এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড

    শিবাংশু লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৬ মার্চ ২০১৯ | ১৩৬৫ বার পঠিত
  • জোড়াসাঁকো জংশন থেকে যখন গাড়িটি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছিলো তখন কি মায়া কেটে গিয়েছিলো তার? দক্ষিণের বারান্দার মৃদু বসন্ত বাতাস অথবা জ্যোতিদাদার ছাতবাগানের জুঁইফুল ভাসাভাসি সন্ধের বিলোল আমেজ কি ছেড়ে গিয়েছিলো তা'কে? অনেক দীর্ঘ পথ অপেক্ষা করে আছে, এমন কোনও প্রতীতি হয়েছিলো কি? জোড়াসাঁকো থেকে জালিয়াঁওয়ালা বাগ, সুরুলকুঠি থেকে সুইডিশ আকাদেমি, শিলাইদহ থেকে সান ইসিদ্রো...
    ক্লান্তিহীন যাত্রাপথের গান, শুধু কি আনন্দে? নাহ, মানুষের যাবতীয় ভাবনার শ্রমসংহিতা, সবাইকে জায়গা করে দেওয়ার অলিখিত ঈশ্বরী দায় , একলা ইঞ্জিনের পিছনে অন্তহীন সারিবাঁধা কামরার ঝমঝম সিম্ফনি .... রবীন্দ্রসঙ্গীত ....

    '... মীড়গুলি তার, মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন'
    'বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত' বিষয়টি এই মূহুর্তে বুদ্ধির কাছে এতো বহুকথিত, আবেগ বা নিরাবেগ কলুষিত প্রদূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রসিকজন হয়তো এই নিয়ে কিছু পড়ার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শুনতেও অধিক আকৃষ্ট হবেন। সম্প্রতি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'জীবন'এর আরও 'কাছাকাছি' আনার জন্য এক যোগে যে ধরনের এলিট ও সাব অল্টার্ন রুদ্ধশ্বাস প্রয়াস চলেছে, তাতে 'সঙ্গীতসরস্বতী'র (খুব ক্লিশে শব্দ হয়তো, তবু বিকল্প না থাকায় ব্যবহার করলুম) অবস্থা কুরুরাজসভায় পাঞ্চালী প্রতিম এবং এক্ষেত্রে বাসুদেব যেহেতু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ , তাই এখনও পর্যন্ত কোন মতে লজ্জারক্ষা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, আগে কহো আর।


    নিধুবাবু, রাম বসু, দাশরথি রায়, রামমোহন, ব্রাহ্মসঙ্গীত থেকে জোড়াসাঁকো। দেড়শো বছর আগেই তা বাঙালিদের জন্য বেশ বড়ো কালচারাল শক ছিলো। তার মধ্যে ১৮৭৭ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত এক রবীন্দ্রনাথ এবং তার পর আরেক বা অনেক রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির রসবোধ ও সাংস্কৃতিক রুচি যে গতিতে এগিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সর্বদা তার থেকে অনেক অধিক বেগে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই গরমিলের কারণে দু'টি প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রকট। রসগ্রাহীদের মধ্যে এই সূত্রেই স্পষ্ট দু'টি ভার্টিক্যাল প্রথম থেকেই তৈরি হয়ে গেছে। একদল প্রহ্লাদ, যারা পূজা করে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার চেষ্টা করেছে, অপর দল ধরে আছে হিরণ্যকশিপুর টোটেম। তারা চিরকাল বিরোধিতা করে, বিরূপ থেকে, অনীহা দেখিয়ে, নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধির নিরিখে নানা কটূক্তি করে, রবীন্দ্রনাথকে পেতে চেয়েছে। ঘটনা হচ্ছে এই যে পছন্দ করুক বা নাই করুক, কোনও বাঙালিই রবীন্দ্রনাথ বা সমার্থে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'জীবন' থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানে রাজি নয়। বাঙলির নানা স্ববিরোধী অবস্থানের মধ্যে এটিও একটি। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজনীতি বাঙালির নিত্যদিনের সড়ক রাজনীতির মতো-ই ধূসর, ধূমিল ও পরিণতিহীন।
    অধরামাধুরী ধরেছি.....
    -----------------------------
    রাজনীতিসহিত বা রাজনীতিরহিত, যেকোনও অবস্থাতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গত অন্ততঃ অর্ধশতক ধরে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এই সংযোগটা খুব সহজে হয়নি। নানা ধরণের অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী টানাপড়েন এর মধ্যে কাজ করেছে। 'বাঙালি রুচিবোধ' নামক একটি ধারণার প্রতি মোটামুটি সব বাঙালিই বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করে। এটি প্রকৃত না অলীক তা নিয়ে তর্ক করবো না। তবু এর কিছু স্বীকৃত লক্ষণ আছে। তার মধ্যে একটি, রবীন্দ্রনাথের প্রতি আনুগত্য। এই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গরিষ্ঠ শতাংশ বাঙালির কাছে গানের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অন্যধারা গুলির প্রতি সংখ্যাগুরু বাঙালির আগ্রহ বিষয়ে সন্দিহান হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান, যা আজ উভয়পারের বাঙালির কাছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি মূল স্রোত, উত্তর কপিরাইটযুগে তার রূপরেখা কী রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অথচ, রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি অতীব নথিবদ্ধ গীতধারা। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিন্যাসের সঙ্গে তার খুব একটা পার্থক্য নেই। 'নতুন' কিছু করো'র উন্মাদনায় তার মূল চারিত্র্য'কে সওদাগরের নিলামে চড়ানোটাকে সঙ্গতভাবেই 'যথেচ্ছাচার' আখ্যা দেওয়া যায়। যে 'রুচিবোধ' নিয়ে বাঙালির বেশ একটু অহমভাব রয়েছে, তার অনেকটা জুড়েই তার সঙ্গীতরুচির ব্যাখ্যান চলে। তারও সিংহভাগ জুড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ন্যায্য অনুরাগ অতি প্রকট। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে দেখছি রবীন্দ্রসঙ্গীত'কে গায়ন ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের স্থূল, শিল্পবোধরহিত পরীক্ষার শিকার হতে হচ্ছে। আগের প্রজন্মের শ্রোতারা, যাঁদের সঙ্গীতরুচি পরিণতিলাভ করে গেছে, তাঁদের নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের আগ্রহী শ্রোতারা, যাঁরা নিজেদের জেন-এক্স বলে চিহ্নিত করেন, তাঁদের কাছে গত এক শতক ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশন শিল্পটি কীভাবে বিকশিত হয়েছে, তার একটি খতিয়ান প্রস্তুত করার ইচ্ছে হ'লো। ইতিহাসটি জেনে নিয়ে তাঁরা নিজস্ব সঙ্গীতরুচি তৈরি করুন, সেটাই ঈপ্সিত উদ্দেশ্য। বিষয়টি বিস্তৃত এবং নিজের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে আমি অবহিত। তবু মোটামুটিভাবে একটি সামগ্রিক আলোচনা করার প্রয়াস করেছি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার নিরীক্ষাটি এপার বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ওপার বাংলায় এই বিষয়ে যে সমৃদ্ধধারাটি রয়েছে, ব্যক্তি আমি তার সঙ্গে যুক্ত হবার সঙ্গতি অর্জন করতে পারিনি।
    ----------------------------------------
    যেকোন শিল্পসৃষ্টি অনুধাবন বা উপভোগ করতে গেলে কিছু মৌল প্রস্তুতি লাগে। শিল্পটি যদি সঙ্গীত হয়, তবে আগে গান 'শুনতে' শেখার অভ্যেস করতে হয়। তাই প্রথমে আমাদের গান শোনার অভ্যেস বিষয়ে দুটো কথা বলে নিই। উত্তর ভারতে যে শাস্ত্রীয় গান আমরা শুনে থাকি সেখানে কোনও একটি সুর, যাকে স্ট্রাকচারড ভাবে 'রাগ' বলা হয়, তার শুধু কংকালটুকুই নথিবদ্ধ থাকে। আরোহ ও অবরোহ। এর পর শিল্পীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় ঐ কংকালের উপর রক্ত মাংস মেদ ত্বক আরোপ করে একটি রাগের শরীরী ও আত্মিক সত্বাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য।তারও অনেক প্রথাবদ্ধ নিয়ম আছে, কিন্তু কোনও ধরাবাঁধা স্বরলিপির সংস্থান নেই। কিন্তু পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে সুরস্রষ্টার তৈরি করা স্বরলিপির বাইরে একবিন্দু সরে যাবার অধিকার পরিবেশক শিল্পীর থাকেনা। এনিয়ে 'স্নেহের মন্টু', ধূর্জটি ও 'গুরুদেবে'র অসংখ্য বোধ, যুক্তি ও আলোচনার কথা সবাই জানেন।
    তা মন্টুর নাম যখন এসেই গেল, তখন বলি তাঁর গান কীভাবে গাইতে হবে সে নিয়ে কবিকে প্রথম সিরিয়স চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পুত্রবৎ এই মানুষটি। আসলে কবির গান শুধুমাত্র খণ্ডসুরের নির্মিতি নয়। যে গানটি আমাদের কাছে আসে তা বস্তুত একটি দীর্ঘ অন্তর্লীন প্রস্তুতির গভীর থেকে উঠে আসা সুন্দরের ছায়ামাত্র। সুন্দর নিজে ন'ন। দারুব্রহ্ম জগন্নাথের মূর্তি যেন । অন্তস্থ 'ব্রহ্ম' রয়েছেন সুদূর গভীর কন্দরে। এই গানকে ধরতে চাইলে সুন্দরকে চিনতে হবে। কিন্তু কীভাবে?

    দিলীপকুমারের এক 'বিশেষ ভক্তিভাজন' শুভার্থী একবার তাঁকে বলেছিলেন, " রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্টতা করছ হে, ঘা খাবে। উনি প্রতিভাধর, কিন্তু স্নেহশীল নন। উনি স্নেহ করেন বুদ্ধি থেকে, হৃদয় থেকে নয়- একথা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।" পরে আরো কেউ কেউ দিলীপকুমারকে একই কথা বলেছিলেন। দিলীপকুমার প্রতিবাদ করেছিলেন এই ধারণার। তর্ক করেছিলেন প্রথম বয়সে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহশীলতা, হৃদয়বত্তা,ভালোবাসার ক্ষমতার অসংখ্য পরিচয় তিনি পেয়েছেন আকৈশোর। কবির নিজের ভাষায় "আদর করিতে জানা, অনাদৃতজনে" , তার পরিচয় পেয়েছেন তিনি নিজে ছাড়াও অযুত মানুষ। কিন্তু যাঁরা অন্যরকম ভাবতেন, তাঁরাও কেউ 'নির্বোধ' ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের ভিতর কবির অন্তর্লীন সুন্দরকে চিনে ওঠার এলেমটি ছিলনা। তাঁর ব্যক্তি পরিচয়ের মতো, তাঁর সঙ্গীতের পরিচয় পেতে গেলেও প্রস্তুতি লাগে।
    দিলীপকুমার এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, " ... আমার মতন সামান্যের এজাহারের মূল্য যে আমাকে তিনি গভীরভাবে স্নেহ করেছিলেন বলেই আমাকে বারবার ক্ষমা করেছিলেন-আমি ঝোঁকের মাথায় তাঁকে বারবার আঘাত করা সত্ত্বেও। আজ একথা ভাবতে আমার অনুশোচনার অবধি থাকেনা।" এই 'বারবার আঘাত'টি কী ছিল? দিলীপকুমারের ভাষায়, "... বাংলাগানে সুরবিহার-অর্থাৎ তানবিস্তারের স্বাধীনতার পথ খোলা রাখা দরকার। কিন্তু এখানেও আমার কাঁচা বুদ্ধির অভিজ্ঞতা ধোপে টিকবে কিনা এ-জিজ্ঞাসা আমার মনে ওঠা উচিত ছিল নিশ্চয়ই। মনে মনে আরও গভীরভাবে সচেতন হয়ে ওঠা উচিত ছিল বই কী যে তিনি তাঁর সঙ্গে সমানে তর্কাতর্কি করার অধিকার দিলেও আমার পক্ষে সে-অধিকারে উল্লসিত হয়ে ওঠা স্পর্ধারই সগোত্র।" এই সময়ে দিলীপকুমার ছিলেন একজন 'যৌবনমদান্ধ' যুবক (১৯২৩)। তার পরেও একবার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আলিপুরের বাড়িতে দিলীপকুমার কবির সঙ্গে তুমুল তর্কে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন। প্রশান্তকুমার সখ্যের অধিকারে দিলীপকুমারকে 'খুব ধমকে' দেন। দিলীপকুমার কবির কাছে যখন ক্ষমা প্রার্থনা করেন তখন কবি তাঁকে লেখেন, তিনি (কবি) দিলীপকুমারকে 'অন্তরের সঙ্গে স্নেহ' করেন, কারণ তাঁর (দিলীপকুমার) মধ্যে তিনি 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য' দেখেছেন। চাবিকাঠিটি ঠিক এখানেই আছে। রবীন্দ্রনাথকে পেতে গেলে 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য' অর্জন করতে হবে। তাঁর সঙ্গীত কীভাবে গাইতে বা শুনতে হবে তার সূত্রটিও এখানেই। ঐ বোধটির মধ্যেই আছে। দিলীপকুমারের সুরবিহারের জেদ কীভাবে তাঁর ঘনিষ্ট সাহানা দেবীর এই গানটির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে, শুনলেই বোঝা যাবে। যদিও রবীন্দ্রসান্নিধ্যের সাহানা দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদিতম রূপকারদের একজন। কিন্তু দৈলীপী প্রভাবে কীভাবে তাঁর গায়নের ধরনটি বদলে গিয়েছিল তা এই গানটিতে লক্ষিত হয়। পরিণতবোধের দিলীপকুমার অবশ্য এই অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন।

    সঙ্গীত উপভোগ করার নানা মার্গ আছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে আবেগমুখী ও সন্ধানমুখী। একটু সাধারণীকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলি, প্রথমটি আমাদের ধরন, দ্বিতীয়টি পাশ্চাত্য ধরন।
    আমাদের সঙ্গীত চর্চা ও উপভোগ করার ব্যাকরণ যেহেতু ইম্প্রোভাইজ করার কৌশলকেই অনেক বেশি মূল্য দেয়, তাই আমাদের সন্ধানমুখী সাঙ্গীতিক প্রবণতা তেমন প্রত্যক্ষ নয়। স্বরলিপির মাধ্যমে সুরের কাঠামো ধরে রাখার কায়দাটি য়ুরোপীয়রাই আমাদের দিয়েছে। পন্ডিত ভাতখন্ডে যখন সুরসংস্থানের বিচারে হিন্দুস্তানি রাগরাগিনীর বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন তখন তাঁকে প্রভূত বিরোধের সম্মুখীন হতে হয়ে ছিলো।
    সুরকে নির্দিষ্ট খাঁচায় বেঁধে রেখে সঙ্গীত চিন্তা ও পরিবেশন আমরা ভিতর থেকে এখনও খুব একটা মেনে নিতে পারিনা। বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ থাকে, স্বরলিপির বাঁধনে গানের আবেগ উচিত মাহাত্ম্যে প্রকাশ করা যায়না।
    আমরা সতত মনে রাখি, যে কবি লেখেন ' বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে' বা 'তোমার জ্ঞানী আমায় বলে কঠিন তিরস্কারে, পথ দিয়ে তুই আসিসনি যে, ফিরে যারে', তাঁকে এই বাঁধনে বদ্ধ করার চেষ্টা অনুচিত। রবীন্দ্রসঙ্গীত যাঁরা ভালোবেসে শোনেন, তাঁদের অনেকেরই মত, স্বরলিপি থেকে ঈষৎ বিচ্যুতি থেকে যদি গানের স্পিরিটকে আরও ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়, তবে তাই হওয়া উচিৎ। ব্যক্তিগতভাবে আমি সহমত। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করলে আমার অবস্থানটি ব্যাখ্যা করার মতো 'যুক্তি' আমার কাছে থাকা দরকার। রবীন্দ্রনাথের গান বহিরঙ্গে যতোটা সরল, প্রকৃতপক্ষে তা নয়।
    রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রধান বঙ্গীয় সুরস্রষ্টা যিনি এই স্বরলিপির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং অত্যন্ত সিরিয়াসভাবে তাকে কার্যান্বিত করেন। মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁর সম্যক ধারণা ছিলো তাঁর গানের প্রকৃত স্বরলিপি তৈরি না করে গেলে তাঁর আপাত সরল সৃষ্টিসকল একদিন শিকড়হীন লোকরুচি ও লোকমতের বেনোজলে মাহাত্ম্য হারাতে পারে। এর সঙ্গে তিনি বিশেষ সচেতনও ছিলেন যে তাঁর গানকে এই য়ুরোপীয় পদ্ধতির ধরাবাঁধার মধ্যে চেপে রাখলে তার প্রাসঙ্গিকতা ও লোকপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন হবে। তাই জীবৎকালে তিনি কাউকে কাউকে তাঁর গানে 'স্টিমরোলার' চালানোর অধিকারও দিয়েছিলেন। তবে এই অধিকার নেহাতই ব্যক্তিস্তরের, তার সামূহিক কোনও প্রয়োগ তিনি স্বীকার করেননি।
    স্বরলিপির প্রয়োগ একটি ডিসিপ্লিনের অঙ্গ, যা মানুষ স্বেচ্ছায় মেনে চলে। তাকে কোনও ‘এসমা’দিয়ে মানাতে হয়না। যাঁরা অধিকারী, তাঁরা স্বরলিপির 'বন্ধন'এর মধ্যে পূর্ণত থেকেও অতি উপভোগ্য সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারেন। তবে অধিকারীর পাত্রভেদ আছে। যে সব শিল্পীর সঙ্গীতের এই ধারাটিতে সিদ্ধিলাভ হয়েছে তাঁরাই অধিকারী। এই সিদ্ধিলাভের তকমা কোনও কলেজে কিনতে পাওয়া যায়না। দীর্ঘসময়ের নিবিষ্ট সাধনা ও অনুশীলন ও তার সঙ্গে অন্তর্লীন সঙ্গীত চেতনার মেলবন্ধন যখন সংবেদনশীল শ্রোতার কাছে প্রকাশ পায় তখন এই স্বীকৃতি আপনিই আসে। যাঁদের নামে মাঝে মাঝে 'সুরচ্যুতি' বা বাঁধাপথের বাইরে' গিয়ে গান শোনানোর অভিযোগ ওঠে, সেই সুচিত্রা মিত্র বা জর্জ বিশ্বাস সিদ্ধির সেই স্তরে পৌঁছে গেছিলেন, যেখানে তাঁদের কাছে সেই সব 'বিচ্যুতি'র জন্য কৈফিয়ৎ চাওয়াটা বাতুলতা। কারণ তাঁরা নিজস্ব পরিবেশনায় 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য'কে ভিত্তি করেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। এই সব বাঁধাবাঁধি আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যমেধার মানুষের জন্যই থাক । আমরা সেই সুধাসাগরের পারে বসে থাকার লোক, ডুব দেবার সামর্থ্য অর্জন করা হয়ে ওঠেনি।
    (ক্রমশ)
    জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড-২
    -----------------------------------------
    আমি যে গান গাই, জানিনে সে...

    নিজের গান, বা বৃহদার্থে 'গান' সম্বন্ধে কবির ধারণা সারা জীবনে পাল্টে গেছে বারবার। নিজের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভাইস' হলো 'ইনকনসিস্টেন্সি' আর তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভার্চু'ও হলো ঐ 'ইনকনসিস্টেন্সি' ।
    নিজের সম্বন্ধে তাঁর এই মূল্যায়ণ যে কতো যথার্থ ছিলো তার প্রমাণ পেয়েছি বহুবার। যেমন ১৯১২ সালে 'জীবনস্মৃতি'র একটি অধ্যায় তিনি শুরু করেছিলেন এইভাবে, '' বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেই খানেই গানের প্রারম্ভ।'' তিনি লিখেছিলেন, '' সুর কেন কথার দাস হইবে'' অথবা '' .... গীতকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয়না সেই সুযোগে গান'কে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়ো, বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে।'' এখানে 'গান' বলতে তিনি সুর'কেই সমার্থ বোধ করছেন। সেই গ্রন্থেরই আরেক স্থানে তিনি একটি বিশেষ স্মৃতির উল্লেখ করে বলছেন, ''... সুর যে জায়গায় কথাটা উড়াইয়া লইয়া গেল, কথা আপনি সেখানে পায়ে হাঁটিয়া গিয়া পৌঁছিতে পারিত না।'' অথচ দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর যখনই প্রাসঙ্গিক আলাপ হয়েছে তিনি আমাদের কালোয়াতি গানে সুরের ইম্প্রোভাইজেশন, অর্থাৎ দৈলীপী 'সুরবিহার', বিষয়ে নিজের দ্বিধা প্রকট করেছেন। ১৯১২ সালে তাঁর এ বিষয়ে ধারণা ১৯৩৮ সালে পাল্টে গেলো। তখন তিনি বলছেন ( এ বিষয়ে) '' ....মত বদলিয়েছি। কতোবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই।'' তিনি আরও জানাচ্ছেন, হিন্দুস্তানি কালোয়াতি গানের তিনি কদরদান, তার রস তিনি পূর্ণতঃ উপভোগ করেন। কিন্তু 'খাঁচার পাখি'র মতো শুধু বুলি আউড়ে গেলে কিন্তু সঙ্গীতে মুক্তি নেই। তিনি চাইছেন নতুন সৃষ্টি ও গণ্ডী ভেঙে নতুন জীবনের পথ। এই ধারণাটি তিনি গ্রহণ করেছেন আবহমান কালের বাংলা পদাবলীসঙ্গীত থেকে। যে শৈলিতে পদাবলী, গীতকলাকে সঙ্গিনী করে শিল্পকে জাগিয়ে তুলেছিলো। সুর যখন কথার সঙ্গিনী হয়ে উঠবে, তখনই এই যুগলবন্দি থেকেই সার্থক হয়ে উঠবে সঙ্গীত। এই বর্ণনাটি কিন্তু যথার্থ উপমা সহকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন 'জীবনস্মৃতি'তে বহুকাল আগেই, ''.... আমাদের দেশে স্ত্রী যেমন স্বামীর অধীনতা স্বীকার করিয়াই স্বামীর উপর কর্তৃত্ব করিতে পারে, এ দেশে গানও তেমনি বাক্যের অনুবর্তন করিবার ভার লইয়া বাক্যকে ছাড়াইয়া যায়।'' ১৯৩৭ সালে তিনি ধূর্জটিপ্রসাদকে লিখেছিলেন , ''... কথাও সুরকে বেগ দেয়, সুরও কথাকে বেগ দেয়, উভয়ের মধ্যে আদানপ্রদানের স্বাভাবিক সম্বন্ধ আছে।'' ১৯২১ সালে বলেছিলেন, ''... সংগীতের মধ্যে বাণীর মিলন সাধনই এখন আমার প্রধান সাধনা হয়ে উঠেছে'' ( আমাদের সংগীত)। এই সময়েই তিনি আরো লিখেছিলেন, ''... বাংলাদেশে কাব্যের সহযোগে সংগীতের যে বিকাশ হচ্ছে, সে এক অপরূপ জিনিস হয়ে উঠবে। তাতে রাগরাগিণীর বিশুদ্ধতা থাকবে না, যেমন কীর্তনে তা নেই; অর্থাৎ গানের জাত রক্ষা হবে না, নিয়মের স্খলন হতে থাকবে, কেননা তাকে বাণীর দাবি মেনে চলতে হবে। কিন্তু এমনতরো পরিণয়ে পরস্পরের মন জোগাবার জন্য উভয় পক্ষেরই নিজের জিদ কিছু কিছু না ছাড়লে মিলন সুন্দর হয় না।'' তার পর ১৯২৬ সালে তিনি দিলীপকুমারকে আবার লিখেছিলেন, ''... কীর্তনে বাঙালির গানে সঙ্গীত ও কাব্যের যে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, বাঙালির অন্য সাধারণ গানেও তাই।''
    দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর এই বার্তালাপ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল কাঠামোটি বিষয়ে কবির অবস্থান কী রকম। দিলীপকুমার চেয়েছিলেন তাঁর গানের ব্যক্তিত্বস্বরূপটি নির্মাণ করবেন গায়ক নিজেই। তিনিই হবেন গানের 'রূপকার'। আমাদের কালোয়াতি গানের মতো। কিন্তু কবি জানতেন গানের ব্যক্তিত্ব ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়ে গেছে সুরকারের সৃজিত কাঠামোতে। গায়ক বা রূপকার সেই প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বকে প্রাণ দেবেন তাঁর স্বরে, পরিবেশনায়, কিন্তু সুরকারকে অতিক্রম করে যাবার অধিকার তাঁর থাকবে না।
    '' ... যে মানুষ গান বাঁধিবে আর যে মানুষ গান গাহিবে দুজনেই যদি সৃষ্টিকর্তা হয় তবে তো রসের গঙ্গাযমুনাসংগম। যে গান গাওয়া হইতেছে সেটা যে কেবল আবৃত্তি নয়, তাহা যে তখন-তখনি জীবন-উৎস হইতে তাজা উঠিতেছে, এটা অনুভব করিলে শ্রোতার আনন্দ অক্লান্ত অম্লান হইয়া থাকে। কিন্তু মুশকিল এই যে, সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা জগতে বিরল। যাদের শক্তি আছে তারা গান বাঁধে, আর যাদের শিক্ষা আছে তারা গান গায়–সাধারণত এরা দুই জাতের মানুষ। দৈবাৎ ইহাদের জোড় মেলে, কিন্তু প্রায় মেলে না। ফলে দাঁড়ায় এই যে, কলাকৌশলের কলা অংশটা থাকে গানকর্তার ভাগে, আর ওস্তাদের ভাগে পড়ে কৌশল অংশটা। কৌশল জিনিসটা খাদ হিসাবেই চলে, সোনা হিসাবে নয়। কিন্তু ওস্তাদের হাতে খাদের মিশল বাড়িতেই থাকে। কেননা, ওস্তাদ মানুষটাই মাঝারি, এবং মাঝারির প্রভুত্বই জগতে সব চেয়ে বড়ো দুর্ঘটনা। এইজন্যে ভারতের বৈঠকী সংগীত কালক্রমে সুরসভা ছাড়িয়া অসুরের কুস্তির আখড়ায় নামিয়াছে। সেখানে তান-মান-লয়ের তাণ্ডবটাই প্রবল হইয়া ওঠে, আসল গানটা ঝাপ্সা হইয়া থাকে।'' (সংগীতের মুক্তি)
    এ বিষয়ে আমার মনে হয় তাঁর অভিপ্রেত অনেকটা পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধরনের সঙ্গে মেলে। সেখানেও স্বরলিপির নির্দিষ্ট বাঁধনকে আপোসহীনভাবে স্বীকার করে নিয়েও বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনে নিজস্বতার সিলমোহর লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মিলটা শুধু সুরের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হতে পারে, সুর ও বাণীর মালা গাঁথার সাফল্য এক্ষেত্রে অর্জিত হয়না। নিজের সৃষ্টির অবয়বকে এইভাবে রক্ষনবেক্ষণ করার সাধ ও সাধ্য, শুধু বাংলায় কেন সারা ভারতবর্ষে কোথাও চোখে পড়েনি। বাংলাতে অন্য যেসব প্রধান কম্পোজার ছিলেন, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল বা নজরুল কেউই নিজস্ব সৃষ্টির পরিবেশন পদ্ধতি বিষয়ে এ জাতীয় স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট নীতিনির্দেশ রেখে যাননি। তাই তাঁদের গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে দিলীপকুমারের ঈপ্সিত পদ্ধতিটিই বলবতী হয়েছে । উল্লেখ্য, যা আমাদের আবহমান কালের গীতকৌশল।

    এখন হবে প্রাণের আলাপ


    রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচার করার সময় পণ্ডিতেরা মোটামুটি দুটি পর্যায় লক্ষ্য করেন। ১৯১৩র আগে ও তার পরে। ইন্দিরাদেবী ১৯৪২ সালে ( অর্থাৎ কবির চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরে) বলেছেন , তিনি নোবেল পাওয়ার আগের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'সাবেক' এবং পরবর্তী কালের রচনাকে 'আধুনিক' আখ্যা দিয়েছিলেন। এই 'আধুনিক' রবীন্দ্রসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে ১৯১৫ সালের পর থেকে। 'সাবেক' রচনাগুলি মূলত রাগাশ্রয়ী ঐশী ও আরাধনাকেন্দ্রিক, যার রচনা, সুরসৃষ্টি ও স্বরলিপিকরণ হয়েছিলো ব্রাহ্মসমাজের প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি রেখে। এই ধারার বাইরে যেসব গান, ধরা যাক তাঁর নিজের সুর করা একেবারে প্রথমযুগের গান, শাহিবাগের প্রাসাদে বসে লেখা 'বলি ও আমার গোলাপ বালা' গোছের গান অবশ্যই রবিবাবুর গান, কিন্তু 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' হয়ে উঠতে পারেনি। এরকম অনেক উদাহরণ হয়তো দেওয়া যায়, কিন্তু তা নিষ্প্রয়োজন। মূল কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে স্বাতন্ত্র্য ও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান নোবেল পাওয়ার পর। এই ধরনের কথা শুধু ইন্দিরাদেবী নন, ধূর্জটিপ্রসাদও বলেছিলেন। তাঁর 'আমরা ও তাহারা' বইয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগবিভাগ করেছিলেন সুরপ্রয়োগের বৈশিষ্ট্য দিয়ে। প্রথমযুগের গানে নানা শাস্ত্রীয়গানের উৎস থেকে আহরণ করা অমিশ্রিত সুরপ্রয়োগ পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাগের মিশেলে সম্পূর্ণ নতুনধরনের সুরব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিলো। প্রমথনাথ বিশী যেরকম বলেছিলেন, ''প্রথমবয়সের গানের মুখ বিরহমিলনপূর্ণ খণ্ডক্ষুদ্র সংসারের দিকে, শেষ বয়সের গানের মুখ বিরহ-মিলনাতীত অখন্ড সৌন্দর্যলোকের দিকে; মধ্য বয়সের গানে, অল্প কিছুদিনের জন্য এই দুই স্বতোবিরোধের মধ্যে সেতুবন্ধনের সুর।''

    এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব বলেছেন, '' মধ্যজীবনে দেখি ছন্দপ্রধান গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেশি ও আগের অনুপাতে ঢিমে লয়ের গানের সংখ্যা অনেক কম''। কবি নিজে ইন্দিরা দেবীকে বলতেন, ''আগেকার গান গুলি ইমোশনাল , এখনকার গুলি এসথেটিক''। আবার কবি নিজে বলছেন, ''... প্রথম বয়সে আমি হৃদয়ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছি গানে, আশা করি সেটা কাটিয়ে উঠেছি পরে। পরিণত বয়সের গান ভাব বাৎলাবার জন্যে নয়, রূপ দেবার জন্য''। এই 'রূপ' দেওয়া প্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়েছেন যে গানটির, '' কেন বাজাও কাঁকন কনকন'', সেটি কিন্তু তাঁর মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সের রচনা। তাই তাঁর নিজের মতে গান বিষয়ে 'পরিণত বয়স' এসে গেছে আরো আগেই।

    আবার ধূর্জটিপ্রসাদ ব্যাপারটিকে দেখছেন সম্পূর্ণ অন্য স্তর থেকে। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগবিভাগ করছেন সুর যোজনার লক্ষণ থেকে। তিনি লিখেছিলেন, '' ... রাধিকাবাবুর মুখে ভালো ধ্রুপদ শুনে হিন্দুস্তানি কথার বদলে বাংলা কথা বসানো-ই তাঁর কাজ, যেমন- 'সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি', 'মন্দিরে মম কে'; এই সব গান হিন্দুস্তানি সুরের তর্জমা। দ্বিতীয় যুগে তিনি কথায় ভালো ভালো সুর বসাচ্ছেন, যেমন-'ঝরঝর বরিষে বারিধারা, 'রিমঝিম ঘন ঘন রে' প্রভৃতি গান । তৃতীয় যুগে তিনি সঙ্গীত রচনা করলেন -বাহারের সঙ্গে মল্লার মিশল, ভৈরবীর সঙ্গে মিশল খাম্বাজ, বেহাগের সঙ্গে কেদারা।'' এই মূল্যায়ণটি আজকের দিনে শ্রোতারা হয়তো সঠিক মনে নাও করতে পারেন, কিন্তু যাঁরা কালোয়াতি গানের সমঝদার, তাঁদের বিচারে এই রকম একটা পর্ববিভাগ সমুচিত মনে হওয়াটা অসম্ভব নয়।

    আমরা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় লঘুমেজাজে বলতুম মহর্ষির পাঁচশো টাকা পুরস্কারের মোহ কবিকে নোবেল পাওয়া পর্যন্ত ‘রবিবাবু’ করে রেখে দিয়েছিলো। যখনই আমাদের কেউ ঐ সব পর্যায়ের গান গাইতে বলতেন, আমরা হয়তো ঈষৎ আড়ষ্টবোধ করতুম, স্বতোচ্ছাস গায়ন হয়ে উঠতো না। এ বিষয়ে সম্প্রতি একজন পরিণতমনস্ক গায়কের সঙ্গে আলাপসূত্রে সেই কথাই হচ্ছিলো। তাঁকে দীর্ঘকাল ধরে সনিষ্ঠভাবে পূজা পর্যায়ের ঐ সব গান পরিবেশন করতে শুনেছি, কিন্তু তিনিও এখন জানালেন ঐসব গানে তিনি ঠিক স্ফূর্তি পাননা। এর একটাই কারণ , আমাদের মনে 'রবীন্দ্রসঙ্গীতে'র শ্রেষ্ঠতর কাজগুলির ছাপ এতোটা প্রবল, যে অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর কাজগুলির প্রতি তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছাড়া বিশেষ আগ্রহ আর উৎসাহ বোধ হয়না।

    রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর্যায়ভেদ বিষয়ে এতো বিশদ চর্চা এই জন্য প্রয়োজন, যে আমাদের সময়ে যেসব শিল্পী রবিবাবুর গানকে 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' করে তুলেছিলেন, তাঁদের পরিবেশনায় এই গুণগত পর্যায়বাচী সৃষ্টির ধারা বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার যে সমস্ত ঘরানাগুলি রয়েছে তার মধ্যে মুখ্য উৎস জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতন। ইন্দিরা দেবী বলেছেন কলকাতাকেন্দ্রিক ঘরানা মুখ্যত ব্রাহ্মসমাজমুখী, যেখানে কাঙালিচরণ সেন, প্রতিভাদেবী, সরলাদেবী ও তিনি নিজে যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতন সঙ্গীতঘরানার মুখ্য ব্যক্তি দিনু ঠাকুর ও সঙ্গে অনাদি দস্তিদার, শৈলজারঞ্জন ও শান্তিদেব। এই দুই ঘরানার মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার বিবিধ অঙ্গ নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক চলতো। বিশেষত দিনু ঠাকুর ও ইন্দিরাদেবীর মধ্যে। দিনু ঠাকুর যে গায়নশৈলির প্রচারক ছিলেন সে প্রসঙ্গে ইন্দিরাদেবীর কিছু ভিন্নমত ছিলো।
    আপাতভাবে মনে হতে পারে ইন্দিরাদেবী হয়তো একটু 'রক্ষণশীল', কিন্তু তিনি যখন লেখেন, "..... স্বরশুদ্ধি এক জিনিস, সুরসিদ্ধি বা রসসিদ্ধি আর। সেই রসপূর্ণ গায়কীতে উত্তীর্ণ হওয়াই গায়কের লক্ষ্য ; এবং সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধ করবার জন্য সদগুরুর দ্বারস্থ হওয়া চাই, নিজ সাধনা দ্বারা স্বরলিপির কঙ্কালে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা চাই।'' ইন্দিরা দেবীর দীক্ষিত বিখ্যাততম শিল্পী ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথাগত 'গুরু' বলতে তিনি সংক্ষিপ্তকালের জন্য হলেও শুধু ইন্দিরাদেবীরই সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তার আগে তাঁর চর্চা তো সীমিত ছিলো শুধু ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনাসঙ্গীতের সমবেত স্বরের একটি স্বর হিসেবে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে প্রচারিত রবীন্দ্রসঙ্গীতে 'রক্ষণশীলতা'র মিথটি মনে হতে পরে কিছু কায়েমি স্বার্থান্বেষীর গড়ে তোলা ব্যাপার। যদি ইন্দিরা দেবীর মতো 'রক্ষণশীল' গুরুর শিক্ষা শ্রোতাদের জন্য একজন দেবব্রত বিশ্বাসকে এনে দিতে পারে, তবে এই রটনাটিকে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ভেবে বর্জন করাই শ্রেয়। এই ভ্রান্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আরো একটি প্রমাণ, স্বত্ববিলোপের এতোদিন পরেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূলস্রোতটিতে এখনও সৎ শিল্পী ও শ্রোতাদেরই স্বরাজ চোখে পড়ে।


    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৬ মার্চ ২০১৯ | ১৩৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শিবাংশু | 5645.249.2378.33 (*) | ২৬ মার্চ ২০১৯ ০৫:৪৫49625
  • বিষয়টি নিয়ে আমার আগ্রহ পারিবারিক উত্তরাধিকার। জ্ঞান হবার আগে থেকেই যুক্ত আছি এর সঙ্গে। সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাগানের এই শৈলীটির গায়ন পদ্ধতিগুলির মধ্যে মেরুপ্রতিম দূরত্ব চোখে পড়ছে। তা কি শুধু গায়কদের অকৃতকার্যতা না শ্রোতাদের রুচিবদলের বিড়ম্বনা? তার কোনও সরলরৈখিক সমাধান খুঁজে পাইনি। 'কোন হাটে তুই বিকোতে চাস ওরে আমার গান?' এর উত্তর কবির নিজের কাছেই অস্পষ্ট ছিলো। অন্য পরে কা কথা? এ বিষয়ে যেসব বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের সন্দর্ভ চোখে পড়েছে, সেখানেও 'শেষ কথা' বলার প্রয়াস নেই। অবশ্য শিল্পের শেষ কথা কে আর বলবে? বহতা নদীর মতো যাপন তার। কোনও ঘাটেই তার দ্বিতীয়বার ফিরে আসা হয়না। বহুদিন ধরেই ভাবছি কবির গানের বাণী বা সুরপ্রয়োগের সিদ্ধির নিরিখ থেকে একটু সরে গিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নশৈলীর মধ্যে যে বিপুল বিবর্তন ঘটেছে গত একশো বছর ধরে, নিজস্ব সীমাবদ্ধতা নিয়ে তারই সন্ধান করি। বহুনন্দিত হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত বাংলাগানের 'মূলস্রোত' নয়। এই সঙ্গীতধারা থেকে রসগ্রহণের জন্য যে পর্যায়ের প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়, সাধারণ বাঙালি শ্রোতা কোনও কালেই তা নিয়ে বিশেষ উদগ্রীব ছিলোনা। রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁর সঙ্গীতও 'ফুলের মালা, দীপের আলো'র আড়ালে আরাধ্য বিগ্রহের প্রতি ভক্তের নিস্পৃহ স্পর্শকাতরতার প্রতীক হয়েই থেকে গেছে। সীমিত হলেও, কিছু মানুষের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক গীতধারাটি যাপনের শেষ সম্বল। হাটের ধূলার মলিন কাতরতা থেকে আমাদের উদ্ধার করে। যাপনের নতুন অর্থ এনে দেয়।

    সামগ্রিক আলোচনার সূত্রে, সঙ্গত কারণেই রচনাটি আয়তনে দীর্ঘ। গত প্রায় এক বছর ধরে 'ঋতবাক' ওয়েবপত্রে লেখাটি কিস্তিবন্দি হয়ে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এখনও পুরোটা লেখা হয়ে ওঠেনি। আশা করি হয়ে যাবে। সঙ্গীত বিষয়ে এই পাতায় আমার ইতোপূর্বে প্রকাশিত লেখাগুলি পাঠকদের কাছে আদৃত হয়েছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীত যাঁদের কাছে দাঁড়াবার জায়গা বলে প্রতীত হয়, এই দীর্ঘ সন্দর্ভটি হয়তো তাঁদের মননকে কিছু ট্রিগার করতেও পারে।
  • Dyuti Mustafi | 785612.42.78.215 (*) | ২৭ মার্চ ২০১৯ ১২:২৮49626
  • পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম ভাবালো ব্যাপার টা
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন