এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • বর্ণসংকর

    বিপুল দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৪ এপ্রিল ২০২০ | ১৮২৮ বার পঠিত
  • এক

    এতটা দৌড়ে এসে কুসুমকুমারী হাঁপাচ্ছিল। এত সকালে রায়বাগানে লোক চলাচলের কথা নয়। সুতরাং, আচমকা সামনে মানুষ দেখে সে আঁতকে ওঠেনি। তাছাড়া, ভোরবেলায় রায়বাগানে ব্যাটাছেলেরা আসে না। সবাই জানে এ রকম ব্রাহ্মমুহূর্তে মেয়েছেলেরা রায়বাগানেই যায়। কেষ্টপুরের আদ্যিকালের নিয়ম। কুসুমকুমারীর ঠাকুমাও যেত। রায়বংশ ফৌত হওয়ার পর বাগানে আসা যাওয়া, ওঠাবসা মেয়েরা কবে, কেমন করে কায়েম করেছে— তারও একটা গল্প আছে।
    গ্রামেগঞ্জে কত যে গল্প থাকে। নদীর মত গল্পগুলো গড়াতে থাকে— পারের লোকজন জানে। তারা কেউ আঁজলা ভরে, কেউ ঘট ভরে, কেউ কলস ভরে জলসই করে। চায়ের দোকানে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে, মাঠে নিড়ানির সময়, হয়তো বা রমণকালেও জলের মত গল্পগুলো বা গল্পের মত জল সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রক্তের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। তারপর ভেতরে ভেতরে সাজানোগোছানো চলতে থাকে। মানুষের অভ্যাস এ রকমই। হাতপায়ের মত মাথার ভেতরে যে আঙুলগুলো থাকে, সবসময় কিছু একটা আঁকড়ে ধরে সেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুন কিছু বানাতে চায়। জলের মত গল্প বা গল্পের মত জল নিয়ে মনোবাসনার রাংতা দিয়ে ঝলমলে করে তোলে।
    গল্পের নদী গড়াতে গড়াতে অনেকদূরের জনপদে পৌঁছলে গল্পের গায়ে নতুন মাটি, নতুন রং লাগে। কোনও একজন কথক হাটচালায় বসে তার ঝুলি খুলে কেচ্ছা শুরু করলে চারপাশে লোকজন জমাট হতে শুরু করে। কথক বলে যে, অশ্বিনী রায়ের খাস মাদি কুকুরের কেমন করে যেন গর্ভসঞ্চার হয়েছিল। হওয়ার কথা নয়। সে ছিল ভিনদেশি কুকুর। তার গায়ে সাদা ঝালরের মত বড় বড় লোম। বিফের অভাবে তার জন্য মাটনের ব্যবস্থা হয়েছিল। অবশ্য, সঙ্গদোষে হতে পারে, শেষের দিকে সে অম্বুবাচীর দিন কিচ্ছু মুখে নিত না। ভোগের খিচুড়ি বড় ভালবাসত।
    নীলকুঠির সাহেব ঘোড়ায় চড়ার সময় অশ্বিনী রায় রেকাবের সামনে হাঁটুমুড়ে বসত। প্রত্যহ নয়, তা হলে রায়মশাইয়ের শিড়দাঁড়া একদিন পট করে ভেঙে যেত। সাহেব আসতেন মাসে এক আধবার। তাতেই অশ্বিনী রায় তারপর তিনচার দিন বিছানায় কেতরে পড়ে থাকতেন। মালীর বউ তারামণি আর খোট্টা জগার কচি মেয়েটা তার কোমরে পিঠে দু’দিন ধরে মখদুম পিরের ফুঁ-দেওয়া তেল মালিশ করে দিত। তখন সেই ঘরে কারও ঢোকা বারণ ছিল। বাইরের লোকের সামনে তেল কাজ করবে না। পিরের বারণ ছিল। তবে তার ব্যথা মরত।
    যারা তাকে শেষ বয়সে দেখেছে, তারা জানে তখন তিনি কেমন করে হাঁটতেন। বয়স হলে মানুষ কুঁজো হয়ে যায়। নুয়ে পড়ে। লাঠি নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। কিন্তু লোকজন অবাক হয়ে দেখত রায়মশায়ের শিরদাঁড়া উলটো দিকে বেঁকে গেছে। থলথলে ভুঁড়িটা অনেকটাই সামনে ছড়ানো। মাথা পেছনে হেলে পড়ার দরুণ সামনের সুন্দর দৃশ্যাবলি দেখতে বেশ অসুবিধা হত তার। এ বাবদ তিনি শেষ জীবনে সারাক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে থাকতেন। স্বামীর এ রকম মনোবেদনা দেখে তার খাস বউ ভুবনসুন্দরী খোট্টা জগাকে হুকুম দিয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়া তার মেয়েকে কিছুদিনের জন্য এখানে এনে রাখার জন্য। তারামণির বয়স হয়েছে, শরীর ঢিলেঢালা। খোট্টা জগার মেয়েটাকে বাবুর বড় পছন্দ ছিল। পরের দিকে তারামণিকে সরিয়ে সে একাই মালিশ দিত। বাবু বড় আরাম পেতেন। ব্যথা মরে যেত। মখদুম পির তো যে সে পির নয়। সবাই জানে অমাবস্যার রাতে সে রায়বাগানের বড় তেঁতুলগাছের মগডাল থেকে উড়ান দেয়। পলক ফেলতে না ফেলতে কেষ্টপুর ছাড়িয়ে সেই ঘোষালবাগানের মসজিদের পাশে শিরীষ গাছের মাথায়। তার ফুঁ- দেওয়া তেলে বাজা বউএর পর্যন্ত পেট বাঁধে। এ তো তুচ্ছ পিঠকোমরের ব্যথা।
    সাহেব দেশে ফিরে যাওয়ার সময় অশ্বিনী রায়কে জটিল একটা ব্যারাম আর ফুটফুটে একটা সাদা কুকুরের বাচ্চা দিয়ে যান। ব্যারামটা তার মলমূত্র ত্যাগের অনিয়ন্ত্রিত বেগ সংক্রান্ত। অশ্বিনী রায় নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ, যেদিনই পিঠকোমরের ওপর সবুট দুমনি ওজন নিতে হত, ব্যথা তো হতই, তারপর দু’চারদিন হাগামোতার নিয়ম একটু উলটোপালটা হয়ে যেত। গরম রসুনতেলের মালিশে ব্যথা মরত। সবাই অবশ্য জানত পিরের ফুঁ দেওয়া জলের ঘটি নিয়ে তারামণি আর খোট্টাজগার কচি মেয়ে রাধিকা তার সেবা করছে। তারামণির গতরে মাংস ছিল বেশি। একটু ঢিলেঢালা গোছের। কিন্তু মাগি মালিশের কায়দা জানত ভালো। রাধিকা তার কোমরের কষি খুলে হি হি করে হাসত শুধু। কিন্তু তার হাতের আঙুল ছিল যেন হলুদমাখানো ময়দা দিয়ে গড়া শালুকের নাল। শরীর যেন ছিপছিপে পানসি নৌকো। তারার মত ভারি বজরা নয়।
    রসুনতেল লেগে শাড়ি দাগি হয়ে যাবে, উপরন্তু ঘরবারের লোকজন জানতে পারবে পিরের জলে রসুনতেলের গন্ধ। সে সব দিকে অশ্বিনী রায়ের দৃষ্টি ছিল। নায়েবি বুদ্ধি। তিনি ওদের দু’জনকেই বলে দিয়েছিলেন এ ঘরে এসে প্রথমেই শাড়ি ছেড়ে গামছা পরে নিতে। ওরা তাই করত। তারামণির ভাতার হারুমালি পেয়েছিল দু’বিঘে, খোট্টাজগা তিন বিঘে। এ বাবদ হারুমালি একদিন তারামণিকে বেদম মার মেরেছিল। এক বিঘা কি কম কথা। তারা নিশ্চয় কাজে ফাঁকি দিয়েছে।
    কুকুর উপহার দিয়ে সাহেব বলেছিলেন এ কুকুরের মা বাপ দু’জনই খানদানি বংশের। বাসন্তীপুরের কুঠির ম্যাকার্থির মদ্দা কুকুর যদি পাওয়া যায়, তবেই যেন সে পাল খাওয়ানোর কথা ভাবে। দেশি কুকুর যেন কোনও মতেই ওর ওপরে চড়তে না পারে। খানদানের ইজ্জত যদি না থাকে, তবে আর কী থাকল। মশা যেন না কামড়ায়। মশা কামড়ালে কেমন যেন পাগল পাগল হয়ে যায়। বিফ না হলেও পাঁঠার মাংস ব্যবস্থা যেন করা হয়। সজনার ডাঁটা ভালোবাসে।
    হুবহু রায়মশাই-এর মত ঝালরদেওয়া মশারির ভেতরে মানকুমারীর শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার গতজন্মের নাম ছিল টিপসি। কিন্তু কোনও অনুষ্ঠান ছাড়াই অশ্বিনী রায় তার নাম দিয়েছিলেন মানকুমারী। প্রথম কয়েকদিন তাকে মানু বলে ডাকলে সে কোনও উত্তর দিত না। ক্রমে সে বুঝতে পারে তার নতুন নাম মানু। তখন সে তার আগুরিপাড়ার ফুলঝাড়ুর মত লেজ নাড়াত। অশ্বিনী রায় তাকে সিট, রান, গো – এ সবের বদলে খাস বাংলায় শিখিয়েছিলেন বস, দৌড়ো মানু, যা যা। রেগে গেলে বলতেন হারামজাদি। খানদানি কুকুর। উন্নত জাতের। দ্রুত সব শিখে নিয়েছিল। রায়মশাই একদিন অবাক হয়ে দেখলেন মানকুমারী জন্মাষ্টমীর ভোগের খিচুড়ি খাচ্ছে। পরে সে পোষড়ার পুলি এবং কাসুন্দিমাখা শাকভাত খেত।
    বছর দুই বাদে ভাদ্র মাসের কোনও এক ঝিরঝিরে বৃষ্টির দুপুরে রায়মশাই তার খাস বউ নিয়ে বিছানায় শুয়ে খুনসুটি করছিলেন। তুমি রাই, আমি মাধব গোছের খেলা চলছিল। দুপুরে আজ রাঁধুনি বড় চমৎকার একটা খিচুড়ি রেঁধেছিল। বেশ গরম খেলছিল তার শরীরে। কর্তব্যকর্মে উদ্যোগ নিলে গিন্নি বললেন মানুটাকে দেখলে কষ্ট হয়। ওর এখন একবার ছেলে কুকুরের কাছে নেওয়া দরকার। কাল দুপুরেই দোতলার বারান্দা থেকে পথের দুমুখো কুকুরগুলো দেখছিল। কেমন যেন আনচান করছিল। বয়স্থা কুকুর, ওসব দেখলে মানুষই ঠিক থাকতে পারে না, বেচারা।
    রায়মশাই প্রথমে দুমুখো কুকুর ব্যাপারটা ধরতে পারেন নি। শেষে বুঝতে পেরে খ্যা খ্যা করে অনেকক্ষণ হাসলেন। তা ঠিক, লুকিয়ে দেখতে তারও কি ভালো লাগে না। কিন্তু পরে বড় কষ্ট। কেন যে ও রকম হয়। এ বাবদ কী যেন একটা গল্প মহাভারতে আছে। দ্রৌপদীর ঘরে কোনও এক পান্ডব কর্তব্যকর্মে ঢুকলে বাইরে তার চর্মপাদুকা দেখে আর সবাই বুঝতে পারত ভেতরে কোনও এক ভাই বসেছে। এক হঠকারী কুকুর সে চপ্পল মুখে নিয়ে সরিয়ে ফেললে যুধিষ্ঠির ঘর ফাঁকা ভেবে ঢুকে পড়ে ... ছি ছি ছি। যুধিষ্ঠিরের অভিশাপেই ওরা নাকি ও রকম কষ্ট পায় ওরা। মহাভারতে যখন লেখা আছে, হতেই পারে।
    মানকুমারীকে সারাক্ষণ বেঁধে রাখা হয়। তার বাড়ির হাতার ভেতরেই অনেক কুকুরবেড়াল রয়েছে। ছেড়ে দিলে দেশি কুকুরগুলো মেম-কুকুর দেখে পাগল হয়ে যাবে। রায়মশাইকে একা দোষ দিয়ে তো লাভ নেই, সবাই মুখ বদলাতে চায়। মানকুমারীর ধবধবে রং, চামরের মত বাহারি লেজ, সুন্দর মুখ – দেশিগুলো তার পেছনে কাতারে দৌড়বে। কিন্তু সাহেব যে পইপই করে বলে দিয়েছে ওর একটা আলাদা বংশগরিমা আছে। কুলরক্ষা যেন হয়। হেঁজিপেঁজি যেন ওর ওপর না ওঠে। টিপসি যদি খুব বেশি মনমরা হয়ে থাকে, মাটনে অরুচি দেখায়, বাসন্তীপুরের কুঠিতে ম্যাকার্থির কাছে একবার যেন নিয়ে যাওয়া হয়। সেটা একই জাতের মদ্দা। গর্মিও কমবে, জাতরক্ষাও হবে।
    কিন্তু সে গুড়ে বালি। ম্যাকার্থির কুকুরকে তার দেশি আর্দালি শিকলিতে বেঁধে কুঠির হাতা ছাড়িয়ে আমবাগানের দিকে চরাতে নিয়েছিল। বাগানে একটা দেশি কুকুর দেখে কুকুর আর্দালির হাত ছুটে যায়। সেদিকে প্রবল আহ্লাদে দৌড়ে গিয়ে তার সামনে পেছনে শোঁকাশুঁকি করে। আর্দালি বিশু ধরতে গেলে সে এমন ভাবে দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে যে, বিশু বোঝে কুকুরের ভয়ানক গর্মি লেগেছে। এখন তাকে ধরতে গেলে বিশুকে ছিঁড়ে খাবে। স্বয়ং সাহেব এলেও তাকে সামলাতে পারবে না।
    বিশু পরে তার জবানিতে বলে যে, দেশিটা মাদি ছিল। দেশি হলেও তার গড়ন ছিল বড়সড়। সে ক্রমে ক্রমে আমবাগানের আরও ভেতরে, গভীর জঙ্গলের ভেতরে পুরনো যে ভাঙা কুঠি আছে, সেদিকে এগোচ্ছিল। সলোমনও নিশি-পাওয়ার মত সব ভুলে তার পেছন পেছন জঙ্গলে ঢুকে পড়ছিল। বিশু অনেকবার তাকে ডেকেছে। কাম কাম বলেছে। মিট দেবে বলেছে। সলোমনের কোনও দিকে হুঁশ ছিল না। মাদিটার পেছনে সে এক সময় অদৃশ্য হয়ে যায়। শিকলসহ। ঘন্টাখানেক বাদে বিশু অনেক সাহস নিয়ে একটু একটু করে ভাঙা কুঠির দিকে গিয়েছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। বিশু একটা উঁচু আমগাছের মগডালে উঠে দৃশ্য দেখে তাজ্জব হয়ে যায়। ভাঙা নীলকুঠির সামনে, পেছনে, মাঝে বেশুমার দেশি কুকুর। বিশু মায়ের দিব্যি গেলে বলতে পারে সব ক’টাই মাদি। এ তল্লাটে এত কুকুর কোথায় ছিল, কে জানে। বাসন্তীপুরে এমন তাগড়াই, ডাগর মাদি কুকুর কোথা থেকে এল! বড় তাজ্জব ব্যাপার।
    যেন রাসলীলা। ভাঙা কুঠির চত্বরে সলোমন বসে আছে। গলার শিকলি সামান্য ঝিকমিক করে। তাকে ঘিরে বসে আছে মাদিকুকুরের দল। পাহারাদারের মত একদল কুঠির চারপাশে টহল দিয়ে ফিরছিল। বিশু পাতার আড়ালে ছিল। তাকে দেখতে পায়নি ওরা। ইলশেগুঁড়ির মত বৃষ্টি শুরু হলে কুকুরগুলো আকাশের দিকে মুখ তুলে ডেকে উঠেছিল। খুব বড়সড়, বেশ সোমত্থ একটা মাদি সাহেবের কুকুরের সামনে এসে শুয়ে পড়েছিল। ঢং করছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, তার ইচ্ছে সলোমন তার ওপরে উঠুক। বিলাতি কুকুরটা উঠে দাঁড়িয়েছিল। শিকলসহ দেশি মাদিটার ওপরে উঠেছিল। বিশু বুঝতে পেরেছিল সলোমন এখন ফিরবে না। আর সে যদি ওই আসরে এখন সাহেবের কুকুরকে ফিরিয়ে আনতে যায়, তাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে কুকুরগুলো। দেশি ডাগর ডোগর মাদিগুলো ভালো জাতের, পুরুষ্ট বীজ নিতে চাইছে। সলোমনের চেহারা তো বাঘের মত। ঘেউ দিলে মনে হয় মেঘের ডাক।
    বাসন্তীপুরের কুঠিতে ফিরে ম্যাকার্থি সাহেবকে সুরতহাল জানিয়েছিল বিশু। সাহেব বন্দুক বের করে বিশুকে বলেছিল – ইউ, সান অফ আ বিচ। মাদার-ফাকার। সাহেবকে নিয়ে সন্ধেবেলায় জঙ্গলের ভেতর পুরনো কুঠিতে আবার তাকে যেতে হয়েছিল। দূর থেকে দেখিয়ে দিয়েছিল সলোমনকে। একটা বড় মাপের দেশি মাদির সঙ্গে সলোমন আটকে রয়েছে। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে মনে হয় দুমুখো কুকুর।
    ফায়ার করার পর সাহেব টুপি খুলে রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছেছিল। বিশুরও কান্না পাচ্ছিল। সাহেবের হাতের টিপ বড় চমৎকার। বন্দুকের শব্দে মাদিটা ভয় পেয়ে পালাতে চাইছিল, কিন্তু গেরোয় আটকে থাকার জন্য পারছিল না। কষ্ট পাচ্ছিল। বিশু ভেবেছিল সাহেবকে বলবে মাদিটাকেও গুলি মারতে। মনে হয় ওটাই সলোমনকে ফুঁসলেছে। তাছাড়া, ওটা কষ্টও পাচ্ছিল। খারাপ লাগছিল বিশুর।

    পরে যখন বিশু কুঠির মলনদার, বামুনপাড়া এবং পাশের কৈবর্ত চাষিদের কাছে গোটা ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করল, সে কয়েক হাজার কুকুরের কথা বলত। সে আরও বলত যে মাদিগুলো সব ছিল যুবতী আর চমৎকার ছিল তাদের গড়ন। সলোমন যার ওপর চড়েছিল, সেটা তো প্রায় একটা ছোটখাটো ঘোড়ার সমান উঁচু ছিল।
    বড় মনোহর ছিল বিশুর বলার ভঙ্গি। প্রায় কথকঠাকুরের কায়দায় সে পুরো গল্পটা বলে যেত। ক্রমে তার চারপাশে একটা গোল বৃত্ত তৈরি হলে বিশুর মনে হত সে মাটির থেকে অনেকটা উঁচুতে আছে। বৃত্তটা তাকে ওপরে তুলে ধরেছে। তার ঘাড়ে রোঁয়া, দু’কাঁধে যেন ডানা গজাচ্ছে।
    এই গল্প নিয়ে বিশু সময় পেলে অনেক দূরের কুঠিতে যাওয়া শুরু করেছিল। সে টের পেত লোকজন সমস্ত শরীর দিয়ে গল্পটা শুষে নিচ্ছে। শরীরে লোমের গোড়ায় যে ছিদ্র থাকে, সেই ছিদ্র দিয়ে বিশুর কথাগুলো সবার শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। দেশি মাদির সঙ্গে সাহেবের কুকুরের ফষ্টিনষ্টির ব্যাপারে প্রথমে তারা নিজেদের ভেতরে খুব ঠারে কথা বলত। তারা চাইত ব্যাপারটা বিশু আরও গুছিয়ে বলুক। তা বিশু বলত। কয়েকটা আসরের পরই বিশু বুঝে নিয়েছিল লোকজন কেমন করে সুখ পেতে চায়। শুনতে শুনতে ওরা যেন স্পষ্ট দেখতে পায় কুকুরের মত একটা সাহেবমানুষ বড়সড় দেশি এক মানুষকুকুরের সঙ্গে দু’মুখো মানুষ হয়ে আছে। কিন্তু শেষের দিকে ওরা খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়ত। বিশুরও কেমন যেন গলাটা ধরে আসত। বিশু শিখে নিয়েছিল কেমন করে সুতো ছড়িয়ে দিতে হয়। বাতাসে দোল-খাওয়া সেই সুতো ধরে সবাই তার মনের মত নক্‌শা তৈরি করে। ক্রমে সে একজন চতুর কথক হয়ে উঠছিল।
    সেবাস্টিয়ানের শাকরেদ কুতুব শুধু বলেছিল সাহেব বড় বেওকুফের মত কাজ করেছে। বড় আহাম্মকি হয়েছে। পরে মারলেই হত। অতগুলো মাদিকুকুরের অভিশাপ লাগবে সাহেবের মাথার ওপর।

    সলোমনের রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল পুরনো নীলকুঠির চত্বরজুড়ে। চিৎকার করে কাঁদছিল সলোমন। অতবড় বাঘের মত কুকুর, মরতে একটু সময় তো লাগবেই। মর মর সলোমনকে নিয়ে মাদিটা যখন ঘষটে ঘষটে পালাচ্ছে, পুরনো নীলকুঠির চত্বরজুড়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ছিল। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল। শেষে এক ঝটকায় আলাদা হয়ে গেল ওরা।
    বন্দুকের দিকে একবার তাকিয়েই বেশুমার মাদিকুকুরের দল নীলকুঠির হাতা ছাড়িয়ে আরও গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গিয়েছিল। তখন পশ্চিমে একটা উজ্জ্বল তারা উঠেছে। জঙ্গলের ওদিক থেকে অনেক কুকুরের কান্না শোনা যাচ্ছে। কোনও কোনও চাঁদনি রাতে ওরা সবাই মিলে গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে এভাবে ডাকে। কুডাক দিয়েছিল বিশুর বুকের ভেতর। নিশ্চয় সবগুলো মাদি একসঙ্গে কাঁদছে। কুকুরের কান্না তো ভালো নয়। কতকিছু খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে। মড়ক লাগতে পারে। খাল, বিল, নদী, পুষ্করিণীর জল রাতারাতি শুকিয়ে যেতে পারে। কোথাও জল থাকবে না, আকাশ থেকে শুধু আগুন ঢালবে সূর্য। পাতা ভেজানোর চৌবাচ্চায় জল শুকিয়ে যাবে, কুঠির চারপাশ জুড়ে যত আছে সাহেবের পত্তনির খেত, সব গাছের পাতায় পোকা ধরবে। কুকুরের কান্নার পেছনে থাকে শনির দৃষ্টি। কাজটা সাহেব বোধহয় গোক্ষুরি করল।
    বাসন্তীপুরের কুঠিতে ফিরে ম্যাকার্থি সাহেব মদের বোতল খুলে বিশুর মা এবং বোনকে বিচিত্র উপায়ে গর্ভবতী করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, স্কটিশ ভাষায় সেই আন্তরিক উচ্চারণ বিশু কিছুই বোঝেনি। সে দৌড়ে দৌড়ে সোডা আনছিল। কুক আবদুল্লাকে বলছিল গরম পাই দিতে। খুব কেঁদেছিল সাহেব।

    অশ্বিনী রায় খবর পেলেন ম্যাকার্থির ডগ আর নেই। তার মানুবিচের এখন আর কোনও ভরসা রইল না। মানকুমারীর জন্য তার এক রকম কষ্ট হচ্ছিল। এক একসময় তার প্রবল ইচ্ছে হত মানুর শেকল খুলে দিতে। যা মানু, ঘুরে আয়। আমি চোখ বুজে আছি – এ রকম ভাবতেন। তিনি নিজে যখন এদিক সেদিক চরে বেড়াতেন, মানকুমারীর কথা মনে পড়লে মেজাজটা বিগড়ে যেত। এক তো খাসবউ ভুবনের সঙ্গে দেখা হলেই সে মানুর কথা তুলত। বয়স্থা কুকুরকে এভাবে শিকলিতে বেঁধে রেখে কষ্ট দেওয়ায় পাপের বোঝা পরিপূর্ণ হচ্ছে। তার শরীরের তো একটা ঠান্ডাগর্মির ব্যাপার আছে। দ্বিতীয়ত, উপায়টা কী। সাহেব পইপই করে বলে দিয়েছে বিলাতির ওপর যেন বিলাতিই ওঠে। এসব ব্যাপারে সাহেবদের খুবই কড়াকড়ি, মানামানি আছে। জাতধর্ম, কুলধর্ম আছে বলেই সাহেবদের এত রবরবা। বেজাত দিয়ে গুয়ের ভান্ড বওয়ানো চলে, খাটি রক্ত ছাড়া দেশশাসন করা যায় না।
    মানকুমারীকে ঘরে আনার পর ভুবনসুন্দরী প্রথমে খুব একচোট তম্বি করেছিলেন, কিন্তু রায়মশাই বললেন যে সাহেব দেশে ফিরে যাচ্ছে, তাকে এটা বকশিস দিয়ে গেছে। ভুবনসুন্দরী ভালো করে কুকুরটা দেখলেন। মন্দ নয়। ধীরে ধীরে কুকুর তারই বেশি ন্যাওটা হয়ে পড়ল। এমনকী, দু’একদিন শিকলি হাতে নিয়ে বাগানের ভেতর ঘুরিয়েও এনেছেন। কুকুরের হাগামোতা, খাওয়াস্নান দেখভাল করত পতিতপাবন। তাকে বলে দিয়েছিলেন রাধামাধবের মন্দিরের ওদিকটায় যেন না নেয়।
    দেশিগুলোর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রায়মশাই প্রথমেই হুকুম দিলেন তল্লাটের সব মদ্দা কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে নদী পার করে চ্যাঙ্গামারিতে পাঠিয়ে দেবার জন্য। বেয়াদবগুলোকে ধরে ধরে একটা খোয়াড়ে যেন আটকে রাখা হয়। তার মাদি কুকুরের সঙ্গে মুখ শোঁকাশুকি বন্ধ করতে না পারলে সাহেবের সঙ্গে বড় বেইমানি করা হবে। প্রথম চোটে বেশ কিছু মদ্দা পার করা হল। গোটা দশেক খোয়াড়ে আটকা পড়ল। তারপর অন্য যে মদ্দাগুলো বাকি রইল, দেখা গেল তারা বড়ই চতুর। কুকুর-তাড়ানো দলের লোকজনদের তারা চিনে ফেলেছে। দূর থেকে দেখলেই ফস করে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ছে। সংখ্যায় তারা কম নয়। তা ছাড়া, খেদানো মদ্দাগুলো কিছু কিছু এপারে, সম্ভবত মাদিগুলোর জন্যই ফিরে আসতে শুরু করেছিল। পূর্ণিমায় গভীর রাতে তারা সবাই মিলে সুর তুলে ডাকতে শুরু করলে রায়মশাই টের পেলেন একা মানকুমারীর জন্য তল্লাটের তাবৎ কুকুর তাড়িয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না। নদী কেন, সমুদ্র হলেও হারামজাদাগুলো ঠিক চলে আসবে। এ বড় কঠিন টান। তিনি নিজেই তো কতবার রাতবিরেতে পালকি সাজাতে বলেছেন। ভুবনকে বিছানায় একা ফেলে কুঠিতে তার খাসকামরায় চলে গেছেন। জনার্দন খবর পাঠিয়েছে নতুন পক্ষীর। তিনি কানে তুলো গুঁজে বেরিয়ে পড়েছেন। জনার্দন তো রায়মশাইএর পছন্দ জানে। আঠারোর ওপরে কোনও দিন ওঠেনি।
    বুঝতে পারছিলেন এ ভাবে মানকুমারীর জাতধর্ম রক্ষা করা যাবে না। বরং তার এ বাড়ির সীমানাসরহদ্দ চৌকশ করে আগল দিয়ে রাখা অনেক সহজ। কেষ্টপুর কুকুরশূন্য করার চেয়ে নিজের ঘর সামলে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া, মানু তো বলতে গেলে চোপহর শিকলিতে বাঁধাই থাকে। সন্ধেবেলা পতিতপাবন তাকে একটু ছুটিয়ে আনে। বাড়ির হাতায় কখনও শিকলি খুলে খেলা দেয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি আর ভুবন মানুর দৌড়ঝাঁপ দেখেন। ভুবন গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললে তিনি টের পান। মনে হয়, মানকুমারী মানুষ হলে সব সম্পত্তি তার নামে উইল করে দেওয়া যেত। যা হওয়ার নয়, তা কি আর কুঠিয়ালের গোমস্তাগিরিতে হয়। সব রাধামাধবের ইচ্ছা।
    ভুবনের খোসামুদিতে নিকট জ্ঞাতিপুত্র গোকুলকে এনে রাখা হয়েছে। ভুবনের আবদারে ননীমাখন খেয়ে হারামজাদা পেল্লায় হয়ে উঠছে। তার শরীরে যেন রোজ পোয়াটাক মাংস গজায়। তিনি ভেবেছিলেন রাধামাধব আর গোকুলকে নিয়ে ভুবনসুন্দরী তার মত ব্যস্ত থাকবে। ভুবনের মনোবাসনা তিনি বুঝতে পারতেন। তার ইচ্ছে গোকুলকে পাকাকথা বলে নিজের ছেলে করে নেওয়া। কিন্তু কুঠিয়ালের গোমস্তাগিরি করে তারও চুলে পাক ধরেছে। কে জানে কার গর্ভস্রাব, দত্তক নিয়ে এই বিশাল সম্পত্তি তার ভোগে দিয়ে যেতে হলে অনেক কিছু আগুপিছু ভাবা দরকার। ও ছোড়া সম্পত্তির কী বোঝে। দু’দিনে সব উড়িয়েপুড়িয়ে দেবে। হারামজাদা মানুকে পর্যন্ত হিংসে করে। তারও নাকি ঝালর-দেওয়া মশারি লাগবে। মানুকে খেতে দিলে গিয়ে তার পাত দেখে আসে। ভুবন যদি মানুর গায়ে এঁটুলি খোঁজে, সেও মাথা এগিয়ে দিয়ে উকুনের কথা বলে। কুকুরটাও তেমনি, গোকুলকে দেখলেই দাঁত বের করে তেড়ে যায়। গোকুল নিশ্চয় ওকে কোনও দিন আদর করার নামে চোরাচিমটি কেটেছে। বিদেশি কুকুরের স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো হয়। আর গোকুল ছোড়ারও বলিহারি, গুয়োর ডিম ভাঙেনি, এখনই নাকি নেশাভাং-এ দড় হয়ে উঠেছে। ভুবনের আশকারায় এসব হয়েছে। শেষমেশ গোকুলের জ্ঞাতিগুষ্টি এসে দখল নেবে তার তালুকের। এই সম্পত্তি করতে তার শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। কোন আবাগির ব্যাটারা এসে ভোগদখল করবে কে জানে।
    মলমূত্র ত্যাগের বেগসংক্রান্ত ঝামেলা ক্রমশ বাড়ছিল। একবার বেগ চাগাড় দিয়ে উঠলে সামলানো দায়। কাপড়চোপড় অনাছিষ্টি হয়ে পড়ত। নাছদুয়ার ছাড়িয়ে দু’পা দূরেই বেহার থেকে আনা গোটা চল্লিশেক আমের চারা লাগানো হয়েছিল প্রায় পনেরো বছর আগে। ঘন ঘন বসানোর জন্য এখন বেশ ঝুপসি বন হয়ে গেছে। ভরদুপুরেও অন্ধকার হয়ে থাকে। রায়মশাই সেদিকে যাওয়া শুরু করলে পাঁচসাতটা জলভরা বদনা বনের ধারে পতিতপাবন হামেহাল তৈরি রাখত।

    অশ্বিনী রায় বুঝতে পারেনি, কিন্তু ভুবনসুন্দরী টের পেয়েছিলেন মানকুমারীর পেট বেঁধেছে। ক’দিন হল মাটন ছুঁয়েও দেখছে না। নিরামিষেও রুচি নেই। পেট এলিয়ে রোদ্দুরে শুয়ে থাকে। আদর করে ডাকলে কোনও মতে ঝালরের মত লেজ নাড়ে। আশ্চর্য ব্যাপার! কখন, কী ভাবে ঘটনা ঘটে গেল। কাকপক্ষী টের পেল না। বড় আজগবি ব্যাপার। এ যেন সেই রাতারাতি জামাই এসে চলে যাওয়ার মত। পাঁচ মাস পরে পাঁচির মা সবাইকে গেয়ে বেড়ায় যে, গত চৈতি ফসল ওঠার মুখে অনেক রাতে পাঁচির জামাই এসেছিল। পাঁচির হবে – এ আর আশ্চর্য কথা কী। কেন, সবাই একটু মনে করে দেখুক সেদিন রাতে তার ঘরে কি জোকার, শাঁখের আওয়াজ কেউ শোনেনি।
    ভুবনসুন্দরী মানকুমারীর মুখের সামনে একটুকরো আমসত্ত্ব ধরলেন। মানু একবার শুঁকেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। কাসুন্দিমাখা শাকভাত বাটি ভরে সামনে এগিয়ে দিলেন। মানু মুখও তুলল না। আমসি দিলেন। মানু শুঁকল, আবার শুয়ে পড়ল। শেষে উনুনের ঝিঁক ভেঙে মাটি এনে, খাও মা – বললে, একবার চেটে দেখল শুধু। ভুবনসুন্দরী বুঝলেন আলবত মানুর পেটে বাচ্চা এসেছে। এবার কর্তামশাই টের পেলে একটা কুরুক্ষেত্তর ঘটবে। যার জন্যি এত টানাটানি মানামানি, মধ্যিখানে ফস্কা গেরো। কিন্তু কর্তামশাইএর ভয় থাকলেও কী যেন একটা আনন্দ হচ্ছে খুব। মানুর পেটে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে মানুর নাকে নোলক, মাথায় সিঁথিমৌর, গলায় সীতাহার, পায়ে তোড়া পরিয়ে সাধ দিতে।
    রায়মশাই দুপুরে বিশ্রামে গেলে পতিতপাবনকে গিন্নিমা ডেকে পাঠালেন। মানু যদি দিনভর শিকলিতে বাঁধাই থাকে, তবে এসব ঘটে কী করে। ভানুমতীর খেল নাকি। পাজির পা ঝাড়া পতিত নিশ্চয় কিছু অনাচার, কোনও লুকোছাপা করেছে। কর্তার ভয়ে জানাতে সাহস পায়নি। এসব লজ্জাঘেন্নার কথা পতিতের সঙ্গে কইতে হবে। বাড়িতে বেজাত যাতে না জন্মায়, তার জন্য কর্তার এত পরিশ্রম, চিন্তাভাবনা। কানাকানি হতে হতে সাহেবের কানে যদি এ খবর একবার পৌঁছে যায়, না জানি কী অনর্থ ঘটে। পইপই করে সাহেব বলে গেছে কোনও মতেই যাতে মিশেল না হয়।
    গিন্নিমার সামনে পতিত দু’কান ধরে, একহাত জিভ বের করে বলল মা মনসার দিব্যি, সে কিছু জানে না। কোথা দিয়ে কী ঘটেছে – সে তার বিন্দুবিসর্গ বলতে পারবে না। সে নিজের চোখে কিছুই দেখেনি। রোজই সে মানকুমারীকে নিয়ে প্রথমে উঠোনে খেলা দেয়। তারপর শিকলিতে বেঁধে বাগানের দিকে হাগামোতার জন্য ঘুরিয়ে আনে। তখন তার হাতে একটা নাদনবাড়ি থাকে। কাছাকাছি কোনও কুকুর ঘেঁষতেই পারে না। দূর থেকে অবশ্য কোনও দিন একটা দুটো মদ্দা বেশ নরম সুরে ঘেউ দেয়, কিন্তু আমাদের মানু তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। সুতরাং গিন্নিমা যা সন্দেহ করছেন, পতিত তামাতুলসী ছুঁয়ে বলতে পারে তেমন কিছু ঘটেনি। আর রাতে তো মাংসভাত খেয়ে সে ঝালর-দেওয়া মশারির নীচে ঘুমিয়ে থাকে। তার আলাদা ঘর আছে। সেখানে কীভাবে ওসব অশৈলী ঘটবে।
    কিন্তু ঘটেছে। মানুর পেট দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় ফষ্টিনষ্টি একটা হয়েছে। মানুও তাহলে ধোয়া তুলসীপাতা নয়। মানু মানুষ নয়, সে হল এক বিলাতি মাদিকুকুর। তার ওপর দেবতার আশীর্বাদ কেন পড়তে যাবে। ঠাকুরের কৃপায় অনেক সময় এরকম হয়। সুয্যিঠাকুরের কৃপায় কুন্তীর গর্ভ হয়েছিল কিনা। মহাভারতে আছে। এ যেন পাঁচির মার বাড়িতে জামাই আসার গল্প। হেঃ, কোথায় কুন্তী, কোথায় মানকুমারী। হতে পারে মানু ইদানীং অম্বুবাচীর দিন মুখে কুটোও কাটে না, ভোগের খিচুড়ি বড় ভালোবাসে। তাতে প্রমাণ হয় না সে বড় ধার্মিক হয়ে গেছে। তা হলে কতকাল আগে ভুবনসুন্দরীর গর্ভ হত। তার মত আচারনিষ্ঠা নিয়ে পুজোআচ্চা ক’জন করে। নন্দোৎসব থেকে সৌভাগ্যচতুর্দশী— কিচ্ছুটি বাদ নেই। ছেলেপুলেয় তার ঘর ভরে যাওয়ার কথা। সেকাল আর নেই। সুয্যির আর সেই তেজ নেই। এখন পাল না খাওয়ালে গোরু বিয়োয় না। সে দিনকাল কী আর আছে। বড় বড় মুনিঋষি দৃষ্টি দিয়েই সৃষ্টি করতেন। মানকুমারীর ব্যাপারটা রহস্যই থেকে গেল।
    অশ্বিনী রায়ের কানে কথা ওঠার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। রোজ সকালে পাখপাখালি ডাকার সময় মানুর আওয়াজও শোনা যেত। গোবরগাদার ভেতর থেকে পোকা খাওয়ার জন্য গুয়ে শালিখ ঘুরঘুর করত। মানু বারান্দা থেকে তাদের শাসন করত। ধরতে পারলে ছিঁড়ে খাবে— বোঝা যেত। ইদানীং অবশ্য গতর ভারি হওয়ায় অলস হয়ে পড়েছিল। শালিখগুলো নির্বিঘ্নে পোকা খেত। কিন্তু অনেকবেলা হলেও মানুর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে পতিত গেছিল খোঁজ নিতে। গিয়ে দেখে মানকুমারী তার মশারীর ভেতর মরে কাঠ হয়ে রয়েছে। তার মুখে তখনও গ্যাঁজলা শুকোয়নি। তার বিছানা বমিবিষ্ঠায় ছয়লাপ। বমির রং দেখেই তার সন্দেহ হয়েছিল। তার বিধবা বড় শালির বেলাতেও বমির রং এ রকমই ছিল। সেও বিছানা নষ্ট করে ফেলেছিল। কিন্তু বড়শালি তো ধুতরোবিচি নিজেই বেঁটে খেয়েছিল। মানুর পেটে সে জিনিস গেল কী ভাবে।
    গিন্নিমা বুক চাপড়ে সারাদিন মাতম করলেন। গোকুল কছেপিঠে নেই। রায়মশাই তার বউ-এর বিলাপের মাঝে মাঝে দু’একটি বাক্য শুনে তিনি কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারছিলেন। পাহারার এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও আসল ব্যাপার আটকানো যায়নি। কোন ফাঁক দিয়ে অনাচার একটা ঘটে গেছে। আর কিছুদিন বাদেই এ বাড়ির আনাচ কানাচ খুদে খুদে বেজম্মায় ভরে যেত। শোর কা বাচ্চা পতিত, শালেকো হাম হরিণবাড়িমে লে যায়গা। বাদ মে শালে টের পায়গা কত ধানে কত চাল। তোর হাতে লাঠি থাকে, হতে দিলি কেন। চাবকে দেশিটার পিঠের ছাল তুলতে পারলি না। কিন্তু কী আশ্চর্য! নারায়ণ নারায়ণ, ধম্মের কাজ ধম্মই করেছে। বাড়িতে বেজাত ভূমিষ্ঠ হতে পারেনি। সব দিক কী সুন্দর রক্ষা পেয়েছে। কেঁদো না ভুবন, নিজের মেয়ের এ রকম হলে আমি নিজের হাতে বিষ দিতাম। ওকে তো ধর্মঠাকুর মেরেছে। তোমার এত সাধনভজনের পুণ্যফল, তাই কুকুরটা মরেছে। মানু যদি বিয়োতো, আর বিলেতে যদি কোনও ক্রমে সে খবর পৌঁছত, কী কেলেংকারীটাই না হত।
    পতিতের ওপর তম্বি করলেও মনটা ভারি খারাপ হয়ে পড়ল। কুঠিয়াল তাকে বড় ভালোবাসত। মাসে এক আধবার ঘোড়ার সামনে পিঠ পেতে বসতে হত বটে, কিন্তু মাসের বাকি দিনগুলোতে কুঠিতে তারই স্বরাজ। চৌবাচ্চার ডলনদার মলনদার, জ্বালঘরের লোকজন, বেবাক নীলচাষী – তার লাঠির নীচে থাকত। এদিক সেদিকের বিলক্ষণ দু’পয়সা উপার্জন ছিল। কুঠিয়ালের ভালোবেসে দেওয়া জিনিসটা আর রইল না। কুকুরটা তাকে বড় মান্যিগণ্যিও করত। দু’একবার তার গায়ে হাত বুলিয়েছেন, লেজ নাড়িয়েছিল। ভুবনও তাকে নিয়ে বেশ মেতে ছিল।

    মেমকুকুর হলেও বাড়ির ওপর একটা প্রাণীর অপঘাতে মৃত্যু, ভুবন পন্ডিতমশাইকে ডেকে পাঠালেন। কুলদাঠাকুর শান্তিস্বস্ত্যয়ন, আপৎশান্তি কবচধারণ, ষোড়শদান শ্রাদ্ধবিধির বিধান দিয়ে পাঁজি খুললেন। দেহ মৃতার জাতানুসারে বাড়ির হাতার বাইরে সমাধিস্থ হওয়া বিধেয়। মাসিক শ্রাদ্ধের দরকার নেই। বার্ষিক করলেই আত্মা শান্তি পাবে।
    পতিত যখন মানকুমারীকে একটা বস্তায় ভরে বাঁশে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল, বাঁশের অন্য মাথায় ছিল মাধব সর্দার। পতিতের খুব কান্নাকাটির কথা মাধব পরে সবাইকে বলেছিল। মাধব পতিতকে জিজ্ঞেস করেছিল ধ্বনি দেবে কিনা, কিন্তু পতিতের চোখে হাপুশজল দেখে তারও কেমন যেন কান্না পাচ্ছিল। হাজার হোক, একটা প্রাণী তো। বাড়ির পেছনে নাছদুয়ার ছাড়িয়ে রায়মশাই-এর আমবাগান। সেখানে পরিষ্কার জায়গা বেছে গভীর একটা গর্ত খোঁড়া হল। সেখানে মানকুমারীকে শেষ শয্যায় শুইয়ে দিয়ে কোদাল টেনে ওরা দুজন মাটি ভরাট করে দিল। কে জানে পতিত কোথা থেকে শিখেছিল, গর্ত ভরাট হলে সে বুকে ক্রুশ এঁকে ছিল। দেখাদেখি মাধবও।
    মাস দু’এক বাদে কোনও এক ফাল্গুনের ভোরে, আমবাগানে তখনও ঝুঁপসি আঁধার, রায়মশাই বাগানে গিয়ে বসেছিলেন। সামনে ঝকঝকে বদনা, কাজ সেরে জল ফিরিয়েছেন, উঠবেন। কেউ জানে না কী ঘটেছিল। পীতাম্বর আর নন্দ ঘোষাল দেখল কাপড়চোপড়ের হুঁশ নেই, রায়মশাই টলতে টলতে বাগান থেকে বেরিয়ে আসছেন। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছেন, তখন তার পিঠ যেন ধনুকের মত উল্টোদিকে বেঁকে যাচ্ছে। মুখচোখ ভেঙেচুরে যাচ্ছে। সে অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে সোজা হচ্ছেন, আবার টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছেন।

    কাজের গাফিলতিতে ম্যাকার্থিসাহেব বিশুকে দু’ঘা শ্যামচাঁদ মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ভালোই হয়েছিল। বিশুকে তখন গল্পের নেশায় পেয়ে বসেছে। যেদিন থেকে সে অস্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল মানুষ গল্প শুনতে বড় ভালোবাসে, তখন মানুষ সব কিছু বিশ্বাস করে, আর এসব বলার সময় বিশু টের পায় কেমন করে যেন সে এই বৃত্ত থেকে কিছুটা ওপরে উঠে যাচ্ছে। তার দুই কাঁধের ওপর কিছু সুড়সুড় করে, বুঝি ডানা গজাচ্ছে। পুরনো কুঠির জঙ্গলে বেশুমার মাদিকুকুরের দল ও ম্যাকার্থির মদ্দাকুকুর সলোমনের কাহিনি সে অনেকটাই বাড়িয়েছিল। বিশেষ করে মৃত্যুদৃশ্য সে এমন ভাবে বলতে শিখে নিয়েছিল— তার ভারি-হয়ে-আসা গলা এবং ভিজেভিজে চোখ দেখে সবাই বলত ম্যাকার্থির মাথায় একদিন বাজ পড়বে। আশপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে তারা এও বলত যে, সাহেব যখন তার বউ-এর সঙ্গে ওইসব করবে, তখনই ঠাঠা পড়বে। বিশুর আপাতনিরীহ কথকঠাকুরের চোখদুটো তখন জ্বলজ্বল করে উঠত। বিশু আরও দূরের কুঠিতে গিয়ে গল্প খুঁজতে শুরু করেছিল। নীলচাষ, লালরক্ত, সবুজ আমবাগান, জলহীনতায় খয়েরি ঘাস, কালো মড়ক, সাদা মেঘ – ঝুলিতে এইসব রং-বেরং গল্প নিয়ে সে ঘুরে বেড়াত। লোকজন তাকে পেলে গোল হয়ে ঘিরে বসত। আবার আসতে বলত। তার ঝুলিতে সিধে ঢেলে দিত।
    অনেক পরে দূরের লোকজন অশ্বিনী রায়-এর গল্প শোনার সময় একই ভাবে গোল হয়ে বসত। রায়বাগানে বসে রায়মশাই জল ফিরিয়ে যখন উঠবেন উঠবেন করছেন, তখন এক চমৎকার কান্ড ঘটেছিল। বলো ঠাকুর, বলো। কথকঠাকুর তার লালনীল শতেক তালিমারা পিরান হাওয়ায় উড়িয়ে একপাক নেচে নেয়। তারপর কখনও বিষণ্ণ সুরে, কখনও শুধু কথা দিয়ে সাজায় মানকুমারীর রহস্যময় গর্ভসঞ্চারের কাহিনি। মেমকুকুরের সঙ্গে কেউ দেখেনি দেশি মদ্দার ঢলাঢলি, অথচ মানকুমারী মাটন ছেড়ে ঝিঁকের মাটি চাটে। দেশি মদ্দা কি তবে অদৃশ্য হয়ে মানকুমারীর ঝালরদেওয়া মশারির নীচে ঢুকে পড়ত। রায়বংশের সম্পত্তির লোভে গোকুলকে দিয়ে কেমন করে ষড়যন্ত্র তৈরি হল। মানকুমারীকে বিষপ্রয়োগে হত্যা, তাকে গোর দেওয়া, আর বাগানে বসে একদিন রায়মশাই দেখলেন তিনটে, না চারটে সাদাকালো কুকুরছানা আমবাগানে ভোরবেলার আলোআঁধারিতে কী সুন্দর খেলা করছে।
    আরও পরে বিশু বলত যে, ঝালরদেওয়া মশারির ভেতর ঢোকার পর মানকুমারীর শরীর আস্তে আস্তে পালটে যেত। লম্বা ঝুলের একটা ফুটফুটে সাদা গাউন পরে সে শুয়ে থাকত। কিন্তু তার সর্ব অঙ্গজুড়ে কত যে গয়না। মাথায় টায়রা, চুলে বেলকুঁড়ি কাঁটা, কানে কানপাশা, নাকে টানানথ, গলায় বিছেহার, হাতে চূড়। মানকুমারী তো আর মানকুমারী নেই, সে তো ডানাকাটা এক পরি হয়ে গেছে। তার হাত পা মুখ বুক – সব মানুষের মত। পিঠে বালিশ রেখে সে এক হাঁটু ভাঁজ করে বসে থাকত। তারপর যখন চাঁদ উঠত, অনেকদূর থেকে শোনা যেত অনেকগুলো কুকুর একসঙ্গে ডাকছে, কেষ্টপুরের একটা মদ্দা হাওয়ায় ভেসে ঘরে ঢুকত। কুঠিয়ালের গোমস্তা কিছুই টের পেত না। তার পাইকবরকন্দাজের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসত। পুরুষমানুষটার গায়ের রং কালো, কেঁদো গড়ন, ঝকঝকে সাদা দাঁত, মাথায় ফেট্টি, মালসাট ধুতি। ঘর ভরে যেত বুনো গন্ধে। অন্ধকারে দুজনের চোখ জ্বলে উঠত। মানকুমারী ভেতর থেকে মশারি তুলে ধরলে পুরুষ তার বিছানায় যেত। ভোরবেলা যখন আবার শোনা যেত দূর থেকে অনেক কুকুর যেন কাঁদছে, মদ্দাটা হাওয়ায় ভেসে ফিরে যেত। গাউন খসে যেত, গয়না উবে যেত। মানকুমারীর শরীরে আবার সাদা লোম, লেজ যেন আগুরিপাড়ার ফুলঝাড়ু। তার বিছানায় শুধু দু’এক ফোঁটা রক্তের চিহ্ন থেকে যেত। কুঠিয়ালের গোমস্তা তো দূরের কথা, ভুবনসুন্দরীও কিছু বুঝত না। কিছুদিন বাদেই মানকুমারী আর মুখে কুটোও তোলে না, তার রুচি নেই। উনুনের পোড়ামাটি ভালো লাগে। পতিত হাতে নাদনবাড়ি নিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।

    বলো ঠাকুর, আরও বলো। সিধেয় তোমার ঝুলি ভরে দেব। লাউ দেব, কুমড়ো দেব, বেগুন দেব, চামরমণি চাল দেব। হ্যাঁ গো কথকঠাকুর, ভোরবেলায় রায়বাগানে তারপর কী হল ?

    পীতাম্বর আর নন্দ ঘোষাল দেখেছিল রায়মশাই এক হাতে কাপড়ের খুঁট, অন্য হাতে বদনা নিয়ে বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার শিরদাঁড়া ধনুকের মত পেছনে বেঁকে গেছে। বোঝা যায়, তিনি চেষ্টা করছেন মুখ এবং শরীরটাকে সিধে রাখার, কিন্তু পারছেন না। ফলে মুখটা আরও ভেঙেচুরে যাচ্ছে। পীতাম্বর শুনেছিল অশ্বিনী রায়-এর মাঝে মাঝে এ রকম হয়। ফলে প্রথমে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। কিন্তু একটু বাদে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর দেখা গেল সোজা হয়ে হাঁটতে পারছেন না। টলে টলে পড়ছেন, মুখ দিয়ে কেমন একটা গোঙানির মত শব্দ হচ্ছে। নন্দ গিয়ে রায়মশাইকে ধরেছে, পীতাম্বর দৌড়ে গেছে গোমস্তাবাড়িতে খবর দিতে।
    ওবেলার মধ্যেই পুরো কেষ্টপুর, বাসন্তীপুর, ওদিকে মঙ্গলডিহি, কোটালপাড়া – সবাই রায়বাগানের বৃত্তান্ত জেনে গেল। পতিতকে ডেকে রায়মশাই বুঝিয়ে দিলেন বাসন্তীপুরের কুঠির মত তার ঘরের পাশে সুপরিগাছগুলোর মাঝখানে বাঁশের ফালির সঙ্গে নারকেলসুপরির শুকনোপাতা, কলার ডোঙা দিয়ে দরপরদা গোছের বানাতে। পতিত একবার তার সঙ্গে বাসন্তীপুরের কুঠিতে গিয়ে সেটা দেখে এসেছিল। সেটার চেয়েও ভালো হল পতিতের তৈরি টাইলেট। পাটাতনের মাঝে ফুটো, নীচে একমানুষ গর্ত। কিন্তু সেখানে কোনও বদনা পতিত দেখেনি। কর্তামশাইকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস পায়নি।
    রায়বাগানের ভেতর দিয়ে তো দূরস্থান, ধার দিয়ে দিনের বেলাতেও জনমানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধের পর অনেকেই বাগানের ভেতরে কুকুরের ডাক নিয়মিত শুনতে পাচ্ছিল। ভিন গাঁয়ের উটকো আনখা লোক ভুল করে রায়বাগান দিয়ে যাওয়ার সময় পষ্টই দেখতে পায় তিনটে সাদাকালো ফুটফুটে কুকুরছানা হুটোপুটি করে খেলছে। কিন্তু হঠাৎ আর সেগুলো দেখা যায় না। যেন ফুসমন্তরে গায়েব হয়ে যায়। বাগান তো দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। সে জন্যও হতে পারে। দু’একজন ওলাইচন্ডীর দিব্যি গেলে বলেছে, চারটে বাচ্চা। তিন, না চার – এ নিয়ে কেষ্টপুরের লোকজন দু’দলে ভাগ হয়ে যায়।

    মলমূত্র ত্যাগের ব্যাপারটা ক্রমে রায়মশাই-এর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। ভুবনসুন্দরীর সংসারের ওপর টান এখন অনেক কম। রাধামাধবের ঘরে সময় বেশি কাটে। কিছুদিন আগে খোট্টাজগাকে বলে তার মেয়ে রাধিকাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে কর্তার জন্য আনা হয়েছে। সে খুব ভালো করে কর্তামশাই-এর পিঠে তেল ডলে দেয়। গোকুলের বাড়ির লোকজন আজকাল প্রায়ই এ বাড়িতে এসে থাকছে। রায়মশাই এখন টাইলেটে যাওয়ারও অবসর পান না। কাপড়চোপড়ে হয়ে যায়। রাধিকা মুখ বুজে সব পরিষ্কার করে। রায়মশাই-এর ভারি লজ্জা করে। কিন্তু আজ বলে নয়, শরীর কোনও দিনই তার কথা শুনল না। এই অবস্থাতেও রাধিকার জন্য তার শরীর অধীর হয়ে ওঠে। একপিঠে যখন গুমুতে মাখামাখি হয়ে থাকা অসহায় শরীর, অন্যপিঠে তখন রাধিকার পরিপূর্ণ যুবতী শরীর দেখে তার এই হারামজাদা বেইমান শরীরের জেগে ওঠা দেখে তার নিজেরই অবাক লাগে।
    ইদানীং আর এক উপদ্রপ হয়েছে। ঘুরে ফিরে মাঝে মাঝেই সেই স্বপ্ন আসছে। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আর ঘুম আসতে চায় না। আবার ঘুমোতে ভয় করে সেই স্বপ্নের কথা ভেবে। অদ্ভুত দেখতে কতগুলো জন্তু তার এই ঘরবাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাধামাধবের মাথায় উঠছে, গোলাঘরে কিচিরমিচির করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার উলঙ্গ শরীর বেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। তারপর একসময় তার দুই কুঁচকির মাঝে একটা গিয়ে হা করে। কুমিরের মত ধারালো দাঁতের সারি। তখন আতংকে ঘুম ভেঙে যায়।
    ভুবনকে জড়িয়ে ধরলে ভুবন সরে শোয়। হয়তো মনে করে তার কাপড় পালটে দিতে হবে বুঝি।

    এভাবেই একদিন পূর্ণিমা রাতে, কেষ্টপুরের আকাশে সেদিন খুব চাঁদ ছিল, রুপোলি জোছনায় ভেসে যাচ্ছিল হলুদ সর্ষেখেত, সোনার ধানখেত, বেগনিফুলে ভরা নীলের খেত – সে রাতে আটদিক থেকে কুকুরের কান্না ভেসে আসছিল, কিন্তু কুঠিয়ালের গোমস্তা শুনতে পাচ্ছিলেন বেজম্মা কতগুলো কুকুরের বাচ্চা হাসছে। রায়বাগানের ভেতর থেকে হুল্লোড় উঠে আসছে। সন্ধেরাত, রায়মশাই তার ঘরে কাপড় আলগা করে শুয়েছিলেন। খোট্টাজগার ভরযুবতী মেয়ে রাধিকা তার শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে নরম আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছিল। তার শরীর আরামে শিরশির করে উঠছিল। আঃ রাধি, তুই বড় ভালো মেয়ে। সামনে আয়, আমি এখনও অনেক অক্ষত যোনি ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি রে। রাধি, আজ ভরাপূর্ণিমা। চল, রাস খেলি।
    কুঠিয়ালের গোমস্তা হয়তো তার প্রিয় এক নারীকে এমন কিছুই বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন আট দিক থেকে কুকুরের ডাক ভেসে এসেছিল। গোল চাঁদের দিকে মুখ তুলে ওরা কেন যে একসঙ্গে কাঁদে, কে জানে। রায়মশাই শুনলেন হাজারও বেজম্মার দল এক সঙ্গে হাসছে। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলেন পরনের কাপড় নীচের দিকে ভেসে যাচ্ছে। দুর্গন্ধে ঘর ভরে গেছে। পিঠের ওপর কে যেন শক্ত জুতো দিয়ে চাপ দিচ্ছে। কে হাসছে ? রাধি ? রাধি, আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে রাখ। আমি বেঁকে যাচ্ছি, ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছি। আঃ রাধি, সরে যা। আমার লজ্জা করছে।
    বিছানা ভেসে যাচ্ছিল। মলমূত্র কোথা দিয়ে বেরোয় – সবাই জানে। কিন্তু প্রাণপাখি যে নবদ্বারের কোন দ্বার দিয়ে বেরোয় – কেউ সঠিক বলতে পারে না। রাধিকা খুব অবাক হয়ে দেখছিল তখনও বাবুর শরীরের গর্মি বোঝা যাচ্ছে। রাম জানে লোকটা মরে গেছে। ফির, মুর্দাবাবুর শরীরে যেন এখনও কিছু সুরতি লেগে আছে।

    বলো বিশুভাই, তারপর ? রায়বংশ কি ফৌত হয়ে গেল ? বংশে কে বাতি দেবে ? কার্তিক মাসে পুর্বপুরুষের জন্য আকাশদীপ জ্বালবে কে ? গল্প বলো কথকঠাকুর। তোমার গল্প যেন নদীর জলের ধারা। আমাদের বারোমাসে শরীরে মিশে যায়। আমাদের মাথার ভেতরে জমা হয়ে থাকে। আমাদের ছেলেপুলেদের তো গল্প বলতে হবে। গল্প ছাড়া কি বাঁচা যায়। অনেক কথা ভুলে যাব। অনেক কথা নতুন করে আমরাই তৈরি করে নেব। এক বিশুপাগলের কথা, এক কুঠিয়ালের গোমস্তার কথা, ম্যাকার্থিসাহেব, তার মদ্দাকুকুর সলোমন কেমন করে মরেছিল, সাদাকালো তিনটে, নাকি চারটে ফুটফুটে কুকুরের বাচ্চার কথা – নদীর মত বয়ে যাবে।

    পক্ষাঘাতে বাঁ অঙ্গ সম্পূর্ণ অসাড়, কিন্তু ডানহাত নাড়ানো যায়, ফলে ভুবনসুন্দরী রাধামাধবের পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করতে পারেন। সিন্দুকের চাবি গোকুলের বউ-এর জিম্মায় অনেককাল আগে চলে গেছে। বার কেষ্টপুরের মহাল গোকুল বন্ধক দিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে। ওদের গুষ্টি ঘরবাড়ি সব দখল নিয়ে নিয়েছে। কর্তামশাই-এর পছন্দের একটা ভারি শেজ আজ খোঁজ করে দেখলেন নেই। পতিতকে গোকুলের মামা লাথি মেরেছে। পতিত কাঁদছিল। এর মাঝে নতুন ঝামেলা – বামুনডাঙা থেকে রামনিবাস নামে এক ছেলে এসে বলছে তার নামে নাকি কর্তামশাই সাড়ে চার বিঘা জমি লিখে দিয়েছিলেন। সেই জমির দখল সে নিতে চাইছে। তার মায়ের নাম বলছে রাধিকা। মহা মুশকিল হয়েছে। কর্তামশাই কোথায় কোথায় বীজ ছড়িয়ে গেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। তারা সব এসে যদি এখন অধিকার দাবি করে, তার কী করার আছে। বাঁ অঙ্গ পড়ে গেছে। নেহাত গোকুল এখনও মা বলে ডাকে, তাই রক্ষে। নইলে তাকে গোপালমামা কোথায় পাঠাত কে জানে।
    ছেলেটা বড় জেদি। গোঁ ধরে বসে আছে তার সাড়ে চার বিঘার জন্য। মজার ব্যাপার, সে গোকুলের কাছে যেতে চাইছে না। তার পায়ের কাছে থানা গেঁড়েছে। বড় মিষ্টি ছেলেটার মুখ। হুবহু কর্তামশাই। মনটা হুঁ হুঁ করে ওঠে। বুকের ভেতর সাপটে নিতে ইচ্ছে করে। তাকে বড়মা বলে ডাক দিলে তার বুক ফেটে যেন কান্না আসছিল। তার অংশ থেকেই না হয় সাড়ে চার বিঘা দিয়ে দেবেন। দাগ খতেন হয়তো বরাবর হবে না, সে তিনি পরে গোকুলকে বুঝিয়ে বলবেন।

    দুই

    রোজকার নিয়মে আজও কুসুমকুমারী জলভরা ঘটি নিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে যখন নিশ্চিন্তে বসার আয়োজন করছে, তখন সামনে তাকিয়ে তার সব আয়োজন আবার পেছনে ফিরে যেতে শুরু করল। তার চোখদুটো আপনা হতেই বিস্ফারিত হয়ে গেল। এ তো সেই লোক। মুহূর্তেই মনে হল শরীরে রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সামনের আমগাছে একটা মানুষ ঝুলছে।
    সে কোনও বড় ব্যাপার নয়। রায়বাগানের দুর্নাম আজকের নয়। দুখি মানুষজন এ বাগানের আমগাছ বেশ পছন্দ করে। বড় পোক্ত ডাল। কিন্তু কুসুম পষ্ট দেখল লোকটা নিজের হাতে গলার বাঁধন খুলে কাঠবেড়ালির মত নীচে নেমে এল। তার দিকেই যেন আসবে। লালনীল তাপ্পি মারা একটা পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা। হাসি হাসি মুখে যেন তাকেই গল্প শোনাবে বলে ঠিক করেছে। মরা হোক, জ্যান্ত হোক, পুরুষ তো। আর কুসুম তখন কেবল বসেছে। ছি ছি।
    ব্যাটাছেলেরা রায়বাগানে বসে না। কে জানে, কোন আদ্যিকাল থেকে কেষ্টপুরে এ নিয়ম চলে আসছে। ডাকাবুকো লোক দু’একজন চেষ্টা করেছিল। তাদের কেমন যেন গা ছমছম করে উঠেছে। জঙ্গলের গভীর থেকে বাঘের মত কুকুরের ডাক শোনা যায়। ধবধবে সাদা ঝাঁকড়া লোমওয়ালা একটা বিলাতি কুকুরের পেছনে ছায়ার মত দৌড়ে যায় অন্ধকারের মত কালো বড়সড় কুকুর। তিনটে চারটে সাদাকালো ফুটফুটে কুকুরের বাচ্চা খেলা করে। খেলতে খেলতে হঠাৎ কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়। অথচ আজ পর্যন্ত কোনও মেয়েছেলে কিছুই দ্যাখেনি, কিছুই শোনেনি। ওরা ভোরবেলা কিংবা সন্ধেবেলা নিশ্চিন্তে বাগানে গিয়ে বসে। কতকাল ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। সেই কোন কালে এখানে নীলকুঠির গোমস্তা অশ্বিনী রায়ের দালান ছিল। সে সব ইটকাঠের এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রায়বংশ উজাড় হওয়ার পর তার জ্ঞাতিরা কিছুদিন ভোগদখল করেছে। তারাও আস্তে আস্তে এদিক সেদিক চলে গেছে। তারপর নতুন কেউ এসে জমিজায়গা পত্তনি নিয়ে রায়ত বসিয়েছে। আবার একটা নতুন জনবসতি গড়ে উঠেছে।
    পুরনো গল্প কিন্তু মরে না। বাঁক নেয়। তার ধারায় নতুন গল্পের জল এসে মিশতে থাকে। নদীর মত তালুক, মহাল, গঞ্জ, পরগণার ভেতর দিয়ে বইতে থাকে গল্পের নদী। এক কথকঠাকুর লালনীল তাপ্পিমারা জামা গায়ে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে গল্প বয়ে বেড়ায়। একশ বছরের নব ঠাকুর্দা বলে সে এ গল্প শুনেছিল বিশুঠাকুরের মুখে। পঞ্চাশ ক্রোশ দূরের তারক কবিরাজ বলে সে তখন ছোট, সেবার এক কথক ঠাকুর এসেছিল তাদের গাঁয়ে। তার মুখে সে এ গল্প শুনেছিল। ষোলো বছরের কুসুমকুমারী বলে গত মাঘে মাজারের মেলায় একটা লোক গল্পের আসর সাজিয়ে বসেছিল। তার চারপাশে গোল হয়ে মেয়েরা বসে গল্প শুনছিল। লালনীল তাপ্পিদেওয়া তার জামা। তার বয়স বোঝা যায় না। মনে হয় যেন একটাই মানুষ একশ দু’শ বছর ধরে দুনিয়াজুড়ে গল্প শুনিয়ে বেড়াচ্ছে। মাজারের মেলায় বৃষ্টি নেমেছিল অসময়ে। কথকঠাকুর গল্প থামিয়ে বলেছিল বাকিটুকু তাকে পরে শোনাবে।

    এসো ঠাকুর। বলো, তারপর। কতদিন পরে আবার এলে আমাদের গঞ্জে। দাঁড়াও ঠাকুর, তোমার পায়ের ধুলো একটু মাথায় নিই। কত তীর্থস্থান তুমি ঘুরে এলে। তুমি নিজেই তো গল্প হয়ে গেছ ঠাকুর। একই সময়ে তুমি বেড়াডাঙায়, তো সবাই বলে সেই মঙ্গলবারের দুপুরে তুমি কমলদিঘির ঘাটে দাঁড়িয়ে পা ধুচ্ছিলে। আবার মঙ্গলবারের বিকেলে করতোয়ার বিশক্রোশ উজানে প্রাণকৃষ্ণর বড়জামাই তোমাকে দেখল নদী পার হবে বলে খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে আছ। আমাদের কত সৌভাগ্য ঠাকুর।
    সব ঠিক, কিন্তু বিশুর শরীরটা মাঝে মাঝে কেমন যেন ভেঙে যায়। নীল কুয়াশার মত বাতাস এলেই উড়ে যেতে চায়। অনেকগুলো খন্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক কষ্টে বিশু আবার সেগুলো জোড়া দেয়। অনেক দিন ধরেই এ রকম হচ্ছে। বাসন্তীপুরের কুঠিয়াল ম্যাকার্থি সাহেবের কাছে কেউ চুগলি খেয়েছিল। বিশু নীলচাষ, লালরক্ত, জলহীনতাবাবদ খয়েরি ঘাসের কথা চাউর করে বেড়াচ্ছে। বলেছে সাহেব কাজটা ঠিক করেনি। পরগণার ম্যাজিস্ট্রেটকে ম্যাকার্থি বলেছিল বিশুকে খুঁজে দেবার জন্য। রমাকান্ত দারোগা তাকে রংপুরের নীলফামারির এক আবাদ থেকে ধরে এনেছিল। ম্যাকার্থির বজ্রমুঠিতে বিশুর গলা মিনিট পাঁচেক জব্দ হয়ে থাকার পর সাহেবের লোক তাকে রায় মশাই-এর বাগানের এক উঁচু ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। রাতারাতি এ কাজ করা হলেও বিশুর মড়া ভোরবেলাতেই বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। তারপর আর দুনিয়াজুড়ে গল্প শুনিয়ে বেড়াতে তার কোনও অসুবিধা রইল না।

    কুসুমকুমারী বড় আতান্তরে পড়েছে। পেটটা ভার হয়ে রয়েছে। দুপুরে খেতে ইচ্ছে করল না। খাবারে অরুচি দেখে মা ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ তার দিকে কেন যেন তাকিয়ে ছিল। রাতে পেটে একটু ব্যথা হল। কিন্তু কাল সকালে সে কী করবে। লোকটা যদি আবার তাকে গল্প শোনাতে আসে।

    "বর্ণসংকর" থেকে নেওয়া ( https://www.guruchandali.com/book.php?&page=2 )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৪ এপ্রিল ২০২০ | ১৮২৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন