এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অবশেষে প্রকাশিত হল ইংল্যান্ডের সেই নতুন টাকা। কিন্তু তাতে জগদীশ চন্দ্র বসু'র ছবি আছে কি ? .....  

    ANIRBAN MITRA লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ | ১২৬১ বার পঠিত
  • দু বছরের বেশি ধরে বাঙালি একে অপরকে ফরওয়ার্ড করে আসছে এই পোস্ট। 'গন ভোটে' ইংরেজরা নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের দেশের নতুন ৫০ পাউন্ড নোটে ছবি থাকবে বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু'র। বাঙালি খুব খুশি যে 'এতদিন অবহেলিত' মহান বাঙালি বিজ্ঞানীকে অবশেষে কুর্নিশ জানাবে জগৎ সংসার। তাই এই পোস্ট সবাই ফরওয়ার্ড করে ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ সমাজ-মাধ্যম বিশ্বকে সমৃদ্ধ করুন। জয় হে জয় হে জয় হে জয় জয় জয় জয় হে।
    ছবি ১: সমাজ মাধ্যমে যে পোস্ট ঘুরে বেড়ায়।
     
    অবশেষে সেই দিন এল।  অতিমারীর ডেল্টা ঝাপ্টার দাপটে ইংরেজরা তাদের লকডাউনের মেয়াদ আরো কয়েক সপ্তাহ বাড়িয়ে দিলেও ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড (মানে ওদের দেশের রিসার্ভ ব্যাঙ্কের সমতুল্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক) নতুন ৫০-পাউন্ড'র নোট আনুষ্ঠানিক ভাবে বাজারে আনলেন। সারা পৃথিবীতে খবর ছড়িয়ে পড়ল।  কিন্তু, কি আশ্চর্য! নতুন নোটে জগদীশ চন্দ্র বসু'র ছবি তো নেই ! তাহলে? ছবি আছে আধুনিক কম্পিউটার বিদ্যা'র জনক অ্যালেন টুরিং'র। এবং নতুন নোট রিলিজ হল ২৩শে জুন, অর্থাৎ টুরিং'র ১১০তম জন্মজয়ন্তীতে। এই যে নতুন নোটের ছবি।  
    ছবি ২: অ্যালেন টুরিং'র ছবি দেওয়া  নতুন ব্রিটিশ ৫০-পাউন্ড নোট। https://www.theguardian.com/money/2021/jun/23/new-50-note-alan-turing-uk-security-features)
     
    অসভ্য ! বদমাইশ! দুস্টু লোক! বেহায়া! সাহেবগুলো আবার আমাদের লেঙ্গি মারল??!!! তাও আবার পলাশীর যুদ্ধের দিন ২৩শে জুনেই !!! [ লিখতে লিখতে খেয়াল হল আজ যেমন সারাদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, তেমনি ২৬৪ বছর আগে মুর্শিদাবাদের সেই আমবাগান আর সংলগ্ন মাঠে হেভ্ভি ঝড়বৃষ্টি নেমে 'এডভ্যান্টেজ ক্লাইভ' করে দিয়েছিল। আর তার সঙ্গে তো ছিলই মীরজাফরের 'দলে থেকে মানুষের জন্যে কাজ করতে পারছিলাম না'।]

     তবে এখন যাক সে কথা ! নতুন নোটে বিজ্ঞানীর ছবির কথায় ফেরা যাক। নাঃ! কেউ আচার্য বসুকে জেনেশুনে অপমান করেনি, বাঙালি জাতিকেও লেঙ্গি মারেনি। এই 'পোস্ট পেলেই চোখ-কান বুজে ফরওয়ার্ড করে দিতে হবে' র যুগে আমরাই অতি-উৎসাহী হয়ে মনে রাখিনি যে খবর-টা একবার যাচাই করা উচিত। 

    অথচ মূল খবরে কিন্তু গোড়া থেকেই কোন ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ ছিল না।২০১৮র নভেম্বরে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড ঘোষণা করেন যে বছর দু-তিনের মধ্যে তাঁরা  নতুন ৫০ পাউন্ডের নোট বাজারে ছাড়তে চলেছেন। পুরোনো কাগজের নোট বাতিল করে নতুন নোট হবে বিশেষ পলিমারের, যেমন এখনকার অন্যান্য সব ইংরেজ টাকা। কিন্তু , তার সঙ্গে ব্যাঙ্ক কর্ণধাররা এও জানান যে এই নতুন নোটে এমন এক বিজ্ঞানীর ছবি থাকবে যিনি শুধু বিজ্ঞানের কোন এক ক্ষেত্রে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাই নয়, তাঁর অবদান ব্রিটিশ সমাজকেও না না ভাবে প্রভাবিত করেছে। 

    পঞ্চাশ পাউন্ড নোটে বিজ্ঞানীর ছবি অবশ্য নতুন না।  যেমন ২০১১য় প্রকাশিত নোটে আছেন এমন একজন যাঁর নাম আমাদের স্কুলবইতে থাকত -  স্টিম-ইঞ্জিনের আবিষ্কর্তা জেমস ওয়াট।  সঙ্গে তাঁর সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক ম্যাথিউ বোল্টন। 

    ছবি ৩: ২০১১র ৫০-পাউন্ড নোটে জেমস ওয়াট ও ম্যাথিউ বোল্টন

    তবে এবার উল্লেখযোগ্য ভাবে ব্যাঙ্ক জানায় যে জনসাধারনের মতামতকে তাঁরা গুরুত্ব দেবেন - পছন্দের বিজ্ঞানীর নাম নোমিনেট করার জন্যে ওয়েবসাইট খুলে দেওয়া হয়।  ছয় সপ্তাহের মধ্যে জানাতে হবে, তারপর শর্টলিস্ট করবেন বিশেষজ্ঞ কমিটি। 

    'বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞান নিয়ে হুজুগ'  - অনেকটা গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মত।  এবং তাই ছয় সপ্তাহ পরে  কমিটি দেখেন যে ২১৪০০০র ওপর ব্রিটিশ নাগরিক ৯৮৯ জন বিজ্ঞানীর পক্ষে মতামত দিয়েছেন! 

    অবাক হবার কিছু নেই। নিউটন, ডারউইন , ফ্যারাডে, জেমস ম্যাক্সওয়েল, আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং, রবার্ট বয়েল, জন ডাল্টন, রাদারফোর্ড,  এডমন্ড হ্যালি'র মত যুগান্তকারী বিজ্ঞানীদের যদি 'ওঁরা এসবের উর্ধে' বলে লিস্ট থেকে বাদ দেওয়াও  হয়, ইংল্যান্ডে কি স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর অভাব আছে? আমাদের ওপর দুশো বছর শাসন করেছে বলে আমাদের স্বাভাবিক 'গজগজ খচখচ মানসিকতা' থাকলেও আধুনিক বিজ্ঞানে ও দেশের অবদান তো অনস্বীকার্য। 

    মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আসল ব্যাপার হল এই হাজারের ওপর নোমিনেশনে ছিল জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম। এবং এখন থেকেই আমাদের 'আমরা বাঙালি' মাতামাতির শুরু। 

    ছবি ৪: জনসাধারনের opinion pollএ জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম। (https://www.bankofengland.co.uk/-/media/boe/files/banknotes/50-character-selection-names.pdf?la=en&hash=F0CCA0655EEC2788748D885BE036662B574B615E)

    এই 'খবর' যখন এখানে এসে পৌঁছল এক অদ্ভুতুড়ে হুজুগ শুরু হল।  একাধিক কাগজে প্রকাশিত হল। পোস্ট লেখা ও শেয়ার শুরু হল।  কেউ কেউ সঠিক রিপোর্টিং করলেও বেশ কয়েকজন বাঙালি আবেগে সুড়সুড়ি দিতে গিয়ে (অথবা সাংবাদিক নিজেই সুড়সুড়ি খেয়ে) ভুল রিপোর্ট বা হেডিং লিখে বসলেন।  পশ্চিমবঙ্গ, জাতীয়, বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যমের কেউ না কেউ এই ভুল করেইছেন । একটি সংবাদমাধ্যম তো আবার ফটোশপ করে ব্যঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের আগেই নতুন নোটের ডিজাইন করে ফেলে অধ্যাপক বসুর ছবি বসিয়ে দিল! এটা ঠিক যে বেশ কিছু ওয়েবসাইট পরে সঠিক খবর নিয়ে আসেন। এমনকি 'জগদীশ নোটের' ডিজাইন করা সংবাদমাধ্যম ও জানায় যে 'বসু নন, নতুন নোটে থাকছেন টুরিং' । কিন্তু ততদিনে যা গণ্ডগোল হবার হয়েই গেছে । আর ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপ 'ফালতু' কিছু ঢুকলে সেটা যে ঘুরতেই থাকে সে তো আমরা সবাই জানি ( না হলে আর এই বাজারে ট্রোলদের সংসার চলত কি?)  

    আচার্য বসুর নাম কে বা  কারা দিয়েছিলেন সেটা হয়ত আর জানা যাবে না, তবে সম্ভবত বিলেতে বসবাসকারী কোন বাঙালিই হবেন। তিনি (বা তাঁরা) ভুল কিছু করেননি। গত ১৫০ বছরে জগদীশ চন্দ্র বসুর মত এক্সপেরিমেন্টাল গবেষক কমই এসেছেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের বাজার-দোকান-ম'লে যে নোট ইংরেজ জনসাধারণ ব্যবহার করবেন (যদিও দৈনন্দিন কাজকর্মে ৫০-পাউন্ড খুব বেশি চলে না) সেখানে  গত শতাব্দীর একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী (যিনি জীবনের কয়েক বছর ওদেশে কাটালেও সেখানে থাকাকালীন তেমন কোন বড় গবেষণা করেননি) তাঁর ছবি ওদের দেশে নোটে শোভা পাবে এটা আশা করা একটু বাড়াবাড়ি। কোন সামাজিক-গণ মানসিকতা থেকে এমন 'আশা' উঠে আসতে পারে এবং লক্ষ লক্ষ 'শিক্ষিত' বাঙালির মনে নির্দ্বিধায় প্রতিষ্ঠা পেতে পারে সেটা মনস্তাত্ত্বিকরাই বলতে পারবেন।  তবে 'আমরাই জগতে গ্রেট গ্রেটার গ্রেটেস্ট, কিন্তু আমাদের কেউ পাত্তা দেয়নি ঠকিয়ে নিয়েছে, এইবার পাত্তা দিচ্ছে কারণ আমরাই জগতে গ্রেট গ্রেটার গ্রেটেস্ট... - এই চিন্তা-টা বহু বাঙালির (এবং ভারতীয়দের) মধ্যে মজ্জাগত। আমার মনে হয় এই  'যাক! এতদিনে JC Bose সন্মান পেলেন' গণ-বিশ্বাস এই মনোভাবেরই প্রসূত। 

     

        কবে থেকে এই মানসিকতার শুরু ঠিক জানিনা। সম্ভবত, প্রাক-স্বাধীনতা যুগে ইংরেজ racism যখন সত্যি সত্যিই এ দেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করত তখন সেই হীনবল দাবিয়ে-রাখা জাতিকে উজ্জীবিত করতেই এই সব 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে' 'পাল্টা' স্লোগানের প্রয়োজনীয় উৎপত্তি। তবে আজ স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও এগুলো কথায়-কথায় আঁকড়ে ধরে থাকা খুব একটা কাজের মনে হয় না।  তাও করা হতেই থাকে, কেন কে জানে? হয়ত প্রায় এক শতাব্দী অভ্যাসের ফল, অথবা  যেসব কৃতি বাঙালি নিজেদের কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন এই মাতামাতি করে তাঁদের  reflected glory  নিজের অপরেও একটু টেনে এনে ফেলা যায়। আর তার সঙ্গে যখন যোগ হয় এই ধরণের অতি-সরলীকরণ রিপোর্টিং তখন তো জল আরো ঘোলা হবেই?

        তবে আন্তর্জাতিক জগৎ তো এর ধার ধারে না, এক্ষেত্রেও ধারেও নি।  এবং তাই যে ১২ বিজ্ঞানী শর্টলিস্ট হলেন তাঁতে নাম নেই জগদীশ চন্দ্র'র।  অথচ সেটা কিন্তু কোন মতেই ভারত-বিরোধী মনোভাবের কারণে নয়। কারণ, ফাইনাল লিস্টে জোতিষ্ক'র মত উজ্জ্বল এক অকালপ্রয়াত তামিল তরুণ  - শ্রীনিবাস রামানুজন। '১২ জন ফাইনালিস্টদের' মধ্যে তাঁর স্থান কারণ রামানুজনের মত গণিতজ্ঞ বিংশ শতাব্দীতে হাতেগোনা, এবং তাঁর মৌলিক গবেষণার  প্রায় সবই  তিনি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন করেছিলেন। কি আশ্চর্য - যে নাম নেই তা নিয়ে লাফালাফি , যে ভারতীয় নাম শর্টলিস্ট হয়েছিল তাঁকে নিয়ে কোন কথা নেই? ?  

    ছবি ৬: শর্টলিস্ট হওয়া ১২জন দিকপাল। চোদ্দজন বিজ্ঞানীর ছবি আছে কারণ চার্লস ব্যাবেজ এবং এডা লাভলেস, ও উইলিয়াম ও ক্যারোলিন হার্শেল র ছবি নির্বাচিত হলে একসঙ্গে নোটে শোভা পেত। 

    অবশ্য রামানুজনের ছবি শেষ পর্যন্ত নতুন নোটে স্থান পায়নি। যেমন পাননি আধুনিক জীবন বিজ্ঞানের দুই অসামান্যা  - রোজালিন্ড ফ্র্যাংকলিন আর ডরোথি হজকিন। অথবা দু বারের নোবেল বিজয়ী ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার বা সর্বজনশ্রদ্ধেয় স্টিফেন হকিং। নির্বাচিত হননি পদার্থবিদ্যার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ট জেমস ম্যাক্সওয়েল অথবা পল ডিরাক। একটাই তো নোট - কি আর করা যাবে? তাই , ব্রিটিশ প্রথা ও আইন মেনে নোটের একদিকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবি। অন্যদিকে অ্যালেন টুরিং। আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক, যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্নতা ও আরো কত কিছুর দিশারী - যাঁকে অনেকে আইনস্টাইন, টেসলা, এডিসন বা দা ভিঞ্চির মত প্রতিভাধর মনে করেন - সেই অ্যালেন টুরিং। আর টুরিং তো শুধু বিজ্ঞানতপস্বী নন।  তিনি ব্রিটেনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম বড় নায়ক। যুদ্ধ জয়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। কেন? কারণ, ১৯৪২এ জার্মানির এনিগ্মা কোড break করেছিলেন টুরিং ও তাঁর সহকারী বিজ্ঞানীরা। ফলে, পরের দু বছর জার্মানির যাবতীয় গুপ্ত পরিকল্পনা ও নির্দেশ মিত্রশক্তি'র কাছে আগেই পৌঁছে পাঠোদ্ধার হয়ে যেত। ভবিষ্যতের যন্ত্র, আধুনিক যন্ত্রের artificial intelligence থেকে বাঘ ও  জিরাফদের গায়ে কিভাবে নানা ধরণের ডোরাকাটা দাগ বা ছোপ হয় - সর্বত্র টুরিং'র অবাধ বিচরণ। বিজ্ঞানী তো অনেকেই হন, প্রতি বছর নোবেল ও ৭-৮জন পেয়ে থাকেন, কিন্তু শতাব্দীতে সম্ভবত একজনই টুরিং আসেন। 

     

    অ্যালেন টুরিং নিয়ে লেখার তো শেষ নেই।  আর সত্যি বলতে কি, আমি ওঁর বিষয়ের details  অতটা ঠিক বুঝিনা। তাই বেশি লেখা অনুচিত হবে। তবে, নিচে কয়েকটি তথ্য-সমৃদ্ধ পোস্টের লিংক দিলাম। টুরিং সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্য-পাঠ্য। 

    তবে,  টুরিং'র ছবি যে আজ ব্রিটিশ পাউন্ডে স্থান পেল এটা শুধু আধুনিক সভ্যতার প্রায় সব কিছুতে তাঁর সব যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের জন্যে নয়। টুরিং'র ছবি দিয়ে এক ধরণের প্রায়শ্চিত্ত করল ব্রিটিশ জাতি। অসামান্য মেধাবী টুরিং সমকামী হয়ে জন্মেছিলেন। জীবনের বিভিন্ন সময়ে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা ছিল। কিন্তু, এ জানাজানি হবার পরে আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগের, আজকের-তুলনায় অনেক রক্ষণশীল, ইংরেজ সমাজে তাঁর ঠাঁই হয়নি। বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ে তাঁর অসামান্য অবদান সত্ত্বেও তিনি অপমানিত হন, আইনত অপরাধী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে 'ঠিক করতে হরমোন থেরাপি' দেওয়া হয়।  এই অপমান সহ্য হয়নি। তাই ১৯৫৪'র এক ভোরবেলা সায়ানাইড মেশানো আপেল খেয়ে তাঁর আত্মহত্যা। বয়স মাত্র ৪২! 

        তারপর টেমস দিয়ে কত জল বয়ে গেছে। বিজ্ঞানে প্রায় প্রত্যেক শাখায় টুরিংর আবিষ্কারের প্রভাব বেড়ে চলেছে।  এবং এককালে যা সমাজচ্যুত-করা অপরাধ ছিল তা আজ স্বাভাবিক প্রকৃতি বলে বিজ্ঞান ও সমাজে স্বীকৃত। তাই, টুরিং'র নাম ঘোষণা করার সময়ে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের কর্ণধার জানালেন - বিজ্ঞানের এই যুগে আমরা চাই যেন সবাই উপলব্ধি করেন যে একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তাঁর গুণাবলী।  তিনি কোথা থেকে এসেছেন, কি তাঁর  মাতৃভাষা, তিনি কোন সমাজের মানুষ, কি তাঁর যৌন্যতা বা তাঁর গায়ের রং কেমন এগুলো আর বিচার্য হতে পারে না।  মানব জাতির কল্যানে কি তাঁর অবদান সেটাই প্রধান ও একমাত্র বিচার্য।  গ্যালিলিও'র মত আজ টুরিং ও বিজয়ী।

      

    ছবি ৭: ৫০ পাউন্ডের নতুন নোট।  একদিকে রানী, অন্যদিকে তাঁর কিছু আবিষ্কার ও মৌলিক চিন্তাভাবনা শোঃ অ্যালেন টুরিং

    আর জগদীশ চন্দ্র?  ভারতরত্ন বিজ্ঞানী CNR Rao একবার বলেছিলেন 'জগদীশ চন্দ্র হচ্ছেন ultimate scientist. অন্য বিজ্ঞানীরা যন্ত্রপাতি কেমিক্যাল হাতের কাছে পেলে গবেষণা করতে পারেন।  আর জগদীশ চন্দ্র গবেষণা করতেন নিজের হাতে যন্ত্র বানিয়ে'. তাই জগদীশ চন্দ্র আছেন, থাকবেন। আর গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি বহু বাঙালি এখনো অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বছরের পর বছর ওই 'ইংরেজ টাকায় বাঙালি বিজ্ঞানী' পোস্ট শেয়ার করেই যাবে।ওই যেমন প্রতি বছর ১২ই জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের 'শিকাগো বক্তৃতা' নাম নিয়ে একটা ঢপের রেকর্ডিং  ফরওয়ার্ড হয়ে হয়ে ঘুরে বেড়ায়।স্বামীজীর নাম যা-তা কিছু শেয়ার করলেই যদি দেশপ্রেম ও পুন্য দু পয়েন্ট বাড়ে এই আর কি ! যেমন লোকজন অবলীলায় ভাবতে পারেন যে ভ্যাকসিন নিলে গায়ে চুম্বক হয় এবং দায়িত্ব জ্ঞানহীন হয়ে সেই পোস্ট কিছু সংবাদ মাধ্যম ও সমাজ মাধ্যমে প্রচার ও পেতে থাকে। ....

    আর তাছাড়া, জগদীশ চন্দ্র বসু সম্মন্ধে বিভ্রন্তিকর প্রচার তো নতুন কিছু না। এই যে আমরা সব গর্ব করে বলে  বেড়াই, আমাদের স্কুল বইতেও আছে - জগদীশচন্দ্র প্রমান করেছিলেন গাছের  প্রাণ আছে' সেটা কি ঠিক ? সত্যিই কি তাই প্রমান করেছিলেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা?  .... হা হা ! সে আরেক অতিসরলীকরণ কাহিনী। আরেকদিন হবে। 

     জুন মাসে লেখাটি  প্রথমে আমার ব্লগে প্রকাশিত হয়। তার একদিন পড়ে ফেসবুক গ্রুপ 'ইতিহাস তথ্য ও তর্ক'  গ্রুপে  প্রকাশিত হয়। তাইই ছিল। আমি কিছুটা ভুলেও গিয়েছিলাম,কিন্তু গত ৩০শে নভেম্বর আচার্য বসু'র জন্ম বার্ষিকীতে  ওই  ঢপবাজি- পোস্ট টা ঘুরছে দেখে আরেক রাউন্ত বিরক্তি লাগল। আজকে আবার নজরে এল। আসলে একটা মিথ্যে ছড়িয়ে পরলে সেটা সমাজ থেকে সরানো যে কি মুশকিল। তবে চেষ্টা করাই যায়। গুরুচণ্ডালী  অনেকে পড়েন।তাই এখানে পুনঃ প্রকাশিত করলাম। 

    রেফারেন্স 

    https://www.bbc.com/news/business-57554102

    https://www.theguardian.com/money/2021/jun/23/new-50-note-alan-turing-uk-security-features

    https://www.reuters.com/world/uk/new-british-50-pound-note-with-ww2-codebreaker-turing-enters-circulation-2021-06-22/

    https://www.theguardian.com/business/2018/nov/02/new-plastic-50-note-bank-of-england-asks-public-nominate-scientist-ada-lovelace-stephen-hawking

    https://www.bankofengland.co.uk/banknotes/50-pound-note-nominations

    https://www.bbc.com/news/business-46063097

    https://www.bankofengland.co.uk/-/media/boe/files/banknotes/50-character-selection-names.pdf?la=en&hash=F0CCA0655EEC2788748D885BE036662B574B615E

    https://www.dailymail.co.uk/news/article-6345913/Bank-England-invites-public-nominate-British-figure-appear-high-tech-currency.html

    https://www.independent.co.uk/news/business/news/new-50-note-vote-scientist-stephen-hawking-ada-lovelace-alan-turing-bank-england-a8614026.html

    https://www.indiatimes.com/technology/news/new-uk-50-pound-note-may-feature-india-s-sir-jc-bose-who-did-pioneering-work-for-wi-fi-357535.html

    https://www.kolkata24x7.com/uk-50-pound-note-may-feature-indias-sir-jc-bose/

    https://eisamay.indiatimes.com/nation/jagadish-chandra-bose/articleshow/66818001.cms

     

    https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/271367/%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%B6-%E0%A7%AB%E0%A7%A6-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1-%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96

     

    https://www.bbc.com/news/business-56503741

    https://twitter.com/c0nc0rdance/status/1400798442360872960

    https://www.facebook.com/groups/elebele.org/posts/396716025072451/

    https://www.facebook.com/groups/1803711656387813/posts/4092204797538476/

    https://sciencehistorysocietyanirban.blogspot.com/2021/06/blog-post.html


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ | ১২৬১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    গূঢ়  - Nahid Ul Islam
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন