এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • সুরক্ষাচক্র, এবং / অথবা মুঠোয় পেষার গল্প

    দময়ন্তী
    আলোচনা | বিবিধ | ২৬ অক্টোবর ২০০৮ | ৬৫৯ বার পঠিত
  • বছর তিনেক আগে আমার বন্ধু গোপাল, গুরগাঁও থেকে বাড়ী বদলে দিল্লী চলে গেল -- কারণ গুরগাঁওতে ওর বাড়ীটি অতিরিক্ত সুরক্ষিত হওয়ায় ওর নাকি খুব অসুবিধে হত। গুরগাঁওতে অফিসের কাছে একটা বাড়ীতে থাকত। থাকত মানে, ওর নামে ভাড়া নেওয়া ছিল, কখনও সখনও খুব রাত হলে সেখানে গিয়ে ঘুমোত। সেখান থেকে দেড়ঘন্টা যাতায়াতের দূরত্বে দিল্লী গেল এক বছর পূর্ণ না হতেই। আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম। "সুরক্ষা' কারো অপছন্দ হতে পারে কিভাবে, তা ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে ওকেই জিজ্ঞাসা করায় ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে। সে কথায় পরে আসছি।

    আজকাল যত বড় বড় হোর্ডিং দেখি রাস্তার ধারে, তার বেশীরভাগটাই থাকে কোন না কোন হাউসিং কমপ্লেক্সের বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন সুযোগসুবিধার সাথে সাথে তাতে অতি অবশ্যই থাকবে সুরক্ষা সংক্রান্ত আশ্বাস। কেউ দেন ২৪ ঘন্টা সুরক্ষাকর্মী মোতায়েন রাখার আশ্বাস, তো কেউবা ক্লোজড সার্কিট টিভি দিয়ে নজরদারীর দাবী করেন। আমরা তাই দেখে আশ্বস্ত হই, পরিচিত ও বন্ধুমহলে আলোচনা করি কোন কমপ্লেক্স কত "নিরাপদ'। বাড়ীভাড়া নেবার সময়ে তো নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ খুঁটিয়েই দেখি। যাঁরা কেনেন তাঁরাও গর্বভরে জানান কত সুরক্ষিত তাঁদের কমপ্লেক্স, হাল্কা করে প্রতিযোগীতাও চলে সুরক্ষার বিভিন্ন স্তর নিয়ে।

    অফিস কিম্বা সিনেমাহল মায় বাজারহাটও আজকাল সুরক্ষাচক্রে ঘেরা। শপিংমলে ঢুকতে যান, কিম্বা সিনেমাহলে, আপনার ব্যাগ সার্চ হবে, আপনার শরীর শুঁকবে মেটাল ডিটেক্টার এবং তারপর উপস্থিত সুরক্ষাকর্মী আপনাকে থাবড়েথুবড়ে দেখবেন। অফিস হলে আরেকটৃ¤ হ্যাপা পোয়াতে হবে। আপনার সঙ্গে যত ইলেকট্রনিক জিনিষপত্র আছে, তা সে আইপড হোক কি কোম্পানি প্রদত্ত ল্যাপটপ, মায় আপনার নিরীহ সেলফোনটার পর্যন্ত বিশদ বিবরণ জানাতে হবে, এমনকি খাতায় লিখতেও হতে পারে। আপনি যদি গাড়ী নিয়ে ঢোকেন, তাহলে আপনার গাড়ীর তলায় আয়না ধরে, ডিকি খুলে দেখবে (অবশ্য সীটে বসিয়ে ব্যাগভর্তি আরডিএক্স নিয়ে গেলেও কেউ কিছু বলবে না)। তা, এইসবকিছুতেই আমরা বেশ কিছুদিন ধরে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

    সত্যি বলতে কি আমাদেরই নিরাপত্তার জন্য এতসব ব্যবস্থা ভেবে বেশ একটু ভালও লাগে। সুরক্ষা ছাড়াও এইসব কমপ্লেক্সগুলিতে আরও অনেক সুবিধে থাকে। সকালে হাঁটাহাঁটি বা ব্যয়াম করবার জায়গা, কোথায়ও কোথায়ও আলাদা জিমনাশিয়াম, সুইমিং পুল, ক্লাবহাউস, উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য কমিউনিটিহল, মার্কেট কমপ্লেক্স, আর আরও একটু বেশী দামী হলে গলফক্লাবও পেয়ে যাবেন চত্বরের মধ্যেই। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেও পারেন কোন কোন চত্বরের মধ্যে। এমনকি পেতে পারেন নিজস্ব একটি ছোট্ট পাহাড়, কিম্বা ব্যক্তিগত জলাশয়। এইসব কমপ্লেক্সে সাধারণত বিদ্যুৎ ঘাটতি হয় না, হলেও বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা থাকে। ২৪ ঘন্টা জলের ব্যবস্থাও থাকে। তা, সব মিলিয়ে বেশ একটা বিদেশ বিদেশ ব্যপার না? কেমন সুন্দর সব সুযোগসুবিধা হাতের মুঠোয়, দরজার গোড়ায়?

    এই "বিদেশ বিদেশ' ব্যপারটাই আসলে এই চত্বরগুলির মূল আকর্ষণ। ভারতবর্ষ নামক দেশটিতে যে সকল নাগরিক সুযোগসুবিধা এখনও তত সহজলভ্য নয়, যে সমস্ত ন্যুনতম সুবিধের জন্য ভারতীয় নাগরিককে অনেক ঝক্কি সহ্য করতে হয়, এখানে সেখানে বহু ধর্ণা দিয়ে, অনুরোধ উপরোধ করে, কখনও বা কিছু ঘুষ দিয়ে পেতে হয়, সেগুলি এইসব চত্বরে সুলভ। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক জল। যে কোন সভ্যদেশে পানীয় ও ব্যবহার্য্য, এই দুইপ্রকার জল সরবরাহের ব্যবস্থা থাকবে এটাই প্রত্যাশিত। ভারতবর্ষের অধিকাংশ জায়গায় জল তেমন দুÖপ্রাপ্যও ছিল না এই সেদিন পর্যন্ত। কিন্তু তবুও সর্বত্র জলের সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। একই কথা প্রযোজ্য বিদ্যুতের ক্ষেত্রে। আবার জনপদগুলি একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে এটাও প্রত্যাশিত। অথচ নাগরিকের সে আশাও পূরণ হয় না অনেকক্ষেত্রেই।

    সেদিক থেকে পাঁচিলঘেরা এই চত্বরগুলি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এখানে পানীয় জল পর্যাপ্ত, বিদ্যুতও তাই। এইসব চত্বরে সন্ধ্যা থেকে সর্বত্র যত আলো জ্বলে থাকে যার অনেকটাই তত প্রয়োজন নয়। কিন্তু তবু থাকে, কারণ বিদ্যুতের অভাব এখানে নেই। যে সব চত্বরে সৌরচুল্লী আছে, সেখানে গরম ও ঠান্ডা জলও ২৪ ঘন্টা পাওয়া যায়। এখানে আবর্জনা জমে থাকবার কোন সম্ভাবনা নেই, কারণ সাফাইকর্মী এসে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সমস্ত পরিস্কার করে দিয়ে যায়, বাসিন্দাদের বাড়ী থেকে জঞ্জাল সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। বাগানগুলিতে সযত্নলালিত ঘাস ও নানারকম ফুলগাছ, পাতাবাহার, প্রায় সারাদিনধরে মালিরা কাজ করে যায়। তাই শিশুরা এখানকার নির্দিষ্ট খেলার জায়গায় অবাধে খেলে, বয়স্ক লোকজন ধীরে ধীরে পায়চারী করেন, অপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা দৌড়ায় কিম্বা দ্রুত হাঁটে। মহিলারা, বিশেষত: একক মহিলারা, এইসব চত্বরে অনেক বেশী নিরাপদ বোধ করেন। অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্যও এই কমপ্লেক্সগুলি তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। মধ্য ও উচ্চবিত্তের পছন্দের তালিকায় তাই এই চত্বরের বাড়ীগুলি একনম্বরেই থাকে।

    রাষ্ট্রের তরফ থেকে এই কমপ্লেক্সগুলিকে বেশ সুনজরেই দেখা হয়, কারণ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের যেসকল চাহিদা মেটাতে পারে না, তার অনেকটাই এরা মিটিয়ে দেয়, রাষ্ট্রের উপর দায় কম হয়। এই কমিউনিটিগুলির নিজস্ব সুরক্ষাব্যবস্থার কারণে নাগরিকদের প্রতি সুরক্ষাবাবদ রাষ্ট্রের দায় ও ব্যয় দুইই কমে। গুরগাঁওতে এরকম অনেক কমপ্লেক্স আছে যেখানে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুতের যোগান দেয় মস্ত মস্ত জেনারেটার, ২৪ ঘন্টা জলের ব্যবস্থা হয় ডিপ টিউবওয়েলের সাহায্যে মাটির নীচ থেকে জল তুলে। রাত্রিবেলা সুরক্ষাকর্মীদের হাতে থাকে সদাপ্রস্তুত আগ্নেয়াস্ত্র। প্রায় সমান্তরাল রাষ্ট্রব্যবস্থাই বলা যায়। গুরগাঁও, নয়ডা, দিল্লী অঞ্চলের প্রচন্ড বিদ্যুৎ ও জলের সমস্যা এই বাসিন্দাদের স্পর্শও করে না। এঁদের অনেকেই ছিলেন বিভিন্ন ডিডিএ কলোনীতে। তাঁদের কয়েকজনের মুখে শোনা দিল্লী অঞ্চলে জলের সমস্যা নাকি ৩৫ - ৪০ বছর আগেও ছিল, খুব ভোরে উঠে বড় জলাধারে জল ভরে রাখতে হত। কিন্তু এখন আর তাঁদের তা করতে হয় না। আর সুরক্ষা? নয়ডার এরকমই এক কমপ্লেক্স হল ATS Green's Village ,যেখানে ৬৫০ পরিবারের জন্য আছেন ৮৫ জন সুরক্ষাকর্মী ও ৯৬ টি ক্যামেরা। এখানে বাসিন্দাদের কাছে আসা প্রতিটি লোককে নিজের পরিচয় দিয়ে ঢুকতে হয়, নথিবদ্ধ রাখতে হয় নিজের নাম, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার। নয়ডার মত জায়গায় সুরক্ষার মূল্য অনেক। বাসিন্দারা নিরাপদ বোধ করেন এখানে। রাষ্ট্র তাঁদের যা যা দিতে পারেনি, সেগুলি এখানে তাঁরা পাচ্ছেন।

    এবারে আবার ফিরি গোপালের কথায়। গোপালও থাকত এমনই এক চত্বরের একটি সুরক্ষিত বাড়ীতে। ওর সাথে দেখা করতে গেলে সুরক্ষাকর্মী পরিচয় জেনে ও নথিবদ্ধ করে ওকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে তবেই ভেতরে যেতে দিতেন। কিন্তু গোপালের তা পোষাল না। ওর বাড়ীতে কাজ করত একটি মেয়ে। এই মেয়েটি একদিন তার আড়াই বছরের ছেলেকে সাথে নিয়ে কাজ করতে এসেছিল। ছেলেটির সেদিন গায়ে জ্বর, বাড়ীতে দেখার কেউ নেই, তাই তাকে সঙ্গে করে ও কাজে আসে। কিন্তু সুরক্ষাকর্মী ছেলেটিকে ঢুকতে দেয় না। মেয়েটি বাধ্য হয় তার ছেলেকে কোন প্রতিবেশীর বাড়ীতে রেখে আসতে। অসুস্থ ছেলের জন্য তার উদ্বেগ উৎকন্ঠার কোন মূল্যই দেয় না ঐ সুরক্ষাকর্মী। গোপাল শুনে অত্যন্ত বিচলিত হয়, সুরক্ষাকর্মীর কাছে জানতে চায় ওকে ফোন করে নি কেন? যেমন করে থাকে অন্যান্য অতিথিদের ক্ষেত্রে? কর্মী সংক্ষেপে জানায় ফোন করার প্রশ্নই নেই, এটা "সুরক্ষা'র প্রশ্ন। গোপাল আরও বিচলিত হয়, যখন অন্যান্য বাসিন্দা, যাদের
    বাড়ীতে এই মেয়েটি কাজ করত, এই কথা শুনেও উদাসীন থাকে, এবং এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা, এরকমই হওয়া উচিৎ বলে গোপালকে জানায়। গোপাল আমায় জিজ্ঞাসা করে "Don't you think we've become numb and only feel comfortable when we meet the same set of people every day! same creatures, who live in those ghetto!'

    এর বেশ কিছুদিন বাদে আমি পুণে চলে আসি আর এরকমই এক সুরক্ষিত টাউনশিপের একটি কমপ্লেক্সের এক বাড়ীতে বসবাস শুরু করি। এতদিন আলাদা বাড়ীতে থাকায় অনেক ব্যপার তেমনভাবে চোখে পড়েনি , যা এখন চোখে পড়ে। লক্ষ করি সমগ্র টাউনশীপটি অসম্ভব সুন্দর সবুজ। ফুটপাথের মাঝে মাঝে বাগান করা, ধারে ধারে অজস্র বড় গাছ রাস্তাগুলিকে ছায়ায় ঢেকে রাখে। ভোর ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মালীরা কাজ করে যায়, ডাল ছাঁটে, আগাছা তোলে, গাছে জল দেয়, রাস্তা থেকে শুকনো পাতা কুড়ায়। কিন্তু রাত দশটার পর তারা সবাই দলবেঁধে টাউনশীপের বাইরে চলে যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সকাল ৭টার আগে তাদের ভেতরে প্রবেশাধিকার নেই। দলেদলে কাজের মেয়েরাও ৭টার আগে ঢুকতে পারে না। এই টাউনশীপের ভিতরে অজস্র অফিস, একটি মার্কেট কমপ্লেক্স ও ১২ টি হাউসিং কমপ্লেক্স আছে। এছাড়াও একটিউ শপিং মল ও একটি মাল্টিপ্লেক্স নির্মীয়মাণ অবস্থায়। ১২টি হাউসিং কমপ্লেক্সের প্রতিটিতে ২৬টি করে ১০ তলা বাড়ী আছে। প্রতিতলায় ৪টি করে ফ্ল্যাট। তা, এই বিশালসংখ্যক লোকের বিভিন্ন পরিষেবা যোগাতে বহুসংখ্যক লোকের প্রয়োজন হয়। এই পরিষেবা সরবরাহকারীদের মধ্যে একমাত্র রাতের ডিউটিতে থাকা সুরক্ষাকমীগণ Ñ এবং অল্প কিছু মেরামতি কর্মী টাউনশীপের ভিতরে রাত্রিবাস করে। সমস্ত পরিষেবাকর্মীর নিজস্ব পরিচয়পত্র আছে, তা তাকে কাজের জায়গায় কর্তৃপক্ষের কাউকে দিয়ে সই করিয়ে আনতে হয়। বছরে একবার করে পুনর্নবীকরণ করাতে হয়। গৃহসহায়তাকারীদের, তারা যতগুলি বাড়ীতে কাজ করে, প্রত্যেক বাড়ীর মালিক কিম্বা মালকিনের স্বাক্ষর নিয়ে আসতে হয়। তাদের পরিচয়পত্রে প্রতিটি বাড়ীর মালিকের নাম, ঠিকানা উল্লেখ থাকে। হাউসিং কমপ্লেক্সে ঢোকার সময় সুরক্ষাকর্মীর কাছে পরিচয়পত্র জমা রেখে ঢুকতে হয়, বেরিয়ে যাবার সময় ফেরত পায়।

    কিছুদিন লক্ষ করে বুঝতে পারি এই বিশালসংখ্যক পরিষেবাকর্মী আসলে বাসিন্দাদের কাছে অদৃশ্য। আমরা শুধু পরিষেবাটুকু নিই, কিন্তু পরিষেবাপ্রদানকারী হাত বা মুখগুলোকে দেখতে পাই না। কলে গরমজল না এলে একটা নাম্বারে ফোন করি, কিছুক্ষণ বাদে ঠিক হয়ে যায়। লিফট না চললে আর একটা নাম্বারে ফোন করি, ঠিক হয়ে যায়। ফলে, আমরা শুধু নিজেদের মুখই দেখি, সেই একই মুখ, যা হাঁটাপথে অফিস যাওয়ার সময়, কিম্বা অফিস পৌঁছে দেখেছি, সেই একই মুখ, যা জিমে কিম্বা সুইমিং পুলে দেখেছি, সেই একই মুখ যা পেস্ট্রীশপে দেখলাম, সেই একই মুখ যা আবার দেওয়ালী মেলায় গয়নার দোকানে দেখি, সেই একই মুখ যা নাকি ভারতের অ্যাস্পায়ারিং মিডলক্লাসের মুখ, শাইনিং ইন্ডিয়ার মুখ। আমাদের চারপাশে কোন গরীব নেই। খুব গরীব তো দুরস্থান, কোন অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের লোকও নেই। আমাদের চারপাশে ঠিক আমাদেরই মত লোকজন। আচ্ছা ইংরাজরা আমাদের শাসন করার সময় ঠিক এরকম ঘেটো বানিয়েই থাকত না? অনুমতি ছাড়া "নেটিভ'দের প্রবেশাধিকার ছিল না সেইসব গৃহে। একইভাবে আমাদেরই কোন না কোন পূর্বপুরুষ এমনভাবেই হয়ত অনুমতিপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে সাহেবের প্রয়োজনীয় পরিষেবাটুকু দিয়ে আসতেন। সাহেবদের চোখে তাঁরাও ছিলেন এরকমই অদৃশ্য, Non-existent .

    লক্ষ করি গৃহসহায়তাকারিণীদের প্রতি সুরক্ষাকর্মীদের বিশেষ মনোযোগ, বেশ কয়েকবার লক্ষ করি এদের অযথা হয়রাণী করার চেষ্টা। লক্ষ করি অটোরিকশাওয়ালাদের হয়রাণী করার জন্য সুরক্ষাকর্মীদের বিশেষ চেষ্টা। একটু অবাক লাগে। এমনিতে এই সুরক্ষাকর্মীরা অত্যন্ত ভদ্র। কিন্তু এই বিশেষভাবে হয়রাণী করার চেষ্টা কেন! আরও ভাল করে লক্ষ করে বুঝতে পারি এই সুরক্ষাকর্মীরা যদি কাউকে নিম্ন আয়ের লোক বলে বুঝতে পারে, তাদের প্রতি অকারণেই হিংস্র হয়ে উঠতে চায়। এরকমই একজনকে একদিন দেখি এক গৃহসহায়তাকারিণীকে কেবলই ধমকে ধমকে তার কাছে যেতে বলছে, মেয়েটিও কিছুতেই যাবে না। তার বক্তব্য পরিস্কার। সে পরিচয়পত্র জমা দিয়েছে, কাজ সেরে ফেরার পথে নিয়ে যাবে। পরিচয়পত্রে যখন কোন গোলমাল নেই, তখন তাকে আটকানোরও কোনও অধিকার অধিকার ঐ কর্মীর নেই। ন্যায্য কথা। উপযাচক হয়েই এগিয়ে গিয়ে সুরক্ষাকর্মীকে ব্যপার জিজ্ঞাসা করি। কর্মীটি থতমত খায়, কোনও সঙ্গত উত্তর দিতে পারে না। মেয়েটি এবারে জোর পেয়ে প্রচন্ড চীৎকার করে জানায়, সে গিয়ে এই কর্মীর নামে সুপারভাইজারকে অভিযোগ জানাবে। কর্মীটি চুপ করে যায়। অবাক হয়ে দেখি কর্মীটির চোখদুটি অদ্ভুত নিস্প্রাণ, যেন মরা মাছের চোখ। এরপরে খেয়াল করে দেখেছি, অধিকাংশ সুরক্ষাকর্মী, বিশেষ করে যারা কোন গৃহের দায়িত্বে থাকে, সারাদিন নিস্প্রাণভাবে তাকিয়ে থাকে। একমাত্র কোন নিম্ন আয়ের লোক, আধময়লা জামাকাপড় পরা লোক দেখলে মুঠোয় পিষতে পারার আনন্দেই হয়ত বা, এদের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে।

    খেয়াল করলে দেখা যায় এই একটুকরো "সবপেয়েছির দেশ'গুলো আসলে কি চমৎকারভাবে মার্কার দিয়ে মানুষের চারপাশে গন্ডী কেটে তাকে একটা খাঁচায় বন্দী করে ফেলছে। গুরগাঁও বা নয়ডার বিস্তীর্ণ অঞ্চল যখন ১২-১৪ ঘন্টা অন্ধকারে ডুবে থাকে, তখন রিজউড কিম্বা এটিএস গ্রীনস আলোয় ঝলমল করে একটুকরো রূপকথার দেশ হয়ে জেগে থাকে। এইসব চত্বরে জলের যোগান দিতে যখন বড় বড় জলের ট্যাঙ্কার ঢোকে, তখন একটু দুরের পাইপওয়াটারবিহীন ঝুগগিঝোপড়ির সামনের কাঁচা রাস্তটা আরেকটু বসে যায় ট্যাঙ্কারের চাপে। ঝুপড়ির পাশের একতলাবাড়ীর ভদ্রলোক বিড়বিড় করে আরো কটা গালি দেন --- আবার বৃষ্টি হলেই রাস্তাটা নরক হয়ে যাবে --- এদিকে ১০০ মিটারের মধ্যে কোন জলের পাইপ নেই, জলস্তর এত নেমেছে যে কুয়ো খুঁড়তে গেলে অন্ততপক্ষে ২৪০ফীট অবধি খুঁড়তে হবে। অথচ ঐ বাড়ীগুলিতে ২৪ ঘন্টা জলের যোগান দিতে এখানকার রাস্তা ভেঙে দিয়ে ট্যাঙ্কার ঢোকে। কমপ্লেক্সগুলি পরিচ্ছন্ন রাখতে জঞ্জালের পাহাড় জমা হয় অদূরবর্ত্তী জনবসতি কিম্বা নদী/জলাশয়ের পাশেই। সাধারণত: বড় শহরের উপকন্ঠে, অথবা মফস্বল শহরগুলিতে যে বিভিন্ন আয় ও বিভিন্ন পেশার লোককে পাশাপাশি বাস করতে দেখা যায়, এই কমপ্লেক্সগুলিতে তা হয় না। বরং এক অদৃশ্য ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ফেলে দেওয়া হয় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে। শিশুগুলি বড় হয়ে ওঠে একইরকম কিছু মানুষের সংস্পর্শে, স্কুলে যাদের সাথে খেলে, বাড়ী এসেও দেখে তাদেরই, অথবা তাদেরই ক্লোন। এই শিশুগুলি বড় হয়ে কোনওদিন কি সহমর্মী হতে পারবে কর্পোরেশানের স্কুলে পড়া কোন শিশুর? এরা কি চিনবে, অনুভব করতে পারবে অন্য ভারতের মুখগুলি?

    দিল্লীর কোন বাজারে, জনবহুল এলাকায় কিম্বা হায়দ্রাবাদের খাবারের দোকানে যখন বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মানুষ, আমাদের মত মানুষ, তখন আমরা ফুঁসে উঠি। নিজের কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও খুঁটিয়ে দেখি। দাবী জানাই দুষ্কৃতকারীর উপযুক্ত শাস্তির। দাবীটি ন্যায্যও বটে, তাই প্রচুর সমর্থন জুটতে দেরী হয় না। অত:পর গেটের প্রহরা আরও কড়া হয়। আগন্তুক খাতায় নাম লিখলেই প্রকাশ পায় তার ধর্মীয় পরিচয় ------ এবং মুঠোগুলি শক্ত হবে কিনা তাও নির্ধারিত হয়ে যায় মুহূর্তেই। ঐ বিস্ফোরণস্থলগুলি -- শপিং মল, মন্দির, প্রার্থনাস্থল, কিম্বা খাবার দোকানে আমি যেতে পারতাম, থাকতে পারতেন আমার পাশের ফ্ল্যাটের জ্যোতি কিম্বা পাশের টাওয়ারের কিরণ। এঁদের আমি চিনি। প্রতিদিন দেখি। তাই একাত্মতা বোধ করতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু আমাদেরই পরিত্যাজ্য জঞ্জালে যাদের পরিবেশ দুষিত হচ্ছে, যে বস্তিটি পরিত্যাজ্য প্ল্যাস্টিকে প্রায় ঢাকা, যাদের জীবনে জল মানে ঐ মুথা নদীর কালচে সবুজ থকথকে তরল উপর থেকে সরিয়ে যে তরল পাওয়া যায় তাই ----- তাদের তো আমি চিনি না। দেখি না। জানি না, তাই অনুভব করতেও পারিনা তাদের প্রতিদিনের যুদ্ধ, তাদের মধ্যে ক্রমেই জমে ওঠা ক্ষোভ, ক্রোধ। যে শিক্ষিত যুবকটি আরেক শিক্ষিত যুবকের সাথে দেখা করতে এসে স্রেফ খাতায় লেখা তার নামের জন্য অজস্র প্রশ্ন ও হেনস্থার মুখোমুখী হয় তার মনে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ ও ক্রোধের আঁচ গেটের ঐ সেন্সারগুলোর ধরার ক্ষমতাই নেই। যে সুরক্ষাকমীদল দিনে দশ ঘন্টা দুইপায়ের ওপর ভর দিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু একটি বাসিন্দাও তাদের দিকে তাকিয়ে দেখে না, যেন তারা দেওয়ালের খুঁটি মাত্র, তারাও যখন কাউকে বাগে পায়, তা তার ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যই হোক, কি তার সর্বাঙ্গে নিম্ন আয়ের ছাপের জন্যই হোক, তৎক্ষণাৎ তারা যে নিতান্তই খুঁটি নয়, সুরক্ষার মহান দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত, তা দেখাতেই তার মুঠো আরও শক্ত হয়ে ওঠে। আমরা খবরও রাখিনা, চরম ঔদাসিন্যে নিজেদের চারপাশের শক্ত খোলসের মধ্যে ঢুকে বসে থাকি।

    আরও একটু ভাবলে মনে হয়, আমরা যতই "বিবিধের মাঝে মিলন'এর গান গাই না কেন, আসলে তো "বিবিধ' বা "অন্য' কোনকিছুকে আমরা তাচ্ছিল্যই করার চেষ্টা করি। প্রাচীনকালে আমাদের গ্রামগুলিতে জাতভিত্তিক ও পেশাভিত্তিক ভাগ থাকত। তথাকথিত "নীচুজাত'কে নিজেদের বাড়ীতে প্রবেশাধিকার দিত না উচ্চজাতিগণ, যদিও নীচুজাত প্রদত্ত পরিষেবাগুলি অবাধে নিতে "জাতিগত' কোন বাধা ছিল না। ভারতের বেশ কটি রাজ্যে এখনও এগুলি অত্যন্ত প্রচলিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দেশভাগোত্তরকালে শহরগুলি ও তৎ নিকটস্থ মফস্বলগুলিতে একধরণের মিশ্র সমাজ গড়ে উঠেছিল। আয়ের ব্যবধান সত্ত্বেও ঝক্‌ঝকে তিনতলা বাড়ীর পাশে মলিন একতলা বাড়ীটিও মাথা তুলত। আয়ব্যায়ের ব্যবধান আছে, ছিল। কিন্তু ব্যবধান যে আছে সেই সম্পর্কে সকল পক্ষই সচেতন থাকত। সামান্য সুযোগেই আমরা এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তুলছি, যাতে আমাদের মন থেকে "ব্যবধান'এর চিত্রটাই মুছে যাচ্ছে, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব শহর বা মফস্বলের সামগ্রিক পরিবেশের উন্নয়নের চেষ্টা না করে নিজেদের ঢুকিয়ে নিচ্ছি একটা ঝকঝকে বুদ্বুদের ভিতরে। পরবর্ত্তী প্রজন্মের কাছে "ব্যবধান' শব্দটাই অচেনা হয়ে যাচ্ছে। "স্বাধীন' আমরা," উন্নত' আমরা আবার ভারতের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে স্রেফ "নেই' করে দিচ্ছি।

    আমাদের দেশের সরকার যদিও বিভিন্ন রঙের সুরক্ষাচক্র এখনও চালু করেন নি, তবু আমরা মনে মনে এই সুরক্ষাব্যবস্থাগুলিকে মনে মনে বিভিন্ন রঙে দাগিয়ে নিজেদের এক রঙীন ফানুসের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছি। তাই আজ আমাদের প্রয়োজন এত বেশী সুরক্ষা।

    অক্টোবর ২৬, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৬ অক্টোবর ২০০৮ | ৬৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন