পর্ণ কিন্তু মোচী নয়; চিরহরিৎ ঋতু
একইসঙ্গে দুজনকে ভালবাসা যায় না?
প্রত্যেকটা সময়ের একটা 'সেইসময়' থাকে। আমাদের সেই সময়ে ভবেশ কুন্ডুর ফুল কেন লাল হচ্ছে সে বলা যাচ্ছে না, সুখেন দাসের এলোমেলোড্রামাটিক চোখের জলে বাংলার নদী খাল বিল সব ভেসে যাচ্ছে।পুরীতে যেমন বড় মাসিমার ভাতের হোটেল, ছোট পিসিমার ভাতের হোটেল, ভাই - বোনের ভাতের হোটেল ( রবিবারে আলুপোস্ত উপলব্ধ), ঠিক তেমনই অঞ্জন চৌধুরীর বড়, মেজ, সেজ, ফুল, রাঙ্গা বৌ সিরিজ হয়ে চলেছে বছরকে বছর। প্রভাত রায়ের একটা আধটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি ছেড়ে ক্রমে স্বপন সাহার 'সাগর বন্যায়' আছড়ে পড়ে আমরা সুনামি খাবি খাচ্ছি। মাঝে মাঝে অপর্ণা, গৌতম, বুদ্ধদেবগণ দয়া করে ঝাঁকিদর্শন দিয়ে যান। তাদের প্রসাদ কপালে ঠেকিয়ে জিভে স্পর্শ করতে না করতেই মিলিয়ে যায় শান্তির জল।
সিনেমা যে হলে গিয়ে দেখতে হয়, সেই তথ্যটা আমাদের সেরিব্রামের কোন এক ধূসর লকারে ক্লোরোফর্ম ঘোরে অকাতরে শায়িত ছিল ।
আমরা তখন ডায়লগ বলতে বুঝি, ফাঁপা ফাঁপা, মডিউলেশন বলতে বুঝি কাঁপা কাঁপা, কনসেপ্ট বলতে বুঝি সাউথ ঝাঁপা আর গান বলতে বুঝি সানুনাসিক গলায়' তোমার ঠোঁটটা যেন কমলালেবুর কোয়া, তোমার গালদুটোতে আপেলের ছোঁয়া,' এমত ফ্রুটস্যালাডোচিত লিরিক্স। এমন সময় একটা দমকা হাওয়া কিংবা অন্তরাত্মার মতো বিনা মেকাপে আস্তিত্বিক সঙ্কটের এভারেস্টে পৌঁছে দেবশ্রীর ডাক - 'বয়া-আ-আ-আ...'
উনিশে এপ্রিলে আমার সব থেকে প্রিয় সিন অপর্ণা দীপঙ্করের সামনে অবলীলায় শাড়ি ছাড়ছেন। 'সেই সময়ে'র নিরীখে তথাকথিত 'পরপুরুষের'সামনে ক্যাজুয়ালি কাপড় ছাড়া এক অনন্য ও অভিনব ব্যাপার। এ হতভাগা সমাজে পরপুরুষ মানেই তার সঙ্গে শোয়ার সম্পর্ক বা নষ্টামির সম্পর্ক কিন্তু ঋতুপর্ণ দেখালেন, স্বামীর সঙ্গে যার কোনদিনও মানসিক বোঝাপড়া হল না, সেই বোঝাপড়াটা যদি পরপুরুষের সঙ্গে ঘটে থাকে, তাহলে পরপুরুষ আর পর থাকে না। সে এক্কেবারে ঘরের লোক হয়ে যায় যার সামনে নিশ্চিন্ত আত্মিকতায় কাপড় ছাড়া যায়- ঋতু ভারতীয় মননে একটি শাবল হেনে পার্টনার, সহমর্মী বা সঙ্গীকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করলেন।
তারপর একের পর এক ছ্যা ছ্যা ছি ছি বিষয় নিয়ে নাগাড়ে নান্দনিক বোম ফাটিয়ে যাওয়া -
সাদা আর কালোর মাঝখানে যে ধূসর পরিসর তার বর্ণচ্ছটায় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া...
এক ধর্ষিতার করুণ ও অবমাননাকর সামাজিক অবস্থান, বৈবাহিক ধর্ষণ বা সাদা বাংলায় ম্যারিটাল রেপ( এখনো লোকে আঁতকে ওঠে,স্বামী আবার ধর্ষণ করবে কি, সে তো স্বামী), ইনসেস্ট, বিয়ের দিন সাপে কাটা পাত্রের এক অরক্ষণীয়া অলক্ষুণে চিরপাত্রী বাড়িউলির যৌন চেতনা, প্রেমাবেশ, স্বপ্নভঙ্গ, চোখের বালি'র অকাল বিধবার রজঃ বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া, একরত্তি যুবতীর শুষ্ক বিছানায় রতিবিলাপ। ফলস্বরূপ, সইয়ের সুখের সংসারে অগ্নিসংযোগ।
এক প্রোফেসরকে বলতে শুনেছিলাম, নিজেকে ঋতুপর্ণ কি - ই যে মনে করে? রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে চোখের বালিতে। কিসব সিন...
জেঠিমা'র বয়সী সেই শ্রদ্ধেয় প্রোফেসরের মুখে মুখে তর্ক করে পরিবেশ তিক্ত করতে চাইনি কিন্তু মনে মনে ভেবেছিলাম, বটে! রবীন্দ্রনাথের যুগে মেয়েরা বুঝি চ্যালাকাঠ দিয়ে তৈরি ছিল! রক্তমাংসময়ী ছিল না!
ভিক্টোরিয়ান যুগন্ধররা মনে করেন যৌনতা মানেই অশ্লীলতা, নোংরামি। তারা ভুলে যান এই অশ্লীল অসভ্যতার উপরই সভ্যতা টিকে আছে। একজন যুবতীর যৌবনোন্মেষ ঘটলে সেই যৌবনের তো একটা দাবি থাকে প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতিরও দায়বদ্ধতা থাকে তার যৌবনকে সম্মাননা প্রদর্শন করার। সেই স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রকৃতির দাবি মেটানোর ক্ষেত্রে সমাজ যদি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তবে নিপীড়িত বাঁকা আঙ্গুলে প্রতিশোধ নেবে বৈকি, প্রকৃতির প্রণোদনাতেই নেবে।
রবীন্দ্রনাথ তার যুগের পরিপ্রেক্ষিতে বিনোদিনীর বিধবা বিবাহের প্রস্তাব অব্দি এগিয়েছিলেন। ঋতুপর্ণ যদি তার কালধর্মের প্রভাবে আরেকটু এগিয়ে বিনোদিনীর শারীরিক অবদমনকে প্রকট করেন, তাতে মহাভারত অন্ততঃ অশুদ্ধ হয়ে যায় না। কারণ মহাভারতের নারীরা অন্ততঃ শারীরিক ও মানসিক অবদমনের কথা গোপন করেননি কখনো।
'সব চরিত্র কাল্পনিক 'থেকে দেখি ঋতু কীভাবে দর্শকদের বৈঠকী চালে গল্প বলার আঙ্গিক থেকে সরে এসে অন্তর্জগতে পা রাখছেন গুটি গুটি। যত নিজের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছেন, তত বিপাশার নূপুর থেকে কাদা ধুয়ে মুছে যাচ্ছে।বিপাশা ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে প্রবেশ করছেন অবচেতনের অরণ্যে।
পরের সিনেমাগুলো সবই এই অরণ্যের গভীর থেকে গভীরতর গহনে প্রবেশ করার মর্মরধ্বনি খুঁজে চলা।
শেষ সিনে কিং লিয়ার (অমিতাভ) যখন মারা গেলেন, সেই মুহুর্তে ফ্রিজ হয়ে গেলেন শেফালি ও দিব্যা। ঐ লোকটার হৃতপিন্ড স্তব্ধ
হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যারা তাকে ঘিরে ছিল তাদেরও জীবন থমকে গেল একচালায়। গো...স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া শেফালির পাশের দেওয়ালে একটি বড় তালা, তার নীচে হারিকেন। কিং লিয়ার জীবন রহস্যের তালা খুলে অমল আলোর পথে বেরিয়ে পড়লেন। এই সিনেকবিতার মুহুর্তগুলো যতবার দেখি, ততবারই ঝিনুকের পেটে মুক্তো থৈথৈ করে।
আজ থেকে সাত বছর আগে এইরকমই একটি সিনে কাব্যিক মুহুর্তে শ্বাশ্বত বিছানায় ফ্রিজ হয়ে গেলেন ঋতুপর্ণ।
মনে পড়ে যাচ্ছে চিত্রাঙ্গদা'র ডায়লগ -একটা বিল্ডিং সম্পূর্ণ তৈরি না হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিল্ডিং কেন বলে? কারণ, সংসারে কোন কিছুই সম্পূর্ণ নয়। ইট ইস এন অনগোয়িং প্রসেস।ঋতুপর্ণকে চেনাটাও আসলে এক অনগোয়িং প্রসেস যার মধ্য দিয়ে আমাদের বারবার যেতে হবে যতক্ষণ না আমরা নিজেরাই ফ্রিজ হয়ে যাচ্ছি।
ও, সেদিন সারাদিন কিছু খাইনি, সারারাত ঘুমোইনি। শুধু বাড়ির পাশে আর্শিনগরের কাচ ভেঙ্গে খুঁজতে চেষ্টা করেছিলাম আমার প্রিয় পড়শিকে।
তামিমৌ ত্রমি