এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • জুজু

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১০ এপ্রিল ২০১৪ | ৯৯১ বার পঠিত
  • ১।
    ২০১৪ সালের মার্চ। টেক্সাসের অধিবাসী পঞ্চান্ন বছরের এক ব্যক্তি নিজের মেয়ের ঘরে একটি তরুণ যুবককে আবিষ্কার করে গুলি করে মেরে ফেললেন। ছেলেটির নাম জোহরান ম্যাককরমিক। বয়স ১৭।
    খবরে প্রকাশ, মেয়েটির ভাই মেয়েটির ঘরে শুভরাত্রি বলতে গিয়ে খাটের তলায় দুখানা পা আবিষ্কার করে। বাবাকে খবর দেবার পরে, তিনি মেয়ের কাছে জানতে চান, ছেলেটিকে সে চেনে কিনা। মেয়ে অস্বীকার করে। বাবা প্রথমে পুলিশে ফোন করেন। তারপর ঘরে ঢুকলে ছেলেটি তার হাত নাড়ায় (বিপজ্জনকভাবে)। বাবা ভয় পেয়ে গুলি চালিয়ে দেন। ছেলেটি প্রায় তৎক্ষণাৎ মারা যায়। বাবাকে প্যানিক অ্যাটাকের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।
    বাবা ঠিক বলছেন কিনা, মেয়েটির অন্য কোনো বয়ান আছে কিনা (পড়ুন ছেলেটি তার বয়ফ্রেন্ড কিনা), ছেলেটির কোনো দোষ ছিল কিনা, সেসব এখনও জানা যায়নি। সেসব আদালতের বিচার্য। বাবা যদি দেখাতে পারেন, যে তিনি ভয় পেয়ে আত্মরক্ষার কারণে গুলি চালিয়েছিলেন, তাহলে সম্ভবতঃ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো চার্জ দেওয়া হবেনা, বা দিলেও আদালতে ছাড় পেয়ে যাবেন।
    বিচারে কি হবে, বা হতে পারে, সেসব নিয়ে কথা বলার জন্য অবশ্য এই লেখা নয়। আমেরিকার বন্দুক সংক্রান্ত আইনকে গাল পাড়ার জন্যও নয়। এই লেখার ফোকাল পয়েন্ট হল ভয়। মেয়েটির বাবা ভয় পেয়েছিলেন। ভয় পেয়ে গুলি চালিয়েছিলেন। এতটাই ভয় পেয়েছিলেন, যে, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। সাপও যখন কামড়ায়, লোকে বলে, ভয় পেয়েই কামড়ায়, যদিও সাপের অনুভূতির সঙ্গে মানবিক ভয়ের অনুভূতির খুব সম্ভবতঃ ওয়ান-টু-ওয়ান ম্যাপিং হয়না।
    আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বের আদত বাসিন্দা, তারা এই ভয়ের মানে ঠিক বুঝিনা। মানে, আমি অন্তত বুঝিনা। কলকাতা শহরে আপনার মেয়ের ঘরে একটি ছেলেকে মাঝরাতে আবিষ্কার করলে আপনি কি করবেন? মেয়েকে ধমকাবেন? চিল্লিয়ে পাড়াপ্রতিবেশী ডাকবেন? বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে পুলিশে খবর দেবেন? অনেককিছু করতে পারেন, কিন্তু খুব সম্ভব্তঃ ভয় পেয়ে গুলি চালিয়ে দেবেন না। অন্ততঃ গড় কলকাতাবাসী তা করবেন না।
    তার একটা কারণ অবশ্য এই, যে, কলকাতাবাসীর কাছে বন্দুক খুব সহজলভ্য নয়। দ্বিতীয় অ্যামেন্ডমেন্টের কারণে আমেরিকাবাসীর ঘরে-ঘরে বন্দুক। (কিন্তু আবার, বন্দুক আইনের নিন্দে করার জন্য এই লেখা নয়)। কিন্তু তার বাইরেও একটা অতিরিক্ত বস্তু আছে। ভয়। আমেরিকাবাসী যেভাবে ভয় পায়, কলকাতাবাসী সেভাবে পায়না। ধরুন, মাঠের মধ্যে একটি ছোট্টো গ্রামের ধারে একটেরে একটি বাড়ি। হাইওয়ে থেকে নেমে টোকা দিয়ে সামনের শহরটা কদ্দূর জিজ্ঞাসা করবেন? হিসি পেলে বাথরুম ধার চাইবেন? দেশে করতেই পারেন। কিন্তু আমেরিকায় একদম নো-নো। আমেরিকার আদি বাসিন্দারা কখনও এরকম করেনা, নবাগতদের বারন করা হয়। কারণ, অচেনা লোক দেখলে দুম করে ভিতর থেকে বন্দুক চালিয়ে দেওয়া হতে পারে। যারা চালাবে তারা খুব বদ কিছু নয়। আপনাকে মেরে ফেলে খুব আনন্দ পাবে, এমনও না। আসল কারণ হল "ভয়"। এবং সেটি চক্রাকার। অর্থাৎ ওরা আপনাকে দেখে ভয় পেয়ে গুলি চালাতে পারে। অতএব আপনিও ওদের "ভয়" পান। অচেনা লোকের বাড়িতে টোকা মারবেন না। বৃত্ত সম্পূর্ণ।
    এ তো গেল একদিক। অন্যদিকটাও দেখা যাক। ধরুন, বাড়িতে চোর ঢুকে পড়েছে, খুটখাট আওয়াজে আপনার ঘুম ভেঙে গেল। দেখলেন ছায়ামূর্তি টুকটাক করে জিনিস নিয়ে ব্যাগে পুরছে। কি করবেন? "কে র্যা" বলে চিৎকার করে উঠবেন? পাগল নাকি? ওসব কেরামতি দেখাতে যাবেন না। ভয় পাবেন। চোর দেখলেও চুপ করে বসে থাকবেন (বা শুয়ে), টুঁ শব্দটিও করবেন না। চোর যেন টেরও না পায়, আপনি তাকে দেখেছেন। তাকে শান্তিতে সব নিতে দিন। জিনিসপত্র সাফ করে বাড়ি থেকে বিদেয় হতে দিন। চলে গেলে তারপর পুলিশে ফোন করবেন। (এটা মোটেই কমন উইসডম থেকে বললাম না। এ রীতিমতো সামাজিক শিক্ষা। মাসখানেক আগে টিভির একটা অনুষ্ঠানেও এই উপদেশ শুনলাম)। মোদ্দা কথা হল, হয় ভয় পান, নয় ভয় দেখান। হয় খাদ্য হোক কিংবা খাদক। ব্যস।
    এর মানে কি এই, যে, প্রথম বিশ্বের লোক সতত ভয়ে মরে আছে? মোটেও না। তারা রাস্তায়-ঘাটে দিব্যি হাহা করে ঘুরছে। খুবই হাসিখুশি। অচেনা লোকের সঙ্গে দেখা হলে ছুঁড়ে দিচ্ছে সৌহার্দ্যপূর্ণ হাসি। হোঁচট খেয়ে আপনি দুম করে পড়ে গেলে দেশের মতো লোকে মুখ বাঁকিয়ে চলে যাচ্ছেনা, বরং হাত বাড়িয়ে তোলার জন্য দৌড়ে যাচ্ছে। অ্যাক্সিডেন্ট হলে দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশে খবর দিচ্ছে। প্রয়োজনে পরোপকার করার জন্য আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
    তাহলে ভয়টা কিসে? এক লাইনে অ্যাপ্রক্সিমেট করে বললে, এরকমঃ "নিজস্ব স্পেসে অচেনা লোককে বিশ্বাস কোরোনা। ব্যক্তিগত স্পেসে আগন্তুক এসে পড়লে তাকে ভয় পাও।" অর্থাৎ, রাস্তায় একটি ছেলেকে দেখলে হাসুন, কিন্তু সে যদি আপনার বাড়ির বাগানে ফুল চুরি করতে আসে, তবে তাকে ভয় পান। অচেনা লোককে বিপদে আপদে সাহায্য করুন, কিন্তু কখনও নিজের গাড়ির একান্ত নির্জনতায় তুলবেন না। মেয়েদের বলা হয় যেখানে যা খুশি কর, কিন্তু কেউ গাড়িতে রাইড দিতে চাইলে নিও না। বাচ্চাদের বলা হয়, অচেনা লোক ল্যাবেঞ্চুষ দিতে এলে নিওনা। এই ভয় পাওয়ার শিক্ষা সর্বস্তরে। ইশকুল, কলেজ, পাড়া, পরিবার, টিভি, মিডিয়া। পাড়ায় খেলতে গিয়ে বাচ্চাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা? দশ মিনিট দেখুন, না পেলে পুলিশে ফোন করুন। সে হয়তো তার বন্ধুর বাড়িতে ঢুকে পড়ে স্লাইট গজল্লা দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কি? বিপদ ঘটতে কতক্ষণ? একদম নিশ্চিন্ত থাকবেন না, কারণ বাচ্চাকে যে কেউ কিডন্যাপ করতে পারে। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর। টিভিতে-গণমাধ্যমে প্রতিটি কিডন্যাপিং এর বিশদ বর্ণনা আপনি পড়েননি বা দেখেননি? অচেনা লোকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাদের জাস্ট গুমখুন করে ফেলে, আপনি জানেন না? পাড়ার ওয়ালমার্টের দেয়ালে দেখেননি রাশিরাশি হারিয়ে যাওয়া শিশুর ছবি? টিভিতে দেখেননি, সেই মেয়েটির কথা, যে অচেনা লোকের গাড়িতে উঠেছিল ভুল করে, আর তারপরে তাকে এক অচেনা বাড়িতে বেসমেন্টে কুড়ি বছর আটকে রাখা হয়েছিল সেক্স স্লেভ করে? অতএব, ভয় পান। গণমাধ্যম ও সামাজিক স্তরে ভয়ের চাষবাস হচ্ছে, তাতে সাবস্ক্রাইব করুন। অচেনা, অগোছালো আগন্তুককে সন্দেহ করুন। আত্মরক্ষায় সতর্ক হোন।
    এসবের কোনোটাই মিথ্যে নয়। সত্যিই তো লোকে লোককে খুন করে। মেয়েদের গাড়িতে তুলে ধর্ষণ করে গুমখুন করা হয়। লাশ পাওয়া যায়না। সংখ্যায় কত হয়, বা কোথায় হয়, সে অন্য কথা। কিন্তু লোকে ভয় পায়। সর্বত্রই পায়। এই ভয় থেকেই টেক্সাসের পঞ্চান্ন বছরের লোকটি মেয়ের ঘরে, একটি ছেলেকে জাস্ট গুলি করে মেরে ফেলেন। তারপর নিজেও প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে পোঁছে যান হাসপাতালে।

    ২।
    প্রশ্ন হচ্ছে, মানে হতেই পারে, যে, এসব জুজু কেন (লেখার শিরোনামে সেরকমই ইঙ্গিত দেওয়া আছে)। লোকে সতর্ক হচ্ছে, ভালই তো। জুজু-টুজু বলার দরকার কি। যদিও এই লেখার বিষয় একেবারেই, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ, তাতে নিবদ্ধ নেই, অন্তত শুরুর সময় ভাবা হয়নি, এখনও নৈতিক কোনো অবস্থান নেবার কথা ভাবাই হচ্ছেনা, কিন্তু ব্লগের পাতা তো, দু চার লাইন লিখেই ফেলা যাক। যে, জুজু কেন।
    তা, কথা হল দুটো।
    এক। ভয় বা সতর্কতা, যে নামেই ডাকুন, সেটা কোনো একমুখী প্রক্রিয়া নয়। আপনি ভয় পাচ্ছেন মানেই ভয়ের একটা সামাজিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, আকাশ থেকে ভয় পাচ্ছেন না। ধরুন, আপনি রাত্তির দশটায় একা রাস্তায় হেঁটে বাড়িতে ফেরা বিপজ্জনক মনে করছেন। এখানে আপনি মানে ঠিক আপনি নন, সমাজের একটা বড়ো অংশ তাইই ভাবছে। অতএব, রাত দশটায় রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যাচ্ছে। এটা ভয়ের একটা সামাজিক ক্ষেত্র তৈরি করছে, যেখানে সম্ভাব্য অপরাধীও ভাবছে, রাত্তির দশটায় রাস্তায় হাঁটা একা লোক মানেই ভালনারেবল। আক্রমণের যোগ্য। অর্থাৎ রাত দশটায় ফাঁকা রাস্তায় অপরাধের একটা সামাজিক ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এবং সেটার উৎস এই চক্রাকার ভয় পাওয়াই। উৎস না হলেও, রাত দশটায় আক্রমনের সম্ভাব্যতা বাড়ার পিছনে একটা বড়ো কারণ তো বটেই।
    একই ভাবে আপনি যখন ভাবছেন, বিপদে পড়ে অন্যের গাড়ির বদান্যতা নেওয়া বিপজ্জনক ব্যাপার, নিশ্চিন্ত থাকুন, ওই একই চিন্তা যিনি আপনাকে সাহায্য করতে চাইছেন, তাঁর মধ্যেও কাজ করছে। ইতিপূর্বে গাড়িতে তোলার সঙ্গে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক আছে যে জানতনা বা ভাবেনি, সেও এই সামাজিক ধারণার অংশীদার হচ্ছে। যে ট্যাক্সিড্রাইভার কখনও তার আরোহীর সুযোগ নেবার কথা ভাবেনি, এই "ভয়" বা "সন্দেহ"এর আবহে ভেবে ফেলছে, যে, একাকী আরোহী মাত্রেই ভালনারেবল। সম্ভাবনা বাড়ছে অপরাধের।

    দুই। এই চক্রাকার ভয়ের আবহে পুরো ব্যাপারটা একটা হাস্যকর অস্ত্রপ্রতিযোগিতার মতো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সবাই সবার সম্পর্কে সতর্ক হচ্ছে। আড়ালে যুদ্ধাস্ত্র শানাচ্ছে। আপনি প্রথম চাল দিচ্ছেন, একাকী ট্যাক্সিতে না ওঠার চেষ্টা করে। ট্যাক্সিওয়ালা জানছে একাকী যাত্রী মানেই ভালনারেবল। সময় পেলেই সে সুযোগ নেবার চেষ্টা করছে। খুন-ছিনতাই-ধর্ষণ ছাড়াও সুযোগ নেওয়া যায়। আপনার দিকে সে সমানে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আপনার অস্বস্তিতে আনন্দ পাচ্ছে। আপনি প্রতিক্রিয়ায় আরও সতর্ক হয়ে সঙ্গে একটা ছুরি রাখছেন। আপনার কাছে ছুরি থাকতে পারে, এটা জানাজানি হবার পর ট্যাক্সিওয়ালাও একটা ছুরি রাখতে শুরু করছে। একই সমাজে পাশাপাশি হৃদ্যতায় বাঁচা দুজন মানুষ একাকী এনকাউন্টারে হয়ে উঠছে শীতল যুদ্ধ। মাঝখানে উঠছে দেয়াল।
    এই চক্রাকার ভয় ও দেয়াল, কোনো রকম নৈতিক চরিত্র আরোপ করার চেষ্টা না করেও, নিশ্চিতভাবেই, একটি লুজ-লুজ গেম। গত শতাব্দীর দুই মহা শক্তিধরের অস্ত্রপ্রতিযোগিতার মতই, তা কারো উপকারই করেনা। কিন্তু বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। সেই জন্যই এই ভয় শুধু ভয় নয়, জুজু।
    (চলবে)
    ৩।
    আমেরিকা দিয়ে শুরু হলেও এইটা ঠিক আমেরিকার কথা লেখা হচ্ছে না। বস্তুত বন্দুক আইন, সাম্রাজ্যবাদ, মার্ক্স, পুঁজি, ফ্রয়েড, এসব এখানে ধরাই হচ্ছেনা। এমনকি অন্ধের যষ্টি উত্তরাধুনিকও হচ্ছেনা। আমরা এখানে কেবল ভয়ের অ্যানাটমি নিয়ে খেলছি। উৎস সন্ধান করছিনা। যে ভয়ের সাম্রাজ্য এই মূহুর্তে দুনিয়াজোড়া, বহুরূপে সম্মুখে তোমার, যে জুজুরা নানা আকারে ও ফর্মে চারিদিকে বিরাজমান, তাদের টুকরোটাকরা নিয়েই এই লেখা। ব্লগে লিখছি, এডিটিং এর সুযোগ নেই, ফলে একটু অগোছালো হবে। আগেরটা পরে ও পরেরটা আগে চলে যাবে, সেইটা, যারা পড়বেন, একটু মানিয়ে নেবেন। নাও নিতে পারেন, তাহলে পড়বেন না, কিংবা গাল দেবেন, যেটা খুশি।
    তো, সে যাই হোক, কথা হচ্ছে, এই ভয় ও সতর্কতার সাম্রাজ্য অনেক বড়ো। একে আমরা গ্লোবাল জুজু বলতে পারি। স্রেফ আমেরিকা নয়, পৃথিবীর উল্টোদিকেও এর প্রাদুর্ভাব আছে। অনেককাল আগে গুরুর পাতায় দময়ন্তী "নিরাপত্তা" নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখাটির নাম সুরক্ষাচক্র। (খুঁজেপেতে লিংক দিলাম, ইচ্ছে হলে পুরোটা পড়ে নেবেনঃ http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?portletId=12&pid=content/bulbulbhaja/1225013717882.htm )। সেই লেখাতেও ভয়ের এই দুটি চরিত্র, অর্থাৎ চক্রাকারত্ব আর ব্যক্তি মানুষদের মাঝে উঠে আসা দেয়াল, একদম পরিস্ফুট।
    লেখাটা কি নিয়ে? কোট করা যাক।
    "আজকাল যত বড় বড় হোর্ডিং দেখি রাস্তার ধারে, তার বেশীরভাগটাই থাকে কোন না কোন হাউসিং কমপ্লেক্সের বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন সুযোগসুবিধার সাথে সাথে তাতে অতি অবশ্যই থাকবে সুরক্ষা সংক্রান্ত আশ্বাস। কেউ দেন ২৪ ঘন্টা সুরক্ষাকর্মী মোতায়েন রাখার আশ্বাস, তো কেউবা ক্লোজড সার্কিট টিভি দিয়ে নজরদারীর দাবী করেন। আমরা তাই দেখে আশ্বস্ত হই, পরিচিত ও বন্ধুমহলে আলোচনা করি কোন কমপ্লেক্স কত 'নিরাপদ'। বাড়ীভাড়া নেবার সময়ে তো নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ খুঁটিয়েই দেখি। যাঁরা কেনেন তাঁরাও গর্বভরে জানান কত সুরক্ষিত তাঁদের কমপ্লেক্স, হাল্কা করে প্রতিযোগিতাও চলে সুরক্ষার বিভিন্ন স্তর নিয়ে।"
    এই সুরক্ষা বা সতর্কতা কিরকম?
    ।।।।
    "এর বেশ কিছুদিন বাদে আমি পুণে চলে আসি আর এরকমই এক সুরক্ষিত টাউনশিপের একটি কমপ্লেক্সের এক বাড়ীতে বসবাস শুরু করি। এতদিন আলাদা বাড়ীতে থাকায় অনেক ব্যপার তেমনভাবে চোখে পড়েনি , যা এখন চোখে পড়ে। লক্ষ করি সমগ্র টাউনশীপটি অসম্ভব সুন্দর সবুজ। ফুটপাথের মাঝে মাঝে বাগান করা, ধারে ধারে অজস্র বড় গাছ রাস্তাগুলিকে ছায়ায় ঢেকে রাখে। ভোর ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মালীরা কাজ করে যায়, ডাল ছাঁটে, আগাছা তোলে, গাছে জল দেয়, রাস্তা থেকে শুকনো পাতা কুড়ায়। কিন্তু রাত দশটার পর তারা সবাই দলবেঁধে টাউনশীপের বাইরে চলে যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সকাল ৭টার আগে তাদের ভেতরে প্রবেশাধিকার নেই। দলেদলে কাজের মেয়েরাও ৭টার আগে ঢুকতে পারে না। এই টাউনশীপের ভিতরে অজস্র অফিস, একটি মার্কেট কমপ্লেক্স ও ১২ টি হাউসিং কমপ্লেক্স আছে। এছাড়াও একটিউ শপিং মল ও একটি মাল্টিপ্লেক্স নির্মীয়মাণ অবস্থায়। ১২টি হাউসিং কমপ্লেক্সের প্রতিটিতে ২৬টি করে ১০ তলা বাড়ী আছে। প্রতিতলায় ৪টি করে ফ্ল্যাট। তা, এই বিশালসংখ্যক লোকের বিভিন্ন পরিষেবা যোগাতে বহুসংখ্যক লোকের প্রয়োজন হয়। এই পরিষেবা সরবরাহকারীদের মধ্যে একমাত্র রাতের ডিউটিতে থাকা সুরক্ষাকমীগণ এবং অল্প কিছু মেরামতি কর্মী টাউনশীপের ভিতরে রাত্রিবাস করে। সমস্ত পরিষেবাকর্মীর নিজস্ব পরিচয়পত্র আছে, তা তাকে কাজের জায়গায় কর্তৃপক্ষের কাউকে দিয়ে সই করিয়ে আনতে হয়। বছরে একবার করে পুনর্নবীকরণ করাতে হয়। গৃহসহায়তাকারীদের, তারা যতগুলি বাড়ীতে কাজ করে, প্রত্যেক বাড়ীর মালিক কিম্বা মালকিনের স্বাক্ষর নিয়ে আসতে হয়। তাদের পরিচয়পত্রে প্রতিটি বাড়ীর মালিকের নাম, ঠিকানা উল্লেখ থাকে। হাউসিং কমপ্লেক্সে ঢোকার সময় সুরক্ষাকর্মীর কাছে পরিচয়পত্র জমা রেখে ঢুকতে হয়, বেরিয়ে যাবার সময় ফেরত পায়।"
    কাদের থেকে সুরক্ষা?
    ।।।।
    "কিছুদিন লক্ষ করে বুঝতে পারি এই বিশালসংখ্যক পরিষেবাকর্মী আসলে বাসিন্দাদের কাছে অদৃশ্য। আমরা শুধু পরিষেবাটুকু নিই, কিন্তু পরিষেবাপ্রদানকারী হাত বা মুখগুলোকে দেখতে পাই না। কলে গরমজল না এলে একটা নাম্বারে ফোন করি, কিছুক্ষণ বাদে ঠিক হয়ে যায়। লিফট না চললে আর একটা নাম্বারে ফোন করি, ঠিক হয়ে যায়। ফলে, আমরা শুধু নিজেদের মুখই দেখি, সেই একই মুখ, যা হাঁটাপথে অফিস যাওয়ার সময়, কিম্বা অফিস পৌঁছে দেখেছি, সেই একই মুখ, যা জিমে কিম্বা সুইমিং পুলে দেখেছি, সেই একই মুখ যা পেস্ট্রীশপে দেখলাম, সেই একই মুখ যা আবার দেওয়ালী মেলায় গয়নার দোকানে দেখি, সেই একই মুখ যা নাকি ভারতের অ্যাস্পায়ারিং মিডলক্লাসের মুখ, শাইনিং ইন্ডিয়ার মুখ। আমাদের চারপাশে কোন গরীব নেই। খুব গরীব তো দুরস্থান, কোন অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের লোকও নেই। আমাদের চারপাশে ঠিক আমাদেরই মত লোকজন। আচ্ছা ইংরাজরা আমাদের শাসন করার সময় ঠিক এরকম ঘেটো বানিয়েই থাকত না? অনুমতি ছাড়া 'নেটিভ'দের প্রবেশাধিকার ছিল না সেইসব গৃহে। একইভাবে আমাদেরই কোন না কোন পূর্বপুরুষ এমনভাবেই হয়ত অনুমতিপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে সাহেবের প্রয়োজনীয় পরিষেবাটুকু দিয়ে আসতেন। সাহেবদের চোখে তাঁরাও ছিলেন এরকমই অদৃশ্য, ণোন-এক্ষিস্তেন্ত।"

    লক্ষ্য করে দেখুন, চক্রাকার একটি ভয়ের বৃত্ত এখানেও। "নিজস্ব জায়গায় বহিরাগত মানেই সন্দেহজনক।" অতএব, বহিরাগতদের থেকে সতর্ক থাকুন। তাদের প্রবেশাধিকার দেবেন না। এটা একদিকে সতর্কতা ও নিরাপত্তা বাড়াচ্ছে। সঙ্গে বাড়াচ্ছে ভয়। যে, বাইরের পৃথিবী শ্বাপদসঙ্কুল। ওখান থেকে দূরে থাকুন। কেউ ঢুকতে এলে আটকে দিন। পাড়ার ছেলেরা ফুল চুরি করতে এলে নিরাপত্তারক্ষীদের খবর দিন। উল্টোদিকে যাদেরকে ভয়, তারাও জেনে যাচ্ছে, যে, এই চত্বরে তাদের ভয় করা হয়। স্বাভাবিকভাবে ঢোকা-বেরোনো যায়না। ঢুকতে গেলে ম্যানিপুলেট করতে হয়। যেমন ফাইভ স্টার হোটেলে পাড়ার ছিঁচকে ছেলে চান্স পেয়ে ঢুকে পড়লে বাথরুম থেকে অন্তত দুটো সাবান ঝেড়ে আনবেই, এনে বন্ধুবান্ধবদের দেখাবে, সেরকম।
    এবং ভয়ের বৃত্তের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে দেওয়াল। অ্যাস্পায়ারিং মিডল ক্লাস, তাদের সঙ্গে বাকি "নেটিভ"দের। সায়েবদের সঙ্গে তুলনাটা তো একেবারে খাপে খাপ। সায়েবদের সঙ্গে নেটিভদের সত্যি সত্যিই অবিকল একই রকম সম্পর্ক ছিল। সায়েবরা ভারতীয় চাকরবাকরদের চোর-চোট্টা বলে দূরে সরিয়ে রাখতেন, এবং মজা হচ্ছে, চক্রাকারে, ভারতীয় চাকর-বাকররাও চুরি করে ফাটিয়ে দিত। মর্যাদার যে একটা বিরাট পার্থক্য ছিল, তার প্রাথমিক সাক্ষী আমাদের ভাষা। আমার আগের বাক্যটাই যদি পড়েন, তাহলে দেখবেন, সায়েবদের প্রসঙ্গে "আপনি" বলা হচ্ছে, আর চাকর-বাকরদের প্রসঙ্গে তুমি। ইচ্ছে করলেই একটু কায়দা করে বাক্যটা অন্যরকম করে লেখা যেত, কিন্তু থাক না, ব্লগই তো। :)
    তা, ব্লগই যখন, আর সায়েবদের কথা উঠলই যখন, এক জনৈক মেম সায়েবের স্মৃতিকথা থেকে চার লাইন কোট করার লোভ সামলানো যাচ্ছে না।
    জনৈকা এলিজা ফে, ১৭৮০ সালে তাঁর লেখা একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন, "অন্য কথা ছেড়ে দিয়ে আমার ঘরের কথা বলি। ঘরবাড়ির কোনো খুঁত নেই কোথাও। কিন্তু তা না থাকলে কি হবে, চারিদিকের চোর-ছ্যাঁচোড়ের উপদ্রবে তিষ্ঠবার উপায় নেই। ইংলন্ডে ভৃত্যরা বদমায়েস হলে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়, অথবা কর্মচ্যুত করা হয়। অন্য ভৃত্যরা তাই দেখে শিক্ষালাভ করে এবং সাবধান হয়ে যায়। এদেশের ভৃত্যদের মানুষ হিসেবে কোনো মর্যাদাবোধ নেই। কটু কথা বললে বা অপমান করলে তারা লজ্জা পায়না। দু-একটা দৃষ্টান্ত দিলে আমার এই ভৃত্য-বেষ্টিত শোচনীয় অবস্থাটা তোমরা বুঝতে পারবে।" (অনুবাদ বিনয় ঘোষ)
    এই একই গপ্পো হিকি সায়েবেরও। কিন্তু সেসব লিখতে গেলে পাতার পর পাতা টুকতে হয়। মোদ্দা গপ্পোটা হল, (নেটিভ)ভৃত্যরা একটি আলাদা গোত্রের জীব। নীচু মানের। তাদের মধ্যে থেকেও সতর্ক হয়ে থাকতে হয়। মজা হচ্ছে, ওই সময়ের সায়েবদের গপ্পে দেশীয় লোক মানেই হয় ভৃত্য, নয় ধুরন্ধর কেরানি (তারা সংখ্যায় কম)। এর বাইরে বিশেষ কেউ নেই।
    দুশো-আড়াইশো বছরেও ভয়-সুরক্ষা-দেয়ালের গল্প বদলায়নি। এ নিয়ে একটা ইতিহাস লিখলে ভালো হত।

    (চলবে)
    ৪।
    ইতিহাস বলতে মনে পড়ল। ভাটে আর্কাইভের সমস্যা নিয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের ইতিহাসের কোনো আর্কাইভ নেই। এই ভয়ের ইতিহাস লিখতে পারলে ভালই হত। কিন্তু তার মালমশলা বোধহয় আর নেই। বোধহয় টা রাখতেই হবে, কারণ নিশ্চিত করে তো কিছু বলতে পারিনা। ওদিকে আমেরিকার সেই "বোধহয়"এর সমস্যা নেই। আমেরিকানদের "জুজু"র ইতিহাস নিয়ে মাইকেল মুর সায়েব, এক চমৎকার ব্যঙ্গচিত্র বানিয়েছেন একখানি সিনেমার মধ্যে। সিনেমার নাম বোলিং ফর কলম্বাইন। আর ব্যঙ্গচিত্র, তথা সিনেমাটিক প্যারাবলটির, বলাবাহুল্য কোনো নাম নেই। নাম নেই একেবারে তাও নয়, ইয়ার্কি মেরে ওটাকে "ব্রিফ হিস্ট্রি অফ আমেরিকা" বলা হয়েছে। তা সেটা এখানে একটু লিখিত ভাষায় লিখে দিলে মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক হবেনা।
    মুর সায়েব দেখাচ্ছেন, (বা ইয়ার্কি মারছেন), যে, আমেরিকার ইতিহাস শুরু হয় ভয় থেকে। একদল ইউরোপিয়ান, যাদের নাম পিলগ্রিম, তারা ইউরোপে নিজেদের অপরাধের শাস্তি পাবার ভয় পাচ্ছিল। ভয়ের চোটে তারা জাহাজে উঠে পড়ে। এবং আমেরিকায় হাজির হয়। সেখানে গেলে আর নাকি ভয় পাবার কারণ নেই। তারা বেশ নিরাপদ বোধ করছিল, কিন্তু ওমা, আমেরিকায় পৌঁছতেই একদল দেশীয় বর্বরের (আমেরিকান ইন্ডিয়ান), সঙ্গে সাক্ষাৎ। ব্যস তারা আবার ভয় পেয়ে গেল। ব্যস, ভয় পেয়ে দুম দুম দুম। এবং শান্তি।
    কিন্তু শান্তি কোথায়? তারপরেই তারা ব্রিটিশদের ভয় পেতে শুরু করল। এবং আবার দুমদুমদুম। ব্রিটিশরা যাবার পর কোথায় নিরাপদ বোধ করবে, তা না কোথায় কি, তাদের ভয় আরো বেড়ে গেল। এবং দ্বিতীয় অ্যামেন্ডমেন্ট পাশ করিয়ে ফেলা হল।
    এবং আমেরিকানরা শান্তিমনে আফ্রিকা গেয়ে গাদাগাদা কালো লোককে ধরে বেঁধে আনল। এবং বিনিপয়সায় খাটিয়ে বড়লোক হয়ে গেল। তারপরে কি শান্তি? মোটেও না, তারা এবার কালো লোকেদেরই ভয় পেতে শুরু করল। আরও বন্দুক টন্দুক কিনে একশা করল।
    তারপরে তো কালো লোকেরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেল। লোকেরা তখন আরও ভয় পেয়ে গেল। এখন নির্ঘাত এরা প্রতিশোধ নেবে। চারদিকে নেমে এল ভয়ের রাজত্ব। সবাই ভীত ও সন্ত্রস্ত।
    কিন্তু কালো লোকেরা কোনো প্রতিশোধ নিলনা। সাদারা তাই আরও ভয় পেয়ে তৈরি করে ফেলল ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান।
    তারপর আরও নানা কিছু হল। সিভিল লিবার্টি, হাবিজাবি। কালো লোকেরা শহরে এসে বসবাস শুরু করল। সাদারা ভয় পেয়ে পালাল শহরতলীতে। যেখানে চাদ্দিক ফাঁকা। লোকজন বিশেষ নেই। দরজা বন্ধ করে বন্দুক হাতে তারা বসে থাকতে শুরু করল্বাড়ির মধ্যে। ভয়ের চোটে। অ্যান্ড দে হ্যাপিলি লিভড এভার আফটার।
    এই হল আমেরিকান জুজুর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। জুজু, হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে যাবার গপ্পো আর কি।
    কিন্তু যেকথা বলছিলাম। ভারতীয় ভয়ের এরকম একটা ইতিহাস নির্ঘাত লেখা যেত। ইয়ার্কি মেরেই হল না হয়। কিন্তু সে মালমশলা পাওয়া মুশকিল।

    (আজকে আর চলবেনা, আবার পরে চলবে)
    ৫।
    তবে ইতিহাস না থাকলে কী হবে, আমরা মিনির মা'র গপ্পো জানি। সেও তো ইতিহাসের টুকরো বটেই। মাটি খুঁড়ে ইয়াব্বড়ো মোহরের ঘড়া বেরোলো, কিংবা পুরোনো গোয়ালের খড়বিচালি থেকে বেরিয়ে এল প্রাচীন পুঁথি, তারপর আমরা টেবিল ও প্রত্নতত্ত্ব বাগিয়ে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যয়ের মতো ইতিহাস লিখতে বসলাম, ওসব প্রথাগত পরম্পরা তো কবেই কাটিয়ে দিয়েছি। এখন সকলই আখ্যান, যার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যায় ইতিহাসের বাগানবাড়ি। অতএব গপ্পোগাছা থেকেই কোট করা যাক। হ্যাঁ, রবিঠাকুরের কাবুলিওয়ালার মিনির মায়ের কথাই বলছি। নেহাৎই শহুরে গৃহিণী হয়েও যিনি সতত জুজুর ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন। বিপদ কোনদিক থেকে আসবে তো কেউ জানেনা। এই নশ্বর অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে যেকোনো দিক থেকে হানা দিতে পারে ঝঞ্ঝা। তাই সর্বসময় সর্বতোভাবে সতর্ক হয়ে থাকাটা তাঁর অস্তিত্বের অংশ। বাঁচতে হলে সতর্ক হয়ে বাঁচুন। নিশ্ছিদ্র সতর্কতা অবলম্বন করুন। বাঁচতে হলে ভয়ে বাঁচুন।

    "মিনির মা অত্যন্ত শঙ্কিত স্বভাবের লোক। রাস্তায় একটা শব্দ শুনিলেই তাঁহার মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত মাতাল আমাদের বাড়িটাই বিশেষ লক্ষ্য করিয়া ছুটিয়া আসিতেছে। এই পৃথিবীটা যে সর্বত্রই চোর ডাকাত মাতাল সাপ বাঘ ম্যালেরিয়া শুঁয়াপোকা আরসোলা এবং গোরার দ্বারা পরিপূর্ণ, এতদিন (খুব বেশি দিন নহে) পৃথিবীতে বাস করিয়াও সে বিভীষিকা তাঁহার মন হইতে দূর হইয়া যায় নাই।
    রহমত কাবুলিওয়ালা সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ নিঃসংশয় ছিলেন না। তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখিবার জন্য তিনি আমাকে বারবার অনুরোধ করিয়াছিলেন। আমি তাঁহার সন্দেহ হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিলে তিনি পর্যায়ক্রমে আমাকে গুটিকতক প্রশ্ন করিলেন, 'কখনো কি কাহারো ছেলে চুরি যায় না। কাবুলদেশে কি দাসব্যবসা প্রচলিত নাই। একজন প্রকাণ্ড কাবুলির পক্ষে একটি ছোটো ছেলে চুরি করিয়া লইয়া যাওয়া একেবারেই কি অসম্ভব।'"

    সকলেরই পড়া টেক্সট। তবুও এইখানে দুটি জিনিস লক্ষ্য করতে বলব। এক তো স্টিরিওটাইপিং। "মেয়েরা আরশোলায় ভয় পায়" জাতীয় স্টিরিওটাইপিং ব্যবহার করে, এখানে হাস্যরসের সঞ্চার করা হয়েছে। স্টিরিওটাইপিংটি প্রকট নয়, শৈল্পিক ও প্রচ্ছন্ন। (কেউ আবার ভাববেন না লেখককে গাল দিচ্ছি। মোটেও দিচ্ছি না। অন্য সব কিছুর মতই স্টিরিওটাইপিং এরও দুই দিক থাকে। মানে, পুরুষ লেখক জোর করে মেয়েদের আরশোলায় ভয় পাওয়াচ্ছেন, এমন একেবারেই নয়। কিন্তু সে অন্য গপ্পো, তাতে আমরা এখানে ঢুকছি না।)দুই হল হাস্যরস। হাস্যরসটা এখানে তৈরি হয়েছে কেন? কারণ, পুরো ভয় পাওয়াটাতে কোনো সিরিয়াসনেস আরোপ করা হচ্ছেনা। এই ভয় পাওয়া জিনিসটাই এখানে খুব লঘু। হাস্যকর (স্টিরিওটাইপিং সেটা জোরদার করেছে?)। সেইজন্য হাসি পাচ্ছে। এবং সে কারণেই এতে গুরুত্ব দেবার কোনো প্রশ্নই নেই। সেই কারণেই এর পরেই লেখক লিখছেন, "আমাকে মানিতে হইল, ব্যাপারটা যে অসম্ভব তাহা নহে কিন্তু অবিশ্বাস্য। বিশ্বাস করিবার শক্তি সকলের সমান নহে, এইজন্য আমার স্ত্রীর মনে ভয় রহিয়া গেল। কিন্তু তাই বলিয়া বিনা দোষে রহমতকে আমাদের বাড়িতে আসিতে নিষেধ করিতে পারিলাম না।"
    বক্তব্য পরিষ্কার। ভয়টি নেহাৎই অমূলক। এবং এই ভয়টি "মিনির মা"র সমস্যা। উনি যাতে ভয় পান, জগতে সেসব কি আর হয়না? চুরি, ছিনতাই, ছেলেধরা? হয় তো বটেই। কিন্তু সেসব মোটেও গুরুত্ব দেবার বিষয় নয়।
    আজও আমরা গপ্পের এই অংশটুকু পড়ে হাসি। অথচ, মজা হচ্ছে, ১৮৯৩ সালে মিনির মায়ের যে ভয় অমূলক ছিল, সেগুলো আজকে আর অমূলক নেই। মানে আমাদের কাছে নেই। মিনির মায়ের ভয়ের জায়গাটা কি? সেই একই, অর্থাৎ "বাইরের পৃথিবীকে ব্যক্তিগত স্পেসে সন্দেহ করো। ভয় পাও"। সিধে বাংলায় "অচেনা কাবুলিওয়ালাকে সন্দেহ করো, ভয় পাও"। প্রথম অনুচ্ছেদে তো অবিকল এই একই ভয়ের কথা বলেছি। এই সেই একই ভয় যে কারণে আমরা সামাজিক ভাবে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে চলেছি। বিশ্বের সর্বত্র। এই একই ভয়ে মেয়ের ঘরে ১৭ বছরের ম্যাককরমিককে গুলি করে মেরে ফেললেন পঞ্চান্ন বছরের এক ব্যক্তি। এই একই ভয়ে আমরা অচেনা ট্যাক্সিড্রাইভারকে সন্দেহ করছি। এই একই ভয়ে আমেরিকানরা আশ্রয় নিচ্ছে শহরতলীতে, আর আমরা বানিয়ে চলেছি সুরক্ষাচক্র। তাতে আমাদের হাসি পায়না, কারণ এখানে ভয়ের প্রক্রিয়াটা সামাজিক। "মিনির মা"কে দেখলে তৈরি হয় হাস্যরস। কারণ তাঁর ভয়টি ব্যক্তিগত। আরশোলাকে ভয় পাবার মতই অমূলক ও হাস্যকর।
    এবং, আরেকবার। এখানে কোনো নৈতিক অবস্থান নেওয়া একেবারেই হচ্ছেনা। কোনো আমেরিকানকে গিয়ে কলার ধরে "আপনিও তো মশাই মিনির মা" বলে হ্যাহ্যা করে হাসা হচ্ছেনা। প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ভয় পাবার নিজস্ব কারণ আছে। থাকতেই পারে। তা যৌক্তিক বা অযৌক্তিক যা খুশি হতে পারে, সেই তক্কে আদৌ ঢোকাই হচ্ছে না। এখানে মোদ্দা কথা হল প্রক্রিয়া নিয়ে। সামাজিকভাবে "জুজু" নির্মান আর "মিনির মা"এর ভয়ের যুক্তি, মোটামুটিভাবে একই পরম্পরা অনুসরণ করে। এইটুকুই।
    (চলবে)
    ৬।
    তা, প্রক্রিয়াটা যখন এক, তখন মিনির মায়ের ভয় পাবার কারণগুলি একটু খুঁটিয়ে দেখা দরকার। ভদ্রমহিলা ভয় পাচ্ছেন কেন? তাঁর যুক্তি পরিষ্কার।
    ক। মানুষের ছেলে চুরি যায়।
    খ। কাবুলদেশে দাসব্যবসা প্রচলিত থাকলেও থাকতে পারে।
    গ। প্রকান্ড চেহারার কাবুলির পক্ষে বাচ্চা চুরি করা খুবই সম্ভব।
    ঘ। এই তিনটেই যখন সাধারণভাবে অসম্ভব নয়, তখন একজন বিশেষ কাবুলিওয়ালার পক্ষে মিনিকে চুরি করাও অসম্ভব নয়। সম্ভাবনা একটা থেকেই যায়।
    ঙ। চুরির সম্ভাবনা যখন আছে, তখন নিশ্ছিদ্র সতর্কতাও অবশ্যপালনীয়।
    চ। অতএব অচেনা কাবুলিকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া চলবেনা।

    এর বিপরীতে লেখকের যুক্তিটা কি? স্পষ্ট করে লেখেননি। এক লাইনে লিখেছেন, "ব্যাপারটা যে অসম্ভব তাহা নহে কিন্তু অবিশ্বাস্য।" অবিশ্বাস্য নিসন্দেহে, আমাদেরও সেরকমই লাগে, কিন্তু কেন অবিশ্বাস্য? কেন এই লেখা পড়ে, আমরা লেখকের পক্ষে থাকি, মিনির মায়ের পক্ষে না? আমাদের যুক্তিটা কি? স্পষ্টতই, তার একটা সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত আছে। ধরুন, মিনির বাবা কলকাতায় না থেকে যদি হত্যা ও ধর্ষণের জন্য কুখ্যাত রুয়ান্ডায় থাকতেন, যেখানে প্রতিটি পাড়াতেই এক আধটা লুটপাট-অপহরণ-ধর্ষণ হয়েছে, তাহলে কি তিনি এখনকার মতো ভাবতেন? মনে হয়না। সেক্ষেত্রে তাঁর ধারণা মোটামুটি মিনির মায়ের ধারণার কাছাকাছিই যেত। বা অতদূরেও যেতে হবেনা। বানতলায় ছেলেধরা সন্দেহে যাঁরা অনিতা দেওয়ানদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলেন, তাঁরা কি ঠিক এই গল্পের সুশীল পাঠকদের মতই ভাবতেন? নাকি খানিকটা মিনির মায়ের ঘরানাতেই চিন্তা করতেন? মনে হয় দ্বিতীয়টাই।
    তাহলে একটা সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত আছে। এবং সেখান থেকেই একটা যুক্তিপরম্পরা তৈরি হচ্ছে, যেটা মিনির মায়ের বক্তব্যের উল্টো দিকে যায়। সেটা কি? লেখক, বা আমরা জানি, যে, মিনির মা যা বলছেন, তার সবই সম্ভব। কিন্তু সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। সম্ভাবনা কত আমরা হিসেব করে দেখিনি, কিন্তু মোটামুটি একটা আন্দাজ আছে আমাদের। "অমন করে ভাবলে তো ফুসকুড়িও খোঁটা যাবেনা, কারণ ফুসকুড়ি খুঁটে টিটেনাস হয়ে পৃথিবীতে কি কোনো লোক মরেনি?" -- এই হল লেখক বা আমাদের মোদ্দা বক্তব্য। এবং এখান থেকেই হাস্যরসের উৎপত্তি। এই হাস্যরসের পিছনে একটা সিরিয়াস বক্তব্যও তাহলে আছে। যে, মহিলার "রিস্ক এস্টিমেট" যথেষ্ট "বাস্তবানুগ" নয়। তাতে "বায়াস" আছে। লক্ষ বছরে একবার এক আধটা গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়তেই পারে। বা বছরে এক আধটা লোক বাজ পড়ে মরতেই পারে। কিন্তু তার ভয়ে কেউ ঘরে বসে থাকেনা। বসে থাকলে সেটা হাস্যকর। কারণ এখানে সম্ভাবনাটা এতই কম, যে, "বিপদের সম্ভাবনা" ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। সেটাকে বাড়িয়ে দেখার কোনো মানে নেই। দেখলে সেটা হবে বায়াসাক্রান্ত। বা পক্ষপাতদুষ্ট মায়োপিক। এই হল মোদ্দা সমালোচনা।
    (চলবে)
    ৭।
    এই টুকু পড়লেই মাথায় একটা প্রশ্নটা গজগজিয়ে ওঠে। সেটা হল, প্রক্রিয়াটা নাহয় একই রকম, কিন্তু মিনির মায়ের টা শুধুই একটা নির্দিষ্ট কেস নয় কি? মানে, একজন মহিলার রিস্ক অ্যানালিসিস, বা এস্টিমেটে কিছু গোলমাল থাকতে পারে। তার হরেক কারণ থাকতে পারে। তিনি খুব কল্পনাপ্রবণ হতে পারেন। বাতিকগ্রস্ত হতে পারেন। এসবেরই নানারকম কঠিন বৈজ্ঞানিক নাম আছে। এইসব ব্যক্তিগত "গোলমাল"কেই আমরা নানারকম "ডিসর্ডার"এর খোপে ভরে ফেলেছি। শরীরের যেমন রোগ হয়, মনেরও নানাপ্রকার সমস্যা হয়, তাদের নানা নাম আছে, ভাগ আছে। সেসবের কোনো একটার শিকার হতেই পারেন মিনির মা। যেজন্য তাঁর ভয়ের রোগ হয়েছে। রিস্ক এস্টিমেশন ঘেঁটে গেছে। রবীন্দ্রনাথের আমলে বলে চিকিৎসা হয়নি, এখন হলে সাইকোলজিস্ট কপ করে ধরে ফেলত। ইত্যাদি। কিন্তু আস্ত একটা সমাজকে, বা বলা ভালো গোটা দুনিয়াকে একই সিমটমের শিকার বলার কি কোনো মানে আছে? গোটা দুনিয়ার ডিসর্ডার হয়েছে? সে কি সম্ভব? নাকি ইয়ার্কি?
    এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে গেলে এখানে একটা তীব্র প্রলোভন আছে, টুক করে দর্শনের অঞ্চলে ঢুকে পড়ার। "ডিসর্ডার", "স্বাভাবিকত্ব" এইসব নিয়ে। মানে, "ডিসর্ডার" কি আদৌ কোনো পরম সত্য, নাকি পুরোটাই হুড়ুমতাল? চালু সামাজিক ধারণার স্রোতে যা খাপ খেলনা, তাইই ডিসর্ডার? এইরকম একটা তুমুল তত্ত্বালোচনা (পক্ষে বিপক্ষে ও মাঝামাঝি) হতেই পারত, কিন্তু সে প্রলোভন, এখানে অগ্রাহ্য করা হবে। আমরা বাপু কোনো থিয়োরিতে নাই। যা হবে সব মানুষের সামনে। মুখোশের আড়ালে নয়, মুখোমুখি :-)।
    কাজেই আমরা এবার খুঁটিয়ে দেখব, রিস্ক এস্টিমেশনে গণ-বায়াস সম্ভব কিনা। দলে দলে র‍্যাশনাল লোক হঠাৎ করে একই সাথে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ভুলভাল এস্টিমেট করতে পারে কিনা। দর্শন-টর্শন নয়, ফুকো-লাকা নিপাত যাক, "সামাজিক সত্যনির্মান" এর প্রক্রিয়া গোল্লায় যাক, ওসব নিয়ে অনেক কচলানো হয়ে গেছে, এখন একটু অন্যরকম ইঁদুর ধরা যাক। "দলে দলে র‍্যাশনাল লোক হঠাৎ করে একই সাথে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ভুলভাল এস্টিমেট করতে পারে কিনা" এই প্রশ্নের উত্তরে বিহেভিয়েরিয়াল ইকনমিক্সের লোকজন স্টাডি করে জানাচ্ছেন, দিব্যি পারে (এই বিশেষ জ্ঞানচর্চার ধারাটি নিয়ে আমার গুচ্ছের সমালোচনা আছে, কিন্তু সেসব আপাতত শিকেয় তোলা থাক)। লোকে স্রেফ দলে পড়ে, কোনো ইনসেনটিভ ছাড়াই, প্রচলিত অর্থনীতির মুখে চুনকালি লেপে, স্রেফ দলে ভিড়ে নানাপ্রকার বায়াসসমৃদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, এমনকি দীর্ঘমেয়াদেও। সেসবের গাদা স্টাডি আছে, সেখানে ঢোকার কোনো মানে নেই। আমরা শুধু গণ-বায়াসের একটি চ্যাপ্টার ছোট্টো করে পড়ে নেব, যার নাম সহজলভ্যতাজনিত পক্ষপাত (ইংরিজিটাও বলে দিই, অ্যাভেলেবিলিটি বায়াস, কারণ অনুবাদটি এই অধমের)। সেটা কি বস্তু? না, রিস্ক অ্যানালিসিসে লোকে যে গণহারে "বায়াস" দেখায়, তার একটি বড়ো কারণ এই পক্ষপাত।
    বিষয়টার একটু গভীরে ঢোকা যাক। আপনি, একজন "সামাজিক মানুষ" প্রতি মুহূর্তে রিস্ক এস্টিমেট করে চলেছেন। নানা বিষয়ে। সেটা আপনি কিভাবে করেন? "হারিকেন, পরমানু শক্তি, সন্ত্রাসবাদ, ম্যাড কাউ ডিজিজ, কুমীরের কামড়, কিংবা এভিয়ান ফ্লু, এই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে আপনার কতটা উদ্বিগ্ন হওয় উচিত? এবং এই প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে যে বিপদের আশঙ্কা জড়িয়ে আছে, সেসব এড়ানোর জন্য আপনার কতটা যত্নবান হওয়া উচিত? আপনার সাধারণ জীবনে এইসব বিপদকে প্রতিহত করার জন্য আপনার ঠিক কী করা উচিত?" বিহেভিয়েরাল ইকনমিস্ট থেলার এবং সানস্টেন প্রশ্ন করছেন। সঙ্গে উত্তরও যোগাচ্ছেন তাঁরা। যে, এই জাতীয় "রিস্ক এস্টিমেট" করার জন্য আমরা "সুলভতার স্বশিক্ষণ" পদ্ধতি ব্যবহার করি। নামটি (আবারও অনুবাদ আমার) খটোমটো হলেও হলেও পদ্ধতিটি মোটেও কঠিন না। সেটা খুবই সোজা। এক লাইনে এর মানে হল, আমরা হাতের কাছে যা আছে, অর্থাৎ সুলভ, তার থেকেই জ্ঞানার্জন করে বিপদের সম্ভাবনা বিচার করি। মানে, "দেয়ালে জোরে ঠোকা লাগলে ব্যথা লাগার সম্ভাবনা কত?" এ জানার জন্য আপনি মোটেও লাইব্রেরি গিয়ে জার্নাল খুলে বসবেন না। হাতের কাছে যা উদাহরণ আছে, সেখান থেকেই সম্ভাবনা নিরূপণ করবেন। আপনার ছোটো ভাইয়ের মাথা দেয়ালে ঠুকে একবার আলু হয়ে গিয়েছিল। পাশের বাড়ির ছেলে রেগে দেয়ালে ঘুষি মেরেছিল। হাত কেটে-টেটে একশা কান্ড। ইত্যাদি প্রভৃতি। এছাড়াও মা-মাসিরা হাজার বার বলেছে ওরে সাবধানে হাঁট। এইসব কাছেপিঠে যা দেখেছেন, তা থেকেই আপনি সিদ্ধান্ত করেন, যে, দেয়ালে জোরে ঠোকা লাগলে ব্যথা লাগবেই। যদিও লাইব্রেরিতে গিয়ে খোঁজখবর নিলেই জানতে পারতেন, যে, দুনিয়ায় অনেক কুংফু-ক্যারাটে বিশেষজ্ঞ আছেন, যাঁরা হাত-পা এমন পোক্ত করে ফেলেছেন, যে, মেরে ইট বা দেয়াল ভেঙে দিতে পারেন। ফলে দেয়ালে ঠোকা লাগলেই যে ব্যথা লাগবে, তার কোনো মানে নেই। এমনও সম্ভাবনা আছে, যে, নাও লাগতে পারে। আপনি বলতে পারেন, বাপু চেনাশুনো কেউ ওসব বিদ্যেয় দিগগজ নয়, সে আমি জানি। সে কথা ঠিকও। কিন্তু রাস্তায় অচেনা লোক দেয়ালে ঘুষি মারছে দেখলে আপনি কি আঁতকে উঠবেন না? সে ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট কিনা, সে সংবাদ তো আপনার জানা নেই।
    তা, মোদ্দা কথাটা হল, ঝুঁকির সম্ভাবনা বিচারে, আমরা মোটেও সংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপকের মতো একটি যথাযথ স্যাম্পল নিয়ে কাজ করিনা। বরং হাতের কাছে যা স্যাম্পল আছে, তাই দিয়েই কাজ চালাই। আমাদের রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, সব সময়েই বায়াসড।
    তা ব্যাপারটা এমনিতে বেশ যুক্তিযুক্তই। আপনি বাঁকুড়ার লোক, রাত্রে রাস্তায় টর্চ নিয়ে বেরোবেন কিনা জানার জন্য তো ছত্তিশগড়ে সাপের উপদ্রব কেমন, সে খবরে আপনার কোনো কাজ নেই। বা কলকাতার রাস্তায় মেয়েরা কেমন নিরাপদ, সেটা কলকাতার মেয়েরা তাদের কাছেপিঠের অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝতে পারে, দিল্লীর নিরাপত্তার পরিসংখ্যান দিয়ে নয়।
    তা, এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু কবি বলেছেন, এ যুগ হল তথ্যবিপ্লবের যুগ। এখানে গোল বাধে অতিরিক্ত তথ্যের কারণে। যেমন ধরুন, আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বলুন তো আজকাল খুন-জখমে বেশি লোক মরছে নাকি আত্মহত্যায়? আপনি নির্ঘাত রেগে-মেগে আমাকে উত্তর দেবেন, যে, ইয়ার্কি মারছো হে ছোকরা? আজকাল খুন কিরকম বেড়ে গেছে জানোনা? তার কাছে আত্মহত্যা? ওদিকে যদি তথ্য নেন, দেখবেন, আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার খুনের চেয়ে দুইগুণ বেশি। এটা আমেরিকার হিসেব, ফ্রিকোনমিক্সে ছিল। ভারতবর্ষের সঙ্গে মিলিয়ে দেখিনি। আর লোকে কি ভাবে, সেটা নিয়ে স্টাডি হয়েছে, মোটের উপর জনতার ট্রেন্ড হল, আপনার আমার মতই। অর্থাৎ খুনে মৃত্যুর হার আত্মহত্যার চেয়ে বেশি।
    এবার প্রশ্ন হল, কেন এটা হয়? সাধারণ লোক কি চারপাশে বেশি খুন দেখছে আজকাল? আতহত্যা কম? স্রেফ পারিপার্শ্বিকের হিসেব নিলে মোটেও তা নয়। তাহলে "বেশি খুন" এই ধারণাটা জন্ম নিচ্ছে কোথা থেকে? অন্য কোনো জায়গা থেকে নয়, "তথ্য" বা "খবর" এর বন্যা থেকে। লোকে আজকাল শুধু নিজের চারপাশই দেখছে তা নয়। টিভি, ইন্টারনেট, খবরের কাগজে চারদিকের খবর ও রাখছে। জগদ্দলের লোক সত্যিই দিল্লীর খবর রাখছে। বাঁকুড়ার লোক কলকাতার খুনখারাপি বিষয়ে অবহিত হচ্ছে। এবং খবরে যা অস্বাভাবিক মৃত্যু আসছে, তার বেশিরভাগই খুন (কেন সেটা আলাদা করে বলার দরকার নেই)। এবার এত খুনের খবর পেয়ে মানুষের নিজস্ব জগতে বেড়ে যাচ্ছে "খুন"এর সহজলভ্যতা। এমনিতে সে জানে, যে, দিল্লীর খুন দিল্লীরই, বাঁকুড়ার নয়, কিন্তু আধা-অচেতন রিস্ক-অ্যানালিসিসের সময়, সে তো অতো হিসেব করেনা। জাস্ট "সহজলভ্যতা" দিয়ে একটা চটজলদি সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে ওই "সহজলভ্যতা" কাজ করছে। এতদিন ধরে যে পদ্ধতিতে এই রিস্ক অ্যানালিসিস কাজ করেছে, সেটা অধিকতর বায়াস দেখাচ্ছে, কারণ ওই আধা-অচেতন সিদ্ধান্ত নেবার পদ্ধতি তথ্যবিপ্লবকে এখনও অ্যাকোমোডেট করতে শেখেনি। এবং এই প্রবণতা দুনিয়া জুড়েই।
    এই কারণে, ঠিক এই কারণেই, স্টাডি দেখাচ্ছে, লোকে মনে করে টর্নেডো (বা ওই জাতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে)তে অ্যাজমা(বা ওই জাতীয় নির্বিষ রোগে)র চেয়ে বেশি লোক মারা যায়। বা, (এটা অবশ্য স্টাডি নেই, আন্দাজে বলছি), মাওবাদী হামলায় সাধারণ খুনখারাপির চেয়ে বেশি লোক মারা যাচ্ছে।
    এই হল গিয়ে সুলভতার বায়াস। যেখানে, লোকে খুনখারাপিকে আত্মহত্যার চেয়ে বেশি বিপদ মনে করছে। বা টর্নেডোকে অ্যাজমার চেয়ে বেশি বিপদ। লোকে মানে একটি লোক নয়। লাটকে লাট লোক। জনগোষ্টী। সংখ্যাধিক্যের কারণে একে আমরা আর ডিসর্ডার বলিনা। বহু লোকে একই জিনিস করলে, তাকে বলা হয় বিহেভিয়ার। যেমন, সব সফটওয়্যারেই এক সমস্যা থাকলে তাকে বলা হয় ফিচার। :-)
    (চলবে)
    ৮।
    তাহলে মোদ্দা জিনিসটা কি দাঁড়াল? আমরা এই কয়েকশো বছর আগেও বাস করতাম পুঁচকে গ্রামে। কয়েকশো, বড়জোর কয়েক হাজার লোক থাকত সেখানে। আমাদের রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের, বা সম্ভাবনা নির্ধারণের ক্ষমতা ওইটুকু পপুলেশনের উপরে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। যেজন্য রাস্তায় একজন খোঁড়া লোক দেখলে আমরা অবাক হইনা (কয়েক হাজারের মধ্যে একজন পঙ্গু লোক থাকা খুবই সম্ভব)। অথচ একটা লোকের উপর একাধিকবার বাজ পড়েছে, এই খবর পেলে আঁতকে উঠি। কারণ কয়েক হাজারের মধ্যে সেটা প্রায় অসম্ভব। আমরা যদি ওই প্রায়-অচেতন সম্ভাবনা নির্ধারণের পদ্ধতিতে এই সংখ্যার বায়াসের উপরে উঠতে পারতাম, মানে কয়েকশো কোটি লোকের পপুলেশনকে সম্ভাব্যতার ধারণার মধ্যে নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে দেখতাম, ওটা এমন কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। তা, এর সবই ঠিক ছিল, যদিনা এর মধ্যে ঝাঁপ দিত মিডিয়া। মিডিয়ার খবর আমরা দুচোখ ভরে দেখি। কোথায় কি ঘটছে, তাও জানি, কিন্তু রিস্ক এস্টিমেশনের আধা-অচেতন প্রক্রিয়ায়, ধরে নিই, সেগুলো একশ-হাজার-দশ হাজার লোকের চেনা গন্ডীর মধ্যেই ঘটছে। অত্পর অসম্ভব জিনিসকে সম্ভাব্য মনে হয়। দূরবর্তী ঝুঁকিকে মনে হয় নিকটবর্তী। সেটা ঝুঁকির একটি সামাজিক ক্ষেত্র তৈরি করে। তাতে ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়ে, এবং আরও একটি অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি হয়। অপরাধটি ঘটলেই সেটা আবার খবর হয়ে আবার কোটি-কোটি লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এইভাবে একটি চক্রাকার বৃত্ত তৈরি হয়।
    এবার কেন, এই চক্র তৈরি হয়, উৎস কি, সেখানে, এখানে একেবারেই ঢোকা হয়নি। আগেই লিখেছি, জাস্ট অ্যানাটমি টুকু দেখা হচ্ছে। মার্ক্স, ফুকো এঁরা এর বাইরে। ওনাদের ডোমেনে আদপেই নাক গলানোর অভিপ্রায় নেই, বা ছিলনা। এখানে জাস্ট প্র্যাকটিকালিটির খেলা। মানে "গুজব কিভাবে ছড়ায়" এইরকম একটা অনুসন্ধান, "গুজব কারা রটায়" সেখানে জাস্ট ঢোকাই হলনা। ডেলিবারেটলি। এবং গপ্পো শেষ হয়ে এল।
    প্র্যাকটিকাল পরীক্ষাই যখন, শেষ করার আগে আরও এক আধটা উদাহরণ দিয়ে ফেলা যাক। প্রথম উদাহরণটি কল্পিত। ধরুন আপনি একজন উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত লোক। আপনি আপনার বাড়ির গৃহসহায়িকাকে সন্দেহ করেন? ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন? করেন কি করেন না, সেটা একদা আপনার ব্যক্তিগত বা সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল ছিল। অর্থাৎ, পাড়ায় বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যেমন ট্রেন্ড দেখছেন, তার উপর সন্দেহ বা ঝুঁকির মাত্রা নির্ভর করত। সেটা, যে মাত্রারই হোক, বলাবাহুল্য, তা মোটামুটি বাস্তবানুগও ছিল, আন্দাজ করা যায়। এবার খবরের কাগজ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে এর মধ্যে ঢুকে পড়ল গোটা বঙ্গদেশ। অন্তত কয়েক কোটি মানুষের শহর ও শহরতলী। "পরিচারিকা কর্তৃক গৃহস্বামী/নি লুন্ঠন/হত্যা", মনে করে দেখুন, মাঝে মাঝেই হেডলাইন হয়ে ওঠে। একটানা হয়না, মাঝে মাঝে ঝাঁকে-ঝাঁকে খবরে আসে (যেন খবরের ভলভক্স কলোনি)। তারও নির্দিষ্ট গতিবিদ্যা আছে, কিন্তু পূর্বপ্রতিশ্রুতিমতো সেখানে আমরা ঢুকছি না। মোদ্দা ফলাফলটা যেটা দাঁড়ায়, আপনার প্রায়-অচেতন সম্ভাবনা নির্ণয়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে এই অপরাধগুলি ঢুকে পড়ে। আপনার সম্ভাবনা নির্ণয়ে বায়াস তৈরি হয়। আপনি খামোখাই গৃহসহায়িকাকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। ভয় পেতে শুরু করেন। "সুরক্ষাচক্র"এ ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন। এবং আগে যেভাবে বলা হয়েছে, এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া। যেখানে "খামোখা"টা আর খামোখা থাকেনা। তৈরি হয় দেয়াল। অবিশ্বাস। এবং একটি পজিটিভ ফিডব্যাক লুপে তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রতিরক্ষা শুধু সুরক্ষা তৈরি করে এমন নয়, আক্রমনকারীকেও সে নিজের মতো করে তৈরি করে নেয়। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে চক্রাকারে।
    এর একটা চমৎকার সমাজব্যাপী উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ভারতের সাম্প্রতিকতম ধর্ষণসংক্রান্ত ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে। এই মুহূর্তে খবরের কাগজ বা ইন্টারনেট খুঁজলে বাংলা ভাষায় অন্তত হাজারখানেক প্রবন্ধ পাওয়া যাবে, যেখানে লেখা হয়েছে, "ভারতে নারীর উপরে ধর্ষণ ক্রমশ বাড়ছে"। সঙ্গে নানাবিধ রাজনৈতিক বা দার্শনিক ব্যাখ্যাসমূহ। অথচ, এই নিয়ে, আমরা (মানে আমি, ঈপ্সিতা আর ঋতেন), বিস্তর খাটাখাটনি করে ডেটা বার করেছিলাম, যে, পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণের হার গত পাঁচ বছরে মোটামুটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সঠিক হিসেব করলে, একটু কমেছেই বলতে হয়। তাহলে এই "ধর্ষণ বাড়ছে" ধারণাটি কোথা থেকে তৈরি হল? এ হতেই পারে, যে বহু ধর্ষণেরই রিপোটিং হয়না, সেটা বাস্তবও, কিন্তু সেটা আমাদের ধারণা তৈরি সমস্যার সমাধান করছেনা। যিনি "ধর্ষণ বাড়ছে" বলে ধারণা করছেন, তিনি নিশ্চয়ই নথিভুক্ত অপরাধ ধরেই হিসেব করছেন, যা লোকচক্ষুর আড়ালে, আনরিপোর্টেড, তা ধরে তো আর হিসেব হয়না।
    আদতে জায়গাটা সেই একই। আমাদের নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ সংক্রান্ত সচেতনতা বেড়েছে। অধিকতর মাত্রায় ধর্ষণের খবর মিডিয়ায় আসছে। ধর্ষণের খবর আর একেবারেই ট্যাবু নয়, বরং বহুল আলোচিত একটি বিষয়। ফলে তা ক্রমাগত খবরে আসছে। তাতে একরকম করে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, জনমতও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে আরও একটা জিনিস ঘটছে। আমাদের প্রায়-অচেতন হিসাব পদ্ধতি ঘটনাগুলিকে পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে ধরে নিচ্ছে। ঢুকে যাচ্ছে সম্ভাব্যতার হিসেবে। ইন্টারনেটের বা খবরের কাগজের প্রবন্ধের "ধর্ষণ বাড়ছে" টা, খুব স্পষ্টতই "ধর্ষণের খবর বাড়ছে" বলে পড়তে হবে।
    এবার প্রসঙ্গটা শুধু ধর্ষণের খবর বাড়ছে, আলোচনা বাড়ছে, এইটুকু হলে সেটা খুবই ভালো ব্যাপার হত, এই লেখায় ঢুকতনা। সঙ্গে আরও একটা জিনিস ঘটছে, যেটা আমাদের বিবেচ্য। তৈরি হচ্ছে একটা বায়াস-নির্ভর সম্ভাবনা নির্ণয় পদ্ধতি, এবং ভয়ের বাড়বৃদ্ধি। দিনে একটি করে ধর্ষণের খবর পড়া মহিলা নিজের অভিজ্ঞতার বৃত্তে খবর গুলিকে ঢুকিয়ে নিচ্ছেন। নিজের পারিপার্শ্বিকতায় "ধর্ষণ বাড়ছে" বলে সম্ভাব্যতা গণনা করছেন। এবং ভয় পাচ্ছেন। সতর্ক হচ্ছেন। রাতে নিজের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করছেন। একলা ট্যাক্সিতে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করছেন।
    এই সতর্কতা অমূলক কি? না। কারণ এটি চক্রাকার এক প্রক্রিয়া। এর উল্টোদিকও আছে। সম্ভাব্য অপরাধীও এই একই মানসিকতার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ ধর্ষণ চারিদিকে রীতিমতো হয়। অন্ধকারে একা মেয়ে দেখলেই ধর্ষণ করা যায়। এবং রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় সেটা রি-ইনফোর্সডও হচ্ছে। ফলে একাকী একটি মেয়ের উপর আক্রমনের আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে, এক চক্রাকার প্রক্রিয়া। সামাজিক "ডিসর্ডার" নাকি বিহেভিয়ার, নামক এক ঘটনা। যেখানে অবিশ্বাস, দেয়াল, ভয় ও সতর্কতা, চক্রাকারে একে অপরকে বাড়িয়েই চলে।
    এই সেই দেয়াল-তোলা বিশ্ব, যাতে আমি, আপনি ক্রমশঃ সুরক্ষাচক্রের গহীনে ঢুকে যাচ্ছি। চক্রব্যূহে অভিমন্যুর মতো। জোরহান ম্যাককরমিকের পঞ্চান্ন বয়সী ঘাতকের মতো। মিনির মায়ের মতো, একাকী ও অসহায়।
    (আগামী টুকরোয় সমাপ্য)
    ৯।
    এ এক অদ্ভুত বিশ্ব। যেখানে আমরা একাধারে পদ্ধতির ভিতরে ও বাইরে। আমরা "সচেতন" বলে বিশ্বদুনিয়ার খোঁজ রাখি। তাতে আমরা আতঙ্কিত হই। আমরা "সচেতন" বলেই আবার এই আতঙ্কিত হবার প্রক্রিয়ার অ্যানাটমি বার করি খুঁজে। তাতে কি আমরা প্রক্রিয়ার বাইরে বেরিয়ে আসি? না। তবুও আমরা ভয় পাই, পেতেই থাকি, কারণ প্রক্রিয়াটিতে আমার ভয় না পেয়ে কোনো উপায় নেই। কে না জানে, "ডিসর্ডার"এর চিকিৎসা হয়, কিন্তু "বিহেভিয়ার"এর হয়না। এমনকি এদের মধ্যের পার্থক্য ক্রমশ অলীক হয়ে এলেও না।
    তবে কি, ইহাই ভবিতব্য? এই সতর্কতা, ভয় ও দেয়াল শেষ এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিনের ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? এই লেখকের তেমন মনে হয়না। সামাজিক স্তরে "সচেতন" হস্তক্ষেপ করে আতঙ্কের চক্রকে উল্টোদিকে ঘোরানো একেবারেই অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু সেটা এই লেখার বিষয় নয়। অতএব এই লেখাটি এই খানেই সমাপ্ত হল। নৈতিকতা ও মরাল বিহীন।
    (শেষ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১০ এপ্রিল ২০১৪ | ৯৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • I | 24.99.93.58 (*) | ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৬72706
  • যুবি আবার ফর্মে ফিরেছে।
  • JAW | 175.12.252.211 (*) | ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:০৯72705
  • কেয়া বাত! চলবার অপেক্ষায় রইলাম।
  • Ekak | 24.96.11.235 (*) | ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:১০72707
  • পড়ছি , ভালো লাগছে ভয়ের এনাটমির উত্সে দুম করে চলে যাচ্ছ না বলে । ও নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে । বরং এলিমেন্ট এন্ড সাইন গুলো খোঁজা চলতে থাকুক । ফিরে দেখতে সুবিধে হবে ।
  • swarnendu | 41.164.232.232 (*) | ১২ এপ্রিল ২০১৪ ১০:২৯72708
  • দারুণ হয়েছে। ফাটাফাটি।
  • sm | 122.79.36.33 (*) | ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৪৩72712
  • একটি রিসেন্ট প্রতিবেদন; সৌজন্য ডেইলি মেইল।যতটা মনে আছে লিখছি । লন্ডন এর একটি বিজি রাস্তা। একটি বছর ৭ এবং একটি বছর ৯ এর মেয়ে কে ,হাতে দুটো পুতুল ধরিয়ে উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে ঘুরতে বলা হয়েছিল। বলাবাহুল্য এই দুটি মেয়েকে এক্টিং করতে বলা হয়েছিল। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যাতে মনে হয় তারা হারিয়ে গেছে। তারা আধ ঘন্টা টাক ওই রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে, কিন্তু একজন বুড়ি মহিলা ছাড়া কেউ তাদের জিজ্ঞাসা করেনি তারা হারিয়ে গেছে কিনা? ওই সময়ের মধ্যে অন্তত ৭০০-৮০০ জন পথচারী পাস করেছিল।
  • pi | 24.139.209.3 (*) | ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৫৬72709
  • দারুণ লাগলো, তবে পড়তে পড়তে ক'দিন আগে ভাটপাতায় এনিয়ে কিছু তক্কাতক্কি মনে পড়ে যাচ্ছিলো ঃ) , আর সেখান থেকেই মনে হল, এই ভয়ের থেকে অপরাধ আর অপরাধের থেকে ভয়, এই চক্রই যে শুধু তৈরি হয় তাই নয়, ভয় জনিত অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন থেকে আরো একটা মানসিকতা জন্ম নেয়। সেটা হল, এই ব্যক্তি স্তরে প্রচণ্ড মাত্রায় সাবধানতা মেনে চলাটাই স্বাভাবিক, অন্যথা হলে সেটার দায়, অপরাধ ঘটে গেলে তার দায় কিছুটা ব্যক্তির অসাবধানী আচরণের উপরেও বর্তায়। আদতে যে দায় ছিল সমাজের, প্রশাসনের, সেটা ভিক্টিমের ঘাড়েও কিছুটা ট্রান্সফার হয়ে যায়। যথেষ্ট ভয় পেয়ে সে অনুযায়ী 'নিশ্ছিদ্র সতর্কতা অবলম্বন' না করার দায়।

    মনে পড়ে গেল ক'দিন আগে টিভিতে দেখা একটা অ্যাডও। টেলি মার্কেটিং এর একটা অ্যাড,প্রায় দশ পনের মিনিট ধরে দেখিয়ে চললো, আমাদের রোজকার গারহস্থ্য জীবনের আনাচে কানাচে কেমন থাবা পেতে আছে, ওতপ্রোতোভাবে কেমন জড়িয়ে আছে নানা শেডের বিপদ। এই যেমন ঘর থেকে বেরিয়ে আপনি আপিসে যাচ্ছেন, জানতেই পারছেন না, বাড়ির কাজের মেয়েটি বাড়িতে বসে কী কী করলো, বাড়িতে কাকে না কাকে ডেকে আনলো, কীসের আসর বসালো, জানতেই পারছেন না আপনার স্ত্রী কাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, ছেলেমেয়ে কাদের সঙ্গ করে বখে গেল, আর বন্ধ বাড়ি যদি হয়, তো চুরি ডাকাতির সম্ভাবনা তো আছেই ! পুরো ক্রাইম সিরিয়ালগুলির মত রোমাঞ্চকর পরিবেশনা, ভয়ে, দুশ্চিন্তায় আপনার রোম খাড়া হতে বাধ্য ! সল্যুশন ও অবশ্য বাতলানো হয়েচে, মানে অ্যাডটা যে জিনিসের। সিসিটিভি। আপনার ঘরে ঘরে সিসিটিভি লাগান, কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে ঃ)। শুধু বেডরুম, বেডরুম এক রেট, ড্রয়িং রুম কম্বোতে কিছুটা ছাড়, পুরো বাড়িতে আকর্ষণীয় ছাড় .. এমত নানাবিধ অফারও ছিল ঃ)

    ও হ্যাঁ, আর মনে পড়ে গেল চ্যানেলে চ্যানেলে নানা পুলিশ ফাইল, সিআইডি, সিবিআই ফাইল কেস নিয়ে সিরিয়ালের রমরমা। চ্যানেলে চ্যানেলে গোছায় গোছায় এই সিরিয়াল, আর তেমনি পপুলারও। অবশ্য পপুলার বলেই এত বেশি হচ্ছে নাকি এত বেশি দেখানো হচ্ছে বলে পপুলার হচ্ছে , সেটা আরেক চক্রাকার প্রশ্ন। তবে মানুষ এখন আর বইয়ের পাতার গোয়েন্দাদের কীর্তিকাহিনী দেখতে তত উৎসাহী নয়, রোজের জীবনে, আমাদের আশেপাশের জীবনে সত্যি সত্যি যা অপরাধ ঘটছে, অভিনয়ের মাধ্যমে সেগুলোকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরা, এগুলো দেখার থ্রিলই যেন আলাদা। এই থ্রিল সত্যি ভয়ের থ্রিল। দেখেশুনে মনে হল, মানুষ কি সত্যিকারের ভয় পেতে, ভয়ের এক পরিমণ্ডলের মধ্যে বসবাস করতে ভালোওবাসে বা ক্রমশঃ ভালোবাসছে কি ?
  • তাপস দাশ | 122.79.38.35 (*) | ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ০৬:৪৫72710
  • পাই এর কমেন্টের পরিপ্রেক্ষিতে আমার একটা কথা মনে হল । ভয়ের পরিমন্ডল সুত্রে । প্রাথমিক ভাবে মানুষের একটা শত্রু লাগে । মানে লাগতে দেখছি । মার্কিনদের তো দেখছিই । সিনেমাগুলো ভাবুন । কম্যুনিস্ট দেশগুলো । তারপর সেখানে যখন শত্রু নেই তখন এলিয়েন । তারপর অদ্ভুত সব প্রাণী । তারপর প্রকৃতির রোষ । এদের সঙ্গে শত্রুতা হয়, তারপর তাদের বাগে আনতে হয় । শত্রু ক্ষমতাধর হলে তাকে জয় করার পর নিজেকে আরও বেশি বলশালী বলে প্রতিপন্ন করা যায় ।
    মানুষকে এই ভাবে ভাবানোর একটা চক্র চলছে কি? সর্বত্র চক্রান্ত দেখতে পাওয়ার একটা ফাঁস গলার কাছে এগিয়ে আসছে?

    লিখতে লিখতে দেখলাম, আমিও আমার মন্তব্যে ওই চক্রান্তের কাহিনিকেই সাবস্ক্রাইব করছি ।
  • Souva | 51.207.253.156 (*) | ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ১২:২৭72711
  • এখানে ভারতীয় উপনিবেশে সায়েবদের প্যারানইয়া নিয়ে সৈকতদা খানিকটা লিখেছে। কিন্তু চাইলে সেটা নিয়ে বিস্তর লেখা যায়। স্বাতী চট্টোপাধ্যায়-এর একটা কেতাব আছে--"Representing Calcutta: Modernity, Nationalism and the Colonial Uncanny " বলে। সেখানে উপনিবেশে সায়েবদের বাড়িঘরদোর বানানোর কৌশল ও স্থাপত্যরীতির বর্ণণায়, এই ব্যক্তিগত স্থান বনাম বারোয়ারি স্থানের দ্বৈত-টা একটা প্রবল আকার ধারণ করছে। সায়েবদের খিদমত খাটার জন্যে চাকর বাকর না হলেই নয়, এবং চাকরবাকরের সংখ্যাও হওয়া চাই উপনিবেশের প্রভুর ঠা্টবাটের সঙ্গে মানানসই। এমিলি ইডেনের ডায়রিতে রয়েছে এইরকম মন্তব্য--"কলকাতায় প্রথম এসে ঘাবড়ে গেসলুম। বাড়িতে কতো লোক, আর তার বেশিরভাগই চাকরবাকর। আপনি যেখানেই যান, আপনার পেছন পেছন ঘুরতে থাকবে হুঁকোবরদার, পাঙ্খাবরদার প্রমুখ প্রমুখ। রাত্তিরবেলা মাঝেমধ্যে তো বেশ ভয় পাইয়ে দ্যায়!" (বলা বাহুল্য, এটা আক্ষরিক অনুবাদ নয়, হাতের কাছে বইটই নেই যে দেখে টুকবো, ফলে স্মৃতি থেকে সারসঙ্ক্ষেপ করছি আর কি)।

    তো এই যে একদিকে চাকরবাকরের অনিবার্য অবস্থান, একেবারে গেরস্থালির মধ্যখানে, আবার অন্য দিকে প্রভুর একটি নিজস্ব, নিভৃত ও সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্থান তৈরির প্রচেষ্টা, এর ফলে তালগোল পাকিয়ে যায় ব্রিটিশ স্থাপত্যের মূলসূত্রগুলি, উপনিবেশে এসে। গথিক, বা নিওরোমান ঐতিহ্যগুলিকে ওপর-ওপর অনুসরণ করলেও, তার মধ্যে ঢুকে পড়ে নানান অপ্রত্যাশিত বাঁক। চাকরবাকরের স্পেস থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রভুত্বের স্পেসটিকে বাঁচানোর তাগিদে।

    এবং এটা শুধু যে বসবাসের বাড়িঘরদোরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়, বরং গোটা কলকাতা শহরের পরিকল্পনার মধ্যেও এই দ্বৈত-টা লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে আছে ভারতীয়দের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস নিয়ে সায়েবি ভয়, তাদের অপরাধপ্রবণতা ও স্বভাবগত চৌর্যবৃত্তি নিয়ে আতঙ্ক, দেশি-বিদেশির অবাধ মেলামেশা ও তৎপ্রসূত রক্তের অশুদ্ধি নিয়ে চিন্তা--এইসব।
  • সে | 188.83.87.102 (*) | ১৪ এপ্রিল ২০১৪ ১১:৪০72713
  • অস্কার প্রিস্টোরিয়াস ও তো প্রমাণ করতে চাইছে যে ভয় পেয়েই সে গুলি করে। সেরকরমই যদি প্রমাণ হয়ে যায়, তবে কি তার সাজা হবে?
  • anirban | 208.128.207.29 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৬:৪৮72715
  • বেশিরভাগটাই তো হল উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তর ভয় - সম্পত্তি সম্মান হারানোর ভয়। কিন্তু ধরুন নিম্নবিত্তর ভয়? তার অ্যানাটমি কি রকম? তাদের জুজু কি রকম? এই যে আমেরিকার কালোদের কথা বলেছেন? তাদের প্রতি মুহুর্তে পুলিশের ভয়, চাকরি যাবার ভয়, স্বাস্থ্যবীমা না থাকার ভয়, গৃহহীন হবার ভয়। বা এখানে বস্তিবাসীর উচ্ছেদ হবার ভয়, আমাদের গ্রাম বাংলায় ক'বছর আগে মিছিলে না গেলে সিপিএম এসে দুমফটাস করে দেওয়ার ভয়, বা এখ্ন তৃণমূলের কথা না শুনলে একই রকম দুমফটাসের ভয় - ছোট আলুচাষীর দেনা শোধ দিতে না পারার ভয় ইত্যাদি। তালিকা না বাড়ালেও চলে। প্রশ্ন হল - এসব ভয়ের হাত পা নাক মুখ চোখও কি একই রকমের হয়?
  • Ekak | 24.96.127.3 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৬:৫০72716
  • মানে পরে গেলে মরে যাব নাতো থেকে মরে গেলে পরে যাব নাতো ? হ্যা । পুরো স্পেকট্রাম ধরা চাপের ।দেখি ঈশেন কখন সময় সুযোগ করে লেখেন ।
  • pi | 24.139.209.3 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৬:৫৮72717
  • অনির্বাণ, সেসব ভয় কি জুজু ? মানে সব ভয়ই জুজু, এরকম কিছু কি বলা হচ্ছে ?
  • ঈশান | 214.54.36.245 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৮:৫৮72718
  • হ্যাঁ, অ্যাকচুয়ালি এখানে জুজু ই কিছু ধরা হয়েছে। তাও সব জুজু নয়। জুজুর একটা প্যাটার্ন। এতে সব এঁটে না যাওয়াই স্বাভাবিক।
    তবে সামগ্রিকভাবে "ভয়" বস্তুটা ধরা হয়নি। তার সাবসেট "জুজু"রও একটা সাবসেট আছে এখানে।

    আর, সিসিটিভির বিজ্ঞাপনটি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। :-)
  • aranyak | 34.5.72.222 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৯:১০72714
  • টেক্সাসের মতো ফালতু জায়গা দিয়ে আমেরিকা-কলকাতা তুলনা হয় নাকি?
    টেক্সাসের সঙ্গে হরিয়ানার তুলনা করুন। হরিয়ানাতেও লোকেদের যথেষ্ট বন্দুক আছে। ওখানেও যথেষ্ট gun-culture আছে। হরিয়ানাতে একটা কথার চল আছে - আপনি যদি অচেনা বাড়ির দরজায় টোকা দেন, বাড়ির কোনো পুরুষ দরজা খুলবে বা হাতে। দরজার আড়ালে ডান হাতে কি থাকবে বুঝে নিন।

    আসলে একটা জিনিস এই টপিকে overlooked করা হয়েছে সেটা হলো urban আর rural পরিবেশ। আমেরিকা বেশ বড় দেশ - বেশিরভাগ জায়গায় প্রায় জনহীন। সেখানে "ভয়" পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ আপনার প্রতিবেশী হয়ত বেশ দূরেই থাকে। তাই চেঁচিয়ে সাহায্য পাবার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাপার আপনাকেই সামলাতে হবে।

    নিউ ইয়র্কের মত urban পরিবেশে কিন্তু সেরকম gun-culture নেই। তাই কলকাতার সঙ্গে নিউ ইয়র্কের তুলনা করুন। মোদ্দা কথা হলো, একটা সামাজিক পরিবেশে আমরা পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে কতটা কাছাকাছি থাকি তার উপর এই "ভয়" জিনিসটা নির্ভর করে। জনবহুল জায়গায় মানুষ কম ভয় পায়। কিছু হলে একটু চেঁচালাম, লোকজন জোর হলো, পাড়াপ্রতিবেশী পুলিশে ফোন করলো - চোর পালিয়ে গেল। কিন্তু সে জিনিসটা জনহীন জায়গায় হয় না।
  • pinaki | 93.180.243.109 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৯:৩১72719
  • নাঃ, শহর গ্রামের আলাদা ক্যারেক্টারের ব্যাপারটায় খুব একটা একমত হতে পারলাম না। আম্রিকানদের এই এলিয়েন প্রীতি, যেটা তাপসদা আগে বলল, সে কি আর গ্রাম শহর ভেদাভেদ করে নাকি? আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, যে দেশটা শিক্ষাদীক্ষা বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে এত এগিয়ে, মাত্র ৬-৮% বেকার, সেই দেশের সাধারণ মানুষের মনে কিসের এই জুজু, যে ঐরকম ছাগলমার্কা এলিয়েন মুভিগুলো বছরের পর বছর নব কলেবরে রিলিজ করে চলেছে, আর পাব্লিক দেখেও চলেছে! ওগুলো তো আমাদের দেশের আশির দশকের খাজাতম হিন্দী সিনেমাগুলোর চেয়েও বোকাবোকা আর হাস্যকর।
  • pinaki | 93.180.243.109 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৯:৩৪72720
  • আমার বউএর ব্যাখ্যা অবশ্য যে ওদের রিয়েল সমস্যা এতই কম আর সিকিওরিটি এত বেশী যে সিনেমায় আকাশ থেকে সমস্যা পেড়ে আনতে হয়।
  • anirban | 208.128.207.29 (*) | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ১০:৩৯72721
  • ওহ। শুধু জুজু হলে ঠিকই আছে। কিন্তু, তাও কয়েকটা কথা বলার ছিল। পরে বলব। ঃ-)
  • Pubদা | 209.67.131.215 (*) | ২১ এপ্রিল ২০১৪ ০৯:২৫72722
  • চার বারের চেষ্টায় পুরো লেখাটা আজ পড়ে শেষ করতে পারলাম । যখনই শুরু করি - একটা জুজু (কাজ) এসে যায় খালি ।
    সৈকত'দার লেখা বরাবরই প্রিয় - সব থেকে ভাবালো যে লাইনটা : "যা লোকচক্ষুর আড়ালে, আনরিপোর্টেড, তা ধরে তো আর হিসেব হয়না" ।
    মানে বেঠিক (হয়ত) তথ্য দিয়ে আমরা মারামারি করি সব সময় ।
    তবে - আমার একটা জায়গায় আপত্তি (বা মতামত) আছে - এরকম ভাবে যদি জুজুর ব্যাখ্যা দিতে থাকি - তাহলে আমরা কি বলতে পারি - এই জুজুই আমাদের সভ্যতা এগিয়ে নিয়ে চলেছে ?
    কিরকম ? প্রাগৈতিহাসিক যুগে জন্তু জানোয়ারদের ভয় আমাদের অস্ত্র আবিষ্কার করতে শেখালো, নদীতে বন্যার জুজু আমাদের বাঁধ বানাতে শেখালো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শত্রু বিমানের জুজু রাডার বানিয়ে দিলো, রিসেন্টলি শুনলাম কে নাকি ইলেকট্রিক ব্রা বানিয়েছে রাস্তার লোফার জুজুদের জন্যে -- ইঃ ইঃ ইঃ ।
    আর প্রিভেসির রক্ষার জন্যে কেউ যদি তার বাড়ির দেওয়ালে বৈদ্যুতিন তার জড়িয়ে রাখে - সেটাকে শুধু জুজুর ভয়ে বলে ব্যাখ্যা করাটা বোধহয় ঠিক নয় । একটু আরামে থাকতে চাওয়া - ব্যক্তিগত পরিধি নির্দিষ্ট করে নেওয়া - যেখানে আপনি অন্যের নজর এড়িয়ে নিজের খেয়াল খুশি মত চলবেন - সেই চাওয়াটা কি ভীষন অন্যায় ? অন্য কেউ সেখানে ঢুকে পড়লে তাকে গুলি করাটাকে আমি বলব মানসিক প্রতিবন্ধকতা - তবে না বলে অচেনা কেউ আপনার মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়লে (এবং বিপজ্জনক ভাবে হাত নাড়লে) - যাকে নাকি আপনার মেয়ে বলছে চেনেনা - আপনি কি করতেন - ভেবেছেন ? জুজু'টা তাহলে একটা নিছকই অজুহাত নয় কি ?
  • π | 192.66.9.48 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৫ ০৮:৩৪72723
  • চারিদিকে নানা আলোচনা পড়ে এই লেখাটার কথা আবার মনে পড়লো।
  • ঈশান | 57.29.249.235 (*) | ১৭ আগস্ট ২০১৭ ০২:১৯72724
  • দেব্জ্যোতি ভট্টাচার্যের পোস্টটা পড়ে এই লেখটার কথা মনে পড়ল।
  • pi | 57.29.249.235 (*) | ১৭ আগস্ট ২০১৭ ০২:৫২72725
  • উপরের জন আমি।
  • ঈশান | 213.163.233.200 (*) | ১৭ আগস্ট ২০১৭ ০২:৫২72728
  • আরিব্বাস, কি দুর্ধর্ষ লেখা ! গুরুগ্রামের ঘটনা ঘাড়ে ধরিয়ে দেখিয়ে দিল এ লেখা আগে থেকে দেখতে পায়। আরো কয়েকবার পড়া লাগবে। অনেক প্রশ্ন আছে।
  • Du | 57.184.8.117 (*) | ১৭ আগস্ট ২০১৭ ০৩:৫১72726
  • মানুষের প্রাণের দাম যে অনেক সেটা আমরা ছোট থেকে জেনে এসেছি না বলতেই ---সেটা আনলার্ন করার কোন দরকার নেই।
  • amit | 213.0.3.2 (*) | ১৭ আগস্ট ২০১৭ ০৬:৫৭72727
  • "এর উল্টোদিকও আছে। সম্ভাব্য অপরাধীও এই একই মানসিকতার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ ধর্ষণ চারিদিকে রীতিমতো হয়। অন্ধকারে একা মেয়ে দেখলেই ধর্ষণ করা যায়। এবং রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় সেটা রি-ইনফোর্সডও হচ্ছে। ফলে একাকী একটি মেয়ের উপর আক্রমনের আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে।"

    অদ্ভুত লাগলো পড়ে এটা। সচেতনতা বাড়ার ফলে সম্ভাব্য অপরাধীরা আরো বেশি করে অপরাধ মনস্ক হয়ে যাবে ? সাবধান হয়ে গিয়ে আরো বেশি করে বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে ? এটা নিয়ে ঠিক কি ধরণের কস & ইফেক্ট ডাটা এনালাইসিস করা হয়েছে ?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন