এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হে ধরিত্রী, divided হও, তোমার lap-এ fall করি!

    শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ জুলাই ২০২১ | ৯২৩ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)

  • এটা সে সময়ের কথা, যখন আমি কলেজে পার্ট-টাইমার, আর ছুটির দিনে বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর। প্রাইভেট টিউটর কিসের – না ইংরাজি অনার্সের। অর্থাৎ কিনা, চসারও জানি, চাটনিফিকেশনও জানি। সে এক আশ্চর্য সময়, সে এক দুঃসহ সময়।


    এমনই এক সন্ধেয়, কলেজের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে সবে হাতমুখ ধুয়ে বসেছি, হাল্কা একটা গান চালিয়েছি আপনমনে অ্যারিস্টোক্র্যাটিক ফুর্তি করবো বলে, এমন সময় ফোন।


    -হ্যালো?


    -“Hello, is this Suvankar Sir? Me ………… Banerjee!”, নারীকণ্ঠ।


    -বলছি।


    -You teach in private? 


    এমনিতেই বাঙালী সাহেব-মেমরা ফোন করে ইংরাজি ঝাড়লে প্রচণ্ড মাথা গরম হয়। আমি উল্টে সাধারণ ইংরাজি কথাগুলোকেও বাংলা করে বলতে শুরু করি। বললাম, “হ্যাঁ, আমি বাড়িতে পড়াই।” 


    “আমাকে পড়াবেন please?”, বলেই সে বলল যে সে ইংরাজি পড়ে।


    কিন্তু “ইংরাজি”র পর একটা কি শব্দ বলতে শুরু করলো, আমি হাজার চেষ্টাতেও বুঝলাম না। প্রতিবারই আমি অসহায়-ভাবে কানের ওপর ফোনটাকে মারাত্মক জোরে চেপে ধরতে ধরতে “অ্যাঁ? ... অ্যাঁ?” করে গেলাম। ভাবতে লাগলাম শহরে বুঝি এখন এসব লাল্টুদের জন্য কোনও বিশেষ ইংরাজি কোর্স অফার করা হয় যেটা আমি পড়াই না (যার অস্তিত্ব সম্পর্কেই আমি উদাসীন ছিলাম এতদিন)। সেইটা নিশ্চয়ই সে পড়তে চাইছে।


    তার বোধ হয় সত্যিই খুব দরকার ছিল টিউটরের, তাই সে-ও নিজের বিলিতি রাগ ও বিরক্তি ঠোঁটের পেশীতে লুকিয়ে রেখে একই সুরে বলে যেতে লাগলো যে সে ইংরিজি কি-একটা পড়ে। প্রায় ৬-৭ বার বলার পর খেয়াল করলাম সে বলছে “ স্যর আমি ইংলিশ হন্স্‌ পড়ি।”


    হন্স্‌?? মানে Hons??? মানে অনার্স????


    একটুও বাড়িয়ে বলছি না, এরকম অবাক আমি এর আগে কখনও হইনি। ছোটো থেকে কত আবোল-তাবোল কাজ করে সময় নষ্ট করেছি, কিন্তু কেন যে কখনও “Hons”-টাকে “হন্স্‌” বলে উচ্চারণ করার চেষ্টা করিনি, কে জানে!


    সে যাই হোক, অতবার “অ্যাঁ? ... অ্যাঁ?” করার জন্যই কিনা জানি না, মিস্‌ ব্যানার্জি আর আমার কাছে পড়তে আসেন নি, আমিও কয়েক বছর আয়ুক্ষয় থেকে বেঁচে গে’ছি।


    আমার প্রাইভেট টিউশনের ভাগ্যটা বরাবরই, যাকে বলে, আশিস নেহরার মতো। প্রতিবারই নতুন স্টুডেন্ট নিয়ে বসে ভাবি, এইবার একে একা হাতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াবো, আর ক’দিন পর থেকেই মনে হতে থাকে, ভগবান না করুন, এ যদি ‘Shakespeare’ বানানটা ‘Sex’ দিয়ে শুরু করে, আর ক্লাস টেস্টে যদি ফেল করে যায়! ফেল করে গেলে এর বাবা-মা এসে আমাকে যদি পিটিয়ে যায়!


    এমন সময় আমার ঘর আলো করে আরেক ছাত্র এল। তার আবার ছাতিও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি। অর্থাৎ, “Discuss elaborately” দিলেও সে আধপাতা লেখে, “Short note” দিলেও তাই। প্রথম ক’দিন গেল তাকে এইটা বোঝাতে যে “elaborately”মানে “সবিস্তারে”। বিস্তার বোঝো, বিস্তার? বড় করে লেখা? কয়েক পাতা জুড়ে লেখা? এটা সেইরকম, কেমন? এর একটা শুরু থাকবে, মধ্যিখান থাকবে, কনক্লুশন থাকবে। কেমন?


    উত্তরে সে বললে, “কুঁই।” মানে, বুঝেছি।


    পরীক্ষা এল। আবার ছড়িয়ে কাদা। এবার অন্য সমস্যা। Robert Browning-এর ওপর সে ‘সবিস্তারে’ “short note” লিখে এসেছে। আমি বললাম, এটা তো এত বড় লেখার কোনও দরকারই ছিল না। এতে তো উল্টে নম্বর কমে যাবে। উত্তর এল, “কুঁই।” মানে, জানি।


    এ তো আচ্ছা গেরো! যা খুশি তাই করে আসবে, আর উত্তরে ওই এক মেনি বেড়াল-মার্কা শব্দ। তারপর একদিন যখন ওরকম ম্যাওম্যাও করেই জিজ্ঞেস করলো যে “Science and Literature”-এর ওপর প্রবন্ধ লিখতে দিলে সে ভিডিও গেম নিয়ে লিখবে কিনা, সেদিনই বুঝলাম, আর বেশিদিন একে রাখা যাবে না। তাহলে ব্যাপারটা এবার আদালতে চলে যাবে। সেও বিদায় নিল ক’ দিন পর।


    এর সঙ্গেই একটি মেয়ে পড়তে আসতো, খুব ঠাস-ঠাস করে ইংরিজি বলতো। আর সে এক অদ্ভুত ইংরিজি। মানে বাংলা না ইংরিজি – কোন ভাষার বলাৎকার যে হচ্ছে, বলা মুশকিল। একদিন আমায় ফোন করে বলল, “স্যর অটোটা tZadobpur-এ এসে stop হয়ে গেছে, আমি walk করে আসছি।” প্রথমত, “tZadobpur”! উচ্চারণ করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন কেউ এটা আপনার সামনে বললে কেমন লাগতে পারে। এককালে একটা ইউনিভার্সিটিতে তিন-চার মাসের একটা ছোটো কো-কারিকুলার কোর্স করেছিলাম, তখন দেখেছিলাম, ওখানে অনেকে ‘জ’/‘য’-কে “tZ” উচ্চারণ করে। ধরুন, “জন্তু”। তারা বলবে “tZon-তু”। মানে একেবারে বাঙাল “Zontu” নয় কিন্তু। “tZontu” – ঠিক যেটা শুনে আপনার শিরদাঁড়ার চারদিকটা রি-রি করতে শুরু করবে, তেমনটা। সেখানে কেউ কারুর গায়ে একটু বেশি ঢলে পড়লেই তাকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে আরেকজন বলতো, “এই tZon-তু, tZa তো!” আমার ছাত্রী ঠিক এইভাবে আমার অতিপরিচিত একটা জায়গার নাম বলল। আর তা-ছাড়া “walk করা” তো আছেই -- খুব কঠিন শারীরিক প্রক্রিয়া, বুঝতেই পারলাম। তাই আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু এরকম ভাষা শুনলে আমার যারপরনাই অস্বস্তি হয়। একদিন পড়ার মাঝে তার ফোন বাজল, সে জিজ্ঞেস করলো, “বাড়ি থেকে call করেছে, একটু talk করে নিই?” আমিও ঘাড় নাড়লাম, কিন্তু ক্রমশই নিজের ভেতর কেমন গুটিয়ে গিয়ে মনে মনে বলতে থাকলাম, “হে ধরিত্রী, তুমি divided হও, আমি তোমার lap-এ fall করি!”


    এরকম যুগান্তকারী নিদর্শন আমার হেঁশেলে প্রচুর। এক ছাত্র আসতো, পড়াশুনায় লবডঙ্কা, কিন্তু এমনিতে বেশ বলিয়ে-কইয়ে। প্রথম দিন তাকে বসিয়ে বেশ গুছিয়ে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় ইংরাজি শিক্ষার মানের সাধারণ অবক্ষয় সম্পর্কে কি বেশ বলছি, এমন সময় সে একটা কোনও কথায় সায় দিয়ে, খুবই অনুশোচনার ভঙ্গীতে বলল, “তুত্‌ তুত্‌।” আমি ভাবলাম, বেশি খারাপ কিছু বলে ফেলেছি নাকি, ভয়ে বেচারার কথা আটকে গেছে। কিন্তু দু’ সেকেন্ডের ফারাকে সে আবার করলো, নিজের মনেই, “তুত্‌ তুত্‌।” এমন অভিনব অনুশোচনা-বাক্যে আমি তো একেবারে অভিভূত। আমারই কথা আটকে গেল। পরে, অনেক পরে ভেবে বার করলাম, বাংলায় যেটা আমাদের দুঃখের “চুক-চুক” আওয়াজ, সেটারই ইংরিজি হল “Tut-Tut”। এটাকেই সে একেবারে আক্ষরিক উচ্চারণ করছিল।


    এরকম আরও কত অভিজ্ঞতা আছে। এক ছাত্রীর ধারণাই ছিল, সাহিত্য মানেই প্রেম। উত্তর লেখার সময় কোথাও একটা প্রেম ঢোকাতেই হবে। শেষে অবস্থা এতটাই ক্রিটিকাল হয়েছিল যে “Bravely Fought the Queen”-এর Symbolism-এর উত্তরে সে লিখেছিল ডলি আর অল্কা আসলে ওই বনসাই গাছটাকে ভালোবাসত। অবিশ্যি হাসির কিছুই নেই এতে, কারণ আজকাল তো সেমিনারে সবই খায়। কি সব থিওরি টিওরি হয়েছে, এ দিয়ে নিশ্চয়ই একটা ইকোক্রিটিকাল পেপার দিয়ে দেবে কেউ। আরেক ছাত্রী, সে মাস্টার্সেও আমার কাছে পড়তো, সে একদিন ফুকোকে “ফাউকাউল্ট” বলে আমায় বেজায় চমকেছিল। সে মনে করতো ‘Orientalism’-এ এডওয়ার্ড স্যেদ-এর কো-অথর রামজী লাল, ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সব গল্প আরেকদিন বলা যাবে না হয়।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন