এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অসুন্দরের দেশ

    Abhra Pal লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩০ নভেম্বর ২০২০ | ২২৩৭ বার পঠিত
  • কেউ কি বললে বিশ্বাস করবেন, যে এই লেখাটা লিখতে শুরু করেছি লকডাউনের গোড়ার দিকে - মাস দু এক হয়েছে। আমফানের দাপটে কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গ বিপর্যস্ত। সেই সময় ঈপ্সিতা'দির অনুরোধ আসে গুরুচন্ডালির জন্য লেখার। বলাই বাহুল্য লেখাটা শুরু হয়েও শেষ হয়নি। অনেকটা ছোটবেলায় লেখায় চিঠির মত। আমাকে চিঠি লেখা প্র্যাকটিস করতে বলা হয়েছে সবে সবে। প্রায়ই কোন একটা খাতা খুলে ছোড়দিকে চিঠি লেখা শুরু করতাম। অনেক সময়েই চিঠিগুলো আর শেষ হত না। এই লেখাটাও সেরকম একটা লেখা। শুধু লেখার জন্য একটা শিরোনাম ভেবে রেখেছিলাম - এখনও সেটা বদলাইনি।

    লেখার বিষয়ে ফিরে আসি। লকডাউনের অচলাবস্থা শুরু হওয়ার পর যেটা বুঝলাম তা হল এ অনেকটা ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের মত কেস। ইঞ্জিনীয়ারিং এ ঢোকার আগে থেকে যে শোনা যায় তা হল কোনওক্রমে একবার ঢুকে পড়তে পারলেই হল - বাকীটা মাখন। পরে সকাল আটটা থেকে পাঁচটা অবধি ক্লাস আর ল্যাব ঠেলতে ঠেলতে যখন দেখা গেল যে মাঝে মধ্যে উইকেট পড়ছে আর তার সাথে গোটা বছরের বারোটা বেজে যাচ্ছে, তখন বোঝা গেল যে ঢুকে পড়াটা সহজ ছিল, বরং একটা পাশ দিয়ে উৎরোনটাই বিরাট ব্যাপার। লকডাউনটাও সেরকম - প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিল শুরুটা কঠিন। পরে বোঝা গেল সমস্যটা অনেক বড় রকমের। সমস্যাটা হল অসুখ, খুব বড় রকমের অসুখ। বিগ ব্যাং থিওরি দেখতে গিয়ে একটা ইংরেজি বাক্যবন্ধ মাথায় এঁটে বসেছিল - এক্সটারনাল লোকাস অফ আইডেনটিটি। আর লকডাউনের ব্যাপারটা গোটা অসুখটাকে আরও অনেক তীব্র করে দিল।

    'ওমকারা' সিনেমায় বিড়ি জালাইলে গানটা মনে আছে? আমাদের চ্যাংড়া বন্ধুমহলে ঐ গানের পরিপ্রেক্ষিতে একটা ডায়লগ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, 'আগুন তো মনে'। মানে কাউকে সিগারেট ধরানোর সময় আগুন চাইলে এই প্রত্যুত্তর জুটত। একসময় খেলাচ্ছলে বলা এই কথাগুলো একদিন জীবনে পরম সত্য হয়ে যাবে, তার আর কি করে জানব। এক পরম অসুন্দরের দেশে আমাদের বাস। আমি মাঝে মাঝে ভেবে সময় নষ্ট করতাম যে ছোঁড়াছুড়ির জন্য এত কাদা আসে কোথা থেকে? পরে আস্তে আস্তে বুঝলাম যে ওটা আসে ভেতর থেকেই। একটু ঘর থেকে বেরোতে পারলে তাও জানলা দিয়ে কিছু হাওয়া বাতাস আসে। দু একটা স্নায়ুকোষে সতেজতার ছোঁয়া লাগে। এবছর লকডাউনের বাজারে তা হল উলটো। যাও টিমটিম করে টিকে ছিল, তা গেল মায়ের ভোগে। পায়ে বেড়ি, সাধ্যে বিকলাঙ্গতা কিন্তু কদর্যতা ভয়ঙ্কর সুন্দর। তাকে মনে আটকে রাখি কি করে? সে বেরিয়ে পড়ে বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকেই। যে দুনিয়ায় সে হেঁটে চলে বেড়ায়, তাকেও সেরকমই অসুন্দর করে তোলে। এই জগতটার নাম ভার্চুয়াল রিয়েলিটি।

    আজকাল ফেসবুক বা যে কোন সোশ্যাল মিডিয়া খুললে ক্লাস এইটের ফিজিক্স খুব মনে পড়ে - যেখানে শিখেছিলুম চুম্বকের দুই মেরু আলাদা করা অসম্ভব, একটা চুম্বককে দু টুকরো করলে দুজোড়া মেরু হবেই , কেউ আটকাতে পারবেনা। এরকম মেরুকরণ আজ মারাত্মক। একদিকে যুদ্ধু যুদ্ধু রব, তো অন্যদিকে দেশপ্রেমী দেশদ্রোহী খেলা। মাঝখানে প্রচণ্ড বিরক্তিকর সব মিম রেফারি। সেই মিমের থিম নিয়ে আবার উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু। বেশ কিছু লোকজনকে আনফলো করতে এক সময় বুঝলাম ব্যাপারটা সেই র‍্যাগিং এর নিয়মের মত। তুমি কিছু বললে তো হয় তুমি বোকাচো নয় তুমি গান-ড-এ হ্রস্ব উ। হয় এস্পার নয় ওস্পার। এর মাঝে কিছু নেই - পাবলিক তোমাকে কোনও একটা দলে ফলে পিষবেই। এটা রাজিনৈতিক হতেই হবে, তার কোন মানে নেই ~ আসল কথাটা হচ্ছে তোমার খিস্তি খাওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই। নইলে নীলকণ্ঠ হও ~ নীল ফেসবুকে এসে যাবতীয় ভাট ধারণ কর। ঠোঙ্গা ভোরা বাদাম ভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না টাইপ।

    আমার এক বন্ধু ও এক সময়ের রুমমেট দেবুর কথা বলে লেখা শেষ করব। অনেক বছর আগের কথা, আমরা গুটিচারেক নব্যযুবা মেস করে থাকি দেশের বাইরে। চারজন চারমূর্তি। একজন মিচকে তো একজন দাপুটে। একজন ক্যাবলা তো একজন সেয়ানা। এর মধ্যে অফিস সেরে বাড়ি ফেরার পর দেবুর মুখে হয় ’মউজা হি মঊজা’ (জব উই মেট) গান, নইলে ’সব বাঞ্চত, সব গুয়ের এপিঠ আর ওপিঠ’ নামক একটি স্ব-উদ্ভাবিত খিস্তি লেগেই থাকত। টানা পঞ্চাশবার লুপে মউজা হি মউজা আর খিস্তি শুনে আমাদের কানের পটহ শুকিয়ে এসেছি। তাই দেখে আরেক রুমমেট সৌমিক একটা মোক্ষম নিদান জোগাড় করেছি। একদিন দেবুকে ডেকে বললে, 'আয় দেবু হিসেবটা সেরে ফেলি'। দেবুও মাসকাবারি ভেবে বসে সোফায় পা গুটিয়ে বসে পড়েছিল| তখন সৌমিক খাতা কলম নিয়ে সবার লিখে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলে, 'তারপর দেবু এক এক করে বল'
    দেবু বললে, 'আমার বোধহয় কুড়ি পাউন্ড হবে।'
    সৌমিক বললে, 'না না - ওসব না। লিস্ট করে নি কে কে বাঞ্চোত, আর কে গুয়ের কোন পিঠ। অভ্রকে দিয়ে শুরু করি, বাঞ্চোত কি বাঞ্চত না'। ঐ একদিনের দাওয়াইতে দেবুর বুলি খুব সেরে যায়।

    তো এইটাই হচ্ছে সমস্যা। সব ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়া। অনেকটা সেই পাগলটার মত, হাতে প্যান্ট নিয়ে ল্যাংটো হয়ে ঘুরছে কিন্তু নিরিবিলি পাচ্ছে না বলে পরতে পারছে না। আমার মনে হয় এই ওভারশেয়ারিংটা হচ্ছে সাফারিং ফ্রম এক্সটারনাল লোকাস অফ আইডেনটিটি। জুকারবার্গ সুন্দর মোড়কে সভ্যতার অন্যতম কদর্য মানসিক বিকারটি উপহার দিয়ে গেছেন। পরশ্রীকাতরতা ব্যাপারটা আবার সোশ্যাল স্টকিং এর মধ্যে ঢুকে গেছে।

    এর কি আর নিদান নেই? করোনার ভ্যাকসিন চলে এল বলে - কিন্তু এই মনোবিকারের ছোঁয়াচ কমানোর চেষ্টা কোথাও নেই। আমার ওজন নিয়ে কটাক্ষ করলে তাই বলি মনের জানলাটা খুলে রেখেছি - এটাই আমার ফিটনেস রেজিম। ভালো থাকবেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩০ নভেম্বর ২০২০ | ২২৩৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন