্টারে। অনেক রেকর্ডেড বার্তা পেরিয়ে জীবন্ত মানুষের গলার মত একজনের আওয়াজ শোনা গেলো।

    –এখনও তো সময় আসে নি ফ্লু শট নেবার। তোমার কি ফ্লু হবার মত কোন উপসর্গ...?
    –না না ওই আরকি, করোনার ভয়ে... আগে থেকে যদি...
    –তোমার কি গলা শুকিয়ে যায়? তোমার কি মাথা ব্যাথা... তোমার কাশি... তোমার কি জ্বর...

    ইত্যাদির উত্তরে না তো, না তো করে কোনরকমে একটা ডেট বুক করে ফোন নামালাম। ততক্ষণে আমার যেন মাথা ব্যাথা, গলা ব্যাথা - ওই সব উপসর্গগুলি হতে শুরু করছে। সুতরাং এক্ষুনি একটা প্যারাসিটামল দরকার। কিন্তু ওষুধের বাক্স ঘেঁটে যা পাওয়া গেলো সবই পুরনো তারিখের। সুতরাং ছুটলাম প্যারাসিটামল কিনতে ফার্মাসিতে। ফার্মাসিস্ট বললেন,

    –খুব বেশী কিন্তু স্টকে নেই। একটা দুটো প্যাকেট আছে। খুব ভাল সময়ে এসেছেন। লাকি আপনি। স্টক আবার রাতে আসবে। আরও বললেন হ্যান্ড স্যানিটাইসার আর টয়লেট পেপার-এরও সেই অবস্থা। দিতে পারব না।

    সুতরাং ছুটলাম পাশেই সুপার মার্কেট – সেখানে। দেখলাম উদ্দিষ্ট বস্তু গুলির কোন চিহ্ন মাত্র নেই। তাক বেবাক খালি। শুনলাম কাল আবার পাওয়া যাবে। তবে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে না এলে কিছু পাওয়া যাবে না। যাই হোক বাড়ি ফিরে এলাম খালি হাতে। মেয়ে যা হোক ব্যবস্থা করবে। রাতে টিভি তে দেখা গেলো টয়লেট পেপার নিয়ে হাতাহাতি মারামারি – যা কিনা সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ রমরম করে চলেছে। মানুষ কি সত্যি ভয় পেয়েছে? কে জানে? সুপার মার্কেটের বান্ধবীর মতে, এটা অনেকটাই মজা। তা হলে ঠিকই আছে। আশ্বস্ত হই।

    মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ। না, ব্যাপারটা মনে হচ্ছে ঠিক নেই। নতুন আক্রান্ত একদিনে ৪৯ জন। টিভিতে সকাল আটটা বাজতেই প্রাইম মিনিস্টার করোনা নিয়ে বলতে শুরু করেছেন আজকাল। মৃত্যু ও আক্রান্তর সংখ্যা, বিধিনিষেধ, সরকারি সুবিধা ও আর্থিক সাহায্য কতো দেবেন তার হিসাব। মারাও গেছেন কয়েকজন। তবে ডাবল ডিজিট হয় নি এখনো। যাঁরা আক্রান্ত, তাঁরা হয় বিদেশ থেকে ফিরেছেন বা তাঁদের কারো সংস্পর্শে এসেছেন। অতএব বিদেশ থেকে যাঁরা আসবেন ১৪ দিন গৃহবন্দি থাকবেন। বিদেশ ভ্রমণও বন্ধ। নরম সুরে বলছেন প্রাইম মিনিস্টার – স্কট মরিসন। এখনো তার মুড হালকা। এমনভাবে বলছেন যেন ভোটের আগে সরকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। মুখে মৃদু হাসি। বিরক্ত হই। লোকটা কি মানুষ নয়! যেখানে লোকের জীবন মরণের ব্যাপার!

    বান্ধবী কান্নাকাটি শুরু করেছে। সদ্য-বিবাহিত পুত্র ও পুত্রবধূ হানিমুন করতে গিয়েছিল ইতালি। এখন তারা ফিরবে কেমন করে? এসেও তাদের সেলফ-আইসোলেশন-এ থাকতে হবে। হ্যাঁ সেলফ আইসোলেশন – গৃহবন্দি – এই কথাটাই ঘুরছে এখন আকাশে বাতাসে। যাঁরাই এখন বিদেশ থেকে আসছে তাঁদের প্রতি এয়ারপোর্ট থেকেই কঠোর নির্দেশ – গৃহবন্দি থাকতে হবে। মিডিয়ার প্রশ্ন ছিল প্রাইম মিনিস্টার স্কট মরিসন – (স্কমো)-এর প্রতি – তারা কি নিজেদের বেডরুমে থাকবে সারাদিন পরিবারের অন্যদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে? হ্যাঁ – বলেছিল স্কমো। কিন্তু কে তাঁদের এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি নিয়ে আসবে? ক্যাব ডাকবে কি? যে নিয়ে আসবে এয়ার পোর্ট থেকে? তারও তো বিদেশবাসির ছোঁয়া লেগে গেলো – তাকেও কি গৃহবন্দি থাকতে হবে, কে তাদের শপিং করে দেবে – এরকম হাজারো প্রশ্নবাণে স্কমো ক্ষত-বিক্ষত; তবু হাসি মুখ। কারণ, এদেশে লিগ্যাল সিস্টেম খুব কড়া – তুমি এই বলেছিলে বা এই বলনি – বলে যখন তখন তুচ্ছ কারণে মামলা লড়ে যাচ্ছে সবাই। সুতরাং খুব ডিটেলে বলা ছাড়া উপায় নেই। যদিও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে।

    বিভ্রান্তি নেই শুধু আক্রান্ত সংখ্যার দ্রুত গতিতে বেড়ে যাবার। রোজ নিয়ম করে সে সংখ্যার ঊর্ধ্বগতি। বাড়ছে বাধানিষেধ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোন পার্টি ১০০ জনের বেশী হবে না। পাবলিক ইভেন্ট-এ ৫০০ জন। হই হই করে বান্ধবীর ফোন আসে – বুঝলি বিবাহবার্ষিকী বোধ হয় করতে পারব। নিমন্ত্রিতের সংখ্যা একটু কাটছাট করতে হবে আর কি। তা না হলে দেখ – হল ভাড়া হয়ে গেছে, ক্যাটারার, ফ্লোরিস্ট, হেয়ারড্রেসার সবই তো ঠিক। এখন যদি সব ক্যান্সেল করতে হতো কী কাণ্ড হতো? বল? শুনে অস্বস্তির মধ্যেও স্বস্তি হয়। কিন্তু বিধাতার তো ইচ্ছে নয় সেটা।

    এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে শুধু জিনিস কেনার ফটো আর ভিডিও আসছে। বাড়ির গ্যারাজে, তাকের মাথায়, লন্ড্রি বাস্কেটে আটা, ময়দা, পাস্তা, নুডলস, তেল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি সমস্ত রকমের শুকনো জিনিষ তো বটেই, ফ্রোজেন মাছ মাংসের পাহাড় তৈরি হচ্ছে ঘরের ভেতর। যেন ছোটখাটো এক দোকান। তবে সবাই যে করছে তা নয়। দোকানে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বা অন্য দূর-বিকল্প নিয়ে আসতে হয়েছে এমন মানুষও আছেন। এখানে অত্যবশ্যকীয় সব জিনিষের দোকানই খোলা। পেট্রোল পাম্প, গাড়ি সারাই, চুল কাটার সেলন সবই খোলা। সব চেয়ে বড় কথা লিকার-শপ এখানে রমরমিয়ে চলছে। এটি এখানে অত্যাবশকীয় পণ্য হিসাবেই ধরা হয়।

    কিন্তু টিভির খবরে চঞ্চল হয়ে উঠলাম দু’দিন পরেই; ১৫ মিনিটের গাড়ী-দূরত্বে, নমুনা পরীক্ষা করার অস্থায়ী ক্লিনিক খুলেছে। সেখানেই ৩০ জন আক্রান্ত। বলে কী? টিভি খুললাম। হ্যাঁ খবরে তাই বলছে। বিদেশীদের সংযোগ ছাড়াও করোনা হচ্ছে। বয়স্করা সাবধান। ঘরে থাকার চেষ্টা করুন – প্রাইম মিনিস্টার-এর অনুরোধ। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আক্রান্ত হয়েছেন। ফোন এলো কলকাতার বান্ধবীর মেয়ের। 'শ' (নাম পরিবর্তিত)। সে ইউনিভার্সিটি হস্টেলে থাকে এখানে।

    –মাসি অবস্থা ভাল না। কী করি বলত? ইউনি তো বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। আমি যে জবটা করি সেই রেস্তঁরাটা তো বন্ধের মুখে, কোন লোক খেতে আসে না। চাকরি না থাকলে মুশকিলে পড়ে যাব। রেন্ট কী ভাবে দেব?
    –আরে তুই আমার বাড়িতে চলে আয়? এখুনি।

    ওদিক থেকে কোন সাড়া পাই না।

    –হ্যালো হ্যালো... না সাড়া নেই। রেখে দিয়েছে।

    তবে 'ম' (নাম পরিবর্তিত)-রাও তো না খেয়ে মরবে। ওদেরও তো রেস্টুরেন্টেরই ব্যবসা। এ কী হোল?

    এরই মধ্যে হঠাৎ একটি কাণ্ড ঘটে গেলো। নিউ সাউথ ওয়েলসের পশ্চিমে সিডনী থেকে প্রায় ১৭৫ কিমি দূরে এক ছোট উপনগরীতে আমার একটি বাসগৃহ আছে। সেখানেও থাকা হয় সুযোগ সুবিধা মত। সেখানকার প্রতিবেশীর জরুরী ফোন। এখুনি সেখানে যেতে হবে সেখানে। এখুনি। বুঝলাম দুর্ভাগ্য সত্যি একা আসে না। সেখানে রওনা দিলাম সবাই। গাড়িতে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এখন পরিত্যাজ্য। পেট্রোল এর দাম দেখি অর্ধেক কমে গেছে।

    তখন মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের শুরুর দিক। নতুন আক্রান্তর সংখ্যা প্রায় ৫০ যোগ হয়েছে গাত ২৪ ঘণ্টায়। মোট সংখ্যা ৪৫৪। কাজকর্ম মিটে যাবার পরও থেকে গেলাম সেই ছোট শহরটিতে। কারণ এখানে লোকের ভীড় প্রায় নেই। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সুবিধে হবে। জিনিষপত্রও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেশীর মতে, চাইনিজরা সিডনী থেকে এসে বাস বোঝাই করে জিনিষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আবার সেই চাইনিজ! দোকানে গিয়ে দেখি চাল, ময়দা, রুটি, আদা, রসুন, কমলা, টয়লেট পেপার কিছুই নেই। বলল,

    –সকাল সাড়ে সাতটায় এলে পাবে। তখন বয়স্কদের সময়।
    –ও সময়ও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে? দেখি কী করি।

    সিডনি থেকে কিছু রসদ তো এনেছি। কিছু না হোক চাল আছে, নুন আছে। ফেসবুকে দেখছি এখানকার বাঙ্গালীরা একটি ভলানটিয়ারদের গ্রুপ বানিয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে গৃহবন্দীদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। শপিং করে বয়স্ক দের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া অনেকেই করছে। সেটা ভাল। বয়স্কদের বাইরে বেরন বন্ধ। তারা বিদেশী ছাত্রদেরও খাবার পৌঁছাচ্ছে। তবে বার, রেস্তঁরা, জিম, পার্লার, পাব সবই এখন বন্ধ মোটামুটি। কারণ সেখানে গিয়ে খাওয়ার উপায় নেই।

    টিভি খুলিনি আজ। বাগানে বসে। খেয়াল হয় বাগানের ঘাস প্রায় গোড়ালি ছাড়িয়েছে। ফোন করি চেনা সব সময়ের ঘাস কাটার লোককেই। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বলেন,

    –তুমি তো এই গত মাসেই হলিডে কাটিয়ে ফিরেছ। বাইরের দেশে গেছিলে। তোমার বাড়ি যাওয়া এখন নিরাপদ নয়। দেখছ না স্কমো বলছে টিভি তে। বাইরে গেছিল যারা তাদের ধারে কাছে না যেতে।

    এ বাবা! বলে কী! কী করে বোঝাই যে আমি ইতালিতে বা স্পেনে যাই নি। গেছিলাম ভারতে যেখানে কিছুই ছিল না তখন। তো অনেক কষ্টে রাজী করান গেলো এই বলে যে উনি যখন আসবেন তখন আমি ঘরে আটকে থাকব এবং টাকা দেব অনলাইনে। দেখলাম চুপ করে আছেন; বুঝলাম রাজী।

    –সী ইউ দেন অন মান ডে…

    বলে তাড়াতাড়ি রেখে দিলাম। বলা যায় না আবার যদি না করে বসেন। তবে এখানে দেখছি লোক আরও বেশী সাবধানী। দেখি আসেন কিনা।

    চোখে পড়ে দু-একজন বয়স্ক মানুষ মর্নিং টী নিয়ে বসেছেন রাস্তার দুধারে। সবার মুখে কিন্তু মাস্ক। সিডনীতে এটা কী শুরু হয়েছে কে জানে!

    এইসব চিন্তায় রাত কাটে। ঘুম হয় কি হয় না তাও বোঝার ক্ষমতা যেন নষ্ট হয়ে গেছে। উদ্গ্রীব হয়ে সকালে টিভির পাশে বসি। আজ এক চাঞ্চল্যকর খবর পাওয়া গেলো। ২৪ শে মার্চ করোনাতে একজন মারা গেছেন যিনি ‘রুবি প্রিন্সেস’ নামক জাহাজের নাকি যাত্রী ছিলেন। এই জাহাজটি ১৯ শে মার্চ সিডনী হারবারে নোঙ্গর করে ১১ দিনের জল ভ্রমণ শেষ করে নিউজিল্যান্ড হয়ে ফিরে আসে সিডনীতে। এই ভ্রমণকালে জাহাজেই অনেক যাত্রীর ফ্লু-র মত হয়। জাহাজে তাদের পরীক্ষা করা হয় ও নমুনা নিউ সাউথ ওয়েলসের সরকারী হেলথ অফিসে পাঠান হয়। সেই রিপোর্ট আসার আগেই নাকি সব যাত্রীদের জাহাজ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। জাহাজে প্রায় ২৭০০ জন যাত্রী। পরে সেই জাহাজ থেকে পাঠান নমুনার রিপোর্ট সরকার প্রকাশ করে পরের দিন ২০ শে মার্চ। রিপোর্ট এ জানা যায় জাহাজে ৪ জনের করোনা হয়েছিল। ততক্ষণে যাত্রীরা অস্ট্রেলিয়ার সবখানে এবং অনেকে ইউরোপ আমেরিকা বা অন্য দেশে চলে গেছেন। এ খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তারপর যাত্রীদের টেস্ট করা শুরু হয়। প্রাথমিক কয়েক’শ যাত্রীকে পরীক্ষা করে প্রায় ২০০ জন যাত্রীর করোনা ধরা পড়ে। পড়ে এ’ সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে - জাহাজের প্রায় ৭০০ জন আক্রান্ত।

    এ পর্যন্ত নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনীতেই প্রায় ৩৬৯ জন করোনার রোগী এবং করোনায় মৃতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন দেখা যায় এই রুবি প্রিন্সেস এর যাত্রী ছিল। সে কী! সিডনীতে! আমার সবাই যে সেখানে! ফোন করি। সবাই রেগে আগুন।

    এই রুবি প্রিন্সেস নিয়ে সে কী তুলকালাম সারাদেশে। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছে রাজ্যপুলিশ। প্রাইম মিনিস্টার বলে চলেছেন টিভিতে। তাঁর চোখের তলায় কালি। পোশাক অবিন্যস্ত। গলা বাষ্পরুদ্ধ। ২০ শে মার্চের পর রুবি প্রিন্সেস ঘটনার পর থেকে করোনা আক্রান্তদের দৈনিক নতুন সংখ্যা হঠাৎ করে বহুগুণ বেড়ে গেছে। ২১ শে মার্চ ২২৬, ২৪ শে মার্চ ৩৭০ থেকে সংখ্যাটি প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। আজ ২৮ শে মার্চ। গত ২৪ ঘণ্টায় মানে একদিনে আক্রান্তর সংখ্যা নতুন ৪৫৭ জন বেড়েছে। এখন পর্যন্ত মোট সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ছাড়িয়েছে। লোককে টেস্ট করাও হচ্ছে বেশী বেশী। তবে প্রতিদিন ন্যূনতম ৪৫০০ জনকে টেস্ট করার লক্ষ্য ছিল। এই লক্ষ্য পূরণ করা হচ্ছিল তো বটেই – পারলে তার চেয়ে বেশীও।

    প্রাইম মিনিস্টার বলে চলেছেন আমাদের ভেনটিলেটর রয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার। টেস্ট কিট সমস্যা নেই, নেই কোন মেডিক্যাল সরঞ্জামের অভাব। ১৩০ টা কোম্পানি তো আছেই। তাঁরা তৈরি করছেন। তাছাড়া বিকল্প সরঞ্জামেরও ব্যবস্থা হচ্ছে। মেলবোর্নের একজন ইঞ্জিনিয়ার তাঁর ৩ডি প্রিন্টার দিয়ে প্রস্থেটিক হাতের পাঞ্জা বানাতেন। তিনি এখন ফেসশিল্ড বানাচ্ছেন। পারসোনাল প্রটেকটিভ সরঞ্জামের সাময়িক অভাবে এই দিয়ে কাজ চালাতে পারবেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। তিনি একা নন। স্থানীয় জিন ডিসটিলারি হ্যান্ড সানিটাইসার বানাচ্ছেন, গাড়ির মেকানিক ভেন্টিলেটর এর নক্সা করে দেবেন। ডিফেন্স কর্মীরা যোগ দিচ্ছেন। ভয় পাবেন না। ঘর থেকে বেরবেন না। সমস্ত অফিসের কাজ ঘরে বসে করতে হবে। সমস্ত রকমের গ্যাদারিং যেখানে হয় ও হবার সম্ভাবনা - তা বন্ধ। দু’জনের বেশী কোথাও কাউকে দেখা গেলে শাস্তি। আর্থিক এবং জেল দুটোই হবে অবস্থা বুঝে। প্রাইম মিনিস্টারের সুর আর নরম নয় – বড্ড চড়া। হুমকি দিচ্ছেন যেন। তবে তিনি আর্থিক অনুদানের থলি উপুড় করে দিচ্ছেন। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অনুদান ঘোষণা করছেন তিনি।

    রুবি প্রিন্সেস কেচ্ছা প্রকাশিত হবার পর সিডনির বণ্ডাই বিচ বন্ধ বলে ঘোষণা হ'ল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এই নিষেধের মধ্যেই ভিড় প্রচুর এবং তার ভিডিও যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল তখন সরকারের কোন যুক্তি ছিল না আত্মপক্ষ সমর্থন করার। বোধহয় বলা হয়েছিল বাইরের কিছু দুষ্টু লোক এসব করেছে। কিন্তু যারাই করে থাকুক ঘটনাটা স্বস্তিকর নয়। তাই আসন্ন গুড ফ্রাইডের লং হলিডে উপলক্ষে এখানে ভিড় হতে পারে জেনে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র সৈকতে দুই মানুষ সমান লম্বা হরফে লেখা হোল ‘ঘরে থাকো’। কিন্তু চোরা না শোনে ধম্মের কাহিনি।

    সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, কোন স্কুল বন্ধ করার কথা সরকার বলছেন না। কেন? বলা হচ্ছে, তাতে করে যে অসংখ্য লোক কর্মহীন হবে তাতে দুর্দশা বাড়বে বৈ কমবে না। তা ছাড়া সরকার অফিস যাওয়াও তো অপশনাল করেছেন। সুতরাং যে বাড়িতে একা মা-বাবা আছেন তাঁরা অফিস করলে তাঁদের স্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়েরা ছুটির পর কোথায় থাকবে? বেকার দাদু দিদিমা ঠাকুরদা ঠাকুমা তো এদেশে নেই। সরকার তাই ডে-কেয়ার, মানে ক্রেশ বন্ধ করলেন না। উপরন্তু এ পরিষেবা ফ্রী বলে ঘোষণা করলেন। এক বান্ধবী ডে কেয়ারে কাজ করে। খবর দিল – ফ্রী পেয়ে মা-বাবাই নাকি ক্রেশে বাচ্চাকে রেখে বাড়িতেই বসে থাকছেন বাচ্চার ঝামেলা এড়াতে। অফিসেও যাচ্ছেন না। কী সুন্দর ব্যবস্থা! আবার এরকমও ঘটছে যে বাবা-মা বাড়িতে বসে কাজ করছেন আর বাচ্চা স্কুলে। স্কুলে যেতেই হবে; বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে করোনার ভয়ে কাঁটা আর প্রধানমন্ত্রীকে গাল দিচ্ছেন লাগাতার।

    করোনা আক্রান্ত ইতিমধ্যে চারহাজার ছাড়িয়ে গেছে। স্কুল চালু রইল না বেশীদিন; বন্ধ হ’ল। মানে অপশনাল হোল আর কী। যাঁর ইচ্ছে পাঠাবেন, যাঁর ইচ্ছে পাঠাবেন না। এই দেশে এই একটা দেখার মত জিনিস। সমস্ত পলিসিই লোকের ফিডব্যাক পেয়ে অবিলম্বে ত্রুটিমুক্ত করার একটা চেষ্টা আছে। খুশী হলুম। কারণ করোনা এখন আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ১৩ জন করোনাতে প্রাণ হারিয়েছেন দুদিন আগেই। এতদিন প্রাইম মিনিস্টার মৃত্যু নিয়ে কোন পরিসংখ্যান দেন নি। আজ দিলেন। তারপর মোক্ষম কথাটি বললেন এবার। যাঁরা এ দেশের স্থায়ী অধিবাসী নন তাঁরা নিজের দেশে ফিরে যান। তাঁর চোখে জল। মুখে জোর করে টেনে আনা হাসি।

    অবস্থা এবার তো আরও সঙ্গিন। এ দেশের অধিবাসী নন এরকম লোক তো এখানে হাজার হাজার। ছুটে যাই বারান্দায়। প্রতিবেশীর উদ্দেশ্যে। ওরা তো নিউজিল্যান্ডের লোক - এখানকার নাগরিক নন আবার স্থায়ী অধিবাসীও নন; অথচ এখানকার স্থায়ী অধিবাসীদের সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করেন। আছেনও অনেকে প্রায় সারাজীবন।। ওদের যদি এবার চলে যেতে হয় তো মুস্কিল। প্রতিবেশী কথা বলেন না। মন ভারাক্রান্ত তাঁর।

    বাকি রইল অধ্যাপক, শিক্ষক, ছাত্র, গবেষণাকারী আর হাজার হাজার ব্যাক-প্যাকার। এই ব্যাক-প্যাকাররা টুরিস্ট ভিসাতে অনেকদিনের জন্য আসেন। এদেশে কৃষিশিল্পে এঁদের অনেক অবদান। এঁরা বিভিন্ন মরসুমে কৃষকদের ফসল তোলা, ফল পাড়ার কাজটি করেন। ভীষণ দারিদ্র্যের মধ্যে থাকেন, নিজেদের মধ্যে ঘিঞ্জি এলাকায় – একজনের হলে ভীষণ বিপদ হবে। সুতরাং তাঁদের তো যেতেই হবে। আরও আছে কিছু ছেলেমেয়ে – যাদের মা-বাবা দুটি ভিন্ন দেশের নাগরিক – তারা নিজেরাও না ঘর কা – না ঘাট কা। তো অসংখ্য এই ধরনের অ-অধিবাসীরা এখন কী করবেন? ফ্লাইট তো বন্ধ হয়ে গেছে। জানা গেলো তারা নিজের দেশের এম্ব্যাসি বা ওই ধরণের কর্তাব্যাক্তির সাথে যোগাযোগ করে চার্টার্ড প্লেনের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু সে প্লেনের টিকিটের দাম তো অনেক বেশী। কিন্তু কিছু করার নেই। বাড়িতে তো ফিরতেই হবে। কিন্তু এই ব্যাক-প্যাকাররা কী করবে? তাদের কি ফেরা হবে? ঘরে?

    তবে মেয়ের ফোনে আরও সাঙ্ঘাতিক কথা শুনি। ওর সহকর্মীর স্ত্রী জার্মান। তাদের দুটি ছেলেমেয়েই জার্মানীতে হয়েছে। এই সহকর্মী নিজে অস্ট্রেলিয়ান। তারা এদেশে এসেছে সবে একবছর। স্ত্রী এখানে টুরিস্ট ভিসায় রয়েছে। তাকে এখন ফিরতে হবে। এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন বাচ্চা দুটিকে অস্ট্রেলিয়ান বাবার সন্তান বলে কিছুতেই প্লেনে উঠতে দিচ্ছিল না। বলছিল – না মাকে একাই ফিরতে হবে। শুনে হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শুনি অস্ট্রেলিয়ান যারা বাইরে আটকে আছেন তাদেরও এভাবে আনার ব্যবস্থা হচ্ছে। শুনি তারাও এসে বাড়িতে নয় – সরকারের ঠিক করে দেওয়া হোটেলে ১৪ দিন গৃহবন্দী থাকবেন।

    এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষ থেকে নতুন আক্রান্তর দৈনিক সংখ্যা কিছুটা হ'লেও সংখ্যা নামতে থাকে। টেস্টের সংখ্যা বাড়তে থাকা সত্বেও। মনে একটু আশার সঞ্চার হয়। ৫ই এপ্রিল মৃত্যু সংখ্যা ৩৫। কিন্তু দেখছি অসম্ভব এক বিরাট সংখ্যা আক্রান্ত – ৫৬৮৭ জন। বিধিনিষেধ কমেনি এক চুলও। তবে শপিংএ যেতে পারছি, ডাক্তারের কাছে দরকারে যাওয়া যাবে, চুল কাটাও চলবে। শুনলাম এরই মধ্যে এক সেলিব্রিটির বিয়ে হোল শুধু চারজন লোক এবং পুরোহিত নিয়ে। অন্ত্যেষ্টিতে দশজন যাবে শুধু। সোশ্যাল গ্যাদারিং হবে দু’জনকে নিয়ে। প্রাইম মিনিস্টার বললেন - সমস্ত সদস্য নিয়ে নিজের পরিবারকে একজন ধরা হবে এবং যোগ দিতে পারবে বাইরের একজন অতিথি। কে এখন এই অবস্থায় বাড়িতে আর একজন ডেকে গ্যাদারিং করবে! আরও দীর্ঘ তালিকা সরকারের। শুনতে শুনতে মাথা ব্যথা করতে থাকে। টিভিতে শুধু এক শব্দ ঘুরে ফিরে চলছে – করোনা – করোনা – করোনা...

    ১২ই এপ্রিল। আক্রান্ত ৬৩০০। মারা গেছেন ৫৯ জন। ১৬ই এপ্রিল - ৬৪৪৭ জন আক্রান্ত। এদের মধ্যে অর্ধেকই নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের - ২৮৭০ জন। বাকিটা পুরো দেশের হিসাব। কুইন্সল্যান্ডে ৯৯৮ জন, ভিক্টোরিয়াতে ১২৯১ আর পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতে ৫২৭ জন। তার মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনীর উত্তর ও দক্ষিণ পূর্ব এলাকাই সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত। সুতরাং সিডনী এখনও বিপদ মুক্ত নয়। আমার ছেলেমেয়ে-বন্ধুবান্ধব সবই এই দুটো দিকে। তারা এবং সমস্ত সিডনী তো রাগে ফুটছে এখন। রুবি জাহাজের এই কেলেঙ্কারী না হলে এটা এমন ভাবে ছড়াত না। নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার পুলিশের কাছ থেকে তদন্ত কমিশন নিজের স্পেশাল কমিটির হাতে নিয়ে নিয়েছেন। জনগনের রোষ প্রশমিত করতে, তাড়াতাড়ি তদন্ত শেষ করার তাগিদে। জাহাজের কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে।

    এই বিধিনিষেধের ধাক্কায় সমস্ত কাজকর্ম কলরব চুপ হয়ে গেলো। অস্ট্রেলিয়াতে বেকারের সংখ্যা এখন দুই মিলিয়ন। যা কিনা এখানকার ২০০৮ সালে যে আর্থিক সঙ্কট হয়েছিল তার চাইতে অনেক বেশী। সরকার আর্থিক অনুদান যতটা পারেন দেবেন রিসেশন ঠেকাতে। অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী। কোন মালিক ভাড়াটে উঠিয়ে দিতে পারবে না। কম সুদে ব্যাঙ্ক ধার দেবে মালিককে। ছ’মাসের আগে কোন ধার শোধ করতে হবে না। কোন ব্যবসা কর্মী ছাড়াতে পারবে না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হোল জব-কিপার ওয়েজ সাবসিডি স্কিম। যেখানে বিজনেস বন্ধ হয়ে গেলেও কর্মীরা কাজ থেকে ছাঁটাই হবেন না। সরকার প্রতি সপ্তাহে প্রতি কর্মীর জন্য $৭৫০ করে পাঠাবেন সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া বিজনেসের মালিককে। জানা গেল প্রায় সাড়ে-সাতলক্ষ মালিক এই টাকার জন্য আবেদন করেছেন সঙ্গে সঙ্গে। তার অর্থ সাড়ে-সাতলক্ষ ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। সুতরাং ব্যবসার মালিকরাও কর্মহীন হয়েছেন। তাঁদের জন্যও অনুদান রয়েছে $১০০০০ এর। এককালীন। খুব স্বস্তির কথা।

    কিন্তু আরও যে কত ব্যবসা বন্ধ হয়েছে তার তো হিসেব জানা যায় নি। আমার প্রতিবেশীর রেস্তঁরাটিও বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি অনুদান পাবেন না। কী সব ব্যাপারে নাকি তিনি কোয়ালিফাই করেন নি। ভাগ্যিস তাঁর স্ত্রীর কোম্পানিটি বন্ধ হয়নি। তিনি মাইনে পাচ্ছেন, না হলে যে কী হত – প্রতিবেশী কপালে হাত ছোঁয়ালেন। 'শ' সপ্তাহে একদিন কাজ করতো। একমাস আগে শুরু করেছিলো। ও কি পাবে জব-কিপার অনুদান? কে জানে? সব চেয়ে বড় কথা ও এখন কোথায়? এখানে? না ফিরে যেতে পেরেছে?

    তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এ-দেশেও সম্ভব নয়। বিকেলবেলা সেই খবরই এলো। সরকারী অনুদান প্রথমে সরাসরি ব্যাঙ্কে জমা পড়বে বলে ঘোষণা হয়েছিল। কিন্তু বহুসংখ্যক লোক একইসাথে সরকারী ওয়েবসাইটটি খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওয়েবসাইটটিতে গোলমাল শুরু হয়েছিল। এর ফলে সরাসরি অফিস থেকে টাকা তুলতে সবাই চলে এলো। দীর্ঘ লাইন। টিভিতে দেখা গেল সব গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় গেল রাস্তায় দু’জন লোকের মাঝে সরকারী নির্দিষ্ট ১.৫ মিটার দূরত্ব? দেখে শিউরে উঠলাম।

    টিভিতে এখন হালকা খবর কিছুটা। পথ দুর্ঘটনা কম, তাই হাসপাতালে ইমার্জেন্সি বিভাগ মোটামুটি চুপচাপ। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, ডিভোর্স-এর মামলা বেড়ে গেছে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে প্লেটোনিক প্রেমের ধারনাটা আবার ফিরে আসছে। অ্যাডেলেডের চিড়িয়াখানায় জন্তুরা আবার নাকি দর্শকদের অভাব বোধ করছেন। মীরক্যাটদের সামনে ছোট্ট গাড়ি রিমোট কন্ট্রোলে চালু রাখা হয়েছে। কিছু না নড়লে নাকি ওদের মন খারাপ হয়ে যায়। শিম্পাঞ্জী সারাদিন বাটনা বাটছে একটা বড় পাথরের ওপর ছোট পাথর দিয়ে। শব্দ করছে ইচ্ছা করে। এতো চুপচাপ তার ভাল লাগছে না। সিংহ সত্যি মহারাজা। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা নাকি প্লেনের শব্দ শুনতে না পেয়ে মন খারাপ করছে।

    আজ ১৯শে এপ্রিল। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ানদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। নতুন করে আক্রান্তর সংখ্যা যৎসামান্য। ১৬ই এপ্রিল ছিল ১১ জন। তবে ১৭ই এপ্রিল আবার বেড়ে ২৯ জন জন হল। প্রায় পাঁচহাজার মত প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। তবে ১৬ এবং ১৭ তারিখে কোন নতুন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল না। মারা গেছেন ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ৭১ জন, ৬৬১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন। এদিন কোন নতুন রোগী নেই প্রায় অধিকাংশ রাজ্যে। আমাদের আর্থিক অনুদান প্রায় $৩২২ বিলিয়নে পৌঁছেছে - প্রধানমন্ত্রী বল্লেন। তাঁর পোশাক ঠিকঠাক। মুখে তাজা ভাব। অনেকদিন পরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

    ছেলে বলল – খুব কম দেশেই এতো বিশাল আর্থিক অনুদান দিয়েছে। আর এমন কড়া হাতে লোককে ঘরে আটকাতে পেরেছ। নীচের গ্রাফ টা দেখো।



    যাদের হয়েছে তাদের সংখ্যা ১০০ থেকে পৌঁছে গেছে ৫০০০ হাজারে ২৫ দিনের মধ্যেই। কিন্তু তার ১০ দিন পরে অস্ট্রেলিয়াতে সংখ্যাটা হাজারের বেশী বাড়েনি। একই সময়ে কিন্তু ইউএস, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেইন, ব্রাজিল, অস্ট্রিয়া, চায়না, ইউকেতে আনেক বেশী সংখ্যক লোকের করোনা হয়েছে।

    হ্যাঁ তাই তো দেখছি – বলি আমি।

    ছেলে ফোন ছাড়ে। গ্রাফে ভারতের করোনা-আক্রান্তের ঊর্ধ্বমুখী রেখাটা কাঁটার মত ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে। ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে নিঝুম পুরীর মত হাজার হাজার শহর অঞ্চল। বন্ধ দোকান বাজার। দেশে প্রিয়জনের উদ্বিগ্ন মুখ। অস্ট্রেলিয়া করোনা আটকেছে কী দাম দিয়ে? ভারত কি পারবে তা? নিউ ইয়র্ক আর ভারতের বিপজ্জনক ভাবে বাড়তে থাকা সংখ্যা চোখে ভাসে। অশনিসঙ্কেতে কাটে আর একটা নিদ্রাহীন রাত।

    এখনই উচ্ছ্বসিত হবার কোন কারণ দেখছি না। সিঙ্গাপুর ও জাপানে করোনা চলে গিয়েও আবার ফিরে এসেছে। এর মধ্যেই সিডনী থেকে মেয়ের ফোন।

    –মা চলে আসছি তোমায় নিতে।

    আমি আঁতকে উঠি। সে কী করে হয়? সকালের খবরেই তো শুনলাম কোন বাধা-নিষেধই শিথিল করা হবে না। পুলিশ তো আটকে দেবে।

    –চিন্তা কোর না, আমার কাছে স্টেট গভমেনটের গেজেটের প্রিন্টআউট আছে। COVID-19 Restrictions on Gathering and Movement – Public Health Order – 2020. হাইলাইট করেছি শিডিউল ওয়ানের নয় নম্বর ধারা। ওখানে পরিষ্কার বলা আছে আমি বয়স্ক ভালনারেবল কাউকে ভিজিট করতে যেতে পারি। পুলিশ আটকালে দেখিয়ে দেব এটা।
    –সে কী রে! আমি তো ৭০+ নই, ক্রনিক কোন অসুখ নেই, আবরজিনিও নই ৫০ বছরের - তারাই তো ভালনারেবল বলে গেজেটে বলেছে।
    –হ্যাঁ আছেই তো তোমার একটা ক্রনিক অসুখ – ওই যে রাতদিন আমাদের নিয়ে চিন্তা কর।
    মেয়ের খুশীমাখা মুখখানি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

    ...ওদিকে টিভিতে - নিষেধ সত্বেও সমুদ্রে সাঁতার কাটতে নামার অপরাধে হাতে হাতকড়া পরাচ্ছে পুলিশ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৫ এপ্রিল ২০২০ | ২০৭৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ২৭ এপ্রিল ২০২০ ০০:০৫92721
  • খুবই রিপোর্টাজ ধাঁচের লেখা, প্রবাসে এই নিদানকালে এমন লেখা খুব সহজ কথা নয়। দেখেশুনে যতোটুকু বুঝেছি, অস্ট্রেলিয়ায় মৃত্যু ভীতির পর বোধহয় বাণিজ্যক ভীতিই প্রধান।

    আমার নিজের ভাগ্নে অয়ন কুইন্সল্যান্ডে থাকে। দাবানল ও করোনা পরিস্থিতিতে তার পোশাক বিক্রির বাণিজ্যিক শোরুমে লালবাতি জ্বলার উপক্রম। ক্রেতাশূন্য দোকানের সব কাপড় হ্রাসকৃতমূল্যে অনলাইনে বিক্রির উদ্যোগেও খুব সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে প্রতিমাসে দোকানের বিপুল পরিমান ভাড়া, বিদ্যুত, পানি, গ্যাস ইত্যাদি বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে।

    এরকম কতো ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, উদ্যোক্তা না জানি সেখানে সর্বশান্ত হবেন।

    আর এদেশে আমাদের করোনায় মরার আগে ভাতে না মরার আপ্রাণ চেষ্টা!

    কারো জুতো নাই, আর কারো পা-ই নাই!

    শ্বাশতী, আরো লিখুন। স্বুস্থ থাকুন, সকলে ভাল থাকুন।  

  • শাশ্বতী | 108.162.250.52 | ২৭ এপ্রিল ২০২০ ০৬:৩০92731
  • ঠিক ই বলেছেন । "কারো জুতা নাই ,কারো পা-ই নাই !" আর কারো প্রাণটাই  নাই যে পা টা টানবে। শুধু আছে নাই  আর নাই। 

    আপনার মন্ত্যব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ বিপ্লব। 

  • সঞ্জয় চক্রবর্তী | 120.17.98.65 | ১৫ আগস্ট ২০২০ ০৭:৫১96261
  • অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরন, নিজে সিডনি নিবাসী বলেই আপনার লেখার সাথে একাত্ম হচ্ছি ..

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন