এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • তবু...

    রুমেলিকা লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১২ জুন ২০২০ | ২২২৬ বার পঠিত
  • ডাক্তারি পড়তে ঢোকা ২০১৩ সালে। কলকাতা মেডিকেল কলেজ। প্রথম বর্ষ থেকেই কমিউনিটি মেডিসিন থাকত। প্রথম বর্ষ থেকে পড়া শুরু হলেও পরীক্ষাটি হত চতুর্থ বর্ষে গিয়ে। প্রথম বর্ষে মেরেকেটে গোটা চারেক থিয়োরি ক্লাস। রোমান্টিকভাবে স্মরণ করে যদি বলতে পারতাম, সেই প্রথম ক্লাসে প্রথম শুনেছিলাম স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা কী—তাহলে ভালোই লাগত। কিন্তু ক্লাসগুলোই করিনি। পরীক্ষার আগে পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম। অত গুরুত্ব দিইনি। নেহাত এটা বলতে না পারলে ভাইভায় ম্যাচ শুরু হবার আগেই ফিল্ড ছেড়ে কাটতে হবে—অতএব নাক-কান বুজে মুখস্থ করে রাখা।

    লেখার শুরুতেই কিছু কথা বলে রাখা দরকার। কোনোরকম পরিসংখ্যান দিয়ে সিদ্ধান্ত বা প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব দেওয়ার যোগ্যতা নেই আমার। বহু সিনিয়র রয়েছেন যারা প্রত্যেকদিন এই কাজ করে চলেছেন। বিষয়গুলির গভীরে গিয়ে চর্চার পরিসর খুলে দিতে তারাই দক্ষ। কেবলমাত্র নিজের কিছু ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি—যে বা যারা আমাকে পথ দেখিয়েছে , বাধ্য করেছে সিম্পটম, এক্সামিনেশন, অ্যাডভাইজের তথাকথিত লাইনের বাইরে ভাবতে…

    শেষের মেডিকেল ক্যাম্পে কোনো একজন দাবি দিয়েছিলেন আমি ক্যাম্প করার সময় দ্বিগুণ কথা বলি তার চেয়ে। সেই সময়ে চ্যাঁচামেচি করে পরের দিন যুক্তি খারিজ করলেও জানি তিনি ভুল কিছু বলেননি। ক্যাম্প করতে গেলে বেশি কথা বলি। অন্তত বেসিক রোগের চিকিৎসা করার জন্য যা প্রয়োজনীয় তার অনেকটাই বেশি। বহু প্রশ্ন করি যেগুলো না করেও ডায়াগনসিস এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া যায়। তবু বলি। কারণ ওই অপ্রয়োজনীয় কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই টেবিলের ওপ্রান্তে বসে থাকা আমার থেকে ঢের ঢের বেশি অভিজ্ঞ মানুষগুলোর জীবনের কিছু আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করি। যেমন ভাবে পেয়েছিলাম ইটভাটায় কাজ করা পূর্ণিমার থেকে, বা তার আগের অসংখ্য জনের থেকে। নিজের জীবনে নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারি না, যেগুলো তাদের থেকে শুনে বুঝি। বুঝি বললে ভুল হবে—বোঝবার চেষ্টা করি।

    তো যা বলছিলাম। ওই হেলথের সংজ্ঞা। হু-এর কথা মতো—Health is a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity. মানে শুধুমাত্র রোগের অনুপস্থিতি শুধু নয়, সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে সম্পূর্ণতা। ভাইভা পেরিয়ে, ব্যারিকেড ভেঙে (পরীক্ষার ব্যারিকেড), ইন্টার্নশিপ করে, রেজিস্ট্রেশন পেলেও সেই স্বাস্থ্যের দেখা আজও পাইনি...

    কিছুদিন আগে টালার বস্তি এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্পে গেছি। বছর ৩০-এর মহিলা। মূল সমস্যা কোমর, পিঠে খুব ব্যথা। কী কাজ করেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন লোকের বাড়িতে কাজ করেন। কাছেই। শ্যামবাজার, বাগবাজার অঞ্চলে। বসে রান্না করতে হয়? হ্যাঁ। হাঁটু মুড়ে? হ্যাঁ। রান্না করতে করতে পা ঝিনঝিন ধরে যায়। পা অবশ হয়ে যায়। সমাধান হিসেবে লিখতে পারি—ব্যথা বাড়লে আইবুপ্রোফেন ৪০০। হজমের গণ্ডগোলের জন্য ফ্যামোটিডিন ২০। ডেলি এক্সারসাইজ। ব্যায়াম দেখিয়ে দিলাম। এরপর এল কঠিন বিষয়টি। শুনুন, বেশিক্ষণ হাঁটু মুড়ে কাজ করা যাবে না। ঘর মোছা যাবে না। ভারী জিনিস তোলা যাবে না। শুনেই হেসে ফেললেন গীতাদি। পিছনে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তিনিও। প্রথম প্রথম এগুলোয় খুব অবাক হতাম। এখন হই না। যেগুলো বলছি সেগুলো গীতাদিদের জীবনে এতটাই অবাস্তব, অসম্ভব—তাই শুনে হেসে ফেলা। তবু ধমক দিতে হল। বললাম ইয়ার্কি মারছি না। এরকমভাবে এগোলে কিছুদিন পরে সবসময় ব্যথা করবে। শুনলেন। খানিক মৃদু ঘাড়ও নাড়লেন। মুখের হাসি গেল না।

    কিন্তু উনিও জানেন, আমিও জানি—এর মধ্যে কোনোটাই হবে না। গীতাদিরা কাজ করে যাবেন। তিন-চার বাড়ি রান্না করে ঘর মুছে এসে নিজের বাড়ির রান্না চড়াবেন। হাঁটু মুড়ে বসেই। ব্যথা বাড়বে। ব্রুফেনে কাজ হবে না। শেষে হোমিয়োপ্যাথি-অ্যালোপাথি সবকিছুই করবেন। কিছুদিন ব্যায়াম করবেন। যদি বেশিদিন করেন ব্যথায় রাশ থাকবে। নইলে বাড়বে। সেই জ্বালায় পরের ডাক্তারবাবুর সামনে বসে আবারও বলবেন কোমরে ব্যথা। তিনি হয়তো-বা বলবেন কাজ করা কমাতে, হাঁটু মুড়ে না থাকতে। বা বলবেন না। গীতাদিরা ওষুধগুলো নিয়ে ছুটবেন বাড়িতে রান্না চাপাতে…

    সোমাদির পেটের বামদিকে ব্যথা করে। মাঝেমধ্যে বুকের কাছে জ্বালা জ্বালা ভাব। খাবার হজম হয় না। খেলে ব্যথা বাড়ে। জিজ্ঞেস করলাম কটায় ওঠো? উঠে থেকে কী খাও?
    ভোরে সাড়ে তিনটে করে উঠে পড়ি। উঠে তো কিছু খাওয়া হয় না। ওই ঘরের কাজগুলো সেরে নিই। চায়ের দোকান খোলে সাড়ে ৫টা করে। এক কাপ চা দুটো বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে যাই লোকের বাড়ি কাজ করতে। এরপর সব বাড়িতেই ওই চা-বিস্কুটই দেয়। তিন-চার বাড়ি কাজ করি। বাড়ি ফিরি দেড়টা করে। ভাত খেতে খেতে আড়াইটে। এতক্ষণ পেট খালি রেখো না। হজমে তো ওই জন্য সমস্যা হচ্ছে। পেটে ক্ষত হয়ে যাচ্ছে তো। কী করব বলো দিদি? আমাদের তো এই জীবন…



    বছর খানেক আগে বাঁকুড়ায় ক্যাম্প করতে গেছিলাম। মেয়েদের বেশিরভাগেরই চাষের কাজ। যে-কোনো ক্যাম্পে গেলেই মেয়েদের মধ্যে কোমরে ব্যথা, পিঠে ব্যথার সমস্যা প্রবলভাবে দেখেছি। অন্তত ৬০ শতাংশের কাছাকাছি মহিলারই সমস্যা এটা। পরীক্ষা হিসেবে এক্সরে এল এস স্পাইন (লাম্বোস্যাক্রাল স্পাইন) অর্থাৎ কোমরের ছবি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষয়জনিত পরিবর্তন। এখানে বেশিরভাগের মধ্যেই একটা জট আছে। আদপে যতজনেরই এক্সরে লিখি না কেন, হাতে গোনা করে ওঠেন মাত্র দু-তিন জন। বেসরকারি জায়গা থেকে করানোর মতো সামর্থ্য নেই। আর সরকারি জায়গা থেকে করার মতো সুযোগ নেই। হয় বহুদূরে, নয় যেদিন করতে হবে সেদিনের কাজ বন্ধ থাকবে। কাজ বন্ধ মানে সেদিনের টাকা মারা যাবে। তার থেকে না করানো বেশি ভালো। বড়ি খেয়ে সামলালে ভালো। না সামলালেও সেইদিকে বেশিক্ষণ নজর দেবার মতো অবসর কোথায়। বাথরুমে কোমডের সুবিধা থাকলে হাঁটুতে চাপ কম পড়ে। যেখানে সকালবেলা উঠে মগ নিয়ে মাঠে যাওয়াই রীতি সেখানে কোমডের কথা বলা হাস্যকর…

    শ্রীরামপুরের মেলা বাড়ি বস্তিতে ক্যাম্প। ওখানে তিয়াস, দেবাঞ্জলিরা বহুদিন ধরে পড়াচ্ছে বাচ্চাদের। ছেলেরা হয় ভ্যান, রিকশা চালায়। মেয়েরা লোকের বাড়ি কাজ করে। প্রত্যেক বছরই একবার করে মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করে ওরা। আমফানে মেলা বাড়ির ছাদ উড়ে যাওয়ার পরের দিনই সাইকেল নিয়ে দেখতে যায় ওরা। এক সপ্তাহের মধ্যে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা করে ডাক পড়ল। গেলাম। একজন এসে বললেন মাথা ঘুরছে, বুক ঢিপঢিপ করছে। কবে থেকে? প্রায় ১০-১২ দিন হল। প্রেশার আছে? হ্যাঁ। ওষুধও খাই। নিয়মিত? আজকে খেয়েছেন? না বাবা ওষুধ তো ১০-১২ দিন হল ফুরিয়ে গেছে। খাওয়া হয় নাই। সরকারি হাসপাতাল থেকে নাওনি কেন? এমনিই সময় তাই নিই। এই লকডাউনের সময় যাব কী করে? তো কয়েক দিন কিনে নাওনি কেন? লকডাউনে হাতে কাজ নাই। পয়সা পাব কোথায়?

    ক্যাম্প থেকে ১৫ দিনের ওষুধ দিয়ে দেওয়া হল। তারপর কী হবে জানা নেই। লকডাউন হবার আগে এই রোগীদের কথা কি একবারও ভেবেছিলেন কেউ? কলকাতা মেডিকেল কলেজকে করোনা হাসপাতাল করার আগে প্রত্যেক দিন যে হাজার হাজার রোগী শুধুমাত্র আউটডোরে দেখানোর জন্য আসেন তাদের কী হবে ভেবেছিলেন কেউ? যাদের কেমো চলে, থ্যালাসেমিয়ায় রক্ত নিতে হয় নিয়মিত, যারা ওই বিনামূল্যের ওষুধগুলো পেয়েই বেঁচে থাকেন তাঁরা কী করবেন? বাস বন্ধ, গাড়ি বন্ধ, ট্রেন বন্ধ—আসতে পারছেন না। একদিক থেকে ভালো। খবরও হবে না… জানতেও পারবেন না। ওনারা বোধহয় মারা যেতেই পারেন—কিছু যায় আসে না। যেমন যায় আসে না পরিযায়ী শ্রমিকদের বেলা।

    করোনায় এখনও অবধি মৃত্যুর মধ্যে কি এদের সংখ্যাও ধরা হবে? জানতে ইচ্ছে হয়। করোনার বিরুদ্ধে যখন নরেন্দ্র মোদী আত্মনির্ভরতার বাণী শোনাচ্ছিলেন, মমতা ব্যানার্জী পাশবালিশের গল্প দিচ্ছেন—এদেরকে কি তখন কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল?

    জানকীদের কথা লিখেছিলাম ফেসবুকে। ওষুধ, টেবিল সাজানো চলছে তখনও। একজন বুড়ি মা অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছেন দেখাবেন বলে। কোনোরকমে অপেক্ষা করতে বলে হাত চালিয়ে ক্যাম্প শুরু করার চেষ্টা করছি আমরা। শেষে ডাক পড়তেই বুড়ি মা এসে বসলেন সামনে। কী সমস্যা বলো? হাতে ব্যথা। কবে থেকে? তিন-চার দিন আগে। কী করে? ছেলে মেরেছে। তারপর থেকেই। ছেলে মেরেছে কেন? উত্তর নেই। ছেলে কী করে? ওই এদিক-ওদিক কাজ করে গাঁয়ের মধ্যেই। এই দু-মাস কী করছে? কাজ পেয়েছে? নাহ্‌। ঘরেই আছে। দুনিয়ার সব মায়েরাই বোধহয় সন্তানদের আগলে রাখে, গায়ে কাদা লাগতে দেয় না। হাত তুললেও না…

    আগের দিন সামান্য চাল-ডাল দিয়ে সাহায্য করা হয়েছিল গ্রামবাসীদের একাংশকে। কাজ মিটিয়ে অবস্থা দেখতে গ্রামের ভেতরে যাওয়া। ২০ মিনিট হাঁটার পর প্রবল বৃষ্টি। তড়িঘড়ি গিয়ে পাশের দোকানের ছাউনিতে মাথা গুঁজলাম প্রত্যেকে। পুলক বলল আর যাওয়া যাবে না। ফিরতে হবে। ফিরতে গিয়ে বুঝলাম কেন যাওয়া যাবে না। রাস্তাটা পুরোটাই এঁটেল মাটির। কোনোকালে মাটির রাস্তা হয়ে থাকলেও বর্তমান ভাঙা কিছু ব্লক বাদ দিয়ে বাকি কিছুর অস্তিত্ব নেই। কাদা-জলে যেখানেই পা রাখা হোক সেখানেই দ্রুম-দ্রাম। চটি পড়লে তো যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানেই...

    ২০ মিনিটের রাস্তা একজনের হাত চেপে ধরে ৪৫ মিনিট যুদ্ধ করে সড়ক রাস্তায় ফেরা। এরই মধ্যে খেল দেখাতে গিয়ে চিতপটাং আমাদের একজন। একটা ভ্যান কাদায় বসে আছে। দু-দিকে ভেঁড়ি…

    নিজের গ্রামবাংলার অভিজ্ঞতা বলার জন্য এই গল্পটা করিনি। পরের দিন ক্যাম্পে প্রায় ৩-৪ জনকে দেখেছিলাম যারা বিগত চার-পাঁচ দিনের মধ্যে ওই রাস্তায় পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন। খুব বড়ো কিছু হয়নি। কিন্তু হওয়ার পরিস্থিতি যে ছিল না এরকম নয়। সামাজিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যোগসূত্রকে অস্বীকার করব কী করে?

    ফিরি জানকী, পূর্ণিমাদের কথায়। জানকীরা সকালবেলা কাঁকড়া ধরে, চিঁটিকাঁকড়া, ছোটো মাছ, চিংড়ি। ১০০০ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে কেউ কেউ এর মাঝে এসেছেন কলকাতায়। বিক্রি করে গেছেন। কেউ কেউ পারেননি যেতে। থেকে গেছেন। যেটুকু রেশনের ব্যবস্থা করেছে তা দিয়েই সংসার চালিয়েছেন। একহাঁটু সমান গঁদ কাদায় নেমে কাঠ কুড়িয়েছেন। সেই কাঠ পুড়িয়ে রান্না হয়েছে। তবু জানকীরা গাছে হাত দেননি। আমরা শহর কলকাতায় বসে গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান করে পরিবেশ উদ্ধার করি। জানকীরা প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠে। গাছের গায়ে কোপ বসানোর কথা বোধহয় ভাবে না।

    জানকীদিকে অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিয়ে এসেছি ওই ইনফেকশনটা কমানোর জন্য। ৫ দিনের কোর্স। মলম দিয়ে এসেছিলাম লাগানোর। বলেছিলাম জায়গাটা শুকনো রাখতে। এখন যেন চটি পড়ে। নোংরা না লাগতে দেয়। শুনে জানকী হেসেছিল। আমিও। ওই অপ্রস্তুতের হাসি। হেসে বলেছিলাম, তবু চেষ্টা করো। আগের দিন কাদায় কান্নাকাটি করার পর কী করে বলি চটি পড়তে। আর-এক জনের গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যথা। বোধহয় ক্যালকেনিয়ালস্পার। জানি না। এক্সরে না করলে জানা যাবে না। লিখলেও করবে না। গ্রামীণ হাসপাতাল ওখান থেকে প্রায় ৩০ মিনিট গাড়ি করে। নরম চটি পড়তে বলেছি। সেও বলল—চটি পরে হাঁটা যায় না। জানকীরা প্রত্যেকেই ভীষণভাবে অ্যানিমিক। আয়রন ট্যাবলেট দিয়ে এসেছি। কিন্তু প্রত্যেক দিনের পরিমিত খাবারের ব্যবস্থা করতে পারিনি। ডিম খেতে বলেছি—বলেছে কিনে খেতি হবে। টাকা কুথায়? —তবু চেষ্টা করো…

    ওই তবু। আমার অ্যাডভাইসের অনেক কিছুতেই তবু থাকে। তবু চেষ্টা করো হাঁটু না মোড়ার। তবু চেষ্টা করো ভারী জিনিস না তোলার। তবু চেষ্টা করো ব্যায়াম করার। তবু চেষ্টা করো কোমর ঝুঁকিয়ে কাজ না করার। তবু চেষ্টা করো চটি পড়ে পায়ে নোংরা না লাগানোর। তবু চেষ্টা করো ডিম-মাছ-মাংস খাবার।

    তবু জানি এর মধ্যে কোনোটাই ওরা করতে পারবে না… সম্ভবনা। বলেছিলাম না, শখের অবহেলা নয়। অভাবের অবহেলা…

    এরকম বহু জানকী, পূর্ণিমা, পূজাদেরই দেখি। পূজাদির লিকলিকে চেহারা। বয়স বলেছিল ৩৫। ইটভাটায় কাজ করে। পাঁচটে মেয়ে। বড়োটার বয়স ১৭। ছোটোটার ৮। বলেছিল মাথা ঘোরে। লো প্রেশার, অ্যানিমিয়া। তার সঙ্গে কোমরের যন্ত্রণা। ঘরে প্যারালাইজড স্বামী। সাহস করে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি ১০টা ইট বয়ে একটাকা পেলে সবমিলিয়ে আয় কত হয়? সংসার চলে কী করে? খাবার হজম হয় না। রাতে ঘুম হয়? নাহ্‌ গো—এই পাঁচটা মেয়ের বিয়ে দেব কী করে? চিন্তায়ঘুমোইকিকরেবলোতো।ঘরেরলোকেরমতোজিগ্যেসকরেপূজাদি …

    আমি ভ্যাবলাকান্তের মতো বসে থাকি…

    মানসিক সমস্যা নিয়ে আমার নিরাপদ প্রগতিশীল পরিসরে চিন্তা বেড়েছে, আলোচনা বেড়েছে, চর্চা বেড়েছে। সেদিনের ক্যাম্পে শেষ যিনি দেখাতে এসেছিলেন—দু-মাস ধরে প্রচণ্ড পেটখারাপ। তার আগে কিন্তু নয়। এই শেষ দু-মাসই। দু-মাস ধরে কাজ নেই, হাতে টাকা নেই—সাময়িক ওষুধ দিলাম। মানসিক সমস্যার সঙ্গে পারিপার্শ্বিকতা ভীষণভাবে জড়িত। গ্রামের অপুরা গাছগাছালি, পুকুরে স্নান, কাদা ঘাঁটায় বড়ো হয়। শহরের গোগোলদের হাতে স্মার্টফোন, ৫০০০ ছুঁয়েছে ফেসবুক ফ্রেন্ডস অথচ বন্ধু নেই। হরিহরদের শেষ দু-মাস ধরে হাতে টাকা নেই। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতামের অবস্থাও ছিল না কোনোকালে। এই সামাজিক অবস্থাকে প্রশ্ন না করে মানসিক স্বাস্থ্যের চর্চা অসম্পূর্ণ। ভিসআভিস স্বাস্থ্যের চর্চাও।

    আমার অ্যাডভাইজ ‘তবু’-তে এসে শেষ হয়ে যায়। জানি যে টেস্ট করাতে লিখছি, যে এক্সরে করাতে লিখছি সেগুলো বেশিরভাগই করিয়ে উঠতে পারবেন না। জানি ওষুধে শেষ অবধি কাজ হবে না— জানি কাজ কীসে হবে। ডাক্তারি বাদে মানুষ হয়ে তারও চেষ্টা করি। তবুও…

    সুন্দরবনের ক্যাম্পে একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমার এক বন্ধুকে প্রথমবারেই দিদি পাতাল। উচ্চমাধ্যমিকের দুটো পরীক্ষা বাকি। আমি ডাক্তার শুনে কাছে এসে বলল, “দিদি একটা কথা বলব?” কী জিজ্ঞেস করতেই, “শোনো না, আমার না বুক উঠছে না।” জিজ্ঞেস করেছিলাম “তো?” “স্কুলে হাসাহাসি করে। আমার সব বন্ধুদের উঠে গেছে। মা বকে। কী করি বলো তো?” তাঁকে আশ্বস্ত করে এলাম। অনেক কিছু বললাম। বুঝল না বেশিরভাগই। আমাদের দেশে যৌনশিক্ষা এসবের পাটবালাই নেই। কিন্তু এই শরীরের অংশ নিয়ে খোঁটা দেওয়া, হাসাহাসি করা—এর সমাধান কোন্‌ ওষুধ? শিল্পকের থেকে শুনেছি, নিজেও দেখেছি গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা। পিতৃতন্ত্রকে প্রশ্ন না করে কী করে তার উত্তর পাওয়া যায়? পূজাদি কেন মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করে রাত জাগে? বাচ্চা একটা মেয়ে নিজের শরীর নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে? বুড়ি মাকে ছেলে কেন মারে? এর সমাধান কোন্‌ ওষুধে হবে?

    শুধু সিম্পটম-এক্সামিনেশন-ডায়াগনসিস-ট্রিটমেন্টের একচোখামিতে ডাক্তারি হয় না। জুড়ে যায় হাজার হাজার ফ্যাক্টর। মানুষটার থাকা, খাওয়া, জীবন, জীবিকা, পরিবেশ। সেগুলোকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র কারণ-ফলাফলের সম্পর্কে চিকিৎসা করা প্রায় অসম্ভব। প্রত্যেকবার ক্যাম্পের পরে হাজারও প্রশ্ন আসে। উত্তর থাকে না।

    শেষ করি আর-একটা ‘তবু’ দিয়ে। সেই দিন গ্রামের রাস্তায় বৃষ্টি আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অবধি বিছিয়ে গেছিল রামধনু। একটা নয়, দুটো।

    তবু একদিন স্বপ্ন দেখি ছবিটা পালটাবে। সেই দিন ভাইভায় বেসিক মিনিমাম ক্রাইটেরিয়া হয়ে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞার অস্তিত্ব থাকবে না। থাকবে মানুষের মধ্যে। সবার মধ্যে। সেদিন হন্যে হয়ে উত্তর খুঁজবে না কিছু মানুষ। পূর্ণিমারা ভরা পেটে বাঁচবে। সেই দিনগুলোর অভিমুখে যাত্রায় আপাতত পা মেলাই সকলে। ওই এক আকাশ রামধনু বুকে করে...


    ছবি: আমফান রিলিফ নেটওয়ার্ক
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১২ জুন ২০২০ | ২২২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৪ জুন ২০২০ ০৭:১০94288
  • চিকিৎসা দরকার সমাজের। নইলে এইসব ওষুধ কতো বিফল!          

    লেখার রিপোর্টাজ ধাঁচের মানবিকতাটুকু ভাল লাগলো।      

  • বিপ্লব রহমান | ১৪ জুন ২০২০ ০৭:১১94289
  • * সংশোধন / লেখার রিপোর্টাজ ধাঁচ ও মানবিকতাটুকু ভাল লাগলো।      

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন