এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা

  • ভগৎ সিং : ভারতে মার্ক্সবাদী রাজনীতির আদিপর্ব

    জয়র্ষি লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | ২৩ মার্চ ২০২১ | ১৮২৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • প্রাককথন : ভগৎ সিং ভারতের মার্ক্সবাদী রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করা গেলেও এই লেখায় মূলতঃ HSRA এর বিকাশ ও তার সাথে ভগৎ সিং এর জীবন ও রাজনীতির বৃত্তান্তের যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি, শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ ইত্যাদি প্রসঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টার পাশাপাশি, সময়ের সাথে সাথে তার রাজনৈতিক বোধের বিকাশও উঠে এসেছে। লেখাটিতে "সন্ত্রাসবাদী" কথাটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের নথি তথা রাষ্ট্রের বয়ানে যাদের সন্ত্রাসবাদী বলা, তাদের সেই হিসেবেই চিহ্নিত করা আছে। রাষ্ট্র নিজের সন্ত্রাসকে মান্যতা দিতে বিপ্লবীদের চিরকাল সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে থাকে। তাই সন্ত্রাসের সংজ্ঞা মেনে মানুষ যাতে বুঝতে সক্ষম হয়, কোন সন্ত্রাস জনগণের পক্ষে আর কোন সন্ত্রাস বিপক্ষে, তা তুলে ধরার জন্যও এই লেখাতে চেষ্টা করা হয়েছে।


    ================================


    ভারতবর্ষ যথার্থই এক বৈচিত্র‍্যের দেশ। আর দেশের চেয়েও বেশী বৈচিত্র্যময় দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারা কোনো সময়েই কেবল সময়ের সাথে সরলরৈখিক রীতিতে আবর্তিত হয়নি। বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ শুধু একটি ছাতার তলায় আসতে পেরেছিলো সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে ভারতকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই বৈচিত্র্য বোধহয় আরও ভালোভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু দেশটার নাম ভারতবর্ষ আর বৈশিষ্ট্যই হলো, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। স্বরাজের (কারও মতে স্বায়ত্তশাসন) দাবীতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পথে নেমেছিলো সকল শ্রেণির ভারতবাসী। বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির প্রায় সব বড় বড় নতুন নেতাই, যেমন যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জি, সূর্য সেন, যতীন দাস, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগবতীচরণ ভোরা, রামপ্রসাদ বিসমিল অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে সোৎসাহে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলন প্রত্যাহার করার অতর্কিত সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবেই তাদের উদ্যমকে অনেকটাই পেছনে ঠেলে দেয়। গয়া কংগ্রেসে এ নিয়ে বিবাদ ওঠে চরমে। রামপ্রসাদ বিসমিল গান্ধিজীকে সরাসরি আক্রমণ করেন হঠকারিতা প্রদর্শনের জন্য। কারও সাথে পরামর্শ না করে একার হাতে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য কৈফিয়তও চান৷ (১ক)


    বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে যে একটি ছাতার তলায় আসার প্রয়োজন আন্দোলনকারীরা অনুভব করেছিলেন, সেই কংগ্রেসের অহিংস নীতি মানতে না পারায় বেড়িয়ে আসতে থাকেন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিপ্লবীদের উপর যে তীব্র দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিলো, তার রেশ ততদিনে অহিংস আন্দোলনের ফলে অনেকটাই স্তিমিত। ১৯২০-র গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সরকারও ক্ষমা প্রদর্শনের নীতি অনুসারে অনেক বন্দিকে মুক্তও করে দেয়। এই সমস্ত সহিংস বিপ্লবের শরিকরা একত্রিত হলে মূলতঃ দুটি স্বতন্ত্র ধারার জন্ম হয় ভারতে - একটি পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশে এবং অন্যটি বাংলায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের শ্রমিক শ্রেণির ট্রেড ইউনিয়নের বিপ্লবের জোয়ার এবং রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য উভয়ধারার বিপ্লবীদেরই উদ্বুদ্ধ করে। অভিজ্ঞ নেতৃবৃন্দের সাথে সাথে তরুণ বিপ্লবীরাও পুনরুজ্জীবিত হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নে।


    বাংলায় পুনর্গঠিত সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর মূল লক্ষ্য ছিলো পুলিশ অফিসার চার্লস টেগার্টকে হত্যা করা। ১৯২৪ এর প্রাকলগ্নেই এই অফিসারকে হত্যা করতে গিয়ে ডে নামক এক ইংরেজকে হত্যা করেন গোপীনাথ সাহা। এই আঘাত সহ্য করতে পারে না ব্রিটিশ সরকার। সদ্য জারি করা বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সের জোরে শুরু হয় প্রবল ধরপাকড়। ফাঁসির সাজা হয় গোপীনাথ সাহার, গ্রেপ্তার হন সুভাষ বসু সহ অসংখ্য কংগ্রেসী নেতা। বাংলাজুড়ে আলোড়িত হয় শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর থেকে তারা মূলতঃ সুভাষচন্দ্র বসু ও জে. এম. সেনগুপ্তের নেতৃত্বাধীন ছিলো। যুগান্তর গোষ্ঠী সমর্থন করতো সুভাষ বসুকে, অনুশীলন সমিতি জে. এম. সেনগুপ্তকে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর এই অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিবাদ এবং বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সের জেরে ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে বাংলার সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের শাখাটি।


    কিন্তু উত্তর ভারতের শাখাটি তখনো রীতিমতো দীপ্যমান। বাংলা থেকেও যোগেশ চ্যাটার্জি, শচীন্দ্রনাথ সান্যালের মতো ব্যক্তিত্বরা মিলিত হয়েছিলেন সমস্ত রকম হতাশা কাটিয়ে। ১৯২৪ এর অক্টোবরে কানপুরে প্রতিষ্ঠা ঘটে 'হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন' এর। উদ্দেশ্য - ঔপনিবেশিক শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে 'ফেডারেল রিপাবলিক অফ ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইন্ডিয়া' প্রতিষ্ঠা করা, যার মূলনীতি প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার। দলীয় মুখপত্রে ঘোষণা করা হলো, "রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জবাব দেওয়া হবে প্রতিসন্ত্রাসের মাধ্যমে, যদিও শুধু সন্ত্রাসবাদই স্বাধীনতা আনতে পারবে বলে বিশ্বাস করি না এবং শুধু সন্ত্রাসের জন্যই সন্ত্রাস চালাতেও চাই না।" (২)


    সশস্ত্র সংগ্রাম চালানোর জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা সংগ্রহ করতে উত্তর প্রদেশের কাকোরি গ্রামে ট্রেন আটকে সরকারি টাকা লুঠ করেন বিপ্লবীরা। ব্রিটিশ পুলিশের তৎপরতায় তাঁরা ধরা পড়ে যান। আশকাফুল্লা খাঁ, রামপ্রসাদ বিসমিল সহ চারজনের ফাঁসির নির্দেশ হয় বিচারে, আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হন সাতজন। কিন্তু সাফল্যের সাথে গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছিলেন চন্দ্রশেখর আজাদ। চন্দ্রশেখর আজাদ ছিলেন অসামান্য যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষ৷ তাঁর ইংরেজি জ্ঞান খুব বেশী না হওয়ায় শিখতে চাইতেন সাথীদের কাছে এবং যুক্তির সাহায্যে তাকে বোঝাতে পারলে তবেই সেই মত তিনি গ্রহণ করতেন।


    কাকোরি রেল ডাকাতি ছিলো উত্তর ভারতের বিপ্লবীদের কাছে নিঃসন্দেহে একটি বড় ধাক্কা। ফাঁসির প্রাকলগ্নে রামপ্রসাদ বিসমিল যুব সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা দেন, 'রিভলভার পরিত্যাগ করার' এবং 'প্রকাশ্যে আন্দোলন' করার। হিন্দু মুসলিম একতার কথা বারবার ধ্বনিত হয় তাঁর বক্তব্যে। সাথে সাথে কমিউনিজমে এবং বিশেষ করে 'প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সকলের সমানাধিকার' নীতিতে নিজের আস্থা তিনি পুনর্ঘোষণা করেন। (১খ)


    বিপ্লবের এহেন টালমাটাল পরিস্থিতিতে আগমন ভগৎ সিং এর। ১৯০৭ এ জন্ম এই দুঃসাহসী বইপোকা তখন একেবারেই কিশোর। সুখদেব, রাজগুরু প্রমুখ তরুণদের সাথে তিনি নানা পাঠচক্র গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিলো 'বিপ্লবের তরবারি তীক্ষ্ণ হয় চিন্তাধারার শানপাথরে'। (৩) এইচ এস আর এ আগ্রা দপ্তরে এমনকি জেলখানাতেও তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটা লাইব্রেরি। তাঁর সহযোদ্ধারাও জোর দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্র, আয়ারল্যান্ড, ইতালির বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে পড়াশোনার ব্যাপারে। ভগৎ সিং ও সুখদেব লাহোর ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকাশ্যে আইনি কাজকর্ম চালানোর জন্য। ভগৎ সিং মনে করতেন, "শিক্ষার্থীদের মূল দায়িত্ব পড়াশোনা করা, সেই অর্থে অন্যদিকে তাদের মনযোগ দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু দেশে কী পরিস্থিতি, সে বিষয়ে জানা এবং তার সমাধান তথা উন্নতির জন্য চিন্তাভাবনা করা কী শিক্ষারই অংশ নয়?" (৪) এই উদ্দেশ্য থেকেই ১৯২৬ সালে গঠিত হয় নওজোয়ান ভারত সভা। এই সভা গ্রামে গ্রামে শাখা বিস্তার করে শিক্ষার্থী, যুবক, কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালাতো।


    ১৯২৮ সালে চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বে শিব ভার্মা, জয়দেব কাপুর, ভগৎ সিং, ভগবতীচরণ ভোরা, দূর্গাবতী দেবী, সুকদেব, রাজগুরু একত্রিত হয়ে পুনরায় গড়ে তোলেন হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিক আর্মি। নামের পাশাপাশি কাজেও সমাজতন্ত্রকে সরকারি লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়। মুখপত্রে ঘোষিত হয়, "বিপ্লব এমন এক বৈশিষ্ট্য, যাতে প্রকৃতির ভালোবাসা থাকে এবং যাকে ছাড়া প্রকৃতি বা মনুষ্যসমাজ কারওরই প্রগতি সম্ভব না। বিপ্লব কখনোই কিছু খুন ও বোমাবাজির ভাবনাহীন পাশবিক প্রচার নয়। বিপ্লব ঈশ্বরবিরোধী হতে পারে, কিন্তু মানববিরোধী কোনোদিনই হতে পারে না।" (৫) ভগৎ সিং নিজে নাস্তিক হলেও মনে করতেন, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, এতে বিরোধ নেই। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা মানুষের শত্রু, এর বিরুদ্ধে লড়াই করতেই হবে। (৬) এমনকি নেতা হিসেবে পছন্দ করলেও শেষ জীবনের হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার জন্য লালা লাজপত রায়ের প্রবল সমালোচনা করেন ভগৎ সিং। লক্ষ্যণীয়, নওজোয়ান সভা সকল যুব সম্প্রদায়ের মিলনভূমি হলেও সকল সাম্প্রদায়িক সংগঠন ও পার্টির সংশ্রব সেখানে ছিলো নিষিদ্ধ।


    তবুও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম সম্পূর্ণ পরিহার করতে পারেন নি। আরউইনের কামরায় বোমা নিক্ষেপের সমালোচনা করে গান্ধিজী 'কাল্ট অফ বম্ব' নামক প্রবন্ধ লিখলে তার পাল্টা দর্শন 'ফিলোজফি অফ বম্ব' রচনা করেন চন্দ্রশেখর আজাদ ও ভগবতীচরণ ভোরা। ঘটনাবহুল ১৯২৮ সালেই সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ অফিসার স্কটের লাঠির আঘাত খেয়ে প্রাণ বিসর্জন করলেন লাজপত রায়। কন্ঠে শ্লোগান 'সাইমন গো ব্যাক'। জীবদ্দশায় তাঁর সাম্প্রদায়িক আচরণের জন্য প্রকাশ্যে পোস্টার বানিয়ে বিরোধিতা করলেও পছন্দের নেতার মৃত্যুর শোধ নেওয়ার দায়িত্ব ভগৎ সিং, রাজগুরু ও চন্দ্রশেখর আজাদ নিজ কাঁধে নিয়ে নেন। তবে কপালের ফেরে স্কটের বদলে প্রাণ যায় জুনিয়র অফিসার স্যাণ্ডার্সের। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভুল বুঝতে পারেন সভ্যরা। যে বিজ্ঞপ্তিতে এইচ এস আর এ তাদের সন্ত্রাসী ক্রিয়াকলাপের প্রচার করেছিলো যেসব পোস্টারের মাধ্যমে, সেখানে স্কটের নাম বদলে আসে স্যান্ডার্সের নাম। সঙ্গে সাংগঠনিক চেতনার ফলস্বরূপ লেখা থাকে, "একজন মানুষকে খুন করতে হলো বলে আমরা দুঃখিত। কিন্তু সে এমন এক অমানবিক অন্যায় ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ যাকে ধ্বংস করতেই হতো।" (৭)


    আসলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তাঁদের প্রায় কয়েক দশক সময়কে অতিবাহিত করতে হয়েছে। এই বিপুল দায়ভার সামলে চলতে গিয়ে হঠকারিতার ফসল হিসেবে সন্ত্রাসী পদক্ষেপ নিতে হয়েছে তাদের। এই কার্যকলাপ তাদের নিজেদের দ্বারাই সম্পূর্ণভাবে সমর্থিত ছিলো না। ১৯২৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুকদেব, বটুকেশ্বর দত্ত প্রত্যেকেই তাঁদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। মার্কসীয় দর্শন উপলব্ধি করে ভগৎ সিং মনে করেছিলেন একমাত্র জনগণের দ্বারাই জনগণের বিপ্লব হতে পারে। ফলে জনসংযোগ বৃদ্ধি ও ব্যাপক গণ আন্দোলনের মাধ্যমেই সফল বিপ্লবের জন্য সচেষ্ট হচ্ছিলেন তাঁরা। (৮)


    এইচ এস আর এ নেতৃত্ব তাদের পরিবর্তিত লক্ষ্য জনসমাজে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। সেসময়ে তাঁরা মনে করতেন শ্রমিকবিরোধী সরকারের স্বরূপ জনতার কাছে উন্মোচিত করা প্রয়োজন। তাই শ্রমিকস্বার্থ মাথায় রেখে 'জন নিরাপত্তা বিল' ও 'শিল্প বিরোধ বিল' নামক দুটি জনবিরোধী বিল পাশ হওয়া আটকাতে এবং একই সাথে প্রচারের জন্য উপযুক্ত স্থল বেছে নিতে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত আইনসভায় দুটি নিরীহ গ্যাসবোমা নিক্ষেপ ও ফাঁকা বন্দুকের আওয়াজ করেন। 'বদ্ধ কালাকে শোনানোর জন্য দরকার জোরালো আওয়াজ' লেখা লিফলেট ভেসে বেড়ায়, কক্ষ ধ্বনিত হয় 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক ধ্বনিতে'। বিচারের আদালতকে তাঁরা বানিয়ে তুললেন প্রচারের মঞ্চ। সভায় আসার সময় রোজ গাইতেন 'সরফারোশী কি তামান্না আব হামারে দিল মে হে' কিংবা 'মেরা রং দে বাসন্তী চোলা'। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে তাঁদের হৃদয় এত দৃঢ় ছিলো যে সচেতনতার সাথে সত শ্রী আকাল, বন্দেমাতরম, জয় হিন্দ প্রভৃতি ধর্ম ঘেঁষা শ্লোগান সযত্নে এড়িয়ে গেছিলেন।


    এমনকি জেলের ভয়াবহ অবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী যতীন দাসকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ করলেন রাজগুরু, শুকদেবসহ সকল রাজনৈতিক বন্দীরা। অপরাধী ও রাজনৈতিক বন্দীদের আলাদাভাবে গণ্য করার দাবীতে তাদের ঐতিহাসিক অনশন সমর্থন পেলো গোটা দেশ জুড়ে। ৬৪ দিন অনশনের মাথায় মারা গেলেন যতীন দাস। জেলে বসে ভগৎ সিং লিখলেন, "আজ আমি ঘোষণা করছি যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে , এবং এই যুদ্ধ ততদিন চলবে যতদিন ভারতের জনগণের শ্রম , প্রাকৃতিক সম্পদ হাতে গোনা কিছু পুঁজিপতি লুন্ঠন করবে , সে পুঁজিপতি ইংরেজ হোক , ইংরেজ ও ভারতীয়দের জুটি হোক বা সম্পুর্ন ভারতীয় হোক না কেন।" (৯) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন শ্রেণীসংগ্রামের আহ্বান।


    ১৯৩১ -এর ২৩শে মার্চ। ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব। পতন হলো স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রায় সম্পূর্ণ যুবশক্তি দ্বারা পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী ধারার। ভেঙে গেলো এইচ এস আর এ। কিন্তু তাদের দর্শন ও রাজনৈতিক চেতনা ছড়িয়ে পড়লো দেশজুড়ে। ফাঁসি দিয়ে রোখা যায় না কোনো চেতনাকে। রাষ্ট্রের অপরাধী তকমা সত্ত্বেও সে চেতনা বৃদ্ধি পেয়ে চলে। তাই রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে গণ্য হওয়ার আন্দোলনের সময়ও জেলের ভেতরে থেকে মৃত্যুদণ্ডের অসাড়তার তাত্ত্বিক সমালোচনা করতে পারেন জেলবন্দি বিপ্লবীরা।


    ভগৎ সিং একটি অধ্যায়। পঠন ও চিন্তার বিকাশ, যুক্তিবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক বন্দী চেতনা, মৃত্যুদণ্ড সকল দিকে ভাবনার বিকাশের জন্য একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্র। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের মতে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক চেতনার একাধিক যুবকের সম্মিলিত অভ্যুত্থান এই অধ্যায়কে সম্পূর্ণ আলাদামাত্রার গুরুত্ব প্রদান করে। ইতিহাস পড়া হয় শিক্ষা নেওয়ার জন্য। রাষ্ট্রীয় সংকটে যুব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব এবং সাংগঠনিক একাত্মতার প্রয়োজনীয়তার শিক্ষাও বোধহয় এই অধ্যায় দেয়। আর এই প্রয়োজন যখন চিরকালীন, এইচ এস আর এ -এর ইতিহাসে স্মরণ বোধ করি চিরকালীনই।


    ১ ক ও খ. রামপ্রসাদ বিসমিল রচিত 'অটোবায়োগ্রাফি'


    ২. এইচ আর এ - ১৯২৪ সালের ম্যানিফেস্টো


    ৩. শিব ভার্মা সম্পাদিত 'সিলেক্টেড রাইটিংস অফ ভগৎ সিং'


    ৪. ভগৎ সিং রচিত 'স্টুডেন্টস অ্যান্ড পলিটিক্স'


    ৫. এইচ এস আর এ - ১৯২৮ এর ম্যানিফেস্টো


    ৬. ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৮৫৭-১৯৪৭) - বিপান চন্দ্র


    ৭. ভগৎ সিং ও তার কমরেডদের দলিল - জগমোহন সিং ও চমনলাল


    ৮. জেল ডায়রি - ভগৎ সিং 


    ৯. ফাঁসি নয়, গুলি করে মারুন - ভগৎ সিং


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৩ মার্চ ২০২১ | ১৮২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন