পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যের মসনদ ধর্মান্ধ হিংস্র মৌলবাদী শক্তির হাতে চলে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনায় আতঙ্কিত ছিলেন এ রাজ্যের গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষ। ফলপ্রকাশের পর যখন দেখা গেল যে তা ঘটেনি, তখন তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, উঠে এসেছে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন। এ রাজ্যের পূর্বতন ক্ষমতাসীন বাম শক্তি, বিশেষত তার বড় শরিক সিপিএম, কি মৌলবাদী শক্তিকে গোপনে সাহায্য করেছে? অর্থাৎ, তাদেরকে ক্ষমতা থেকে যারা হঠিয়েছে, সেই তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি ক্রোধ ও প্রতিহিংসা বশত তাদের কর্মী ও সমর্থকেরা কি বিজেপি-কে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতে চেষ্টা করেছিলেন? নির্বাচনের আগে থেকেই এ হেন সম্ভাবনার কথা হাওয়ায় ভাসছিল কোনও কোনও মহলে, এবং নির্বাচনের পর তার ‘প্রমাণ’ মিলেছে বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। যাঁরা এ আশঙ্কার কথা বলছেন, তাঁদের একাংশও নিজেদেরকে বামপন্থীই বলেন, এবং কেউ কেউ বিশুদ্ধতর বামপন্থী বলে দাবি করে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনী ফলাফল থেকে সত্যিই এমন ইঙ্গিত মেলে কি? সেটাই আজ আমরা এখানে পর্যালোচনা করে দেখব।
গোপন ব্যালট ব্যবস্থায় কে কাকে ভোট দিয়েছে তা সরাসরি বোঝার উপায় নেই, কিন্তু ভোটের তথ্য খুঁটিয়ে লক্ষ করলে কিছু না কিছু মোদ্দা প্রবণতা তো বেরিয়ে আসেই। সে পথে হেঁটে কতদূর এগোতে পারা যায়, দেখা যাক।
এটা ঘটনা যে, সিপিএম-এর নির্বাচনী প্রচারে আক্রমণের বর্শামুখটা ততটা বিজেপির দিকে ছিল না, যতটা ছিল তৃণমূলের দিকে, বিশেষত তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগগুলোর দিকে। এ অবস্থান আকার পেতে সাহায্য করেছে উপরোক্ত অভিযোগটিকে। আর তার ওপর, ভোটের মোদ্দা ফলাফল পূর্ববর্তী বিধানসভা নির্বাচনের (২০১৬) সঙ্গে তুলনা করলে আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে করার সুযোগ থাকছে যে, আশঙ্কাটি হয়ত বা সত্যিই হবে। তৃণমূল গতবারে ভোট পেয়েছিল ৪৫ শতাংশ, এবারে পেয়েছে ৪৮, অর্থাৎ এবারে গতবারের চেয়ে ৩ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে। বিজেপি গতবারে ভোট পেয়েছিল ১০ শতাংশ, এবারে পেয়েছে ৩৮, অর্থাৎ এবারে গতবারের চেয়ে অভাবনীয় ২৮ শতাংশ বেশি পেয়েছে। সিপিএম-এর ভোট হয়েছে ২০ থেকে ৫ শতাংশ, অর্থাৎ তারা খুইয়েছে ১৫ শতাংশ। কংগ্রেস-এর ভোট হয়েছে ১২ থেকে ৩ শতাংশ, অর্থাৎ তারা খুইয়েছে ৯ শতাংশ (সবই পূর্ণসংখ্যায়, ভগ্নাংশ না ধরে, এক নজরে সবটা পেতে চিত্র-১ দেখুন)। ফলে, খুব সহজ যে চিন্তা প্রথমেই মাথায় আসবে সেটা এই যে, তৃণমূল তো ভোট হারায়নি বরং বাড়িয়েছে, তাহলে বিজেপির ভোটে এই অভাবনীয় বৃদ্ধি আর কোথা থেকে আসবে, বামেদের হারিয়ে ফেলা ভোট যদি ওখানে না ঢুকে থাকে? যাঁরা আগে থেকেই এমন আশঙ্কা করছিলেন, এ সহজ ব্যাখ্যা তাঁদের কাছে অনিবার্য বলেই মনে হবে। অনেকে তা থেকে এমনও অনুসিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও গুণ্ডাবাজির অভিযোগগুলোর কারণে ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর’ প্রবলভাবে কাজ করবে এবং তার ফলে ভোটারদের এক বড় অংশ তাদের প্রতি বিরূপ হবেন বলে যে প্রত্যাশা বিরোধী দলগুলো করেছিল, তেমনটা আদৌ ঘটেনি, অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আদৌ জাগ্রত হয়নি। কিন্তু, ব্যাপারটা কি সত্যিই অতখানি সোজা? ভেবে দেখা যাক একটু।
মনে করুন যদি এমন হয় যে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে আসলে ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সিফ্যাক্টর’ ঠিকই কাজ করেছে, এবং তার দরুন তাদের নিজেদের ভোটের এক বড় অংশ বাস্তবিকই বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে, কিন্তু সিপিএম-সহ অন্যান্য নানা পক্ষের ভোট আবার তৃণমূলের পক্ষে গিয়ে তাদের মসনদকে রক্ষা করেছে (বা অন্তত পাকা করেছে) --- তাহলেও তো মোদ্দা শতাংশের হিসেবটা একই দাঁড়াবার কথা, তাই না?
জানি, এ অনুমানে কোনও কোনও পাঠক বিরক্ত হবেন। বলবেন, ধুর মশায়, যে সহজ সরল সত্যিটা সাদা চোখেই বোঝা যাচ্ছে তাকে অস্বীকার করে একটা জটিল গল্প ফাঁদছেন কোন দুঃখে? এমন কি, তিনি যদি দর্শনচর্চা করেন, তো আমাকে মধ্যযুগীয় ব্রিটিশ যুক্তিশাস্ত্রী ওকাম সাহেবের নীতিবাক্যও মনে করিয়ে দিতে পারেন --- কোনও ঘটনা বা তথ্যকে যদি সরলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে অকারণে জটিল ব্যাখ্যা আমদানি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কাজেই, আমাকে এখন খুলে বলতে হবে, জটিল ব্যাখ্যা ফাঁদছি কোন দুঃখে। সত্যি বলতে কী, সে দুঃখ একটা নয়, অন্তত গোটা তিনেক। প্রথমত, তৃণমূলের প্রতি যতই রাগ থাক, সিপিএম নিজের ভোট-ভাণ্ডারটি, যা নাকি ইতিমধ্যেই ক্ষীয়মান, তা বিজেপির হাতে তুলে দিয়ে নিজেকে পুরো মুছে দিতে চাইবে --- এমন অনুমান একেবারেই উদ্ভট ও অবান্তর। দ্বিতীয়ত, সিপিএম যে পনেরো শতাংশ ভোট হারিয়ে ফেলেছে তার পুরোটাও যদি বিজেপিতে গিয়ে থাকে (সাধারণ বুদ্ধিতে যা অসম্ভব), তাহলেও তা দিয়ে বিজেপির ২৮ শতাংশ ভোটবৃদ্ধির মাত্র অর্ধেকটা ব্যাখ্যা হয়, বাকি অর্ধেক অব্যাখ্যাতই থাকে। এমন কি, সিপিএম ও কংগ্রেসের মোট খুইয়ে ফেলা যে ভোট, অর্থাৎ ১৫+৯=২৪ শতাংশ, তার পুরোটা বিজেপিতে গেছে এইটা ধরে নিলে তার পরেও বাকি চার শতাংশ (২৮-২৪=৪) অব্যাখ্যাত থাকে। তৃতীয়ত, নির্বাচনের প্রাক্কালে দলে দলে বিজেপিতে যোগদান করা তৃণমূল নেতারা কোনও ভোটই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন নি এ অনুমানও অসম্ভব, কারণ তা যদি হত, আর যাই হোক, নন্দীগ্রামে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত হারতেন না। এত দুঃখের পরে সহজ সত্যি আর তত সহজ থাকবে না, বলা বাহুল্য।
তাহলে, নির্বাচনী বাস্তবতাকে খুঁজব কোন পথে? অবশ্যই সত্যান্বেষণের চিরকেলে পথে --- তথ্য, যুক্তি, বিশ্লেষণ। দেখতে হবে, গত দুটি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কী ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ জন্য প্রথমেই আমরা তাকাব এবারে বিজেপি যে সাতাত্তরটি আসন জিতেছে তার ইতিহাসের দিকে, সে ইতিহাস এক নজরে পেতে হলে দেখুন চিত্র-২। এই আসনগুলো আগে কাদের দখলে ছিল সে তথ্য সবিস্তারে পাবেন এ চিত্র থেকে, বস্তুত এটি একটি সারণি।
এই সারণির তথ্যের পরিসংখ্যানগত সারাৎসার দিয়েছি তার পরের ছোট্ট এক লাইনের সারণিটিতেই, দেখুন চিত্র-৩। বিজেপি-বিজিত সাতাত্তরটি আসনের মধ্যে কতগুলো কোন দলের জিম্মায় ছিল তা এখানে পাবেন এক নজরেই, এবং পাশেই ব্র্যাকেটে পাবেন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা শতাংশের হিসেব। ভাল করে দেখুন, এই সাতাত্তরের মধ্যে যেখানে তৃণমূল থেকে গেছে আটচল্লিশটি আসন (প্রায় বাষট্টি শতাংশ) এবং কংগ্রেস থেকে পনেরোটি (প্রায় কুড়ি শতাংশ), সেখানে সিপিএম থেকে গেছে মাত্র ছয়টি (প্রায় আট শতাংশ) এবং বাকি বামদলগুলোকে ধরলে সব মিলিয়ে প্রায় বারো শতাংশ। অর্থাৎ, এর মধ্যে প্রায় বিরাশি শতাংশ অবদানই যে অ-বাম দলের, সে নিয়ে বোধহয় আর কোনও কথাই হওয়া উচিত নয়।
আচ্ছা, এবার উল্টো দিক থেকে ব্যাপারটা দেখা যাক। গতবার সিপিএম যে ছাব্বিশটা আসন পেয়েছিল, এবারে সেগুলোরই বা কী গতি হল? সে তথ্য এক নজরে পাবার জন্য দেখুন চিত্র-৪,
এবং একইভাবে তার পরিসংখ্যানগত সারাৎসারের জন্য দেখুন চিত্র-৫। কী দেখলেন বলুন তো? ওর মধ্যে বিজেপিতে গেছে মাত্র ছটা (তেইশ শতাংশ), আর তৃণমূলে গেছে পুরো বাকিটাই, অর্থাৎ কুড়িটা (সাতাত্তর শতাংশ)! এখানেও বামভোটের রাম হওয়ার খুব বেশি ইঙ্গিত নেই, অন্তত ঘাসফুল হওয়ার থেকে বেশি ইঙ্গিত নেই, তাই না?
চিত্র-৬ থেকে পাওয়া যাচ্ছে ইতিপূর্বেই বিজেপির হস্তগত তিনটি আসনের পরিণতি সংক্রান্ত তথ্য। সংখ্যার স্বল্পতার কারণে এ থেকে টানা সিদ্ধান্ত খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে না, কাজেই এ সারণিটি এখানে না দিলেও হয়ত খুব ক্ষতি হত না। তবু বলি, বিগত কয়েক বছরে অর্জিত বিজেপির নিজস্ব ভোট যে এবারে খুব বেশি স্থানচ্যুত হয়নি, তার একটা আবছা ইঙ্গিত এর মধ্যে আছে।
অবশ্য, এইসব হিসেব নিকেশের পরেও একটা আপত্তি তোলা যায়। বলা যায়, এক নির্বাচন থেকে আরেক নির্বাচনে কিছু না কিছু ভোট তো এক থেকে আরেক দলে গিয়েই থাকে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সেখানে যে দলের ভোটের ভাঁড়ার বেশি তার থেকে নির্গমনের আয়তনও বেশি হবে, আর যে দলের ভাঁড়ারে মা ভবানী তার থেকে নির্গমনও কম হবে, এ তো জানা কথাই। কাজেই, শুধু এইটুকু দেখিয়ে এ কথা মোটেই প্রমাণ হবে না যে, সিপিএম থেকে কিছু বাড়াবাড়ি রকমের ভোট বিজেপিতে যায় নি। এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে গেলে কয়েকটি অনুপাত হাজির করা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত ঘোষিত ২৯২ সংখ্যক আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৭৭, অর্থাৎ শতাংশের হিসেবে দাঁড়াচ্ছে মোটামুটি ২৬.৩৭ শতাংশ। এখন, এই সংখ্যাটার সঙ্গে কীসের তুলনা করব? তৃণমূল, কংগ্রেস ও সিপিএম থেকে বিজেপি যে আসনগুলো হাতাতে পেরেছে সেগুলো আনুপাতিক হিসেবে ওই মোদ্দা অনুপাতটার চেয়ে কম না বেশি --- এ তুলনা থেকে হয়ত কিছু মূল্যবান ইঙ্গিত মিললেও মিলতেও পারে। বিগত বিধানসভায় তৃণমূল পেয়েছিল ২১১-টি আসন, আর কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪-টি আসন, মানে মোট ২৫৫। এবারে তা থেকে বিজেপির কব্জায় গেছে মোট ৬৩-টি (৪৮+১৫), অর্থাৎ প্রায় ২৫ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, অনুপাতটা প্রায় একই, হয়ত বা এক-দেড় শতাংশ কম। সেখানে সিপিএম-এর পূর্বতন ২৬-টি আসনের মধ্যে ৬-টি গেছে বিজেপির কব্জায়, অর্থাৎ প্রায় তেইশ শতাংশ, মানে বিজেপির মোট আসনলাভের মোদ্দা অনুপাতের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ কম। অতএব আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি, সিপিএম থেকে বিজেপিতে যাওয়া ভোট যদি কিছু থেকে থাকে (কিছু তো আছেই), তো সেটা কোনও হিসেবেই তৃণমূলের চেয়ে বেশি নয়। ফলত, সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির প্রশ্নে তৃণমূলের দায়ও কোনওভাবেই সিপিএম-এর থেকে কম নয়।
এখানে অবশ্য একটা স্বীকারোক্তি করে রাখা উচিত হবে। এই যে আমি আসন দিয়ে ভোটের হিসেব কষছি, এটা কিন্তু পরোক্ষ হিসেব, এখানে একটু ফাঁক থেকে যেতে পারে। কমবেশি ভোটের সঙ্গে কমবেশি আসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তো আছেই, কিন্তু সে সম্পর্ক মোটেই সব সময় সমানুপাতিক নয়। যদি এবারের ও গতবারের নির্বাচনে প্রতি আসনে বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোট-সংখ্যা দিয়ে সত্যিকারের ভোট হিসেব করা হত, এবং বঙ্গীয় নির্বাচনের এক দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষাপটে ফেলে তাকে বিচার করা যেত, তাহলে নিশ্চয়ই আরও নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে আসা যেত, এবং আরও অনেক লুকোনো সত্যিই হয়ত বেরিয়ে আসতে পারত। তবে, এখানে যে মোটাদাগের চিত্রটা উঠে আসছে সেটা তাতে পুরোপুরি খারিজ হয়ে যেত, আমার তা মনে হয়না। আমার ধারণা, তাতে বরং এই চিত্রটিই আরও পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠবে।
তা সে যাই হোক, এখন দেখা যাক, এই ভোট-সংখ্যার খেলাটা আরেকটু খেললে আরও কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় কিনা। ওপরে দেখেছি, সিপিএম ও কংগ্রেস মিলিয়ে এবারে মোট চব্বিশ শতাংশ ভোট খুইয়েছে। আর এই বড় চারটি দল বাদ দিয়ে অন্যান্যরা, যাদের মধ্যে মূলত আছে সিপিএম ছাড়া অন্যান্য বাম দল, মুসলমান ধর্মভিত্তিক দল, নিম্নবর্গীয় রাজনীতির দল --- এদের মোট ভোট তেরো থেকে কমে গিয়ে হয়েছে পাঁচ শতাংশ, অর্থাৎ এখানেও প্রায় আট শতাংশ ভোট খোয়া গেছে। মানে, সব মিলিয়ে বত্রিশ শতাংশ, খুব কম নয় মোটেই। স্পষ্টতই, এ ভোট ভাগ হয়েছে বিজেপি ও তৃণমূলে। ওপরের আলোচনায় এ ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, এর বেশিটাই গেছে তৃণমূলে। কিন্তু ধরুন, তাকে পাত্তা না দিয়ে যদি একটা ‘নিরাপদ’ অনুমানে যাই, এবং ধরে নিই যে এর ভাগ তৃণমূল ও বিজেপি সমানভাবে পেয়েছে, তাতেও তৃণমূলের ভাগে দাঁড়ায় ষোলো শতাংশ। যদি তৃণমূল এবারের ভোটে নিজের ভোটব্যাঙ্ক একটুও না খোয়াত, তাহলে গতবারের পঁয়তাল্লিশ শতাংশের সঙ্গে এই বাড়তি ভোট জুড়ে তৃণমূলের ভোট গিয়ে দাঁড়াত একষট্টি শতাংশে, কিন্তু তার বদলে হয়েছে আটচল্লিশ শতাংশ, অর্থাৎ বাস্তবে তাদের ভোট বেড়েছে মাত্র তিন শতাংশ। কীভাবে সম্ভব, যদি তৃণমূলের পূর্বতন সমর্থকেরা দলে দলে শিবির পরিবর্তন না করে থাকেন?
তাহলে, এ সবের অর্থ তবে কী? ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রবল উন্মত্ত ঝড়ে, এবং কিঞ্চিৎ প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্ষোভের উত্তাপেও, বাম-অবাম সবারই বিস্তর ভোট মৌলবাদী রাজনীতির শিবিরে উড়ে গিয়ে পড়েছে --- এ অনুমান সহজসাধ্য। কিন্তু, বামেদের মধ্যেই যে অংশ এ ঝড়েও অবিচলিত ছিলেন (তাঁরাই যে বেশিরভাগ, সে ইঙ্গিত ওপরে আছে), তাঁরাই বা নিজেদের প্রার্থীকে বঞ্চিত করে খামোখা তৃণমূলকে ভোট দেবেন কেন, বিশেষত যখন তাঁদের পার্টির ভোট-প্রচারের বর্শামুখ ছিল তৃণমূলের দিকেই? সত্যি বলতে কী, এ ধাঁধার উত্তর বোধহয় সবচেয়ে ভাল দিতে পারবেন স্বয়ং বাম ভোটার এবং তাঁদের নেতারাই। তবুও, আমরা যে অন্তত যৌক্তিক সম্ভাবনাগুলোকে একটু নেড়েচেড়ে দেখতেও পারিনা, এমন তো আর নয়। কে জানে, হয়ত পূর্বতন বাম ভোটারদের কাছে বাম রাজনীতি আর তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। কিংবা, বাম রাজনীতি প্রাসঙ্গিক হলেও, বর্তমান বাম দলগুলো আর প্রাসঙ্গিক নয়। কিংবা, দুইই প্রাসঙ্গিক, কিন্তু তাঁদের মনে হয়েছে, ধর্মান্ধ হিংস্র মৌলবাদী রাজনীতিকে আটকাতে নিজের ভোটটা এদিক ওদিক দিয়ে নষ্ট না করে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর শিবিরে জড়ো করা উচিত --- সেটাই এই মুহূর্তের কর্তব্য। কিংবা হয়ত, এই সবই একসাথে, কোনও এক জটিল রাসায়নিক অনুপাতে। কিংবা, আসলে হয়ত এর কোনওটিই নয়, এ হল পশ্চিমবঙ্গীয় ভোটারদের এক বৃহত্তর দীর্ঘমেয়াদি আচরণ-নকশার অঙ্গমাত্র। তাঁরা তিন দশক কংগ্রেসকে ক্ষমতায় রেখে হঠাৎ একদিন হুড়মুড়িয়ে ফেলে দিয়েছেন, সাড়ে তিন দশক বামফ্রন্টকে দেখে নিয়ে অকস্মাৎ ক্ষমতাচ্যুত করেছেন, এবং এখন হয়ত অপেক্ষা করছেন, আরও দুই-আড়াই দশক পরে হঠাৎ এক সুন্দর নির্বাচনী প্রভাতে তৃণমূল উৎপাটিত করবেন বলে।
বঙ্গের নির্বাচনী রথযাত্রার রথটিতে বিজেপি উঠতে পারেনি, কিন্তু শক্ত মুঠিতে হাতল চেপে ধরে ঝুলে পড়েছে। দিদি ভাবছেন আমি দেব, পিকে ভাবছেন আমি, ‘নো ভোট টু বিজেপি’ শিবিরের লোকজনও যে কিছুই ভাবছেন না এমন নয় (আমি স্বয়ং এই শেষোক্ত দলেই পড়ি)। ভোট-অন্তর্যামী মহোদয় অলক্ষ্যে হেসেছেন কিনা, সেটা হয়ত সমাজবিজ্ঞানীরা আমাদেরকে জানাতে পারবেন বেশ কয়েক বছর পরে।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় একান্তভাবে ব্যক্তিগত ক্যারিসমা-নির্ভর একটি পপুলিস্ট দল এবং মৌলবাদী দল ছাড়া আর অন্য কোনও দল না থাকা, এবং বামেদের পরিসর মুছে যাওয়া, সম্ভাব্য কোনও অর্থেই সুলক্ষণ নয়। রাজ্যের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ এবং আম জনতার জন্য তো নয়ই, এমন কি ‘বিশুদ্ধ’ বামেদের জন্যও নয়। মূলস্রোত বামেদের কাজ-কর্ম-চিন্তা যেমনই হয়ে থাকুক, রাজনৈতিক পরিসরে দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের অস্তিত্ব এক ‘রেফারেন্স ফ্রেম’ হয়ে থেকেছে, যার সাপেক্ষে ‘বিশুদ্ধ’ বাম নিজের অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধতার দাবিটি ওঠাতে পারেন। এখন যদি রামচন্দ্রের অশেষ কৃপায় সে রেফারেন্স ফ্রেম ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, ওই বিশুদ্ধতা তার যাবতীয় অর্থ ও প্রাসঙ্গিকতাটুকু হারাবে।
ঠিক কী কারণে কে কতটা ভোট পেল বা না পেল সে নিয়ে যত তর্কবিতর্কই হোক, দিনের শেষে তাহলে ঘটনা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে এটাই যে, বাংলার মসনদে তৃণমূলের আসন পোক্ত হয়েছে, অযুক্তি অন্ধত্ব ধর্মান্ধতা হিংস্রতা বিদ্বেষের রাজনীতির শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে ভীতিপ্রদ গতিতে, এবং বামেরা মুছে গেছেন নির্বাচনী পরিসর থেকে। সবচেয়ে খারাপ যেটা ঘটতে পারত সেটা ঘটেনি, কিন্তু বিরাট কিছু স্বস্তির কারণও ঘটেনি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে ক্ষমতা দখল থেকে বহুদূরে বিজেপিকে আটকে রাখা গিয়েছে, কিন্তু আসলে তৃণমূলের সঙ্গে তাদের ভোটের পার্থক্য মাত্রই দশ শতাংশ, এবং আর মাত্র তিন-চার শতাংশ ভোট ইধার-উধার হলেই খেলাটা পুরো ঘুরে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান ভোটার যদি কম করে পঁচিশ শতাংশও ধরি, এবং যদি ধরে নিই যে তাঁরা বিজেপিকে মোটেই ভোট দেন নি, তো তার অর্থটি দাঁড়াবে সাংঘাতিক --- বাকি পঁচাত্তর শতাংশের মধ্যে আটত্রিশ শতাংশ --- মানে সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোটের অর্ধেকের বেশিই বিজেপির দখলে! ফলত, পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ যে প্রবল হুমকির মুখে, সে নিয়ে বিশেষ সন্দেহ থাকার কথা না।
তবুও, আতঙ্কে দিশাহারা হবার কারণ ঘটেনি, এবং স্বাভাবিক যুক্তিবিচার ও শুভবুদ্ধিতে আস্থা হারানোরও কোনও কারণ ঘটেনি। আশা করা যেতেই পারে, ক্ষমতাসীন সরকার সুশাসনে মন দিলে সরকার-বিরোধী নেতিবাচক ভোটটা হয়ত বিদ্বেষ-আশ্রয়ী রাজনীতির কবল থেকে বেরিয়ে আসবে, হয়ত বা উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর ক্ষোভ মেটানোর সুবন্দোবস্ত হলে সেখানে বিজেপির জয়-জয়কারের বেলুন ফেঁসে যাবে। সে সাধ ও সাধ্য সরকারের আছে কিনা, তা অবশ্য সরকারি কর্তাব্যক্তিরাই ভাল বলতে পারবেন।
আরও আশা করা যেতে পারে, এ দেশে মৌলবাদী রাজনীতির বাকরোধকারী অগ্রগমনের এই পর্বটি হয়ত বা তার সেরা সময়টা পেরিয়ে এসেছে, হয়ত বা এবারে আস্তে আস্তে ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রদেহের আভ্যন্তরীণ ভারসাম্য-ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে তার সংঘর্ষ ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠতে থাকবে। তাদের অধিকৃত রাজ্যগুলোতে মানুষের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্ষোভ বেড়ে উঠবে, স্থানীয় দলগুলোর সঙ্গে তাদের জটিল ও অস্থিতিশীল বোঝাপড়াগুলো ভেঙে পড়তে থাকবে, প্রভাবশালী বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক লবির সঙ্গে বাধবে সংঘাত, এবং সেনা-আমলাতন্ত্র-বিচারব্যবস্থার সঙ্গে তাদের সুসম্পর্কও আর তত মসৃণ থাকবে না। ইতিমধ্যে, আন্তর্জাতিক চাপও হয়ত বাড়তে থাকবে। ফলত, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে যেভাবে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে রাজনৈতিক পরিসর দখল করার চেষ্টা করেছিল, সে প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন বজায় রেখে চলাটা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠবে না।
আর, সর্বশেষ আশা, দেশের সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় যুক্তিশীল কর্তৃত্ববাদ-বিরোধী নাগরিক তাঁদের বিচিত্র মত-পথ-বিশ্বাসের বেড়া ভেঙে দেশের সংকট মোচনে ক্রমশ একজোট হবেন, আটকে দেবেন দেশের সমস্ত রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসর অযুক্তি অন্ধত্ব আর বিদ্বেষের হাতে বেদখল হয়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া, গণতন্ত্রের এই ভয়ঙ্কর বহ্ন্যুৎসব।
তবে, সে সবের জন্য, নিজে নিজে যুক্তি দিয়ে ভাবা, নিজে নিজে তথ্য যাচাই করে নেওয়া, এবং আবেগাশ্রয়ী মিথ্যে প্রচারের অংশ হতে অস্বীকার করাটা খুব জরুরি।
হ্যাঁ, এমন কি সে প্রচার মৌলবাদ বিরোধিতার নাম করে হলেও!
দেবাশীষবাবুর ও সাগ্নিকবাবুর বক্তব্য ও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে আমার মত গোলা লোক কী বুঝল?
ফ্যাক্ট= বামের ভোট বিপুল ভাবে কমেছে (২০১৬- থেকে ১৯শে)। এতটাই যে বামদল বা কংগ্রেস একটাও সীট পায়নি।
কমে গেছে কোথায়?
দেবাশীষবাবু= বেশিরভাগটাই বিজেপিতে যায়নি। বেশ, তাহলে সিদ্ধান্ত ? তিনোতে গেছে? নইলে আর কোথায়?
সাগ্নিকবাবু= এভাবে বলা যায় না। ২০১৯ সালেরটা খেয়াল করলে হিউরিস্টিক সিদ্ধান্ত হোল বেশির ভাগ বিজেপিতে গেছে, কিছুটা তিনো।
আমার মনে হয় পিনাকীই ঠিক। সীট ধরে বিচার করলে বেটার অ্যানালিসিস হবে।
আপাতত; দেবাশীষবাবুর কথা মেনে নিলাম। বামের ভোট রামে যাওয়ার অপবাদ খারিজ করলাম। কিন্তু বাম সমর্থকরা কি খুশি হবেন যে ইস্টবেঙ্গল -মোহনবাগানের মত 'চিরশত্রু' দলে গেছে আমাদের সমর্থকদের ভোট? বহোত না-ইন্সাফি!
অর্জুনদা,
উত্তর দিতে দেরি হওয়ায় দুঃখিত। তোমার আলঙ্কারিকতা আর উড়ো রসিকতা --- দুটোই আমার বড্ড প্রিয়। এই যেমন ধর, এই যে বলেছ, 'ভোট কারো বাবার নয়' --- একে আমি দুই বগল উর্ধ্বে তুলে সমর্থন জানাতে প্রস্তুত। ভোট কারো বাবার নয় তো বটেই, এমন কি, দিদিরও নয়।
তুমি যা লিখেছ তার সঙ্গে নির্দিষ্ট যুক্তিতর্ক করা কঠিন, কারণ, তুমি তো আর যুক্তি-তথ্য দিয়ে আমার প্রতিপাদ্য বিষয়কে খণ্ডন করার চেষ্টা করনি, বরং আমার বক্তব্যকে 'পণ্ডশ্রম' প্রতিপন্ন করতে চেয়েছ। অর্থাৎ, সে প্রতিপাদ্যটি সত্যি না মিথ্যে তাতে আদৌ কিছুই যায় আসেনা। এতে আমার এমনিতে হতাশ হবারই কথা, তবে কিনা উল্টোদিকে আবার একটা আবছা তৃপ্তিও আছে --- অন্তত একে তুমি মিথ্যে বলনি। আমার মূল প্রতিপাদ্য ছিল --- পূর্বতন বামফ্রন্ট বিশেষত সিপিএম-এর ভোট বেশিটাই বিজেপিতে গেছে (এবং সেইহেতু বিজেপির ভোট বৃদ্ধির দায়টা মুলত তাদেরই), এবং দুর্নীতি ও ঔদ্ধত্য সংক্রান্ত বিস্তর অভিযোগ সত্ত্বেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোটারদের আদৌ কোনও ক্ষোভ তৈরি হয়নি (অর্থাৎ অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর এবার অনুপস্থিত ছিল) --- এই দুটো বক্তব্যই ভুল। কষ্ট করে এগুলোকে ভুল প্রমাণ করতে নেমে পড়েছিলাম, কারণ, তথাকথিত 'বিশুদ্ধ বাম' এবং লিবারেল মহলে সম্প্রতি কথাদুটো বড্ড বেশি শুনেছি। এবং, ফেসবুকে মূলত এঁরাই আমার চারপাশ ঘিরে আছেন বলেই সম্ভবত, একটু বেশি জোরে শুনেছি।
এই দুটো কথা কেন ভুল সে তো মূল লেখায় সবিস্তারে লিখেইছি, আর তুমিও তার বিরোধিতা করনি, অতএব সে নিয়ে আর কথা বলছি না। আপাতত এইটা বোঝাবার চেষ্টা করি, কেন এটা পণ্ডশ্রম বলে আমার মোটেই মনে হয়নি। সেটা করতে গেলে আগে এটা উল্লেখ করা দরকার, কেন তোমার কাছে এটা পণ্ডশ্রম মনে হয়েছে। যদ্দুর বুঝলাম, তোমার কাছে তার একমেবাদ্বিতীয়ম কারণ হল, সিপিএম তথা বামফ্রন্ট যেহেতু আদৌ 'বাম' নয়, অতএব 'বামভোট' কোথায় গেল এ প্রশ্ন অবান্তর --- পশ্চিমবঙ্গে বামভোট বলে কিছু নেই।
সিপিএম তথা বামফ্রন্ট কেন আদৌ 'বাম' নয় সে ব্যাপারে তোমার ব্যাখ্যা, বাম মানে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, আর সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সাড়ে তিন দশক সরকারে থেকে ক্ষমতার অংশ হয়ে গেছে, পুলিশ দিয়ে কৃষক-শ্রমিক পিটিয়েছে, অতএব তারা বাম নয়। ক্ষমতার অংশ হয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘদিন সে অবস্থায় থাকা বাম অবস্থানে চাপ সৃষ্টি করে তো বটেই, কিন্তু ওভাবে বললে তো যে কোনও বাম দল নির্বাচনে বেশি বেশি জিতলেই ডান হয়ে যাবে। তুমি অবশ্য বলতে পারো, ঠিক তাইই হবে এবং হয়ে থাকে, কিন্তু আমি যদ্দুর জানি, অ্যাকাডেমিক সমাজবিজ্ঞান চর্চায় বামের সংজ্ঞা ওভাবে দেওয়া হয়না। বাম বলা হয় তাদেরকেই যারা সামাজিক উচ্চনিচকে (সোশাল হায়ারার্কি --- গরিব-বড়লোক, উঁচুজাত-নিচুজাত, নারী-পুরুষ) প্রশ্ন করে এবং পরিবর্তনীয় মনে করে, আর ডান বলা হয় তাদেরকেই যারা সে উচ্চনিচকে ন্যায়সঙ্গত ও অপরিবর্তনীয় মনে করে। সেভাবে ভাবলে, বাম আর ডান বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা-না-থাকার ভিত্তিতে তৈরি দুটো স্থির বাইনারি বিন্দুমাত্র নয়, বরং এক রকমের সোশিও-পোলিটিক্যাল স্কেল-এর দুই প্রান্ত, যার মধ্যে বিভিন্ন দল বিভিন্ন বিন্দুতে পড়বে, প্রত্যেককেই অপরের সাপেক্ষে বেশি (বা কম) বাম (বা ডান) বলে সাব্যস্ত করা যাবে। কারুকে কারুকে মধ্যপন্থীও বলা চলবে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে।
কাজেই, সিপিএম বাম কি ডান --- আমার কাছে এটা আদৌ কোনও বৈধ সমাজবৈজ্ঞানিক প্রশ্নই নয়। আমার কাছে বৈধ প্রশ্নটা হচ্ছে, সিপিএম আর কংগ্রেস আর তৃণমূল আর বিজেপি কে কার তুলনায় বাম বা ডান।
কাজেই, 'বাম' আইডেন্টিটি সম্পর্কে তোমার ধারণা আমি প্রথমেই খারিজ করছি।
বাকি কথা পরে বলছি, এখন কমপিউটার থেকে উঠতে হবে। গোটা উত্তরটাই দেব, আপাতত তত্ত্বের গোড়াটা বেঁধে রাখলাম।
Ranjan Roy,
আপনার প্রশ্ন ও মন্তব্যগুলো বেশ 'নো ননসেন্স' টাইপের হয় বলে আমার বেশ ভাল লাগে। নজর রাখবেন, প্লিজ, কথা শেষ হয়নি।
খেলা হবে !!!
আমার তো চমৎকার লেগেছে এই বিশ্লেষণ। এতটা কাঙ্ক্ষিত নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে সমাজ মাধ্যমের লেখায় কাউকে চট করে লিখতে দেখি না। সবাই প্রায়,চটজলদি সিদ্ধান্ত টানা,কাউকে ভিলেন সাজানো, এতেই ব্যতিব্যস্ত। সেখানে আপনি কাউকে এগজনারেট করলেন বলে নয় রাজনৈতিক বিশ্লেষণের নামে নিজেদের পলিটিকাল ভিসনের প্রোজেকশন চালানো, এই প্র্যাকটিসটাকেই চ্যালেঞ্জ জানালেন। কুর্ণিশ ও ধন্যবাদ।
সন্দীপন,
অনেক ধন্যবাদ। আরও আসছে, দেরি হলেও। একটু নজর রাখবেন প্লিজ।
অর্জুনদার প্রতি আমার আরও যা যা বলবার, সেগুলো বাকি আছে, ইতিমধ্যে সাইটে আসতে পারিনি। কিন্তু সেগুলো বলার আগে আর একটা ছোট্ট প্রসঙ্গ সেরে নিই। এই সাইটে এবং ফেসবুকে আমাকে অনেকেই বলেছেন, শুধুই ২০১৬ আর ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল তুলনা করলে আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয় তা ভুল, এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনা করলেই নাকি তা খারিজ হয়ে গিয়ে প্রকৃত সত্যিটা বেরিয়ে পড়বে। ব্যাপারটা আমার খুব একটা সম্ভাব্য বলে মনে হয়নি, তবু মনটা খচখচ করছিল বলে সে তথ্যগুলোও একটু ঘেঁটে দেখলাম। কী পেলাম, এখানে বলি। প্রথমে দেখুন ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ভোট শতাংশ বণ্টনের এক সামগ্রিক চিত্র। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে ফলাফলের তফাতগুলো কী রকম, সেটাও এখানে বলা আছে।
খেয়াল করে দেখুন, নিছক ভোট শতাংশের বিচারে ২০২১ সালের সঙ্গে এর মোটেই খুব বেশি তফাত নেই। সামান্য যেটুকু তফাত আছে, সেটুকু থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ, লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচনে ভোটারদের উদ্দেশ্য ও আচরণ পুরোপুরি এক রকম হবার কথা না। নিচের সারণিতে ২০১৯ আর ২০২১ পাশাপাশি পাবেন, এক নজরে।
দেখে বোঝা যাচ্ছে, তফাত উনিশ বিশ --- বিজেপির ভাগ বরং সামান্য কমেছে। অর্থাৎ, একাধিক স্তরের বিভিন্ন বিগত নির্বাচনগুলোতে তৃণমূল ও বিজেপির সমস্ত পরিসর দখল করে ফেলা এবং বামেদের অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে প্রান্তিকীভবন --- এ প্রক্রিয়া হয়ত অবশেষে এক ভারসাম্যাবস্থার মুখোমুখি এসে দাঁড়াচ্ছে।
এবার তাহলে ভেবে দেখুন, ২০২১-এর ভোট ভাগাভাগি নিয়ে যে সমস্ত যুক্তি-বিশ্লেষণ উঠে এসেছিল, তার সবই ২০১৯-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হচ্ছে। অর্থাৎ, ঠিক ২০২১-এর মতই এখানে ভোট-শতাংশের মোদ্দা বণ্টন দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, তৃণমূল যখন ভোট হারায়নি বরং সামান্য বাড়িয়েছে, তখন বিজেপি-র ভোটের অভাবনীয় বৃদ্ধিটুকু নিশ্চয়ই বামেদের হারানো ভোট থেকেই এসেছে। কিন্তু, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আসনগুলো আগে কোনটা কার দখলে ছিল সে তথ্য বিশ্লেষণ করে মূল লেখায় আমি দেখিয়েছিলাম, ঘটনা তা নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আসনগুলোর বণ্টন-ইতিহাস ঠিক একইভাবে বিশ্লেষণ করলে কোন সত্য বেরিয়ে আসবে? সেটা জানতে গেলে ২০১৯-এ বিজেপির জিতে নেওয়া ১৮-টি লোকসভা আসনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসটা এক নজরে দেখতে পাওয়া দরকার, সারণির আকারে। নিচে দেখুন।
একই সঙ্গে এক নজরে দেখে নিন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম যে দুটি আসন জিতেছিল, ২০১৯ সালে তাদের গতি কি দাঁড়াল। যদিও সংখ্যার স্বল্পতার জন্য এ থেকে টানা সিদ্ধান্ত খুব জোরাল হবে না, তবু আবছা ইঙ্গিত কিছু তো অন্তত পাওয়া যেতেই পারে।
তাহলে, বিজেপি ২০১৯-এ যে ১৮-টি আসন জিতেছে সেগুলো কোন কোন দলের কাছ থেকে তাদের হাতে এসেছে, তার বণ্টনটা এবার দেখা যাক এক নজরে। পরম-সংখ্যাগুলোর পাশেই ব্র্যাকেটে থাকছে শতাংশ-হিসেব।
দেখুন, এর মধ্যে দুটি (এগারো শতাংশ) আগে থেকেই বিজেপির হাতে ছিল। বাকি প্রায় চুরাশি শতাংশই এসেছে অ-বাম দল থেকে, সাড়ে পাঁচ শতাংশ বাম দল থেকে। অর্থাৎ, এবারে বিজেপির নতুন করে 'গেইন' বা লাভ হয়েছে ১৮-২=১৬ টি আসন। যদি শতাংশগুলো তার সাপেক্ষে কষা যায়, হিসেবটা তবে ঠিক কী রকম দাঁড়াবে? সেটা রইল নিচের সারণিতে।
অর্থাৎ, ২০১৯-এ বিজেপি যা নতুন করে লাভ করছে, তার ৯৪ (৮৮+৬) শতাংশ দায় অ-বাম দলের, আর বামেদের মাত্রই ৬ শতাংশ!
তার মানে হচ্ছে, ২০২১-এ যে সিদ্ধান্ত যে যে কারণে প্রযোজ্য, ২০১৯-এও ঠিক সেই একই সিদ্ধান্তগুলো ঠিক সেই সেই কারণেই প্রযোজ্য।
কী বুঝলেন, মাননীয় বন্ধুগণ?
যা বুঝলাম, তা হল সিপিএমের দুটি সিট ছিল ২০১৪তে, ২০১৯এ তার ৫০% বিজেপিতে চলে যায়। তৃণমূলের ২০১৪-র ৩৪টার মধ্যে ২০১৯-এ ১৪টা (৪১%) বিজেপিতে যায়।
সংখ্যাতত্ত্বের খেলার মজা এটাই। ধরা যাক আগে একটা সিটে তৃণমূল ৪০, বাম ২৫ ও রাম ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। পরেরবার তৃণমূল ৪০-ই পেল, বাম আর রাম মিলে গেল। তাহলেও দেখা যাবে তৃণমূলের সিট বিজেপিতে গেল। সুতরাং সিটের হিসেব অনুযায়ী বাম-রাম মিলের তত্ত্ব ভুল দেখিয়ে দেওয়া যাবে।
না, সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে যা খুশি খেলা করা যায় না, গেলে ওটার আর কোনও মানেই থাকত না। সিপিএম-এর ৫০% আর তৃণমূলের ৪১% --- মোট সংখ্যার স্বল্পতার জন্য এখানে এ দুটোর তফাত খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তৃণমূলের আসন আর দু-তিনটে বেশি বিজেপিতে গেলেই শতাংশ ৫০% হয়ে যেত, আর সিপিএম-এর ক্ষেত্রে মাত্র একটা ইধার-উধার হলেই শতাংশ হয় ১০০% হয়ে যেত না হয় পরম শূন্যে নেমে আসত। কাজেই, এখানে ও দুটোর অর্থ প্রায় সমান সমান। তাতে তো এটাই প্রমাণ হয় যে, প্রবল সাম্প্রদায়িক ঝড়ে সব কিসিমের ভোটই কমবেশি গেরুয়া শিবিরে উড়ে গিয়ে পড়েছে, 'বাম ভোট রাম' হবার তত্ত্বের আলাদা কোনও বিশেষ তাৎপর্য নেই। বরং এটাই পরিষ্কার যে, যেহেতু ভোটের সিংভাগই তৃণমূলের আর সিপিএম ইতিমধ্যেই প্রান্তিক, অতএব ওই ৫০% অনুপাতের অর্থ হচ্ছে, বিজেপির বঙ্গজয় মূলত সম্ভব হয়েছে তৃণমূল সমর্থকদের ভোটেই।
প্রত্যেক আসনের ভেতরকার ভোট-বণ্টনের বিস্তারিত হিসেবটা সরাসরি হাজির করতে পারলে যে আরও সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যেত তাতে সন্দেহ নেই। তার জন্য শুধু বিজয়ী আর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটটুকু জানলে হবে না, তৃতীয় চতুর্থ এদের ভোটগুলোও জানা দরকার। যদি কেউ সে পরিশ্রমসাধ্য কাজটি করতে পারেন, করুন না। তাতে সকলেরই জ্ঞানবৃদ্ধি হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যদি বলেন, বিজেপির ষোলখানি নতুন আসনের মধ্যে পনেরোটিই অ-বাম উৎস থেকে আসার তথ্য থেকে কোনও ইঙ্গিতই মিলছে না, একমত হওয়া কঠিন।
অর্জুনদার বক্তব্যের উত্তর দেওয়া বাকি আছে, ওটুকু আজ বা কাল। ওটা ছাড়া আর বিশেষ কোনও কথা বলব না, যদি একান্ত দরকার না পড়ে। অন্যদের মতামত সুস্বাগতম।
ঠিকই, সিটের হিসেব দিয়ে ভোট শতাংশের পাল্লাবদল মাপতে যাওয়ার মানে নেই। যেহেতু তৃণমূলের ভোট শতাংশ কমেনি, বিজেপির বাড়তি ভোটটা আসতে হবে যাদের ভোট কমেছে তাদের দিক থেকেই। এটাকে সিটের হিসেব দিয়ে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। যাদের দুটি আসন,তারা কোনভাবেই দুটির বেশি আসন বিজেপিকে উপহার দিতে পারবে না কাজেই সিটের হিসেব দিয়ে বাকি সব আসনের দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপানো সহজ। ২০১৯ এ যে বাড়তি ২২ শতাংশ ভোট বিজেপিতে এল, সেটা তৃণমূল থেকে এসেছে আর বাম-কং-এর ২১% প্লাস আরো কিছু ভোট তৃণমূলে চলে গেছে এই ডিফেন্স যুক্তিহীন।অন্ততঃ তার সমর্থনে কোন তথ্য এখানে পেশ করা হয়নি।
দেবাশিসবাবুর কাছে একটা সিট ধরে বুঝতে চাই। বাঁকুড়াতে ২০১৪তে তৃণমূল জিতেছিল, ২০১৯ বিজেপি। বিজেপির ভোট বেড়েছিল প্রায় ২৯%, তৃণমূলের কমেছিল আড়াই পার্সেন্ট। সিপিএম আর কংগ্রেস দুদলেরই কমেছিল ২৪% করে। আপনার হিসেবমত সিটটা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গেছে মানে তৃণমূলের ভোট বিজেপিতে চলে গেছে। এখানে কি মনে হয় তৃণমূলের ২৯% ভোট বিজেপিতে গেছে আর সিপিএম কংগ্রেস থেকে ২৬-২৭% ভোট তৃণমূলে এসেছে?
বা ধরুন মেদিনীপুর। ২০১৪-২০১৯এ তৃণমূলের ভোট কমেছে ৪%, বিজেপির বেড়েছে ৩৪%, সিপিএমের কমেছে ২৭%, কংগ্রেসের ২%। এখানেও কি তৃণমূলের ৩৪% ভোট বিজেপিতে গেছে আর কং-সিপিএমের ভোটগুলো তৃণমূলে চলে এসেছে?
এগজ্যাক্টলি এই কথাটাই প্রথমদিন বলার চেষ্টা করেছিলাম। এরকম গাদা গাদা সীট দেখতে পাওয়া যাবে, যেখানে ২০-৩০% বাম/কংগ্রেস ভোট কমেছে (২০১৯এ) এবং ঠিক সম পরিমাণ % বেড়েছে বিজেপির। তৃণমূলের প্রায় হরে দরে এক আছে বা ২-৩% এদিকওদিক। এটা যদি কেবল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ঘটত, তাহলে এই ব্যাখ্যাটা খাটত যে মুসলিম ভোট বাম/কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে গেছে আর তৃণমূলের হিন্দু ভোট বিজেপিতে গেছে। কিন্তু বহু হিন্দুপ্রধান সীটেও এরকম বাল্ক ট্রান্সফার ঘটেছে, যেটা আদৌ কাকতালীয় নয়, হতে পারে না। সময় পাচ্ছি না বলে সীট ধরে ধরে এই হিসেবটা দেখাতে পারছি না। বিশ্লেষক নিজেই এটা দেখে নিতে পারেন। সবই পাবলিকলি এভেলেবল। ২০১৯ এর লোকসভাকে বিধানসভা ধরে ম্যাপ করতে হবে শুধু।