ভদ্রলোকের বয়স প্রায় ৮৩ বছর। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ইনিই মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর পদের বৈধ উত্তরাধিকারী। মুর্শিদাবাদ শহরবাসী তাঁকে নবাব বাহাদুর হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করেন। ভদ্রলোকের নাম নবাব সৈয়দ মুহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জা। তিনি থাকেন কেল্লা নিজামতের ভেতরে দক্ষিণ দরজার পাশে অবস্থিত একটি পুরনো বাড়িতে। তবে নবাব সাহেবের দেখা পাওয়া মুশকিল, অনেকেই তাঁর সাথে দেখা করতে চান কিন্তু তিনি খুব একটা দেখা দিতে চান না। এতে অবশ্য কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, কারণ আজ যদি নবাবী আমল হতো আর উনি যদি নবাব হতেন তবে তো নবাব সাহেবের সাথে দেখা করা মোটেই সহজ সাধ্য হতো না। আজ হয়তো নবাবী আমল নেই ঠিকই কিন্তু নবাব সাহেবের শরীরের মধ্যে তো এখনও তাঁর পূর্ব পুরুষদের রাজকীয় রক্ত বইছে।ফলে তাঁর কিছুটা প্রভাব তাঁর আচরণে দেখা দেওয়া দোষের কিছু নয়। ... ...
পরের দিন আমাদের কিরাঙ্গোজির নির্দেশ মেনে পূর্ব দিকে এগোলাম; তবে যে রাস্তা দিয়ে সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল তার থেকে এটাও বোঝাই যাচ্ছিল, যে সে এই দেশটার কিছুই জানে না। যদিও সে এতই বকর বকর করছিল যে মনে হবে যেন সে এনগোন্ডো, ইয়ম্বেহ এবং পুম্বুরুর এলাকাগুলোর সম্বন্ধে একদম দিগগজ পণ্ডিত। কাফেলার মাথার দিক থেকে আমাকে ডাকা হল। তখন আমরা সিধা লোয়াজেরির খর স্রোতে নামতে যাচ্ছি, আর সেটা পেরলেই তিন থাক দুর্গম পর্বতমালা, সেগুলোকে উত্তর-উত্তর-পূর্ব দিকে পেরোতে হবে। মোটেই আমাদের নির্দিষ্ট পথের দিকে না সেটা। ... ...
এসকেলেপিয়াস, আমরা বোধ করি সবাই জানি, প্রাচীন গ্রিসের মেডিসিনের পৌরাণিক দেবতা। তাঁর মন্দিরে যাবার জন্য, অবশ্যই রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে, এই আকুলতা। মন্দির, মঠ, চার্চগুলোতে আর্ত মানুষের নিরাময় করার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকত সে আদিম কাল থেকে। ইউরোপের উদাহরণে আবার ফিরে আসব। তার আগে ভারতের প্রথম আয়ুর্বেদ গ্রন্থ তথা শাস্ত্র বলে স্বীকৃত চরক-সংহিতারও সংকলনকালের সময়কালের কিছু আগে পরে (আয়ুর্বেদের সবচেয়ে মান্য গবেষক মিউলেনবেল্ডের মতে এ সময়কাল খুব বেশি হলে ১৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে হতে পারেনা, বা খুব বেশি হলে ১০০ খ্রিস্টাব্দ – মিউলেবেল্ড, A History of Indian Medical Literature, IA, পৃঃ ১১৪) বৌদ্ধযুগে কিছু হাসপাতালের হদিশ পাওয়া যায়। ... ...
স্বাধীনতার পর আমি রোকেয়া হলে ফিরে আসি। এক রুমে আমরা তিনজন থাকতাম। রুমে এসে দেখি আমাদের ডেস্ক উলটাপালটা, বইপত্র ছড়ানো ছিটানো, আমার বিছানা বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত বিছানা, বড় বড় রক্তের ছোপ, ততদিনে কালো হয়ে গেছে। এখানে কোনো মেয়েকে ধরে এনে ধর্ষণ করে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সারা ঘরে রক্তের পচা গন্ধ। এখনো মনে হয়—কোন মেয়ে ছিল সে? পাকিস্তান আর্মির যে মেজর ছিল, সে নাকি মন্ত্রী হয়েছিল পাকিস্তানের। তাদের কোনো বিচার হয়নি এখন পর্যন্ত। ... ...
যোগ্যতা অবশ্য আজকাল কোনও মাপকাঠিই নয়, বুক জোড়া আত্মবিশ্বাসটাই আসল রাজা। সাহস করে নামতে পারলে বাকিটা গুগল ট্রান্সলেটর দেখে নেয়। দুর্বোধ্য অনুবাদে ন্যূনতম দায়বদ্ধতা কারোর না, বইবাজারের এই ভরা বসন্তে, প্রকাশক দিব্য ঘুমন্ত, অনুবাদক তো চির ক্লান্তই, চাঙ্গা কেবল অনুবাদ যন্ত্র! দিতে যা দেরি, মুহূর্তে বঙ্গানুবাদ। হ্যাঁ, বাংলা অক্ষরমালা থাকবে ঐটুকুই নিশ্চিন্তে বলা যায়, বাকিটা কপালজোরের হিসাব নিকাশ। বললাম, "life is full of problems that are, quite simply, hard". গুগল ট্রান্সলেটরে খাবি খেয়ে দাঁড়াল: "জীবন এমন সমস্যায় পূর্ণ যেগুলো, বেশ সহজ, কঠিন।" চমৎকার! কাজেই সাড়ে তিন পাতার আড়মোড়া ভেঙে অনুবাদ উপন্যাস চলল সেলফের সব চেয়ে দুরূহ কোনায় একটু গা গড়াতে। তারপর ... তারপর মরণ ঘুম! ক্রেতা-কাম-পাঠক গেল ভুলে ওই শিরোনামের কোনও বইকে গাঁটের কড়ি দিয়ে বড় সাধ করে আপ্যায়ন করেছিল সে। ... ...
এবার হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। বললেন, আমার বক্তৃতার ফাঁকটা ভরাট করে দিল আপনার পুত্র। আমি বলেছিলাম আপনি বাংলার কবি বাঙালির কবি। যে-কথাটা বলতে ভুলেছিলাম, তা হল আপনি এখন থেকে বয়েস-সম্পর্ক নির্বিশেষে বাঙালির শুধু কবি ন'ন, কাজিদাও! এবার বুলবুলের দিকে তাকিয়ে বলেন, গুড বয়, বুদ্ধিমান ছেলে। তোমাকে কেমিস্ট্রি পড়াতেই হবে। ... ...
টাটা এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের ৭৭তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে কিছু বলবার জন্য আপনাদের আমন্ত্রণ পেয়ে আমি একই সঙ্গে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ এবং যারপরনাই সংকুচিত। দেশের প্রাচীনতম কর্মী সংগঠনগুলোর অন্যতম এই সংগঠনের বিপুল প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি ও অর্জিত অভিজ্ঞতার তুলনায় আমার জ্ঞান অতি তুচ্ছ। সুতরাং আজকের এই সভায় এমন কিছু বোধ হয় বলতে পারব না, যা আপনাদের অজানা। তা সত্ত্বেও আপনাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি এই কারণে যে, জানা কথাগুলোও বারবার বলার প্রয়োজন হয়। এটাই জ্ঞানীদের অভিমত। যে বাস্তবতায় আমরা দিন কাটাই তাকে যদি বদলাবার দরকার হয়, অথচ কাম্য পরিবর্তনটি আসে না, তাহলে পরিবর্তনের প্রয়োজন ও উপায় নিয়ে আমাদের কথা বলে যেতেই হবে। যেমন, আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানুশীলক অমর্ত্য সেনকে বারবার একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, আপনি পুরনো কথাগুলোই বারবার বলে যাচ্ছেন, নতুন কিছু বলছেন না, কেন? তাঁর উত্তরটি অপরিবর্তিত, যতক্ষণ পুরনো সমস্যাগুলো থাকবে ততক্ষণ সেগুলো নিয়ে কথা বলে যেতে হবে, কারণ নতুন কথা বলার জন্য নতুন বাস্তবতার প্রয়োজন। ... ...
- মা কী বলবে বলেছিলে মনে আছে? - কী রে? - দাদুরা আড়বালিয়ার বাড়ি ছেড়ে শহরে কেন গিয়েছিল? - ইচ্ছে হয়েছিল তাই গিয়েছিল। - না, বল ঠিক করে, বলতেই হবে। তোমার মামার বাড়ির কথা তো অনেক শুনলাম। আমার মামার বাড়ির কথা জানবোনা বুঝি? আড়বালিয়ার অমন প্রাচীন ইতিহাস নেই? - সে তো নিশ্চয়ই আছে, তবে কিনা রাজা মহারাজাদের সাত পুরুষ, দশ পুরুষ সব নাম নথি পাওয়া যায়, সাধারণ মানুষের সেসব লেখা থাকেনা, তাই হারিয়ে যায়। আমাকে নিয়ে কেবল চার পুরুষের কথাই জানি। - সেটাই বল, আমাকে তো জানতে হবে। - জানতে হবে? সংক্ষেপে জানবি নাকি বিশদে? - ওসব জানিনা, তুমি যা জানো আমাকে বলতে হবে। - তাহলে তোকে কিন্তু ধৈর্য ধরে অন্তত সোয়াশো বছর আগের আড়বালিয়ায় যেতে হবে। পারবি? - তাই নাকি! চল, চল, শিগগির। ... ...
উরিম্বা কাওয়েন্দির একটা বড় জেলা। যদিও একই নামের একটি গ্রামও রয়েছে - সেখানে ইয়োম্বেহের থেকে পালিয়ে আসা লোকেরা থাকে, তারা লোজেরির ব-দ্বীপে বাসা বেঁধেছিল। যদিও রুসিজির দ্বীপের মতোই অস্বাস্থ্যকর জায়গা, তবু তাদের মনে হয়েছিল দক্ষিণ কাওয়েন্দির সুলতান পুম্বুরুর এলাকার আশেপাশের থেকে অনেক বেশি যুতসই। বিজয়ীদের ভালমতো তাড়া তাদের অভ্যাস নাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হল, কারণ তারা খুব ভীতু আর অপরিচিতদের প্রতি ঘোর অবিশ্বাসী, কোনমতেই তাদের গ্রামে আমাদের ঢুকতে দিল না। অবশ্য সত্য বলতে, যে পচা গলা জায়গাটার উপর তারা আস্তানা গেড়েছিল, সেদিকে এক ঝলক দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার ধারণা যে একদম ওই এলাকায় —না, দু'পাশেই কয়েক মাইল জুড়ে —একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষের পক্ষে এক রাত ঘুমানো মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। গ্রামের দক্ষিণে যাওয়ার পথে, আমি টংওয়ে উপসাগরের শেষতম দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, কিভাঙ্গা বা কাকুঙ্গু পাহাড়ের উঁচু চুড়ো থেকে প্রায় দেড় মাইল পশ্চিমে একটি উপযুক্ত ক্যাম্পিং-এর জায়গা পেলাম। ডাক্তার যা মাপজোক নিলেন সেই অনুসারে আমরা ৫° ৫৪' দক্ষিণ অক্ষাংশে অবস্থান করছিলাম। ... ...
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘আমরা বাঙালি’ কবিতায় তাঁর সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালি দিয়াছে বিয়া...”, আবার একই বছরে জন্ম হওয়াতে তাঁর সত্তর বছরের জন্মদিনে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশস্তিপাঠে বলেন, “কালের যাত্রাপথে আমরা একই তরণীর যাত্রী...”। তাঁকে বাঙালি চেনে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, দেশপ্রেমী, ছাত্রদরদী, দানবীর, ব্যাবসায়ে উদ্যোগী পুরুষ হিসেবে। এ লেখায় তাঁর জীবনের এমন কিছু অংশের কথা বলবো, যার কিছু অন্যান্য বইয়ে পাওয়া গেলেও, বাকি আমি জেনেছি পারিবারিক গল্প হিসেবে। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্ম—অবিভক্ত বাংলার (ব্রিটিশ ভারত) খুলনা জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরে রাড়ুলি কাটিপাড়া গ্রামে এক প্রাচীন জমিদারবাড়ির অন্দরমহলে। সাল ১৮৬১, তারিখ ২রা আগস্ট। বংশের পুর্বপুরুষ দেওয়ান মানিকলাল রায়চৌধুরী বাংলার নবাবের থেকে দক্ষিণদেশে অনেকগুলো তালুক পত্তনি পেয়ে কপোতাক্ষ-তীরে এই অঞ্চলে, গাছপালা কেটে, জঙ্গল পরিষ্কার করে, জমিদারি স্থাপনা করেন। রায়ের আল বা আলি থেকে গ্রামের নাম হয় রাড়ুলি আর গাছপালা কেটে স্তুপ করে রাখা পাশের গ্রামের নাম কাটিপাড়া। মানিকলাল যথেষ্ট অর্থশালী ছিলেন। ভারী লোহার কড়িকাঠের বরগা, চুন-সুরকি দিয়ে তিনি অন্দরমহলে মহিলাদের জন্য একটি দ্বিতল বাড়ি তৈরি করেন। এই অন্দররমহলেরই একতলার একটি ঘরে, মানিকলালের বংশধর হরিশ্চন্দ্র রায়চৌধুরীর স্ত্রী ভুবনমোহিনী দেবী জন্ম দেন প্রফুল্লকে। ... ...
এই বই লেখা শেষ করে প্রকাশকের কাছে জমা দেবার সময় রুশদি অবশ্য জানতেন না এর বেশ কিছু মাস পরে তাঁকেও এক ধর্মান্ধের আক্রমণে একটি চোখ হারাতে হবে। এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে আমার এর লিঙ্গ রাজনীতির পরিব্যাপ্তি। পম্পা কম্পনার সৃষ্ট রাজ্যে মেয়েরা প্রচলিত সামাজিক নিয়মে লিঙ্গ নির্ধারিত ভূমিকায় বাঁধা নয়, তারা কবি কিম্বা শ্রমিক, শিল্পী কিম্বা উকীল, চিকিৎসক কিম্বা যোদ্ধা বেছে নিতে পারে যে কোন পেশা তাদের ইচ্ছেমত। সিংহাসনে মেয়েদের উত্তরাধিকারের চেষ্টা করতে গিয়েই সর্বস্ব খুইয়ে প্রাণ হাতে করে অজ্ঞাতবাসে যেতে হয় নিজের তিন মেয়েকে নিয়ে, তবু সেই সমানাধিকারের স্বপ্ন ছাড়ে না সে। ... ...
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন্দ্র সিংহ কি রাজধর্ম পালন করেছেন? ৩ মে থেকে দুই জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ে রক্তাক্ত উত্তর-পূর্বের রাজ্যটিকে দেখে এই প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। রাষ্ট্র কি তার কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করছে? ঘটনাটি ঘটার এত পরে কেন পদক্ষেপ করল প্রশাসন? কেনই বা ৭৯ দিন পর মুখ খুললেন প্রধানমন্ত্রী? কোন নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর মূল্যায়ন করা যায়? ভিন্ন প্রেক্ষিতে ভিন্ন সময়ে এমন প্রশ্ন উঠেছিল। ২০০২ সালে গুজরাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর রাজ্যটির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ঘিরেও তৈরি হয়েছিল নানা প্রশ্ন। সে সময় মোদীকে পাশে বসিয়ে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। মোদীর উদ্দেশে বলেছিলেন, রাজধর্ম পালন করতে হবে। ... ...
এবারের অধিবেশন দুব্রভনিক। ক্রোয়েশিয়ায় আমার যাতায়াত আছে, জাগ্রেবের সঙ্গে মোলাকাত হলো কয়েকবার। তবে দুব্রভনিক একবারে আলাদা। এক অসামান্য শহর যাকে ভূমধ্যসাগরের মুক্তো বলা হয়—পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। লাল টালির ছাত! প্রথমবার ছবি দেখেই মনে হয়েছিল সমুদ্রের ভেতরে গিয়ে শহর ও কেল্লা বানানোর কি প্রয়োজন ছিল? ডাঙ্গায় জমিজমা কি অপ্রতুল? অনেক ঝড় ঝাপটা বিশেষ করে সাড়ে চারশো বছর আগের বিধ্বংসী ভূমিকম্প, ১৯৯২-১৯৯৫ সালের গৃহযুদ্ধ – এই সব সামলেও দুব্রভনিক একবারে পিকচার পোস্টকার্ডের শহর। কাশীকে হার মানানো সরু সরু গলি। সেখানে পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। চলমান জনতার স্রোত। সকল ইউরোপীয় ভাষা শোনা যায়! স্ত্রাদুন নামক ৩০০ মিটারের সদর পথে হাঁটলে মনে হয় একটা রূপকথার ভেতরে ঢুকে পড়েছি স্বপ্নে। ঘুম ভাঙলেই হয়তো দেখব লন্ডন টিউবে বসে আছি! ... ...
কুকিদের একাংশ দাবি করছে যে কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরের ৬টি জেলার ৬৭ হাজার হেক্টর জমি পাম তেল উৎপাদনের জন্য চিনহিত করেছে। বিজেপি সরকারের পেটোয়া শিল্পপতিদের হাতে ঐ জমি যাতে বিনা বাধায় তুলে দেওয়া যায়, সেজন্য দাঙ্গা লাগিয়ে আগে থাকতেই জনজাতিদের হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই অভিযোগও যে অমূলক নয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের পরস্পরবিরোধী বয়ান। মণিপুরের তথ্য কমিশনার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও গুয়াহাটিতে খুব সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উত্তরপূর্বাঞ্চলের পাম চাষ সম্পর্কিত আলোচনায় হাজির মণিপুরের কৃষি অধিকর্তা ও রাজ্য পাম অয়েল মিশনের উপদেষ্টাকে সামনে রেখে গোদরেজ কম্পানি জানিয়েছে, গত বছরই মোট ৭টি জেলায় পাম চাষের জন্য সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। সংখ্যালঘু কুকি অধ্যুষিত চুড়াচাঁদপুর তাদের মধ্যে একটি ( সূত্র, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩শে জুলাই। ২০২৩)। অন্তর্জালে ঘুরে বেড়ানো একটি ভিডিওর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ... ...
দোষটা কি শুধুমাত্র অতিমারীই? অতিমারীর কাঁধে বন্দুক রেখে কোনো বৃহত্তর শক্তি তাঁর স্বার্থসিদ্ধির জন্য ময়দানে নেমে পড়েনি তো? প্রশ্নটা গুরুতর। এবং পাপী মনে প্রশ্নটা আসছে এই কারণেই যে, অতিমারী আগে-পরে বিগত পাঁচ বছরের রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে, কমবেশী প্রতিবছরই গড়ে প্রায় দু-মাস করে গরমের ছুটি দেওয়া হয়েছে স্কুলগুলোতে। এর পাশাপাশি রয়েছে গড়ে প্রতি বছর একটি করে ভোট-উৎসব, যার জন্য কমবেশি পনেরো দিন থেকে এক মাস স্কুল-বাড়িগুলো অধিগ্রহণ করা হয়। যেদিন এই নিবন্ধটি লিখছি, সেদিনকার সংবাদপত্রেই এই মর্মে প্রতিবেদন রয়েছে যে, দুমাস গরমের ছুটি এবং একমাস পঞ্চায়েত জনিত ছুটির পর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার একটি স্কুলে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি দশ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে, ফলে ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধান শিক্ষককেই মাইক হাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচারে নামতে হয়েছে। ... ...
“১৯৮৪ সালে হ্যালির ধূমকেতু যখন এসেছিল, তখন বিড়লা মিউজিয়াম হ্যালির ধুমকেতু দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। তখন আমি সবে এই বিজ্ঞানের জগতে ঢুকেছি। সেই সময়ে আমার ওঁকে প্রথম দেখা। একজন মানুষ, যিনি দৌড়ে একবার ছাদে যাচ্ছেন একবার নিচে নামছেন। কোনও সমস্যা হয়েছে কিনা দেখে তার সমাধান করতেন। এর পর অল ইণ্ডিয়া অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমার্স মিট, সারা ভারত জুড়ে অপেশাদার আকাশপ্রেমীদের সংগঠন, তার যে মিট, সেটা আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজে করেছিলাম। সেই মিটটার জায়গা খোঁজার জন্য আমাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছেন কখনও নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম, কখনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। এরপর একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে সংগঠন করার পরে। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ওঁর সঙ্গে করি এবং শিখি যে বিজ্ঞান কিভাবে ডেমনস্ট্রেট করতে হয়। ... ...
আমাদের ইস্কুলের একশ পঁচিশ বছর এসে পড়েছে। বিভিন্ন প্রাক্তনী ব্যাচের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আমরা সাতাশির ব্যাচ ঠিক করলাম, কলকাতায় প্লেগ মহামারী আর বর্তমান করোনা মহামারীর তুলনা করে একটা আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার করব। ১৮৯৮ সালে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার সময়ে প্লেগের থাবায় আহত হয়েছিল শহরটা, তাই এই আলোচনার উদ্যোগ। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা মিলে সময় বের করে আমরা কাজ শুরু করলাম। মাতাজীরা বললেন, নিবেদিতার ডাকে সেযুগের যুবকেরা, মহিলারা প্লেগ নিবারণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই করোনা মহামারীতে নবীন প্রজন্ম কীভাবে অংশ নিয়েছে, সেটা তাঁরা শুনতে চান। ... ...
পরের দিনটা কাটল মালাগারজির মুখের বিস্তীর্ণ জলরাশি পেরিয়ে কাফেলার সবকিছু নদীর কয়েক মাইল উত্তরে আমাদের শিবিরে নিয়ে যাওয়ার কাজে। এই নদীটা এমন একটা নদী যেটা সভ্য মানুষেরা ট্যাঙ্গানিকা থেকে উপকূলের দূরত্ব কমানোর জন্য খুব সুবিধাজনক হিসেবে দেখবেন। এই নদী বেয়ে প্রায় একশ মাইল চলে যাওয়া যায়, আর এটা সমস্ত ঋতুতেই যথেষ্ট গভীর থাকে - ফলে উভিনজার কিয়ালা পর্যন্ত সহজেই চলে যাওয়া যায়। আর সেখান থেকে উন্যানয়েম্বে অবধি একটা সোজা রাস্তা সহজেই বানিয়ে ফেলা যায়। মিশনারিরাও ধর্মান্তরের জন্য এলে উভিনজা, উহহা ও উগালায় যাওয়ার জন্য এখান থেকে একই সুবিধা পেতে পারেন। ৩০ তারিখে আমাদের পথ ধরে, কাগঙ্গো, এমভিগা ও কিভোয়ের মনোরম অন্তরীপগুলিকে পেরিয়ে, প্রায় তিন ঘণ্টা নৌকা বাওয়ার পরে খরস্রোতা ঘোলা জলের ইউগুফুর মুখের গ্রামগুলো আমাদের চোখে পড়ল। এখানে আবার আমাদের কাফেলাকে কুমির-বোঝাই নদীর মোহনা পেরোতে হয়েছিল। ... ...
ভারতে একবিংশ শতকের গোড়ার দিকেও মেডিক্যাল শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষায় প্রধানত ব্রিটিশ/ইউরোপীয় মডেলকে অনুসরণ করা হত। ২০১৪ সালের পরে এটা প্রায় সম্পূর্ণত আমেরিকার মডেলের অনুসারী হয়ে ওঠে – ‘নতুন শিক্ষানীতি’ এবং ৪ বছরের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্স চালু করা যার ভালো উদাহরণ। ব্রিটিশ মডেলে ক্লিনিকাল শিক্ষার ওপরে জোর দেওয়া হত। হাউসস্টাফশিপ ছিল বাধ্যতামূলক যাতে একজন ডাক্তার স্পেশালিস্ট না হলেও যেকোন ধরনের রোগীর সাধারণ চিকিৎসায় দক্ষ একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনার হয়ে উঠতে পারত। এখনো ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, গ্রামেগঞ্জে এধরনের চিকিৎসকেরাই রোগীদের প্রধান ভরসা। আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথা রাখতে হবে। চিকিৎসক এবং চিকিৎসার এ ধারার মধ্য দিয়ে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের একটি দীর্ঘকালীন বনিয়াদ জন্মায়। রোগীরা পারিবারিক, ব্যক্তিগত এবং সামজিক সমস্যা সম্পর্কে মন খুলে কথা বলতে পারে। এখানে একজন রোগী চিকিৎসার বাজারের (কর্পোরেট জগতের থাবায় যা ক্রমাগত সমস্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করছে) অর্থনৈতিক ‘ভোক্তা’ নয় – একজন মানুষ, যে ঘটনাচক্রে রোগী হয়েছে। ... ...
মিলান কুন্দেরার মত তকতকে স্বচ্ছতার সাথে খুব কম ঔপন্যাসিককে পড়া যায় । তাঁর গদ্য জলের মত পাতলা, স্পষ্ট, সহজবোধ্য, সহজপাঠ্য। তাঁর তীক্ষ্ণ, কড়া, অব্যাহতিহীন সুশৃঙ্খল বুদ্ধিমত্তা পাঠককে একইসাথে উত্তেজিত এবং উত্যক্ত করে। কুন্দেরার ন্যারেটিভ ভয়েস মনোরমভাবে অন্তরঙ্গ, কখনও আবার স্বীকারোক্তিমূলক, হামেশাই আনন্দ ছলনা সম্মোহিনী প্রতারণা প্রবণ — প্রলোভিত করে। কুন্দেরা শহুরে, কুন্দেরা রুচিশীল, যুক্তিসঙ্গত। পরিশীলিত সতর্ক বিদ্রূপে তাঁর গুরু গাম্ভীর্য কম, সঙ্গে নাস্তিকবাদের হতাশার প্রান্তে ঘোরাফেরা করা চিন্তা — গল্পকার হিসেবে এ এক অমোঘ অবদান। ... ...