যে তুমি ফোটাও ও ফুল ঘ্রাণে ভরো ব্যাপক সবুজ জমিতে বিছিয়ে দাও ধান শিম খিরোই তরমুজ কুমড়োর সুস্বাদ, যে তুমি ফলাও শাখে ফজলি আম কামরাঙা পেয়ারা, বাতাসে দোলায় গুচ্ছগুচ্ছ জাম, যে তুমি বহাও নদী, পাললিক নদীর ভেতরে লালনপালন করো ইলিশ বোয়াল স্তরেস্তরে, যে তুমি উঠাও চাঁদ মেঘ ছিঁড়ে নীলাকাশ জুড়ে বাজাও শ্রাবণ রাত্রি নর্তকীর অজস্র নূপুরে , যে তুমি পাখির ডাকে জেগে ওঠো, এবং নিশ্চুপে বলিকার সারা দেহ ভরে দাও তিলেতিলে রূপে আর কণকচাঁপার গন্ধে আর ভাটিয়ালি গানে, যে তুমি বইয়ে দাও মধুদুগ্ধ গাভির ওলানে খড় আর ঘাস থেকে, যে তুমি ফোটাও মাধবী আর অজস্র পুত্রকে দাও ছন্দ- করে তোলো কবি, যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর- সে তুমি কেমন করে, বাঙলা, সে তুমি কেমন করে দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছ পালেপালে শুয়োর কুকুর? ... ...
দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার কাজী পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আয়শা সিদ্দিকা নামের এক নারী কাজী পদের জন্য আবেদন করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও শুধু মাত্র পুরুষের জন্য এই পদ এমন কিছু লেখা ছিল না। আর যেহেতু তিনি আর বাকি সব দিক দিয়ে যোগ্য ছিলেন তাই তিনি আবেদন করে দেন। যথা সময়ে পরীক্ষা হয়, তিনি প্রথম হন। তার সাথে আরও দুইজন নারী আবেদন করেন। এবং পরবর্তীতে পুরো প্যানেলকেই বাদ দেওয়া হয় শুধু মাত্র নারী এই যুক্তিতে। শারীরিক সীমাবদ্ধতা, রাত বিরাতে বিয়ের জন্য যেতে হবে ইত্যাদি নানান কারণ দেখিয়ে তাদের না করে দেওয়া হয়। এবার শুরু হয় আয়শার লড়াই। ২০১৪ সালে তিনি আদালতে যান। আইনের কোথাও নারী হিসেবে নিকাহ রেজিস্টার হতে পারবে না এমন কথা না থাকার পরেও এতদিন পরে আদালত এই রায় দেয় যে নারী বিবাহ পড়াতে পারবে না। আয়শা সিদ্দিকা আবার আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন। কি হতে পারে এখনই অনুমান করা যাচ্ছে। বিশেষ করে মানুষের যে পরিমাণ সমর্থন এই কয়দিনে আদালত পেয়ে গেছে তাতে আরও সহজ হয়ে গেছে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আমার দুইটা কথা না বললে ভাল লাগছে না তাই লিখতে বসছি। ... ...
নিকোলাস পাড়া। নাফাখুম থেকে প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা ঝিরি পথ দিয়ে হেঁটে পাহাড় টপকে এক অদ্ভুত জায়গায় পৌছালাম।এই পাড়া প্রতিষ্ঠা করেছে নিকোলাস ত্রিপুরা। পদ্মা নদীর মাঝির হোসেন মিয়ার মত নতুন এক নতুন ঠিকানা তৈরি করেছে নিকোলাস। তার গল্প পুরোপুরি আমি জানি না, আমি যা এখন পর্যন্ত জানি তা হচ্ছে এ এক অদ্ভুত জায়গা। আমরা এসে পৌছাতে পৌছাতে সন্ধা নেমে এসেছিল। তারপর থেকেই জাদুবাস্তবতার জগতে চলে গেছি যেন। এখানে পাহাড়ের কোলে কুসুম গরম সুর্য টুপ করে ঢলে গেল। কয়েক বাড়ি আদিবাসিদের সন্ধ্যা আসল সরল পথে। যে সমাজ আমরা দেখে অভ্যস্ত তার সাথে তুলনা কই? শিশুরা অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দেখছে। আমরা আমাদের নিয়ে ব্যস্ত। খাড়া পাহাড় উঠে আমরা ক্লান্ত, তারচেয়ে আসলে আমরা ব্যস্ত নতুন জায়গার চারপাশ দেখতে। এরপরই যেন শুরু হল জাদুর খেলা। শা করে তারা চলে আসল আমাদের কোলে। ঝকঝকে লাখ লাখ তারা যেন আমাদের ঘিরে নেচে চলছে। আমাদের সাথে মজা নেওয়ার জন্যই যেন দুই একটা তারা দৌড়াচ্ছে এদিক ওদিক। হুট করেই খেয়াল করলাম আমাদের সকল কাজের সমাপ্তি হয়েছে। আগামীকাল ভোরে নতুন পথে রউনা হওয়ার আগে আমাদের ঘুম আর খাওয়া ছাড়া কোন কাজ নাই। এই গ্রামের মানুষ অন্য সময়ে কী করে এই সময়ে? সন্ধ্যায় চা নাস্তা খাওয়া মানুষ আমরা। এরপর নানা অকাজে ব্যস্ত থাকা আমরা বুঝেই উঠতে পারছি না এদের জীবন। এই গ্রামে পানির ব্যবস্থা নাই। পানি নিয়ে আসে ওরা অনেক নিচে থেকে। নেই কোন পয়নিস্কাশনের সুস্থ কোন ব্যবস্থা। নেই মানে নেই। বন হচ্ছে এদের ভরসা স্থল। এই সমাজ কীভাবে আমাদের বুঝে আসবে? আসার কোন সম্ভাবনা আছে? আমার মনে হয় না। ছনের ঘর। ঘর উঁচু করেছে বাঁশ দিয়ে খুটি দিয়ে। তাড়াই বাঁশের বেড়া হচ্ছে মেঝে। আমরা যা দেখি তাই মুগ্ধ হই, বা মুগ্ধ হওয়ার ভান করি। কৃত্রিমতায় পূর্ণ জীবন কি জানে সত্যিকার মুগ্ধ হওয়া কাকে বলে? ... ...
আমি এক ঝটকায় সব ছেড়ে দিলাম। সোজা আব্বার পাশে। শুরু হল আমার সংগ্রাম। আমার মনে হয়েছে আমি লোক রেখে আমার মন মত সেবা আমার বাবাকে দিতে পারব না। আমার মনে হয়েছে এখন আমার বাবা উনার পাশে উনার কাছের একজনকে খুঁজবে। এখানে বলে রাখা ভাল যে আমার মা মারা গেছেন ২০১২ সালে। এবং তখন থেকেই আমি বুঝতেছিলাম যে আমাদের এই বিশাল ভাই বোনের পরিবারে আমি আর আমার বাবা এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দুইজনই ব্যাচেলর। সবাই যার যার সংসারের নানান সমস্যায় জর্জরিত। তাদের চিন্তার, তাদের কাজের সেন্টার অফ গ্রেভেটি পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাদের বৃত্তের কেন্দ্র এখন আমার বাবা না। সন্তান, স্বামী তারপরে হয়ত শ্বশুরবাড়ি তারপরে আব্বা। কাজেই চাইলেও তারা পারবে না পুরোপুরি সময় দিতে। কাজেই এ কাজ যে আমার তা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারেছিলাম। ... ...
এই যে দুই দুইটা সম্প্রদায় প্রবল ভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। একজনের রক্তে আরেকজনের হাত রঞ্জিত হল, এত কিছুর পড়েও তো আমরা একদিন বুঝতে পারলাম আমরা আসলে এক। আমাদের জাতি পরিচয় এক। ৪৭ সনের দুঃখ ভুলতে আমাদের বেশি সময় কিন্তু লাগেনি। সময় আমাদের আবার একটা সুযোগ দিয়েছিল। দুই সম্প্রদায় সমস্ত নীচতা, সমস্ত কালিমা ভুলে গিয়ে ১৯৭১ সালে মিশে গিয়েছিল। গোলাম মুর্শিদ তাঁর হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি বইয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা। সেবার দুর্গা পূজায় পূজা মণ্ডবে দুর্গা প্রতিমার সাথে বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখা হয়েছিল! উনাকে অমিতাভ চৌধুরীর স্ত্রী সুনন্দা চৌধুরী তাঁর একমাত্র ভাইয়ের সাথে একত্রে বসয়ে দিয়েছিলেন ভাই ফোঁটা! ভাই ফোঁটা দিয়ে ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তাকে। এমন অজস্র উদাহরণ তৈরি হল সে সময়। এর আগের সমস্ত কালিমা নিমিষে দূর হয়ে গেল। হাওয়ায় উড়ে গেল যেন ধর্ম বর্ণ, ঘটি বাঙালি সহ যত বাধা ব্যবধান! ... ...
স্বাদের কথা যখন বললাম তখন আরেকটু বলি। বড় ঈদ মূলত খাওয়ার ঈদ। কোন পরিসংখ্যান আছে কিনা জানা নাই আমার। আমার ধারনা এই ঈদের পরে মানুষ বেশি অসুস্থ হয়। কারণ সবার ঘরে ঘরে গোরুর মাংস। সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাত চলছে গোরু খাওয়া। এখন অনেক ধরনের রান্না হয় মাংস। আগে তা হত না। আম্মাকে দেখতাম বড় এক পাতিলে অনেক মাংস একবারে রান্না করত। ওই এক জিনিসই। চলত জ্বাল দেওয়া আর খাওয়া। একদিন পর থেকে স্বাদ পরিবর্তন হয়ে যেত। যতই দিন যেত ততই নতুন স্বাদ পাওয়া যেত। দুইদিন তিনদিনের মাংসের যে স্বাদ তা রীতিমত স্বর্গীয় লাগত আমাদের। জ্বালে জ্বালে মাংস আর মাংস থাকত না, সব মিশে অন্য কিছু একটা হয়ে যেত, যার কোন তুলনা নাই। ঈদের পর দিন আমাদের বাড়িতে খাওয়া হত গোরুর মাংস আর পরোটা। কেউ কেউ চালের গুড়ার রুটি খেত, আমাদের এখানেও হত। লা জবাব স্বাদ! এখন নানান ধরনের রান্না হয় মাংস। কাবাব হয়, কোরমা হয়, টিকিয়া হয়, সাদা মাংস রান্না হয়, এবং আরও নানান ধরনের রান্নায় এখন ঈদ জমে যায়। ... ...
Commonwealth War Graves Commission নামে একটা সংস্থা আছে। এরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশ যত সৈন্য নিহত হয়েছে তাদের প্রতি সম্মান জানানোর কাজ করে। বিভিন্ন জায়গায় যত কবর আছে যুদ্ধের সব গুলোর যত্ন নেওয়া, ইতিহাস তুলে রাখা এবং তাদের যেন কখনোই মানুষ ভুলে না যায় তা নিশ্চিত করা হচ্ছে এদের কাজ। CWGC একটা ওয়েব সাইট আছে, তাতে তারা বলছে পুরো দুনিয়ায় ২৩ হাজার স্থানে ওয়ার সিমেট্রি আছে আর তাতে শায়িত আছে ১.৭ মিলিয়ন নর নারী সৈনিক। এই সংস্থা ১৯১৭ সালে Imperial War Graves Commission নামে যাত্রা শুরু করে, ১৯৬৫ সালে নাম পরিবর্তন করে Commonwealth War Graves Commission হয়। কিন্তু কাজ একই আছে, এই দীর্ঘ দিন ধরে তারা নিজেদের বীরদের সম্মান দিয়ে আসছে। ... ...
হিন্দি সিনেমার নায়ক নায়িকা চেনা ছিল বিশেষ গুন। সবাই পারত না, ফট ফট করে নাম বলে দেওয়া এ কি সোজা কথা? ডিডি ওয়ান আমাদের কাছে বিটিভির মতই ছিল। তাই আমরাও দুই একটা নাম জানতাম। কিন্তু আমাদের চেয়েও পাকনা কেউ আসলে অবাক হওয়া ছাড়া ভিন্ন কোন রাস্তা থাকত না। একটু ঘাইঘুই করে মেনে নিতাম। ঢাকা থেকে কোন আত্মীয় আসছে, তাদের সাথে আমরা পারি? হয়ত বাসায় তাদের ভিসিআর আছে, ততদিনে ক্যাবল লাইনও চলে গেছে ওদের ঘরে। নিত্য নতুন সিনেমার গল্প, নায়ক নায়িকার কিচ্ছা আমরা কই পাব? রবিবার করে রঙ্গোলী আর চিত্রাহার দিয়া খুব বেশি ফাইট দেওয়া যেত না। তাই মেনে নিতাম। ... ...
লোকটা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। চাকরি দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল যে মৃত মানুষ নিয়ে কারবার। চাকরি দরকার, আমি রাজি হয়ে গেছি। কিন্তু আমাকে নদীর পাড়ে, ঠিক শ্মশানের পিছনে নিয়ে আসল কেন বুঝে উঠতে পারছি না। এদিকে অন্ধকার থাকে সব সময়। শ্মশানে আগে আসলেও পিছনে আসা হয়নি। কিন্তু আমার সুপারভাইজারের কোন দিকে কোন খেয়াল নেই, তিনি হনহন করে হাঁটছেন আর বলছেন, "আসেন, জলদি আসেন। কাজ ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সময়ের এদিক সেদিক হয়ে মহা কেলেঙ্কারি!" আমি তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি, আর ভাবছি, সমস্ত ব্যস্ততা শেষ করেই তো মানুষ শ্মশানে আসে, এখানে এত কিসের তাড়াহুড়া? আমার সুপারভাইজার, যার নাম মোহাব্বত, তাকে যে জিজ্ঞাস করব, তার সুযোগ তিনি দিচ্ছেন না। বিড়ি টানতে টানতে দ্রুত হাঁটছেন তিনি, পারলে দৌড় দেন! ... ...
সাড়ে পাঁচশ পৃষ্ঠার বই যখন শেষ হয়ে আসছে, মহারাজা যখন সমানে অসুস্থ হয়ে পরছেন তখন আমাদেরকে আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছিল এই লোকটা কী জিনিস ছিল। আমি সিনেমার হিসাব করছিলাম তখন, শুধু মনে হচ্ছিল না, এই অসুস্থতায় তিনি যাবেন না, এখনো তো আগন্তুক করা বাকি, এর আগে যাবেন কী করে? অসুস্থ অবস্থায় শেষ সিনেমা আগন্তুক তৈরি করলেন, উৎপল দত্ত তার জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয় করলেন। আর শেষ সিনেমায় এসেও সত্যজিৎ দেখালেন তিনি কত বড় পরিচালক, কী দুর্দান্ত কাজই না করে গেছেন। আগন্তুক সিনেমার শুটিং শেষ হওয়ার পর, শেষ শট নেওয়ার পর তিনি বলে উঠেন, "যাঃ, আমার যা কিছু বলার ছিল সব ফুরিয়ে গেল, আমার আর কিছুই বলার নেই।" এই কথা শোনার পর বিজয়া রায়ের যেমন লেগেছিল, আমাদেরও তেমনি যেন লাগে। আমরা জানি তাই সত্য হয়েছিল। কিংবা বলা চলে উনার সময় ফুরিয়ে গেছিল, সত্যজিতের মত মানুষ কী কোনদিন ফুরিয়ে যায়? ... ...