এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • গামছা

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১০ জানুয়ারি ২০১৮ | ১২০১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • "কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে” – এই জাতীয় প্রশ্ন মনে হয় কবি আমার মত পাবলিকদের উদ্দেশ্যেই ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সেই কবে। আর তারও আগে থেকে আমার মত পাবলিকদের মায়েরাই ‘সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়” বাগধারাটিকে শুধু টিকিয়ে নয় বরং জাগ্রত করে রেখেছেন আমাদের বিদ্ধ করে করেই। সেই দিন ভোর বেলা নাগাদ ফুরফুরে হাওয়ায় বারান্দায় চা খেতে গিয়ে বাঁদরের নাচানাচি এবং পাখির ডাক শুনতে শুনতে ভুতে কিলোনোর ব্যাপারটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। প্রায় সবার ডাকনাম আছে, কিন্তু আমার কেন নেই – তার মানে কি আমার দিকে ঠিক মত নজর দেওয়া হয় নি ছোটবেলায় – এই সব জটিল সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার ভেবে ভেবে হৃদয় বেদনার্ত করে ফেলতে সক্ষম হলাম। বেদনার্ত হয়ে থাকতে পারলে উইকএন্ডে খরচা কম হয়। গত উইক এন্ডের বেদনার্ত হবার বিষয় ছিল - এই জন্মে আর পেয়ে উঠলাম না ভালো একটা ডাকনাম, অথচ আমার ভিতর পোটেনশিয়াল ছিল ডাকনাম অর্জন করে নেবার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ‘গামছা সুকান’ ডাকনাম পাবার জন্য যা যা করা উচিত আমি তার থেকে অনেক বেশী কিছুই করেছিলাম।

    কিন্তু কেউ আমাকে ‘গামছা সুকান’ নামে ডাকল না আমার গ্রামে! পরে সেই না ডাকার সাইকোলজি নিয়ে প্রবল ভাবনা চিন্তা শুরু করে টের পেলাম আমার ডাকনাম না পাবার মূল কারণ ছিল আমাদের গ্রামে অন্য কেউ সুকান্ত নামে না থাকা! নিমো গ্রাম দ্বিতীয় সুকান্ত বিহীন হবার জন্য, আমার নামের আগে বা পরে কিছু যুক্ত হবার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিতই থেকে গিয়েছিলাম। মোটা শৈলেন – ঢ্যাপা শৈলেন, প্যান্ট বাপি – লুঙ্গি বাপি, তোতলা বাপন – কাতলা বাপন এই সব কম্বিনেশন মেনে চললে, আমার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘গামছা সুকান’ যদি অন্তত একজনও কেউ থাকত আমার প্রতিদ্বন্ধী! অনেক পরে শুনেছিলাম গ্রামের আমাদের থেকে কিছু সিনিয়ার জীবন হালদারের আরেকটা নাম নাকি সুকান্ত। কিন্তু ‘জীবন হালদার – সুকান্ত’ এক অসম্ভব কম্বিনেশান, ‘পান্তা ভাত – সয়া সস্‌’ এর মতই। তাই জীবন হালদার কালক্রমে নিজেই নিজের সুকান্ত নাম ভুলে গিয়েছিল, অন্যরা তো তার অনেক আগেই।

    গড়িমসি করা এবং সর্বদাই কাল করব বলে কাজ ফেলে রাখা ভালো ইঞ্জিনিয়ার হবার একটা লক্ষণ। সব সময় কাজের মধ্যে আছি, কাজ না থাকলে মাথা ঝিম ঝিম করে, মানুষ কি করে সময়ের অপচয় করে বুঝতে পারি না – এই সব ডায়লগ আউরে যাঁরা জীবন ধারণে ব্রতী হয়েছেন, তাঁরা আর যাই হোক প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ার হওয়া থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন। এমনকি আমি তো আরো এককাঠি বাড়িয়ে বলব, গড়িমসিতে লিপ্ত থাকা ভালো ইঞ্জিনিয়ার হবার এক আবশ্যিক শর্ত হিসাবে আরোপ করা উচিত। সেই হিসেব ধরেই, আমি জীবনের অনেক কাজই গড়িমসি ক্যাটাগরীতে ফেলে দিয়েছি। সেই গড়িমসি করতে গিয়েই গামছার সাথে আমার নাম জড়িয়ে ঘটনাক্রম আমি লিখে রাখি নি, ফলে নামের আগে গামছা যোগ করার ব্যাপারটায় আর কপিরাইট নেওয়া হয়ে উঠল না!

    ছোটবেলা থেকে আমার সেই গামছা প্রীতিকে একমাত্র অ্যাকনলেজ করেছিল জগা জ্যেঠু। সর্বদা লাল বা সবুজ গামছা গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য জগা জ্যেঠু আমাকে ‘রাখাল’ বলেই ডাকত। এমনকি অনেক বড়বেলা পর্যন্ত – নানা কারণে তখন মাঝে মাঝে গ্রামে নতুন পাবলিক আমার খোঁজে মাঝে মাঝে আসত। সেই পাবলিকদের মধ্যে একবার এক সাংবাদিকও ছিল যে নিমো তোলা ফটকের কাছে সুকান্ত ঘোষের বাড়ি যাব কোনদিকে বলে জগা জ্যেঠুকে জিজ্ঞেস করে। সুকান্ত নাম দিয়ে জগা জ্যেঠু প্রথমে আমাকে মেন্টালি লোকেট করতে পারে নি – সাংবাদিকের কাছ থেকে কার্যক্রমের ব্যখ্যা শুনে নাকি আঁচ করেছিল কে হতে পারে এবং হালকা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিল ‘রাখাল’-এর বাড়ি যাব সেটা ডাইরেক্ট বললে ফালতু সময় নষ্ট হত না!

    সেই দিন ভাবলাম বয়স হচ্ছে, তাই আর গড়িমসি না করে গামছা নিয়ে নিজের নামটাকে জড়িয়ে ব্যাপারটা ডকুমেন্টেড করে রাখা যাক। একেবারে গোড়া থেকে শুরু করব ভাবলাম, মানে গামছার ডেফিনেশন থেকে শুরু করে উৎপত্তি ইত্যাদি ইত্যাদি – ফলতঃ গুগুলে বাংলায় গামছা শব্দটি টাইপ করা। প্রথমেই ঝটকা – সার্চে চলে এল ‘গামছা পলাশ’-এর নাম, বুঝে গেলাম ‘গামছা সুকান’ নাম আর নেওয়া যাবে না, লোকে কপি করছে বলে ধিক্কার দেবে। খুবই মুসরে পড়লাম – কিন্তু পাঁচ মিনিট পরে রিকভার করে গামছা-পলাশকে নিয়ে একটু বসলাম। যা বুঝলাম ইনি বাংলা গানের গায়ক – ইউ টিউবে গিয়ে তার গানে ক্লিক্‌! ভুলের মধ্যে সাউন্ড সিষ্টেমটা বেশ জোরে দেওয়া ছিল – গামছা পলাশের গান শুনে টেবিলের উপরের স্প্লিট টাইপ এ সি-র (এয়ার কন্ডিশনার) ভিতরে যে তিনটে টিকটিকি বাস করত তারা ফেইন্ট হয়ে ধুপ করে পরে গেল টেবিলে। জানালার পাশের গাছে হর্নবিল পাখিগুলি ফল খাচ্ছিল রসিয়ে রসিয়ে – প্রবল চমকে তারা কর্কশ ডাক দিয়ে উড়ে গেল, রান্নার ঘর থেকে কাজের মেয়েটা ছুটে এল কোন বিপদ হয়েছে কিনা দেখার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি। গামছা পলাশ তখন গাইছে, “কলঙ্কেরি মালা লইয়া ঘুরি আমি দেশ বিদেশ, তোর প্রেমে পড়িয়া আমার সোনার অঙ্গ শেষ”। হাতের কাছে কাঁচের জিনিস পত্র না থাকলে আপনারাও গামছা-পলাশের গান শুনে দেখতে পারেন। কিংবা এও ভাবতে পারেন যে ছোকরা হয়ত আদৌ ততো খারাপ গায় না, যতটা আমি বলছি – হয়ত বিদেশী টিকটিকি বা হর্নবিলদের লোকগীতি শোনার অভ্যেস নেই।

    নেট সার্চ করে চট করে গামছা নিয়ে রবি বাবুর কোন কবিতা পেলাম না – যেটা আমাকে খুব অবাক করল। গামছা নিয়ে রবি ঠাকুরের কোন কবিতা থাকবে এটা আমি জাষ্ট মেনে নিতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ সার্চ করার পর পেলাম রবিবাবু কোন একজায়গায় নাকি লিখেছেন,

    “তীরে তীরে ছেলেমেয়ে নাহিবার কালে
    গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে”

    সেই আমদের ছোট নদী কবিতার শেষের কয়েক লাইন এই গুলি! কে আর মনে রাখে! অন্য কোথাও শুধু গামছা নিয়ে প্রবন্ধ বা আর লিখেছেন কিনা কিছুই জানি না। প্রশান্তকুমার পালকে আমায় আরো ভালো করে হার্ড কপিতে হাঁটকাতে হবে।

    কিন্তু গামছা নিয়ে এবং গামছা নামেই নির্মলেন্দু গুণের একটা গোটা কবিতার উল্লেখ পেলাম যার প্রথম কয়েক লাইন এমনঃ

    “গ্রাম-বাংলার পুরুষ মাত্রই গামছাকে খুব ভালোবাসে,
    তারা তাদের প্রিয় গামছাটিকে স্কন্ধে সাজিয়ে রাখে।
    গরমের দিনে তারা গামছা দিয়ে শরীরের ঘাম মোছে,
    নাকের সর্দি মোছে, শোকে-দুঃখে চোখের জল মোছে,
    স্নান শেষে গা মোছে, কেউ মাটিতে সঙ্গমশয্যা পাতে।
    গামছা ব্যতিত ঘর থেকে বেরুতে গেলেই তাদের পা
    ঘরের চৌকাঠে আটকে যায়, ভুলে ওড়না ছাড়া ঘরের
    বাইরে বেরুতে গেলে মেয়েদের বেলায় যেমনটি হয়।

    বাংলার নারীরা পুরুষদের এই দুর্বলতার কথা জানে।
    তারা পুরুষের গামছা পাহারা দেয়। তাতে কাজ হয়,
    গামছার টানে অনেক সময়ই তারা ঘরে ফিরে আসে।
    শুধু গামছার জন্যই আমি আমার গ্রামের বহু বহুগামী
    পুরুষকে নির্দিষ্ট নারীর কাছে ফিরে আসতে দেখেছি...”

    চরম অ-নারীবাদী টাইপের কবিতা যাকে বলে – কবি বলছেন কিনা নারীরা পুরুষের গামছা পাহারা দেয়! এবং শুধুমাত্র গামছার জন্যই বহুগামী পুরুষ নির্দিষ্ট নারীর কাছে ফিরে আসছে!! এতো মরার উপর খাঁড়ার ঘা! গামছা বিতর্কে নির্মলেন্দু কেন যে জড়ালেন না কে জানে? ভাগ্যবান কবি বলতে হবে!

    নির্মলেন্দু বেঁচে গেলেও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিন্তু এড়াতে পারলেন না গামছা বিতর্ক – অন্তত এমনটাই আমি মনে করলাম জি নিউজের ওয়েব সাইটের খবরের হেডলাইন দেখে, “মুকুলকে সামলাতে 'গামছা'-য় মাঠে নামলেন পার্থ”। বয়ষ্ক মানুষের গামছা পড়ে একে অপরকে সামলানো দেখতে দেখতেই গ্রামে আমাদের বড় হয়ে ওঠা – ভাবলাম মা, মাটি, মানুষ স্লোগান বহনকারী পার্থ হয়ত সেই ফ্লেভারটা আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন! ক্লিক করে ওয়েব সাইটে ঢুকে পর্বতের মুষিক প্রসব। গামছা প্রিন্টের কাপড় দিয়ে তৈরি পাঞ্জাবি পড়ে মুকুল বিষয়ক সাংবাদিক বৈঠকে তৃণমূলের মহাসচিব সাফাই দিচ্ছেন, “সবাই পরছে, ভাবলাম আমিও একটু ট্রাই করি..” ।

    এবার প্রশ্ন হচ্ছে, গামছাকে তা হলে ফ্যাশন সামগ্রী করে রিপ্রেজেন্ট করে মার্কেটে হাওয়া তুলল কে যাতে করে পার্থকেও গামছা পাঞ্জাবী পরে সাংবাদিক সম্মেলন করতে হয় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে? রিসার্চ করে (অর্থাৎ গুগুল মারফত) যা জানা গেল, “গামছা বাঙালিয়ানার প্রতীক” এই আইডিয়া মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল গামছাকে পোশাক, গৃহসজ্জা সামগ্রী এমনকি গয়নাতেও ঢুকিয়েছেন এবং প্রায় একার চেষ্টায় নাকি আগে ভ্রু কুঁচকে তাকানো পাবলিকদেরও গামছা নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছেন। ওয়েবসাইটে গামছা গলায় আন্তেনিও বান্দেরাস-এর সাথে বিবি রাসেলের ছবি সেই দাবীর প্রামাণ্যতা সমর্থন করে।

    গামছার টেকনিক্যাল ব্যাপার স্যাপার যারা আরো বেশী জানতে চান, তাঁরা নিজেরা গুগুলের কাছে যান। আমাদের কাছে গামছার প্রধান দুই সমস্যা ছিল তাদের দৈর্ঘ‍্য এবং ঘনত্বের। সবচেয়ে নিকৃষ্টমানের গামছা সাপ্লাই করা হত পুজোর সময় ব্রাহ্মণদের প্রণামীতে। সেই গামছা প্রায় মসলিনকেও হার মানিয়ে দেয়, অনেকে ভয়ে ভাঁজই খুলত না গামছার, এই যদি ফেঁসে যায়! তবে পুজোতে গামছা এক সিম্বলিক জিনিস ছিল প্রায় – ডাঁই করে রাখা গামছার উপরের কয়েকটায় কিছু সিঁদুর এবং ফুল-গঙ্গা জল পড়ত। তাদের তলার গুলো পুজো শেষ হয়ে গেলে ব্রাক্ষণ ঠাকুর নিজে গিয়ে বিক্রী করে দিয়ে আসত আমরা যেই দোকান থেকে কিনেছি। পরের বছর আবার সেই গামছা আমরা কিনতাম। রিসাইকেলিং কনসেপ্টের আঁতুরঘর। নন্দ ঠাকুর অনেকবার রিকোয়েষ্ট করেছিল আমাদের বাড়ির দূর্গা পূজার সময় এই বলে যে, নেপাল, বাকি গামছা যাই দিস না কেন, উপরের দিকের তিন চারটে গামছা একটু ভালো দেখে দিস, বাড়িতে ব্যবহার করব। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সেই গামছা গুলি কোমরে জড়াতে গেলে কোনক্রমে সামনে গিঁট বাঁধা যেত মাত্র – গামছার দুই প্রান্তের ওভারল্যাপ বড়জোর থাকত দুই থেকে তিন মিলিমিটার।

    এমন পুজোর গামছাই ব্যবহার করত বামুনদের দীপু তার নিত্য জীবনে। সেই গামছা পড়েই সে চান করতে আসত শিবতলার সিলিন্ডার কলে। গ্রামের বেশীর ভাগ টিউবকল ছিল ফার্ষ্ট লেয়ারের – মানে দুটো পাইপ, ত্রিশ ফুট মত। স্বাভাবিক ভাবেই প্রবল গ্রীষ্ম কালে জলের লেয়ার নেমে গেলে সেই কলে আর জল উঠত না – ফলে অনেকে নির্ভর করত পঞ্চায়েতের করে দেওয়া সিলিণ্ডার কলে – যার ছিল প্রায় ১৫ গাছা পাইপ, মানে ২২৫ ফুট গভীরে। দীপু তার বাবার পুজো করে পাওয়া স্বচ্ছ এবং নাতিদীর্ঘ গামছা পরেই শিবতলার কলে চান করত দীর্ঘ দিন ধরে। সত্যম শিবম সুন্দরমের মন্দাকিনীর ভেজা কাপড় নিতান্তই শিশু ছিল রিন্টুর সেই ভেজা গামছার কাছে। যে টুকু অস্বচ্ছতা ছিল, তা কেবল গামছার লাল রঙে। সেই গামছা পড়ে চান শেষে দীপু হেঁটে বাড়ি ফিরত এবং ফেরার আগে রক্ষকালী বেদীর সামনে হাঁটু ভাঁজ করে ঠাকুর প্রণাম। এই ভাবেই দীপুর বীচির দুলুনির সাথে গ্রামের অনেকেই সম্যক পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। তবে তাতেও আমাদের চাষা পরিবারেরা বামুন দীপুর কোন দোষ খুঁজে পায় নি – দোষ দিত তারা যজমানদের, একটু বড় গামছা দিলে তো আর বামুনদের ছেলেটাকে বীচি বের করে ঘুরতে হত না!

    শিবতলার কলের প্রায় সামনেই বাড়ি ছিল মোড়লদের বাসুর। বাসু দীপুর রোমাণ্টিক এবং এ-মার্কা চানের সাথে পরিচিত ছিল। কালক্রমে বাসুর দাদার বিয়ে হয়ে বাড়িতে নতুন বৌদি এল যার থাকার ঘরের জানালা খুললেই শিবতলার কল। একদিন দীপু চান করতে এসেছে কলে, সেই সময় বসু এসে বলল,

    -দ্যাখ দীপু এখন আমাদের বাড়িতে বৌদি এসেছে নতুন, তা তুই যদি একটু সামলে চান করিস, তা হলে খুব ভাল হয়।
    -কেন তোর বৌদি কি বীচি পছন্দ করে না, নাকি বীচি আগে কোন দিন দ্যাখে নি!
    -আরে আস্তে আস্তে। এতো জোরে বলিস কেন?
    দড়াম করে আমরা জানালা বন্ধের শব্দ শুনলাম, হয়ত লজ্জায় বৌদি বন্ধ করতে লাগল শুনতে পেয়ে। ওদিকে দীপু গ্যাছে রেগে -
    -তোর বৌদিকে বলগা যা, আমার বীচি তোর দাদার বীচির থেকে অনেক ফরসা। সব দেখা আছে আমার – এই কল তলাতেই তো সব চান করত নাকি?

    চাষার বীচির সাথে বামুনের বীচির তুলনাও সেই প্রথমবার!

    সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরে বাড়িতে ‘মেমারী সংবাদ’ পত্রিকার সাংবাদিক এসেছে ইন্টারভিউ নিতে। ভ্যাগিস সঙ্গে ক্যামেরা ম্যান ছিল না (মেমারী সংবাদে ছবি ছাপার ব্যবস্থা ছিল না তখন অবশ্য), না হলে আমিই হয়ত প্রথম ছাত্র হতাম গামছা গায়ে সাক্ষাতকার দেওয়ায়। তোমার প্রিয় লেখক কে? তোমার প্রিয় বই কি? তোমার প্রিয় খেলোয়ার কে? মেমারী ইস্কুলে তোমার প্রিয় শিক্ষক কে? শালা, তোমার প্রিয় সিনেমা কি, সেটা আর জিজ্ঞেস করছে না। আগের দিন রাতে ওই গামছা পেতে শুয়েই আমি ভিডিওতে সপ্তম বারের জন্য ‘ত্রিরঙ্গা’ সিনেমা দেখে এসেছি। লাষ্ট সিনে রাজকুমার গিয়ে মিসাইল থেকে চট করে ফিউজ্‌ খুলে নিয়ে এসে ভিলেনের প্ল্যান বানচাল করে দিয়েছে মিসাইল অকেজো করে – সেই দৃশ্য আমার মনে বিশাল ইম্প্যাক্ট ফেলেছে। দুটো রেপ সীন নিয়ে ভাবা ছাড়াও আমি তখন প্রায় সর্বদাই ত্রিরঙ্গা সিনেমার মিসাইলের ফিউজ খোলা নিয়ে ভাবছি। ভিলেনের টেবিলে লাল নীল বোতাম টিপে মিসাইল চালু করা নাকি ঢপের ব্যাপার, মিসাইল এই ভাবে টেবিলে বোতাম টিপে লঞ্চ করা যায় না, এটা অনেকে জ্ঞান দিত। তারা আজকে বেঁচে থাকলে কিম জঙ আর ট্র্যাম্পের বাক্যালাপ শোনাতাম – আমার মনে সেই ছোটবেলা থেকেই ডাউট ছিল না যে, টেবিলে বোতামে চাপ দিয়েই ভিলেন-রা মিসাইল ডিল করে।

    একবার ছোটকাকা বলল তুই আজকে গামছা গায়ে ঘুরবি না বাড়ির মধ্যে। কারণ খুঁজতে গিয়ে পিসি-র কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, সেই দিন পিসির বন্ধু এবং ছোটকাকার জুনিয়ার মৌসুমি এবং তাদের আরো বন্ধুদের গ্যাঙ আসবে বাড়িতে। আগের বার নাকি আমার গামছা কাকা-দাদা দের মান ডুবিয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, শালা আলাপ করতে কে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? এটা আমার ভাইপো, এর নাম তো নিশ্চয়ই স্যারদের কাছ থেকে শুনেছো, দারুণ ক্রিকেট খেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে নাকি কাকার কোন এক বান্ধবী মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, এই গামছা গায়ে গাঁইয়াটাকে নিয়ে স্যারেরা আলোচনা করে? কাকার নাকি অনেক কষ্ট হয়েছিল এটা প্রমাণ করার জন্য যে, ভাইপো গাঁইয়া হলেও, কাকার উপর তার কোন প্রভাব পরে নি।

    গামছার নানাবিধ ব্যবহার আছে – সবাই তা জানে, নতুন কিছু তেমন অ্যাড করার নেই। কেবল আর একটি ব্যাপার – আমাদের ছোটবেলায় দশটার ক্যাস ট্রেন যেটাতে করে গ্রাম থেকে ছানা যেত কলকাতায়, সেটা আলেকালে বিশাল লেট করত। বিশেষ করে বর্ষার সময়। খুব বেশী লেট করলে আর ছানা নিয়ে কলকাতা যেত না গয়লারা। সেই বিপুল পরিমাণ ছানা লিটারেলি জলের দামে বিক্রয় হত। আর সেই সব দিনে বাড়িতে গামছার টান পড়ে যেত। জল ছানা গামছায় বেঁধে জানালার রড, কাপড় শুকুতে দেবার তার, পেয়ারা গাছের নীচু হয়ে আসা ডাল, সব জায়গায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত। জল ঝড়ে গেলে, ভারী জিনিস চাপা দিয়ে জাঁক ছানা – এবং তারপর নানাবিধ।

    গামছা আমি দীর্ঘ কাল চালিয়ে এসেছি। বি ই কলেজে ফার্ষ্ট ইয়ারে আমাদের রুমের তিন জনা গামছা, কিন্তু শ্রীরামপুরের সৌগত আঁতেল তোয়ালে ব্যবহার করত। সেই প্রথম আমার বয়সী কোন ছেলেকে আমার তোয়ালে ব্যবহার করতে দেখা। তোয়ালে কেমন করে ব্যবহার করতে হয়, মানে অত মোটা জিনিসটা ভাঁজ করে কিভাবে দুই পায়ের মাঝে সেন্সেটিভ জায়গা গুলিতে ঢোকানো যায়, মাথার জল কি ভাবে তোয়ালে দিয়ে ঝাড়তে হয় সবই সৌগতকে অবসার্ভ করে শেখা। তার বিনিময়ে অবশ্য আমাদের দীর্ঘ দিনের আকাচা তোয়ালের বিভৎস গন্ধ সহ্য করতে হয়েছিল দিনের পর দিন।

    বিদেশে প্রথমে গামছাই নিয়ে গিয়ে গিয়েছিলাম পড়াশুনা করতে যাবার সময়। যে বাড়িটায় থাকতাম, সেখানে মেয়েরাও থাকত। একদিন চান সেরে গামছা পড়ে বেরিয়েছি (কারণ আমার ঘরটা ছিল ঠিক শাওয়ারের সামনে) দেখি এক গ্রীক ললনা দাঁড়িয়ে আছে আমার পর ঢুকবে বলে। আমি একটু লজ্জিত হলাম, হাত চলে গেল প্রতিবর্ত ক্রীয়ার প্রভাবে নির্দিষ্ট জিনিস আড়াল করতে – বলাই বাহুল্য আমার পড়নে সেই পুজোর গামছাই ছিল!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১০ জানুয়ারি ২০১৮ | ১২০১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ন্যাড়া | 118.217.227.153 (*) | ১০ জানুয়ারি ২০১৮ ০৩:২৫64806
  • অনেকদিন পরে ভিন্টেজ সুকি। আরও হোক।
  • dd | 59.205.217.102 (*) | ১০ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:৪১64807
  • হা হা হা। অনবদ্য হয়েছে।
  • সুকি | 71.6.238.204 (*) | ১০ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:২৯64805
  • .
  • amit | 213.0.3.2 (*) | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৪৪64808
  • দুর্দান্ত হয়েছে। তো গামছা নিয়ে সেই গ্রিক ললনার কোনো পার্সোনাল ফিড ব্যাক পাওয়া যায়নি পরে ?
  • Du | 57.184.35.198 (*) | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৩:২৭64809
  • হাহাহা ঃ))। সাধু সাধু।
  • | 144.159.168.72 (*) | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:২৬64810
  • যা তা
  • নেতাই | 175.225.106.81 (*) | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৬:০২64811
  • ঃ))
  • শিবাংশু | 55.249.72.221 (*) | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৭:২২64812
  • "হ্যাঁয় অওর ভি গুরু মেঁ সুকনওয়র বহোত অচ্ছে,
    কহতে হ্যাঁয় সুকন কা হ্যাঁয় অন্দাজ-এ-বয়াঁ অওর...."
  • সুকি | 71.6.239.128 (*) | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৯:০৬64813
  • ধন্যবাদ সবাইকে।

    অমিতাভদা,
    গামছার বাইরে জিনিস পত্রের বর্হিপ্রকাশ নিয়ে সেই গ্রীক ললনা তো একেবারেই চিন্তিত মনে হল না। অভ্যস্ত চোখ হতে পারে! গামছাকে অবশ্য আমি 'এথিনিক টাওয়েল' বলে চালিয়েছিলাম পরে ব্যাখ্যার সময়।
  • Atoz | 161.141.85.8 (*) | ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৯:১৯64814
  • গ্রীকরা গামছা ফামছা কেয়ার করেন না। আর্কিমিদিস কেস স্মর্তব্য। ঃ-)
    তারপরেও সন্দেহ থাকলে প্রাচীন চিত্র দেখুন, গ্রীক এবং পারসিকদের লড়াইয়ের ।
    ঃ-)
  • de | 24.139.119.171 (*) | ১২ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:০৩64815
  • ইচ্ছা করে পরাণডারে গামছা দিয়া বান্ধি
    আইরন বাইরন কইলজাডারে মশলা দিয়া রান্ধি -

    বিখ্যাত গান নির্মলেন্দু বাবুর -
  • avi | 57.11.1.118 (*) | ১২ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:৫১64816
  • অনবদ্য।
    ইয়ে, রবি ঠাকুরের গামছার ওপর আরেক রেফারেন্স দিই।
    "ঠিক স্নানের অব্যবহিত পূর্বেই আমাদের শরীরের মধ্যে ভৌতিক বারণশক্তির উত্তেজনা হয় — এই তো ম্যাগ্‌নেটিজ্‌ম্‌ । ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজেরা স্নানের পরে যে গায়ে তোয়ালে ঘষে , তার কত হাজার বৎসর আগে আমাদের আর্যদের মধ্যে গামছা দিয়ে গাত্রমার্জন প্রথা প্রচলিত ছিল ভেবে দেখুন দেখি ।
    লেখকগণ । ( সবিস্ময়ে) আশ্চর্য! ধন্য! আর্যদের কী বিজ্ঞানপারদর্শিতা! আর্য কুণ্ডুমশায়ের কী গবেষণা!"
    http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/5615
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন