এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • #সফরনামা -৬

    Roshni Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ নভেম্বর ২০১৬ | ১২১৬ বার পঠিত
  • পড়ন্ত জানুয়ারির বিকেল। খাটের ওপরে লেপ মুড়ি দিয়ে "সুহানের স্বপ্ন" পড়ছি হঠাৎ করে ফোন টা ঝনঝন করে বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখি, ঐশ্যারিয়া (অ্যাশ) ফোন করেছে। অ্যাশ আমার সাথে সেইন্ট জন্স ইউনিভার্সিটিতে পড়তো, আজকাল বোস্টনে একটা স্টার্ট-আপে চাকরি করে। ভাবলাম, নিশ্চই নিউ-ইয়র্ক আসছে সেটা জানবার জন্য ফোন করেছে। কিন্তু তা নয়, ফোন তুলতে অ্যাশের প্রশ্ন,
    "বেড়াতে যাবি?"
    "কোথায় রে? কবে?"
    "এক্ষুনি ক্রেটার লেকের ছবি দেখছিলাম। সিম্পলি অসাধারণ। আমার এপ্রিলে একটা লং উইকেন্ড আছে, তার সাথে এক-দুদিন জুড়ে ঘুরে আসাই যায়, কিন্তু একা যেতে ইচ্ছে করছে না। তুই যাবি? তাহলে বেশ একটা গার্লস ট্রিপ হয়।"
    বেড়াতে তো আমি সব সময়েই এক পায়ে খাড়া, চ্যাটকেও ভুজুং ভাজুং আর এরপরেই ওর সাথে ভার্জিন আইল্যান্ড বেড়াতে যাবো কথা দিয়ে রাজি করিয়ে ফেললাম কটা দিন একা একা থাকতে। এইবার শুরু হলো আমাদের ম্যারাথন ট্রিপ প্ল্যান। একটাই বড় সমস্যা, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, আর অ্যাশের যদি বা আছে, ও আবার হাইওয়েতে গাড়ি চালাতে ভয় পায়। আর মুশকিল হলো, ক্রেটার লেকের আশেপাশে কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন নেই।
    তা সব রিসার্চ টিসার্চ শেষ করে বেড়ানোর যেটা প্ল্যান হলো সেটা এরকম, আমি নিউ ইয়র্ক আর অ্যাশ বোস্টন থেকে ফ্লাই করে পোর্টল্যান্ডে মিট করবো। রাতে পোর্টল্যান্ড থেকে পরের দিন সিটি ঘোরা, দুপুরবেলা আমট্রাক ধরে রাতে ক্লাম্যাথ ফলস পৌঁছাবো, পরের দিন ওখান থেকে একটা টুর কোম্পানি আমাদের নিয়ে ক্রেটার লেক ঘুরিয়ে এনে বিকেলে অ্যাশল্যান্ডে ছেড়ে দেবে। সেখান থেকে রাত তিনটের বাস ধরে পোর্টল্যান্ড ফেরত। ঘোরাঘুরি সেরে বিকেলে আবার আমট্রাক ধরে সিয়াটল যাত্রা, সেখানে দুদিন ঘুরে যে যার শহরে ফেরত।
    সবই মোটামুটি ঠিক শুধু অ্যাশল্যান্ডে বিকেল থেকে রাত তিনটে অবধি অপেক্ষা করতে হবেই মনটা একটু খুঁতখুঁত করছিলো। অ্যাশকে সেটা বলে ও বললো যে ও টুর কোম্পানির সাথে কথা বলেছে, আশলান্ডে একটা বার আছে, আমরা সেখানে বসেই বাসের জন্য অপেক্ষা করতে পারবো।
    তো যাকগে পুরো টুরের গল্প আর এখানে বলবো না। সেটা পরে কখনোর জন্য তোলা থাক। আজকে যেটার গল্প বলতে বসেছি সেটাই বলি বরং। ক্লাম্যাথ ফলসে যেতে যেতেই মেইল পেলাম যে, পরের দিনের ট্রিপে শুধু আমরা দুজনই যাচ্ছি। তাই টুর বাসের বদলে, একজন গাইড তার নিজের গাড়ি নিয়েই আমাদের ক্রেটার লেক ঘোরাতে নিয়ে যাবেন। আমি আর অ্যাশ তো খুশ হয়ে গেলাম। বাবা, এতো একদম পার্সোনালাইজড টুর হয়ে গেলো।
    পরের দিন সকালে ৯ টা নাগাদ রেডি হতে হতেই আমাদের গাইড হাজির। বেশ মধ্যবয়স্ক একজন লোক, রোদে পুড়ে গায়ের রং লাল তকতকে হয়ে গেছে। বোঝা যায় উনি সারাদিন আউটডোরে থাকতেই অভ্যস্ত। মুখটা হাসিখুশি, দেখলেই মনে হয় সব সময়ে খুব আনন্দে আছেন। আমাদের দেখেই হৈহৈ করে উঠলেন, "তোমরাই রোশনি আর অ্যাশ? আমি জিম, তোমাদের গাইড। তাড়াতাড়ি চলো, আজকে ভীষণ ভালো দিন, একদম হাওয়া নেই, আজকে তোমরা ক্রেটার লেকের অসাধারণ ছবি পাবে।"
    আমাদের থেকেও চারগুন উৎসাহ ওনার। ভদ্রলোকের বাড়ি অ্যাশল্যান্ডের কাছে। তবে সারাজীবন কাটিয়েছেন আলাস্কায়। একটা অয়েল রিগে শ্রমিকের চাকরি করতেন, ওনার গল্পের ভাঁড়ার প্রচুর। আর জিওগ্রাফিতে ইন্টারেস্ট আছে বলে লোকাল এরিয়া সম্পর্কে জ্ঞানও অসামান্য। লোকাল এরিয়ার জিওগ্রাফি, শিল্প, আশেপাশের নেটিভ আমেরিকানদের হিস্ট্রি টপিকের পর টপিক আমাদের শোনাতে শোনাতে ক্রেটার লেক দেখাতে নিয়ে চললেন জিম।
    তা ক্রেটার লেক কেমন দেখলাম, সে গল্প বলে আর আপনাদের দুঃখ দেব না। শুধু এটুকু বলতে পারি, "আহা, কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিবো না।" অদ্ভুত একটা ঘন নীল রং, আর হাওয়া নেই বলে আকাশের নিখুঁত প্রতিবিম্ব পড়েছে লেকের মাঝে, হাজার ভালো ক্যামেরার সাধ্যি নেই সে দৃশ্য সঠিক ভাবে ক্যাপচার করে। দুপুরের লাঞ্চটা খেলাম পাশের ক্যাফেটেরিয়াতে বসে লেক দেখতে দেখতে। জিম তারপর নিয়ে গেলেন ক্রেটার লেকের হিস্টোরির ওপারে একটা ডকুমেন্টারি দেখাতে। এবার আমাদের ফেরার পালা। ফেরার পথে জিম নিয়ে গেলেন একটা ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্ক আর ট্রাউট ফার্ম দেখাতে। এগুলো আমাদের টুর প্ল্যানে ছিলোনা। জিমকে সেটা বলতে বললেন "ধরে নাও, ভালো টুরিস্ট হওয়ার জন্য তোমাদেরকে বোনাস পয়েন্ট দিলাম।" তা সেসব দেখেও শেষ করে এবার অ্যাশল্যান্ড ফেরার পালা। জিম জিগেস করলেন "কোথায় ছাড়বো তোমাদের? আজকে কি হোটেল এ থাকবে?" আমি বললাম "নাহ, আমাদেরকে বাসস্টপে যেতে হবে. রাত তিনটায় বাস।" জিম দারুন অবাক হয়ে বললেন "সেকি? এখন তবে বিকেল তিনটে। অ্যাশল্যান্ড পৌছাবো ধরো অ্যারাউন্ড ৪:৩০। তখন থেকে রাত ৩টে অবধি করবেটা কি তোমরা?" অ্যাশ তখন বললো থ্রি ডটার বারের কথা। জিম কিছু বললেন না, কিন্তু মুখটা দেখি গম্ভীর হয়ে গেছে।
    অ্যাশল্যান্ড পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৪:৩০ তে বেজে গেলো। জিম আমাদের নিয়ে চললেন থ্রি ডটার বারের দিকে। ওখানে নামতেই দেখি জিম ও গাড়ি পার্ক করে পেছন পেছন আসছেন। আমাদের টাকাপয়সা ওনাকে মেটানো হয়ে গেছিলো, তাই একটু অবাক হয়েই জিগেস করলাম "কি হলো জিম? কিছু ফেলে এসেছি নাকি গাড়িতে?" "না, তা ঠিক নয়। তোমরা দুটো একলা মেয়ে, একটা অচেনা জায়গায় এতো রাত অবধি থাকবে তাই একটু খোঁজ নিয়ে যাবো সব ঠিকঠাক আছে কিনা।" বলেই আমাদের দুজনকে প্রায় বগলদাবা করে হাজির হলেন বারটার ম্যানেজারের কাছে। দুঃসংবাদ, বারটা রাত ১ টায় বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে ছোট জায়গা, ওই বারটা ছাড়া আর কোনো কিছুই অত রাত অবধি খোলা থাকেনা। অ্যাশের তো শুনেই মুখ শুকিয়ে গেছে। আমার একটু একটু ভয় করছে। তাও জোর করে মুখে হাসি টেনে বললাম, "চল, গ্রেহাউন্ডের ওয়েটিং রুমে যাই, ওখানে নিশ্চই অপেক্ষা করতে দেবে।"
    গ্রেহাউন্ডের ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখি একজন কর্মচারী সেখানে তালা লাগাচ্ছেন। জিগেস করে বললেন কিছু হোমলেস আর ড্রাগ ইউসার রেগুলারলি ওয়েটিং রুমে ঢুকে বসে থাকে, তাই নতুন পলিসি অনুযায়ী বাস আসার মাত্র আধ ঘন্টা আগে ওয়েটিং রুম খোলা হয়. মানে রাত ২:৩০ টের আগে এদিকেও কোনো আশা নেই। এবারে সত্যি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। রাত ১টা থেকে ২:৩০ টে কোথায় যাবো আমরা?
    জিম দেখি ইতিমধ্যে একটু দূরে চলে গিয়ে কাকে ফোন করছেন। ফোন শেষ হতেই হাসি মুখে এগিয়ে এসে বললেন "কোন চিন্তা নেই, চল গাড়িতে ওঠো, আমার বাড়িতে নিয়ে যাই তোমাদের। ২:৩০ টা নাগাদ আবার এসে তোমাদের ছেড়ে দেব।" আমি তো শুনেই প্রবল আপত্তি শুরু করলাম, "না না সে হয় না। তোমার বৌয়ের ওপর খুব চাপ পড়বে। চেনে না শোনে না, এখন আমরা দুজন গেলে তোমাদের অনেক অসুবিধে হবে। আর তার ওপরে তোমার কালকেও টুর আছে, রাত ২:৩০ টায় আমাদেরকে পৌঁছে, তারপর বাড়ি গেলে তুমি কখন শোবে আর কখন ঘুমোবে? তোমার ওপর এতো অত্যাচার করতে পারব না।" জিম দু মিনিট হাসিমুখে আমাদের বক্তব্য শুনলেন। তারপর খুব ফার্মলি বললেন " এতক্ষন বৌয়ের সাথেই কথা বলছিলাম। ওই সাজেস্ট করলো তোমাদেরকে বাড়ি নিয়ে আসতে। ইনফ্যাক্ট, বরং তোমাদেরকে বাড়ি না নিয়ে গেলেই আমার কপালে দুঃখ আছে।" অ্যাশ এতক্ষন চুপচাপ শুনছিলো, এবার এগিয়ে এসে বললো "জিম, আমার একটা সাজেশন আছে, আমরা বরং এখন থেকে ডিনার করে একটা ক্যাব নিয়ে তোমার বাড়ি যাই, আর তারপর ওই ক্যাবটাই আবার আমাদের ২:৩০ তে নাগাদ পিক আপ করে এখানে পৌঁছে দেবে। দেখো, এখন অলরেডি ৫:০০ তা মতন বাজে, এখন হঠাৎ করে ডিনারে দুজন বাড়তি লোক হাজির হলে অসুবিধা হবে। তুমি বরং তোমার বৌকে এখানে চলে আসতে বলো, আমরা একসাথে ডিনার করবো।" জিমের আবার এব্যবস্থায় প্রবল আপত্তি। শেষ কালে রফা হলো, জিমরা বাড়িতে ডিনার করবে আর আমরা এখানে আর তারপর আমরা দুজন ক্যাব নিয়ে ওর বাড়িতে যাবো।
    জিম দেখি এরপর গিয়ে এক ক্যাব ড্রাইভারকে ধরেছেন "এই যে দুটো মেয়েকে দেখছো, ওরা এখন থ্রি ডটারে ডিনার করবে, তুমি তারপর ওদের তুলে নিয়ে আমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে, আবার রাত ২:১৫ নাগাদ ওদের তুলে এখানে পৌঁছে দেবে, যাতে ওরা রাতের বাসটা ধরতে পারে। আর শোনো, ওরা বাসে না ওঠা অবধি অপেক্ষা করবে কিন্তু। এই আমার নাম-ঠিকানা আর ফোন নম্বর রইলো। ওরা দুজন কিন্তু এখানে কিছু চেনেনা। কোন অসুবিধা হলেই আমাকে ফোন করবে। ক্যাব ড্রাইভার ও দেখি খুব ঘাড় নেড়ে নেড়ে জিমের কথা শুনছে। অ্যাশ ফিসফিস করে বললো "বুঝলি এক গার্জেন আরেক গার্জেনকে ডিউটি হ্যান্ডওভার করছে।"
    কথাটথা শেষ হলে, আমাদেরকে রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়ে আমাদের মালপত্র নিয়ে জিম চলে গেলেন। আর আমরা দুই মূর্তি ঢুকলাম ডিনারে। খেয়েদেয়ে, একটু ডেসার্ট আর ওয়াইন কিনে দুজনে চললাম জিমের বাড়ি। জিমের বাড়িটা একদম সাবার্বের মধ্যে, ছোটোখাটো বাড়ি, দেখলেই বোঝা যায় বেশ মধ্যবিত্ত পাড়া। আমরা দুজনে বেল টিপতে, জিম দরজা খুলেই হৈহৈ করে উঠলেন, "হেলেন, আমাদের গেস্টরা এসে গেছে।" জিমের বৌ, হেলেনও ততক্ষনে দরজায় হাজির। জিমের মতনই বয়েস, একটু মোটাসোটা ভারিক্কি গোছের মহিলা, মুখের মধ্যে একটা স্নেহময়ী মা, মা ভাব। এসেই জিমকে একটা ধমক, "আহ জিম, ওদেরকে ঢুকতে দেবে তো? এস, এস, আমি হেলেন। তোমরা তো নিশ্চই সারাদিন ঘুরে টায়ার্ড হয়ে গেছো। রেস্টরুমটা ওদিকে, ঝটপট করে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও, ভালো লাগবে। আমি বরং তোমাদের জন্য একটু কফি বানাই। আচ্ছা, তোমরা কফি খাও তো? ইন্ডিয়ানরা তো শুনেছি খালি চা খায়। আমার কাছে ভালো চাও আছে। আমরা আসলে আগে কখনো কোনো ইন্ডিয়ানকে মিট করিনি। তাই ঠিক সিওর না, তোমাদের কি ভালো লাগবে।" ভালো আর লাগবে কি? কন্টিনুয়াস কথার তোড়ে আমরা তখন হতভম্ব। হেলেন একটু থামতেই বলে উঠলাম, "না না, আমাদের নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না. আমরা চা, কফি সব খাই। ইনফ্যাক্ট আমরা ডেজার্ট আর ওয়াইন এনেছি। আমরা ফ্রেশ হয়ে এলে ওগুলোও খাওয়া যেতে পারে।"
    ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতেই হেলেন দুজনকে দুটো চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলেন। চা খেতে খেতে ওদের সাথে গল্প করছিলাম। হেলেন স্থানীয় একটি স্কুলের স্পেশাল এডুকেশন টিচার। একটিই ছেলে, সে এখন আলাস্কাতে চাকরি করে। জিম এখানে বড় হয়েছে, তাই রিটায়ারমেন্টের পর এখানে চলে এসেছেন। এবছর ওনাদের বিয়ের ৪৫ বছর হবে। জিম ততক্ষনে পাশ থেকে ফুট কাটছেন "ওদেরকে আমাদের বিয়ে গল্পটা বলো। কত কষ্ট করে তুলেছিলাম তোমাকে।" হেলেনের মুখে তখন নবকিশোরীর লজ্জা, "তোমার ওই গল্পটা যে আসে, তাকেই বলতে লাগে, তাই না?" জিমও নাছোড় "আরে, ওটা আমার জীবনের বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট, লোককে না বললে চলে? বুঝলে হে ছুকরিরা, আজকে যে এই মহিলাকে দেখছো, যিনি এককালে মিস আলাস্কা ছিলেন। তা ওনার ক্রাউনিং এর পর একদিন আমাদের অয়েল রিগ দেখতে এসেছিলেন। তখন ওনার আশেপাশে, আগে পিছে রোমিওদের ভিড়. আমি আর চান্স পাইনা।"
    "তা তখন কি করলেন?" "আমিও বাবা চালু ছেলে, খোঁজ নিয়ে দেখলাম, হেলেনের কুকুরটা ওর বড্ডো প্রিয়। তাই আমি হেলেনকে ছেড়ে ওর কুকুরকে পটাতে শুরু করলাম। তারপর সে এমন হলো কুকুর আর আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। হেলেন আবার কুকুরকে ছেড়ে থাকতে পারেনা। কাজেই আমি ঝোপ বুঝে কোপ মারলাম যে আমাকে বিয়ে করলেই প্রব্লেম সল্ভড। ব্যাস বিয়ে হয়ে গেলো।" হেলেন এতক্ষনে লজ্জারুণ মুখে প্রতিবাদ করলেন "যাহ, আমি মোটেই টমির জন্য তোমাকে বিয়ে করিনি। তোমাকে ভালো লাগতো, তাই বিয়ে করেছি।" জিম খুশির চোটে চেয়ার ছেড়ে একদম লাফিয়ে উঠে পড়লেন "সত্যি? প্লিজ প্লিজ আরেকবার বলো।" "আর বলবো না, তুমি ওটা শোনার জন্যই বারবার ওই অ্যাবসার্ড গল্পটা সবাইকে বলো." জিমের মিচকি হাসি সমেত কমেন্ট, "আহা, বলি বলেই না তুমি সবার সামনে বারবার আমাকে আই লাভ ইউ বলো."
    দম্পতির এই খুনসুটি দেখতে বড্ডো ভালো লাগছিলো। মনে মনে ভাবছিলাম, আমরাও যেন বিয়ের ৪৫ বছর পর এরকমই থাকতে পারি। এরপর শুরু হলো ওয়াইন আর ডেসার্ট সমেত আড্ডা। কি নেই তাতে? হেলেন আর জিমের প্রচুর পড়াশুনা আর ইন্ডিয়া নিয়ে প্রবল আগ্রহ। কাজেই গল্পের টপিসের অভাব নেই। গল্প করতে করতে কখন ১০:৩০ টা বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি। হেলেন হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ ফেলেই জিমকে আরেক ধমক "তোমার আর কোনোদিন আক্কেল হবেনা। মেয়েগুলোর মাঝরাতে উঠতে হবে, তুমি এখনো ওদের বসিয়ে রেখে গল্প করছো।" জিম মিনমিন করে বলতে চেষ্টা করলেন "ডার্লিং, তুমিও তো......." "আমি যা করি, করি, তা বলে তুমিও করবে?" এপ্রশ্নের উত্তর হয়না, তাই বোধহয় জিম চুপ করে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন।
    হেলেন এরপরে নিয়ে গেলেন একটা বেডরুমে। "তোমরা আসবে শুনেই বিছানা পেতে রেখেছি। চটপট এখানে শুয়ে ঘন্টা তিনেক ঘুম লাগাও। ১:৪৫ এর অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি। আর কফিমেকারে জল ও ভরা আছে. সকালে উঠে, ওখান থেকে চা বা কফি খেয়ে বেরিয়ো। আর শোনো, বেরোবার সময় সদর দরজাটা টেনে দিয়ো, অটোলক আছে, বন্ধ হয়ে যাবে।" আমরা কিন্তু কিন্তু করে বললাম "কিন্তু তুমি তো আমাদের চেনোও না, আমাদের ভরসায় বাড়ি খোলা রেখে ঘুমোতে যাবে?" হেলেন এতক্ষন ভালোভাবে কথা বলছিলেন হঠাৎ আমাদেরকেও জিমের মতোই ধমকে উঠলেন, "ননসেন্স, চিনিনা মানে? এতক্ষন তাহলে কি করলাম? কোন আপত্তি করবে না, ঝটপর্ট শুতে যাও। কাল-পরশু তো আবার টইটই করে ঘোরা আছে, আর ফিরে গিয়েই অফিস। একটু না ঘুমোলে চলবে কেন?" বলেই আমাদের দুজনকে এক এক করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন "গড, ব্লেস ইউ মাই চাইল্ডস। তোমাদের সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো। দুজন বুড়োবুড়ি একা থাকি, তোমরা এলে, সন্ধ্যেটা খুব ভালো কাটলো।" আমরাও ততক্ষনে জড়িয়ে ধরেছি ওনাকে। গায়ে কি সুন্দর মা-মা গন্ধ। জিম ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকে বললেন "আমি তোমাদের বাড়িতে আনলাম, আর তোমরাও ওর দলে হয়ে গেলে?" অ্যাশ বললো "কেন? হয়েছেটা কি?" জিম একদম অভিমানী বাচ্ছাদের মতন ঠোঁট ফুলিয়ে বললেন "আমার হাগ্ কই? আমি কফি খাওয়াইনি বলে, হাগ্ও পাবনা?" জিমকেও জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিলাম দুটো। এরপর আমাদেরকে গুড নাইট বলে দম্পতি শুতে চলে গেলেন। আমরাও ঝটপট শুয়ে পড়লাম ঘন্টা দুই ঘুমোতে।
    অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙলে, আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে গিয়ে রেডি হলাম। তারপর কিচেনে গিয়ে দেখি, শুধু কফি নয়, তার পাশে দুটো ক্রয়স্যা আর দুটো আপেল রাখা। পাশে ছোট চিরকুট, "পোর্টল্যান্ড পৌঁছাতে সকাল নটা বেজে যাবে। এগুলো সকালে খেয়ে নিয়ো, নয়তো খিদে পাবে।" অ্যাশের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে জল, আমারও চোখটা জ্বালা করছে তখন. একটা কাগজে দুজনে থ্যাংক ইউ নোট লিখে যখন বেরোলাম, তখন ঘড়িতে ২:১৫.
    বেরিয়ে দেখি আমাদের ক্যাব ড্রাইভার হাজির। খুশি খুশি মুখে বললাম "বাহ্, তুমি তো একেবারে অন টাইম" সে বললো "টাইমে না এলে চলবে? তোমরা আমাদের শহরের অতিথি না?" যেতে যেতে তার সাথেও একটু গল্প হলো, যে ক্যাবটায় যাচ্ছি ভদ্রলোক সেই ক্যাব কোম্পানিটার মালিক। পাশের শহরে থাকেন। আজকে এসেছিলেন এদিকে, রুটিন দেখাশুনো করতে। জিম সে সুযোগে ওনাকে পাকড়েছে। অ্যাশ জিজ্ঞাসা করলো "তাহলে তুমি এলে এতো রাতে? তোমার কোনো এমপ্লয়ীকে পাঠালেই তো পারতে। তুমি এতো ঝামেলা নিলে কেন?" ডিলান খুব গম্ভীর হয়ে বললেন "আমার একটা দায়িত্ব নেই? জিম আমার ভরসায় তোমাদেরকে পাঠিয়েছে। আমি সেই রেস্পন্সিবিলিটি অন্যের ঘাড়ে কি করে ট্রান্সফার করবো? বিসাইডস, আমি নিজেকে যতটা ট্রাস্ট করি, সেটা তো বাকিদের করিনা। তাই সে প্রশ্নই ওঠে না।" এ কথার পর আর কথা ওঠে না. তাই আমরাও চুপ করে গেলাম।
    যখন বাসস্টেশনে পৌছালাম ঘড়িতে তখন ২:৪০। ডিলান আমাদের নামিয়ে বললেন "আমার ফোন নম্বরটা লিখে নাও। এখানে গাড়ি পার্ক করার জায়গা নেই আশেপাশে, তাই আমি গাড়িটা নিয়ে চারপাশেই চক্কর দিচ্ছি। কোন অসুবিধা হলেই ফোন করবে।" আমরা বলবার চেষ্টা করলাম বাস স্টেশনে যখন পৌঁছে গেছি, আমরা ঠিক বাসে উঠে যেতে পারবো। কিন্তু কে কার কথা শোনে। ডিলানেই এক গোঁ, আমাদের বাসে না উঠিয়ে উনি যাবেন না। তা আমরা অগত্যা মাল পত্র নিয়ে বসে রইলাম বাস স্টেশনে। দশ মিনিট পর পর ডিলানের টেক্সট আসছে, "সব ঠিক আছে তো?" প্রায় ৩:০৫ নাগাদ টেক্সট এলো "তোমাদের বাসটা আসছে।" বাস এলো, আমরাও উঠে পড়লাম। জানলার ধারে আমার সিট্। ডান দিকে চোখ পড়তেই দেখি ডিলান হাসি মুখে টাটা করছেন। এক ঘুমে বাকি রাত কাবার। সকালে উঠতে উঠতেই দেখি জিম আর ডিলানের টেক্সট, ঠিকঠাক পৌঁছেছি কিনা আমরা।
    রুরাল আমেরিকা নিয়ে আমার ধারণা খুবই সীমিত। কিন্তু আজকে যখন ফেসবুকে সারাক্ষন পড়ছি রুরাল আমেরিকানরা মিসোজিনিস্ট, রেসিস্ট বা জেনোফোবিক তখন আমার হঠাৎ করে হেলেন, জিম, ডিলানের মুখগুলো মনে পড়ছিলো। দুটো অচেনা বাদামি চামড়ার মেয়েকে পরম স্নেহে বাড়িতে নিয়ে তাদের ভরসায় বাড়ি ছেড়ে নিশ্চিন্তে ঘুম লাগান যে দম্পতি, বা অচেনা দুটো মেয়ের জন্য যে ক্যাব কোম্পানির মালিক আদ্ধেক রাত জেগে পাশের শহর থেকে ছুটে এলেন তাদের বাস ধরাতে, তাদেরকে আর যাই বলি এই লেবেলগুলো লাগাবো কি করে? এসেছিলাম ক্রেটার লেক দেখতে, সাথে নিয়ে ফিরলাম আরো কিছু অপূর্ব স্মৃতি, মানুষের প্রতি বিশ্বাসের, ভালোবাসার।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ নভেম্বর ২০১৬ | ১২১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 37.58.168.232 (*) | ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:২৯54886
  • আবারও দারুণ লাগল।
  • aranya | 154.160.226.92 (*) | ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৬:৪৮54887
  • খুব সুন্দর। মানুষের ওপর বিশ্বাস ফিরে আসে, এরকম গল্প পড়লে
  • Nina | 84.209.30.85 (*) | ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৭:০৬54888
  • বড় সুন্দর ----
  • reek | 94.246.168.11 (*) | ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৮:১৭54885
  • মনে ভরে গেলো রোশনি । আমি বরাবর দেখেছি এক এক দুমদাম যখন বেড়িয়েছি এরকম অনেক অনেক অচেনা মানুষ মধুসুধন দাদা হয়ে এগিয়ে এসেছেন । তাই আমি মানুষের ভালোবাসার ভরসার গল্পই ভালোবাসি । অনেক ধন্যবাদ :)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন