এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • আমি মোহনবাগানের মেয়ে (পর্ব তিন)

    Sara Man লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০২ আগস্ট ২০২১ | ১৬০৫ বার পঠিত
  • ড. শারদা মন্ডল

    মায়ের কাছে কীর্তি মিত্তিরের বাড়ির গল্প শুনতাম, সেনবাড়ির গল্প শুনতাম। এও শুনেছিলাম বোসেরা, সেনেরা আর মিত্রেরা মিলে মোহনবাগান তৈরি করেছে। মায়েরা ছোটোবেলায় বাগবাজারে থাকত। মামারা সকলে বাগবাজারী শৈলীতে লুচিকে নুচি, লেবুকে নেবু, লুকোতেকে নুকুতে, ঘড়িতে দেড়টাকে ডেড্ডা বলতো। মুষলধারে বৃষ্টিকে উপঝ্ঝান্তে বৃষ্টি বলা হত। জানিনা কী শব্দ থেকে কথাটা এসেছে। আর সেনেদের বাড়ি উচ্চারণে হত স‍্যানেদের বাড়ি। দিনরাত দাঁতি দা, মাল দা, বাচি দা, ভাউ দার গল্প হতো। মা বলতো, জানিস সবাই মোহনবাগানের। আর মায়ের পূর্বপুরুষেরা মানে বোসেরা মোহনবাগানের তৈরির সময়ে মোটা অনুদান দিয়েছিল। শ‍্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় পেরিয়ে, মনীন্দ্র কলেজের লাগোয়া গলি দিয়ে শ‍্যাম পার্কের পাশ দিয়ে, আমি, মা আর বোন ভূপেন বোস এভিনিউ এ পড়তাম। বলরাম মন্দির, বোরোলীন হাউস আর গিরিশ ঘোষের বাড়ির পাশে নিবেদিতা লেন। সেই গলিতে আমাদের ইস্কুল। কিন্তু তখন জানতাম না ভূপেন বোস কে। ফেরার পথে শ‍্যামপার্কের ধারে বাগবাজারের সেনবাড়িতে যেতাম মাঝে মাঝে।পরিণত বয়সে যখন আমার কম্পিউটার হল, অন্তর্জাল সংযোগ হল, আর সবচেয়ে বড় কথা লকডাউনে গৃহবন্দী হলাম, মনপ্রাণ দিয়ে আমার অনুসন্ধান শুরু করলাম। মানে টুকরো স্মৃতি, টুকরো কথা, কিছু পাঠ সূঁচ সুতো দিয়ে জুড়তে শুরু করলাম।

    শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব তাঁর পালক পিতা গোপীমোহন দেবের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ফড়িয়াপুকুরে এক বিরাট বাগান পেয়েছিলেন। সেই বাগানই মোহনবাগান, গোপীমোহনের উত্তরপুরুষের কাছ থেকে যা কিনে নেন প্রখ্যাত পাট ব‍্যবসায়ী কীর্তি মিত্র। তিনি ঐ বাগানে তখনকার ডাকসাইটে স্থপতি নীলমণি মিত্রকে দিয়ে নকশা করিয়ে মোহনবাগান ভিলা নামে শ্বেতপাথরের এক চোখ ধাঁধানো বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন, যদিও বেশিদিন এই প্রাসাদ তিনি ভোগ করতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর মালিক হলেন পুত্র প্রিয়নাথ মিত্র। তিনি ব‍্যরিস্টার হরিদাস বোস, আইনজীবী ভূপেন বোস এবং আরো কয়েকজন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই মোহনবাগান ভিলার লাগোয়া মাঠে খেলা ছেলেদের নিয়ে নতুন দল গঠন করেন। সেই দলই আজকের "এ.টি.কে. মোহনবাগান"। অন্তর্জালে দেখছি হরিদাস বোস পরবর্তীতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সহকারী হয়ে ওঠেন এবং অনুশীলন সমিতির গোপন বিপ্লবী কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

    রাধাকান্ত দেবের তৃতীয়া কন্যার স্বামী মহেশচন্দ্র বোস রাজবাড়িতেই ঘরজামাই হয়ে সংসার পাতেন। মহেশের পুত্র শরৎচন্দ্র বসু ইংরেজদের সঙ্গে বস্ত্র ঊপকরণ রপ্তানি এবং বস্ত্র ও কাগজ আমদানির ব‍্যবসা করতেন। তাঁর স্ত্রী কুমুদিনী বসু লেখিকা, সমাজসেবী, সম্পাদিকা, স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভগিনী নিবেদিতার সহযোগী। শরৎ-কুমুদিনীর কনিষ্ঠ পুত্র আমার মাতামহ। এই দম্পতির পাঁচ পুত্র, তিনকন‍্যা। জ‍্যেষ্ঠা লীলার বিবাহ হয় বাগবাজারের সেন পরিবারের অন‍্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভবনাথ সেনের পুত্র শ্রীশচন্দ্র সেনের সঙ্গে আর কনিষ্ঠা ইন্দিরার বিবাহ হয় প্রখ‍্যাত পাট ব‍্যবসায়ী কীর্তি মিত্রের পৌত্র এবং প্রিয়নাথ মিত্রের পুত্র রবীন মিত্রের সঙ্গে। ভবনাথ সেন ইংরেজদের কাছ থেকে ধাপা লিজ নিয়ে, জঞ্জালের ওপরে ফসল ফলাতে সফল হন। আজ যে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি কলকাতার কিডনি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তার সূত্রপাত ভবনাথ সেনের হাত ধরে। ভবনাথ সেনের দাদা ব্রহ্মনাথ সেন ছিলেন আইনজ্ঞ। তাঁর পুত্র মণিলাল সেনের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল আর এক খ‍্যাতনামা আইনজীবী ভূপেন্দ্রনাথ বসুর কন্যা নীরোদবালার। রামরতন বসু ও দয়াময়ী দেবীর পুত্র ভূপেন্দ্রনাথ পরে আইন সভার সদস্য, জাতীয় কংগ্রেসের নেতা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। আইন ব‍্যবসার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন নিখাদ ক্রীড়াপ্রেমী। মণিলাল সেন মোহনবাগানের ফুটবল এবং ক্রিকেট দুটো দলেরই প্রথম অধিনায়ক। বাংলায় তিনি প্রথম রাউন্ড দ‍্য আর্ম বোলিং শুরু করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি নামকরা অ্যাটর্নি হন। মণিলাল-নীরোদবালার পুত্র দীনবন্ধু সেন বা দাঁতি সেন। মণিলাল সেনের খুড়তুতো ভাই ভবনাথ সেনের এক পুত্র হেমচন্দ্র সেনও মোহনবাগানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। দাঁতি সেন আমার মাতামহের বিবাহের সম্বন্ধ করেন তাঁর শ‍্যালিকার সঙ্গে। দাঁতি সেনের স্ত্রী ফুলরানী সেন (বসু) চিকিৎসক আর জি করের ভাই রাধামাধব করের দৌহিত্রী এবং ফনীন্দ্রনাথ বসুর কন্যা। আর আমার মাতামহী হলেন আর জি করের ছোটো ভাই রাধাকিশোর করের দৌহিত্রী এবং ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষের কন্যা। সেন পরিবার খেলাধূলায় খুবই উৎসাহী ছিল। দাঁতি সেন পরিণত বয়সে খ‍্যাতনামা অ্যাটর্নি হন। কিন্তু প্রথম জীবনে তিনি মোহনবাগানের খেলোয়াড় এবং পরবর্তীতে কর্মকর্তা। স্বাধীনতার পরে বেশ কিছু বছর তিনি মোহনবাগানের সহসভাপতি ছিলেন। এই দলে সেন পরিবারের অবদান শুধু ফুটবলে নয়, ক্রিকেট, হকি এবং টেনিস সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। মণিলালের আর এক পুত্র কানাই সেন ওরফে রবীন্দ্রনাথ সেনও ফুটবল এবং ক্রিকেট দুটি দলেরই অধিনায়ক হয়েছিলেন। এঁদের এক ভাই সত‍্যেন্দ্রনাথ সেন বা মাল সেন মোহনবাগানে টেনিস বিভাগের প্রবর্তন করেন এবং ঐ বিভাগের সচিব ছিলেন। শুনেছি ছায়াছবির প্রয়োজনে উত্তম কুমার তাঁর কাছে টেনিসের কৃৎকৌশল শিখতে এসেছিলেন। উত্তমকুমার আমার কাহিনীতে বারবার ফিরে আসেন। তবে সেটা শরৎ-কুমুদিনীর মেজমেয়ের মানে আমার মেজপিসিদিদার বাড়ির গল্প। এখন তো বড় আর ছোটো পিসিদিদার বাড়ির গল্প বলছি। আসলে আমার পরিবারের ইতিহাস তো আর বাংলার ইতিহাস থেকে আলাদা কিছু নয়। যাক সে কথা। সেনবাড়িতে ফিরে আসি। যাঁদের কথা বললাম, তাঁরা ছাড়াও ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র সেন বা কেষ্ট সেন, খগেন্দ্রনাথ সেন বা মন্টু সেন, মন্টু সেনের দাদা দীপেন সেন। এঁরা প্রত‍্যেকেই খেলোয়াড় এবং সংগঠক হিসেবে মোহনবাগানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর একজনের কথা না বললেই নয়। সম্পর্কে তিনি মায়ের পিস্তুত দাদাদের জেঠতুত দাদা, মায়ের পিসেমশাই শ্রীশচন্দ্রের দাদা প্রিয়নাথ সেনের পুত্র। যৌথ পরিবার তো। দাদাদের তুতো দাদারাও নিজের দাদার মতো। তিনি ভাউ সেন বা জিতেন্দ্রনাথ সেন। ভাউমামাও দীর্ঘদিন মোহনবাগানের সহ সভাপতি ছিলেন। মা ভাউদা বলতে অজ্ঞান ছিল। মা লেখাপড়ায় ভালো, দেখতে সুশ্রী, পুতুল পুতুল। সেনবাড়িতে মায়ের খুবই আদর ছিল। ও বাড়িতে মায়ের স্নেহের নাম ছিল রাজকুমারী। আসল নাম কেউ মনে রাখে নি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০২ আগস্ট ২০২১ | ১৬০৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন