লাগাতার কাজ শুরু হওয়া প্রয়োজন ছোটদের পরিসর থেকে। ভিন্নমত প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে তর্ক করা অমূলক সময় নষ্ট; বেশিরভাগেরই কান নেই, মুখ আছে। বরং সমমনস্ক কিছু প্রাপ্তবয়স্ক জোট বাঁধলে তবু একটা ব্যাপার। কিন্তু জোট বেঁধে, তারপর? আবার তর্ক? ঝগড়া? "আমাদের দাবি মানতে হবে"?
সে চলতেই পারে; বিকল্প ভাষ্যে যৌথ পরিবারের মতো এরা। কিন্তু এই সবই আগাছার পাতা ছেঁটে শিকড় রেখে দেওয়ার মতো ব্যাপার। গঠনমূলক কাজ অনেক, অনেক বেশি প্রয়োজন বুনিয়াদি স্তরে, ছোটদের সঙ্গে/ জন্য। আসলে আমাদের গবেট মাথায় রাজনীতি এতটাই 'বড়দের বিষয়' যে বড়দের ওদিকে ব্যস্ত রেখে রাষ্ট্রচালিত শিক্ষাব্যবস্থা ছোটদের apolitical কুচুসোনা প্রকল্পের অংশ করে নেয়। এ এক আশ্চর্য মজা! 'অরাজনৈতিক' ইতিহাস, 'অরাজনৈতিক' সাহিত্য, 'অরাজনৈতিক' ভূগোল, 'অরাজনৈতিক' বিজ্ঞান। partisan politics এত ঘৃণ্য, এত ভয়াল যে রাষ্ট্রের "আহা ওরা তো ছোট, এখন রাজনীতি কিসের" বাণী অভিভাবকরাও দিব্যি খান। অতএব, লং লিভ 'অরাজনৈতিক', ঠুলি-ওরিয়েন্টেড পাঠক্রম।
লজ্জিত ও অসহায় লাগে যখন তেত্রিশ বছর বয়সে এসে বুঝি ছোটবেলায় কিভাবে আমাদের 'অরাজনৈতিক' 'খেলু খেলু' রেখে রাষ্ট্রচালিত শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রাপ্তবয়স্করা আমাদের মধ্যে মসৃণভাবে নোংরা রাজনীতি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে বলা হয়েছে দেশকে ভালোবাসো; খেলাটাকে ভালোবাসতে কেউ বলেনি। সব্জিওয়ালা মাত্রেই ঠকায়, চোর; রিকশাচালক, রান্নার মাসি, নাপিত, মেথর, মুদিরদোকান-কাকু, এঁদের সঙ্গে ভালো করে কথা না বললেও চলে, কারণ এরা 'পড়াশুনা না করা'; এমনকি পরের ক্লাসে উঠতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আটকে গেলে তাকেও ত্যাজ্য করা --- এসব তো আমাদের চারপাশে ঝকমক করছে সমাজশিক্ষার চেহারায়। আর স্কুলে? ত্রিশ বছর বয়সে এসে রবীন্দ্রনাথের 'ইতিহাস' পড়ে বুঝেছি, ক্লাস এইট-নাইনে কী ভাঁওতাবাজি হয়েছিল! কী যে প্রতারিত লাগে! যে সময়ে আমাদের স্কুলের পড়াশুনা, সেই সময়কার সরকার কিভাবে উঁচু ক্লাসে আমাদের 'লার্নিং ইংলিশ' পড়িয়ে ইংরাজি পাঠের আদ্যশ্রাদ্ধ করেছেন। ক্লাস এইট, নাইন। কী পড়ছি, না 'লার্নিং ইংলিশ'! হাঃ! কেন? না মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব অপিরিসীম। মাতৃভাষায় কী পড়ছি, না 'অপুর কল্পনা'। বলেছিলাম না, আশ্চর্য মজা? বিদেশী ভাষার বদলে মাতৃভাষাকে prioritize করতে বললে আপনার প্রথমেই কী মনে হবে? মাতৃভাষার পাঠকে বিদেশী ভাষার পাঠের সমকক্ষ করে তুলি, আরও ক্রিটিকাল করে তুলি। আর আমরা কোন ভাবনার ফসল, না মাতৃভাষা যা আছে থাক, বিদেশী ভাষাটাকে টেনে নামিয়ে দাও সরকারী প্রকল্পে। কেন বাংলা মিডিয়াম মার খাবে না? কেন বাপ-মা হ্যালহেলিয়ে বাচ্চাগুলোকে ইংলিশ মিডিয়ামে পাঠাবেন না? ভূগোল বলতে বার্ষিক বৃষ্টিপাত আর গমের ফলনের জন্য আদর্শ জলবায়ু! আমাদের সময় স্কুলে 'জীবনশৈলী' (যৌনশিক্ষা বলা যাবে না, 'কাম' মানে 'এসো') শেখানো হতো না, তাই সেটা নিজেদের সাবলীল চেষ্টায় কিছুটা জেনেছি; নাহলে যে কী তৈরি হতাম।
না না, চিন্তার কোনও কারণই নেই। সরকার বদলে কিছুই পাল্টায় নি। আর কেন্দ্রে-রাজ্যে পাল্টাপাল্টি করে যে সরকারই আসুন, বিশ্বাস রাখুন, শিক্ষায় ছোটদের জন্য এই কুচুসোনা প্রকল্প বহাল থাকবে। এই প্রকল্প শুধু অভিভাবকদের শান্তিই দেয় না, আগামীর নিশ্চিন্ততা তৈরি করে।
কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে ছোটদের জন্য কাজ শুরু হওয়া প্রয়োজন। ওরকম আল-বাল রঙিন পাখি, ছুটির সকাল, বার্থডে পার্টি জাতীয় রূপকথা নয়। কাজ। যে কাজ তাদের ঘেঁটি ধরে বলে যাবে "ভাবো, ভাবো", যে কাজ ভাবা প্র্যাকটিস করাবে, এমন কাজ।