অনেকদিন পরে বাড়িতে এলাম। এই করোনা শুরুর অনেক পরেই এসেছি। পাড়ার পুরানো যে দু একঘর প্রতিবেশী ছিল তারা আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, ভাবছিল কথা বলবে কিনা।
দেখি দিপুকাকার বউ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। কিছু বলবে ভাবছিল, কিন্তু নিজেকে আটকে রেখেছে। প্রত্যেক বার এরকম হয়, প্রতিবেশীরা চিনেও চেনে না।
আমি আইস ব্রেক করার মতো করে দিপু কাকিমাকে বললাম, "ভালো আছো?"
দাঁত বিহীন মাড়ি বার করে বলল, "ওই চলে যাচ্ছে।"
চলে যে যাচ্ছেনা সেটা ভালোই বুঝতে পারলাম। দিপু কাকা চলে গেছে অনেক কাল আগে। এখন বুড়ি একাই থাকে। শুনেছিলাম পেনসানই ভরসা।
মাথায় গোনাগুন্তি কয়েকটা চুলে জট পড়েছে দিপু কাকিমার। বয়েসের থেকে বেশি বুড়ো হয়ে গেছে।
কি মনে হল জিজ্ঞেস করলাম, "দিপু কাকার ছিপ টা আছে?"
বুড়ি হেসে বলল,"হ্যা আছে। নিবি নাকি?"
"এখন থাক, পরে নিয়ে যাবো।"
"কদিন আছিস?"
কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না। চাকরিটা চলে গেছে আমার। দিল্লীতে ভাড়া ঘরে থাকতাম। হাতে টান পড়ছে বলেই চলে এলাম। এখন অন্য একটা পেলে তবেই যাওয়া হবে।
হেসে বললাম, "এই কদিন আছি।"
"ভালো, আসিস সময় করে।"
আমি মাথা নাড়িয়ে বাড়ির দিকে গেলাম। দরজাটা খুলতেই চোখটা ট্যারা হয়ে গেল। বাড়ির ভগ্নদশা দেখে মনটা অস্থির হয়ে উঠল। মনে হলো সিনেমাতে দেখানো কোন ভূত বাংলোতে ঢুকছি। বাড়িতে দুটো নারকেল গাছ ছিল, এখন আর দেখছিনা। সম্ভবত আমফন নিজের মনে করে নিয়ে গেছে। মা চলে যাওয়ার পর সবাই নিজের মনে করে জিনিস নিয়ে যায়। আমিও আর থাকিনা তাই মগের মুল্লুকই হয়ে গেছে একেবারে। বাড়ির দেখাশুনা করার জন্য একতলা ভাড়া দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম একটু ঠিকঠাক রাখবে বাড়িটা।
আমাকে দেখে সেই একতলার ভাড়াটে শুভেন্দু এসে বলল,"দাদা কখন এলেন?"
"এই তো ঘরে ঢুকছি।"
"ও হ্যা, হ্যা। আপনি যদি একবার ফোন করে দিতেন তাহলে ওপরের ঘরগুলো পরিষ্কার করিয়ে রাখতাম।"
বাড়ির উঠোন টা দেখে আৎকে উঠলাম। মনে হলো বাজারে যাওয়ার আর দরকার হবেনা। সমস্ত ধরণের আগাছাতে ভরে আছে। খুঁজলে দু একটা সাপ নেউল ও পাওয়া যাবে। পরিষ্কার যে হয়না বোঝাই যাচ্ছে।
"বলছি , দুপুরে খাবেন তো ?"
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, "না খেয়ে এসেছি।"
দোতলায় উঠে ঘর খুলে দেখি মাকড়সা গুলো নিজের মতো করে মশারি বানিয়ে ঘুম লাগাচ্ছে। আমার আসাতে খুব একটা ব্যস্ততা দেখালো না। যেন ওরাই এই ঘরের মালিক। আমি অবাঞ্চিত কোন ব্যক্তি ওদের শান্তি ভঙ্গ করতে এসেছি।মা, বাবার ফটোগুলোও ধুলোর চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
ইতিমধ্যে শুভেন্দুর স্ত্রী একজন মহিলাকে নিয়ে এসে হাজির।
"দাদা, আপনি সরে যান। ও সব পরিষ্কার করে দেবে।"
আমি বাধা দিলাম না।
ঘন্টা দুয়েক এর মধ্যে সেই মহিলা ঘরগুলোকে একেবারে নতুন করে দিল।
তকতকে ঝকঝক করছে মেঝেগুলো। মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "মুখ দেখতে পাবেন এবারে। আয়নার দরকার হবেনা।"
আমি হেসে তিনশো টাকা বার করে দিলাম। গা কচ কচ করছিল, বড় অভাব চলছে। আর আয়নার দরকার আমার আর নেই। নিজের প্রতিবিম্ব অনেক আগেই মুছে গেছে ভেঙে যাওয়া পুরাতন বাড়ির রঙের মতো।
(২)
সন্ধেবেলাতে একলা বসে আছি ঘরের মধ্যে। টিউবের লাইটে একটা গল্পের বই হাতে নিয়ে ঘাটছিলাম। আমার বই পড়ার খুব সখ। মায়ের থেকেই বংশানুক্রমে এসেছে আমার মধ্যে। মা বেঁচে থাকতে প্রত্যেক মাসে দেশ, নবকল্লোল আসতো। আর আমার জন্য শুকতারা, আনন্দমেলা।
আরও একটা সখ ছিল মাছ ধরার। বাড়ির পিছনে খানিকটা দূরে একটা পুকুর আছে, মেন রাস্তা দিয়ে আসতে থাকলে সেই পুকুর দেখা যায় না। অনেকটা ভেতরে, লোক সমাজের আড়ালে সাপের মত গুটিয়ে থাকে।
ছোটবেলায় দিপু কাকার সাথে অনেক মাছ ধরেছি। আমাকে নিজের হাতে করে মাছ ধরা শিখিয়েছিল। দশ বছরের জন্মদিনে দিপুকাকা একটা মস্ত ছিপ উপহারও দিয়েছিল। বলতো ,"মাছ ধরাটা একটা আর্ট"।
ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ফাটনার উপর নজর রাখাটা সত্যি একটা আর্ট। অসীম ধৈর্য্যের মাপকাঠি।
জন্মদিনে পাওয়া আমার সেই ছিপটা দিয়ে ছোট ছোট বাটা মাছ, কই মাছ ধরেছি অনেক। গ্রীষ্ম ,বর্ষা কোন কিছুই আমাকে আটকে রাখতে পারতো না। এক ভয়ংকর নেশা ছিল। এইরকম নেশা পৃথিবীর কোন মাদক আমাকে আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি।
পরে দিপুকাকার সঙ্গ ছেড়ে একলাই চলে যেতাম পুকুর পাড়ে। একটা ছাতা মাথায় নিয়ে বসে থাকতাম সারাদিন। আমার ছিপ কখনো বিফলে যেত না, জলে ফেললেই কিছু না কিছু উঠতো। আর যা উঠতো তার একভাগ বাড়ি নিয়ে যেতাম।
মা দেখে জিজ্ঞেস করতো,"কি খাবি আজ?"
আমি মহানন্দে বলতাম, "টাটকা বাটামাছ ভাত দিয়ে মেখে খাবো"
ছুটির দিনগুলো এইভাবেই কেটে যেত। আমি রোজ মাছ ধরতাম আর রোজ নানা রকম মাছ দিয়ে ভাত খেতাম। বড় অদূরে দিনগুলো ছিল।
এরকমি এক অদূরে দিনে ছিপ ফেলেছিলাম জলে, সেবারও বিফলে যায়নি। ফেসেছিল ভারী কিছু একটা। আমি সজোরে টেনে তুলতেই দেখি সাদা ধবধবে ফুলে ওঠা একটা হাত। ভয়ে আমার প্রাণ যায় যায়। আমি যেন কোন ভৌতিক কাহিনীর অংশ হয়ে উঠেছিলাম।
চীৎকার করতে করতে ছুটে গেছিলাম বাড়িতে। আমার হাঁকডাক শুনে শুনে পাড়ার লোকজন এসে দেখলো দিপুকাকা আমার ছিপে উঠেছে। কেন ,কি কারণে সেই বিষয়বস্তু কোনোদিন জানা যায়নি।
সেই দিন থেকে আমার মাছ ধরা বন্ধ। আমার ছিপটা দিপু কাকার সাথেই চলে গেল। তিনি পুড়লেন চুল্লিতে আর আমার ছিপটা গেল বাড়ির উনুনে। তারপর থেকে ভয় লাগে, আবার যদি কিছু উঠে পরে আমার বড়শিতে। তাই আর ছিপ বানানোও হয়নি কোনোদিন।
কলেজ শেষ হতেই চলে যাই দিল্লীতে। একটা চাকরি পাওয়ার পর মাকেও নিয়ে গেলাম। বাবাও গেছিল হয়তো আমাদের সাথে। মা বলতো ,তোর বাবা সব সময় আমাদের সাথে আছে।
আছে হয়তো, আমি দেখতে পাইনা। অনেক ছোটবেলায় দেখে ছিলাম। ক্যানসার তাকে কাঁধে করে নিয়ে গেছে আর মাকে রেখে গেছে আমার কাছে। পরে মাকেও ছাড়লো না, খুব আদর করে নিয়ে গেল।
বাবার কথা আমার খুব একটা মনে নেই, বহুকাল আগেই তিনি দেওয়ালের ফটোতে আশ্রয় নিয়েছেন। ওই ফটোটাই বাবার একমাত্র স্মৃতি আমার কাছে। আর সবকিছুই হারিয়ে গেছে। এখন যেন মায়ের মুখটাও খানিকটা হারিয়ে যাওয়ার পথে।
বয়স আমারও হচ্ছে, শরীরের সাথে সাথে স্মৃতিগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। একসময় যে সবুজ অরণ্য ছিল তা যেন এখন এক বালুকাময় প্রান্তর হয়ে উঠেছে। আর আমি সেই বালুকারাসিতে কোদাল চালিয়ে জল খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্মৃতিগুলোকে আর একটু উর্বর করার জন্য।
(৩)
রাতে ঘুম ভালো এলো। তকতকে মেঝে আর পুরানো দেওয়ালের গন্ধে মনটা আবার শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে গেল। সেই আদ্র সকাল, সেই জুঁই ফুলের গন্ধ, সেই বাড়ি বাড়ি অনুভূতি। এই অনুভূতির জন্যই তো বাড়িতে আসা। পাখিরা যেমন প্রলয় থেকে বাঁচবার জন্য বড় বট গাছে আশ্রয় নেয়, আমিও তেমন আশ্রয় নিয়েছে আমার পরিচিত বট গাছের তলায়।
সকালের সেই আদ্র ভাব কাটিয়ে তাকিয়ে রইলাম দেওয়ালে ঝুলে থাকা পূর্ব পুরুষদের ফটোর দিকে। ঠাকুমা, ঠাকুরদা,বাবা, মা সবাই যেন দেখছে আমাকে। তাদের আলতা মাখানো পায়ের ছাপ লক্ষী পুজোর আলপনার মতো ফুটে উঠেছে মাটিতে। মনে হলো কখনও হয়তো আমারও স্থান হবে এই দেওয়ালে, আর আমার পায়ের ছাপও ঘুরে বেড়াবে এই ভঙ্গুর বাড়িতে।
নিচের ঘর থেকে রান্নার গন্ধ পেলাম। ব্রেকফাস্ট হচ্ছে। এরকমই তো দিন কাটতো ছোটবেলাতে। সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে পড়ার বইগুলোর ফাঁকে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি লুকিয়ে নিতাম। আর একাগ্র চিত্তে গ্যাংটক, রাজস্থান ঘুরে বেড়াতাম।
বড় হয়ে কাজের সূত্রে অনেক ঘুরেছি ঐসব দেশ, গল্পে বর্ণিত জায়গাগুলোতে গিয়ে নিজেকে যে কতবার ফেলুদা ভেবেছিলাম তার ঠিকানা নেই। যখন মা ছিল তখন ফোন করে বলতাম, "তোমার ছেলে এখন মিস্টেরি সলভ করবে এখানে।"
খুব হাসতো মা , বাবাও হয়তো হেসেছিল আড়াল থেকে।
এত সব জিনিস কেন যে এখন মনে পড়ছে সেটা বুঝতে পারছিনা। আর সেই পরিচিত প্রাচীন স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ । হয়তো আজ বছর পাঁচেক পর বাড়িতে এসেছি বলে পুরানো দেওয়ালগুলো ফেলে আসা দিনগুলোর মতো তাজা হয়ে যাচ্ছে। তাই বেশি করে গন্ধ মাখিয়ে দিচ্ছে আমার নাকে।
হঠাৎ শুভেন্দু এসে জানালো নীচে কে একজন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
আমি ভাবলাম হয়তো দিপুকাকা এসেছে, মাছ ধরতে নিয়ে যাবে বলে ডাকছে। দৌড়ে নীচে গিয়ে দেখি মাস্ক পরিহিত এক ভদ্রলোক। দিপুকাকার মতোই দেখতে তাকে।
"দাদা আপনার সাথে কথা ছিল।"
"কি ব্যাপারে?"
"আপনার এই বাড়িটা আমাকে দেবেন? ফ্ল্যাট বানাবো। অনেক ঘর হবে, আপনাকেও তিনটে দেব। ভাড়া দিয়েই আপনার জীবন চলে যাবে। এত বড় বাড়ি মেন্টেন করা তো সমস্যা। আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবেনা, সব আমরাই করে দেব।"
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বলার মতো কোন ভাষা এলো না।
"এককালীন অনেক টাকাও পাবেন। ভেবে দেখুন।"
টাকা কথাটা শুনেই আমার চোখ দুটোতে চমক এলো। আজ ছয় মাস রোজগার নেই। সঞ্চিত যা ছিল তা দিয়েই চলছে। এরকম সময়ে কেউ টাকা দিতে চাইলে না করাটা বড্ড কঠিন।
সে আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরেছিল। পাকা ব্যবসাদারদের এই বিশেষ ক্ষমতা থাকে। ইনারও আছে।
"ভেবে দেখুন দাদা", বলে আমার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিল।
আমি কার্ডটার দিকে না তাকিয়েই বললাম, "মাছ ধরতে পারেন ?"
"আজ্ঞে?"
"ছিপ!, ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পারেন?"
লোকটা একটু হেসে বলল, "কি যে বলেন দাদা।"
আমি কার্ডটা ঘুরিয়ে দেখলাম লেখা বিমল রায়। রায় রিয়াল এস্টেট ডেভেলপার।
মৃদু হেসে বললাম ,"ঠিক আছে জানাবো।"
লোকটা চলে যাওয়ার পর আমার সেই প্রাচীন নেশাটা কেমন চেগে উঠলো। আমি দিপু কাকাদের বাড়িতে গিয়ে কাকিমাকে ডেকে বললাম ছিপটা দিতে।
কাকিমার আমাকে দেখে বলল, "ভিতরে আয়।"
"না, করোনা চলছে। বাইরে থেকে এসেছি তো তাই আর ঢুকবো না। তুমি ছিপটা দাও।"
কাকিমার থেকে ছিপ নিয়ে চলে গেলাম আমাদের সেই গোপন পুকুরের দিকে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম আজ সারাদিন কাটাবো সেখানে।
কিন্তু পুকুরের কাছে যেতেই চমকটা লাগলো। পুকুর আর নেই সেখানে, বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হয়েছে তার যায়গায়। হারিয়ে গেছে আমার সেই ছোটবেলার পুকুর। এক লহমায় আমার ইচ্ছেগুলো যেন সেই হারানো পুকুরে দিপু কাকার মতো ডুবে গেল।
কিন্তু আমিও উৎসাহ হারালাম না। সেই ফ্ল্যাটবাড়ির দেওয়ালে বড়শি ফেলে চুপ করে বসে রইলাম। সারাদিন ধরে তাকিয়ে রইলাম। আমার বড়শি কখনও বিফলে যায়না।
বেলা শেষে এক টান মারলাম। যা উঠে এলো তা দেখে মুখে হাসি ফুটল। আজও বিফলে যায়নি। তাকিয়ে দেখলাম ফ্ল্যাট বাড়ির দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা আছে "রায় অপার্টমেন্টস"।
রায় বাবু তাহলে মাছ ধরতে জানেন। একদিন যেমন দিপুকাকা আমার বড়শিতে আটকেছিল, তেমনি আমিও আজ রায় বাবুর বড়শিতে আটকে গেছি।
বাড়িতে ঢোকা মাত্রই মনে হল মা এসে দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করছে ,"কি খাবি আজ?"
আমি বললাম, "টাটকা স্মৃতিগুলো আবেগ দিয়ে মেখে খাবো।"
মা আমার কথা শুনে হেসে উঠলো।
জানিনা কেন মনে হল বাবা মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। তিনি হয়তো সত্যি আছেন আমাদের সাথে।