এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সেই যুগান্তকারী  আবিষ্কার, সেই অবিস্মরণীয় প্রাণদায়ী মুহূর্ত 

    ANIRBAN MITRA লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ নভেম্বর ২০২১ | ১৮১০ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)
  • ''ভেবে দেখ, ওই লেভেলের একজন মহাপুরুষের কি দুর্ভাগ্য (এবং তার সঙ্গে আমাদেরও) যে অকাল মৃত্যু ওঁকে বিংশ শতাব্দীর top  জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলি দেখার সুযোগ দেয়নি। মাত্র ৩৯ বছরে চলে গেছেন;  এমন মানুষটা বঙ্গভঙ্গ পর্যন্ত দেখতে পাননি  !! ''
     
    আমাদের  বন্ধু সৌম্য ঐতিহাসিক। বিংশ শতাব্দীর বাংলা নিয়ে বেশ কিছু তথ্যসমৃদ্ধ বই'র লেখক। তাই, তার  objective আফসোস করার কারণ যথেষ্ঠ। সত্যি তো এত কম বয়েসে দেহত্যাগ না করলে, চোখের সামনে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিকশিত হতে দেখলে স্বামী বিবেকানন্দ'র জীবনধারা কোন দিকে যেত কে জানে ? তাঁর শ্রেষ্ঠ শিষ্য নিবেদিতা ও মানসপুত্র সুভাষ চন্দ্রের মত  তিনিও কি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে যোগ দিতেন? এর উত্তর কোন দিন জানা যাবে না।  
     
    তবে, শারীরবিদ্যা'র ছাত্র বলে  আমার কাছে  এই tragedyর  একটা অন্য আঙ্গিকও আছে - স্বামীজীর মৃত্যুর মূল মেডিকেল কারণ।  ডায়াবেটিস মেলিটাস। মধুমেহ। এমন এক কালান্তক অসুখ যা সিমলে পাড়ার নরেন দত্ত'র মত বাঘা লোককে নকআউট করে দিয়েছিল। কারণ ? সেভাবে কোন চিকিৎসাই তো হয়নি (শঙ্করের লেখা পড়ে দেখবেন - আজব  - অথবা বলতে পারেন ভয়ানক - কিছু চিকিৎসা চালানো হয়েছিল ওঁর ওপর এবং  স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলি কাজ করেনি)।  কারণ ১৯০১-০২য়ে ডায়াবেটিস'র ব্রহ্মাস্ত্র' ইন্সুলিন'র আবিষ্কার তখনও কুড়ি বছর দূরে।  অতিরঞ্জিত না করে  বলছি, স্বামীজীর লেখা পড়তে পড়তে চমৎকৃত হয়ে একাধিকবার ভেবেছি  'হায় হায়! আর মাত্র কুড়ি বছর পরে হলে হয়ত ইন্সুলিন পেয়ে যেতেন'।  ..... .....
    ---- ----
    ১৯০২'র বেলুড় মঠ থেকে Fast forward করে চলে আসি ১৯২১'র ক্যানাডায়।  টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে জেমস ম্যাকলয়েড'র  গবেষণাগারে রিসার্চ করছেন ৩০ বছর বয়সী ফ্রেডরিক ব্যান্টিং। নিজে তিনি পাস-করা ডাক্তার এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের শুশ্রষা করে 'মিলিটারি ক্রস' সম্মান ও পেয়েছেন। যুদ্ধের পরে ক্যানাডায় ফিরে অবশ্য পসার খুব একটা জমাতে পারেননি, আর তাছাড়া ব্যান্টিং'র বেশ কিছুটা উৎসাহ হচ্ছে গবেষণা।  ডায়াবেটিস কেন হয় এবং কি করে এই মৃত্যুদূতকে জয় করা যায় এই তাঁর  গবেষণার বিষয়। তাই, গত ৫০-৬০ বছরে এ বিষয়ে যা গবেষণা হয়েছে সব কিছু জার্নালের পাতা থেকে পড়ে ফেলেছেন  ব্যান্টিং। এখন তার কাজ এই গবেষণা আরো এগিয়ে নিয়ে চলা।  
     
    ছবি ১ : গবেষণাগারে ফ্রেডরিক ব্যান্টিং। ১৯২০-২২ (https://www.nobelprize.org/prizes/medicine/1923/banting/photo-gallery/)
     
    মনে রাখা আবশ্যক যে ১৯২১ কিন্তু ডায়াবেটিস মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। প্রাচীন কাল থেকে জানা এই অসুখের তখনো কোন ওষুধ নেই।  শিশু, কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক যার হবে তার রক্তে ও মূত্রে glucose বাড়বে, আস্তে আস্তে আরো নানা উপসর্গ জীবন দূর্বিষহ করে তুলবে এবং কয়েক বছরের মধ্যে কোমা ও  মৃত্যু অনিবার্য। অকালে যে কোন মৃত্যুই বেশি কষ্টের, কিন্তু সবচেয়ে বেশি দুঃখ দেয় ডায়াবেটিসে পঙ্গু ও অসাড় হয়ে পরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, যাদের অনেককেই ব্যান্টিং দেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে'র collaborator টরন্টো জেনেরাল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ওয়ার্ডে। 
     
    এটাও অবশ্য ঠিক যে ১৮৬০'র দশক থেকে ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণা বেশ কিছুটা এগিয়েছে। ডায়াবেটিস শরীরে কি পরিবর্তন হয় এবং pancreasর (বা অগ্ন্যাশয়) সঙ্গে তার কি সম্পর্ক সে সম্পর্ক অন্তত কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় কথা জানা গেছে যে অগ্নাশয়ে দু'ধরণের কোষ কলা দিয়ে গঠিত - ১) pancreatic acini, যার থেকে নিঃসৃত রস (pancreatic juice) খাবার হজম করতে অপরিহার্য এবং ২) islets of Langerhans. Islet মানে ছোট ছোট দ্বীপ , আর Langerhans হলেন জার্মান প্যাথলজিস্ট পল ল্যাঙ্গেরহান্স।  মাইক্রোস্কোপে'র কোষকলা পর্যবেক্ষণ করায় দক্ষ ল্যাঙ্গেরহান্স ১৮৬৯ সালে লক্ষ্য করেন যে অগ্ন্যাশয়ের মূল tissue হল পূর্বপরিচিত pancreatic acini. কিন্তু, acini 'সমুদ্র' র মাঝেমাঝে রয়েছে ছোট ছোট কিছু স্বাতন্ত্র্য কোষসমষ্টি - যেন সমুদ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একাধিক দ্বীপ।  সেই থেকে নামকরণ islets of Langerhans, যা আজও স্কুল পাঠ্য থেকে anatomyর বই সর্বত্র রয়ে গেছে. ল্যাঙ্গেরহান্স ঠিকই চিনেছিলেন -  Islet কোষগুলি  acini কোষকলা'র থেকে বেশ আলাদা, এবং তাদের ঘিরে রয়েছে অনেক বেশি রক্তজালিকা (capillaries).  কিন্তু এরা করে কি ? নাঃ , সে রহস্য সমাধান হয়নি। 

    ছবি ২ : মানবদেহে যকৃৎ, পিত্ত থলি, ক্ষুদ্রান্ত এবং অগ্ন্যাশয়। 
     

    ছবি ৩ : আধুনিক মাইক্রোস্কোপে islets of Langerhans . আজ আমরা জানি মাঝের সবুজ কোষগুলি থেকে নিঃসৃত হয় ইন্সুলিন এবং ধারের লাল কোষগুলি থেকে তৈরী হয় glucagon. (https://blogs.bcm.edu/2019/10/01/from-the-labs-image-of-the-month-islet-of-langerhans/)
     
     অবশ্য  অসুস্থ বা ক্ষতিগ্রস্ত অগ্ন্যাশয়'র সঙ্গে যে ডায়াবেটিস 'র একটা স্পষ্ট যোগ আছে সেটা ভালোই বোঝা গেছে। কুকুরদের ওপর   অপারেশন করে পরিষ্কার দেখা গেছে যে গোটা অগ্ন্যাশয় বাদ দিলে ওদের ডায়াবেটিস হবেই, রক্তে ও মূত্রে  glucose  এবং ketone bodies (একধরণের জৈব অনু) বাড়বেই। আরো আন্দাজ পাওয়া গেছে যে এই ব্যাপারটার সঙ্গে pancreatic acini জড়িত নয়, নাটের গুরু হল ল্যাঙ্গেরহান্স আবিষ্কৃত কোষ-দ্বীপপুঞ্জ। অর্থাৎ, islet থেকে নিঃসৃত হয় কোন এক (বা একাধিক?) জৈবঅনু এবং সেইই রক্তে শর্করা'র  মাত্রা কন্ট্রোল করে।  
     
    মুশকিল হল এত অবধি এসে একটা ট্রাফিক জ্যামে পড়ে গেছেন সব বিজ্ঞানীরা। I অজানা জৈব অণুটিকে  চিহ্নিত এবং  পরিশোধন করা কিছুতেই সম্ভব হয়নি।  এবং এখানেই শুরু ব্যান্টিং'র আসল কেরামতি। একটু ভেঙে বলি -  ব্যান্টিং'র  গবেষণা'র সুবিদার্থে ম্যাকলয়েড নিযুক্ত করেছিলেন তাঁরই প্রাত্তন ছাত্র চার্লস বেস্টকে। আর দিয়েছিলেন কয়েকটি কুকুর, যাদের 'গিনি পিগ' বানানো যাবে। ব্যান্টিং আর বেস্ট যে পন্থা নিলেন সেটা হল অগ্ন্যাশয়ের যে নালী (pancreatic duct ) দিয়ে acini থেকে নিঃসৃত রস ক্ষুদ্রান্তে পৌঁছয় সেটা ভাল করে স্টিচ করার সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া। বিজ্ঞান'র পরিভাষায় একে বলে 'duct ligation'. এটা অন্য বিজ্ঞানীরাও আগে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ঠিকঠাক সাফল্য আসেনি। ব্যান্টিং আর বেস্টকেও প্রচুর খাটতে হল এবং কয়েকটি কুকুর বাঁচল না। তবে শেষ পর্যন্ত একটি  কুকুরের pancreatic duct ঠিকঠাক ভাবে সুতো দিয়ে বেঁধে দেবার ফলে দেখা গেল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার অগ্ন্যাশয়ের acini কোষকলাগুলি মারা গেল। তাহলে তার অগ্ন্যাশয়ে বাকি রইল কি? উত্তর -  Islets of  Langerhans . অর্থাৎ, এবার ওই অগ্ন্যাশয় থেকে যা কিছু নিঃসৃত হচ্ছে সেটা আসছে একমাত্র islet থেকেই। আর আগের গবেষণা তো দেখিয়েইছে যে ওখান থেকেই শর্করা- নিয়ন্ত্রণকারী এখনো-অজানা জৈবঅনু বেরোয়। আগেই বলেছি, গোটা অগ্ন্যাশয় সার্জারি করে বাদ দিলে ডায়াবেটিস হয় (সেরকম বেশ কিছু কুকুর বেস্ট এবং ব্যান্টিং'র গবেষণাগারেই রয়েছে). কিন্তু, এই duct ligated কুকুর'টির islets অক্ষত আছে এখনো আর ওর ডায়াবেটিস হয়নি; ওর রক্তে glucose এবং ketone bodies লেভেল একদম healthy. 

    ছবি ৪ : টরন্টো উনিভার্সিটির ছাদে 'গিনি পিগ' কুকুর নিয়ে বেস্ট এবং ব্যান্টিং। ১৯২১-২২. (https://www.nobelprize.org/prizes/medicine/1923/banting/photo-gallery/)
     
    স্যালাইনের  মাধ্যমে এই islet-নিঃসৃত রস বেস্ট এবং ব্যান্টিং ঢুকিয়ে দিলেন অগ্ন্যাশয়-বাদ-তাই-ডায়াবেটিস-আক্রান্ত কুকুরদের মধ্যে। ফল দেখে সবাই চমৎকৃত - ধাঁই করে ব্লাড সুগার কমে গেল।  আবার রস দেওয়া বন্ধ করলে কয়েকদিন পরে glucose লেভেল বেড়ে যায়।  অর্থাৎ, যা হচ্ছে ওই islet-নিঃসৃত রস'র জন্যেই - ওতেই আছে 'ডায়াবেটিস'র ওষুধ'. 
     
    আশাব্যঞ্জক ফল এলেও তিনজনেই বুঝলেন যে পরিশোধন আরো ভাল করে করা উচিত, এবং এর জন্যে প্রয়োজন একজন রাসায়নিক। তাই ম্যাকলয়েড দলে আনলেন জেমস কলিপ-কে।  কয়েকদিন কাজ করেই কলিপ বুঝলেন কুকুরদের অগ্ন্যাশয় থেকে বেশি পরিমানে islet-নিঃসৃত রস কখনোই পাওয়া যাবে না।  এভাবে কটা কুকুরই বা মারবেন ওঁরা? এবার তো রাস্তার কুকুর ধরে ধরে আনতে হবে, এবং তাতেও কাজ হবে কি না কে জানে? সমাধান করলেন ব্যান্টিং।  টরোন্টোর কসাইখানা থেকে নিয়ে এলেন গরু বাছুর'র pancreas . সাইজে বড় বলে 'রসে ভরপুর'. কলিপ  লেগে পড়লেন এবং কয়েক সপ্তাহ পরেই বাকি সব আবর্জনা সরিয়ে ৯০% আলকোহলে ভাল মাত্রায় পরিশোধিত anti-diabetic জৈবঅনু পাওয়া গেল।  

    ছবি ৫: ছাত্রাবস্থায় জেমস কলিপ। পরে প্যারাথাইরোয়েড গ্রন্থি থেকে আরেকটি হরমোন আবিষ্কার করবেন। (https://www.sciencehistory.org/historical-profile/frederick-banting-charles-best-james-collip-and-john-macleod)
     
    জন্তু-জানোয়ারে তো ভালোই ফল পাওয়া যাচ্ছে। ১৯২১'র ডিসেম্বরে তাই ম্যাকলয়েড নির্দেশ দিলেন এবার কোন ডায়াবেটিক রুগী'র ওপরে পরীক্ষা করে দেখা যাক, সেই জন্যেই তো এত সবকিছু করা।  সুযোগ ও এসে গেল দ্রুত। ১৯২২'র ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হল ১৪ বছর বয়সী কিশোর লিওনার্ড থমসন। দুবছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছে সে, অতি কষ্টে ডায়েট কন্ট্রোল করে সে বেঁচে আছে, কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ছেলেকে বাঁচাতে ব্যান্টিং'র 'খড়কুটো' প্রস্তাবেও রাজি হলেন লিওনার্ডের মা-বাবা। তার শরীরে গরু বাছুরের islet-পরিশোধিত রস ইনজেক্ট করলেন ব্যান্টিং এবং বেস্ট (উল্লেখ্য এর মধ্যে শুরু হয়েছে চার বিজ্ঞানীর মধ্যে বিশাল ego লড়াই। সবারই অভিযোগ - দলে থেকে কাজ করতে পারছি না! একবার তো কলিপ আর ব্যান্টিং'র মধ্যে প্রায় হাতাহাতি  হয়েছে! যাই হোক, নিজেদের স্বার্থেই শেষমেষ চারজনে একসঙ্গে আরো কিছুদিন কাজ করতে রাজি হয়েছেন। ভাগ্যিস হয়েছিলেন!....)
     
    ঝগড়া যাই হোক, ওদের বৈজ্ঞানিক  কর্মপরিকল্পনা সত্যিই ভাল। তাই কয়েকবারের চেষ্টায় পরিষ্কার দেখা গেল লিওনার্ডের রক্তে ও প্রস্রাবে glucose  এবং ketone bodies কমছে। পাঁচ ছয়বার দেবার পরে একদিন সবাই উল্লসিত - আর মূত্রে সুগার নেই।  ডায়াবেটিসের সবচেয়ে পরিচিত উপসর্গ বিদায় নিয়েছে।  (রেগুলার ইন্সুলিন -ভরা রস নিয়ে লিওনার্ড আরো ১৪ বছর বেঁচেছিলেন। ১৯৩৫শে তার মৃত্যুর কারণ ডায়াবেটিস নয়, ইনফ্লুয়েঞ্জা) 
     
    আরো দু একজন রুগীর ওপরে টেস্ট হল।  একবার তো কেলেঙ্কারি। পরিশোধিত রসে কিছু একটা রয়ে গিয়েছিল যার থেকে রুগীর ভয়ঙ্কর এলার্জি হয়ে যায়।  যাই হোক, সেসব ঠিকঠাক করে উচ্চমানের  islet-পরিশোধিত রস যথেষ্ট পরিমানে বানিয়ে ফেললেন চারমূর্তি। এবং তারপর এল চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্য মুহূর্ত। এবং অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে। 
     
    আগেই বলেছি তখনকার দিনে হাসপাতালে আলাদা করে থাকত ডায়াবেটিস ওয়ার্ড; এবং তার মধ্যে চিলড্রেন্স ওয়ার্ড। আর সেখানে এক বুক-ফাটা পরিস্থিতি। সেখানে ডায়াবেটিসের শেষ পর্যায়ে পৌঁছনো শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা কোমায় আচ্ছন্ন, হয়ত এখনই আসবে যমদূত। এভাবেই সারসার বেড আর প্রত্যেক বিছানা ঘিরে শোকে প্রায় বাকরুদ্ধ বাবা-মা ও পরিজনেরা।  এক অসহ্য অসহায় পরিবেশ।
     
     ১৯২২র মাঝামাঝি একদিন টরোন্টো হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে ঢুকলেন ব্যান্টিং এবং বেস্ট। সঙ্গে ট্রে-তে অনেকটা islet-পরিশোধিত রস এবং সিরিঞ্জ। চুপচাপ একের পর এক child-patientকে ইনজেকশন দিতে দিতে এগিয়ে চললেন। কাজে গভীর মনোযোগ, কেউ কোন কথা বলছেন না।  বড় হল ঘরের মোট ওয়ার্ড, পঞ্চাশের ওপর বেড।  স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম রুগী থেকে শেষ rowতে পৌঁছতে মিনিট ১৫-২০ কেটে গেছে। হঠাৎ, দরজার দিকে ওয়ার্ডে'র প্রথম rowতে শোরগোল শুনে ব্যান্টিং এবং বেস্ট চমকে উঠে তাকালেন। আবার কি হল রে বাবা?! আবার এলার্জি!?? 
     
    কিন্তু, নাঃ. এক আশ্চর্য মুহূর্তের রচয়িতা ও সাক্ষী হয়ে রইলেন দুই বিজ্ঞানী। প্রথম rowএ একাধিক বিছানায় কোমা কাটিয়ে উঠে বসেছে একাধিক কিশোর-রুগী। ইনজেকশন দেবার পরে বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেছে, এবং এই সময়ের মধ্যে নতুন-ওষুধ  কাজও  করেছে।  রক্তে glucose মাত্রা কমতে জ্ঞান ফিরছে বাচ্ছাদের। আর তাদের বাবা-মা'রা আনন্দে আত্মহারা হয়ে কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। স্বর্গীয় দৃশ্যও বলতে পারেন, অথবা যেন কল্পবিজ্ঞান। কিন্তু আসলে সত্যি, বিজ্ঞান-ভিত্তিক সাফল্যের বাস্তব।  

    ছবি ৬ : বেস্ট এবং ব্যান্টিং'র সেই কালজয়ী রিসার্চ পেপার। (https://academic.oup.com/nutritionreviews/article-abstract/45/4/55/1917696?redirectedFrom=fulltext)
    -- -- 
    এই ঘটনাটি exactly কি ঘটেছিল সেটা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত আছে।  তখন তো আর স্মার্টফোন নিয়ে লাইভ স্ট্রিমিং হত না, আর চার মূল রূপকারদের মধ্যে এত ঝগড়া যে কে কোনটা একটু  বাড়িয়ে-কমিয়ে বলেছেন কে জানে।  ভেবে দেখুন এই যুগান্তকারী সাফল্য ও ওদের মধ্যে friction কমাতে পারেনি। পরের বছর যখন নোবেল কমিটি ব্যান্টিং আর ম্যাকলয়েড'র নাম ঘোষণা করেন তখন ব্যান্টিং নিজের প্রাইজ'র টাকা ভাগ করে নেন বেস্ট'র সঙ্গে। মানে 'ও আমার দলের লোক' .  ম্যাকলয়েড কেন নিজেকে কম মহানুভব দেখতে যাবেন? তিনিও পাল্টা বলেন - আমি প্রাইজ ভাগ করে নিলাম কলিপ'র সঙ্গে।  
     
    অবাক হচ্ছেন? আরে বাবা! বিজ্ঞানীরাও তো মানুষ। সুখ-দুঃখ-রাগ-অভিমান-লোভ-হিংসে সব নিয়েই তাঁরা ছিলেন, আছেন (সিনেমায় যেসব ভাবেভলা মানবসভ্যতার স্বার্থে নিবেদিত প্রাণ দেখেন ওগুলো mostly সিনেমাটিক ঢপ) . আসল কথা  হল  বৈজ্ঞানিকরা  ব্যক্তিগত জীবনে যেমনই হন  বৈজ্ঞানিক processটা এমনই যে কষ্টিপাথরে  সব ফলাফল ঘষে দেখে  তবেই তাকে স্বীকার করে , স্বীকৃতি দেয়। সেখানে ভুল করার সুযোগ নেই, করলে আজ -না হয়-কাল-না-হয়-পরশু ভুল  ধরা পড়বেই, এবং সেটা শুধরোতে হবে। তুমি না শুধরোও অন্য কেউ করবে আর বিজ্ঞানের জয়রথ এগিয়ে চলবে।  যেমন ব্যান্টিং আর ম্যাকলয়েড, বেস্ট আর কলিপ'র বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি ছিল বিজ্ঞানের হিসেবে খাঁটি। তাই , আজও তাঁরা এত সমাদৃত। তাই আজ ডায়াবেটিস নিয়েও বেঁচে আছেন কোটি কোটি মানুষ, তার মধ্যে সম্ভবত অনেক পাঠক এবং তাঁদের পরিবার পরিজনেরা। 
     
    এটা আজ কেন লিখলাম? কারণ, ১৮৯১'র ১৪ই নভেম্বর ক্যানাডার ওন্টারিও'য় জন্ম গ্রহণ করেন ফ্রেডরিক ব্যান্টিং। তাঁর সন্মার্থে ১৪ই নভেম্বর হল বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। আর ঘটনাটি এমনই , কোথায় যেন শিশু দিবসের সঙ্গেও একটু মিলে গেল তাই না ? নমস্কার 
     
    রেফারেন্স 
     
    ১. https://www.nature.com/articles/d42859-021-00004-3
    ২. https://www.sciencehistory.org/historical-profile/frederick-banting-charles-best-james-collip-and-john-macleod
    ৩. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6205949/
    ৪. http://www.thependseytrust.org/the-discovery-of-insulin/
    ৫. https://www.diabetes.org/blog/history-wonderful-thing-we-call-insulin
    ৬. https://hekint.org/2018/05/15/part-i-the-impact-of-insulin-on-children-with-diabetes-at-toronto-sick-kids-in-the-1920s/
    ৭. https://en.wikipedia.org/wiki/Frederick_Banting
     
     
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ নভেম্বর ২০২১ | ১৮১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ড্.মধুমিতা মুখোপাধ্যায় | 223.191.17.158 | ১৪ নভেম্বর ২০২১ ০৮:১৯501149
  • চমৎকার 
  • Ranjan Roy | ১৭ নভেম্বর ২০২১ ০৬:১৮501261
  • এক্ষুণি পড়লাম।  আমার মত আকাটেরও মূল কথাটা বুঝতে কোন অসুবিধে হয়নি। আরও এমন লেখার অপেক্ষায়।
    নমস্কার!
  • জয় | 92.40.186.156 | ১৭ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৪৭501262
  • চমৎকার লেখা। আরো চাই। সোজা নয় এমন সোজা করে লেখা, অনির্বাণবাবু।
     
    মেডিসিনের সব আবিষ্কারই তাহলে পেনিসিলিন আবিষ্কারের মত সেরেন্ডিপিটাস নয়, কত মেথডিক্যাল-এবং কি আকর্ষণীয়- অবশ্যই লেখার গুনে (কত জীবন বাঁচল/ কত লোকে সুস্থ হল তার হিসেব যদি বাদও দিই)! 
     
    আমি ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ এবং বনফুল হস্টেলে এক অনির্বাণ মিত্র ব'লে এক দাদা কে ইউনিল্যাটেরালি চিনতাম। কোন চান্স।
  • Prabhas Sen | ১৭ নভেম্বর ২০২১ ০৯:০৫501263
  • বিজ্ঞান এর রোমাঞ্চ ও ইতিহাসের রোমাঞ্চ মিলে সুন্দর ও সুখপাঠ্য লেখা। লেখকের কাছে প্রত্যাশা বেড়ে গেল।
  • ANIRBAN MITRA | ১৮ নভেম্বর ২০২১ ১৩:১৬501278
  • পাঠকদের অনেক ধন্যবাদ। সত্যিই ভাবিনি এতজন পড়বেন.  লেখক মাত্রই তো ইচ্ছে থাকে ( আসলে 'লোভ' ) সবাই  পড়বে এবং জানাবে কেমন হল, তাই এটা বেশ একটা feel good অনুভূতি. তবে এটাও ঠিক প্রভাস বাবা ঠিকই বলছেন হইত প্রত্যশা বেড়ে গেল. নিজের কাছে। 
    সবাইকে পার্সোনালি কি করে উত্তর দেব সেটা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে parini. তাই একেবারেই দিই - অমি মেডিকেলে কলেজে বা বোনফুল হোষ্টেলে ছিলাম না . আসলে উচ্চবর্ণ কুলীন কায়স্থদের মধ্যে 'অনির্বাণ মিত্র' এখন মোটামুটি প্রপার নাউন না হয়ে কমন নাউন হয়ে গেছে।...তাই ....laughcheeky
     
    রঞ্জন বাবু  আমি তো আর বিজ্ঞানের জার্নালে লিখছি না (সেখানেও আজকাল অনেক সহজ ভাবে লেখা হয় ) . সাধারণ পাঠক যদি পড়ে উৎসাহী না হন তাহলে তো আমারই ব্যর্থতা হত . তাই না ? 
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন