এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মফস্বলী বৃত্তান্ত

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ | ১৫০০ বার পঠিত
  • আমাদের ক্যান্টিনের ম্যানেজার কেন চলে গেল সে আমি জানিনা। হতে পারে, কারবার চালাতে পারছিলনা। ধার-বাকিতে ডুবে গিয়েছিল। হতে পারে চলে যেতে বলা হয়েছিল। হতে পারে, গ্রামে ফিরে চাষবাস করবে ঠিক করেছিল। আবার এসব কিছুই নাও হতে পারে। আমি জানিনা।

    আসলে, ম্যানেজারকে যেতে হতই। কারণ, ক্যান্টিন দুরকমের। এক হল মারকাটারি ও জগদ্বিখ্যাত। যাদবপুরের আর্টস ক্যান্টিন যেমন। পেডিগ্রি দেখলেই গা ছমছম করে। ভিতরে এক আধজন হ্যাহ্যা ছেলেপুলে তাস পেটায়না তা নয়, কিন্তু ভাব ও প্রকরণে যেন পুরো ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল। ডানদিকে বাঁদিকে তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী, দেড়েল ও স্বপ্নসুন্দরী, সৃজনশীল ও আভাঁগার্দ। সবসময় কিছু একটা হবে-হবে ভাব। এই বুয়েনাস এয়ার্স থেকে দমদম হয়ে সিধে আসছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বগলে সম্পূর্ণ অজানা একজন স্প্যানিশ লেখক, পরশু থেকেই আঁতেলকুলে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে যোগ হবে আরেকটি দাঁতভাঙা নাম, তো ওই দিকে যেকোনো মুহূর্তে চটি ফটফটিয়ে সামনে চলে আসতে পারেন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, দেখতে পেলেই চাট্টি থান ইঁটের মতো হেগেল আর নিৎশে ছুঁড়ে মারবেন, দাঁত টাত ভেঙে গেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী না। এইতো সেদিন অলোকরঞ্জন রেগুলার ভাট মারতে আসতেন এ তল্লাটে, ঘাসে-ঘাসে নবীন পল্লবে আর "কবিতার মূহুর্ত"এ রয়ে গেছে চটির জলছাপ।আর জাস্ট কদিন আগেই এই তো সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন স্বয়ং শঙ্খ গোষ, ভাবলেই নাকি গায়ে কাঁটা দেয়। যদিও এতদ্বারা বোঝা যায়না, এই প্রবল ও সলিড বুদ্ধিজীবিত্বের হাম্বারবের মধ্যে এসি কারেন্টের মত আর্টস ক্যান্টিনও কেন এসি ক্যান্টিন নামে জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেল। এই অচিন্তনীয় আর্ষ প্রয়োগের কারণেই বোধহয়, আর্টস লবিতে নানা গ্রাফিত্তির সঙ্গে "সুপারম্যান যদি এতই বুদ্ধিমান, তাহলে জাঙ্গিয়া প্যান্টের উপরে পরে কেন" এই দেয়াললিখনটিও দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল, উত্তরহীন।

    ওপাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও কম যায়না। স্লাইট কালিদাসীয় গুরুনিতম্ব হলেই আঁটবেনা এমন সাইজের অখাদ্য কাঠের চেয়ারে ভর্তি হলে কী হবে, স্রেফ ঐতিহ্যের ঝাঁঝেই মেরে দেবে। সেই স্যার আশুতোষও নাকি এইসব চেয়ারে পাছা ঠেকিয়েছিলেন। ইয়ংবেঙ্গল গুষ্টি বুটজুতো পরে হিন্দু কালেজে এই চেয়ারে বসে গোমাংস ভক্ষণ করেছিলেন, তারপর ম্লেচ্ছ দোষে দুষ্ট হওয়ায় সেসবকে জলের দরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাচার করে দেওয়া হয়। নবজাগরণের বুটধূলিতে ধন্য চেয়ারাকীর্ণ এই ক্যান্টিনে মধ্যরাতে নাকি কখনও কখনও পোড়া মাংসের গন্ধ পাওয়া যায়। প্রমাণ-টমান চেয়ে লাভ নেই, যদুনাথ সরকারের অপ্রকাশিত হিস্ট্রি বইতে নাকি সেসবের ইতিহাস লেখা ছিল। সেনেট হল ভাঙার সময় পান্ডুলিপিটি হাওয়া হয়ে যায়। পুর্নেন্দু পত্রীর ছবিতে সেসবের স্লাইট হিন্ট আছে, কিন্তু বোঝার জন্য চোখ থাকা চাই। আর এত কথার আছেই বা কি, রাখালদা সেই সুভাষ বোস থেকে বুদ্ধ-বিমান সবাইকে নাম ধরে ডাকে এ কি আমরা এমনিই জানিনা?

    এসবের পাশাপাশি আমাদের ক্যান্টিন, যাকে বলে অখাদ্য ও যমের অরুচি। একে তো ডেকরেশন বলতে শুধু দু-সারি চোঁচ-ওঠা বেঞ্চি, তায় গঙ্গার ওপারে, মানে বেলুড় মঠ টাইপের মফস্বলী কারবার। অবশ্য কলেজটাই বা কী পদের। শতাব্দী প্রাচীন হলে হয় কি, স্টার বলতে কূল্যে দুজন, মাইকেল মধূসুদন, আর বিনয় মজুমদার। একেবারে কুলীনকুল সর্বস্ব যাকে বলে। একজন হেনরিয়েটায় মত্ত অন্যজন গায়ত্রী চক্কোত্তিতে। একজনের বৌয়ের নাম রাধা আর পুত্রের নাম কেলো, অন্যজন, যত পারো মাল-গাঁজা গেলো -- পেডিগ্রি বলতে এই। আর কদিন পরে হলে অবশ্য রঞ্জন প্রসাদ আর প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়কেও হিসেবে ধরা যেত, কিন্তু এসব নব্বই দশকের শুরুর গপ্পো। এই সেই সময়, যখন সুমন সবে উঠছেন, তোমাকে চাই বোধহয় বছর খানেক আগে বেরিয়েছে, সবাই লোকটাকে চোখেও দেখেনি, মেয়েরা তখনও একে-তাকে "টেকো হলে কী হবে, হেবি নাকি হ্যান্ডু?" বলে প্রশ্ন করে জীবন ঈর্ষায় পরিপূর্ণ করে দিচ্ছে, মহীনের ঘোড়ায় বাজি ধরার সময় তখনও আসেনি। ফলে গ্ল্যামার বলতে ওই দুজনই। খানিক অপ্রাসঙ্গিক হলেও, ঝপ করে বলে নিই, অ্যাদ্দিন বাদে আমার মনে হয়, "পড়াশুনোয় ভালো হলে কি হবে, ছেলেগুলি জাস্ট বখে যাওয়া" -- বিই কলেজের ছেলেদের সম্পর্কে এই জাতীয় পাবলিক পারসেপশন খুব একটা ভুল নয়। ও আমাদের ঐতিহ্যে আছে। মাইকেল বা বিনয়, দুজনেই মহান কবি হলেও কারো সঙ্গেই তো মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়না।

    তো, সে মরুক, মোট কথা ম্যানেজারকে যেতে হতই, কারণ আমাদের ক্যান্টিনটি ছিল দুনম্বরী, অর্থাৎ পাতে দেবার অযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল রাখালদা, কফি হাউসের চাচা। কী প্রচীনত্ব, কী গ্ল্যামার, দাপটের চোটে বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খায়। মধ্য কলকাতার বিখ্যাত গোপাল-পাঁঠাও রাখালদার সামনে সুবোধ বালক হয়ে যেত, সেই নিয়ে বিদ্যাসাগর অবধি গোপাল ও রাখালের গপ্পো লিখেছিলেন, এ কোনো গোপন কথা নয়। তা এরকম সুমহান ঐতিহ্য আমাদের কোথায়? থাকার মধ্যে ওই এক বুড়ো ম্যানেজার। নাম নেই কোনো, শুধু পরিচয়, ম্যানেজার। সারা মুখে কাটাকাটা বলিরেখা, কেউ তার কথা শোনেনা, সেও কারো কথা শোনেনা, কানে সর্বক্ষণ একটা ভাঙা ট্রানজিস্টার নিয়ে বসে থাকে। অবশ্য করবেই বা কী? কোক-পেপসি তখন অনেকবছর নির্বাসনের পর সবে মার্কেটে ঢুকেছে, হেবি কেত, লোকে দেখছে আর ঢকঢক করে গিলছে। দোকানে দোকানে ঠান্ডাপানীয়ের নিয়ন সাইন ঝুলছে, শুরু হয়ে গেছে সুন্দরীদের বিজ্ঞাপন যুদ্ধ। ও পাশে নতুন কেকের দোকান খুলেছে, সেটার উচ্চারণ মঙ্গিনিজ না মনজিনিস হবে, সে নিয়ে হেবি তর্ক। কিন্তু আমাদের ক্যান্টিনে ওসবের বালাই ছিলনা। থাকার মধ্যে দুবছরের পুরোনো লাড্ডু আর ছমাস ধরে চোখের সামনে বাসী হতে থাকা কেক, নেহাৎ সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কবলে না পড়লে সাধ করে কেউ কিনে খেতনা। ম্যানেজার তাই চুপচাপ বসেই থাকত। যেন কুলুঙ্গীতে বসে থাকা নিথর প্যাঁচাটি। হ্যাঁ, এমনই ছিল তার মুখের গড়ন। চওড়া মুখ, স্পষ্ট বলিরেখা। কালো শরীর। অমনোযোগী চোখ। সেই মুখ দেখলেই আমার রঁদার ভাস্কর্যের কথা মনে পড়ত। ওই একদা যে ছিল শিরস্ত্রাণনির্মাতার সুন্দরী স্ত্রী -- সেই বৃদ্ধার নগ্নতার কথা। আরেকটাও মনে আসত, যার নাম থিংকার। কেন কে জানে। চেহারায় ভাঙন খুব স্পষ্ট ছিল বলে? বসার ভঙ্গী? হবেও বা।

    এসব নিয়ে হাসিঠাট্টা হত বিস্তর। কলকারখানায় নাকি জেনারাল ম্যানেজার হয়, আর আমাদের আছেন স্বয়ং ম্যানেজার জেনারাল। মেজর জেনারালের মতো। যিনি সর্বক্ষণ অতন্দ্র থেকে শুধু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন, ওয়াচ টাওয়ার ছেড়ে নড়েন-চড়েন না। আর্মি ডিসিপ্লিন বাবা, যাবে কোথায়। অন্য কলেজের ডে স্কলার বন্ধুবান্ধবরা তো খোরাকের চূড়ান্ত করত। কলেজ ফেস্টে এবার থেকে নাকি ক্যান্টিন কমপিটিশন চালু করা হবে। তাতে কী? না কেউ প্রথম পুরষ্কার পারে, কেউ দ্বিতীয়, শুধু আমরা নাকি পাব অদ্বিতীয় পুরষ্কার। যার পুরো কৃতিত্বই ম্যানেজারের। যিনি এক ও অদ্বিতীয়। সোহহং। এইসব। আরও একটা বাজে গল্প ছড়ানো হয়েছিল আমাদের নামে। ইলেকশনের আগে দুই পক্ষের মিছিল হত কলেজে, তাতে একটা কমন স্লোগান ছিল উভয় পক্ষেরই। ফার্স্ট গেটে কে? এসেফাই। সেকেন্ড গেটে? এসেফাই। টাওয়ার ক্লকে? এসেফাই। গ্রেভ ইয়ার্ডে? এসেফাই। এইরকম। (অন্য পক্ষ অবশ্যই এসেফাই বলতনা, কিন্তু প্যাটার্নটা একই ছিল)। তা, সেই নিয়ে দুষ্টু লোকে বলত নিজের দলকে বিই কলেজের ছেলেরা কবরখানায় পাঠালেও পাঠাতে পারে (সত্যিই একখানা কবরখানা ছিল কলেজে), কিন্তু ক্যান্টিনে কক্ষনো পাঠাবেনা। তাতে হার অনিবার্য। এটা অতি অবশ্যই অসত্যভাষণ, অন্য কলেজের অপপ্রচার, কিন্তু এই ছিল বহির্জগতে রেপুটেশন।

    তা, অন্য কলেজের ডে স্কলার নামক সুখের পায়রাদের যে কথা কখনও বোঝানো যায়নি, চেষ্টাও করিনি অবশ্য খুব একটা, তা হল, বিই কলেজ আসলে মধ্যরাতের প্যাঁচাদের জগৎ, যা পায়রাদের আয়ত্ত্বের বাইরে। তারা দিনের বেলায় শহরে বাজারে বকবকম করে, রাতে ফেরে গৃহকোণে। যেমনটি নিয়ম। আর রেলপাড়ের ঝুপড়ির মতো এই ক্যান্টিনের আসল মাহাত্ম কেবল বোঝা যেত শহরে রাত নেমে এলে। আমাদের ক্যাম্পাসে, বললে লোকে বিশ্বাস করবেনা, এত গাছ, যে লোকে বোটানিকাল গার্ডেন ভেবে ভুল করে ঢুকে পড়ত। সন্ধ্যে হয়ে এলে সেইসব ঝুপসি গাছের ছায়া দীর্ঘতর হত। সরু সরু রাস্তায়, তখনও আলোর বালাই ছিলনা। দুই চার-জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা সে অরণ্যে ঢুকে যেত, তাদের আর খুঁজে পাওয়া যেতনা। মাঝে-মাঝে আদ্যিকালের স্টিম-ইঞ্জিনের মতো লাইট জ্বেলে রাস্তা দিয়ে চলে যেত এক-আধটা পথভোলা ধুমসো অ্যাম্বাসাডার। সেই ধূ ধূ ক্যাম্পাসে গা ছমছমে অন্ধকার রাস্তায় টিমটিমে আলো জ্বেলে একাকী পান্থনিবাসের মতো চুপ করে বসে থাকত পথপ্রান্তের ক্যান্টিন। যেন ঠগীদের আস্তানা। গোপন তান্ত্রিকদের পীঠস্থান। আর ষাট পাওয়ারের বাল্বের নীচে তান্ত্রিক সাধনার গূঢ় তত্ত্ব আলোচনা করছি আমরা গুটিকয়েক পান্থজন। একটু বাদেই আমাদের বিরক্ত করে আধভাঙা ট্রানজিস্টর চালিয়ে দেবে ম্যানেজার। খ্যাড়খ্যাড় করে বাজবে কলকাতা ক। চাষীভাইদের বলছি। আর ক্যান্টিনময় মন্ত্রগুপ্তির শপথের মতো ছড়িয়ে যাবে আলুচাষের গোপন রহস্য। আমরা চমকে উঠব, আর বলিরেখাকীর্ণ ভাবলেশহীন ম্যানেজার মাথা নীচু করে বসে থাকবে। আমরা গিটার বাজিয়ে গান ধরব। কোথাও কোনো শ্রোতা নেই, নিজেরা ছাড়া। ম্যানেজার তবু রেডিও বন্ধ করবেনা। পাশাপাশি চলবে বব ডিলান আর কৃষিকথার আসর। ম্যানেজার বসেই থাকবে, ভাবলেশহীন। ট্রানজিস্টার কানে গুঁজে যেমন থাকে সারাদিন।

    এসব রাত্রের ওড়াউড়ির কথা কাউকে বোঝানো যায়নি, যাবার কথাও না। সেরকম অ্যাজেন্ডাও ছিলনা কারো। তাই ম্যানেজারকে যেতে হতই। আজ বা কাল। সময়ের ম্যান্ডেট খুব পরিষ্কার ছিল ওই নব্বইয়ের শুরুতে। জায়গার জিনিস জায়গায় রাখুন। ট্রানজিস্টর শুনতে হলে গ্রামে গিয়ে মেঠো রাস্তায় বসে আনন্দ করে শুনুন, মনে ভাব এসে গেলে শান্তিনিকেতনে দুদন্ড ফুর্তি করে আসুন। পাপকর্মে যান ডায়মন্ডহারবার। নাগরিকতা চাইলে সুমন শুনুন, ভাব এসে গেলে ব্রহ্মসঙ্গীত, কিন্তু ডিলান আর আলুচাষ একসঙ্গে, ইয়ার্কি নাকি? ওসব মধ্যযুগীয় আধিভৌতিক তন্ত্রসাধনার দিন শেষ। সেটা নেহাৎ আমরাই গাম্বাটের মতো বুঝিনি। ঘটনার মধ্যে থেকেও। এমনকি যেদিন ম্যানেজার সত্যি চলে গেল সেদিনও না।

    সেই দিনটার কথা আমার মোটামুটি এখনও মনে আছে। যেদিন ম্যানেজার বিদায় নিল আর কি। মনে থাকার মতো কিছুই নেই অবশ্য, নাটক ফাটক কিছু হয়নি। হবার কথাও ছিলনা। নিজের ট্রানজিস্টারটা এক কোণে রাখা ছিল, সেটা তুলে নিয়ে একবার ভিতরের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়তে, বলল, যাচ্ছি। বলিরেখাগুলো একটু স্পষ্ট হল। ব্যস। বিদায় বলতে এই। উত্তর দিয়েছিলাম কিনা মনে নেই। ম্যনেজার পিছন ঘুরে আস্তে আস্তে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটা আধময়লা সাদা পাঞ্জাবি পরেছিল সে। নীচে কী ছিল মনে পড়েনা। মনে থাকার কথাও না। বস্তুত ও নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথাও ছিলনা। চাচার বিদায় খবরের কাগজে খবর হয়েছিল, লিটল ম্যাগাজিনে আলোড়ন।রাখালদা স্মরণে তো হুজ-হু রা সশরীরে চলেই এসেছিলেন। কিন্তু এসব অনেক পরের কথা। তখন জানার কথাই নয়। জানলেই বা কি হত, ম্যানেজারের অন্তর্ধান তো তেমন হাই প্রোফাইল কিছু না, যে, সেনেট হল ভেঙে যাবার মতো পূর্ণেন্দু পত্রীর ছবিতে লটকে থাকবে। কারবার চালাতে পারেনি, চলে যাচ্ছে, ব্যস। সত্যি কথা বলতে কি, কারবার চালাতে পারেনি, নাকি চলে যেতে বলা হয়েছিল, তাও জানিনা। শুধু মনে আছে, তখন ক্যান্টিনে নতুন আলো বসে গেছে। পাল্টে গেছে চেয়ার-টেবিল। ঠান্ডা মেশিনও হাজির। পেপসির গ্লো সাইন বসেছে কিনা মনে নেই। না বসলেও কদিনের মধ্যেই বসে যাবে, শহুরে কলকাতার সমস্ত উন্নতমানের ক্যান্টিনের সঙ্গে পাল্লা দেবে আমাদের শতাব্দীপ্রাচীন কলেজ। গিজগিজ করবে ছেলেমেয়েরা। গমগমিয়ে চলবে হিট গান। আমরা ক্লাস মায়া করে প্রত্যহ নতুন ফিলিম, লাতিন আমেরিকান সাহিত্য নিয়ে তক্কো করব। এইসব হবে-টবে। তার আগে কে ওসব ছুটকো শেষ-দিন নিয়ে মাথা ঘামায়।

    অবশ্য এটা যে শেষ দিন তাও ঠিক না। এরপরেও এক আধবার ম্যানেজারকে দেখেছি। পুরোনো ধার-বাকি উদ্ধার করতে মাঝে-মাঝেই কলেজে আসত। খাতাপত্তর নিয়ে। দেখা হত। বাক্যবিনিময় কখনও হয়নি। বা হলেও মনে নেই। শুধু শেষ দিনটার কথা, কেন কে জানে, মনে আছে। সেটা উৎসবমুখর রিউনিয়নের সকাল। সকাল বলে মনে হলেও, আসলে দুপুরই হবে, কারণ রিইউনিয়নের মধ্যে দুপুরের আগে ঘুম থেকে ওঠে কোন লক্ষীপ্যাঁচা। তা, ক্যান্টিনের দিকে যেতে গিয়ে দেখি বকুলতলার পাঁচিলে একা বসে ম্যানেজার। হাতে সেই ট্রানজিস্টার। আর একটা বই। ম্যানেজারের হাতে বই? ক্কী ক্কান্ড। কাছে গিয়ে দেখি, ধুর, ধার-বাকির খাতা। আমাকে দেখে, মাথা নাড়ে। বলে, এলাম। রেবেকার দিনে যদি কেউ দেয়। ভাবলেশহীন মুখে। বলতে বলতে বলিরেখাগুলো একটু স্পষ্ট হয় মাত্র। ম্যানেজারকে আমি কখনও হাসতে দেখিনি। কাঁদতে তো নাই।

    কী ভেবে, আমি পাঁচিলে উঠে ম্যানেজারের পাশে বসে পড়ি। কোনো কথা বলিনা। সে যথারীতি ট্রানজিস্টর চালিয়ে দেয়। কী শোনে কি জানি। চারিদিকে উৎসবমুখর পুজোর দিন, সুন্দরী মেয়েরা হেঁটে-হেঁটে যায়, ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় সুগন্ধ। আর আমার পাশে কানে ট্রানজিস্টর নিয়ে বসে থাকে নতমুখ ও দীর্ণ ম্যানেজার। রঁদার থিংকার।

    আমরা পাশাপাশি বসে থাকি অনেকক্ষণ। সেই শেষবারের মতো।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ | ১৫০০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sumitr roy | 79.207.13.161 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০১:০৫46772
  • সাধু! মজা পেলাম পড়ে।
  • π | 79.204.169.146 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০২:০৫46773
  • এসব লেখা পড়ে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ।
  • kk | 81.236.62.176 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০২:৪২46774
  • খুব ভালো লাগলো এই লেখাটা।
  • pinaki | 148.227.189.9 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:০৪46775
  • বেশ ভাল্লাগলো।
  • সিদ্ধার্থ | 125.118.104.34 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৪:১৪46776
  • এই নিয়ে পাঁচবার পড়লাম। লুপে পড়ে যাচ্ছি
  • I | 24.99.13.199 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৪:২৩46777
  • কী আর বলি। সৈকতের লেখা যেমন ভালো হয়। আমার লেখা পড়ে এই লেখাটার কথা ওর মাথায় এসেছে ভাবতেও ভালো লাগে।
  • | 24.97.54.37 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৪:৫৬46767
  • আরো একজন নেই-মানুষ :-(
  • শিবাংশু | 127.197.248.242 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৫:০৯46768
  • বাহ...
  • ফরিদা | 192.64.11.251 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৫:৩৬46778
  • এটা বেশ অচেনা মামু। যে মামু গান গায়, সুর বসায় সেইরকম।
  • কল্লোল | 125.242.151.98 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:০৭46769
  • কলম অক্ষয় হোক তোর।
  • Blank | 69.93.242.251 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:২০46770
  • বাহ বাহ
  • ল্যাদোষ চন্দ্র মিত্র | 118.91.116.131 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:২৩46771
  • বাহ, একদম ঈশান-ish - তবে একটু নরম, করুণ।
    কিন্তু, ইয়ে থিঙ্কার এর কিন্তু হেব্বি মাসল ছিল ।
  • ranjan roy | 24.96.88.126 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:৩৯46779
  • ইন্দো ও মামুকে দেখে আরো অনেকে উদ্বুদ্ধ হোন, হারিয়ে-যাওয়া-মানুষ সিরিজট কে এগিয়ে নিয়ে যান।
  • Pijush Dey | 113.24.190.162 (*) | ০৬ অক্টোবর ২০১৩ ০১:৪৬46782
  • সৈকতের লেখার এমনিতেই ফ্যান। তাই পাঠ কোরে
    কি কোরব বুঝে উঠতে পারলাম না।
  • সিনফট | 127.194.231.247 (*) | ০৬ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:৪৫46780
  • এ লেখায় ব্যালান্স গেছে হারিয়ে। ম্যানেজার যে সত্যি একলা মানুষ, নেই মানুয সেসব পেরিয়ে, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সির সাথে তুলনাটাই বেশি। ম্যানেজারের জন্য কেন ফীল করব বুঝলাম না। সরি।
  • সিকি | 131.243.33.212 (*) | ০৬ অক্টোবর ২০১৩ ১১:৩০46781
  • অসা।
  • ঈশান | 202.43.65.245 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০২:৫৪46785
  • ক্যান্টিনটা একই। ইনস্টিটিউট হল আর বেকসু আপিসের গা ঘেঁষে যেটা। তখন চালাতেন এই ভদ্রলোক। পরে হাতবদল হল। সেটা নিয়েও লেখা যায়। :)
  • Tim | 188.91.253.11 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:৩১46783
  • ঈশানদার হাতে কটকটে শার্প লেখা অনেক বেশি উপাদেয় হয়। লেখনীর যে স্বাভাবিক্ল স্মার্টনেস সেটা এই ধরণের লেখার বড়ো শত্রু। ম্যানেজারের জন্য কষ্ট হওয়ার অবকাশ পাইনা, একটা গতিময়তা আর সপ্রতিভভাব বিষাদটা থিতিয়ে যেতে দেয়না। তবে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা আমার বড়ো প্রিয় বিষয়, এমন লেখা আরো আসুক।
  • ইনাসি | 212.142.119.142 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:৩৯46786
  • ধন্যবাদ সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়,
    আপনি লিখেছেন " শতাব্দী প্রাচীন হলে হয় কি, স্টার বলতে কূল্যে দুজন, মাইকেল মধূসুদন, আর বিনয় মজুমদার। একেবারে কুলীনকুল সর্বস্ব যাকে বলে।"
    আমি বলছিলাম কি নারান সান্যাল, বদ্ধদেব দাশগুপ্ত, বাদল সরকার এঁদের হিসেবের মধ্যে নিয়ে আর একটু কুলীন হবার চেষ্টা করা যেত না?
    আর মাইকেল এখানে পদধূলি দিয়েছিলেন ঠিক-ই, কিন্তু তিনি তো পড়তেন বিশপ কলেজে। সিপাহি বিদ্রোহের সময় সাহেবরা ভয় পেয়ে কলেজের তল্পি তল্পা গুটিয়ে কলকাতা চলে গেলেন। ঘরবাড়ি সব পড়ে রইল। ওদিকে রাইটার্স থেকে উচ্ছেদ হওয়া অব্দি 'দি ক্যালক্যাটা সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ', প্রেসিডেন্সি (তখন হিন্দু) কলেজে সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্ট হয়ে কিরকম যেন খাপছারা অবস্থায় আছে। এদিকে ইঞ্জিনীয়ার-এর যোগান বাড়াতে হবে। তাই এই ফেলে যাওয়া পরিসরে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের আগমন। সেও ১৮৮০ সালের কথা।
  • ঈশান | 214.54.36.245 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:৪৬46787
  • অ্যাল। সরি। লেখার সময় বাদল সরকার আর বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ভুলে গিয়েছিলাম। তখন বাদল সরকারকে নিয়ে সত্যিই খুব ফাটাতাম। কিন্তু আর তো এডিট করা যাবেনা। তাই এখানেই লিখে দিলাম।
  • SG | 134.124.204.10 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০৭:৩৪46784
  • একটা ছোট প্রশ্ন : এটা কথায় ছিল , মানে আফসার দার ক্যান্টিন এ কি?
  • . | 172.69.134.122 | ০৫ মে ২০২০ ১৩:৪৫93044
  • .

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন