শনিবার সকালে কলকাতার একটি ইংরেজি কাগজের ভাঁজ খুলতেই পাতাজোড়া রঙিন ঝকঝকে বিজ্ঞাপন দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। উত্তরবঙ্গের অরণ্যময় ডুয়ার্সের লাটাগুড়িতে উচ্চবিত্ত শহুরে নাগরিকদের ভোগবাদকে উস্কে দিতে ২০ একর জমিতে বিলাসবহুল আবাসন তৈরি হচ্ছে। দুপুরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের অনলাইন এডিশনে দেখলাম, ফরিদাবাদের বনভূমিতে বন কেটে বসত তৈরির উদ্যোগ নেওয়ায় ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল (এন জি টি) সেই রিয়ালটারকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। অসাধু ব্যবসায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাঁচ একর জমিতে অন্তত ৫০০ গাছ কেটে ফেলেছে। প্রতিটি গাছ কাটার জরিমানা দু' লাখ টাকা। ফরিদাবাদের ঘটনায় এন জি টি-র নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে স্মরণ করা যেতে পারে, প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে প্রকৃতি সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রচার করা হয়েছিল। সনাতন হিন্দু ধর্মে বৃক্ষ ও প্রকৃতি বন্দনার প্রশস্তির প্রকৃত লক্ষ্য হল, মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা জাগিয়ে তোলা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা গাছ রক্ষা করা তাঁদের আবশ্যিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করতেন। আর সে কারণেই প্রতিটি গাছের প্রতি তাঁরা আরোপ করতেন ধর্মীয় পবিত্রতা। তাই সমাজে খুব সহজেই গাছ হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় আরাধনার বস্তু। এর দৃষ্টান্ত রয়েছে লোকাচারেও। নগরায়ণের বেপরোয়া দাপটে বোঝা যায়, প্রকৃতিকে লালন করার যে সহজাত নীতিবোধ অতীতে ছিল তা থেকে বর্তমান সমাজ পুরোপুরি বিচ্যুত। ... ...
পুজোর উৎসবের আতিশয্যে ভুলে না যাই, আজ গান্ধী জয়ন্তী। আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারাবার পরে গান্ধীজির প্রথম জন্মদিনটি পালিত হয়েছিল স্মরণে। আজ এত দশক বাদে জনচেতনার পরিসরে গান্ধী কি ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছেন? সরকারি-বেসরকারি সংবাদমাধ্যমে গান্ধী-চর্চা কি তেমনভাবে কোথাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে? খবরের কাগজে চোখে পড়ল, কেন্দ্রীয় সরকারি তরফে গান্ধী এবং সঙ্গত কারণেই লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন মারফত শ্রদ্ধা নিবেদন। রয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠান 'প্রত্যহিকী'তে দিনটির বিশেষ তাৎপর্যের উল্লেখ, 'মৈত্রী' প্রচারতরঙ্গে 'সুচিন্তন' অনুষ্ঠানে গান্ধিবাণী এবং 'সঞ্চয়িতা' প্রচারতরঙ্গে রিলে করা হয়েছে দিল্লির হিন্দি অনুষ্ঠান। ওই পর্যন্ত। ইঙ্গিত স্পষ্ট, অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় গান্ধী আজ কার্যত ফিকে। ... ...
১৯৪৭ সালের ১৩ অক্টোবর সোমবার ছিল মহালয়া আর ২১ তারিখ মঙ্গলবার ছিল মহাসপ্তমী। দেশ যখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, সমাজে যখন পারস্পরিক অবিশ্বাস আর বিভেদের রেশ, সেই মুহূর্তে উৎসবের সুর কেমন ছিল এই কৌতূহল তো স্বাভাবিক। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও যখন নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে থেকেই মাথাচাড়া দেয় তখন আমরা দেখি, পারস্পরিক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজি নজরুল ইসলামের কলমে ফুটে উঠেছে দুর্গা-বন্দনা। নজরুল-রচিত অনেক শ্যামাসঙ্গীত সুপরিচিত। কিন্তু আগমনীর আগমনে ১৯৪২ সালে নজরুলের লেখা গান ততটা পরিচিত নয়। অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্র থেকে সেই বছর সপ্তমীর দিন সকাল সওয়া সাতটায় 'আগমনী' অনুষ্ঠানে সে যুগে ভক্তিগীতির জনপ্রিয় শিল্পী মৃনালকান্তি ঘোষের কণ্ঠে সম্প্রচারিত হয়েছিল এই নজরুলগীতি। স্বাধীনতা লাভের বছরে পুজোর সূচনায় যে গানটি বাজানোর জন্যে রেডিও চয়ন করেছিল আজ সকলের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতির ভাব গড়ে তুলতে মন্ডপে মন্ডপে আবার বেজে উঠুক নজরুলের সেই বিখ্যাত গান। ... ...
১৯৩৪ সালে উপন্যাসের শুরুতেই নায়কের ভূমিকায় 'বঙ্গ ব্যায়ামাগারে'র প্রতিষ্ঠাতা আলোকনাথ সেনের চরিত্র অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। "পায়ের ধূলো" নামে উপন্যাসটি লিখেছিলেন "আবার যকের ধন"-খ্যাত হেমেন্দ্র কুমার রায়। বার্মিংহামে সদ্য কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়ন অচিন্ত্য শিউলি, তাঁর দাদা অলোক বা আট বছর আগে গ্লাসগো কমনওয়েলথে আর এক সোনাজয়ী সুখেন দে-র রোমাঞ্চকর কাহিনীর সূত্রেই আজ থেকে ৮৮ বছর আগে লেখা হেমেন রায়ের এই রচনার কথা মনে পড়ে যায়। উপন্যাসের নায়ক আলোকনাথের মতো চরিত্র কিন্তু মোটেও কাল্পনিক নয়। বাংলা ও বাঙালির অবক্ষয় এখন সর্বস্তরে। তবু তারই মধ্যে কেউ কেউ নেহাত ব্যতিক্রম হিসেবে নিজের উদ্যমে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অচিন্ত্য বা সুখেনের মতো দেশের পতাকা সবার উঁচুতে তুলে ধরে প্রচারের আলোয় উঠে আসেন। আমাদের তখন স্মরণ করা দরকার, একদা বাংলার ঘরে ঘরে দেশ বিদেশ কাঁপিয়ে দেওয়া এমন পালোয়ানের কোনও অভাব ছিল না। সাহসে, বীর্য্যে, সহ্য ক্ষমতায় ও আত্মরক্ষার শক্তিতে বাঙালি যুবকদের বাহুবলে বলীয়ান করে তুলতে পাড়ায় পাড়ায় তখন 'বঙ্গ ব্যায়ামাগারে'র মতো জিমন্যাস্টিক ও কুস্তির আখড়া গড়ে উঠেছিল। বাংলা তার শরীরচর্চার সেই ধারাটি বজায় রাখতে পারলে এবং সেই সব ব্যায়ামাগার থাকলে হাওড়ার অষ্টম দাসকে আর মরচে ধরা সরঞ্জাম নিয়ে গাছতলায় অচিন্ত্যের মতো যুবকদের অনুশীলন করাতে হত না। আর কীর্তিমান সেই পালোয়ানদের যোগ্য উত্তরসূরিরা থাকলে এশিয়াড, কমনওয়েলথ বা অলিম্পিকসে সোনার মেডেলের ভিড়ে বাংলার সিন্দুক ভরে উঠত। সেকালের শৃঙ্খলা, নীতিবোধ, দেশপ্রেম আর সাহস থাকলে আজকের সমাজও এমন মূল্যবোধহীন দুর্নীতির পাঁকে ডুবে যেত না। ... ...
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ১০০ দিন ছাড়াল। যুদ্ধাবসানে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা ক্ষীণ। ইউক্রেনের সেনানী ইউরোপে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউক্রেনকে আর ফ্রান্স পাঠাতে শুরু করেছে স্বয়ংক্রিয় সিজার হাউইৎজার কামান। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনকে পশ্চিমি সামরিক সাহায্য আগুনে ঘি ঢালছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। কিন্তু যাবতীয় অশান্তি এবং বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা ছড়ানোর মুলে তো গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আচমকা রুশ আগ্রাসন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত কলকাতা রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পথে নামেনি। যদি নামত তাহলে রোজকার চায়ের সঙ্গে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে, গোপালদার চায়ের দোকানের ঠেকে বা বাড়ির বৈঠকখানায় বসে নিরীহ মারি বিস্কুট চিবানো বোধহয় সহজ হত না। তখন হয়ত রুশ দূতাবাসের সামনে জনতার বিক্ষোভে স্লোগান উঠত "বয়কট মারি বিস্কুট।" সাদামাঠা মারি বিস্কুটের সঙ্গেই যে জড়িয়ে রয়েছে রুশ রাজকীয় দম্ভের ইতিহাস! ... ...
মুসলিমদের আজান এসেছে বেদুইনদের সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে। সেই ১৯৫০-৬০ এর দশকে জর্ডনের মরু অঞ্চলে বেদুইনদের রহস্যময় জগতের সঙ্গে পরিচিত হবার সূত্রে এবং বেদুইনদের গান-বাজনা শোনা ও রেকর্ড করার পর সঙ্গীত- সংগ্রাহক দেবেন ভট্টাচার্যের এমনটিই মনে হয়েছিল। ঈদের আগে রমজান মাসের এক সকালে এমন এক উপলব্ধির কথা জানতে পেরে বেশ চমকিত হলাম। বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা আলি জাকেরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গের অবতারণা। জাকেরও বলেছিলেন, আজানের সুরের ভিত্তি আহির ভৈরবী। সেই সময় দেবেন ভট্টাচার্যের রেকর্ড করা বেদুইন সঙ্গীতের একটি অংশ পেলাম ইন্টারনেট আর্কাইভে। সেটি শুনলে ভ্রম হয় যেন আজানের ধ্বনি। ১৯৫৫ সালের গ্রীষ্মে বিবিসির-র এক কমিশনড প্রোগ্রামে ইউরোপ থেকে প্রায় লঝ্ঝড়ে একটি মিল্কভ্যানে এক বাঙালি যুবক যুগোস্লাভিয়া, গ্রিস, ইতালি, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, জর্ডন, ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হয়ে ১২ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ছ' মাস বাদে ভারতে আসেন বিভিন্ন দেশের গান রেকর্ড করতে করতে। সঙ্গী ছিলেন আর্কিটেকচারের ইংরেজ ছাত্র কলিন গ্লেনি আর ফরাসি সাংবাদিক হেনরি অ্যানভিল। দেবেনের রেকর্ডিংয়ের বিচিত্র সম্ভারের কিছু নমুনা শুনলেই বোঝা যায়, জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি সারা বিশ্বের খ্যাত-অখ্যাত শহর, গ্রাম, পাহাড় বা মরুপ্রান্তরে কাটিয়েছেন। এভাবেই আন্তর্জাতিক স্তরে দেবেনের পরিচিতি গড়ে ওঠে এথনোমিউজিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে। বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ সঙ্গীতের অপূর্ব ঐতিহ্যের হদিস প্রকৃতপক্ষে দেবেনই প্রথম দুনিয়ার মানুষকে দিয়েছিলেন। তার আগে নানা দেশের লোকসঙ্গীতের সমৃদ্ধ ভান্ডারের অস্তিত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্তরে কার্যত কোন ধারণাই ছিল না। যাঁকে নিয়ে আজও সমান ভাবে গর্ব করার কথা আমাদের দুই বাংলার মানুষেরই, ভাবতে অবাক লাগে এমন এক আশ্চর্য বাঙালিকে নিয়ে হাল আমলে কোন চর্চা নেই। ... ...
পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির খবরকেও ছাপিয়ে দেশজুড়ে এখন লোকজনের প্রাত্যহিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে লেবুর অস্বাভাবিক দাম। গতমাসেও যেখানে কুড়ি টাকায় অন্তত ছটি লেবু পাওয়া যেত, সেই লেবুই এখন অবিশ্বাস্য ভাবে বিকোচ্ছে আক্ষরিক অর্থে সোনার দামে। একে তো গত ১২১ বছরে এত গরম নাকি মার্চ মাসে পড়েনি, তাই তৃষ্ণায় ছাতি ফাটা ধনী-দরিদ্র সব মানুষের সামান্য চাহিদা একটু লেবু জল। চাহিদা যখন আকাশচুম্বী লেবুর যোগান তখনই অন্যান্যবারের তুলনায় সবচেয়ে কম। লেবু এখন রাতারাতি বিলাস সামগ্রী। লেবুর দাম কমানো এখন বুঝি কেবল ভগবানেরই হাতে! সেই বিশ্বাস সম্বল করে বারাণসীতে তন্ত্র সাধনার জাগ্রত দেবী আদিশক্তির মন্দিরে তাই এগারোটি লেবু বলি দেওয়া হয়েছে। আজ হঠাৎ লেবু বিলাসিতার পর্যায়ে চলে যাওয়ায় স্মরণ করা দরকার, একেবারে গোড়ার দিকে রোমে লেবু ছিল ধনীদের কাছে বিরাট মর্যাদার প্রতীক। ঐতিহাসিক পম্পেই শহরের নানান মন্দির, প্রাসাদ, বাড়ি ও স্থাপত্যের দেওয়ালে খচিত ফ্রেস্কো পেইন্টিংয়ে লেবু চিত্রিত আভিজাত্যের চিহ্ন হিসেবেই। প্রাচীন গ্রিসে বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে লেবুর ব্যবহার ছিল। গুপ্তচরবৃত্তি, অবৈধ প্রণয় বা যুদ্ধের ক্ষেত্রেও লেবুর ভূমিকা চাঞ্চল্যকর। প্রবাদ প্রতিম প্রেমিক ক্যাসানোভা ও তাঁর শতাধিক প্রণয়ীর সম্ভোগে জন্মনিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার ছিল লেবু। কিংবদন্তিতুল্য জেনেরাল টমাস 'স্টোনওয়াল' জ্যাকসন রণক্ষেত্রে যাবার আগে লেবু চুষতেন। সেই থেকে তাঁর পরিচিতি বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান লেবু-প্রেমিক হিসেবে। ... ...
মঙ্গলবার সকালে গাড়িতে পেট্রোল ভরলাম ১১৪ টাকা ২২ পয়সা দরে। আজ সকালে দেখলাম কলকাতায় পেট্রোলের লিটার আরও বেড়ে ১১৫ টাকা ১২ পয়সা। খবরের কাগজ বলছে, "এখনও পর্যন্ত এটাই তার সর্বোচ্চ দর"। এই পর্যবেক্ষণ বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নেহাতই অসার। সংসদে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনার গলা টিপে দেওয়া হচ্ছে। তবু এই পরিস্থিতেও জনজীবনে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ টের পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মরীয়া তাগিদে বিনা প্রশ্নে, বিনা প্রতিবাদে, পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করে সব কিছু মেনে নেওয়াই বোধ হয় ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে বা যাঁরা এই পরিস্থিতির জাঁতাকলে পড়ে সহ্যের শেষ সীমায় চলে যাচ্ছেন, তাঁরা মর্মান্তিক ভাবে চরম পদক্ষেপ বেছে নিচ্ছেন। সস্তা-গন্ডার দিনকালের কথা পাওয়া যায় সুরসিক যম দত্তের রম্যরচনাতে -- "আশু মুখুজ্জে মহাশয় যখন ভীমনাগের দোকান হইতে রোজ রোজ করিয়া সন্দেশ খাইতে আরম্ভ করেন, তখন সন্দেশের সের চোদ্দ আনা দাঁড়ায় আর এখন?... " সন্দেশের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তিনি বাঙালির মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির চূড়ান্ত চাঞ্চল্যকর তুলনা করেছেন। তাঁর ভাষাতেই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক -- "যখন সন্দেশের সের দুই আনা তিন আনা তখন দেশে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মাইয়াছেন, যখন সন্দেশের দর চার আনা ছয় আনা তখন দেশে বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ জন্মাইলেন, যখন সন্দেশের সের এক টাকা, দেড় টাকা তখন দেশে সুনীতি চাটুজ্জে, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা জন্মাইয়াছেন; যখন সন্দেশের সের দুই টাকা, আড়াই টাকা তখন শ্যামাপ্রসাদ, সুভাষ বসু জন্মাইয়াছেন। আর এখন ছয়, সাত টাকা সের সন্দেশ কয়জনেই খাইবে?...বাঙালি মরিয়া গেল।" ... ...
তিনি মধুপ্রিয়। তাঁর পছন্দ নীল। তাই রুপোলি বুটিদার নীল রেশমের কাপড়ের পশ্চাৎপটে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত গৌরবর্ণ সুস্মিত দারুবিগ্রহের বুকের কাছে ধরা বাম হাতটিতে মধুর বাটি। হাতের ফাঁকে গোঁজা রয়েছে একটি হল। মাথার উপরে অনন্তনাগের প্রসারিত ফনার নিচে ডান হাতের মুঠিতে ধরা মুষল। তিনি বিষ্ণুর বাহন সর্পরাজ শেষাবতার। তিনি শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলদেব। তিনিই তো হলধর কিংবা হলায়ুধ, বলরাম বা সঙ্কর্ষণ অথবা পুরীর মন্দিরে জগন্নাথদেবের পাশে বসা বলভদ্র। তিনি এক তবু অনন্য। বর্ধমানের রায়না থানার বোড়ো গ্রামে দশ হাত উঁচু, চোদ্দটি হাতের অনার্য-পূজিত প্রাচীন বলরাম মন্দির রয়েছে। যার উল্লেখ পাওয়া যায় ধর্মমঙ্গল কাব্যে -- "বোড়ো গ্রামের বলরামে নত কৈনু শির।" উত্তর কলকাতার রাজবল্লভ পাড়ার কাছে 'হারানো বলাই' মন্দিরও আছে। কিন্তু বেলেঘাটার শুঁড়া অঞ্চলে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ রাজাবাহাদুরের গৃহদেবতা বলদেব ও শেষজায়া অর্থাৎ রেবতীরানির এই বিশেষ মূর্তি ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই। বিভিন্ন মন্দিরে বা পারিবারিক দেবালয়ে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ সুপরিচিত ও জনপ্রিয় হলেও বলদেব ও রেবতীরানির ঠাকুরবাড়ি একেবারেই ব্যতিক্রমী। শ্রীকৃষ্ণের দাদা, তাই পরিবারের ভক্তহৃদয়ে এই কুলবিগ্রহের মৌখিক পরিচিতি একান্ত আপনার 'দাদা-বৌদি' হিসেবেই। আর এই দারুবিগ্রহের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম ভারতীয় প্রধান, বাংলার রেনেসাঁসের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের নাম। রবীন্দ্রনাথ 'জীবনস্মৃতি'তে লিখেছিলেন, "রাজেন্দ্রলাল মিত্র সব্যসাচী ছিলেন। তাঁহার সঙ্গে পরিচিত হইয়া আমি ধন্য হইয়াছিলাম। রাজেন্দ্রলালের স্মৃতি আমার মনে যেমন উজ্জ্বল হইয়া বিরাজ করিতেছে, এমন আর কাহারো নহে।" তাঁর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে চলতি বছরেই। ... ...
তিনি ছিলেন আমার রাঙামা। আসলে রাঙা ঠাকুমা। বাবার মেজ কাকিমা। কিন্তু সকলের কাছেই তিনি একডাকে পরিচিত ছিলেন এই রাঙামা নামেই। একেবারে টুকটুকে গায়ের রঙের সঙ্গে আদরের ডাকের কী মিল! মাথায় কালো চুলের বড়ি খোঁপা। ছোটখাটো চেহারা। সংসারের হাজারো কাজ সামলে ওই বয়সেও মসৃন ত্বক। আদতে দ্বারভাঙার কন্যা। কবি যদিও বলেছেন, "যব-ছাতু খেয়ে বাঁচে পশ্চিমের দীনে," পশ্চিমে কিন্তু লোকপ্রিয় ছোলার ছাতু। উত্তরবঙ্গে বলতে শুনেছি, বুটের ছাতু। তা রাঙামা ছিলেন এই ছোলার ছাতু মাখার স্পেশালিস্ট। তাঁর হাতের তারে সেই ছাতু মাখা গোল বলের মতো দলার যে কী সুস্বাদ ছিল তা এখনও ভুলতে পারি না। আজকের আধুনিক প্রজন্ম এমন সব আটপৌরে জলখাবারের মর্মই হয়ত বোঝে না। তবে আজও এই সব সাধারণ ঘরোয়া খাবার নিয়ে বসলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবী থেকে একে একে চলে যাওয়া প্রিয় মুখগুলি যাঁদের স্নেহ, আর ভালোবাসা আমাদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে এমন উজ্জ্বল করে রেখেছে। ... ...