এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সর্বস্বান্ত

    শর্মিষ্ঠা নাহা লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৮ মে ২০১৬ | ৫৮৬ বার পঠিত
  • #সর্ব

    অদ্যকার দিবস আমার জীবনে এক পরম আনন্দের দিবস হইতেই পারিত। অদ্য বৈকালে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রাঙ্গণে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার সপত্নী( প্রয়াত স্বামীর পঞ্চম পক্ষীয় বিধবা) নয়নতারা দেবী ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম অনুসারী শ্রীযুক্ত প্রভাসচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের সহিত পুনর্বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়িলেন। বিধবা বিবাহ হইলেও উহা সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হইল। রাঙাদিদি নয়নতারা সদ্যবিবাহিত পতির সহিত শ্বশুরালয়ে গমন করিলেন। নিকট ভবিষ্যতে তিনি পতির সহিত বিলাত যাত্রা করিবেন।
    আজ হইতে ছয় বৎসর পূর্বে আমার বিবাহ হইয়াছিল। আমি তখন নবমবর্ষীয়া কন্যা মাত্র। স্বামী প্রৌঢ়। আমি তাঁহার ষষ্ঠ পক্ষ। আমার বিবাহের সময় তাঁহার প্রথম পক্ষের দুই সমর্থ পুত্র, দ্বিতীয় পক্ষের এক বিবাহিতা কিশোরী কন্যা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ পক্ষের একটি করিয়া শিশুপুত্র বর্তমান ছিল। পঞ্চমপক্ষীয়া তখনও ঋতুমতী হন নাই।
    বাল্যবিবাহের পর ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত বধূর পিতৃগৃহে বাস করাই চিরাচরিত প্রথা। কিন্তু পঞ্চম পক্ষীয়া নয়নতারা পিতৃমাতৃহীন। মাতুলালয় হইতে অনাদরে এই গৃহে আসিয়া পড়িয়াছে। তাহার যাইবার কোনও স্থান ছিল না। সেই বধূ, আমা হইতে দুই বৎসরের অগ্রজা আমার রাঙাদিদি আমাকে আদরযত্নে আপনার কক্ষে স্থান দিল। আমি বিপত্নীক পিতার একমাত্র সন্তান। পিত্রালয়ে বড় একাকী জীবন। খেলার সাথী পাইয়া পিত্রালয় ভুলিলাম। নূতন গৃহে নূতন সঙ্গিনীর সহিত জীবন বড়ই রঙীন হইয়া উঠিল।
    অবশ্য, এ সুখের স্থায়িত্ব খুবই ক্ষণিক। বিবাহের কয় মাস পরেই আমার স্বামী স্বর্গারোহণ করিলেন। রাঙাদিদি তখন সদ্য ঋতুমতী।
    অকস্মাৎ সব রং মুছিয়া গেল। বিধবার রিক্ত বেশে পিত্রালয়ে ফিরিয়া আসিলাম। সঙ্গে রাঙাদিদি। আমার পিতৃদেব তাকেও কন্যাজ্ঞানে আপন গৃহে লইয়া আসিয়াছিলেন।
    আমার পিতা খুব উদার না হইলেও ঠিক যাহাকে বলে 'পাষাণ বাপ' ছিলেন না। কন্যার বাল্যবিবাহ নেহাৎ সমাজের চাপে পড়িয়া দিয়াছিলেন। আমাদের দু জনকে সাদা থান, নিরামিষ একাহার, একাদশী ইত্যাদি পালন করিতে বলিলেও যাহাতে আমরা যথাসম্ভব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তাহার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। পিতৃগৃহের স্বচ্ছন্দ পরিবেশে রাঙাদিদির সহিত বন্ধুত্ব গাঢ়তর হইতে লাগিল।
    অতঃপর একদিন বয়ঃপ্রাপ্তা হইয়া রজঃস্বলা হইলাম। রাঙাদিদি সস্নেহে মানবজাতির সৃষ্টি রহস্য বুঝাইয়া দিলেন। তৎপরে আমরা দুইজন পরষ্পরের আরও আরও ঘনিষ্ঠতর হইয়া উঠিতে লাগিলাম। বৈধব্যের শুষ্ক কৃচ্ছ্রসাধন দু জনে দুজনার শরীর হইতে রস আহরণ করিয়া মনোরম করিয়া তুলিলাম।
    এইরূপে দিন একপ্রকার কাটিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ একদিন বৈঠকখানা ঘর হইতে পিতৃদেবের জরুরি তলব আসিল। "সদু, নয়নকে নিয়ে একবার শুনে যাও।" অনভ্যস্ত পায়ে গিয়া দেখি এক বৃদ্ধ ফরাসে বসিয়া কায়স্থদের জন্য সাজা হুঁকা টানিতেছেন। সঙ্গে এক মাঝবয়সী যুবা। যুবকটি পেশায় ঘটক। যে বৃদ্ধ ঘটক একদা আমার বিবাহ স্থির করিয়াছিলেন, তিনি ইতমধ্যে প্রয়াত হওয়ায় তাঁর পুত্র পিতার স্থান পূর্ণ করিয়াছেন।
    -এই মেয়েটির কথাই আপনাকে বলছিলাম, রাঙাদিদিকে নির্দেশ করিয়া বলিলেন পিতৃদেব।
    - কিন্তু, আপনার নিজের মেয়ে.....
    - এ ই আমার বড় মেয়ে। আমার মেয়ে সদুর সতীন। পিতৃদেব ঘটককে মধ্যপথে থামাইলেন। "যবে থেকে আমার এই আশ্রয়ে সে আছে, তার সব দায়িত্ব আমার। যেহেতু সে আমার মেয়ের চেয়ে বড়, প্রথম কাজ তার হবে।"
    - এত বড় কথাটা এত সহজভাবে বলতে পারলেন আপনি! আপনি সত্যিই মহানুভব। বৃদ্ধ বলিলেন।
    - দুর কি যে বলেন। ঘরে দুই মেয়ে থাকলে বড়র বিয়ে তো আগে দিতে হয়, না কি?
    - তা ভাল, তা ভাল। তা দুই মেয়েই আপনার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। তোমার নাম কি মা?
    - শ্রীমতী নয়নতারা দেবী। আধগলা ঘোমটার ফাঁক হইতে লজ্জায় মাটিতে মিশিয়া যাইতে যাইতে বলিল রাঙাদিদি।

    -বাঃ, খুব ভালো মেয়ে। বৃদ্ধ বলিলেন, "বুঝলেন কি না, আমার ভাইপো প্রভাসচন্দ্র মেডিকেল কলেজের ডাক্তার। একবার রুগীর নাড়ি টিপে সব রোগ ধরে ফেলে। আরও বড় ডিগ্রীর জন্য শিগগির বিলেত যাবে। সেই তার ইচ্ছে বিয়ে করে বৌ নিয়ে সেখানে যায়। বাপ মা মরা ছেলে, কখনও কোনও চাওয়া অপূর্ণ রাখি নি।সেইজন্যই..... আমাদের ঘরের মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশায় সম্প্রতি যে অসাধ্যসাধন করলেন, তাঁর দেশেরই আমিও একজন, ভাবতেই কেমন আনন্দ হয়। কিন্তু শুধু দূরে দাঁড়িয়ে সেই যজ্ঞ দেখলেই তো চলবে না, সেই আগুন এনে নিজের ঘর ও আলো করতে হবে তো। আমার তিন পুত্র বিবাহিত, কিন্তু বিবাহযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র রয়েছে। তার মত ও আছে। আর ঈশ্বরের ইচ্ছা দেখুন, আমাকে আপনার ঘর চিনিয়ে দিলেন। আপনার কনিষ্ঠাটি ও শীঘ্রই সুপাত্রস্থ হবে, দেখবেন।
    ঘোমটার নিচে রাঙাদিদি অস্ফুটে কাঁদিয়া উঠিল। আমি তাহাকে লইয়া অন্দরমহলে চলিলাম। আমারও বুক ভাঙিয়া আসিতেছিল।
    দেখিতে দেখিতে শুভদিন আসিয়া পড়িল। পিতৃদেবের নির্দেশে শুভ্র বস্ত্র ত্যাগ করিয়া রাঙাদিদি পুনরায় রঙীন হইয়াছে। সারা শরীর গহনায় মুড়িয়া ফুলের সাজে সাজিয়া উঠিয়া সে যখন শুভকার্যস্থলে উপস্থিত হইল, সকলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। তাহার নতুন মানুষটিও বড় সুন্দর। ঠিক আমাদিগের গোবিন্দজীউ এর ন্যায়। পিতৃদেবের অনুরোধে আমিও কুমারীর বেশে উপাসনা মন্দিরে গিয়াছিলাম। অনুষ্ঠানশেষে রাঙাদিদি তাহার মানুষের সহিত আপন গৃহে চলিয়া গেল। কয়েকদিন পর বিলাত অভিমুখী জাহাজে চড়িয়া চিরকালের জন্য ভাসিয়া যাইবে।আমি পিতৃদেবের সহিত গৃহে ফিরিয়া আসিলাম।
    চোখের জল আর বাঁধ মানিতেছিল না। শয্যায় উপুড় হইয়া উপাধান সিক্ত করিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিলাম। পিতৃদেব সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করিয়া ক্ষান্ত দিলেন।
    আমার রাঙাদিদি নয়নতারা শুধু আমার আবাল্যের সঙ্গিনীই ছিল না, সে ছিল আমার প্রথম প্রেম। আমার দেহের নদীতে উথালপাতাল ঢেউ, আমার হৃদয়ের সমুদ্রে সৃষ্টিগ্রাসী প্রলয়। আমার যথাসর্বস্ব সঁপিয়া দিয়া আমি তাহাকে ভালবাসিয়াছিলাম। সে আমার সর্বস্ব লইয়া আপন জীবনপথে বিলীন ইইয়া গেল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৮ মে ২০১৬ | ৫৮৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • d | 24.96.232.231 (*) | ১৮ মে ২০১৬ ০৬:৪৩54684
  • আপনার এই গল্পটা অপেক্ষাকৃত ভাল, আগেরগুলোর তুলনায়।
    আমার মনে হল, বিধবাবিউবাহ, সমপ্রেম সব একটা ছোট্ট পরিসরে ঢোকাতে গিয়ে কেমন চেপ্টে গেছে।

    যাই হোক লিখে যান।
  • d | 24.96.232.231 (*) | ১৮ মে ২০১৬ ০৬:৪৪54685
  • বিধবাবিবাহ
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন