এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • কাঠাম

    Rumela Saha লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৪৫০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • অমর্ত্য কালো অন্ধকার চারদিকে, আলো নেই কোথাও। আসমানেও কোন তারা ফোটেনি।বিশ্ব চরাচর জুড়ে এক নিবিড় তমসাচ্ছন্নতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সবকিছু। আঞ্জুমান বুঝতে পারে না, সে চোখ বন্ধ করে আছে, না তাকিয়ে আছে। কোন তারা বা কোন নক্ষত্র নেই আকাশে যে তাকে নিজের অস্তিত্ব দিয়ে আশ্বস্ত করবে। পথ দেখাবে। দাদাজান বলতো, "যখন খুব একা লাগবে, তখন কালো আসমানের দিকে তাকাবি। দেখবি অন্ধকারের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট আলোরা টুকরো টুকরো অনেক শরীরে ভাগ হয়ে মিটমিট করে রাতের শোভা বাড়াচ্ছে। তখন তোর আর একা লাগবে না"।


    নিজেকে খোঁজে আঞ্জুমান। টুকরো টুকরো হয়ে বিখরে যাওয়া নিজেকে খোঁজে সে। ওই... ওই আবার শুরু হল। হায় আল্লাহ, এই দোজখ যন্ত্রণার কি কোন শেষ নেই। কত পাপ, কার পাপ ? সামনেই শাদি। কত স্বপ্ন কত আশা এক-একটা অমানুষিক মোচড়ে পেটের নাড়িভুঁড়ির সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। চেতন আর অবচেতনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে সে। 


     দাদাজান খুব ভালো রান্না করতে পারে। আর দাদাজানের হাতের কলিজা ভুনা যারা খেয়েছে তারা জানে কি অপূর্ব স্বাদ। সে আবদার করেছিল কলিজা ভুনা খাবে। একমাত্র নাতনীর আবদার মেটাতে পাঠার কলিজা এনেছিলেন তিনি। সংসারে এই দুটি মানুষের আপন বলতে আর কেউ নেই। সন্ধ্যায় কতগুলো লোক জোর করে বাড়িতে ঢুকলো। কেউ চেনা, কেউ অচেনা। ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে লোকগুলো চিৎকার করে বললো, এগুলো গরুর মাংস। রান্নাঘরের দরজার আড়ালে ভয়ে তখন কাঁপছিল আঞ্জুমান। তার বৃদ্ধ দাদাজান অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু দাদাজানের কথা কেউ শুনল না। আঞ্জুমান শুনেছিল দাদাজানের শেষ চিৎকার, "পালিয়ে যা বেটি, পালিয়ে যা"।


    পেছনের দরজা দিয়ে ছুটল সে। খালি পায়ে, যেদিকে দু'চোখ যায়। কিছুটা যাওয়ার পর কতগুলো লোক তাকে ধরে ফেলল। তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে টানতে টানতে নিয়ে গেল কোথাও। আর তারপর...


    ‌ উষ্ণ গরম জলের ছিটে লাগলো মুখে। দুর্গন্ধময় লবণাক্ত জল। পেচ্ছাপ করছে কেউ ওর মুখে। ভেজা নরম মাটি আর ভেজা বাতাসে মাছের গন্ধ। নদীর ধারে আছে সে। পালাতে হবে, যে করেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে। হাতের বাঁধনটা আলগা ছিল। সেটা কোন মতে খুলে আস্তে আস্তে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো অঞ্জুমান। কিন্তু কোমরের নিচে কোন সাড় নেই। 


    নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল সে। সরীসৃপের মত। খপ করে পা'টা টেনে ধরলো কেউ। -"শালী এখনো খুব তেজ তোর"।


    দেখতে পাচ্ছে আঞ্জুমান অন্ধকারটা ফিকে হয়ে আসছে। লোকটা চুলের মুঠি ধরে শোয়া থেকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল তাকে। অনেকেই শুয়ে আছে এদিক ওদিক। হয়তো মদ খেয়ে বেহুশ তারা। বাঁচতে হবে এই সুযোগ। তার শতছিন্ন শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ার মুহূর্তে লোকটার গলায় কামড় দিলো আঞ্জুমান। মরণ কামড়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। লোকটা অনেক চেষ্টা করল নিজেকে ছাড়াতে কিন্তু পারলো না। কামড় একটুও আলগা হলো না, ধস্তাধস্তির পর নেতিয়ে পরলো লোকটা। আঞ্জুমানের মুখে রক্তের স্রোত। তার শরীরে আর শক্তি নেই। কামড় আলগা করতেই লোকটা কাটা কলাগাছের মত পরে গেল। আঞ্জুমান একবার লাথি মেরে দেখল, লোকটা নড়লো না। কাদার উপর দিয়ে এগিয়ে চলল আঞ্জুমান। ওরা যে কোন সময় ধরে ফেলতে পারে।


    নদীর তীরে অনেক বিসর্জিত প্রতিমা পড়ে রয়েছে। সামনে ছোট্ট মন্দির। আঞ্জুমান ওখানে আশ্রয় নিল। মন্দিরে কোন প্রতিমা নেই। বেদির ওপর শুধু একটা কাঠাম দাঁড় করানো। বাঁশের কঞ্চির হালকা পলকা কাঠাম। পাশে তেল ফুরিয়ে যাওয়া প্রদীপটার বুক জ্বলছে। লুকোনোর কোন জায়গা নেই এখানে। দরজার ওপরে একটা লোহার খড়্গ টাঙ্গানো ছিল। সেটাই হাতে নিল আত্মরক্ষার জন্য।


    পুরোহিত মশাই অভ্যাস মতো ভোরে মন্দিরে এলেন। সঙ্গে তিন বছরের নাতনী। নাতনীর হাতে একটা সাদা জবা। দাদু বললেন, "এখনতো ঠাকুর নেই, তুমি কাকে ফুল দেবে মা" ? নাতনী হেসে দৌড়ে মন্দির ঢুকে গেল। মন্দিরের দরজা খোলা দেখে অবাক হলেন পুরোহিত মশাই, এত সকালে তো কেউ আসে না। 


    বাইরে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। আঞ্জুমান ভাবলো ওরা এসেছে। সে কাঠাম এর সামনে দাঁড়িয়ে খড়্গশুদ্ধ হাতটা ওপরে তুললো। নাতনী দৌড়ে এসে থমকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।


    সে ভিতর থেকে বলল , "দাদু এখানে একটা কালী ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছে"।


     দাদু ভাবলেন দুর্গামন্দিরে কালী। হেসে বললেন, "কালী, দুর্গা সবাই সমান, কোন তফাৎ নেই"। 


    কাদায় আঞ্জুমানের সারা শরীর কালো হয়ে আছে। বুকে কামড়ের ক্ষতগুলো রক্ত জবার মতো রক্তরঞ্জিত হয়ে ফুটে আছে। কোমর ছোপানো চুল, রক্ত আর কাদায় মাখামাখি হয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। মুখময় কাঁচা রক্ত। হঠাৎই তার খেয়াল হল সে বিবস্ত্রা। আদিম অনুভূতি ফিরে এলো এক লহমায়। ‌সে লজ্জায় শিঁউরে উঠে জিভ কাটলো।


    নাতনী এতক্ষণ পর চেনা প্রতিমা দেখে ফুলটা তার পায়ের কাছে রেখে এক গাল হেসে বলল, "কোন তফাৎ নাই"।


    গল্পটি বাক সাহিত্য পত্র -এ পূর্বে প্রকাশিত


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৪৫০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রুটি - Rumela Saha
    আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Madhumita | 2409:4065:d04:5411::690a:6c10 | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:২৪97828
  • দারুন , এগিয়ে যা .. র ও সুন্দর লেখা chai. চাই 

  • | ০১ অক্টোবর ২০২০ ১৫:৫৯97903
  • besh

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন