এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • এক পুরোনো পানকৌড়ি

    সুমন মান্না
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৫৮৭ বার পঠিত
  • ভান-ভণিতা

    অনেক দূরের থেকে আসা শব্দ এলো।
    বলা কওয়ার ধার ধারেনি কোনোদিনই।
    তাও সে অবুঝ শব্দগুলো ধুলো পায়েই
    আমার তোমার বসার ঘরে আয়েস করে বসলো যখন,
    সোফার ওপর পা তুলেছে।
    অপ্রস্তুত হলেও তুমি চায়ের জন্য খবর পাঠাও ভিতরঘরে।

    আস্তে আস্তে গল্পগাছা খুলে বসে শব্দগুলো।
    পুঁটলি গুলো ঠিক তখনি ঠাহর করি –
    কোনটায় সে হলদে মুড়ি কুসুম ফুলের বীজ মেশানো,
    কোনটাতে সে নাড়ু মোয়া আচার বিচার সে পর্যন্ত দেখতে দেখতে -
    চা এলে বেশ চমকে উঠি - বেয়াক্কেলে শব্দগুলো
    ধুলোয় আমায় বসিয়ে রেখে ফিরেই গেছে -
    লাস্ট ট্রেন তার ফেল হবে না,
    হলেই বা কি আসবে সে ফের নাড়তে কড়া নিশুত রাতে।
    আসবে সে কি ? আসবে কি সে?

    কোত্থেকে সে এসেছিলো-
    সেই ঠিকানা হয়তো আমার মনেই আছে।
    আমার যেসব আনাচকানাচ ছড়িয়ে রাখা গেরস্থালির
    মধ্যে থেকে বেশ কয়েকটা হলদে রঙের পোস্টকার্ডে তা কয়েকখানা আস্ত আছে।
    এদের মধ্যে বেশ ক'জনার জামাটামা হয়তো আজও
    টানাহ্যঁচড়ায় আসতে পারে আড্ডা দিতে।
    প্রথম প্রথম জড়সড়, তারপরে সে কখন জানি গ্রাস করে নেয় আমায় তোমায়,
    সোফার ওপর পা তুলে বেশ মুড়ি লঙ্কা চিবোই যখন শব্দ করে -
    শব্দগুলো হাসতে থাকে, নাচতে থাকে।
    অনেকদিনের পরে যেন সত্যিকারের বৃষ্টি পড়ে।

    চিঠি যেমন, কিম্বা হয়তো অন্য কিছু, কথার মতো।
    কথাও যারা শব্দ দিয়ে তৈরি নয়তো অন্য কথা।
    যে বেচরা উচ্চারিত হওয়ার আগেই দিশেহারা।
    ভাবছে কখন বলেই বসি সেই কথাটা,
    সেসব আমি শুনেই ফেলি হিড়িক খেয়ে।
    যেমনটা সে আসতে থাকে ঠিক তেমনই পরম্পরায় বলতে থাকি,
    যা বলে সে এমনি করেই আমি তখন অন্য আমির কাছে থেকে

    অন্য হয়ে দেখি আমায় অন্য জামায়।
    ভুলতে থাকা অস্তিত্ব সেই দুরন্ত স্রোতখানি ওর
    ফেরৎ পাঠাই কোনমুখে তার হিসেব না পাই।





    শহরতলির একটু নিচে আরেক শহর,
    এমন গলি খুঁজির মধ্যে -
    কাঁচায় পাকায় গায়ে গায়ে সব এদের বাড়ি, ওদের বাড়ি।
    লোকজনও সব কেমন যেন, গায়ে পড়া তা বলতে পারো একটু বেশি।
    এদের ঘরে ফোড়ন ডালে ওদের ঘরে বাচ্চা কখন হাঁচতে থাকে।
    পাশের বড়ি নতুন বউ সে খায় নি কিছু সারাদুপুর মন খারাপে,
    পল্লবিত সেই বাসি ভাত সারা পাড়ায় তরকারি সব জুটিয়ে নিয়ে ভোজ লাগাবে এমনি ধারা।

    এদিক ওদিক গাছগাছালি অনেক পাবে,
    তাদের আবার মুখ দেখা চাই বলেই বোধ হয় পুকুর অনেক।
    পাড় বরাবর হাঁটবে মানুষ, তাই তো রাস্তা পুকুর পাড়ে-
    ভোটের আগে নিয়ম করে পাথর পড়ে - এক বর্ষা গেলেই আবার
    যে কে সেই রাস্তা দিয়ে পিছলে পড়ে শহর থেকে ঘুরতে আসা কলেজ ছেলে।
    সাইকেলও তার, কিন্তু এরা এই গল্পের মধ্যে থাকে যেমন করে
    তোমায় কিছু বলতে গিয়ে হয় অহেতুক ভাণভণিতা।
    তোমার আমার মধ্যে যেমন হাজার হাজার প্রাণময়তা।
    এদিক ওদিক ছোটে কিছু উটকো মাছি,
    তোমার ঘাড়ের আবডালে সে বসবে খানিক,
    সে অস্বস্তি বাধ্য করে তোমার ঈষৎ নাড়াচাড়ায়।
    তখন সে এক পাখির ঠোঁটে ফেরৎ আসে।
    তারই মধ্যে ঠাহর করলে এই শহরের সীমা ছাড়াও
    পিচঢালা ঐ রাস্তা ধরে, কমতে থাকা দোকান-টোকান বদলে যাবে।

    বাসস্টপে সব দোকান বাড়ি অন্যরকম।
    চুলের কাঁটা গেরস্থলি, দুধ বিস্কুট, খাতা কলম।
    কেউ বা আবার সব্জি রাখে।
    ঝাঁপের থেকে নেমে আসা তারের ঝুড়ির মধ্যে থাকে
    লালচে রঙের হাঁসের ডিমও।
    সন্ধেবেলার লো-ভোল্টেজে তাদের এমন হলদে লাগে।
    বাড়ির বাইরে দাওয়া জুড়ে দোকান সেটা, দাদুর দোকান,

    সেই দাওয়াতেই নাতি নাতনি শিতলপাটির ওপর কেবল ছড়ায় মুড়ি।
    তারপর সেই একটা একটা খুঁটতে থাকা।
    ডুমের আলো চুঁইয়ে সেই অন্ধকার যা সব দেশে সেই একই রকম।
    রাত বিরেতেও হালকা আলো ছেয়ে থাকে বাঁচায় যারা আমায় তোমায় হোঁচোট থেকে
    যতক্ষণ না জোর আলোতে হঠাৎ করে অন্ধ হয়েই ফিরে আসি।

    কলকাতা ক খবর পড়েন।
    ভেতর বড়ি থেকে তখন ধারাবাহিক সুর তুলেছে।
    টিভির গন্ধে দেয় হানা রোজ আশে পাশের বাড়ির আইবুড়ো মেয়ে,
    ক্লাসছুট সব, গান শিখে যায় নিয়ম করে।
    আসন বোনে কুরুশ কাঠি ঠুকুর ঠাকুর সুজনি বোনে।
    নতুন বৌদি হাতখরচায় পাশের পাড়ার হলে নতুন বাংলা বইতে
    ঠিক হানা দেয় খিড়কি পথে।
    যে অন্যথায় বিষজর্জর ছোবল হয়ে
    বিদ্ধ করে সমবয়সী এক হতাশা।
    যেমনটা এক মেঘ এসে যায় হঠাৎ করে
    তোমায় যেন আমার থেকে আড়াল করে,
    মাছের মতো ঠুকরে খেতে থাকে তখন
    প্রাণস্পন্দন যায় ভেসে যায় হাওড় বেয়ে অনেক দূরে।

    অনেক রাতে, বাসিন্দারা যখন সবাই যায় ঘুমিয়ে
    গঞ্জখানি চুপিসারে মিলতে থাকে ক্ষেতের সাথে,
    সীমানা তার খসিয়ে ফেলে।
    দু-একঘর ঝুপড়ি জুড়ে রাতজোনাকি জ্বলতে দেখি।
    মিঠে হাওয়া হাওড় বেয়ে ফিরে এসে স্পিরিট মাখা গন্ধ মেখে
    তড়িৎ খেলে স্নায়ু জুড়ে।
    পা টলমল দেহাত সুরে ভর করে রোজ উঠে দাঁড়ায় সেই লোকটা।
    কানাঘুষোয় শুনবে বুঝি এই লোকটার অনেক কিছু যায় হারিয়ে।
    রাস্তা মানে যা গিলে খায় - বলবেই সে কউকে তেমন একলা পেলে।
    নয়তো ওকে দেখবে তুমি
    দিনের মধ্যে বাসস্টপে নীলচে রঙের চেয়ার টবিল বিছিয়ে দিয়ে -
    ধনলক্ষী, সিকিম ভুটান সব লটারি পইয়ে দিতে।
    ভাগ্য বেচার ব্যবসা বোধ হয় একেই বলে -
    নিজেরটা সব নিলাম করে সেই বেসাতি দৈনন্দিন বেচতে বসা।

    ঘুরে ফিরে রাস্তা ধরে আসছি যখন গঞ্জটিতে,
    ডানদিকে সেই চুপটি করে বড় রাস্তার পোষাক থেকে
    সুতোর মতো ঝুলতে থাকে গলি যেটা,
    মোড়ের মাথায় পুরোনো এক হোমিওপ্যাথি দোকান ঘেঁষে,
    সেখান থেকে হাঁটা পথের খানিক পরেই পাখির বাসা অনেক পাবে।
    ঠোঁটে ঠোঁটে খড়কুটো সব জোগাড় করে রান্নাবাটি মানুষ খেলে।

    চড়ুই শালিক ধনেশ টিয়া হাঁস মুরগি ছানাপোনা শষ্য খুঁটে খুঁটে বেড়ায় সারাজীবন।
    দমকা হাওয়া থেকে থেকে আসতে যেতে খোঁজ নিয়ে যায়।
    এক খোঁড়া কাক রোজই আসে রামের বাড়ির দাওয়ায় যখন রৌদ্র আসে।
    রাম তার আগে যায় বেরিয়ে, বাজার যাওয়ার রাস্তাতে তার মুদির দোকান।
    বছর বছর বিওয়োয় যারা যন্ত্রণারা তাদের মতোই এ বাড়িরই গিন্নি তিনি।
    গেল বছর এই সময়েও সেই খোঁড়া কাক বিদেয় দিতো -
    বউটি তখন একলা হাতে সামাল দিত গেরস্থালি।
    রাম বেরোলেই সেও অমনি এদিক ওদিক বেড়িয়ে যেত
    ছুতোনাতায় গল্প জুড়ে গল্পতে তার টল্প জুড়ে
    নক্সীকাঁথা বিছিয়ে দিত পাড়া জুড়ে।
    বাচ্চা দুটি স্কুলেই তখন - দিনের মধ্যে হঠাৎ করে গান শুনতো,
    কিম্বা হঠাৎ বৃষ্টি এলে পিছল উঠোন পাড়ি দিত টিউকলে জল ভরার ছুতোয়।
    সপসপে গায়ে, ঘরের ভিতর মেঘের খেলা খেলতে দিতো মঝে সাজে।
    খোঁড়া পায়ের কাকের কাছে এই খবরটা কি করে সে পৌছে গেল।
    আজ সেই বউ চিনতে পারে কাকটিকে রোজ দেখতে পেয়ে।
    এখন যদি মেঘ করে সে ভয়েই বুঝি জানলা কপাট বন্ধ করে।
    ভাতের আলু মাখতে বসে ভাগ করে দেয় চারটি ভাগেই আগের মতো -
    তার মেয়েটি বৃষ্টি মাথায় খেলতে গিয়ে আর ফেরেনি, সেইটে বোধ হয় ভুলেই গিয়ে।

    অনেক দূরের গাঁয়ের মানুষ হেঁটেই ফেরে হাটের থেকে।
    টোকা পিঠে দুলতে গিয়ে খালি গায়ে খেটো কাপড়
    উঠে আসে হাঁটু অবধি ধুলো কাদায়।
    হাঁস তাড়িয়ে পুকুর থেকে ফিরতে থাকে ঘরের দিকে গিন্নিবান্নি।
    সময় একটু এদিক ওদিক হলেই যে তার
    তুলসিতলা প্রদীপটুকু দেখতে না পেয়ে চমকে যাবে।
    খানিক পরে স্টেশন পাড়ায় রাস্তা জুড়ে জ্বলবে হ্যাজাক।
    বিক্কিরি সব আনাজপাতি টুকিটাকি হয়তো একটু চড়া দামেই।
    শহর ফেরৎ চাকরিজীবি কিনেই নেবে সময় তো তার অনেক দামী।
    চটকা ভেঙে পাগলটা কি এসব দেখে থমকে গেল?
    খানিক আগে খোসমেজাজে রাংতা মোড়া মুকুট পরা
    সেনাপতি যুদ্ধে ছিল।
    কাল বেচারি এই সময়েই বাঁধা ছিলো চৌধুরিদের দোকানটাতে।
    খিদে হয়তো তার সঙ্গে একলা কিছু সময় কাটায়,
    পাগল হলেও খিদে তাকে থাকবে ছেড়ে কেমন কথা?
    খিদের খিদে রেয়াত করা করা পাগলটা কাল তুলে থাকবে
    টুকরো খাবার চপ ফুলুরির দোকান থেকে।
    বাঁধা থাকবে চৌধুরিদের রোয়াক জুড়ে সারা সন্ধে চাহনিতে রাত্রি এনে।

    কুকুর যেমন একলা ঘোরে,

    এমনিতে সে ল্যাজ নেড়ে খুব আনন্দ দেয়,
    তাও তো খিদে ওৎ পেতেছে শরীর জুড়ে,
    সেই চেতনা জানছে যখন খানিক পরেই মেলা শেষে
    খিদেটুকুই থাকবে পুরো সমগ্রটায়,
    আঁকড়ে ধরে খড়কুটো সে এমনি করে।
    আলো যখন থাকে তখন জমকালো সব নাচোনকোঁদন চাটতে থাকা,
    আলো তখন নিচ্ছে পিছু সকাল সন্ধে ফেউএর মতো।
    লোম ওঠাদের ঝক্কি অনেক জানতে নাকি?
    সময়মতো বকলস যার যায় জুটে সে অমনি নামে সন্ধেফেরৎ অফিসবাবু
    ট্রেন থেকে সব সন্ধেগুলোয়।
    অন্য লোকে খিদে চেপে পাগল নামে খিদে চেপে
    কাঁদতে থাকে সমস্তরাত সমস্তদিন কাঁদতে থাকে,
    কোথাও যেন বৃষ্টি পড়ে তেমন করে।

    অন্য কোথাও কুকুর যেমন দাদুর দোকান-বাড়ি প্রায়ই আসতে থাকে।
    আসতে যেতে দেখবো ওকে বিকেল হলে ঘষটে ঘষটে
    ভাঙা মাজা টেনে বুঝি আসবে বুড়ি,
    চায়ের সঙ্গে যদি একটু জোটে মুড়ি।
    চায়ের কাপে ভিজিয়ে নিয়ে মুখের লালায় নরম করে
    মাড়ি ঘষে গিলতে থাকে মুড়ি যখন।
    তিন চারটে নাতবৌ তার কে যে কেমন বলেই যাবে।
    আজকালকার মেয়ে বৌ সব কেমনধারা ধিঙ্গি মতো,
    সাতকাহনের ঘেউ ঘেউ সব বলতে বুড়ি আসতে থাকে।
    মুড়ির দানা যটা সেই হিসেব করে নিন্দেমন্দ শুনতে হবে।
    দিদিমা আর বাকি বৌরা জানে সবই, আড়াল করে হাসতে থাকে।
    এমনকরে দাদুর দোকান সন্ধে নামে।
    ছোটো ছোটো ডানপিটে সব কুঁচোকাঁচা বই নিয়ে সব
    নানান সুরে আলোটুকু ঘিরে ধরে বইয়ের পড়া উজার করে কান ফাটিয়ে।
    দাদুর দোকান বিক্রিবাটা কমতে থাকে।
    বেশ খানিকটা রাতে আসে যতনদাদু ঠিক যখনি কলকাতা ক খবর পড়েন।

    সারাদিনের বিক্রিবাটা সব গুছিয়ে
    দশ পয়সা, সিকি আধলা এক একটা সেই
    থাক বরাবর হয় আলাদা।
    গুণতি শেষে খাতায় সব যোগ বিয়োগের হিসেব নিকেশ।
    শেষ হলে সব ভেতর ঘরের থেকে তখন ডাক আসবে খেতে আসার
    তারও পরে গঞ্জ ছুঁতে আসার বাকি শেষ ট্রেনটির।

    সাধ্যমতো সাপ খোঁজে তার রসদ সারা শরৎ জুড়ে।
    ভরা বর্ষা যেই না গেল সবারই তো ভরভরন্ত।
    উৎসবে সবে ছেলে পিলে যে দু একটা খুব দুরন্ত।

    ঝাঁপ খায় সে ভরা দিঘীর মাঝবরাবর নোয়ানো সেই গাছে চড়ে।
    সাপ দেখে সব, উৎসবে তার চেরা জিভের ফাঁকে শুধু ধান্দা ঘোরে।
    এদের তুমি দেখতে পাচ্ছো চকচকে গায়ে,
    তোমার আমার পকেট যখন একটু ভারি আসছে এরা নানা ছুতোয়,
    গছায় জিনিস রকমারি।
    এদিককার সব সাপ সাপিনী দোকান করে আলোয় ভরা।
    চকচকে সব বিজ্ঞাপনী তুমি আমি আত্মহারা।

    আত্মহারা ছিলাম সেদিন এই আমিও যেদিনটাতে বৃষ্টি হল।
    মাঠ ঘাট পথ সব একাকার।
    ভোরবেলারই চাদর মুড়ে সারা দিনটা ঝিমিয়ে ছিল।
    আমি তখন মেঘঝুপ্পুস জলমানুষটা
    রাস্তা জুড়ে সাইকেলে সেই জলের দাগ দুভাগ করে চলতে থাকি।
    জলের ছিটে চোখে মুখে বিঁধতে থাকে।
    মুখ গুঁজে দি হ্যান্ডেলে আর প্যাডেল মারি।
    স্টেশনটাতে যাওয়ার ছিল,
    তোমার সেদিন ফেরার কথা যেন কয়েক মাসের পরে।
    কাউকে তুমি বলোনি তাই বাড়ির লোকে জানতো না সে।
    আমি দেখলাম এ বৃষ্টিতে স্টেশনে কি রিক্সা পাবে?
    এখন ভাবি কি ধৃষ্টতাই না সেদিন ছিল।
    থাক সে কথা, আবার সেই গল্প শোনো।

    ফাঁকা রাস্তায় দু প্রান্তের আভাস দেখে চালিয়ে যাওয়া,
    সপসপে সব পোশাক থেকে টপটপাটপ ঝরছিলো জল,
    থেকে থেকে দমকা হাওয়া এদিক ওদিক ঝাপট মারে।
    বিড়ির প্যাকেট প্লাস্টিকের তো বোধ কিছু শুকনো তখন,
    তা হলে কি দেশলাই তো পুরো ভিজে ন্যাতার মতোন।
    একলা চলি সঙ্গে থাকে মিছিল যত কথা তোমায়।
    বকবকানি বৃষ্টিটারও কে যে কাকে চালায় থামায়, ভাবছি শুধু।
    হঠাৎ করে উল্টোদিকের থেকে গাড়ি আসলে যখন সাইড মারি
    গাড়ির ছিটে জলের থেকে কেন তখন আড়াল করি কেই বা জানে।
    হয়তো ওসব কথাগুলো এতো আমার সঙ্গে থাকে বুঝতে পেরে এতো বেশি ছটফটানি।

    এ গল্পটা এইটুকুনই,
    এরপরে সেই স্টেশন গিয়ে শুনবো আমি
    আগের রাতেই বৃষ্টি এতো মোটেও তোমার ট্রেন ছাড়েনি –
    একলা যখন ফিরে আসি একলা শুধু জলমানুষের সঙ্গে শুধু বৃষ্টি থাকে।
    দিনদুপুরে সমস্তটা সন্ধেকাঁথা গায়ে চাপিয়ে কাশতে থাকে। কাশতে থাকে।

    চড়ুই ছিল দুই বিনুনির,

    তিড়িং বিড়িং সমস্তদিন দস্যিপনা।
    স্কুলে কিম্বা ঘরের মধ্যে কে জানে সে
    খোপ খুঁজে পায় চতুষ্কোণা।
    চু কিত কিত চু কিত কিত ডাক দিয়ে যায় কিশোরীকে যে ভোরবেলা,
    সেই বাসেতেই আসত বুঝি ঘুমচোখে ওর সকালবেলা।
    চড়ুই ইতি উতি দেখে সামনাসামনি হলেই অমনি ফুরুৎ করে যায় পালিয়ে।
    তার পরে সেই ছোট্টো বুকের খাঁচাটিতে ঢিবঢিবাঢিব বাদ্যি বাজে।
    সামলে নিয়েই তাতে আবার ফুলকি ওড়া হাসি ছোটে
    কিচকিচাকিচ আরো অনেক সাঙ্গোপাঙ্গো জুটে না হোক চারপাশটা মুখর করে।

    চড়াই মায়ের ঘরের কাজ সামলানো এক ঝক্কি বড়।
    সে খোঁড়া কাক ময়লা রঙে শুরু থেকেই একলষেঁড়ে।
    ঘর সংসার নিপুণ হাতে গোছায় সে মা।
    চড়ুই বোনের দাদাটি এক রত্ন বিশেষ।
    সেই তোতাটি স্কুলের খাতায় খেলার মাঠে সারাক্ষণই জিততে থাকে।
    ভালো ছেলে জেনেও তোতার পাড়ার সবাই তার সঙ্গে মিশতে পারে আপন করে।
    ওদের পড়ার ফুলবাগানে এই দুটো গাছ সবার এমন প্রিয় থাকে।
    ছোট্টোবেলা মানেই যেমন পাহাড় আঁকে তার মধ্যেই সুর্য ওঠে লালচে রঙে।



    যে কুনকে সময় মাপে,
    চাপা কোনো ভাড়ার ঘরের অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে
    সবার জন্য হিসেব কষে বের করে দেয় বরাদ্দকে।
    তারই মধ্যে ভুলচুক কি হয় না কোনো?
    এতো মানুষ, গাছগাছালি, গাছের ডালে পাখির মেলা,
    ইতস্তত: ঘুরে বেড়ায় কুকুর ছাগল গাই গরু মোষ;
    মোষের পিঠে বসবে উড়ে মশা মাছি বরাদ্দ হয় তারও কিছু।
    সেই বরাদ্দ ঢালা সবার ফুটো মতো বাটিতে তা।
    এরি মধ্যে খুব বেশি যে অস্থির তার কিছু বুঝি চলকে পড়ে।
    তার খেলা খুব হঠাৎ করে যায় ফুরিয়ে। কোথায় যায়?
    ফেরৎ পায় কি কুনকে ওলা নাকি এসব তার একটা খেলার খেলা?

    তিরতিরে সেই নদীটিকে একলা আমার দারুণ লাগত,
    কপালে ওর একখান টিপ, যেদিন দুটি গোছ বিনুনি,
    নেমেই যেতাম জলে সেদিন, ক্লাসের পড়া আর হতো না।

    বিকেল বেলার বন্ধুরা তো আমার খবর টের পেত না।
    কয়েকদিনের পরে নদী যাবে যখন দুর শহরে,
    বসেই ছিলাম একলা হয়ে সত্যিকারের নদীর ধারে।
    সন্ধে হলে দেখছি দুরে ব্রীজ কাঁপিয়ে ট্রেনটা গেল।

    নদীই কেন আগ বাড়িয়ে রাখতে মাথা কাঁধটা দিলো?

    অনেক রাতে যাই শুতে সেই বাইরে ঘরে,
    আমার জন্য বরাদ্দ যা।
    বাড়তি লোকের জন্য রাখা ঝড়তি পড়তি ব্যবস্থারা।
    সবার টিভি দেখা হলে,
    তক্তোপোষের ওপর থেকে অনেক অনেক ধুলো ঝেড়ে
    কোনোমতে চোখ বুজে দি।
    সেদিন শুধু ঘুম আসেনি।
    গভীর রাতেও মঝবয়সী বুকের খাঁচায়
    ঘটাং ঘটাং ট্রেন চলে যায়,
    ট্রেন চলে যায়
    ট্রেন চলে যায়।

    অনেক দিনের পরে আকাশ ফর্সা হতে দেখি আমি।
    অন্যদিনের চেয়ে অনেক আগেই আসি বাইরে নেমে।
    দু এক আঁজলা প্রজাপতি ছটফটিয়ে স্কুলের পথে।
    তারই মধ্যে ছন্দপতন রাম চলে তার খুলতে দোকান ঘোঁতঘোঁতিয়ে।
    সকাল থেকেই শক্ত চোয়াল - সবকিছুতেই দেখছে তারই খরিদ্দারকে।

    আমার চেনা সকালবেলার আস্তানাটাও বেশ অচেনা লাগে তখন।
    আঁচ দিয়ে তার উনুনটাকে কেমন করে মাধবদা
    তার ছোট্টোমতো দোকানটাকে সাফ করে তা দেখার মতো।
    টিউকলে সে বালতি ভরে জল এনে তার ছিটে দিয়ে দাওয়াটাকে দেয় ঝেঁটিয়ে।
    তারপরে সে দোকানঘরের ভেতর থেকে কাঠের বেঞ্চি সাজিয়ে দেয়।

    রাতে আবার চড়ুই-টিয়ার বাড়িতে যাই পড়াই আমি।
    না গেলে হয় কিন্তু সময় কাটতে থাকে এমন করে দগদগে ঘায়ে,
    যন্ত্রণাকে বাড়তে দিতে মন চায় খুব। পালাই তখন - যাবো কোথায়?
    আস্তানা সেই দু এক টুকরো রুটি আর চচ্চড়ির নিরাপত্তা।
    একটা দুটো করে আকাশ রংমশালের রামধনুটা সরিয়ে ফেলে
    ময়লা সাদা পর্দা হয়ে ঝুলতে থাকে।
    হাসপাতালের মাঠে যেমন সারারাত্রি চাদর টাঙা প্রোজেক্টরে
    বই চলে খুব পুজোর সময়ে।
    অন্ধকারটা ফিকে হলেই চোখে পড়ে
    সতরঞ্চির ফাঁকে ফাঁকে বাচ্চাগুলো কখন থেকে ঘুমন্ত সব।
    আলো ফুটলে নিজের থেকে পর্দা ছবির গুরুত্বটাও যায় হারিয়ে।
    জেগে থাকা দর্শকেরাও খোঁওয়ার থেকে জেগে উঠে নিজের নিজের রাস্তা খোঁজে।
    সিনেমাওলা তখন যেমন বন্ধ করে শেষ সিনেমার শেষের আগেই।
    তখন এমন সাদা চাদর ময়লা মুখে সবার নজর দেয় ফিরিয়ে কুন্ঠা নিয়ে।

    সেই সিনেমার থেকে তখন উঠতে গিয়ে
    বেভুল আমি পাই না খুঁজে রাস্তা বলেই
    হঠাৎ করে মনে পরে পাখি দুটোর বকবকানি, ফিরি তখন।

    হাওদা এঁটে রাজার হাতি বেরোয় যখন সাজসজ্জা দেখার মতো।
    আতিশয্য চুঁইয়ে পড়ে ঠাসবুনুনি নীলের থেকে।
    হাওড় তখন টইটম্বুর।
    আশেপাশের পাড়ার পুকুর আয়না সাজে ছবি দেখায় গঞ্জটিকে।
    স্কুলের থেকে পালাই পালাই করলেও সে চড়ুইপাখি
    শেয়ালমুখো পন্ডিতকে সমঝে থাকে।
    যেমনটি সেই উপচে পড়া রং মাখা সেই আকাশটা ওর,
    একটু এদিক ওদিকে হলেই সব কিছুতে রং মাখাবে ভঙ্গী করা।

    রাজার হাতি আসলো বলেই-
    সেই বচ্ছর শহর থেকে ঘুরতে আসে কোম্পানিরা।
    কিসের ব্যবসা কি বৃত্তান্ত কেউই তেমন ঠিক জানেনা।
    আসলো ওরা বিরাট বিরাট গাড়ি চেপে
    ফুটফুটে সব বাবু বিবি রংচঙে সাজ চমক লাগে।
    হাঁকডাকে সব সরগরমে ভীড় জমে খুব।
    চড়ুই স্কুলে হুলুস্থুলু,
    এমনিতেতো সম্বচ্ছর ক্যাঁচড়ম্যাচোড় লেগেই থাকে,
    তার সঙ্গে এমন হঠাৎ গল্প করার খোরাকরা সব
    হাত পা মেলে লাগ ভেলকি উড়তে থাকে।

    কে বল্ল ওরা একটা দোকান দেবে বিরাট বড়।
    সব পাওয়া যায় দোকান যেমন ঐ শহরে তেমনধারা।
    আরেক জনে আরো জানে বলছে জানিস বল্ল বাবা
    মোটোরগাড়ির ফ্যাক্টারি তো লাগবে এখন ,
    সেই জানিস না টাটা কেমন পালিয়েছিলো আগের বারে
    তাই তো এবার ছদ্মবেশে ওরাই এসে কারখানা সব খুললো বলে।
    টিফিন হলে ছুটি হলে চড়ুই পাখি বড় বড় চোখ মেলে ভিড় করতে থাকে।

    ওদের একটা সামিয়ানা বিরাট করে মাঠ জুড়েছে।
    গাড়ি আসছে জিনিসপত্র নামছে যত দেখেই লোকে থতমত,
    দেখবে কী আর সবকিছু তার বাক্সবন্দী।
    বাইরে শুধু ইঞ্জিরিতে সোজা ট্যারা সংখ্যা লেখা।
    ওদের লোকরা কয়েকজন তো বাচ্চা মতন,
    কিন্তু এসব ভিড় দেখে সব মুচকি হাসে।
    এদের মধ্যে একটা যেন নতুন ছেলে,
    ঠিক চেনা যায় য়ুনিফর্মের নতুন গন্ধ
    ঠিকরে বেরোয় আড়ষ্ট তার হাসি থেকে।

    চড়ুই সেটা ফিকফিয়ে দেখছিলো আর ফেলছে হেসে।
    সে ছেলে তা টের পেয়ে বেশ বিড়ম্বিত।
    ঘন ঘন ঘাম মুছেছে,
    জোর করে খুব না তাকিয়ে
    কাজে সে তার মন দিয়ে সে পড়ছে ধরা।
    খানিক পরেই এদিক ওদিক করতে সে যে যায় পালিয়ে ভিতরঘরে।
    আসছে আবার ফিরে ফিরে,
    আড়চোখে সে দেখছে চড়ুই।
    ঠোঁট টেপা সে হাসি দেখেই লালচে ছেলে পালায় আবার।

    আমার কাজ তো দেখে ফেলা
    এইসব কি অন্য কোথাও ধরা পরে?
    কাগজে সব বিজ্ঞাপনের ভিতর থেকে,
    টিভি থেকে আসতে থাকা ছবি কথায় স্পষ্টতা সব জাহির করা।
    ওসব কিছু দেখার আগেই বুঝে যাওয়া।
    আমি দেখি এসব যখন পরত পরত দৃশ্যাবলী
    মেঘের থেকে আড়াল এনে বিরাট একটা প্রেক্ষিত আনে।
    তারই মধ্যে ঘরসংসার করতে থকে শব্দসকল।
    যা দেখতে পাই, যা দেখতে চাই,
    যা বুঝতে চাই, যা শুনতে চাই
    সবাই মিলে সেই মেঘেরই বারান্দাময়
    জমিয়ে বসে আড্ডা মারে।
    তাই যখনি দেখি চড়ুই দেখছে সে ঐ ছেলেটাকে,
    কীসব যেন দোটানা তার
    কানের পিছন থেকে ওর ঘাড়বরাবর ফিরতে থাকে।
    কিছু ওকে বলতে হবে - কিন্তু একটা কিন্তু কেন
    এমন করে আটকে থাকে, চড়ুই সেটা বুঝতে গিয়েও
    না বুঝিয়ে পারছে না তা। শব্দ ওকে ভাষা দিলেও
    অন্য কিছু দেয় থামিয়ে বলতে থাকা।
    কাজেই সেসব জমা হওয়া শব্দসকল
    মেঘের মত জমতে থাকে।
    ঠাহর যখন করি তখন কালো মেঘে সব ঢেকেছে।
    নাকি হঠাৎ সন্ধে কখন ফিরে গেছে না জানিয়ে অন্ধকারে।

    বাড়ির পথে ফেরে চড়ুই খুব একলাই।
    বন্ধুরা ওর পাশেই তবু।
    জমে থাকা শব্দেরা সব ভাবায় ওকে।
    পরত পরত মেঘে ঢাকা অন্ধকারে
    কোন পথে সে ফেলে আসে বকবকানি
    আমিই কি তার সবটা জানি?

    সত্যি সেদিন দেরি হল,
    বারান্দাতে জ্বলছে আলো,
    দেখেই চড়ুই টেরটি পেল।
    অন্য দিনের চেয়ে ষাঁড়টা
    ঘরে সেদিন আগেই ফেরে,
    চড়ুই সেটা বুঝতে পেরে
    পা টিপে সে ঘরের ভেতর চায় সেঁধোতে।
    রাম তখন তার ফোনটা নিয়ে এতোই ব্যস্ত
    দেখলো না চড়ুইপাখির দেরিটাকেও দেখার মতো।
    আসন্ন ঝড় মাথায় করে ঢিবঢিবে বুক দ্রুত ফেরে পড়ার ঘরে।
    ষাঁড়টা সেদিন ফুঁসছে তার কারণ বুঝি অন্য কোথাও।
    এই গঞ্জের বাজারে সেই বিরাট দোকান ঝড় তুললে
    তার ঐটুক খাপড়া চালের দোকান যেন ধুলোয় মেশে।
    কোত্থেকে সে খবর আনে এমনধারা হচ্ছে নাকি
    প্রায়ই আজকাল সব গঞ্জে গ্রামে।
    চিন্তা টিন্তা করতে পারা খুব একটা সে ধার ধারেনা
    তাই বুঝি সে ফুঁসে ওঠে, থেকে থেকে।

    খোঁড়া কাকটি এসব কিছুই দেখতে থাকে।
    তার তো কোনো নেই ভাষা সে বলবে কিছু।
    চুপটি করে আড়াল থেকে অপেক্ষা তার
    ফোঁসফোঁসানি যদি সত্যি আঘাত আনে।
    চড়ুই যখন ফিরছিলো না সন্ধে এলো,
    রামও এলো তখন সে তো ভয়েই গেলো।
    আজ না মেয়ে মার খায় খুব বাপের কাছে।
    এখন চড়ুই পড়তে বসে দেখে সে কাক অল্প করে চিন্তামুক্ত।
    কোথায় যেন কড়কড়ে ভয় তবু একটু আটকে থাকে।
    উগড়ে ফেললে ভালোই হত -
    থাকলে ভাষা হয়তো সে কাক বলেই দিতো অনেক কিছু।



    সপ্তাহে রোজ শুক্রবারে
    চড়ুই একটি টিকিট কাটে স্টেট লটারির।
    স্বভাব যেমন, বাসস্টপে সেই দুর্ভাগা ঐ ভাগ্যওলা,
    তার সঙ্গেও কিচিড়মিচিড় গল্প খানিক।
    এবার টিকিট কাটতে গিয়ে
    নতুন সামিয়ানার কথাও গল্পতে সে ছুটতে থাকে।
    তড়বড়িয়ে তার কথা সব শেষ হলে সেই ভাগ্যওলা খোলে ঝোলা -

    সে লোকটার ঝোলা ভরা গল্প জমা।
    পথচলতি মানুষ সেটা জেনেশুনে যায় এড়িয়ে।
    কাজ ভোলানো কথা সে সব অবোলতাবোল
    ঘষটে যাওয়া পয়সা যেমন দু-পাঁচ নয়া।
    ঝুঁকে সে সব তুলতে গেলেও সময় নষ্ট।

    চড়ুই সেসব ঠিক খুঁজে পায়।
    তার কাছে সে মুল্যায়নের নিক্তি অন্য।
    কষ্টিপাথর ঘষে ঘষে একটুখান অকাজ সে যে ঠিক খুঁজে পায়।
    বৃষ্টি এলে জানলা ধারে জলের ছিটে অল্প অল্প ভিজতে থাকে অকাজ সবার -
    আলস্যেতে উঠে গিয়ে জানলাটুকু বন্ধ করার ইচ্ছে তখন
    কোথায় যেন যায় পালিয়ে।
    ভাগ্যওলার তেমনই সব কাজ করবার ইচ্ছেগুলো
    উড়ে বেড়ায় তার থেকে ঠিক হাত তিন চার তফাৎ রেখে।
    ভাগ্যওলা চুপটি করে বসেই থাকে হাত ছোঁড়ে না
    সবার মতো ধরতে ওদের।
    বরং ওদের নাচ দেখে খুব হাত্তালি দেয়।
    কথার পরে কথারা সব ফুলকি নেচে
    অনেক দুরের থেকে কেমন আসতে থাকে,
    সামনে এলে নাচের সে তাল বাড়তে থাকে চার পাঁচ গুণ।
    মার্চ পাস্টের শেষে সবাই ফিরে গিয়েও ফিরে আবার আসতে থাকে।
    ততক্ষণে ভিজে ভিজে গল্পতে সব চলতি সময় ন্যাতার মতো বাতিল হলে,
    মেঘের ফাঁকে রোদ বেরোলে -
    ভাগ্যওলা বেশ কিছুক্ষণ চুপটি করে ভাবতে থাকে।
    চড়ুই পাখি সে গল্পতে নৈ:শব্দও নিজের করে শুনতে থাকে।

    মাজা ভাঙা বুড়ি কুকুর নতুন কিছু হবে ভেবে
    গুজব খানিক দেয় উসকিয়ে।
    ছেলে বউয়ের নিন্দেমন্দ বাদ পড়ে যায় সেই তালিকায়,
    তবু খানিক বিস্তারে তা ঘুরে ফেরে একই কথায় -
    আজকালকার ব্যাপারস্যাপার অন্য রকম।
    আমরা কেমন ঘোমটা টেনে শুধু কেমন শুনে যেতাম - এরা যেন কেমন ধারা।

    ঝুঁকে যখন দেখি কিছু অনেক নীচে
    জলকে ভাবি আয়না যেন পড়ে গেছে
    নিজের থেকে কেমন করে।
    অনেক দুরের থেকে সেই প্রতিফলন
    নিজের বলতে ঠাহর হলেই
    আশেপাশের মানুষ খুঁজি সেই ছবিতে।
    কার পাশে কে পরিপ্রেক্ষিত
    হয়তো কিছু আবেগ আনে -

    সেটা পেতেই ঝুঁকে পড়া।
    যখন সেই চারপাশটা খুব দ্রুততায় পালটে যাচ্ছে –
    আরো বেশি সময় লাগে চিনতে তাকে,
    তারও বেশি অবস্থানকে।
    নিজের ছবি ভেঙেচুড়ে বসাই এনে
    সবচেয়ে যা অন্যরকম। চমক লাগে।
    নিজেকে সেই ঠাটাঠমকে সাজাই এতো।
    চমকে দিতে আমার পাশের মানুষটিকে,
    খানিক পরেই যাই ভুলে সে কোনটা আমি -
    সাজার আগে নাকি এখন।

    এখন তখন ভোর হয়ে যায়।
    সময় কাটে যেন কোথাও গম ভাঙানো মেশিন চলে।
    আয়না সবার দুমড়ে গিয়ে বিক্ষিপ্ত প্রতিফলন যতই দেখি -
    তাতেই সবাই অবিন্যস্ত।
    তোতা অবধি এসব দেখে না বুঝেও তো
    সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে।
    সময় বড় হবে যখন
    তাকেও তার যোগ্য হতে খাটতে হবে।
    এসব ভেবেই আয়নাটুকুর সর্পিলতায় নাম লেখাচ্ছে
    নতুন স্কুলের রেজাল্ট আরো ভালো করার ইঁদুর্দৌড়ে -
    ইঁদুরকলে আটকে পড়তে।
    আজকাল সে খেলার মাঠে যায় না মোটে।
    অ¡রো বেশি লাইব্রেরিতে উঁকি মারে।
    আস্তে আস্তে কোথায় যেন একটা দুটো করে আলো কমতে থাকে।

    খবর হল বাইরে থেকে অনেক টাকা লোন এসেছে।
    এই গঞ্জে গড়বে নাকি মডেল শহর।
    ছবির মতো সবুজ থাকবে ঘর বাড়ি আর রাস্তা পুকুর।
    ছিমছাম সব ঝাঁ চকচকে যেমনটি হয়।
    ওরা একটা বেসরকারি সংস্থাকে বরাত পাঠায় -
    তাতেই ঐ সামিয়ানা, ঠাট ঠমকে তাক লেগে যায়।



    তখন একটা কোথাও তবু পৌছয় না
    এমন একটা রাস্তা যেটা গঞ্জ থেকে
    হঠাৎ করে যায় বেরিয়ে অন্য দিকে।
    আদিঅন্ত আঁকাবাঁকা রাস্তা সেটা বেশ অকাজের।
    ঐতিহাসিক সাপ যেন সে।

    ভরা পেটে খানাখন্দ বুকে বয়ে জিরোচ্ছে ঠিক গঞ্জ ছেড়ে।
    হাইওয়েটা যখন এই গঞ্জটিকে চিড়ে জোগায় রসদ কিছু,
    তাতেই গঞ্জে আলো জ্বলে, মানুষ চলে, থাকতে এসে ভরিয়ে তোলে।
    ঐ রাস্তার সেই পরোয়া নেই যে কোনো
    জিরোচ্ছে সে সাপ অতিকায় তার একটু গল্প শোনো।

    লোকে বলে আগে নাকি এই রাস্তা ছিল অনেক জমজমাটই,
    বাংলা তখন ভাগ হয় নি।
    এদিক সেদিক যেতে তখন
    নিয়ম বেনিয়মের কোনো কাগজ দেওয়ার চল ছিল না।
    রাস্তাটা বেশ চলছিল তার ঠাটঠমকও কম ছিল না।

    তারপরে এই রাস্তা যেন হঠাৎ করে পথ হারালো।
    স্বেচ্ছা অবসরে মানুষ হঠাৎ করে যায় বুড়িয়ে।
    পিচের খোয়া প্রতি বর্ষায় অল্প অল্প যাচ্ছে ক্ষয়ে।
    অবসরের পরে যেমন অফিসবাবুর বুটজুতোটাই
    সবার আগে হয় পুরোনো।
    প্যান্ট শার্ট সব ভাঁজে ভঁজে পিঁজতে থাকে।
    ঘরেও তারও পাত্তা কমে রোজই যেমন অল্প করেই।
    সকাল বেলার চা টা যেমন আগের চেয়ে ঠান্ডা থাকে।
    কলেজ ফেরৎ ছেলের বাড়ি ফেরার সময় যায় পিছিয়ে।
    এ রাস্তার দু-পাশে সে সংসারেও সব ছন্নছাড়া।
    চাষের জমি, ইতস্তত: পাট পচানো পুকুর কিছু।
    ছন্নছাড়া কিছু কিছু গ্রামও পাবে মাঝে মাঝে।
    ক্ষয়ে যাওয়া মানুষজনের বেশির ভাগই খুব অকাজের।
    এই রাস্তার বিষের নেশায় বুঁদ হয়ে সব ক্ষইতে থাকে।
    পথ হারানো রাস্তাখানি আমায় ডাকে থেকে থেকে।
    লজঝড়ে সেই সাইকেলেতে সাপের পেটে সেঁধোই যখন নেশা লাগে।
    কয়েক মাইল গেলে হঠাৎ একটা কিছু একটা দেখার মতো থাকতে হবে
    বলেই একটা লেভেল ক্রসিং।

    শেষ ট্রেন তার ছেড়ে গেছে হয়তো অনেক বছর আগে,
    তাও সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে পরিত্যক্ত লাইনম্যানের ঝুপড়িখানি।
    কাছেপিঠে মানুষ তো ছাড়, কুকুর বিড়াল কেউ দেখে নি সে তল্লাটে অনেকদিনই।

    আমি থামি ঠিক এখানেই।
    রেলগেটে ঐ পাল্লাদুটো কোনোকালে বেশ রুপোলি
    আজকে সেটা মরচে মেখে ঝুরো ঝুরো।
    দু-পাল্লা তার শেষ যেবারটি খোলা হল, কি হচ্ছিলো!
    তারপর সেই গেটম্যানকি শেষ ট্রেনকে রওনা করে ফিরেই গেলো?
    ফিরবে কোথায়? রাস্তাটা কি সেই সেদিনেও রাস্তা ছিলো?

    জানতো সেটা যাচ্ছে কোথায়?

    এত প্রশ্ন রেলগেটে সে প্রায় আমাকে আটকে দিতো।
    কাল্পনিক সে প্রশ্নগুলো না আসা সেই রেলগাড়িতে
    ঝমঝাঝম বাজতে বাজতে নিয়ে যেত সঙ্গে করে।
    অন্য একটা প্রশ্ন তখন তার কামরায় হাত বাড়িয়ে তুলে নিতো।
    বিন টিকিতে না-রেলগাড়ি চড়ে চড়ে ফেরৎ যেতাম
    ঠিক সেখানে রাস্তা ছিলো
    বলেই না কি না-রাস্তার নেই ঠিকানা পৌছল এক অসীম দূরে?

    দুটো একটা ভ্যানরিক্সা
    দু- ফালি সব টিনের কৌটো লোকাল বাসও
    এই রাস্তায় যায় কদাচিৎ।
    বাসগুলো সেই গেট পেরিয়ে
    অদ্ভুত সব নামের গ্রামে যেতেই থাকে।
    মানুষ কিছু দু-এক আঁজলা খুঁজে পাওয়া প্রতি কোণেই।
    সেই কোজাগর রাস্তা কাকে পথ দেখালো?
    নিজে নিজে হারিয়ে সে রেলগেটে সে জিরোয় যখন একলা হাসে।

    সখ্যতা এক অকৃত্রিম কানামাছি
    খেলতে বসে জিওল ডাঙায়।
    ভ্যাপসা রোদে পাট পচানো পুকুর থেকে
    খুব চেনা এক সখ্য হাওয়া সঙ্গ দিচ্ছে।
    খুব যে এটা কাম্য বললে গ্রাম্যতাতে হাসবে তুমি।
    চেনা এমন গন্ধ যাতে জিরোয় কারোর জন্মভূমি -
    শুধোও তাকে। অনিশ্চয় যা থেকে থেকে,
    চেনা চেনা বন্ধুদেরকে ডেকে নিল শহরওলা -
    পড়ে থাকি একলা বুকে গঞ্জ এঁটে
    ডাকটিকিটে ছ্যাতলা ধরা খামের মতো।
    আসা যাওয়া এক রাস্তায়
    চেনা সাপের মধ্যে সেঁধোয় দিনকাল যা -
    ভিড়ের মধ্যে একলা গাছের কোনো ডালে
    পেতেও পারো তার ঠিকানা,
    হাতের লেখা স্পষ্ট হলেও
    পৌছত কি আজন্মকাল ভুলে যাওয়া
    রেলগেট কি পার হয়ে সে? বলে দিও, বলেই দিও।

    পা ডোবানো সেই জলে প্রায়
    চান সেরে রোজ ফিরতে থাকি।
    যেমন ফেরে পেটের খিদে ঠিক সময়ে,
    খেয়ালখুশি চুলোয় দিয়ে।

    সন্ধেবেলায় পড়তে বসাই দেখছি চড়ুই থমথমে মুখ।
    বাপ নাকি ওর স্কুল পালিয়ে
    সামিয়ানার ধারে যাওয়া জানতে পেরে
    বেশ একচোট ঝড়বৃষ্টি।
    আমি তাতে বলবটা কি?
    বললে কিছু অন্যরকম ঘটতো না
    তা জানলে কি আর চুপটি থাকি?

    রাত পোহাতেই হুলুস্থুলু
    চড়ুই নাকি ফুরুৎ তার স্কুলের ব্যাগেই
    দুটো একটা জামা নিয়েই।
    টাটকা এমন খবর তাতে
    সকাল থেকেই
    মশলা পড়ে এলোপাথাড়।
    অবান্তর সব প্রসঙ্গরা
    দল বেঁধে সব ঘুরতে আসে।
    থানা পুলিশ রক্তারক্তি
    কান্নাকাটি কদিন ধরে চেটেপুটে
    খেলো মানুষ গোগ্রাসে সব।
    শকুনমার্কা ওবি ভ্যানও
    সেই সেবারেই দেখলো ওরা
    কাছের থেকে।
    এ-পক্ষ আর ও-পক্ষতে ভাগ হয়ে খুব
    রংতামাশায় জুটলো সবাই।
    সমকোণে ঘষটে হাঁটা ঠাকমা বুড়ি
    ঝাঁপখোলা সেই দোকান বাড়ির দালান জুড়ে
    কদিন একটু পুত্রবধুর নিন্দে থেকে ক্ষ্যান্ত দিলেন।
    রামের দোকান বন্ধ ছিল হপ্তাখানেক।
    সবই যেন ঘটল এমন দুর থেকে সব দেখতে গিয়ে
    মনে হচ্ছে সবাই যেন তৈরি ছিল এমন কিছু হবে বলেই।

    কেবল শুধু,
    বাচ্চাছেলে জিগস পাজল খেলতে গিয়ে –
    একটা শুধু টুকরো যেমন হারিয়ে যায় এমনি এমনি।
    তেমনটা ঠিক বলতে পারি
    তারপর আর কেউ কোনোদিন
    ভাগ্যওলার দোকানটাকে কেউ দেখেনি।
    ওর যেখানে আস্তানা সেই ট্রাকের গ্যারাজ
    সেইখানে যাই কদিন পরে অন্য কাজে।
    তখন জানি সেই লোকটাও হঠাৎ করে হাওয়ায় যেন মিলিয়ে গেছে।

    ডুবতে থাকা সুর্যটাকে
    চড়ুই কান্ডে খুব একটা কি সামনে আসতে দেখি?
    সেদিন অমন বিপর্যয়েও চুপচাপ সে দোকান সামলে বসেই ছিল।
    সেটা দেখে অবাক হওয়ার থেকেও সেদিন এতো কিছু দেখার ছিল -
    এখন কিছু বুঝতে পারি।

    সামিয়না সেই ঝড়েতেই উপড়েছিলো জানিয়ে রাখি।





    সেই জ্যামিতিক ছক কাটা সব গঞ্জ জুড়ে
    মাপা মানুষ চেপে থাকে অনেক কিছুই।
    ঝাঁপের দোকান দেওয়া দাদু সেই বছরেই
    ঝাঁপ ফেলে আর খুলল না এক সকলবেলা।
    বুড়ো মানুষ চলে গেলে
    সে অভিঘাত হয় না তেমন তীব্রতর,
    তাই কি সেটা চাপা একটা বোঝার মতো
    লাগে যখন সাইকেলে রোজ পার করি সেই দোকানবাড়ি -
    ঝাঁপের টিনে আস্তে আস্তে মরচে লাগে,
    ঠিক যেমনটি সেই রাস্তার রেলের গেটে,
    তফাৎ বলতে একটা শুধু বন্ধ হলে
    আর একটার খোলা মানেই খেলা ফুরোয়।

    সামিয়ানার সেই ঘটনা
    অনেক দুরের থেকে এখন গল্প লাগে।
    চড়ুই পাখি সেই সময়েই থমকে গিয়ে
    সবার মনে সেই রকমটা হয়েই যেন হাসতে থাকে।
    তারপরে আর ওদের বাড়ি হয় না যাওয়া,
    পড়ানো আর উঞ্ছবৃত্তি থেকেও বোধ হয়
    অন্য কোথাও অতিরিক্ত রুটির টুকরো
    আমায় নিয়ে হাজির করবে গঞ্জ থেকে অনেক দুরে।
    তাতেই আমি সেই সময়েই আটকে থাকি।
    যেন তুমি প্রথমবারের জন্য গেলে শহরটাতে
    আমি তোমায় খুঁজে যাচ্ছি
    আজ এতোদিন পরেও তেমন টাটকা লাগে।
    ক্ষত থেকে বিন্দু বিন্দু রক্তফোঁটা
    আজও তেমন জ্যান্ত যেন
    সকাল বেলার শিশির মাখা গোলাপ হয়ে ফুটে থাকে।
    তারও পরে গল্প ছিল, গল্প আছে,
    থাকবে হয়তো আসছে দিনেও।
    ভুঁইপটকা বাজার গরম কাহিনীরাও

    আজ হয়তো তেমন করে কাঁপায় ছোট্টো গঞ্জটিকে।

    আগে না'হক থাকার মধ্যে চোখ ছিল তাই
    দেখতে পেতাম - ঠাকমা বুড়ি মাজা টেনে
    গন্ধ শুঁকে বুঝে নিত
    আজকে সে আজ কোথায় গেলে
    প্রার্থিত তার পাত্তা পাবে।
    সকাল বিকেল নানা রঙের
    বাচ্চারা সব কিচিরমিচির
    বইতে থাকা দালান জুড়ে।
    হাট বাজারেও মাঠের থেকে
    সিধে আসা খেঁটো ধুতি
    টোকা মাথায় সওদা নিয়ে
    বসতে আসা মানুষ বড় দেখার ছিলো।
    ভিড়ের মধ্যে মানুষগুলোর প্রায় সবারই
    দুটো আস্ত নাম তো ছিলো।
    এই গঞ্জেই এই সেদিনেও
    পো: জগাছা গ্রা: ঢিমেলা জে: নদিয়া
    লিখে দিলেই পেতো চিঠি
    ঝাঁপাদাদু কলকাতায় তার মেয়ের থেকে।
    তেমন কিছু না থাকলেও
    সবার যেন খুব আলাদা গন্ধ ছিলো।

    ফিরে আসি মাঝে মাঝে
    খিড়কি পথে গঞ্জটিতে -
    তাতেও শুধু ফারাকটুকু দেখতে থাকি।
    সখ্যতা তার চেনা গন্ধে হাজির হয়ে সামনে এলে
    চেনা তেমন লাগার আগে মাপতে বসি কতটা সে বদলে গেছে এই ক'দিনে।
    বয়স বোধ হয় ভাটির টানে ফেরায় যখন সমতলে -
    দৌড়নো আর হয় না মোটে-
    গাছের ছায়ায় সময় কাটে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।
    বদলে আমি নিজেই গেছি জানলেও তা
    ঢাকছি বলেই ফরাকটুকুর চুল চেরা সব বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকি।
    তবু যেন কোথাও একটা ধন্দ লাগে।
    এখন চোখে ঠাহর বোধ হয় কম সবারই -
    নয়তো সবই একইরকম,
    তাতেই এতো বাড়িটাড়ির নম্বরেরই বাড়বাড়ন্ত।
    ছেলেপিলে ধেরে থেকে বুড়ো- হাবড়া সবাই যেন
    এক ছাঁচে সব মোড়োলদাদুর কথা মেনে একইরকম।
    আস্তে আস্তে চেনা চেনা মানুষগুলো ভিড় হয়ে যায়।

    বিচিত্র সেই পশু পাখি গন্ধ মাখা মানুষগুলো মানুষ হলেই ভিড় হয়ে যায়।

    রেলগেট সেই ভিড়ের চাপেই
    কবে থেকে উপড়ে গেলো ঠিক জানি না।
    হাওড় ধারের কুঁড়ে ঘরের নিষিদ্ধ সব গল্প উবে
    সেটা এখন "তিলোত্তমা" -
    বিরাট বড় হাউসিং যেই উঠল বেড়ে -
    সঙ্কোচে সেই হাওড় দেখি যায় সিঁটিয়ে রোজই একটু একটু করে।

    সেই খোঁড়া কাক আর আসে কি?
    ঠিক জানিনা।
    তোতা এখন বাইরে থাকে
    মাঝে সাজে ফিরলে পরে
    ওদের বাড়ির এক একটা তলা ওঠে।
    ওর যেগুলো বন্ধু ছিল
    সেদিন দেখি একজন তো
    সেই তোতাকে দেখে ফেলে
    হাতের বিড়ি লুকিয়ে ফেলে।

    রামের এখন পাইকারি সব,
    নাম কা ওয়াস্তে দোকান চালায় কর্মচারি উনিফর্মে।
    সেও বাপধন এই বাজারে ষাঁড়পনা তার বদলে ফেলে
    ঠিক শহুরে লোকের মতো, খাতির করে যায় এড়িয়ে।

    বৃষ্টি আগের মতো এলে সাইকেলে নয় হেঁটেই বেরোই
    মনে করে ছাতা হাতে। এদিক সেদিক জল জমে যায়।
    জলে ছাট লাগলে এখন অসুখ করে।
    আগেও অসুখ ছিল আমার ব্যক্তিগত
    তিরতিরে সেই নদী যখন শহরটাতে পা রাখলো।
    একলা নদী পারবে কি সে চলতে একা
    ভেবেই আমি যেতাম শুধু ছিলাম তখন এমন বোকা। -
    তার কি হল প্রশ্নটা যে এতই সহজ বাহুল্য তা।
    তবু জানাই, সেই নদীটি যথাসময়ে টের পেয়ে যায়
    সমুদ্র তার কোথায় আছে।
    হাওড় যদি জানবে এসব তবে সে কি হাওড় থাকতো?
    জল শুকিয়ে চটচটে যা জ্যান্ত থাকলে
    দেখতে পেতাম নিজের রক্ত।

    যে নিরুদ্দেশ ছিল আমার কোথাও যেন পৌছয় না,
    তেমন একটা রাস্তা ধরে।
    মরে যাওয়া ভুল ঠিকানার রাস্তা সেটা

    জ্যান্ত হলে খুশি হব তেমন মুরোদ কোনোকালেই টের পাই নি।
    রাস্তা পাশে এখন রিসোর্ট হাতছনি দেয় খরুচেদের।
    অনেকদিনই হয় না যাওয়া ওদিকটাতে।
    সেদিক থেকে বলতে পারি থেমে গেছি বেশ কিছুদিন।
    আগেও বোধ হয় থেমেই ছিলাম -
    বাপ দাদাদের আমল থেকে।
    তফাৎটা এই - আগে আমর সঙ্গে অনেক
    বিনা কাজের বন্ধু ছিলো।
    এখন শুধু সে রাস্তাটা সেই খুব পুরোনো রাস্তা হয়ে
    বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াই।
    এই শরীরের ঢিলে ঢালা শিরা উপশিরায় ধারে
    বর্ষা শেষে পাট পচানো গন্ধ থাকে।
    সেই পুরোনো রাস্তা যেন প্রাণ পেয়ে যায়
    আমায় ছেড়ে যায় এগিয়ে
    সত্যিকারের রাস্তা ধরে গড়গড়িয়ে।
    রাস্তা নাকি নদীর মতো
    বলবে আমায় সেই কথাটা একলা কখন সময় হলে?

    মরচে ধরা রেলগেট সেই
    বুকের পাঁজর খোলা রেখেই ধু ধু মাঠে যায় হারিয়ে।
    কোথাও আকাশ কালো হলে বুকের মধ্যে গঞ্জটিতে বৃষ্টি নামে।
    একের পর এক থেমে থাকা গাড়ির ফাঁকে সাইকেলটা ছোটাই আমি -
    পানকৌড়ি দাগ রেখে যায় হাওড় বুকে
    যে ক্ষণিকের মতো একটা
    সে অস্তিত্বে
    শ্বাস-প্রশ্বাস জ্যান্ত থাকে।

    ছবি- রোহন কুদ্দুস
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৫৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন