অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী—এই আপ্তবাক্যকে অবহেলা করে বাহাদুরি দেখাবার চিরাচরিত বাঙালি অভ্যাস কখনও ত্যাগ করিনি। লিলিয়ানার কাছে শোনা জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার এই সুযোগ। বললাম, ভিটেক, যতটুকু জানি – পোলিশ, চেক, স্লোভেনিয়ান একই স্লাভিক ভাষা পরিবারের সদস্য। তফাৎ আছে ব্যাকরণে, বাক্য বিন্যাসে, কিন্তু নিত্যদিনের ব্যবহারের শব্দ প্রায় এক। পোলিশে তোমরা গোনো ইয়েদনা দ্ভা ত্রি, স্লোভেনিয়ানরা গোনে এনা দ্বা ত্রি; পোলিশে কেনা হলো কুপিচ, এরা বলে কুপিতি। কার্ড কেনা নিয়ে কথা। তুমি তো আর দোকানদারের সঙ্গে ব্লেদ শহরের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা বিষয়ে কোনো আলোচনায় বসছ না! ... ...
জীবন চলমান। কাদামাটির রাস্তা গিয়ে মেশে পিচে অ্যাসফল্টে। প্রকৃতির হাওয়া কেড়ে নেয় বিদ্যুতি বাতাস। তার মাঝেই উঁকিঝুঁকি দেয় জোনাকিরা। হাতছানি দিয়ে ডাকে গ্রামীণ স্বপ্ন। আন্তরিকতা আর সৌজন্যের তফাৎ বুঝতেই কেটে যায় অনেকটা সময়। কাদামাটি আর ইটপাথরের সংশ্লেষময় সময়ের বৃত্তান্ত। ... ...
প্রথমেই এখানে যে প্রশ্ন ওঠে সেটি হল কর্মীর যোগ্যতার আগে সেই কর্মীকে দিয়ে কাজ করানো সিস্টেমের যোগ্যতা নিয়ে। কোনো কর্মীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাঁর প্রাপ্ত নম্বর অথবা একটি কাজ করার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার পরিমাপ (সেরকম পরিমাপযন্ত্র একমাত্র ছাত্রের মূল্যায়ন বাদে কিছু আছে বলে আমার জানা নেই) যাচাই করার আগে যাচাই করার দরকার গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটিকেই। যে ব্যবস্থা দীর্ঘদিন যাবত পূর্ণ সময়ের নিয়োগ না করে, ক্লাস পিছু পূর্ণ সময়ের শিক্ষকদের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ বেতন দিয়ে টিকে আছে (যখন এই কম বেতন পাওয়া কর্মীদের চাকরি নিশ্চিত হয়নি তখন থেকে) সেই সিস্টেমের যোগ্যতা থাকে কি নিযুক্ত কর্মীর যোগ্যতা বিচার করার? বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ামক ইউজিসির নির্ধারিত ক্লাস পিছু অর্থের অনেক কম টাকায় কাজ করিয়ে নেওয়া এই ব্যবস্থা বা অব্যবস্থা যেটুকু ভদ্রস্থ অবস্থায় আছে সেটুকু অবশ্যই এই বৈষম্যের শিকার হওয়া শিক্ষকদের কাঁধে ভর করে। তাই গালভরা ডিগ্রি বা একাডেমিক যোগ্যতার ধুয়ো তুলে (যা অবশ্য এঁদের অনেকেরই আছে) স্যাক্ট শিক্ষকদের খারিজ করার অধিকার কারোরই নেই। ... ...
উপন্যাসটি আশ্চর্যজনকভাবে একজন প্যারানয়েড, নিজের জালে আটকে পড়া শাসকের চরিত্র চিত্রায়িত করেছে। যখন জাবিবা বলেছেন, “আপনার প্রাসাদের দিকে তাকান: মোটা দেয়াল, জানালা প্রায় নেই, অন্ধকার, বাইরের বাতাস ঢুকতে পারেনা, বাঁকানো করিডোর। এখানে থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো এক দানবের বাড়িতে বাস করছি। এখানে শুধু রাক্ষস বাস করতে পারে, এখানে ষড়যন্ত্রের বীজ অঙ্কুরিত হয়। রাজার দুর্গ তার কাছে কারাগারে পরিণত হয়েছে: যেমন মোটা দেয়াল আপনাকে বাইরে কী চলছে তা শুনতে বাধা দেয়, ঠিক যেমন আপনি খুব কমই দিনের আলো বা তাজা বাতাস পেতে পারেন, তেমনি বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য আপনার আর্তনাদ কখনই শোনা যাবে না। তার উপর আপনার পালানোর পথ অবরুদ্ধ, এবং আশেপাশে এমন কেউ নেই যে আপনাকে সাহায্য করবে।” ... ...
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ঐতিহ্যের মধ্যে র্যাগিং-এর ঘটনাগুলিকে (একটি বীভৎস মৃত্যুর ঘটনার পাশাপাশি যখন বহু বছর ধরে হয়ে আসা অত্যাচারের বিভিন্ন বয়ান উঠে আসছে) কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, এইটা আমাদের ভাববার বিষয়। ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে র্যাগিং একটি অতিসংক্রামিত সামাজিক ব্যাধি। বিভিন্ন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০০ সাল থেকে ভারতের বিচারব্যবস্থা এবং শিক্ষানিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি র্যাগিং প্রতিরোধে কড়া ব্যবস্থার নিদান দেয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ব্যবস্থাগুলির প্রায় কোনওটিই লাগু হয়নি। এবং ছাত্রদের মধ্যেও র্যাগিং বিরোধী কোনও সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। বরং, এই কথা শোনা গেছে, ২০০৭ সালে নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধিরা র্যাগিংকারীদের শাস্তির বিরোধিতা না করায় বাকি ছাত্রদের একটি অতিসরব দলের চাপে তাদের পদত্যাগ করতে হয়। আমরা জানি, র্যাগিং পরম্পরামেনে চলে। জুনিয়র ব্যাচের ছাত্ররা পরের বছরের জুনিয়র ব্যাচকে র্যাগ করে। এক প্রতিষ্ঠানের র্যাগিং-এর গল্প শুনে আরেক প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা র্যাগিং-এ উদ্বুদ্ধ হয়। সম্ভবতঃ সেই ধারা ধরেই কলোনিপ্রভুদের বহু বদঅভ্যেসের মতন এই প্রথাও এদেশের শিক্ষিত সমাজে ঢুকেছিল। আর, পরম্পরা হিসেবে একটি অপরাধকে বহুজনের মধ্যে মান্যতা দিয়ে দিলে, তথাকথিত বিবেকবান ব্যক্তিও অনেকক্ষেত্রে তাতে লিপ্ত হতে সংকোচ বোধ করেন না। কিন্তু, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিকভাবে এ পরম্পরার বাহক, তা তো ঠিক এর বিপরীতমুখী। ... ...
১৯৩৬ সালের বসন্ত কাল। আর মাস খানেক বাদেই রয়েছে ইউএসএর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বিভাগে ভর্তির পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই এখন বেশ কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বছর বাইশের তরুণী জিন ফ্রান্সেস ট্যাটলক (Jean Frances Tatlock)। তা নাহলে এতক্ষণে হয়তো তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কোনও কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার সক্রিয় কর্মী তিনি। ট্যাটলকের জন্ম ইউএসএর বিখ্যাত পঞ্চ হ্রদ তীরবর্তী মিচিগান প্রদেশে। তবে বর্তমানে পশ্চিম ইউএসএর ক্যালিফর্নিয়া প্রদেশের বার্কলে শহরের বাসিন্দা তিনি। বার্কলে শহরের কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের ঘরোয়া সভাই হোক বা ডক শ্রমিকদের পথসভা- সর্বত্র হাজির থাকেন তিনি। কিন্তু ইদানীংকালের সভা সমিতিতে বড় একটা দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। ওই যে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বিভাগে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ... ...
সুভাষবাবু তো স্পষ্টই বললেন, “নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয় – এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব – তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই, বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের 'দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরু'র মত প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।” কাজিদা নিজেও তো সম্বর্ধনার উত্তরে বলেছিল, “...আমি জানি, আমাকে পরিপূর্ণরূপে আজও দিতে পারিনি; আমার দেবার ক্ষুধা আজও মেটেনি। যে উচ্চ গিরিশিখরের পলাতক সাগরসন্ধানী জলস্রোত আমি, সেই গিরিশিখরের মহিমাকে যেন খর্ব না করি, যেন মরুপথে পথ না হারাই!– এই আশীর্বাদ আপনারা করুন।” ... ...
পার্থ গাছ আঁকছিল। এক বিশেষ আলোয় সে দেখেছে গাছকে যার তলায় রাতের বেলা হরিণ ঘুরছিল। রাতের বেলা বলে তখন গাছকে দেখা যায়নি, রান্নাঘরের জানলার পাতলা জালের ওপাশে দলে দলে হরিণ দেখা গেছে — চিতল হরিণ। ছবি আঁকছে দেখে বাঘা তাকে বলল,“সূর্যের আলোয় তোর মাথা ধরে যাবে। ছাওয়ায় বস।” পার্থ বলল,“ হ্যাঁ রোদে আমার মাথা ধরে যাবে। সরে যাচ্ছি। ” বাঘা বলল,“ সূর্যের আলো পড়লেই রোদ হয় আর গরম চেপে আসে তখনই তোর মাথা ধরবে। এই জঙ্গলের মধ্যে মাথা ধরে গেলে রোদ লেগে গেলে বড় মুশকিল।” একটা বিশেষ কোণ থেকে পার্থ গাছটা দেখতে পেল আর আলো এসে তাতে এমনভাবে পড়ল যে সে থাকতে না পেরে ছবি আঁকছে। সামনের রাস্তা দিয়ে একটা বাঁদর হেঁটে হেঁটে আসছিল, কুমু মালানি বনবাংলোর চাতালে বসে বসে দেখছিল বাঁদরের হাঁটা — রাস্তা দিয়ে। ... ...
ফেসবুকের ওই পোস্টটার মধ্যে হয়তো আঠা ছিল। আর স্ক্রল ডাউন করতে পারলাম না। একজন লিখেছেন, ‘স্বপ্নদীপের মৃত্যু নিয়ে এই শোরগোলের আয়ু আর মাত্র কয়েকদিন, যে কদিনের মধ্যে নতুন কিছু এসে এই ঘটনাকে চাপা না দিয়ে দেয়।’ দিন তিনচারেক আগের সেই পোস্টের ভবিষ্যৎ-বাণী ফলতে দেখেছি ইতিমধ্যেই। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন, বিগ ডে মহা-ধামাকায় তেলের সঙ্গে আটা ফ্রি আর অনলাইন খুচরো বিপণিতে নতুন কোনও ফোন উদ্বোধনের লিমিটেড টাইম ডিলের গর্জনে ক্রমশ আড়ালে চলে যাচ্ছে স্বপ্নদীপের মৃত্যু। কবীরের সুমনের গানে ছিল, 'শ্লোগান পাল্টে হয়ে যায় ফিসফাস'। এমন শিরোনামও ক্রমশ পর্যবসিত হবে টুকরো খবরে। তারপরে, আমাদের মন থেকে স্রেফ মুছে যাবে এই অকালপ্রয়াণ। পুজো এগিয়ে আসছে ক্রমশ। আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উৎসবে নিজেদের গায়ে জরির ঝালর পরব সবাই। আজকে যে খবরে মন উথালপাথাল, তা জাঙ্ক হতে দেরি নেই আর। ... ...
বাড়ি ফিরে আরেক প্রস্থ ঝামেলা। ফ্ল্যাটবাড়ির দরজায়ই বিজনবাবু। সব্য তখনও গাড়ি থেকে নামেনি, ভালো করে নাকি পার্ক করছে। সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে শমিতা, তখনই বিজনবাবু। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। বয়স্ক মানুষ, ওদিকের ফ্ল্যাটে থাকেন। খুব যে দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়, তা নয়। কিন্তু আজ শমিতাকে দেখে কীরকম আশ্বস্ত হন মনে হয়। - আপনি বাড়ি ছিলেননা না? শমিতা বলে, না, এই তো ফিরছি। - ও। আসলে আমি একটু গিয়েছিলাম। - কোথায়? - আপনাদের ফ্ল্যাটে। আপনারা কেউই ছিলেননা না? শমিতা একটু অবাক হয়ে বলে, এই সময় তো কোনোদিনই আমরা থাকিনা। - সে তো জানি। বিজনবাবু চিন্তিত গলায় বলেন। - আসলে ওদিকে একটা আওয়াজ পেলাম। ভাবলাম চোর-ডাকাত নাকি। একবার নক করে দেখি। যা দিনকাল। ... ...
- আপনারা তো প্লাস্টিক সার্জারি করেন। - করি। আপনার না অন্য কারো? - আমার। - নাক সোজা করতে গেলে ২৫ লাখ। গাল তোবড়াতে গেলে ৩০। অবিকল পড়া মুখস্থের মতো বলে মেয়েটা, মেয়ে না কলের পুতুল কে জানে। - ঠোঁটও ঠিক করি। কিন্তু মেলদের ওটা লাগেনা। - আপনার বাজেট কত? মনির গলা কেঁপে যায়। - মানে, মুখে না, একটু নিচে। - ঘাড়, গলা, এগুলোয় হবেনা। ওগুলো ভগবান দিয়েছেন। যা দিয়েছেন তাই নিয়েই খুশি থাকুন। ওখানে আমরা হাত দিইনা। বুকে ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করি। সেটাও আপনার লাগবেনা। ভুঁড়ির ফ্যাট বার করে দেওয়া যায়। রেট কত চেক করে বলতে হবে। তবে সিক্স প্যাক হবেনা। ওটা আপনাকে নিজেকেই বানাতে হবে। - মানে, ভুঁড়িও না। তলপেটের সাইডটা। - বুঝিয়ে বলুন। চোখ-কান বুজে মনি বলে ফেলে - ওই জেনিটালস সাইডটা। আঃ। বলে ফেলে কী আরাম। ... ...
“যেদিন আমার শ্বশুড় বাড়িতে আগুন দিল, তখন চারদিকে কানাকানি, গুনগুন হচ্ছে। তখন আমি বুঝতে পারছি, কী একটি ঘটনা ঘটছে কিন্তু আমাকে কেউ আর প্রকাশ করে না। তখন আমি খুব অস্থির হয়ে গেছি জানার জন্য- ‘তোমরা বলো না কেন? কী হয়েছে?’ কেউ বলতে চায় না। আমি মামার বাড়ির দালানে ছিলাম। কাউকে না বলে লুকিয়ে আমি ছাদের উপর গিয়েছি। যেয়ে দেখি ছাদ থেকে—নৌকা দিয়ে মিলিটারিরা আমার বিছানা, আমার বালিশ, আমার তোষক, আমার কোল বালিশ, আমার বেড কাভার— আমি এগুলো দেখে চিনে ফেলেছি। ওরা নৌকায় আরাম করে শুয়ে। আমি তখন চিৎকার করছি। আমার বান্ধবীরা— খালাতো, মামাতো বোনরা ছিল। ওরা দৌড়ে গিয়েছে আমাকে থামানোর জন্য। তখন তো জেনেই ফেলেছি যে আমার শ্বশুড় বাড়িতে আগুন দিয়েছে।...” ... ...
যাদবপুর, যাদবপুর, যাদবপুর….কান ঝালাপালা করছে… যেন পৃথিবীর আর কোথাও আমরা হেনস্তা করি না…. যেন আমাদের হাতে রক্ত লেগে নেই! আমার ছাদে গিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে….না-আ-আ-আ। এই হেনস্তা প্রতিনিয়ত, প্রতি মূহূর্তে হয়ে চলেছে। বিভিন্ন ফর্মে। আর তার ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কত কত জীবন। স্বপ্নদীপ মরে গেছে। সবাই মরে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু বিশাল না শুকোনো ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ৱ্যাগিং আসলে ক্ষমতার ভাষা, জোর ফলানোর ভাষা। সে ভাষা কোথায় নেই? আমরা “অপর”কে সম্মান দিতে জানি? জানলে আভিজাত্যের প্রতিমূর্তি জয়া বচ্চন ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে ঋতুপর্ণর হাতে বটুয়া ধরাতেন না। জানলে শিক্ষক থেকে অফিসের বস অব্দি আমরা সবাই আমাদের অধস্তনদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাষা ব্যবহার করতাম না। আমাদের স্কুলে-কলেজে শারীরিক শাস্তি বন্ধ করার জন্য আইন আনতে হত না। ... ...
এক ছিল হনুমান। সে ছিল খুব রামভক্ত। মানে, প্রথম থেকে কি আর ছিল? এক সময় অবধি হনুমান দিব্যি জঙ্গুলে জীবন কাটাতো, হনুমতীদের সঙ্গে খুব ফস্টিনস্টি করতো, হনুমানোচিত নানারকম কাজ এমন দক্ষতার সঙ্গে করতো, যে গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল হনুর কীর্তিকলাপের। বাপ পবনদেবের অর্থ আর প্রতিপত্তির সাহায্য নিয়ে অনেক গ্যাঁড়াকল থেকে বেঁচেও ছিল অবশ্য ছোকরা। প্রতিপত্তি না থাকলে কি আর সূর্য নিজে প্রাইভেট ট্যুশন পড়ায় কাউকে? বেয়াদপ হনু সেখানে আপেল-ফাপেল নিয়ে কী একটা কেত্তন করেছিল, পবনদেব নিজের উদ্যোগে সে খবর ধামাচাপা দেন। ... ...
শুন সবে ভক্তগণ, শুন দিয়া মন, দুঃখের কাহিনী এক করিব কথন-- অগ্রে দিব পরিচয় শুনে রাখো নাম, অতীব দুঃখী আমি বাঙালির রাম। ... ...
আমাদের মানুষদের নীচের চোয়ালের হাড়টিকে বলা হয় ‘হনু’। যদি বুদ্ধি থাকলে কেউ আমাদের বুদ্ধিমান বলেন, কেউ ভেসে থাকলে যদি তাকে ভাসমান বলেন, তাহলে ব্যাকরণের সেই যুক্তিতে আমরা সবাই ‘হনুমান’ হবো না কেন? ‘চিকেন টপ’ টিভি চ্যানেলের স্টুডিও। শুরু হবে প্রাইম টাইম অনুষ্ঠান। অতিথি শ্রী ঘনশ্যাম কর্কট মহাশয়। আর রয়েছেন অ্যাঙ্কার, ক্যামেরাম্যান এবং অন্যান্য crew। অ্যাঙ্কার - চিকেন টপ টিভি চ্যানেলের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠানে আপনাদের সকলকে স্বাগত। শুরু হচ্ছে আজকের অনুষ্ঠান “ইতিহাসে পাতিহাঁস”। অতিথি হিসেবে আমরা আজকে পেয়েছি “ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টিরিয়া রিসার্চ” এর একজন স্বনাম ধন্য বাঙালি ইতিহাসবিদ শ্রীমান ঘনশ্যাম কর্কট মহাশয়কে... [ঘনশ্যাম কর্কট হাত তুলে নমস্কার করলেন] ঘনশ্যামবাবু আমাদের অনুষ্ঠানে আসবার জন্য ধন্যবাদ... ঘনশ্যাম – [হেসে] জয় বজ্রং বলি... জয় হনুমান। আর ওটা হিস্টিরিয়া নয়, হিসটরিকাল। ... ...
ওপরের গল্পটা বাংলার বা ভারতের বা পৃথিবীর হাজার হাজার ছেলের গল্প। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কখনো এর চেয়েও অনেক হাজারগুণ বেশি bullying আর সিস্টেম্যাটিক হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়। তাদের মধ্যে কিছু স্বপ্নদীপ থাকে, যাদের উপর অত্যাচার এমনভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় যে বেচারাদের আর লড়াই করার ইচ্ছেটুকুও আর বেঁচে থাকে না। উপরের গল্পের ছেলেটা লড়াইটা লড়তে পেরেছিল। যুদ্ধটা ওর জন্য অতটাও কঠিন ছিল না। একটা একটা করে স্বপ্নদীপ নিভে যায়। আমাদের অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে। জনমানসে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে। বাজারি আনন্দের পাতায় ঝলসে ওঠে সাংবাদিক/সাহিত্যিক/সম্পাদকের কলম। প্রাক্তন হেনস্থাকারী রাস্তায় নামে কালো পতাকা নিয়ে। টিভির পর্দায় মুচমুচে গসিপ। বাইট দিয়ে চলে যায় কলেজ পড়ুয়া, পথচারী, চেনা জানা মুখ। পণ্ডিত লোকজন সিপিএম তৃণমূলের কাজিয়ায় মন দেন। শ্রেণী সংগ্রামের যোদ্ধারা শহর-মফস্বলের দ্বান্দ্বিকতার গভীর বিশ্লেষণ করেন। ... ...
‘দ্য ম্যান উইথ নো নেমে’র মাথায় উঠল ছেঁড়াফাটা বাদামি টুপি, গায়ে কোঁচকানো কাপড়চোপড়, হাতে রইল পুরনো ০.৪৫ রিভলভার। এমনই এক চরিত্র যে নিজের আর্থিক মুনাফা ছাড়া অন্য কোন বিষয়েই আগ্রহ দেখায় না বিশেষ। এবং যার নৈতিকতা পেন্ডুলামের মত সতত দোদুল্যমান। তাকে একবার মনে হয় ন্যায়পরায়ণ, আবার পরমুহূর্তেই মনে হয় দুর্নীতিগ্রস্ত। ছবির সর্বত্র ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’কে ভাল এবং খারাপের মধ্যে যে কোন একটা দিককে বেছে নিতে হয়। দর্শক হিসেবে আমরাও ধন্দে থাকি, কোনও এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী হবে তার প্রতিক্রিয়া? দর্শকের পক্ষে গল্পের ভবিষ্যদ্বাণী খাড়া করাটাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। আর এটাই হল ছবিতে তৈরি হওয়া বেশ কিছু শক্তিশালী মুহূর্তের জ্বালানী। এই নামহীন মানুষটি আগ বাড়িয়ে অন্যদের রক্ষা-টক্ষা করে না, অন্যায়-টন্যায় সংঘটিত হচ্ছে দেখলেও থাকে নিরুত্তাপ উদাসীন, এবং ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের উপকার করে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে নিশ্চিত হচ্ছেন এই উপকারের বিনিময়ে সেও উপকৃত হবে। ... ...
লিলিয়ানার মুখে জার্মানে ‘আমি চঞ্চল হে’ শুনে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। একটি ইয়ুগোস্লাভিয়ান মেয়ে তার আপন ভাষায় ‘আমি চঞ্চল হে’ পড়ে সেটি সে এক বাঙালিকে শোনালো জার্মান তর্জমায়! দেশ ছাড়ার আগেই শুনে এসেছি - পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে ‘আওয়ারা’ ছবির কল্যাণে রাজ কাপুর একটি সুপরিচিত নাম। পারিবারিক সূত্রেও তার সত্যতা উপলদ্ধি করেছি – শুধু রাশিয়া, ইউক্রেনে নয় - রোমানিয়াতেও রাজ কাপুরের নাম কিছু লোক এখনও মনে রেখেছেন। কিন্তু লিলিয়ানার ভারত রাজ কাপুরের নয়, রবীন্দ্রনাথের। বলকানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়লে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির আরও সন্ধান পেয়েছি – এমনকি ভয়ভোদিনার (সার্বিয়া) রাজধানী নোভি সাদ শহরে দেখেছি জাতীয় থিয়েটারের সামনের ফুটপাথে (হলিউডের স্টার ওয়াকের মতন) মার্বেলে খোদিত আছে ‘১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ সেখানে পদার্পণ করেছিলেন’। ... ...