এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • যৎকিঞ্চিত ... (৩০তম পর্ব)

    Rana Alam লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৬ নভেম্বর ২০১৪ | ৯৩৪ বার পঠিত
  • ক্লাস সেভেনের ঘরে ইংরেজি পড়াচ্ছি।কি একটা বিচ্ছিরি গ্রামাটিক্যাল কোশ্চেন ধরেছি যা আমাকে ইস্কুল লাইফে ক্যানো এখনো ধরা হলে যে বই না দেখে পারতুম না তা নিয়ে কুণাল ঘোষের ঘোষিত আত্মহত্যার মতই কোনো সংশয় নেই।তা আমিই যখন পারতুম না তখন আমার ছাত্র ছাত্রীরাই বা পারবে ক্যানো? ভালো ছেলে মেয়েগুলো একে একে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তা দেখে আমি একটু হেসে বললাম, ‘একে একে নিভিছে দেউটি’, তারপর সামনের বেঞ্চে বসা ওসামা’র দিকে তাকিয়ে বললুম,
    ‘এর মানে কি জানিস?’
    মানে টা ওর জানার কথা নয়।আমি এম্নিই জিজ্ঞেস করেছিলাম।তবু ওসামা বাহাদুর দিব্যি হেসে উত্তর দিলেন,
    ‘আপনি একা একা ডিউটি করছেন’।

    আসলে সমস্যা হচ্ছে ভাষা নিয়ে।আর এম্নিতে বাংলা ভাষাটা বড্ড গোলমেলে।আপনি কিভাবে বলছেন আর যিনি শুনছেন তিনি কিভাবে শুনছেন তার উপরেই অর্থ নির্ভর করে। মনে আছে যখন নবান্ন থেকে মুরগি’র মাংস বিক্রি হচ্ছিল,আমি এক সরকারী উচ্চপদস্থ আধিকারিক যার অফিসে নবান্নে,তাকে বলেছিলাম ‘অমুকদা,এখন তো সরকারী মুরগি’দের একটাই ঠিকানা-নবান্ন’।তা ভদ্রলোক মোটেও খুশি হোন নি।অথচ আমার বলার মধ্যে কোনো ইন্টেন্ডেড পাপ ছিল না।
    এই উল্টো মানে করার আরেকটা বড় গোলমালের উদাহরণ হল আমার ভাই অর্ক। বেশ কদিন আগে যখন সরকার বাঁধা দরে আলু বিক্রি করছিল,তখন অর্কের সাথে সায়ন্তিকা’র বাবা’র বাজারে দেখা।সায়ন্তিকা’র বাবা তখন খোলা বাজার দরেই আলু কিনছিলেন।অর্ক তাকে মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করে,
    ‘কাকু,আপনার তো আলু তো সরকারী হওয়ার কথা ছিল। বারোয়ারী হল কি করে?’
    অত্যন্ত নিরীহ প্রশ্ন,অথচ ভদ্রলোক রেগে গিয়ে অ্যাবাউট টার্ন করেন।

    ভাষা জিনিস টাই গোলমেলে তা আগেও বলেছি। জিয়াগঞ্জের দিকে যেতে একটা কাঠের দোকানের সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা আছে যে ‘এখানে সব সাইজের মাল পাওয়া যায়’। এরপরে ভাগ্যিস পরীক্ষা প্রার্থনীয় কথাটা জুড়ে দেয় নি।বহরমপুরে ব্রিজ পেরিয়ে যে হাইওয়ে টা ঢুকছে সেখানে কলেজিয়েট স্কুলের দিকে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়েছিল।উপরে লেখা ডালিয়া গারমেন্টস।তার নিচে লেখা ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টস অ্যাভলেবল হিয়ার’।

    ইস্কুলে পড়ার সময় আমার শ্রদ্ধেয় মাস্টার মশাই রা আমার নিরেট মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করেছিলেন যে ভাষাটা কিভাবে বলা হচ্ছে তার উপরেই তার অর্থ নির্ভর করে।তারপর কান ধরে বুঝিয়েছিলেন ‘গাধা’ শব্দটা অনেক রকম ভাবে বলা যায়।উচ্চারণের তারতম্যে কখনও তা গালাগাল হয়,কখনও বা নিছক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
    এই গাধা তত্ত্ব একই ভাবে আমি আমার ক্লাস সেভেনের বিচ্ছু হাসিম কে বোঝাচ্ছিলাম। বলাবাহুল্য যে কান পাকড়ে।গুরুবিদ্যা আর কি।
    তা মহামতি ঈশ্বর তো আর সবাইকে আমার মত নিরেট মাথা দেন নি,হাসিম পাকড়ানো কানে হাত বুলিয়ে আমায় বলল,
    ‘কিন্তু সার,আদর করেই বুলেন কি গাল দিয়েই বুলেন,আমি তো সেই গাধাই থাকছি। নাকি?’
    এই হাসিম কে নিয়ে অনায়াসে একটা উপন্যাস লিখে ফেলা যায়।হাসিম আর হাসমত দুজনে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু,বাংলায় যাকে বলে বুজুম ফ্রেন্ড। হাসমত পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে।হাসিম ক্লাসে একটু এগিয়ে থাকে,মানে রোজ দাঁড়ায় না।
    সেদিন ক্লাসে কি একটা পড়া ধরার ছিল।হাতে বইটা নিতেই দেখলাম হাসমত অনার স্যালুটের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেলো।আমি জিগালাম,
    ‘ কি হল এটা?’
    ‘এমনিতেও দাঁড়াতে হতোক।আপনার খাটনি বাঁচায়ে দিলাম’।,হাসমতের ঝটিতি উত্তর।
    দুটো বেঞ্চ পড়া ধরার পর দেখলাম হাসমতের পাশে হাসিমও দাঁড়িয়ে গেছে।আমি অবাক হলাম।হাসিম এই পড়াটা পারবে বলেই জানি।আবার জিগালুম,
    ‘এইটা আবার কি হইল?’
    ‘ আমার দোস্তো দাঁড়াবে তাইলে আমি কি করে বসি বোলেন সার?’,এই বলে সগর্ব দৃষ্টিতে হাসিম একবার হাসমতের দিকে তাকালো,লেনিন যদি ভালোবেসে ট্রটস্কি’র দিকে তাকাতেন তাহলে যেরকম হত সেরকম আর কি।

    ভাষা জনিত গোলমালের একটা অ্যাডাল্ট উদাহরণ দিই এবার।কদিন আগের কথা।ওমরপুর থেকে বাসে ফিরছি।লোকাল বাইপাস।বেশ ভিড়।আমি তখনও জায়গা পাইনি।সেখদিঘি থেকে এক পরিচিত উঠলেন।বাসের দুপাশের তাক গুলোও ভর্তি।ব্যাগ রাখার জায়গা নেই।পরিচিত ভদ্রলোক তার মস্ত বড় ব্যাগ হাতে নিয়ে সমস্যায়।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
    ‘কোথায় ঢোকাই বলুন তো?’
    আমি বললাম, ‘দেখুন যদি ব্যাগ ট্যাগ সরিয়ে জায়গা করা যায় যদি’।
    ভদ্রলোক তখন ঘুরে একহাতে তাকের ব্যাগ গুলো সরিয়ে আরেকহাতে নিজের ব্যাগটা জোর দিয়ে প্লেস করতে করতে দম নিয়ে বললেন,
    “না ঢোকানো অব্দি আরাম নেই’।
    ব্যাগটা রাখা হলে দম ছেড়ে শ্বাস নিয়ে উনি বললেন,
    ‘ ঢুকলো।ওহ শান্তি’।
    পাশের সহযাত্রী দাদা তখন গলা ফাটিয়ে হাসতে শুরু করেছেন।

    অর্কের ইদানীং খুব চাকচিক্য বেড়েছে,মানে পোশাক নিয়ে বেশ সচেতন থাকছে দেখছি।অর্ক এমনিতেই বাংলায় কি বলে যে সুপুরুষ তা হতভাগার ফ্রেন্ডলিস্ট দেখলেই বোঝা যায়।কিন্তু পোশাক নিয়ে সচেতনতার কারণ টা বোঝা যাচ্ছিল না।পরে জানলুম যে ব্যাটা নাকি কোন নার্সিং ট্রেনিং ইস্কুলে পড়াচ্ছে।
    গম্ভীর গলায় জিগালুম,
    ‘হ্যাঁরে,এইযে তুই নার্সিং ট্রেনিং ইস্কুলে পড়াচ্ছিস,তাতে আবার এরম সাজের বহর,টা তোর নিজেরই নার্সড হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা গজাচ্ছে নাতো?’
    অর্ক খানিক ভুঁরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
    ‘এই যে তুমি ফেসবুকে আমার ক্যারেক্টারের তেরোটা বাজিয়ে যাচ্ছো।এটা কি ঠিক হচ্ছে?’
    ‘নাহ।আমি তো জনস্বার্থে একটা তথ্য জানতে চাইছিলাম আর কি।মানে,নার্স রা তো অনেকেই বেশ চোখে পড়ার মত সুন্দরী হয় কিনা’।
    ‘অ, তা গেল বছর সিএমআরআই তে ভর্তি থাকার সময় তুমি ঠিক কতগুলো নার্সের সাথে সকাল বিকেল হেসে হেসে কথা বলতে সে তথ্যটাও জনস্বার্থে সায়ন্তিকা দি’কে জানিয়ে দিই?’
    অর্ক নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করল।
    আমি ঢোঁক গিললাম।রাগলে সায়ন্তিকা কি হতে পারে তা নিয়ে আমার অল্প বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে।মাথা চুলকে বললাম,
    ‘ইয়ে,ওরা তো সিস্টার।আর সিস্টারের সাথে কি কথা বলা যাবেনা নাকি?’
    ‘তাহলে আমার ইস্কুলের ছাত্রীরাও সিস্টার।হিসেব কমপ্লিট’।অর্ক বলল।
    কিন্তু ব্যাপারটাকে একদম উড়িয়ে দেওয়ার জন্য বললাম,
    ‘তা ওই কোনকালের সিএমআরআই এর কথা গুলো ভুলে গেলে হয় না।মানে,গীতা তে তো বলেইছে যে পুরোনো কাপড়ের মতই পুরোনো কথা ভুলে যেতে হয়।আর শাস্তর বাক্য তো অমান্য করা আমাদের সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে কিনা।তাই বলছিলাম’।
    ‘আহা,আমি তো ভুলতে রাজি আছে।সামনে শুক্কুরবার আকবরের মাতন বিরিয়ানী হলেই ভুলে যাবো।তবে...’, অর্ক থামলো।
    বেশ আশ্বস্ত হচ্ছিলাম।এই মাঝপথে ‘তবে’ শুনে আটকালুম।জিগালুম,
    ‘এই তবে টা কি? কেশে ফ্যালো’।
    অর্ক একগাল হেসে বলল,
    ‘আমি আবার নাস্তিক কিনা।মানে এইমাত্র হলুম।তাহলে গীতা মানাটা অসম্ভব।তবে যখনই মনে পড়বে তুমি বেশি না ওই এক প্লেট করে আকবরের বিরিয়ানি খাইয়ে দিও।আমি ওয়ার্ড অফ অনার দিচ্ছি যে আবার খেতে ইচ্ছে না করা অব্দি আমি বেমালুম ভুলে থাকবো’।
    হাতের কাছে কিছু ছুঁড়ে মারার জন্য খুঁজে পাওয়ার আগেই হতভাগা ছুটে ঘর থেকে পালালো।

    এ বছরই গরমের ছুটি’র মধ্যে একটা ঘটনা।ছুটির মধ্যেই একদিন স্কুলে গেছি।কিছু অফিসিয়াল কাজ ছিল।দুপুরে ফেরার সময় ওমরপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে।একটা টাটা সুমো এসে দাঁড়ালো।শাটল।সরকারী অফিসে ভাড়া খাটা গাড়ি।পিছনে একজন আছেন।গাড়ি চলার মাঝেই আলাপ হল।ড্রাইভার আর আর পিছনের ভদ্রলোক পূর্ব পরিচিত বোঝা গেল।ভদ্রলোক যে সরকারী অফিসে কাজ করেন তা আবার ঘুঁষ খাওয়ার জন্য বেশ বিখ্যাত।মাঝ বয়সী,চেহারার বিবরণ দিচ্ছিনা।উনি বললেন,
    ‘দেখুন দাদা।আমার অফিসে ঘুঁষ না খেয়ে কেউ থুতু অব্দি ফ্যালেনা।তবে কিনা আমি এই লাস্ট প্রোমোশনের পর ওসব ছেড়ে দিয়েছি।বয়স টাও তো হচ্ছে কিনা।ধম্ম কম্মে মন দিয়েছি।অফিসের ছেলে ছোকরাদের পষ্ট বলে দিয়েছি কখনও ঘুঁষের ভাগের টাকা আমার হাতে দিবিনে।সব টেবিলে রেখে যাবি’।
    বলে বেশ আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন।মুখ থেকে পানের পিক ফেলে বললেন,
    ‘নিজের হাতে ঘুঁষের টাকা নিতে পারিনা কিনা।ধম্মে লাগে।বোজেন তো?’
    আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে বুঝি।গাড়ি তখন মোড়্গ্রাম ছাড়িয়েছে। নিজে হাতে ঘুঁষ না খাওয়া দাদা তখন আমায় বললেন,
    ‘সার।এখানে গাড়ীটা দশ মিনিট দাঁড়ালে আপনার আপত্তি আছে?’
    চা খাবেন নাকি,জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলুম,তার আগেই উনি বললেন,
    ‘এইখেনে একটা গাঁজা’র ঠেক আছে।পবিতরো জাগার পাশ দিয়ে যাচ্ছি কিনা।মায়ের ইচ্ছেতে এট্টু ভিজিট দিয়ে আসি।বেশি না,মাত্তর দুটান দেবো’।বলে এমন করে আমার দিকে তাকালেন যাতে আমার অনুমতি চাইছেন।আমি আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলুম,
    ‘আপনি একা টানবেন নাকি এই ড্রাইভারও টানবে? আপনি টানুন।ক্ষতি নেই।কিন্তু ড্রাইভার টানলে আমি এখানে নেমে পরের লোকাল বাসটা ধরবো’।
    ‘না।ও ব্যাটা টানবেনা।আমি একাই’। সেই দাদা আমাকে অভয়বাণী দিলেন।ড্রাইভারের বোধহয় দু-এক সুখটান দেওয়ার ইচ্ছে ছিল,আমার আপত্তিতে বাগড়া পড়লো দেখে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে একটা বিড়ি ধরালো।
    মিনিট দুয়েক বাদে সেই দাদা বিরক্ত মুখে ফেরত এলেন।
    ‘ধুস শালা।হতভাগারা আজ বসেনি।পুলিস নাকি রেইড দিচ্ছে।পুলিসের এরম অত্যাচার চল্লে তো শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা বাঁচবে ক্যামনে বলুন তো?,বিরক্ত মুখেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
    গাড়ি আবার রওনা দিলো।পলসন্ডার আগে সেই দাদা আবার মুখ খুললেন।ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলেন,
    ‘এই রতনা,মদ খাবি?’
    ড্রাইভার দেখলাম বেশ রাজি।আমি আবার আশংকিত হয়ে জিগালুম,
    ‘এখানেই খাবেন নাকি?’
    ‘না না।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।আপনাকে নামিয়ে তাপ্পর খাবো’।আশ্বস্ত করলেন সেই দাদা।তারপর বললেন,
    ‘তাছাড়া আমি নিজের পয়সায় মদ খাইনা।মায়ের বারণ আছে।বুজলেন তো।মদ খেয়ে পয়সা নষ্ট করতে পারবনি’।
    তাহলে কিভাবে খাবেন? আমার মুখটা পাঁচের প্রশ্নমালা হয়ে যাচ্ছিল।
    নিজের হাতে ঘুঁষ না খাওয়া দাদা বললেন,
    ‘হাইওয়ে দিয়ে যে খাদ্যশস্য বা খাদ্যসামগ্রী ভর্তি লরিগুলো যাচ্ছে সেগুলো’কে আমি ইন্সপেকশন করতে পারি।ব্যাটা’রা ঠিকঠাক ট্যাক্স ছাড়াই নিয়ে যায়।একটাকে ধরবো।ওই শ পাঁচেক হলেই আজকের আমার আর রতনার খাওয়াটা হয়ে যাবে’।
    বুঝলাম যে লরিগুলো বৈধভাবে এলে যদি হাজার দু-তিনেক টাকা টযাক্স দিতে হয় টা এনাদের ঘুঁষ দিলে অর্ধেকেই হয়ে যায়।
    আমাদের গাড়ি একটা খাদ্যতেল বহনকারী লরি’কে টার্গেট করে ধাবিত হল।নিজে হাতে ঘুঁষ না খাওয়া দাদা দু হাতের তালু ঘসে আনন্দে বললেন,
    ‘কমসে কম আট নশো টাকার ফায়দা হবে।বুজলই রতনা।তোকে আজ ময়ূরের বারে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবো।মা আমার খুশি আছেন’।
    উক্ত রতন গালে ইঞ্চি তিনেক বাড়তি হাসি এনে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো।
    টার্গেট হওয়া লরি টাকে ওভারটেক করে থামিয়ে সেই দাদা ছুটে ড্রাইভারের কাছে গেলেন।শেয়াল যেমন ফাঁদে পড়া খরগোশের দিকে যায়।মিনিট তিনেক পর দেখছি খুব বিরক্ত মুখে ফিরে এসে গাড়িতে উঠলেন।ড্রাইভার দাদার মুখ দেখেই বুঝল যে ধান্দা হয় নি।অতএব সে বিরস বদনে গাড়ি স্টার্ট করলো।
    চশমা টা খুলে পকেটে রেখে দাদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
    ‘ভাবতে পারেন সার,ব্যাটার সব কাগজ ও.কে? শালার পো শালা হাজার দুয়েক ঘুঁষ দিলেই যেখানে পাঁচটা চেকপোস্ট পেরোনো যায়,সেখানে পাক্কা সাড়ে তিনহাজার টাকার ট্যাক্স গচ্চা দিয়ে মাল নিয়ে যাচ্ছে।সাধে কি বাঙালির ব্যবসা হয় না’।
    এই বলে বাঙালির ব্যবসায় অদক্ষতার প্রতি প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করে মুখ টা পার্থ চ্যাটার্জির মত করে বসে রইলেন। বাস স্ট্যান্ড ঢুকছিল।আমি পকেট থেকে টাকা বের করে ভাড়াটা ড্রাইভার কে দিতে যাচ্ছিলাম।তা দেখে সেই ঘুঁষ না খাওয়া দাদা আচমকা চাঙ্গা হয়ে বললেন,
    ‘এই রতনা।কত টাকা পেলি? সত্তর টাকা? চ,আজ বাংলা খাই গিয়ে’।
    রতনা দেখলাম বেশ খুশি মনেই রাজি।আমি নেমে গেলাম।জানালা দিয়ে আমার দিকে মুখ বাড়িয়ে সেই দাদা বললেন,
    ‘আমি ম্লেচ্ছদের বিলিতি খাই তা মা চাইছেন না।বুজলেন তো।ওইজন্য লরিটে হল না’।
    আমি একগাল হেসে সায় দিলাম।রতনা গাড়ি ঘোরালো। ঠিকঠাক পোঁছাতে পেরেছে ভেবে শ্বাস ফেললাম।সবই মায়ের ইচ্ছে।

    আমাকে ওমরপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে ভ্যানে নিয়ে যায় মুকুল।একটা হাত কনুই থেকে কাটা। এক হাতেই ভ্যান চালায় আর মুখে রাজ্যের কথা।হপ্তা দুয়েক আগে আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলো,
    ‘মাস্টার,হানিমুন কি?’
    আমি হাসলাম,‘বিয়ের ঠিক পর বর বউ একসাথে কোথাও বেড়াতে যায়।তখন সেটাকে হানিমুন বলে।তা তোর তো বিয়ের দুবছর পেরিয়ে গেছে।তোর আবার হানিমুন কি?’
    ‘আর বুলোনা মাস্টার।কাল বউ টিভিতে একটা বই দেখে আমাকে বুলল যে তুমি আমাকে হানিমুনে লিয়ে গেলানা।তাই জেনে লিলাম।তো একসাথে বেড়াতে গেলে হানিমুন হয় তাই তো?’,মুকুল জিজ্ঞেস করলো।
    আমি এতেই সায় দিলাম মাথা নেড়ে।অত মানে বোঝাতে ইচ্ছে করছিল না।
    কদিন পর বিকেলে স্কুল থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছি।দেখলাম ওদিক থেকে মুকুল ভ্যান চালিয়ে আসছে।হাত তুললাম।থামলো।জিজ্ঞেস করলাম,
    ‘যাবি তো?’
    মুকুল একগাল হেসে মাথা নাড়লো।এবার খেয়াল করলাম ভ্যানে আরেকজন বসে।মুকুলের বউ।সস্তা নতুন শাড়ি পরা বছর বিশেকের এক সলাজ কন্যা।
    ‘কোথায় যাচ্ছিস মুকুল?’,আমি জিজ্ঞেস করলাম।
    প্যাডেলে পা দিয়ে ভ্যান টা গড়িয়ে মুকুল আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
    ‘হানিমুনে যাছি মাস্টার।দুজনা মিলে ঘুরতে গেলে হানিমুন হয়,তুমিই বুল্যাছিলা’।
    আমি এবার হেসে ফেললাম।মুকুলের বউও লজ্জায় হেসে ঘোমটা টানলো।

    মুকুলের ভ্যান সামনের দিকে এগোলো।আমিও চশমা টা একবার মুছে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিলাম।
    পশ্চিমের আকাশ টা আচমকা ঝলমলিয়ে উঠলো।

    কার জন্য...কে জানে?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৬ নভেম্বর ২০১৪ | ৯৩৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 24.97.217.240 (*) | ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫২73270
  • :-) দিব্বি লাগল, যথারীতি।
    'ঘুষ' এ চন্দ্রবিন্দু হয় না।
  • Abhyu | 85.137.13.34 (*) | ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৫:২৯73271
  • বেশ হয়েছে। রাণা আপনাকে একটা মেলও করলাম।
  • Rana Alam | 113.24.111.96 (*) | ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ১১:০২73269
  • এটা ২৯তম পর্ব হবে।অত্যন্ত দুঃখিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন