এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ইসকুল-টিসকুল (পর্ব ১)

    মাহফুজ আলম লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১২ জুন ২০১৬ | ৪৭৯ বার পঠিত
  • বাঙালি হিসেে্বে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। বাংলা ভাষা নিয়ে গভীর আবেগ রয়েছে আমার। আগাম এটুকু বলে রাখাটা জরুরী।
    কদিন আগে একটি প্রিন্ট মিডিয়াতে জনৈক বাঙালি শিশুশিল্পীর সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। সেখানে তার মা জানাচ্ছেন যে তার কন্যাটি বাংলা পড়তে পারেনা। আমার জ্ঞানলাভ হল যে কলকেতাতে অ্যামন ইস্কুলও আছে যেখানে পড়লে বাঙ্গালির ছেলে মেয়েরা বাংলা পড়তে পারেনা।
    এখন আমি সেকেলে লোক। বাংলা মাধ্যম ইস্কুলে পড়ে পাশ করা। কাজেই আমার চোখে বাঙালি হয়ে বাংলা পড়তে না পারাটা খুব গর্বের বিষয় নয় আর কি। যাদের কাছে গর্বের বিষয় তারা ভালো থাকুন।
    প্রসঙ্গত, আমারো পেট চলে ইস্কুলে ইংরেজি ভাষাটা পড়িয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে জানিয়ে রাখি যে ইংরেজি ভাষার প্রতি কোনোরকম অসূয়া আমার নেই। বিশ্ব জ্ঞান ভান্ডারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি'র গুরুত্ব অসীম। এবং সেটাকে অস্বীকার করাটা মূর্খামি। ব্রিটিশ ভাষাবিদ DAVID GRADDOL দেখিয়েছেন যে ইন্টারনেটে সঞ্চিত জ্ঞান ভাণ্ডারের ৮০% শতাংশই হচ্ছে ইংরেজি ভাষাতে লেখা।
    সুতরাং, ইংরেজি ভাষাটা ভালোরকম ভাবেই শেখা উচিত। যদিও আমাদের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় ইস্কুল স্তরে ইংরেজি শিক্ষার সিলেবাসটা অ্যামনভাবে তৈরী করেন ঠান্ডি ঘরের কর্তাব্যক্তিরা যাতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়ির সন্তান আর ভালো গৃহশিক্ষক এর সাহায্য ছাড়া গরিব ঘরের ছেলে মেয়েরা ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে গুচ্ছের বাধার মুখোমুখি হয়।
    সেটা ক্যামনে হয়? ছোট্ট করে বুঝিয়ে দিই। আমরা ইস্কুলে যখন ইংরেজি পড়াই তখন ধরে নিই যে বাচ্চারা অমুক জিনিস গুলো বাড়ি থেকে জেনেই এসেছে। বেশিরভাগ শিক্ষিত বাড়িতে ইস্কুলে আসার আগেই ইংরেজি অক্ষর জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু নকুল মাঝি’র মেয়ে রিমি মাঝি’র কি হবে সার? তাকে তো বিঁড়ি বেঁধে ইস্কুলে আসতে হয়। নকুল মাঝি সাত সকালে খাটতে বেরোয়।বাড়িতে পড়া দেখানোর কেউ নেই।
    সরকারী প্রাইমারি স্কুলে বাচ্চারা গাদাগাদি করে বসে।রাজ্য সরকারের সৌজন্যে শিক্ষক কম। মাস্টার মশাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চেয়ারে বসে ‘লেকচার’ মেথডে পড়িয়ে যান। আর ছেলে পুলে একসাথে উত্তর দেয়। দশজনের মধ্যে তিন জন উত্তরটা বুঝে বলে। দুজন বোঝার মতন জায়গায় যায়। বাকি পাঁচ জন কিছুই বোঝেনা।
    পাশ-ফেল প্রথা জাহান্নামে গেছে। সুতরাং প্রায় কিছু না শিখেই অনেক ছেলে মেয়ে এইট অব্দি তরতরিয়ে উঠে যায়। সরকারী খাতায় সাফল্যের খতিয়ান লেখা হয়। মা সরস্বতী আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফ্যালেন।
    এখন প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ে কে আলাদা করে দেখাতে হলে ৩৬৫ দিনেও অ্যাকাডেমিক ইয়ার সম্পূর্ণ হবেনা। সম্পন্ন বাড়ির অভিভাবক সরকারী স্কুলে ভর্তি করলেও তার উপরে ভরসা রাখেন না, হয় নিজে দেখান অথবা গৃহশিক্ষক দেন।
    (একটা বিষয় এখানে গুঁজে দিচ্ছি। পরিকাঠামো নেই, এটা একশোভাগ ঠিক। কিন্তু সরকারী স্কুলগুলোর খারপ হালের জন্য একাংশের মাস্টার মশাইরাও দায়ী যারা ক্লাসে গিয়ে কিস্যু পড়ান না বা নাম কে ওয়াস্তে পড়ান এবং মাসের শেষে অম্লানবদনে মাইনেটা পকেটে পোরেন। বিবেকে কিস্যু খোঁচা লাগেনা।এবং এদের জন্য যারা খেটে পড়ান তারাও বদনামের ভাগিদার হোন।যারা এই অখাদ্য নোট টা পড়ছেন, তারা আশে পাশে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন সরকারী স্কুল টিচারদের অধিকাংশই নিজেদের ছেলে মেয়েদের বেসরকারী স্কুলে পড়ান।)
    গরিব বাড়ির ছেলে মেয়েরা দু-একটা মেধার জোরে অথবা কারুর ব্যক্তিগত সাহায্যে ছিটকে ছাটকে বেরোয়, বাকিরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংখ্যা ভারি করে।
    এই সমস্যাটা ক্যানো হয় সেইটে বোঝার চেষ্টা করছি। প্রথম অভিযোগ অবশ্যই সিলেবাস নিয়ে। আমাদের ইস্কুল বোর্ডের সিলেবাসটা হয় শহরের দিকে তাকিয়ে। নিচু ক্লাসে একটা টপিক আছে, নাম ‘কলকাতা অ্যান্ড হার মনুমেন্টস’।বীরভুমের প্রান্তিক গ্রামের ছেলেটি যে কিনা টাউন বলতে কি বোঝায় তাইই চেনেনা, তাকে কিভাবে অ্যাসোসিয়েট করা যাবে পাঠ্য বস্তুর সাথে? এখানেই শেষ নয়। জওহরলাল নেহরু তার মেয়ে ইন্দিরাকে চিঠি লিখতেন। সেটার উপরে ভিত্তি করেও একটা টেক্সট দেওয়া হয়েছে। বেচারা মাস্টার মশাই আগে ছেলে মেয়েদের জওহরলাল নেহরু আর তার মেয়েকে চেনাবেন। বাপ ক্যানোই বা মেয়েকে চিঠি লিখতো সেইটে বোঝাবেন। তারপরে লার্নিং অবজেকটিভ এ যাবেন।
    অ্যাত্তো সময় খুদাতলা হতভাগ্য ক্লাস টিচার কে দেন না।
    এখন শহরের জন্য আলাদা, গ্রামের জন্য আলাদা –এভাবে সিলেবাস করাটা শক্ত। কিন্তু গ্রাম শহর ভেদে ছেলে মেয়েরা সহজেই নিজেদের অ্যাসোসিয়েট করতে পারে, অ্যামন টেক্সট করাটা বোধহয় ততটা কঠিন কাজ নয়।
    এবার আসি পড়ানোর ক্ষেত্রে। প্রথমেই বুঝে নেওয়া যাক যে কোনো ভাষা শেখানোটা খুব সহজ কাজ নয়, বাচ্চাদের পড়ানোটা তো আরও কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ইংরাজীতে প্রথম শ্রেণী পেলেই সে ভালো ভাষা শিক্ষক হবে অ্যামন ভাবাটা মূর্খামি।
    পড়ানোর অনেক রকম মেথড আছে। লার্নারদের সোসিও-সাইকোলজিক্যাল অবস্থান বুঝতে হয়।এগুলো রপ্ত করার জন্য ট্রেনিং এর দরকার।
    সেইজন্যেই বিএড ট্রেনিং এর ব্যবস্থা। যাতে শিক্ষক হবার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়।
    সরকারী উদাসীনতায় বিএড ট্রেনিং টা দীর্ঘকাল ধরে হাস্যকর প্রহসনে পরিণত হয়েছে।ট্রেনিং কালে প্রায় কিছুই শেখা যায়না। এবং শুধুমাত্র পাশ করাটাই উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
    অগত্যা, মাস্টার মশাইও কিভাবে পড়াইবেন তাহা কিছু শিখিলেন না। সেই সুবাদে তাহার ছাত্রও কিছু শিখিলোনা। শিক্ষাদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা ঠান্ডি ঘরে বসিয়া খাতা কলমে কল্পিত সাফল্যের ঢেঁকুর তুলিলেন। আর রহিম শেখ এবং রামা কৈবর্ত্যের সন্তানেরা পূর্বের ন্যায় ইস্কুল ছুট হইয়া জমিতে অথবা ইঁটভাঁটায় খাটিতে গেলো। এইরূপে ইস্কুলে ইংরাজি শিক্ষার শ্রাদ্ধ সম্পূর্ণ হইলো।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১২ জুন ২০১৬ | ৪৭৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রাণা আলম | 24.139.221.129 (*) | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৫:২৭55351
  • এই নিয়ে রাণা এখন অনেক কাজ করছে। আশা করি লিখবে।

    নামের জায়গা আসছে না। পাই লিখলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন