এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • প্রহাস

    একক লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২২ নভেম্বর ২০১৬ | ৯৩৯ বার পঠিত
  • যে ধারণ করে সে মাতা । নারীর মধ্যে এই ধারণের রূপটি বর্তমান । তাহারা কেহ জগতের যাবতীয় শংকাকে আপনার মাঝে ধারণ করিয়াছে ,কেহ আবিল আনন্দকে ।কেহ আবার সংসারের অণুপুন্খের মধ্যে যে অন্তর্লীন তিক্তভাব তাহাকে ধারণ করে । সে যেন সবুজ নবীন কারবেল্লীগুল্মের মধ্যে তিক্ততম ফলটি । প্রানীদেহ মধ্যে পিত্তের ন্যায় ।

    যৌবনদ্গমকালে ভ্রমরের অভাব হয়না । নলিনীও ব্যতিক্রম নহে । কিন্তু মধুপের দল যথাকালে টের পাইয়াছিল যে কবির নির্দেশ উল্টাইয়া দিয়া ,জিহ্বাগ্র ও হৃদয়ে হলাহলের কোনো পার্থক্য রাখেন নাই সৃষ্টিকর্তা , অন্তত নলিনীর ক্ষেত্রে।

    আধুনিক শাস্ত্রবিদরা অবশ্য বলিবেন যে কালেজের পরিবেশ নলিনীর অনুকুল ছিলনা ,ছাত্রছাত্রী শিক্ষক কেহই তাহার সহিত উপযুক্ত ব্যবহার করেন নাই , এই সমস্ত প্রসঙ্গ বেমালুম আড়াল করিয়া একা নলিনীকে দোষী ঠাউরাইতেছি কেন ? উত্তর হইল , আদপেই নলিনী দোষী নহে । আধুনিক শাস্ত্র চলে ব্যবহারযোগ্যতার নিক্তি মাপিয়া । হিংসা হউক বা তিক্ততা ওই সকল বিশেষ গুন তাহাদের নিকট দোষবাচক এবং কোনো না কোনরূপে উহা আরাম করিবার নিদান তাহাদের দোকানে রহিয়াছে । আমাদের নলিনী , সৌভাগ্যবশত ঐরূপ বিপনির খরিদ্দার নহে । তাই , ইতিহাসের মধ্যবয়েসী অধ্যাপক শশাঙ্কচরণ তাহার প্রতি প্রণয়ভাব প্রকাশ করিলে সে সটান জানাইয়া দেয় যে বিরলকেশ , দোজবরে ও মধ্যম আয়ের পুরুষের সহিত সম্পর্ক অপেক্ষা সংবাদপত্রে ঘোষণা দিয়া কোনো সোমত্থ বেকারকে বিবাহ করা শ্রেয় ।তাহাতে অন্তত লোকসমাজে একটা মহত্বের ভাব চাউর হয় , মূর্খামির না । কোনরূপ বিরাগ প্রদর্শন বিনা নেহাতই সহজভাবে এই কথাটুকু বলিয়া সে হাঁটা দেয়। শশাঙ্কচরণ আর মাথা তুলিয়া প্রত্যুত্তর করিতে পারে নাই ।ছাত্রীসকাশে এরূপ অপকর্মের দায় লইয়া আত্মধিক্কারে ডুবিয়া গিয়াছিল !

    জনপ্রিয় অধ্যাপকের অপমানে ছাত্রছাত্রীকুল অবশ্য বেজায় চটিয়াছিলো । ছাত্রীকুল বেশি , ছাত্ররা কম । যদিচ তাহাদের মধ্যেও কেহ কেহ আপনার ভাগ্য পরীক্ষা করিতে যাইয়া ততোধিক আঘাত পাইয়া ফিরিয়া আসে । ক্রমে দেখা যায় ,বিদ্যাশিক্ষার পালা সাঙ্গ করিবার কালে দৃশ্যত নলিনীর কোনো বন্ধু নাই । সে কাহাকেও গালিগালাজ করে নাই । কাহারও নামে কতৃপক্ষকে নালিশ জানাইয়া জীবন দুর্বিসহ করে নাই । এমনকি গলা উঁচু করিয়া কলহ করিতেও তাহাকে কেহ দেখে নাই । শুধু জিহ্বাগ্রে তিক্ত স্বরস্বতীর অবস্থানের কারণেই এই বিপুল সংসারে সে বান্ধবহীন ও পৃথক । অবশ্য সেই অনুভূতি তাহাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করিত এমন বোধ হয়না ।

    ইতোমধ্যে নলিনী একটি চাকুরী বাগাইলে তার পিতা অমিতেশের টনক নড়িল যে মেয়ের বিবাহকাল উপস্থিত । মাতা অবশ্য নিমরাজি ছিলেন ।অমিতেশের অবসর লইতে আর মাত্র দুই বত্সর। দোতলায় আরও দুটি ঘর না বাড়াইলে আত্মীযরা আসিলে বড় সমস্যা হয় ।

    :: আমার রোজগারে ভূতপেরেত পালন করা চলবে না । ও আমার ভবিষ্যত । যখন হাত পা চলবেনা খাবো কী?

    মাতৃদেবী তাঁর কন্যার দূরদর্শিতায় মুগ্ধ হইবেন না চমত্কৃত ভাবিয়া পাইলেন না । অমিতেশ স্থির নিশ্চিত হইলেন যে নির্বান্ধব মেয়েটিকে সংসারপুত্তলিকা গছাইবার এই উপযুক্ত সময় । কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়া খোঁজ শুরু হইল।নলিনীর পছন্দ জিজ্ঞাসা করায় কোনো উত্তর মিলিল না । শুধু বাপকে ডাকিয়া বলিল : পয়সার ছেরাদ্দ করনা ; যতই গেলাও, বরপক্ষ মানেই বে বাড়ি খেয়ে ফিরবার পথে মাছের পেটিতে কেরোসিনের গন্ধের গান গাইবে।

    যাহাই হউক , দুই চারিটি ফটো চালাচালি ও দূরভাষালাপের পর এক কন্দর্পকান্তি যুবার সহিত কলিকাতার একটি দামী রেস্তোরায় দেখা করিবার দিন স্থির হইল । এইরূপে পাত্র-পাত্রী মিলিত হওয়া নাকি আধুনিক কেতা ,দুই পক্ষের অভিভাবকগন দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষায় রহিলেন ।

    :: তা পলাশ বাবুর রোজগারপত্র নিয়মিত নাকি উচ্চবংশ ও চাঁদবদন সম্বল করিয়া বাজারে নাবিয়া পড়িয়াছেন ?

    পলাশ নবীন যুবা । দেশবিদেশী নবেল পড়িয়া ও সিনে ক্লাবে হাজিরা দিয়া মানবমনকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে দেখিতে শিখিয়াছেন । মনে করিলেন মেয়েদের মধ্যে এরূপ সেন্স অব হিউমর তো আগে কখনো দেখি নাই ! বিবাহে সম্মতি দিলেন ।অলক্ষ্যে সেদিন অপর কেহ হিউমরে শান দিতেছিলেন ।

    শ্বশুরবাড়িটি কলিকাতার একটু পুরানো এলাকায় । ভাঙ্গা পাঁচিল ও মেরামত না হওয়া বাড়িগুলিকে এখানকার মানুষজন "বনেদী" বলিতে ভালবাসে । পাড়ার সধবারা মিলিয়া নতুন বউ দেখিবার ধুম এখনো রহিয়াছে শুধু পুরাতনী ঠাট্টাতামাশা গিয়া যোগ হইয়াছে আপন আপন আম্রিগানিবাসী পুত্র কন্যাদিগের প্রসঙ্গ উত্থাপন ও প্রতিপত্তি বর্ণন । তাহারই মধ্যে কোনো পৃথুলা আসিয়া আলিঙ্গনপূর্বক নলিনীর গন্ডদেশে হাত বুলাইয়া : চাঁদের মত বউ হয়েছে গো ...বলিতেই
    নলিনী একপ্রকার গা ঝাড়া দিযা বলিল, আপনাদের সুপুত্তুরের ডাকনাম কলংক বুঝি ? পলাশ শুনিয়া হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল । বাকিদের মুখ গম্ভীর হইল ।

    পলাশের মনে গভীর প্রত্যয় ছিলো নলিনী সেই দুর্লভ নারীকুলের একজন যাহাদের হাস্যরসের মাত্রা একটু ধারালো সুরে বাঁধা । তোষামোদী কৌতুকনক্সাকে যাহারা হাস্যরস বলিয়া জানে তাহাদের নিকট উহা আঘাতের সামিল কিন্তু এরূপ মানুষদের অন্তরে কোথাও একটি সরস ফল্গু বহমান যাহার নাগাল পাইলে অন্তত এক জীবনের তৃষ্ণা নিবারণ হয় । পলাশের আদরের কুকুর ডোডো এতশত বুঝিত না | সে জন্মাবধি প্রভুর গাত্রে গাত্র ঘষিয়া ও মুখলেহন করিয়া আহ্লাদ প্রকাশ করিয়াছে । নলিনী তাহাকে বকিল না মারিল না আদপে দেখিতেই পাইল না । সে হতভাগা কয়দিন পায়ে পায়ে ঘুরিয়া আপন ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এইটুকু বুঝিয়া লইল যে এই নুতন মানুষটির সঙ্গে দুরত্ব রক্ষা করাই একজন বুদ্ধিমান সারমেয়র কর্তব্য ।

    আপিস হইতে ফিরিয়া পলাশ ও নলিনীর কার্যক্রম ধীরে ধীরে আপন ছন্দ ধরিয়া লইল । আপিসের ফাইলপত্র ঘাঁটা আর সময় সুযোগ ঘটিলে পুস্তক পাঠ । নলিনীর অবশ্য দূরদর্শনে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ শ্রবণে আগ্রহ অধিক । পলাশ সাহিত্যমোদী মানুষ । প্রথম কয়দিন নানান বিদেশী পুস্তক , লেখক এই লইয়া গল্প জুড়িবার মতলব করিয়াছিল । নলিনী সংক্ষিপ্ত উত্তরে জানায়, পরের ঘরের কেচ্ছা শুনিতে তাহার রুচি নাই । পলাশ হাসিয়া বলে , সাহিত্য তো লেখকের কল্পনা,
    পরের ঘরের গল্প ঠিক নয় । নলিনী আবার বলে , লেখক কল্পনা বেচে দু পয়সা করছে তাতে তোমার কী ? পলাশ চুপ করিয়া যায় ।

    কালের নিয়মে পলাশ ও নলিনীর একটি সন্তান হয় । শ্মশ্রুমা সোনার বালা দিয়া মুখদর্শন করেন ও নাম দেন শতদল । নামকরণের কালে
    পলাশ শংকায় কাষ্ঠবত হইয়া নলিনীর মুখপানে তাকাইয়া ছিলো , এই বুঝি কিছু বলিয়া বসে , তবে আশংকাকে মিথ্যা প্রমান করিয়া নলিনী স্মিত হাস্য প্রদান করিয়া চুপ থাকে । মা হইয়া বোধ করি তাহার কান্ডজ্ঞান হইয়াছে ।

    ঘরে ফিরিয়া নলিনী বলে : যাক বাবা বাঁচা গিয়েছে , একজনেই শত , নিরানব্বুইএর দায় থেকে উদ্ধার । পলাশ শুনিয়া বাক্যহীন হইয়া বসিয়া থাকে খানিক ।
    যদিচ রসিকতা তবু কেন যেন তারিফ করিতে পারেনা । তাহার আপিসের কাজ জমা হইয়াছিল এই কয়দিনে । তড়িঘড়ি যোগদান ও সহকর্মীদের মিষ্টি বিতরণের ন্যায় সামাজিকতায় ব্যস্ত হইয়া পড়ে।

    অপরদিকে নলিনী সদ্যজাতকে লইয়া ব্যস্ত । একমাস বাদেই তাহাকেও আপিসে যোগ দিতে হয় । শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ইহাতে খুশি হন নাই । কাজেই কীয়দ্দিবস পরেই শিশুটি নিদারুন জ্বরে পড়িলে নলিনীর দোষী সাব্যস্ত হইল । অথচ ছুটি লইবার সুযোগ তাহার ছিলনা । মুখ বুজিয়া আপিস ও হাসপাতাল দৌরদৌরী করিল কয়দিন । অবশেষে সাত দিনের ইন্ফ্লুএনযায় ভুগিয়া শিশুটি যেদিন সংসারের মায়া কাটাইলো সেইদিন নলিনীকে আর আপিস হইতে
    হাসপাতাল যাইতে হয় নাই । সরাসরি নিমতলা গিয়া শেষকৃত্য ।

    পলাশ বাস্তবিক ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল । নলিনীর কথা আমরা জানিতে পারিনা। তাহাকে কেহ কাঁদিতে দেখে নাই । তথাপি পলাশ ক্রমশ নিজের মনোকষ্ট সামলাইয়া নলিনীকে লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িল । আপিসের কোনো এক বান্ধবের পরামর্শে নলিনীকে মানসিক ব্যাধির চিকিত্সক দেখানো জরুরি স্থির করিয়াছে । কথাটি কীভাবে উত্থাপন করিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না । টেবিলে ডাক্তারের ভিসিটিং কার্ড দেখিয়া নলিনী নিজেই একদিন বলিয়া বসিল : আমার জন্যে মাথার ডাক্তার দেখছ বুঝি ? এ হপ্তায় তো হবেনা , আগামী হপ্তায় দিন ঠিক করে জানিও ।

    পলাশ ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিল :: আহা মাথার ডাক্তার না , মনের ।

    নলিনী বলিল :: যার কাছে যেটা দামী । বলিয়া পুনরায় আপনার কার্যে ব্যপৃত হইল ।

    মনোচিকিত্সক নলিনীর কোনো ব্যধি খুঁজিয়া পাইলেন না । সেইহেতু অথবা অতঃপর হাওয়াবদলের পরামর্শ দিলেন । পলাশ, পাহাড় -সমুদ্রতীরের ছবি লইয়া প্ল্যান আঁটিতে বসিল । নলিনী শুনিয়াই বাতিল করিয়া দিলো । যেখানেই যাও সেই তো পিঠে শামুকের খোল । লাভ কী ?

    অতএব প্রাত্যহিকের মাঝেই ব্যস্ততায় ডুবিয়া থাকা । নানারূপে নলিনীর মনোরঞ্জনের চেষ্টা করিয়া অবশেষে পলাশ নিশ্চিত হইয়াছিল যে আদতে কোনো সমস্যা নাই । সে শক্ত ধাতের মেয়ে ,জীবনের ওঠাপড়া ও দুর্ঘটনাকে মানিয়া লইতে জানে । পলাশ খামোখা দুর্ভাবনা লইয়া মরিতেছে । সত্যই নলিনীকে দেখিয়া অন্যরূপ মনে হইবার অবকাশ নাই । প্রভাতের এলার্ম ঘড়ির শব্দে গাত্রোত্থান হইতে , রাত্রিকালে নাসিকাগর্জনরত পলাশের বিছানা হইতে উঠিয়া স্নান করিয়া নিদ্রা যাওয়া অবধি একটি শান্ত স্বল্পভাষী মানুষ ।পলাশের কুকুর ডোডো আজকাল তাহাকে ভয় পায়না সেইরূপ , তবে আদরের চাহিদাও রাখে না । শ্মশ্রুমাতা তাঁহার সন্তানকে বুঝাইলেন এত দুশ্চিন্তার কিছু নাই , আরেকটি সন্তান কোলে আসিলেই সকল মেঘচ্ছন্নতা কাটিয়া যাইবে । এই জৈব সংসারে নিয়মের বাহিরে কবে কী ঘটিয়াছে ?

    তবে , ঠিকঠাক নিয়ম ধরিযা বেশিদিন চলিল না ।

    বছর ঘুরিতেই মনের বদলে শরীরে যন্ত্রণা লইয়া নলিনী হাসপাতালে ভর্তি হইল । শ্মশ্রুমা ঠাউরাইয়াছিলেন মাতৃপর্ব ,

    কিন্তু চিকিত্সক বিশদে পরীক্ষা করিয়া বলিলেন , দ্রুত অস্ত্রপচার জরুরি ; নলিনীর শরীরে কর্কটরোগ বাসা বাঁধিয়াছে । অবশ্য আশ্বাস দিলেন, বাঁচিয়া যাইবে এযাত্রা তবে কখনো শারীরিকভাবে সন্তানধারণ করিতে পারিবেনা । নলিনী সকল কথা শুনিল। কিছুই বলিলো না ।পলাশ নলিনীকে আশ্বাস দিলো দুশ্চিন্তার কিছু নাই । এই আশ্বাসের কোনো প্রয়োজন নলিনীর ছিলো কিনা তাহা আমরা নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি না ।

    অস্ত্রপচার যথাযথরূপে সমাধা হইল ।হাসপাতাল হইতে ছাড়িবার দিন পলাশ নিয়ম ভাঙ্গিয়া একগুচ্ছ ফুল কিনিয়াছিল । নিয়ম ভাঙ্গিয়া কারন নলিনী ফুল পছন্দ করেনা , বা বলা ভালো কোনকালে ফুলের প্রতি কোনোরূপ অনুরাগ প্রদর্শন করে নাই । হাসপাতালে পৌছিয়া পলাশ দেখিল নলিনী ফোন লইয়া ব্যস্ত , কাহাকে কিছু নির্দেশ দিতেছে । পলাশ কাছে আসিয়া নলিনীর হাত ধরিল ।

    নলিনী অন্যদিকে তাকাইয়া জলপান করিতে করিতে শুধু বলিল :: তোমার ভারী অসুবিধে হয়ে গেল যে, আর তো আমাকে ধামসে লাভ হবেনা !

    পলাশ হতচকিত হইয়া কিছু বলিতে যাইয়াও কথা গিলিয়া লইল । নলিনী তাহার সন্তানের মা হইতে পারিবেনা এর চাইতেও সে যে সুস্থজীবনে ফিরিতে পারিবে ইহাতেই সে আপাতত তুষ্ট । পুনরায় সন্তান ধারণের জন্যে মাঝের একবছর কিছু জোর করিয়াছিল বটে , তাই বোধহয় নলিনীর মনে অভিমান বাসা বাঁধিয়াছে । হাসপাতালের বাহিরে গাড়ি অপেক্ষা করিতেছিল । দুইজনে উঠিতে ছাড়িয়া দিলো ।

    ওভারব্রিজ , তাহার পর দুই দিকে রাস্তা বাঁকিয়া গিয়াছে । মধ্যিখানে গাছের সারি । শীতের আগমনে তাহারা পত্রশূন্য বলিলেই চলে । একপাশে সার দিয়া আধুনিক সাজে সজ্জিত বিপনীসকল । পোশাকবুটিকের সম্মুখে পরম যত্নে একটি নেড়া মাথা ম্যানিকিনকে ফুল হাতা পুলওভার পরাইতেছে একটি বালক । নলিনী ফোন ধরিল । ইঙ্গিতে গাড়ির চালককে বলিল ফুটপাথ ঘেঁসিয়া দাঁড়াইতে । পলাশ জিজ্ঞাসু মুখে তাকাইলে নলিনী শান্তভাবে বলিল : শোন , আমাকে নিতে গাড়ি আসবে । তুমি বাড়ি ফিরে যাও ।

    :: গাড়ি ? আজকেই অফিস না গেলে নয় ? কদিন বিশ্রাম নিয়ে যেতে ।

    :: না , অফিস নয় । না বল্লেও চলত , সময় নেই সাতকাহন শোনাবার । হিমাচলে একটা ছোট চাকরি নিয়েছি । ঠিকানা জানতে চেওনা । আইনি ডিভোর্স দরকার হলে ইমেলে জানিও। আমার যা ব্যাঙ্ক একাউন্ট ছিলো ক্লিয়ার করে তুলে নিয়েছি । আর হাসপাতালের খরচ আমার আপিস দিয়ে দেবে , কাগজ সব সই করা আছে । তোমার টাকায় হাত পরেনি ।

    নলিনী গাড়ির দরজা খুলিতেছিল ।আধুনিক মডেল । ল্যাচ টানিতে হয়না । সুক্ষ বোতাম।
    পলাশ কথা খুঁজিতেছিল । অতীত -ভবিষ্যত - পড়া -না পড়া কোনো বিদ্যাতেই এইরূপ পরিস্থিতির সম্যক সংলাপ বর্ণনা করে নাই ।
    সর্বাপেক্ষা মুশকিল ইহা রসিকতা না অন্য কিছু তাহাই পলাশের মাথায় আসিতেছিল না । পশ্চাতে আটকাইয়া থাকা দুটি মোটরকার ক্রমাগত হর্ন দিতেছিল ।

    পলাশ একবার জানালা দিয়া হাত মুখ বাড়াইয়া বলিল : কেন এরম করছ ?

    নলিনী তাহার ট্রলিব্যাগের চাকা ফুটপাথের উপর ন্যস্ত করিতে করিতেছিলো :: আমার যা ছিলো তা তো গেছেই । এবার রইলাম আমি । এদিয়ে তোমার বা তোমাদের কোনো ফায়দা নেই ।চোখ বুজলে টাকাগুলো ভুতে খাবে ।বরং নিজেই ভোগ করি বাকি কদিন ।

    পশ্চাতে আরও তিনটি মোটরগাড়ি জুটিয়াছে । তীব্র হর্নের শব্দ । পলাশ একমুহুর্তের জন্যে ভাবিল এ চরম রসিকতা ! এইভাবে কেহ চলিয়া যাইতে পারে নাকি । নলিনীর মনের গভীরে এই তীক্ষ্ণ রসবোধকে পলাশ না বুঝিলে কে বুঝিবে ? পিছনের গাড়ি হইতে ড্রাইভার আসিয়া জানলায় টোকা দিতেছিল । কিছু করিতে হইবে । ড্রাইভার পলাশকে ইঙ্গিত করিতেছে গাড়ি ছাড়িয়া দিবে কিনা ।

    ফুটপাথের উপর নলিনীর মূর্তিটি ক্রমশ দূরবর্তী হইতেছে । পত্রহীন শুস্ক গাছের সারি । তাহার নীচ ধরিয়া মাথা অল্প ঝোঁকাইযা ট্রলি ব্যাগ টানিয়া নলিনী চলিতেছে। ঠিকানা চাহিয়া লইবে ? হাতে পায়ে ধরিযা বাড়ি ফিরিতে অনুরোধ করিবে ?

    পিছনের গাড়ি হইতে আরেকজন ড্রাইভার নাবিযা আসিয়া জানলায় টোকা দিতেছে । সরু লেনে পলাশের বিশালবপু গাড়ি একপাশে দাঁড়াইলেও আরেকটি বড় গাড়ি যাইবার জায়গা নাই । নলিনী ইউ টার্ন ধরিয়া মিলিয়া যাইতেছে ধীরে ধীরে ।পলাশ ড্রাইভারের দিকে ফিরিয়া স্টার্ট লইতে ইঙ্গিত করিল ।

    ওভারব্রিজের নীচে সুদৃশ্য রাস্তা । গাড়ির কাঁচ তোলা হয় নাই তাই ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা মুখে লাগিতেছে । উল্টোদিকের রাস্তায় কোনো একটি জুলুস বাহির হইয়াছে । মুখোশ ও বিবিধ সাজপোশাক পরা নরনারী -ব্যান্ডের বাদ্য । রোদ্দুর গায়ে লাগিয়েও চামড়া ভেদ করেনা । এমন অকারন অথচ উজ্জ্বল সকাল অনেকদিন দেখে নাই । পলাশ জানালা ঘেঁসিয়া পা ছড়াইয়া বসিল ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২২ নভেম্বর ২০১৬ | ৯৩৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    নাইটো - একক
    আরও পড়ুন
    সিপাহী - একক
    আরও পড়ুন
    স্বাদ - একক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একক | 53.224.129.44 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০৬:১৮54899
  • #
  • একক | 53.224.129.44 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০৬:৪৫54900
  • এহ বাজে টাইপো আছে । হালার গুগল ট্রান্স
  • ছোটোলোক | 198.155.168.109 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০৭:০২54901
  • খুব ভাল হয়েছে।
  • Atoz | 161.141.85.8 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০৮:৫৭54902
  • খুব ভালো লাগল গল্প।
    যদিও শশাঙ্কচরণকে আমি বারে বারে শঙ্কাচরণ পড়ে গেলাম। ঃ-)
  • d | 144.159.168.72 (*) | ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৫:২৫54903
  • ভারী ভাল গল্প। ভারী ভাল।

    এদিকে লেখার স্টাইলে শরদিন্দুর অপ্রাক্শিত বলেও চালিয়ে দেওয়া যেত।কিন্তু যাবেনা কনসেপ্টটার জন্যই।
  • d | 144.159.168.72 (*) | ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৫:২৬54904
  • *অপ্রকাশিত
  • de | 69.185.236.54 (*) | ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৮:০৯54905
  • খুউব ভালো!
  • kumu | 69.178.35.125 (*) | ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ১১:৫৫54906
  • বলছিলাম পেমেন্ট মিটিয়ে না দিলে হসপিটাল থেকে পেশেন ছাড়বে ?
  • de | 24.139.119.171 (*) | ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ১২:০৬54907
  • অস্পাতালের খ্চ্চা তো আপিস দেবে নিকেচে -
  • একক | 53.224.129.50 (*) | ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ১২:৫৫54908
  • হ্যা , অফিস একাউন্ট থেকে পেইড । "দেবে" নয় । ওখানটা একটু ক্লিয়ার করে দেওয়া দরকার ছিলো । এটা আসলে একেবারেই এডিট করা হয়নি ।
  • Soumyadeep Bandyopadhyay | 122.133.223.2 (*) | ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ ১০:২৪54909
  • সরেস ঃ)
  • কান্তি | 113.57.239.5 (*) | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:৫৮54910
  • যথার্থ আধুনিক গল্প। পড়ে আনন্দ পেলাম। এককের এ পর্যন্ত এখানে লেখা গল্পের মধ্যে সেরা, আমার মতে অবশ্য।
  • একক | 53.224.129.56 (*) | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:০৮54915
  • একাধিক অর্থ আছে । এখানে দমকা হাসি অর্থে ব্যবহৃত ।
  • ঈশান | 183.24.110.20 (*) | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:১১54911
  • এই গপ্পোটা খাসা হয়েছে।
  • সিকি | 132.177.149.115 (*) | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৫:২৮54912
  • খুব মনোগ্রাহী গপ্পো। তবে আমি কিনা বানানচাড্ডি -

    ওটা হবে অস্ত্রোপচার। একটা ও-কার মিসিং হয়ে গেছে সর্বত্র।
  • সিকি | 132.177.149.115 (*) | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৫:২৯54913
  • আর ইয়ে - পলাশকে বড্ড বেশি শাস্তি দেওয়া হয়ে গেল মনে হচ্ছে।
  • sinfaut | 11.23.253.46 (*) | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৬:৪৮54914
  • প্রহাস মানে কী?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন