এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  ইদের কড়চা  ইদের কড়চা

  • উৎসকথা

    বিপুল দাস
    ইস্পেশাল | ইদের কড়চা | ২৮ মে ২০২১ | ২২৬৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বাইরের বড় দিঘির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বাহাত্তর। এখন কী করবে, সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। মনে হচ্ছে দু’কিলো নয়, বুকের মাঝে একটা জ্যান্ত বাইশ কিলোর কাতলা জাপটে ধরে রেখেছে বুঝি। গামছা দিয়ে ঢাকা। মাছটা ঝাপট মারছে। আঁশটে গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আসছে। কতকালের প্রাচীন শ্যাওলা জড়িয়ে আছে মাছটার শরীরে। অথই জলে ফিরে যাবে বলে এখনও ছটফট করছে। বাহাত্তর একটু আলগা দিলেই পিছলে বেরিয়ে যাবে একলাফে। পুকুরের জলে আবার সাঁতার কাটবে।

    যাক পালিয়ে। তার আগে জিনিসটা একবার ভালো করে দেখতে ইচ্ছে করল তার। ঠাকুরঘরে ঢুকে প্রদীপদানি সরাবার সময় তো আর হা করে দাঁড়িয়ে শোভা দেখার সময় ছিল না। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস, নাকচোখমুখ কেমন ভোঁ ভোঁ, নেশার মত একটু ঘোর ঘোর ভাব, যেন রাতে খুব জ্বর আসবে – তবু তার ভেতরেই মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ হাসিল করেছে সে। তখন আর দেখার ফুরসত কোথায় ছিল। একে তো রাধামাধবের ঘরে ঢুকে পড়েছে, তার ওপর এমন জিনিস হাতিয়েছে, যা শুধু বিশ্বাসবাড়ির নয়, পুরো বল্লভপুরের সম্পত্তি বলে মনে করে সবাই। এখন শরীরটা কেমন ভার হয়ে আসছে। এক পিস বাটি বা একটা থালা হলে যেখানে সেখানে লুকিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু এখন যেন বাঘের পিঠে চড়ে বসেছে সে। নামতে গেলেই বাঘ হালুম দেবে।

    গাছের ওপর বাচ্চাদের নিয়ে পাখি যখন বাসায় থাকে, রাতের অন্ধকারেও বুঝতে পারে গাছ বেয়ে কোনও বিপদ উঠে আসছে এঁকে বেঁকে। বাহাত্তরও বুঝতে পারল অনেকটা দূরে হলেও হালকা পায়ে তার পেছনে কেউ আসছে। ঘাবড়ে গেল বাহাত্তর। তার পেছনের সরু পথ দিয়ে আসছে, মানে ও বাড়ি থেকেই আসছে। সম্ভবত এই মাত্র পেরিয়ে আসা বটতলার বাঁকের ওপাশেই রয়েছে। তাহলে এখনও তাকে দেখতে পায়নি। রাখালবাগাল হোক, আর বাড়ির লোক হোক – তাকে দেখলে হাঁক একটা দিতই। তাকে দেখলেই তো সবার হাটবাজারে দরকারি জিনিসের কথা মনে পড়ে যায়। খোঁড়া হয়ে যায়। দৌড়ে পালাবে – একবার ভাবল বাহাত্তর। নাঃ, সেটা বোকামি হয়ে যাবে। খামোখা কেউ দৌড়োয় না। তাকে দৌড়তে দেখলেই লোকের কৌতূহল বাড়বে। হঠাৎ কারও নজরে পড়লে ধরা পড়ে যাবে। তা হলে কি বোকাসোকা মানুষের মত হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে ? পেছনে যে আসছে, সে যদি সামনে এসে জানতে চায় গামছা দিয়ে সে কী আড়াল করে রেখেছে – তখন সে কী উত্তর দেবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুকুরের জল দেখছিল? পাগল নাকি! একটাই পথ বাকি। বাহাত্তর তাই করল। পায়ে পায়ে পুকুরে নেমে গেল। এক গলা জলে গিয়ে দাঁড়াল। কী আশ্চর্য! জিনিসটার ওজন না হোক এক কিলো কম মনে হচ্ছে এখন।

    ঘাড় ঘুরিয়ে বাহাত্তর যাকে দেখল, সে মালতী। মালতীকে ভালো করে লক্ষ করতেই সে খুব অবাক হল। চমকেই গেল। এক তো তাকে দেখে মালতীর চোখেও ভয়ের ছায়া ফুটে উঠেছে। তার ওপর মালতীর পেট। শাড়িতে ঢাকা থাকলেও সেটা যে বেশ উঁচু হয়েছে, স্পষ্ট টের পেল বাহাত্তর। কবে হল এমন। বড়মার চোখ এড়িয়ে দিনে দিনে বেড়ে উঠল কী করে। কার সঙ্গে শুয়েছিল মালতী। স্বপ্নে তার কাছে আসে, আর আসলে আর একজনের বিছানায় গিয়ে একেবারে ... হুঁ

    পায়ের নীচে নরম কাদা থকথক করছে। মালতীর দিকে তাকিয়ে দাঁত বার করে হাসল বাহাত্তর। দুটো হাত দিয়ে আড়াআড়ি পেট ঢেকে রেখেছে মালতী। পুরো নয়, সামান্য ঠোঁট ভেঙে মালতীও হাসল।

    পুকুরের জলের রং টলটলে সবুজ নয়। ঘন সবুজ, প্রায় কালো। ঘাটের যেখানে মালতী দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে জলের নীচে বাহাত্তরের হাতে কী রয়েছে, দেখতে পাওয়া অসম্ভব। মালতীর পেট থেকে চোখ না সরিয়ে গামছার নিচে একবার হাতড়ে নিল বাহাত্তর। মালতীর চোখে কেমন অস্বস্তি ঘুরছে, যেন দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি চলে যাবে – বুঝতে পারছে না। হাতদুটো কাটাকুটি চিহ্নের মত করে পেটটা ভালো করে ঢাকার চেষ্টা করল মালতী। এখন তার চোখের মণিতে লজ্জা দেখল বাহাত্তর।

    জলের নীচে বাঘটার লম্বা লেজে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বাহাত্তর। এ প্রদীপের গল্প সে অনেক শুনেছে। এখন তার হাত উঠে এসেছে বাঘের পিঠের ওপর। বাঘের নীচে টুপিপরা এক সাহেব। তার গলায় চেপে বসেছে বাঘের দাঁত। পিঠের ওপর হাত বোলাচ্ছে বাহাত্তর। তারপর চার কোণার চারটে খুঁটি, তাদের মাথায় চারটে প্রদীপ। আজব বটে। সাহেব, বাঘ, প্রদীপ। কে জানে কে, কী ভেবে এমন আশ্চর্য গড়নের প্রদীপদানি বানিয়েছিল। তবে যে বানিয়েছিল, কেরামতি ছিল বটে তার। ক্রমশ সরু হয়ে ওপরে উঠে যাওয়া খুঁটিগুলোর গায়ের খাঁজগুলো পর্যন্ত বাহাত্তর টের পাচ্ছিল। এবার বাঘের দাঁতে হাত দিলে তার কেমন শীত করে উঠল।

    ঢং করে মাঝপুকুরে দাঁড়িয়ে আছিস কী কইরতে? সরবি? দেখছিস তো পুকুরঘাটে মেয়েছেলে এসে দাঁইড়ে রয়েছে।
    হ্যাঁ, এই তো উঠব। তুই নাম, আমি ওদিককার ঘাট দিয়ে উঠে যাচ্ছি।
    দেখেশুনে পার হবি। মাঝপুকুরে যাস না কিন্তু। ডানদিক কিংবা বাঁ দিক দিয়ে পার হয়ে যা।
    কেন, মাঝপুকুরে কী এমন কুমীরকামট আছে ?
    যা না, গিয়ে দ্যাখ। এত বছর বিশ্বাসবাড়ির বেগার ঠেলছিস, কোনও খবর রাখিস না? মাঝপুকুরে চোরা ঘুর্ণির কথা শুনিস নাই?

    এক মুহূর্তের জন্য বাহাত্তর কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। না নদী, না সমুদ্র, ঘুর্ণি কেমন করে বিশ্বাসবাড়ির দিঘির জল তোলপাড় করে। মালতী তাকে মিথ্যে মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে। নদী, দিঘি, বিল, তেঁতুলগাছ – এসব নিয়ে হাটেবাজারে গল্পের তো শেষ নেই। বাঘটা কি গরগর করে উঠল নাকি? বাহাত্তর দেখল কতগুলো বুদ্বুদ উঠে আসছে। জলের বাইরে এসে বাহাত্তরের চিবুকের সামনে ফেটে পড়ছে। তুই নিজের চোখে কোনও দিন ঘুর্ণি দেখেছিস ?

    ভরা পেট নিয়ে মালতী ঘাটে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুনিয়া বড় আশ্চর্য জায়গা। মেয়েমানুষের কেমন করে পেট হয়, বাহাত্তরের তো জানতে বাকি নেই। রোজ-ই তো একটু আধটু করে শিখছে। শেখার কি শেষ আছে নাকি। বড়মার চোখ এড়িয়ে মালতীর মত ভালো মেয়ে নষ্ট হয়ে গেল, আশ্চর্য ! এদিকে পুকুরের জলে নাকি ঘুর্ণি ওঠে। মাঝপুকুরের জল পাক খায়। তখন সেখানে গিয়ে কেউ পড়লে তার নির্ঘাত মরণ।

    বড়মার কাছে শুনেছি। বড়মা নাকি তার জ্যাঠা তারিণী বিশ্বাসের কাছে শুনেছে। এ তো অনেক পুরনো দিঘি। মাটি কাটতে কাটতে চারপাশের পাড় পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে উঠল। তবু জলের কোনও নামগন্ধ নেই। শেষে কোন জমিদারের লোক এসে বেলদারদের বুদ্ধি দিল পুকুরের মাঝখানে কুয়ো খুঁড়তে। সে কুয়োও প্রায় পাতালে পৌঁছে গেল।

    তারপর?

    তারপর হঠাৎ যেন বাঁধ ভেঙে গেল। কোথাকার কোন দরজা ধড়াম করে খুলে পড়ল। আর সে কী জল। ঘুর্ণির মত পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠে আসছে। কুয়ো যেন দিঘির নীচে মস্ত এক পাইপ। সমুদ্দুরের অন্য জল এসে পড়ল বিশ্বাসবাড়ির উঠোনে। দেখতে দেখতে জল থই থই দিঘি। বড়মার কাছে শুনেছি প্রথম প্রথম পুকুরের জলে নোনাস্বাদ পেত সবাই। যেন লবণগোলা জল। পরে পুজো দিয়ে দোষ কাটান গেছে। এখন আর বোঝা যায় না। এক গাং-এর জল অন্য গাং-এ গিয়ে পড়া তা হলে এমন কোনও বড় ব্যাপার নয়। হতেই পারে। দোষ কাটান দেবার জন্য পুজো আচ্চা, মন্ত্রতন্ত্র আছে। পরে আর কিছু বোঝা যায় না। জলের নীচে বাহাত্তরের এখন আর অতটা শীত করছিল না। এক খাবলা জল মুখে নিয়ে কুলকুচি করল। কোথাও নোনাস্বাদ নেই। সামান্য কচুরিপানার গন্ধ।

    টানা কথা বলে যাওয়ার সময় মালতীর নিজের পেটের কথা হয়তো খেয়াল ছিল না। একভাবে অনেকক্ষণ রাখার জন্য হাত ধরেও যেতে পারে। হাতদুটো সরিয়ে নিয়েছিল। এবার বাহাত্তর টের পেল তারও কাঁধদুটো ধরে এসেছে। কতক্ষণ ধরে বুকের মাঝে ভারি একটা জিনিস আগলে ধরে আছে। সময়ও আর বেশিক্ষণ নেই। সন্ধে পড়লেই সব জানাজানি হয়ে যাবে। তারপর কী হবে, বাহাত্তরের ভাবার ক্ষমতা নেই।

    মালতী যা বলল, হতেও পারে। তলে তলে হয়তো পৃথিবীর সব নদীনালা, সাগরদিঘির ভেতরে যোগাযোগ রয়েছে। বড়মার মুখেই সে শুনেছে – কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। এর মানে বোঝা এমন কিছু কঠিন নয়। সেবার কোথাকার কোন সাগরে তুফান উঠল, এ দিককার সব পুকুরদিঘির জল উথলে উঠল। চারাপোনা অব্দি ডাঙায় উঠে খাবি খেতে লাগল। ঘুর্ণি ওঠা বিচিত্র নয়।

    এবার যা তুই বাহাত্তর। ঘাটে আমার কাজ আছে। হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল মালতী। পেটের কথা ভুলে গিয়েছিল। ঘাটের সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে পা রাখতেই টালমাটাল হয়ে গেল তার চলন। কাত হয়ে পড়ে আরও দুটো ধাপ গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ঘাটের সামনে জলে গিয়েই পড়ল। বাহাত্তর বুঝতেই পারল না কখন তার হাত থেকে চুরি করে আনা প্রদীপদানি জলে পড়ে গেছে। সিঁড়িতে কাত হয়ে পড়তেই মালতীর পেটের কাপড় আলগা হয়ে গেছে। দুটো হাত ছড়িয়ে নিজেকে সামলাতে গিয়ে ভরা পেট আর সামলাতে পারেনি। সিঁড়িতে, সামনের জলে ছড়িয়ে পড়েছে সন্দেশের বাক্স, কত আপেল, বড় বড় পেয়ারা, দুটো বোধহয় ডালিম। একছড়া মর্তমান কলা।

    সাঁতরে মালতীর সামনে এসে দাঁড়াল বাহাত্তর। উঠে কোমরজলে দাঁড়িয়ে আছে মালতী। মালতীকে ঘিরে ফলমূল ভেসে বেড়াচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে হাসল বাহাত্তর। হাঁ করে অসভ্যের মত কী দেখছিস ? ফুটে ওঠা স্তনবৃন্তের দিকে অসভ্যের মতই তাকিয়ে রইল বাহাত্তর। মালতীর ঠোঁটভাঙা হাসিতে কেমন যেন একটা রহস্য রয়েছে। নির্লজ্জের মতই দাঁড়িয়ে রয়েছে মালতী। তাকে অসভ্য বললেও বুক ঢাকার কোনও চেষ্টা করছে না তো। আশপাশের ভেসে-থাকা ফলমূলের দিকে তাকিয়ে বাহাত্তর বলল – প্রসাদী ফলমিষ্টি চুরি করলি! তোর ভয় করল না?

    মাথা নিচু করে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল মালতী। তার পেট এখন আবার স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। এখন হঠাৎ আবার তার লজ্জা ফিরে এসেছে। ভেজা আঁচল দিয়েই ভালো করে বুক ঢাকার চেষ্টা করল মালতী। তারপর হিসহিস করে উঠল। ভয়? সারাজীবন ধরে মালতীকেই শুধু ভয় পেয়ে যেতে হবে কেনে? মালতীরই শুধু পাপ হয়? মালতী একাই শুধু নরকের পোকা হয়ে জন্মাবে? আর সব শুকদেব গোঁসাই। অক্ষয় স্বর্গবাস তাদের। এ বাড়ির পনেরো থেকে পঁচাশি বছরের প্রত্যেকটা পুরুষমানুষকে আমার চেনা হয়ে গেছে। কেউ পাগল, কেউ সাধু। ভেতরে ভেতরে সবগুলো বজ্জাতের বাসা। আমাকে যেন খাস জমি পেয়েছে সবাই। ওদের কারও পাপ হয় না? দুটো বাতাসা, দুটো পেয়ারা বাড়িতে নিয়ে গেলেই আমি পাপী হয়ে যাব? ভগবানের একটা বিচার নাই বটে? ভয় করে বেঁচে থাকা যায়, বল। সন্দেশ খেতে কেমন ... বল, ইচ্ছে করে না?

    পেছনে তাকিয়ে বাহাত্তর আন্দাজ করার চেষ্টা করল একটু আগে সে পিলসুজটা কোথায় ফেলেছে। কোথায় সে গলাজলে দাঁড়িয়ে ছিল। বুক কেঁপে উঠল বাহাত্তরের। সব একাকার হয়ে গেছে। কোথাও কোনও চিহ্ন রেখে আসেনি সে। তুইও কেন ওভাবে তাকাস সাহেব ? আমার মন খারাপ হয়ে যায়। ছটফট করে উঠল বাহাত্তর মণ্ডল। মনে হল পুকুর থেকে পাঁক তুলে তার দিকে ছুঁড়ে মেরেছে মালতী। তার সাদা শরীর, কটা চুল, সবজেটে চোখের মণি – কে জানে কোন অচেনা গাং-এর জল তুফান তুলে ছুটে এসেছিল তার জন্মের দিকে। দিঘির শ্যামলা জলে এসে মিশেছিল ভিনদেশি কোন নোনাজল। সেই দিঘির জলে জন্ম হল তার। সে তো গোলাম। সাহেব বলে কেউ ডাক দিলে মুখটা নোনাস্বাদে ভরে ওঠে।

    রাগ করলি বাহাত্তর ? তোকে সাহেব বলে ডাক দিলে আমার কেমন যেন সুখ হয়। কিন্তু সুখটা যে কোথায় হয়, বুঝতে পারি না রে। একবার মনে হয় সুখটা বুঝি আমার শরীর বেয়ে ঠান্ডা জলের মত ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে। আবার কখনও মনে হয় সুখটা ঠান্ডা বাতাস হয়ে আমার বুকের ভেতর কুলকুল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    শুধু ঠান্ডা ? আর কিছু মনে হয় না ?
    না বাহাত্তর। ওসব কথা ভাবার সময়ই পাই না।
    এই যে বললি আমাকে সাহেব বলে ডাক দিলে তোর সুখ হয়। সময় যদি না-ই থাকে তোর, তা হলে সে সুখ কখন টের পাস তুই ?
    ও তুই বুঝবি না। সে কথা বলে দিলেও পুরুষমানুষ বুঝতে পারে না কীসে মেয়েছেলের সুখ। তোরা তো সুখের একটাই মানে বুঝিস।

    ঘাটের ওপর একটা কুচকুচে কালো দাঁড়কাক কোথা থেকে উড়ে এসে রাধামাধবের প্রসাদী সন্দেশ খাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে মালতী হেসে ফেলল। দ্যাখ, আমার পিণ্ডি খাচ্ছে। চল মালতী, দিঘিতে সাঁতার কাটি একসঙ্গে। মাঝপুকুরের গিয়ে দু’জনে একসাথে ডুব দেব। আজ নয় বাহাত্তর, আর একদিন। এখন কেউ দেখে ফেললে দু’জনেরই বদনাম ছড়াবে। বড়মার মুখ তো জানিস, মনে হয় ওর চেয়ে পিঠে দু’ঘা দিলে কষ্ট কম হত। আর একদিন, কোনও পূর্ণিমার রাতে তোর সঙ্গে সাঁতার খেলব।

    এদিক ওদিক থেকে ভেসেবেড়ানো কিছু ফল কুড়িয়ে নিল মালতী। ভেজা আঁচলে বেঁধে আমবাগানের দিকে রওনা হল। যাই, আমার জন্য বাবা বসে আছে। তোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। ডাক্তার বইলছে রোজ একটা করে ডিমসেদ্ধ, একগ্লাস দুধ আর আপেল খেতে। আঙুর, কলাও চলবে। ডিম কোথায় পাব। দুধ মাঝে সাঝে জোগাড় হয়ে যায়। ফল রোজ নিয়ে যাই। কোনও দিন সন্দেশ। হ্যাঁ, চুরিই তো করি। বেশ করি।

    ছপছপ করে মালতী হেঁটে যাচ্ছে। বাহাত্তর তাকিয়ে আছে ভিখারির মত। মালতীর যদি পেছনেও দুটো চোখ থাকত, নির্ঘাত বলত – হাঁ করে অসভ্যের মত কী দেখছিস। কিন্তু সুখের কথা কী যেন বলছিল মালতী, ধরি ধরি করেও কথাটার মানে ধরতে পারছিল না মালতী। কে জানে মেয়েছেলের সুখ কীসে। বড় পেঁচিয়ে কথা বলে এই জাতটা। আদ্ধেক কথা ফোটে, আদ্ধেক পেটে রেখে দেয়। বাহাত্তরের মত বোকাসোকা লোক কী করে মালতীর সুখের কথা বুঝতে পারবে। অথচ মালতী বলে দিল সুখের মানে নাকি ছেলেরা একটাই বোঝে। না রে মালতী, তোরাও ঠিক জানিস না। সে আমিও তোকে বোঝাতে পারব না। শরীর নিংড়ে সুখের ফোঁটা গড়িয়ে যাওয়ার পরও কী যেন একটা কথা বাকি থেকে যায়। ধরতে গেলে কচুপাতার ওপর জলের ফোঁটার মত গড়িয়ে যায়। কিন্তু ভেতর থেকে রুপোর মত কী একটা কথা যেন ঝিলমিল করে সরে সরে যায়।

    যেখানে দাঁড়িয়ে পিলসুজটা জলে ফেলে দিয়েছিল, সে জায়গাটা আরও একবার আন্দাজ করার চেষ্টা করল বাহাত্তর। তারপর হুঁশ করে ডুব দিয়ে সেদিকে ডুবসাঁতার দিয়ে এগিয়ে চলল। নীচে কালো জলের অন্ধকার। ওপরে তাকালে বাইরের পৃথিবীটা স্পষ্ট বোঝা যায় না। শুধু আকাশের আলোটুকু টের পাওয়া যায়। মাথা জলের ওপরে তুলে বুক ভরে বাতাস নিল বাহাত্তর, তারপর আবার ডুব দিল পানকৌড়ির মত।

    বিশ্বাসবাড়ির কতকালের পুরনো পিলসুজ পড়ে রয়েছে অন্ধকারে, কাদার ভেতর। দু’হাতের দশটা আঙুল দিয়ে কাদা হাতড়ে বেড়াচ্ছে বাহাত্তর। সে কতকাল আগে একদল ঘোড়সওয়ার এসে তারিণী বিশ্বাসকে দিয়েছিল এই আশ্চর্য প্রদীপদানি। সাহেবের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে বাঘ তার টুঁটি কামড়ে ধরেছে। পুতুলের মত গড়ন। তার চারপাশে চারটে বাতিদান। মাথায় বারমুখো প্রদীপ। কাদা ঘাঁটতে ঘাঁটতে লম্বা বাঁকানো যে জিনিসটার স্পর্শ পেল বাহাত্তর, বুঝল বাঘের লেজ। তাড়াতাড়ি করতে হবে। বুকের খাঁচায় বাতাস কমে আসছে। দু’হাত অঞ্জলির মত করে কাদা থেকে পিলসুজ ওঠাল বাহাত্তর। এখন আর বুকের মাঝে আগলে রাখল না। হাতের মুঠোয় জব্দ করে সবল দুটো পায়ে ধাক্কা দিল পায়ের তলার নরম মাটিতে। মাত্র তো একগলা জল, অমনিই ভুস করে ভেসে উঠল তার মাথা।

    গামছা দিয়ে গোটা বল্লভপুরের সম্পত্তি কোমরে বেঁধে নিয়েছে বাহাত্তর। আশ্চর্য প্রদীপদানির সঙ্গে কত পুরনো গল্প, ধুলোমাখা ইতিহাস, রেড়ির তেল, লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ, যুদ্ধবিগ্রহ, একদল কালোঘোড়ার সওয়ার – সব নিয়ে বাহাত্তর সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক মাঝপুকুরে। কাছাকাছি গিয়ে দেখল আশপাশের জলে অল্প ঢেউ রয়েছে, কিন্তু সেখানে জল একদম স্থির। একহাতে কোমরের গামছা খুলে জিনিসটা একবার ভালো করে দেখল বাহাত্তর। পশ্চিমের কমলাহলুদ আলো এসে পড়েছে বাঘের দাঁতে, সাহেবের মুখে, চারটে প্রদীপের ওপর। একটা দেশি বাঘ একজন বিদেশির টুঁটি টিপে মেরে ফেলছে। চারদিক থেকে আলো এসে পড়ে সেই দৃশ্যের ওপর।

    এবার বাহাত্তর দেখল দিঘির মাঝখানে জল সামান্য পাক খাচ্ছে। ফাল্গুন চৈত্রে ফাঁকা মাঠে যেমন শুকনো বাতাসের ঘুর্ণি ওঠে, ধুলোবালি, শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজ – সব শূন্যে তুলে নেয় সেই বাতাস, পুকুরের মাঝখানে ঠিক তেমন একটা জলের ঘুর্ণি আস্তে আস্তে নীচের দিকে টান দিতে শুরু করেছে। বাহাত্তরের কত বার ইচ্ছে হয়েছে গরম বাতাসের সেই ঘুর্ণির ‘চোখ’-এ ঢুকে পড়তে। দেখি না, কী হয়। যদি বাতাস তাকে শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে যায়, যদি অনেক দূরের এক অচেনা দেশে নিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়, যেখানে কেউ তাকে হারামজাদা বলবে না, বাপঠাকুরদার নাম জানতে চাইবে না।

    পুরো দিঘির জলেই এখন কাঁপন ধরেছে। হাওয়ায় তেঁতুলপাতার ঝিরিঝিরি কেঁপে ওঠার মত দিঘির জলের ওপরটা থিরথির করে কাঁপছে। মাঝখানের ‘চোখ’-এ একটু জোরে পাক ধরেছে। ছোট ছোট কচুরিপানা, মালতীর ফেলে-যাওয়া একটা আপেল, এক টুকরো কাঠ – সব খুব আস্তে আস্তে মাঝপুকুরের দিকে এগিয়ে আসছে। কে যেন আড়াল থেকে চোরাটান দিয়েছে।

    ‘চোখ’ টিপ করে পিলসুজ ছুঁড়ে দিল বাহাত্তর। মুহূর্তেই লকলক করে উঠল ঘুর্ণির জল। শোঁও শব্দে জল তাকে পাতালে টেনে নিল।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ২৮ মে ২০২১ | ২২৬৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ঘন্টাঘর - একক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন